You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে কিশোরগঞ্জ উপজেলা (নীলফামারী)

কিশোরগঞ্জ উপজেলা (নীলফামারী) ১৯৭১ সালে থানা ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর কিশোরগঞ্জে স্বাধীনতার পক্ষে প্রবল জনমত তৈরি হয়। ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষিত হওয়ার পর কিশোরগঞ্জে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। কিশোরগঞ্জ থানার অবাঙালি ওসি-র বাঙালিবিরোধী ভূমিকার কারণে তার প্রতি স্থানীয় মানুষের ক্ষোভ ছিল। স্থানীয় জনতা তাকে থানা থেকে ২৬শে মার্চ পাকিস্তানের পতাকা নামাতে বাধ্য করে। ছাত্রনেতা এসরারুল হক, মাজির উদ্দিন প্রমুখ থানায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। উৎসুক জনতা থানার পার্শ্বস্থ বটগাছেও একটি পতাকা উত্তোলন করে।
১৫ই এপ্রিল কিশোরগঞ্জে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব দেন আজহারুল ইসলাম এমপিএ, আজিজার রহমান, শফি মিয়া, কোরবান আলী, এমদাদুল হক, মোজাম্মেল হক, সাজির উদ্দিন, মকবুল মাস্টার, আজগর আলী, এমদাদুল হক, শরিফুল ইসলাম প্রমুখ। ছাত্রলীগ নেতা সাজির উদ্দিনের নেতৃত্বে মার্চের শেষদিকে কিশোরগঞ্জে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় ৷ যুদ্ধ শুরুর পর সাজির উদ্দিন কিশোরগঞ্জ বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) বা মুজিব বাহিনী-র প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
কিশোরগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা প্রাথমিকভাবে দেশের ভেতরে এবং পরে ভারতের হলদিবাড়ী, হেমকুমারী ও দেওয়ানগঞ্জের যুব অভ্যর্থনা এবং যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
১৩ই এপ্রিল পাকবাহিনী কিশোরগঞ্জে অনুপ্রবেশ করে। কিশোরগঞ্জ উপজেলায় তাদের সবচেয়ে বড় ক্যাম্প ছিল ডাকবাংলোয়। এছাড়া পুটিমারী ইউনিয়নের সাদুরার পুল ক্যাম্প, বড়ভিটাহাট বন্দর ক্যাম্প, রণচণ্ডি ইউনিয়নের জুম্মারপাড়া ক্যাম্প, মাগুড়া ইউনিয়নের চেকপোস্ট ক্যাম্প, চন্দনের হাট ক্যাম্প, বগড়াডাঙ্গার ক্যাম্প, নিতাই ইউনিয়নের ফুলবাড়ি ডাঙ্গার ক্যাম্প থেকেও পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা মানুষের ওপর অত্যাচার ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করত।
মে মাসের শেষের দিকে কিশোরগঞ্জ থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটির নেতৃত্ব দেয় মওলানা মো. মুসা ও জহির উদ্দিন। শান্তি কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে রুস্তম আলী, ডা. এম এ কুদ্দুস, সায়েদুর রহমান, ইউসুফ আলী, আ. মজিদ, জোবেদ আলী, আমির আলী, গ্যান্দা মামুদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তয়েজ কমান্ডারের নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জে -রাজাকার- বাহিনী গঠন করা হয়। অন্য যেসব রাজাকার হত্যা ও নির্যাতনের মাধ্যমে ত্রাসের সৃষ্টি করে, তারা হলো- কাহলী, বুলু, ওসমান, হাজী কছুদ্দি, আবেদ হাজী, জহুর মুন্সি, কাশেম প্রমুখ।
উপজেলার বিভিন্ন ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে রাজাকারদের চক্র গড়ে ওঠে। ডাকবাংলো ক্যাম্পের রাজাকারদের মধ্যে সাহাবুদ্দিন (চাঁদ ইউনুস), আব্দুল্লাহ (চাঁদ ইউনুস), নুরুল (কিসবা), মোহাম্মদ আলী (রাজীব), আজগর আলী (রাজীব), সাকমল হোসেন (রাজীব), লোকমান (রাজীব), শফিকুল ইসলাম (রাজীব), আবু সায়েদ (রাজীব) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
বড়ভিটা বন্দর ক্যাম্পের উল্লেখযোগ্য রাজাকারদের মধ্যে আজিজার রহমান (বড়ভটিা), আনিসুল ইসলাম (বড়ভিটা), আব্দুল আজিজ, বোগরা মামুদ, নুরুল হক, কিতাব উদ্দিন প্রমুখ। এরা নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাত এবং অসহায় নারীদের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দিত। এদের নির্যাতনের শিকার হয়ে এলাকার অনেকে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে।
রনচণ্ডি ইউনিয়নের জুমারপাড়া ক্যাম্পে রাজাকারদের নেতৃত্বে ছিল আফসার আলী, আব্দুল হাই প্রমুখ। এরা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে নির্যাতন করত। আওয়ামী লীগ-এর নেতা-কর্মী ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এদের অত্যাচারের মূল লক্ষ্য ছিল।
মাগুড়া ইউনিয়নের কুখ্যাত রাজাকার ছিল মতলুবার রহমান। ভারত থেকে যাতে অস্ত্র বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে না পৌঁছে, তার নেতৃত্বে রাজাকাররা চেকপোস্ট বসিয়ে সেদিকে নজর রাখত। এ ইউনিয়নের রাজাকাররা ভারতগামী শরণার্থীদের সর্বস্ব লুট করত। এ উপজেলায় পাকবাহিনীর উল্লেখযোগ্য সহযোগীদের মধ্যে ছিল মো. এ টি এম আনিছুর রহমান চেয়ারম্যান ও তছলিম উদ্দিন। এদের নেতৃত্বে রাজাকাররা বিভিন্ন হিন্দুপাড়ায় লুণ্ঠন করত।
কিশোরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা অনেক নির্যাতন, লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। পুটিমারি ইউনিয়নের সাদুরার পুল ক্যাম্প থেকে রাজাকাররা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর শারীরিক নির্যাতন ও বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করত।
তারা হিন্দুপাড়ায় লুণ্ঠন করত। তারা ডালিম কুমার সরকার নামে এক শিক্ষকের বাড়িতে লুণ্ঠন চালায়। তারা গাড়াগ্রামের ধরেন্দ্রনাথ সরকার ও সুরেন্দ্র নাথ সিং-এর বাড়ি লুণ্ঠন করে। রাজাকারদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কামারপাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ দেশত্যাগ করে। নিতাই ইউনিয়নের ফটিক চন্দ্র মহন্ত, ষষ্টিচরণ মহন্ত, ফরুয়াপাড়ায় দীনেশবাবু রাজাকারদের হাতে নির্যাতিত হন।
ব্রাহ্মণপাড়ায় রাজাকাররা অনেক নারীর ওপর নির্যাতন চালায়। টেপারহাট এলাকায় তারা ৪ জন মহিলাকে নির্যাতন করে। বসুনিয়াপাড়ায় পাকবাহিনী ৬-৭ জন নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। উত্তর বাহাগিলীর জনৈক ব্যক্তির স্ত্রী, দক্ষিণ বাহাগিলীর মালতি রানী রাজাকারদের দ্বারা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। এ নির্যাতনের কারণে পরে মালতি রানীর মৃত্যু হয়। পুটিমারি ইউনিয়নের হিন্দুপাড়া, কালিকাপুর, নিতাই ইউনিয়নের ফুলবাড়ি, পানিয়ালপুকুর, বেলতলী বাজার, রণচণ্ডি ইউনিয়নের জুম্মারপাড়া, টেপারহাটের অবিলের বাজার, বড়ভিটা ইউনিয়নের বড়ভিটা বাজার এবং বাহাগিলী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের হিন্দুপাড়ায় অসংখ্য নারী নির্যাতনের শিকার হন।
রাজাকার এয়েজ উদ্দিন নিতাই ইউনিয়নে সকল লুণ্ঠন ও অত্যাচারে নেতৃত্ব দিত। সাধারণ মানুষের বাড়ি থেকে গরু- ছাগল, হাঁস-মুরগি এবং থালা-বাসন নিয়ে যেত। এ ইউনিয়য়ের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রবীন্দ্রনাথ কুণ্ডুকে কিশোরগঞ্জ হাইস্কুল ক্যাম্পে হত্যা করা হয়। নিতাই সেনপাড়ায় করুণা সেন দত্ত, অমিয়কান্ত সেন ও দুখিয়া ব্রাহ্মণের বাড়ি লুণ্ঠন করা হয়। এতে নেতৃত্ব দেয় কাহলী, বুলু, ওসমান, উদফুরসহ অন্য রাজাকাররা। রনচণ্ডি ইউনিয়নের কুঠিপাড়ায় ডা. গজেন্দ্রনাথ রায়ের বাড়ি লুণ্ঠন করে রাজাকাররা। এ লুণ্ঠনে নেতৃত্ব দেয় হাজী কছুদ্দি। ফটিকচন্দ্রের বাড়ি থেকে ৫০০-৬০০ মন ধান লুট করা হয়।
২৪শে জুন ক্যাপ্টেন জাবেদের নেতৃত্বে হানাদার পাকবাহিনী দক্ষিণ বাহাগিলীতে আক্রমণ চালায়। দক্ষিণ বাহাগিলী গণহত্যা নামে পরিচিত এ হত্যাকাণ্ডে ১০ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। রাজাকাররা বড়ভিটা ইউনিয়নের বাবুরডাঙ্গায় লুণ্ঠন চালায়। কিশোরগঞ্জের বানিয়াপাড়ায় রাজাকাররা অনেক মানুষকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে। পুটিমারি ইউনিয়নের পূর্বপাড়ায় পাকবাহিনী রাজাকারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ-যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১০ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ক্যাপ্টেন ইকবালের নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জে প্রবেশ করে। ১২ই ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন ছাতোয়ানের নেতৃত্বে ভারতীয় বাহিনী কিশোরগঞ্জে আসে। ১৪ই ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। যৌথবাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী কিশোরগঞ্জ ছাড়তে বাধ্য হয়। এ-যুদ্ধে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ১৫ই ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ হানাদারমুক্ত হয়।
কিশোরগঞ্জ উপজেলার যেসব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা যায়, তাঁরা হলেন— শাহাব উদ্দিন (পিতা জহির উদ্দিন, সীট রাজীব; কিশোরগঞ্জ হাইস্কুলের ১০ম শ্রেণির ছাত্র), আব্দুল বারেক (পিতা আব্দুল গফুর উদ্দিন, মাগুড়া ইউনিয়ন), মো. আজাদ মিস্ত্রী (পিতা আয়েন উদ্দিন, মাগুড়া চাঁদখানা), রবীন্দ্রনাথ কুণ্ডু (গাড়াগ্রাম), মোস্তাফিজুর রহমান, খোকা বাবু (পুটিমারি ইউনিয়ন), রমেশ টাঙ্গার পুত্র (চাঁদখানা ইউনিয়ন), আব্দুর রশীদ (পিতা মো. তফেল উদ্দীন, মাগুড়া ইউনিয়ন), আতাউর রহমান (পিতা আশরাফ আলী, ব্রমোত্তর ইউনিয়ন), মজনু (কৈমারী বাজার) ও আব্দুল মজিদ।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে কিশোরগঞ্জ স্টেডিয়ামের কাছে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। উপজেলা সদর দপ্তরের সামনের সড়কের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ আজাদ আলী সড়ক। [এস এম সারওয়ার মোর্শেদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!