কুণ্ডুবাড়ি হত্যাকাণ্ড (দৌলতপুর, মানিকগঞ্জ)
কুণ্ডুবাড়ি হত্যাকাণ্ড (দৌলতপুর, মানিকগঞ্জ) সংঘটিত হয় ২৬শে আগস্ট। এতে একই পরিবারের ৩ জনকে হত্যা করা হয়।
দৌলতপুর থানার অদূরে বিষ্ণুপুর গ্রাম। জনসংখ্যার অধিকাংশই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। ২৫শে আগস্ট রাতে এ গ্রামের কুণ্ডুবাড়ির সকল সদস্য যখন গভীর ঘুমে মগ্ন, ঠিক তখন ধলেশ্বরী নদীর গজঘাটা নামক স্থানে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর ভর্তি একটি পানসি নৌকা ভেড়ে। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য কলিমুদ্দি (চেয়ারম্যান, খলসী ইউপি) ও মোসলেম উদ্দিনের সহযোগিতায় তারা কুণ্ডুবাড়ির অবস্থান নিশ্চিত করে এবং কিছুক্ষণের মধ্যে তারা সেখানে পানসি নৌকা ভেড়ায়। নৌকা থেকে নেমে পাকসেনারা বেশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে। মুহূর্তের মধ্যে কুণ্ডুবাড়িসহ সমস্ত গ্রামের মানুষের ঘুম ভেঙ্গে যায়। গুলির শব্দে তারা আর্তচিৎকার করে এলোপাতাড়ি ছুটাছুটি করতে থাকে। কুণ্ডুবাড়ির নারী ও শিশুরা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতে সক্ষম হলেও পুরুষ সদস্যরা পালাতে পারেননি। হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা বাড়ির প্রধান ফটক রাইফেলের বাট দিয়ে ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে পড়ে। স্থানীয় দোসররা ইঙ্গিত করা মাত্রই কুণ্ডুবাড়ির বিলাসবহুল সুরম্য ঘরটি পাকসেনা ও রাজাকার-রা ঘিরে ফেলে। পর্যায়ক্রমে তারা বাড়ির সদস্য নৃপেন কুণ্ডু, নরেন্দ্র কুণ্ডু, নিরেন্দ্র কুণ্ডু (মিন্টু) এবং নরেশ কুণ্ডুকে ধরে বেঁধে ফেলে। এদিকে রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা জনমানবশূন্য কুণ্ডুবাড়ির প্রতিটি ঘরে তল্লাশি চালায় এবং আলমারি-সিন্ধুক ভেঙ্গে স্বর্ণ- রৌপ্য ও নগদ টাকাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নেয়। এভাবে তারা সারারাত লুটপাটের তাণ্ডবলীলা চালায়। এরপর রাজাকাররা পেট্টোল ঢেলে শাল-সেগুন কাঠের সুরম্য ঘরটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। দাউ-দাউ করে আগুন আকাশচুম্বী হয়ে উঠতে থাকে। কুণ্ডুবাড়িতে শস্য রাখার একটি বিশাল আকৃতির গুদাম ঘর ছিল। সেখানে এক হাজার মণের মতো খেসারি, মাশকলাই, সরিষা ও ধান গুদামজাত করা ছিল। রাজাকাররা গুদাম ঘরটিতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এরপর কুণ্ডুবাড়ির চারজনকে হাতকড়া পড়িয়ে পানসি নৌকায় ওঠানো হয় এবং রাতে তাদের দৌলতপুর ক্যাম্পে হাজির করা হয়। সেখানে তাদের নির্যাতন ও ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরের দিন ২৬শে আগস্ট সন্ধ্যার পর তাদের বেউথা ঘাটে (মানিকগঞ্জ) লঞ্চে ওঠানো হয় এবং লঞ্চটি হরিরামপুর থানার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। এক পর্যায়ে কুণ্ডুবাড়ির ৪ জন সদস্যকে এক-এক করে হাতকড়া খুলে পাকসেনারা সারিবদ্ধভাবে বেঁধে ফেলে। তাদের মধ্যে নরেশ কুঞ্জু অন্ধকারাচ্ছন্ন লঞ্চে বাঁধন খুলে কালিগঙ্গা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুহূর্তের মধ্যে গর্জে ওঠে পাকহানাদারদের হাতিয়ার। উপর্যুপরি ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয় অপর ৩ সদস্যকে। লঞ্চ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া নরেশ কুণ্ডু মৃতের মতো ভাসতে ভাসতে অজানা এক গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে সুস্থ হয়ে ভারতে পাড়ি জমান। স্বাধীনতার পর তিনি নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। [মো. আমিনুর রহমান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড