You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা

কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা উজান-ভাটির বৈচিত্র্যে প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত একটি জনপদ। এ উপজেলার একদিকে হাওর বেষ্টিত বিস্তীর্ণ ভাটি অঞ্চল, অন্যদিকে প্রকৃতির লীলাময় উজান এলাকা। এখানকার মানুষ যেমন অতিথিপরায়ণ ও বন্ধুবৎসল, তেমনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ও তেজস্বী। মোগল শাসনের বিরুদ্ধে ঈশা খাঁ-র বিদ্রোহ, ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম এবং পাকিস্তানি শাসন- শোষণের প্রতিবাদে তীব্র আন্দোলন সব ক্ষেত্রে কিশোরগঞ্জের মানুষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৫২- এর ভাষা-আন্দোলন-এর পর থেকেই কিশোরগঞ্জে পাকিস্তানবিরোধী জনমত তৈরি হতে শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় ৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-র ছয় দফা আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এ এখানকার জনসাধারণ অংশ নেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ৬-দফা দাবিকে কেন্দ্র করে কিশোরগঞ্জে গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নেতা, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্মভূমি হওয়ায় কিশোরগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্বের কার্যক্রম খুবই সুসংগঠিত ও তীব্র ছিল।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্যতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সর্বস্তরের মানুষ বিশেষ করে তরুণরা কিশোরগঞ্জে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। উদ্যমী তরুণদের সমন্বয়ে কিশোরগঞ্জ স্টেডিয়ামে সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। একজন বাঙালি আনসার কমান্ডার এ প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন। অন্যদিকে কিশোরগঞ্জ শহরের আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে তরুণদের আরেকটি দলকে মুক্তিযুদ্ধের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বাঙালি সৈনিক যশোদল গ্রামের আব্দুর রশীদ এ প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন।
২৫শে মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা সংঘটিত করার মাধ্যমে বাঙালি জাতির ওপর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। যে-কোনো দিন কিশোরগঞ্জেও হানাদার বাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে, এ আশঙ্কায় বেশকিছু সাহসী তরুণ স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত অস্ত্র নিয়ে শত্রুপক্ষকে প্রতিরোধের জন্য শহরের চতুর্দিকে টহল জোরদার করে। শহরের শহীদী মসজিদ সংলগ্ন ইসলামীয়া ছাত্রাবাস মুক্তিকামী ছাত্র-যুবকদের পরামর্শ কেন্দ্রে পরিণত হয়। এখানে বসে তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আক্রমণ ও প্রতিরোধের ছক তৈরি করে।
২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম গণহত্যার পর বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনা কর্মকর্তা মেজর কে এম সফিউল্লাহ তাঁর বাহিনী নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি জয়দেবপুর এলাকায় বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে অধীনস্থ সৈনিকদের নিয়ে ময়মনসিংহ হয়ে ১লা এপ্রিল কিশোরগঞ্জে পৌঁছান। শহরের আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে বিদ্রোহী সেনাদের ঘাঁটি স্থাপিত হয়। বাঙালি সেনাদের আগমনে কিশোরগঞ্জের জনমনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রবল সাহস ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে ছাত্র- জনতা এপ্রিল মাসের শুরুতে কিশোরগঞ্জ-যশোদল রেলপথের মধ্যবর্তী স্থানে রেলের স্লিপার উপড়ে ফেলে। এপ্রিলের ১২ তারিখ খবর আসে যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পাকুন্দিয়ার মঠখোলা হয়ে কিশোরগঞ্জের দিকে এগিয়ে আসছে। এ খবর শোনার পর তরুণরা পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য হাল্কা অস্ত্র ও পেট্রোল বোমাসহ মঠখোলার দিকে অবস্থান গ্রহণ করে। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পর খবর আসে যে, হানাদার বাহিনী আসছে না। পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার ব্যাপারে এলাকাবাসীর মধ্যে বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।
এপ্রিল মাসের মধ্যবর্তী সময়ে হানাদার বাহিনী শহরের দিকে এগিয়ে আসছে জেনে আজিমউদ্দিন হাইস্কুল মাঠে প্রশিক্ষণরত কয়েকজন তরুণ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। কিশোরগঞ্জ থানার সামনে রক্ষিত চারটি খালি জিপ হানাদার বাহিনী যাতে ব্যবহার করতে না পারে, সেজন্য বিক্ষুব্ধ তরুণরা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে জিপগুলো বিকল করে দেয়। এসব তরুণের কয়েকজন হচ্ছেন ছাত্রনেতা এম এ আফজল, কবির উদ্দিন ভূঞা, নিজাম উদ্দিন, মতিউর রহমান, এ বি সিদ্দিক, কামরুজ্জামান কমরু, মিহির বসাক, সাব্বির আহমদ মানিক, রেজাউল করিম খসরু, গোলাম রব্বানী বুলবুল এবং আনোয়ার কামাল।
ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পৈতৃক বাড়ি কিশোরগঞ্জে এসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে ছক তৈরি করেন। ১৪ই এপ্রিল বিকেলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৬ জন কমান্ডোসহ ক্যাপ্টেন হায়দার কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ মহাসড়কের তারেরঘাট ব্রিজে যান। একটি শক্তিশালী ডিনামাইটের আঘাতে তিনি প্রথমে ব্রিজটি ধ্বংস করেন। এরপর কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ রেলপথের মুশুলী রেলব্রিজটিও একই কায়দায় ধ্বংস করা হয়। কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলায় পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষের এটি ছিল প্রতিরোধের প্রথম পর্যায়। ১৯শে এপ্রিল পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর সারোয়ার খান ও ক্যাপ্টেন বোখারির নেতৃত্বে দেড় শতাধিক পাকিস্তানি সেনা ও পাঞ্জাবি মিলিশিয়া ট্রেনযোগে কিশোরগঞ্জের দিকে এগিয়ে আসে। যশোদল স্টেশনের কাছাকাছি স্থানে পূর্ব থেকেই ছাত্র-জনতা রেললাইন বিচ্ছিন্ন করে রাখায় ট্রেনটি যশোদল স্টেশন পার হতে পারেনি। পাকসেনারা যশোদল স্টেশনে নেমে হেঁটে কিশোরগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে। তারা জেলা বোর্ডের ডাকবাংলোয় ক্যাম্প স্থাপন করে পুরো এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তারা কাচারিবাজারের সম্মুখস্থ ডাকবাংলোয় উপ-সামরিক আইন প্রশাসকের কার্যালয় স্থাপন করে। পাকিস্তানি বাহিনী জুলাই মাসের দিকে মেজর সারোয়ার খানকে প্রত্যাহার করে মেজর ইফতেখারকে এ মহকুমার দায়িত্ব প্রদান করে। দায়িত্ব পেয়ে মেজর ইফতেখার নৃশংসতা ও জঘন্য নারী-লিপ্সার অনেক নজির তৈরি করে। কিশোরগঞ্জ আনসার অফিসকে তখন রাজাকার বাহিনীর সদর দপ্তরে রূপান্তরিত করা হয়। শহীদী মসজিদ সংলগ্ন ইসলামীয়া ছাত্রাবাসকে আলশামস ও মুজাহিদ বাহিনীর ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সশস্ত্র যুদ্ধের অনিবার্যতা স্পষ্ট হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে কিশোরগঞ্জে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন- এবং মাহবুবুল হক দোলন সমর্থিত ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফ্রন্টের স্থানীয় ছাত্রনেতাদের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছাত্র-জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন ব্যাপক জনমত গঠন করে। কিশোরগঞ্জে পূর্ব বাংলার স্বাধিকার ও স্বাধীনতার প্রশ্নে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, তাঁরা হলেন- আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ উদ্দিন মাস্টার, এডভোকেট আব্দুস সাত্তার, মহিউদ্দিন আহমেদ, খন্দকার আব্দুল ওয়াদুদ, আব্দুল কুদ্দুছ মোক্তার, মোস্তাফিজুর রহমান খান (চুন্নু মোক্তার), এ কে এম শামসুল হক গোলাপ মিয়া, সিরাজ উদ্দিন মোক্তার, আবু হানিফ, বোরহান উদ্দিন মোক্তার, সাবির উদ্দিন আহমেদ, মাহমুদ হাসান, মো. আব্দুল করিম, মতিয়ার রহমান খান, ন্যাপ নেতা কাজী আব্দুল বারী, জমিয়ত আলী, গঙ্গেশ সরকার, আব্দুল মান্নান, কমিউনিস্ট নেতা নিবারণ চক্রবর্তী, আব্দুল রাজ্জাক ভূঞা প্রমুখ। এছাড়া স্থানীয় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরাও সে-সময় গণআন্দোলনে সমর্থন প্রদান করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন- অধ্যাপক নরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ, অধ্যাপক জিয়াউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক রফিকুর রহমান চৌধুরী, অধ্যাপক আতিকুল্লাহ চৌধুরী, প্রধান শিক্ষক মতিয়ুর রহমান, সার্জেন্ট আব্দুল জলিল, ডা. এ এ মাজহারুল হক, ডা. জে বি রায়, বিরাজমোহন রায়, নীলোৎপল কর, এম এ আজিজ প্রমুখ।

৬৯-এর গণআন্দোলনে স্থানীয় ছাত্র সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সে-সময় যে-সকল ছাত্রনেতা আন্দোলন সংগঠনে ভূমিকা রাখেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- মো. আবদুল হামিদ (বর্তমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি), মো. ফজলুর রহমান, মো. ফজলুল হক, মো. জিল্লুর রহমান, গোলাম রব্বানী বুলবুল, মো. মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাফিজ, লিয়াকত হোসাইন মানিক, শাহাবুদ্দিন ঠাকুর, মো. ইদ্রিস আলী, শাহাদৎ হোসেন, শওকত আহমদ আল- ফারুকী সানা, নাসির উদ্দীন ফারুকী, হেলাল উদ্দিন মানিক, হেলাল উদ্দিন ভূঞা, সাধন সাহা, মাহমুদ হোসেন, শাহ মনসুরুল হক, এম এ আফজল, জোনাব আলী, আলমগীর হোসেন, নিয়ামত উল্লাহ, আব্দুল্লাহ মাহমুদ, মতিউর রহমান, কবির উদ্দিন ভূঞা, আগা হিলালী, গৌরাঙ্গ সরকার, নূরুল ইসলাম নূরু, আলমগীর হোসেন, ইকবাল হোসেন, সবিতা রায়, সাব্বির আহমদ মানিক, দিলারা বেগম আসমা, লতিফুর রহমান খান মরু, আ ন ম তৌফিক পানু, জাহাঙ্গীর ভূঞা, মানিক লাল চৌধুরী, মশিউর রহমান, মোজাম্মেল হক খান রতন, গোলাম হায়দার চৌধুরী, বিকাশ মজুমদার, এম এ শুকুর, জীবন ঘোষ, ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন, জাহাঙ্গীর হোসেন, আব্দুল হান্নান মোল্লা, নাজিম উদ্দিন কবির, সিরাজুল ইসলাম, বীর বিক্রম (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), মো. আমিরুজ্জামান, শেখ নূরুন্নবী বাদল, আমিরুল ইসলাম, বিমলাংশু রায় বাবলু, মহিউদ্দিন ধন মিয়া, আকবর হোসেন খান, মিজানুর রহমান, এনএসএফ (দোলন গ্রুপ) নেতা মো. আকরাম হোসেন, মাহবুবুল হক, আরজু মিয়া প্রমুখ। কিশোরগঞ্জের অনেকে যুদ্ধে অংশ নিতে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের ত্রিপুরায় যান। তাঁদের কয়েকজন হচ্ছেন— আতিকুর রহমান আতিক, নূরুল ইসলাম খান পাঠান, বীপ্রতীক, এ কে এম রফিকুল হক, বীর প্রতীক, কামরুজ্জামান কমরু, বাশির উদ্দীন ফারুকী, এ কে এম মুর্শেদুল হক, খলিলুর রহমান, খায়রুল বাশার খান পাঠান (সিরু পাঠান), ফজলুর রহমান বাচ্চু, মো. জসিম উদ্দিন, প্রদীপ সরকার ভজন, মো. পরশ আলী, শামসুল আলম বকুল, বিমল রঞ্জন সরকার, আব্দুর রশীদ, মো. বাবুল, আনিসুল হক সঞ্জু, রেজাউল করিম, আজিজুল হক প্রমুখ।
কট্টর বামপন্থী ছাত্র-রাজনীতিক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন কিশোরগঞ্জের আব্দুল হান্নান মোল্লা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি স্থানীয়ভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করে সমমনা তরুণদের সমন্বয়ে ‘মোল্লা বাহিনী’ গড়ে তোলেন। এ বাহিনী কিশোরগঞ্জ শহরতলীর মারিয়া, বিন্নাটি, কালটিয়া, চৌদ্দশত, পুলেরঘাট, হোসেনপুরের পুমদি, নান্দাইলের বাকচান্দা প্রভৃতি এলাকা অনেকদিন হানাদারমুক্ত রাখতে সক্ষম হন। ১২ই অক্টোবর কিশোরগঞ্জ-পাকুন্দিয়া সড়ক পথের কালটিয়া বাজারের কাছে গুলি করে পাকিস্তানি মিলিশিয়াবাহী ট্রাক বিধ্বস্ত করা, ৮ই ডিসেম্বর শহরতলীর মেলাবাজার-বগাদিয়া এলাকায় রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া, ১৪ই ডিসেম্বর কামালিয়ারচর এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ, হোসেনপুর থানাধীন চরপুমদি বাজারে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ ইত্যাদি এ বাহিনীর উল্লেখযোগ্য অপারেশন। মোল্লা বাহিনী পরে মুক্তিবাহিনী হিসেবে অনুমোদন লাভ করে। মুসলিম লীগ, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি), জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী- এসব দল ১৯৭১ সালে কিশোরগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল। এ সকল দল এবং দলের নেতারাই পাকিস্তানের তথাকথিত অখণ্ডতা রক্ষার নামে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। হানাদার বাহিনীর নির্দেশে মওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দিনকে সভাপতি ও আব্দুল আউয়াল খানকে সাধারণ সম্পাদক করে মহকুমা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। কিশোরগঞ্জ শহরের পুরান থানাস্থ পাবলিক লাইব্রেরির দোতলায় শান্তি কমিটির একটি তথাকথিত বিচারালয় স্থাপিত হয়েছিল। পাকিস্তান-বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক ব্যক্তিদের এ বিচারালয়ে হাজির করা হতো। বিচারকের আসনে বসত সৈয়দ মুসলেহ উদ্দিন। স্বঘোষিত পাবলিক প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পালন করত মো. রুস্তম আলী।
মে মাস থেকে কিশোরগঞ্জে পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। মহকুমা শান্তি কমিটির সভাপতি ও জেলা পিডিপি প্রধান মওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দিনের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এ বাহিনীতে তার দুই ছেলে সৈয়দ মুহম্মদ হাসান ও সৈয়দ মুহম্মদ হুসেইন কমান্ডার হিসেবে অনেক অপকর্ম সংঘটিত করে। হাসান তাড়াইল থানার এবং হুসেইন নিকলী থানার স্বঘোষিত ওসি হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হয়। এ দুই সহোদরের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে সুনির্দিষ্ট মামলা হয়েছে। এছাড়া রাজাকার বাহিনীর কুখ্যাত সদস্য হিসেবে যাদের নাম এখনও জনমনে আতঙ্ক তৈরি করে, তারা হলো- আশরাফ উদ্দিন খান মিল্কী, আবু লায়েছ, আলমগীর শাহজাহান রেজা, আব্দুস ছোবান, আঙ্গুর আমিন, আব্দুল কাদির, করম আলী, আব্দুর রশিদ রেনু, আবুল হাসিম, শমসের আলী, মঞ্জিল মিয়া, আব্দুল খালেক প্রমুখ।
গুরুদয়াল কলেজের শিক্ষক জামায়াতের স্থানীয় নেতা অধ্যাপক মাহতাব উদ্দিনের নেতৃত্বে জামায়াত কর্মীদের সমন্বয়ে আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশনের মাস্টারের পরিত্যক্ত বাসভবনে আলবদর বাহিনীর কার্যালয় ও টর্চার সেল ছিল। অষ্টগ্রাম উপজেলার কে এম আমিনুল হক (রজব আলী) ও কিশোরগঞ্জ শহরতলীর শোলাকিয়া ব্যাপারী বাড়ির আরফান দুর্ধর্ষ আলবদর কমান্ডার হিসেবে পরিচিত ছিল।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলামী পার্টির প্রধান মওলানা আতাহার আলীর নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জ মহকুমায় হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী ফোর্স হিসেবে আলশামস বাহিনী গঠিত হয়। মূলত মুসলিম লীগপন্থী ছাত্র সংগঠন এনএসএফ-এর সদস্যদের সমন্বয়ে আলশামস বাহিনী গঠন করা হয়। গুরুদয়াল কলেজের ছাত্র শাহজাহান চেঙ্গিস ও গাইটাল গ্রামের আবুল কাসেম ছিল এ বাহিনীর সক্রিয় সদস্য। এর বাইরে কিশোরগঞ্জ শহরে মওলানা আতাহার আলীর নেতৃত্বে মুজাহিদ বাহিনী নামে আর একটি অতিরিক্ত সশস্ত্র বাহিনী ছিল। এ বাহিনীর মহিউদ্দিন আজমী, মফিজ উদ্দিন, আব্দুর রহমান, তারা মিয়া, মওলানা আব্দুল হান্নান ও মৌলবি আখতার শাহ সবচেয়ে কুখ্যাত ছিল। এখানে যারা হানাদার বাহিনীকে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও নারী ধর্ষণে সরাসরি সহযোগিতা করে, আজও তাদের নাম ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। এ-রকম চিহ্নিত কয়েকজন দালাল-রাজাকারের মধ্যে মৌলবী লোকমান হাকিম, আব্দুর রহমান, মফিজ উদ্দিন, আবু লায়েছ, তারা মিয়া, বাদশা মিয়া, মওলানা মহিউদ্দিন আজমী, ইসহাক বিহারী, সোলেমান বিহারী, এমদাদুল হক মতি মিয়া, কদম রসুল বিহারী, মাহতাব উদ্দিন, সৈয়দ মুহম্মদ হাসান, সৈয়দ মুহম্মদ হুসেইন, কে এম আমিনুল হক (রজব আলী), শাজাহান চেঙ্গিস, মৌলবী আখতার শাহ্ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। ১৯শে এপ্রিল কিশোরগঞ্জে প্রবেশ করে হানাদার বাহিনী প্রথম দিন ৯ জন নিরীহ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ ঘটনা কিশোরগঞ্জ শহর গণহত্যা- নামে পরিচিত। নিহতদের মধ্যে রিক্সাচালক, দোকানদার, শিক্ষক, গৃহবধূ প্রভৃতি পেশার মানুষ ছিল। পাকবাহিনী নির্বিচারে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে সমগ্র শহরে নৈরাজ্য ও ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করে। শহরের পাকিস্তানপন্থী প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং স্থানীয় অবাঙালি বিহারিরা সরাসরি হানাদার বাহিনীর সহযোগিতায় এগিয়ে যায়। তাদের মধ্যে এমদাদুল হক মতি মিয়া, মফিজুল হক মানিক কাজী, কদম রসুল বিহারী, সোলেমান বিহারী, ইছহাক বিহারী, মজিদ বিহারী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। রাজাকার ও স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী কিশোরগঞ্জ জেলা সদরের বিভিন্ন গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালায়। শহরতলীর রশিদাবাদ, সগড়া, কাটাবাড়িয়া দিঘিরপাড়, ভাস্করখিলা, কানকাটি, নীলগঞ্জ গ্রাম এবং শহরের বত্রিশ, বিন্নগাঁও, খড়মপট্টি, হয়বতনগর, নগুয়া, মেলাবাজার ইত্যাদি মহল্লার অনেক নিরীহ মানুষকে তারা নৃশংসভাবে হত্যা করে। শুধু হত্যাকাণ্ড নয়, শহরে ও গ্রামে বেছে বেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলম্বনকারীদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও নারীনির্যাতনে হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা লিপ্ত হয়।
কিশোরগঞ্জ শহরতলীর রশিদাবাদ ইউনিয়নের সগড়া গ্রামের নবীন চন্দ্র সাহা রায় (পিতা নন্দ কুমার সাহা রায়) একজন বিশিষ্ট মোক্তার ছিলেন। ১৯শে এপ্রিল পাকবাহিনী কিশোরগঞ্জে অনুপ্রবেশের পর নবীন চন্দ্র রায় বিপদের আশঙ্কায় গ্রামের বাড়ি ছেড়ে পার্শ্ববর্তী বেরুয়াইল গ্রামের মোল্লাবাড়িতে আশ্রয় নেন। তার দ্বিতীয় ছেলে সুধাংশু সাহাও পিতার সঙ্গে মোল্লাবাড়িতে চলে যান। এদিকে সগড়া গ্রামের বাড়িতে থেকে যান নবীন রায়ের বড় ছেলে প্রফুল্ল সাহা ও শহর থেকে পালিয়ে আসা মেয়ের জামাই গোপাল চন্দ্ৰ সাহা। ২৩শে মে শেষরাতে একদল পাকসেনা অতর্কিতে নবীন রায়ের সগড়ার বাড়িতে চড়াও হয়। বাড়ি থেকে প্রফুল্ল সাহা ও গোপাল চন্দ্র সাহাকে আটক করে ঘাতক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঐ রাতেই বেরুয়াইল মোল্লাবাড়িতে যায়। সেখান থেকে মোক্তার নবীন রায় এবং তার দ্বিতীয় ছেলে সুধাংশু সাহাকেও ঘাতকেরা ধরে নিয়ে আসে। পরদিন শহরের সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি ঘাটে তাদের সকলকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
কিশোরগঞ্জ সদর থানাধীন রশিদাবাদ ইউনিয়নের সগড়া গ্রামের নীরদ রঞ্জন পণ্ডিত (পিতা হরিচরণ পণ্ডিত; মুক্তিযুদ্ধে ‘বীরনারী’ খেতাবপ্রাপ্ত ঊষা রাণী দেবীর স্বামী) ১৯৬৭ সালে গুরুদয়াল কলেজ থেকে বিএসসি পাস করার পর বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৯৭১ সালে তিনি কিশোরগঞ্জ শহরের আরজত আতরজান উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ২৩শে মে শেষরাতে পিতা হরিচরণ পণ্ডিত ও আরও কয়েকজন নিকটাত্মীয়সহ নীরদ রঞ্জন পণ্ডিত সগড়ার বাড়ি থেকে হানাদার পাকবাহিনীর হাতে আটক হন। সারাদিন মানসিক নিপীড়নের পর ঘাতক বাহিনী ২৪শে মে তাদের সকলকে শহরের সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি ঘাটে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
কিশোরগঞ্জ সদর থানাধীন মারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন ছফিরউদ্দিন আহম্মদ (পিতা আমুদ আলী ভূঞা, খিলপাড়া)। তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগেরও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭১ সালে ছফিরউদ্দিন আহম্মদ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। তার বিরুদ্ধে স্থানীয় দুই রাজাকার সহোদর ফটিক মিয়া ও মাতু মিয়া দখলদার পাকহানাদার বাহিনীর কাছে অনেক তথ্য সরবরাহ করে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে ২রা মে পাকসেনারা উল্লিখিত রাজাকারদ্বয়ের মাধ্যমে ছফিরউদ্দিন আহম্মদকে কিশোরগঞ্জ থানায় ডেকে পাঠায়। থানায় আসার পর দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা তাকে রেলস্টেশন সংলগ্ন পাকসেনা ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন বোখারির সঙ্গে দেখা করতে বলে। তিনি রাজাকার মাতু মিয়ার সঙ্গে সরল বিশ্বাসে সেনা ক্যাম্পে যান। এরপর সেনা ক্যাম্প থেকে ইউপি চেয়ারম্যান ছফিরউদ্দিন আহম্মদ আর ফিরে আসেননি। ক্যাপ্টেন বোখারির নির্দেশে পাকিস্তানি ঘাতকরা কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশন সংলগ্ন সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি ঘাটে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরদিন তার লাশ উদ্ধার করে বাড়িতে দাফন করা হয়।
কিশোরগঞ্জ থানার পেছনে খড়মপট্টিতে বসবাস করতেন বিশিষ্ট মোক্তার গিরিজা মোহন চক্রবর্তী। শহরে পাকবাহিনী আসার পর তিনি শহর ছেড়ে পালিয়ে যান। জুন মাসে পাকবাহিনী সকল বাঙালিকে স্ব-স্ব কর্মস্থলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে শহরে মাইকিং করলে অন্য অনেকের মতো গিরিজা চক্রবর্তীও নিজের বাসায় ফিরে আসেন। কিছুদিনের মধ্যে স্থানীয় দালাল ও রাজাকারদের সহায়তায় একদল পাকসেনা গিরিজা চক্রবর্তীকে তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর গিরিজা মোহন চক্রবর্তীর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
কিশোরগঞ্জ শহরতলীর বৌলাই গ্রামের মো. ইয়াকুব আলী (পিতা হাজী আমির হোসেন) রাজনীতি সচেতন অগ্রসর মনের মানুষ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের একজন সক্রিয় সংগঠক হিসেবে আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯শে এপ্রিল পাকবাহিনী কিশোরগঞ্জে আসার পর তিনি করিমগঞ্জ থানার জাফরাবাদ ইউনিয়নের বাদে শ্রীরামপুর গ্রামস্থ শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানকার রাজাকাররা ২৮শে জুলাই ইয়াকুব আলীকে ধরে নিয়ে কিশোরগঞ্জ শহরের পাকসেনা ক্যাম্পে সোপর্দ করে। পাকসেনারা তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা সংক্রান্ত তথ্য দেবার জন্য প্রবল চাপ দেয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান দিলে ছেড়ে দেয়া হবে বলে আশ্বাস দেয়। কিন্তু ইয়াকুব আলী হানাদারদের কাছে মুখ খুলতে রাজি হননি। ফলে তাঁর ওপর ৩-৪ দিন অকথ্য শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে ৩১শে জুলাই মধ্যরাতে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
কিশোরগঞ্জ শহরের ঈশা খাঁ রোডের (তমালতলা) নিজস্ব বাসায় বসবাস করতেন মো. নবী হোসেন ভূঁইয়া (পিতা সোনাধর ভূঁইয়া)। তার গ্রামের বাড়ি হোসেনপুর থানাধীন চরজামাইল গ্রামে হলেও তিনি সপরিবার কিশোরগঞ্জ শহরে বসবাস করতেন। তার ছেলে মো. কামরুজ্জামান কমরু স্থানীয় কিছু তরুণকে নিয়ে ৬ই মার্চ সর্বপ্রথম কিশোরগঞ্জের কালীবাড়ি মোড়স্থ রঞ্জিত ঘোষের রেশন দোকানের ছাদে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কামরুজ্জামান কমরু, তার চাচাতো ভাই মো. আফাজউদ্দিনসহ তাদের আত্বীয়-স্বজনদের মধ্য থেকে প্রায় ৩০ জন তরুণ-যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এ-কারণে হানাদার পাকবাহিনী মো. নবী হোসেন ভূঁইয়াকে বাসা থেকে ধরে এনে ১৫ই আগস্ট কিশোরগঞ্জ শহরতলীর কিশোরগঞ্জ- নীলগঞ্জ রোডের শোলমারা ব্রিজে অন্য ১০ জন বন্দির সঙ্গে নৃশংসভাবে হত্যা করে। পরে এলাকাবাসী এসব শহীদের লাশ পার্শ্ববর্তী ক্ষিরোদা বাজারের কাছে সমাহিত করে। কিশোরগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক বিনোদ বিহারী রায় (পিতা বৈকুণ্ঠ নাথ রায়) শহরতলীর লতিবাবাদ ইউনিয়নের কাটাবাড়িয়া (দিঘিরপাড়) গ্রামে বাস করতেন। ১৩ই সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে কিশোরগঞ্জ শহরের কুখ্যাত রাজাকার তারা মিয়া, মফিজউদ্দিন ও আব্দুর রহমানসহ অন্যরা বিনোদ বিহারীর বাড়িতে চড়াও হয়। ঘাতকদের ভয়ে বিনোদ বিহারী সন্তর্পণে বাড়ি থেকে বের হয়ে পার্শ্ববর্তী ভূঁইয়া বাড়ির গভীর জঙ্গলে আত্মগোপন করেন। বাড়িতে ব্যাপক তল্লাশি করে রাজাকাররা তাকে না পেয়ে যখন ফিরে আসছিল, তখন স্থানীয় রাজাকার আব্দুল খালেক ভূঁইয়া বাড়ির জঙ্গল থেকে বিনোদ বিহারীকে ধরে এনে ঘাতকদের হাতে তুলে দেয়৷ ঘাতক দল তাকে শহরে নিয়ে আসে। এরপর বিনোদ বিহারী রায়ের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। কিশোরগঞ্জ সদর থানায় সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয় বরইতলায়। ১৩ই অক্টোবর দুপুরে পাকসেনা ও পাকিস্তানি মিলিশিয়া মিলে প্রায় ৫০ জন বরইতলা গণহত্যা- সংঘটিত করে। তারা দামপাড়া, চিকনীরচর, গোবিন্দপুর, তিলকনাথপুর, কড়িয়াইল, বাদে কড়িয়াইল, কালিকাবাড়ি ও ঘাগর গ্রামের সাড়ে তিন শতাধিক নিরীহ বাঙালিকে বরইতলায় জড়ো করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি এক নির্মম হত্যাকাণ্ড হিসেবে পরিচিত।
কিশোরগঞ্জ সদর থানাধীন মাইজখাপন ইউনিয়নের কালাইহাটি গ্রামের ১৬ বছরের তরুণ মো. জহিরুল ইসলাম ভূঞা ওরফে ছন্দু মিয়া (পিতা মো. আব্দুল খালেক ভূঞা) ১৯৭১ সালে নান্দাইল থানা সদরের চণ্ডীপাশা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এ সাহসী তরুণ জুন মাসের প্রথম দিকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের আগরতলায় যায়। সেখানে মেলাঘরে ৭ থেকে ২৮শে জুন পর্যন্ত সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মেজর কে এম সফিউল্লাহর অধীনে ৩ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। ৮ই নভেম্বর কিশোরগঞ্জের পুরান থানাস্থ ইসলামিয়া ছাত্রাবাসের রাজাকার ক্যাম্প রেকি করার জন্য সে শহরে আসে। থানার পাশের একটি চায়ের দোকান থেকে কুখ্যাত রাজাকার আব্দুর রহমান, বাদশা মিয়া এবং মাওলানা আতাহার আলীর ছেলে রাজাকার আক্তার মৌলভী তাকে আটক করে ইসলামিয়া ছাত্রাবাসের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তারা তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। শত নির্যাতনেও মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল ইসলাম ভূঞা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য ঘাতকদের কাছে ফাঁস করেনি। কোনো কথা আদায় করতে না পেরে ঘাতক দল ৮ই নভেম্বর রাতে কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ রেলপথের মুশুলী রেলস্টেশন সংলগ্ন কালীগঞ্জ রেলসেতুতে এ অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁর লাশ উদ্ধার করা যায়নি।
হোসেনপুর গ্রামের মহিউদ্দিন আহমেদ (পিতা মো. নবী হোসেন) স্থায়ীভাবে কিশোরগঞ্জ শহরের গাইটাল এলাকায় বসবাস করতেন। রাজনীতি সচেতন মহিউদ্দিন আহমেদ স্থানীয় গুরুদয়াল কলেজে অধ্যয়নকালে ১৯৪৯-৫১ সালে কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনেও তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। তিনি কিশোরগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাড়াইল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কর্মস্থল তাড়াইল ছেড়ে এক পর্যায়ে কিশোরগঞ্জে চলে আসেন এবং গোপনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় সংগঠক হিসেবে কাজ করতে থাকেন। জীবিকার তাগিদে জুন মাসের দিকে তিনি তাড়াইল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেখানে দায়িত্ব পালনকালে পরপর দুবার হানাদার পাকবাহিনীর হাতে আটক হয়ে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হন। বাধ্য হয়ে আবারও তাঁকে তাড়াইল ছেড়ে কিশোরগঞ্জে চলে আসতে হয়। ১০ই নভেম্বর গুরুদয়াল কলেজের জামায়াতে ইসলামী সমর্থক ও স্থানীয় আলবদর বাহিনীর অঘোষিত প্রধান মাহতাব প্রফেসরের ইন্ধনে দুজন আলবদর সদস্য শহরের কাচারিবাজার থেকে মহিউদ্দিন আহমেদকে ধরে এনে কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশন সংলগ্ন পাকসেনা ক্যাম্পে সোপর্দ করে। ঐ রাতেই পাকিস্তানি ঘাতকরা শহরের সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি ঘাটে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
কিশোরগঞ্জ শহরের কুটিগীর্দি এলাকার মো. সিরাজুল হক (পিতা মো. মনসুর আলী) ১৯৭১ সালে কিশোরগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণির ছাত্র ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এ অসীম সাহসী কিশোর সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যায়। সেখানে ঢালু ক্যাম্পে ভারতীয় সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন চৌহানের তত্ত্বাবধানে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। পাকুন্দিয়া থানাধীন শিমুলিয়া গ্রামের ক্যাপ্টেন মো. মতিউর রহমান (ক্যাপ্টেন হামিদ)-এর অধীনে কিশোর সিরাজুল হক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ায় তার পিতা- মাতার ওপর স্থানীয় দালাল-রাজাকাররা নানারকম উৎপীড়ন করে। দালাল মাওলানা মুসলেহ উদ্দিনের চাপে সিরাজুল হকের অসহায় পিতা মো. মনসুর আলী মুক্তিযোদ্ধা পুত্রকে এফিডেভিটের মাধ্যমে ত্যাজ্যপুত্র করতেও বাধ্য হন। ১২ই নভেম্বর সিরাজুল হক পিতা-মাতার সঙ্গে দেখা করার জন্য একটি স্টেনগান নিয়ে অত্যন্ত গোপনে কুটিগীর্দির বাড়িতে যায়। তার আসার খবর পার্শ্ববর্তী বাড়ির রাজাকার মানিক ও গফুর তৎক্ষণাৎ মাওলানা মুসলেহ উদ্দিনের কাছে পৌঁছে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে একদল রাজাকার সিরাজুল হকের বাড়ি ঘেরাও করে। ঘাতকদের উপস্থিতি টের পেয়ে সিরাজ বাড়ি ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসার সময় তারা তাকে পেছন থেকে ধাওয়া করে। সে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে শহরের রথখলা এলাকার পপুলার টেইলার্সে এসে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে ঘাতক রাজাকার দল তাকে বন্দি করে মাওলানা মুসলেহ উদ্দিনের হয়বতনগরের বাসায় নিয়ে যায়। খবর পেয়ে কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশন সংলগ্ন সেনা ক্যাম্প থেকে একদল পাকসেনা সেখানে যায়। মাওলানার বাসায় মুক্তিযোদ্ধা সিরাজের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। ঘাতক পাকসেনারা তাঁকে মুমূর্ষু অবস্থায় একটি ট্রাকে উঠিয়ে সমগ্র কিশোরগঞ্জ শহর প্রদক্ষিণ করে। মুক্তিযোদ্ধা সিরাজের বাবা-মা ছেলেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি। ১২ই নভেম্বর রাতে ঘাতক পাকসেনারা বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হককে কিশোরগঞ্জ- ভৈরব রেললাইনের গচিহাটার নিকটবর্তী ধুলদিয়া রেলসেতুতে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
কিশোরগঞ্জ শহরতলীর রশিদাবাদ গ্রামের প্রফুল্ল কুমার সরকার (পিতা দুর্গানাথ সরকার) তেভাগা আন্দোলন ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। এ- কারণে তাঁকে এক সময় জেলও খাটতে হয়। ষাটোর্ধ্ব এ প্রবীণ ব্যক্তি শেষ বয়সে গ্রামের বাড়িতে কৃষিকাজ তদারকি করতেন। কিশোরগঞ্জে পাকবাহিনী আসার পরও আত্মপ্রত্যয়ী প্রফুল্ল কুমার সরকার ভিটেবাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাননি। ২৭শে নভেম্বর সকালে স্থানীয় কতিপয় দালাল ও রাজাকারের সহায়তায় একদল পাকসেনা প্রফুল্ল সরকারকে তাঁর দুই ছেলে পরিতোষ চন্দ্র সরকার শংকর ও বিকাশ চন্দ্র সরকার কানু-সহ তাঁর বাড়ি থেকে ধরে আনে। একই সময়ে তাঁর বাড়িতে অবস্থানরত কিশোরগঞ্জ শহরের এস ভি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত কৃতী শিক্ষক যোগেন্দ্র চন্দ্র মজুমদারকেও (পিতা শরদিন্দু মজুমদার, রশিদাবাদ) ঘাতরো ধরে আনে। পরদিন কিশোরগঞ্জ শহরের রেলস্টেশন সংলগ্ন সিদ্ধেশ্বরী কালিবাড়ি ঘাটে এ ৪ জনকে ঘাতক বাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করে। যুদ্ধে শহীদ হওয়ার পরও মুক্তিযোদ্ধাদের মরদেহ নিয়ে পাকসেনা ও রাজাকাররা কী রকম পৈশাচিকতা করেছে, তার এক উদাহরণ খায়রুল জাহান, বীর প্রতীক। কিশোরগঞ্জ শহরের শোলাকিয়া মহল্লার খায়রুল জাহান (পিতা মো. আব্দুল হাই তালুকদার ওরফে মেন্দি মিয়া) ময়মনসিংহ কারিগরি মহাবিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের মেধাবী ও কৃতী ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য তিনি ১৮ই জুলাই ভারত যান। সেখানে প্রশিক্ষণ শেষে মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ২ নং সেক্টরে গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে অংশ নেন। ২৬শে নভেম্বর কিশোরগঞ্জ শহরের পার্শ্ববর্তী কিশোরগঞ্জ-হোসেনপুর রোডের প্যারাভাঙ্গায় খায়রুল জাহানের নেতৃত্বাধীন ছোট একটি মুক্তিযোদ্ধা দল পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর মুখোমুখি হয়। বিশাল শত্রুপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ করে কুলিয়ে ওঠা সম্ভব নয় জেনেও বীর যোদ্ধা খায়রুল জাহান আদৌ ভীত হননি, বরং সহযোদ্ধাদের নিরাপদে সরে যাবার সুযোগ সৃষ্টির জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একাই প্রতিপক্ষের দিকে মেশিনগানের গুলি ছুড়তে থাকেন। তাঁর সাহসিকতায় মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পান। সহযোদ্ধাদের অধিকাংশ অক্ষত অবস্থায় সরে যেতে পারলেও তাঁর দলের সদস্য কুলিয়ারচর থানার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সেলিম, বীর প্রতীক- প্যারাভাঙ্গার যুদ্ধে শহীদ হন। এক পর্যায়ে প্রতিপক্ষ বাহিনীর গোলার আঘাতে একই স্থানে শহীদ হন অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল জাহান। এরপর ঘাতক পাকবাহিনী ও রাজাকারের দল শহীদ খায়রুলের মৃতদেহের ওপর বর্বরোচিত নিপীড়ন চালায়। তাঁর মৃতদেহ কিশোরগঞ্জ শহরে এনে প্রধান সড়কে টেনে- হিঁচড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে। পাকবাহিনীর দোসর মাওলানা মুসলেহ উদ্দীনের ছেলে রাজাকার মো. হোসেইন খায়রুলের রক্তমাখা গেঞ্জিটি তাঁর (খায়রুলের) মায়ের সামনে ছুড়ে দিয়ে চরম বীভৎসতা প্রদর্শন করে। স্বাধীনতার পর শহীদ খায়রুলের বীরত্বের জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার তাঁকে মরণোত্তর ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে।
কিশোরগঞ্জ সদর থানাধীন মাইজখাপন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি তাহেরউদ্দিন ভূঞা (পিতা আফছরউদ্দিন ভূঞা, বেত্রাটি, নীলগঞ্জ) সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। ২৮শে নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে নীলগঞ্জ বাজার এলাকায় রেকি ও প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে তাড়াইলে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে যাওয়ার পথে তাহেরউদ্দিন নন্দীপুরে একদল পাকসেনার হাতে আটক হন। স্থানীয় এক রাজাকারের ইঙ্গিতে ঘাতক পাকসেনারা সেখানেই তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।
মাইনউদ্দিন চিশতী (পিতা মো. আবুল হাশেম; স্থায়ী বাড়ি কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার মাছিমপুর গ্রামে; তার পিতা কিশোরগঞ্জ আয়কর বিভাগের ইন্সপেক্টর ছিলেন) গুরুদয়াল কলেজে অধ্যয়নকালে ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) একজন প্রথম সারির নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নিরাপত্তার কথা ভেবে পিতা-মাতার নির্দেশে তিনি তাবলীগ জামাতে যান। একাত্তরের নভেম্বর মাসে তার তাবলীগ দল বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কিশোরগঞ্জ শহরের বড়বাজারস্থ শামছু ভূঁইয়ার মসজিদে আসে। মাইনউদ্দিন চিশতী এক পর্যায়ে পরিবারের খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য সেখান থেকে তাদের আখড়াবাজারের বাসায় আসেন। তার ফিরে আসার সংবাদ রাজাকার ও আলবদরদের কাছে গেলে আলবদর বাহিনীর অঘোষিত প্রধান মাহতাব প্রফেসরের ইন্ধনে আলবদররা মাইনউদ্দিন চিশতীকে তাদের বাসা থেকে ধরে আনে। শহরের রেলস্টেশন সংলগ্ন আলবদর বাহিনীর ক্যাম্পে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানোর পর মুমূর্ষু চিশতীকে ঐ রাতে ঘাতক আলবদররা নৃশংসভাবে হত্যা করে। কিশোরগঞ্জের যশোদল গ্রামের এ বি এম শফিউদ্দিন শফি (পিতা মো. খলিল) স্থানীয় আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে বিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন। পরে কিশোরগঞ্জ শহরের আরজত আতরজান উচ্চ বিদ্যালয়ে শরীরচর্চা শিক্ষক হিসেবে চাকরি গ্রহণ করেন। অনেকের সঙ্গে তিনিও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য ভারতের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করেন। কিন্তু দেশ স্বাধীন হলেও তিনি আর ফিরে আসেননি।
কিশোরগঞ্জ থানাধীন মারিয়া ইউনিয়নের বগাদিয়া (বিন্নগাঁও) গ্রামের মো. নিজামউদ্দিন (পিতা মো. ছমিরউদ্দিন) কলেজে পড়া অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ভারতের ইকো-ওয়ান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেন। এক পর্যায়ে পাকুন্দিয়া থানাধীন আশুতিয়া বাজারে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে যোগ দেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নান মোল্লার দলের সঙ্গে কিশোরগঞ্জ শহরতলীর মারিয়ায় রাজাকার ও আলবদরদের সঙ্গে সংঘটিত সম্মুখ যুদ্ধে তিনি সাহসী ভূমিকা রাখেন। এক সময় গুরুতর টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েন। শত্রুপক্ষের প্রবল প্রতিরোধ এবং হাসপাতালে গেলে ধরা পড়ার ভয়ে তাঁর কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়নি। অস্থায়ী ক্যাম্পের ছোট কুটিরে খড়ের বিছানায় গুরুতর টাইফয়েড নিয়ে বিনা চিকিৎসায় শুয়ে থাকা অবস্থায় ১৬ই ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ মুক্ত হওয়ার মাত্র একদিন আগে বীর মুক্তিযোদ্ধা নিজামউদ্দিন মৃত্যুবরণ করেন।
কিশোরগঞ্জের বিন্নাটি গ্রামের সম্রাট মিয়া ওরফে সমরাজ (পিতা জমিরউদ্দিন) ছিলেন দরিদ্র ভূমিহীন পরিবারের সন্তান ও পেশায় রিক্সাচালক। ২৫ বছরের তরুণ সম্রাট মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে কমান্ডার আব্দুল হান্নান মোল্লার অধীনে একজন দুঃসাহসী যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। সম্রাট সম্পর্কে এমন কথাও প্রচলিত আছে যে, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত জুতো পরবে না এরকম প্রতিজ্ঞায় সে আমৃত্যু অটল ছিল। কিশোরগঞ্জ মুক্ত হবার মাত্র একদিন আগে ১৬ই ডিসেম্বর শহরতলীর কামালিয়ারচর বালুকার বিলে সকাল ১০টায় রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা হান্নান মোল্লা বাহিনীর এক তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের ভয়াবহতায় কৌশলগত কারণে মুক্তিযোদ্ধা দল পিছিয়ে বালুকা বিলে নেমে যায়। ঠিক সেই সময় প্রতিপক্ষের একটি গুলি অমিত সাহসী সম্রাটের শরীরে বিদ্ধ হয়। আহত অবস্থায় সে রাজাকার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। ঘাতক দল তাকে জিপের পেছনে বেঁধে সারা শহরে টেনে-হিঁচড়ে সমস্ত শরীর ক্ষত-বিক্ষত করার পর মুমূর্ষু অবস্থায় শহরের সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি ঘাটে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করে। পরে তার স্বজনরা লাশ উদ্ধার করে তাকে বিন্নাটি ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের কাছে সমাহিত করে।
কিশোরগঞ্জ থানার বিভিন্ন জায়গায় অনেক মানুষ পাকবাহিনী ও রাজাকারদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের সবার পরিচয় জানা যায়নি। যাদের পরিচয় জানা গেছে, তারা হলেন- মতিউর রহমান (পিতা মোহাম্মদ আলী, প্যারাভাঙ্গা), বাদশা মিয়া (পিতা মালেক মিয়া, প্যারাভাঙ্গা), কার্তিক নাথ (পিতা শিবা নাথ, প্যারাভাঙ্গা), শুকুর মাহমুদ (পিতা মোহাম্মদ খলিল, দনাইল), মো. নূরুল হক ওরফে শাবান মিয়া (পিতা হাজী আব্দুল খালেক, লতিবপুর), চুনিলাল সাহা (পিতা শিরীষ চন্দ্র সাহা, চরশোলা, সাহাপাড়া), পরিমল চন্দ্র সাহা (পিতা ক্ষেত্র মোহন সাহা, চরশোলা, সাহাপাড়া), বল্লভ সাহা (পিতা অধর সাহা, চরশোলা, সাহাপাড়া), গোপাল সাহা (পিতা বল্লভ সাহা, চরশোলা, সাহাপাড়া), খগেন্দ্র কিশোর লোহ (পিতা বিপিন চন্দ্ৰ লোহ, খড়মপট্টি), হীরেন্দ্র দাস (পিতা শচীন্দ্র চন্দ্ৰ দাস, গৌরাঙ্গ বাজার), রেবর্তী চক্রবর্তী (পিতা ব্রজনাথ চক্রবর্তী, কালীবাড়ি; পুরোহিত), শৈলেন্দ্র চক্রবর্তী (পিতা শরৎ চক্রবর্তী, কালীবাড়ি, কিশোরগঞ্জ), হরিচরণ পণ্ডিত (পিতা বৃন্দাবন পণ্ডিত, সগড়া), ক্ষিতীশ চন্দ্র পণ্ডিত (পিতা কালী কুমার পণ্ডিত, সগড়া), শৈলেশ চন্দ্র পণ্ডিত (পিতা কালী কুমার পণ্ডিত, সগড়া), অশোক কুমার ওরফে মধু পণ্ডিত (পিতা ক্ষিতীশ চন্দ্র পণ্ডিত, সগড়া), আইনউদ্দিন ওরফে জারু মিয়া (পিতা, আমির উদ্দিন, সগড়া), তাপস পণ্ডিত (পিতা রজনীকান্ত পণ্ডিত, বিন্নগাঁও), ননী গোপাল সাহা (পিতা উমেশ চন্দ্র সাহা, বিন্নগাঁও), অনিল কুমার আচার্য (পিতা রাজকুমার আচার্য, বিন্নগাঁও), ইন্দ্ৰজিৎ পণ্ডিত (বিন্নগাঁও), নগেন্দ্র রায় (পিতা ইন্দ্রজিৎ পণ্ডিত, বিন্নগাঁও), আবুনি বিবি (পিতা আব্দুল আলীম, বগাদিয়া), মোজাফফর আলী (পিতা ইদু শেখ, বগাদিয়া), সুধীর জীবন বীর ওরফে মনাবীর (পিতা হরি জীবন বীর, রাখুয়াইল), শশাঙ্ক জীবন বীর ওরফে পঁচা বীর (পিতা হরি জীবন বীর, রাখুয়াইল), শৈবাল জীবন বীর (পিতা শশাঙ্ক জীবন বীর, রাখুয়াইল), বিপুল জীবন বীর (পিতা শশাঙ্ক জীবন বীর, রাখুয়াইল), বাদল জীবন বীর (পিতা শশাঙ্ক জীবন বীর, রাখুয়াইল), যোগেশ দত্ত (পিতা শ্রীধাম দত্ত, কাটাবাড়িয়া দিঘিরপাড়), সুধাংশু রঞ্জন দাস (রাখুয়াইল), হীরণ বালা দত্ত (স্বামী শ্রীধাম দত্ত, রাখুয়াইল), সুধীর চন্দ্র সেন (পিতা শিবনাথ সেন, রাখুয়াইল), মো. আব্দুর রউফ (পিতা ছফুর উদ্দিন মুন্সী, বড়ভাগ, দক্ষিণপাড়া), মো. আব্দুস সালাম (পিতা ছফুর উদ্দিন মুন্সী, বড়ভাগ, দক্ষিণপাড়া), মো. আব্দুর রেজ্জাক ফেলু (পিতা মো. বাছির শেখ, সাদুল্লারচর, দক্ষিণপাড়া), অভয় চন্দ্র ধর (পিতা হরকিশোর ধর, বড়ভাগ), মো. জোয়াদ মোল্লা ওরফে হাজী মিয়া (পিতা হোসেন মোল্লা, বেরুয়াইল), আব্দুল হাফিজ ওরফে তোতা মিয়া (পিতা মো. আবু হানিফ, ভুবিরচর), মো. আব্দুর রহমান (পিতা আব্দুল হাফিজ তোতা, ভুবিরচর), বৈকুণ্ঠ নমঃদাস (পিতা আবু রাম নমঃদাস, নধার, যশোদল), মো. শুকুর মামুদ (পিতা মো. মশ্রব আলী, যশোদল), হাদিউল ইসলাম ভূঁইয়া মানিক (পিতা আব্দুর রাশিদ ভূঁইয়া, ঝিকরজোড়া), মো. আব্দুল হামিদ (পিতা আছিরউদ্দিন, চিকনীরচর), নরেন্দ্র চন্দ্র সরকার (পিতা নারায়ণ সরকার, দামপাড়া), কড়ু নমঃদাস (দামপাড়া), ডেঙ্গু নমঃদাস (দামপাড়া), গুরুদয়াল সরকার (দামপাড়া), মো. কমরউদ্দিন (পিতা আবুল হোসেন, ভাবুন্দিয়া), মো. আব্দুল খালেক (পিতা আব্দুল হাকিম, ভাবুন্দিয়া), মো. আব্দুল ওয়াহেদ (পিতা তৈয়ব আলী প্রধানী, ভুবিরচর), পরিমল ভৌমিক (পিতা পূর্ণ চন্দ্র ভৌমিক, ঘাগৈর), পবিত্র চন্দ্র ঘোষ (পিতা রোক্কিনা চন্দ্র ঘোষ, কালিকাবাড়ি), মো. আব্দুল হাশিম নবী (পিতা নূর, মধ্যপাড়া), মো. ঈমান আলী (পাটধা কুড়েরপার), সুরেশ সরকার (পিতা হরচন্দ্র সরকার, কানকাটি, খালপাড়), হর্ষবর্ধন সরকার (পিতা উপেন্দ্র সরকার, খালপাড়), বিশ্ববর্ধন সরকার (পিতা রাজেন্দ্র সরকার, খালপাড়), জ্ঞান চন্দ্র নন্দী (পিতা বৃন্দাবন নন্দী, খালপাড়), আব্দুল জব্বার (পিতা তোরাব আলী, খালপাড়), জয় চন্দ্র নন্দী (পিতা বৃন্দাবন নন্দী, খালপাড়), মধুসূদন নন্দী (পিতা যোগেন্দ্র নন্দী, খালপাড়), বীরেন্দ্র চন্দ্র রায় (পিতা বিপিন চন্দ্র রায়, যশোদল মধুনগর), শৈলেন্দ্র চন্দ্র রায় (পিতা বিপিন চন্দ্র রায়, যশোদল মধুনগর), যতীন্দ্র চন্দ্র রায় (পিতা বিপিন চন্দ্র রায়, যশোদল মধুনগর), বিজন বিহারী রায় (পিতা বীরেন্দ্র চন্দ্র রায়, যশোদল মধুনগর), হরি সুন্দর দে (পিতা ব্রজেন্দ্র চন্দ্র দে, খড়মপট্টি), প্রদীপ মজুমদার (পিতা অশ্বিনী কুমার মজুমদার, খড়মপট্টি), সুদীপ মজুমদার (পিতা অশ্বিনী কুমার মজুমদার, খড়মপট্টি), হরলাল পোদ্দার (পিতা ভগীরথ পোদ্দার, খড়মপট্টি), অরুণ চন্দ্র রায় (পিতা উপেন্দ্র চন্দ্র রায়, খড়মপট্টি), খগেন্দ্র চন্দ্র রায় হেলু (পিতা শৈলেন্দ্র চন্দ্র রায়, খড়মপট্টি), আহম্মদ আলী (পিতা মো. ফজর আলী, হয়বতনগর), দীনেশ রায় (পিতা জগৎ চন্দ্র রায়, নগুয়া), দেবেন্দ্র বিজয় ধর বোঁচাবাবু (পিতা সারদা ধর, নগুয়া মোড়), বিরাজ বসাক (পিতা কৈলাশ বসাক, ঝাঁপানিয়াপাড়া), চন্দ্র কুমার রক্ষিত (নগুয়া), এম এ মজিদ (পিতা ইসমাইল মুন্সী, নগুয়া ১ম মোড়), মো. নূরুল ইসলাম বাচ্চু (পিতা মো. হোসেনউদ্দিন, গাইটাল), যোগেশ চন্দ্র সাহা (পিতা গুরু প্রসাদ সাহা, বত্রিশ মেলাবাজার), রাখাল চন্দ্র সাহা (পিতা মথুর চন্দ্র সাহা, বত্রিশ), কৃষ্ণ চরণ সাহা (পিতা দুর্গা চরণ সাহা, বত্রিশ), বামা চরণ সাহা (পিতা দুর্গাচরণ সাহা, বত্রিশ), গোপাল চন্দ্ৰ সাহা (পিতা মথুর চন্দ্র সাহা, বত্রিশ), গৌর গোপাল দাস (পিতা শশী কুমার দাস, মেলাবাজার), সুধাংশু রঞ্জন দাস (পিতা শশী কুমার দাস, মেলাবাজার), রাধাকৃষ্ণ দাস (পিতা শশী কুমার দাস, মেলাবাজার), নিতাই চন্দ্র মণ্ডল (পিতা হরিচরণ মণ্ডল, বত্রিশ নতুনপল্লী), গৌরাঙ্গচরণ মণ্ডল পিতা হরিচরণ মণ্ডল, বত্রিশ নতুনপল্লী), হরিচরণ মণ্ডল (পিতা নগরবাসী মণ্ডল, বত্রিশ নতুনপল্লী), ক্ষেত্রমোহন মণ্ডল (পিতা নগরবাসী মণ্ডল, বত্রিশ নতুনপল্লী), বিনয় কৃষ্ণ দাস (পিতা রাধাকৃষ্ণ দাস, মেলাবাজার), নীরোদ চন্দ্র সরকার (পিতা শরৎ চন্দ্র সরকার, বত্রিশ), অজিত চন্দ্র সরকার (পিতা নীরোদ চন্দ্র সরকার, বত্রিশ), রঞ্জিত চন্দ্র সরকার (পিতা নিরোদ চন্দ্র সরকার, বত্রিশ), মনোরঞ্জন পোদ্দার (পিতা গঙ্গাচরণ পোদ্দার, বত্রিশ), রাধানাথ দাস (পিতা কাশীনাথ দাস, বত্রিশ), বিমল চন্দ্র দাস (পিতা গৌর গোপাল দাস, মেলাবাজার), জীতেন্দ্র বসাক জিতু (পিতা রাধানাথ বসাক, বত্রিশ), জীতেন্দ্র চন্দ্র সরকার (পিতা মহেশ চন্দ্র সরকার, কালটিয়া), মহেশ চন্দ্র ভৌমিক (পিতা উদয় ভৌমিক, কালটিয়া), বীরেন্দ্র কিশোর ভৌমিক (পিতা মহেশ চন্দ্ৰ ভৌমিক, কালটিয়া), আবু কপালি (পিতা মহেশ কপালি, কালটিয়া), বিমল চন্দ্র দেবনাথ (পিতা গণেশ চন্দ্র দেবনাথ, কালটিয়া), আহম্মদ মোল্লা (পিতা আব্দুল মজিদ মোল্লা, বিন্নাটি মোল্লাবাড়ি), আনোয়ারউদ্দিন মোল্লা মিলন (পিতা ছালেমউদ্দিন মোল্লা, বিন্নাটি, মোল্লাবাড়ি), মুর্শিদ আলী (পিতা নিজামউদ্দিন, বিন্নাটি), মো. গোলাম হোসেন (পিতা নূর হোসেন, বিন্নাটি), মো. আব্দুল কাদির (পিতা আ. হামিদ মুন্সী, বিন্নাটি), মো. শুক্কুর মিয়া (পিতা মো. খলিল, দনাইল), আব্দুল হেকিম (পিতা আলীনেওয়াজ, স্বল্পমারিয়া), অমর কৃষ্ণ দেব পল্টু (পিতা অশ্বিনী কুমার দেব, করমূলী), আব্দুল গণি গুনু (পিতা আব্দুল করিম, করমূলী), যতীন্দ্র চন্দ্র রায় ঝগর (পিতা চন্দ্র মোহন রায়, করমূলী), মো. আজিমউদ্দিন (পিতা মিয়া চাঁন, করমূলী), মো. খুর্শিদ মিয়া (দক্ষিণ মোল্লাপাড়া), মো. কামাল উদ্দিন (পিতা ডা. মো. জনাব আলী, বাটাইল), সোহরাব উদ্দিন (পিতা মিয়া হোসেন, টিকুয়াইল), সৈয়দ মহিউদ্দিন আহম্মদ ডিপু (পিতা সৈয়দ আব্দুর রশিদ, চৌদ্দশত বোর্ড বাজার), মো. শুক্কুর আলী (চৌদ্দশত), মো. শামছুদ্দিন নেপাল (পিতা ছমেদ আলী, গোপ জিনারাই), আব্দুল মালেক (পিতা মুর্শিদ আলী, পঁয়ত্রিশ কাহন), মনির হোসেন (পিতা গাজী মামুদ, মজুমদারপাড়া), মো. শাহজাহান (পিতা মো. নবাব আলী, নিউটাউন), জয়ধর আলী (পিতা সুলেমান, ভরাটি, বৌলাই), মঙ্গল মিয়া (পিতা মহিন মিয়া ভরাটি, বৌলাই), মো. ইমাম হোসেন (পিতা মো. তজুরউদ্দিন, বাটাইল), মো. ইসরাইল (পিতা মো. তজুরউদ্দিন, বাটাইল), মোহাম্মদ আলী (পিতা আব্দুর রাজ্জাক, বাটাইল), মো. হোসেন আলী (পিতা মো. আব্দুল খালেক, কলাপাড়া), মো. আব্দুল মন্নাছ (পিতা মিয়াধর, কলাপাড়া), হাবিবুর রহমান হবি (পিতা শহর আলী মীর, মাইজখাপন), কাজী জালালউদ্দিন ওরফে রেনু মিয়া (পিতা কাজী ওয়াহিদউদ্দিন, দানাপাটুলি), মো. কিতাব আলী (পিতা ছমেদ হাজী, দানাপাটুলি), মংলু মিয়া (পিতা রইছ আলী, দানাপাটুলি), চান্দু মিয়া (পিতা নূর হোসেন, দানাপাটুলি), মো. কিনাম উদ্দিন কেনু (পিতা মো. ইয়াসিন, দানাপাটুলি), মো. শামছুদ্দিন (পিতা নিবু মিয়া, দানাপাটুলি), আব্দুল খালেক মুসলিম (দানাপাটুলি), মো. রুস্তম আলী (পিতা হাতেম আলী, দানাপাটুলি), মো. সাইদুর রহমান (পিতা হাজী আব্দুল জব্বার, মাথিয়া), আব্দুল মজিদ ভূঁইয়া (পিতা আমজাদ ভূঁইয়া, বেত্রাটি নীলগঞ্জ), গোপাল চন্দ্র বর্মণ (পিতা নীলমোহন বর্মণ, বেপারীপাড়া নীলগঞ্জ), যুধিষ্ঠির বর্মণ (পিতা নীলমোহন বর্মণ, বেপারীপাড়া নীলগঞ্জ), সজনী বর্মণ (পিতা সনাতন বর্মণ, বেপারীপাড়া নীলগঞ্জ), কেবল চন্দ্র গোস্বামী (পিতা বোধরাম বর্মণ, বেপারীপাড়া নীলগঞ্জ), মুকুন্দ বর্মণ (পিতা পবন চন্দ্র বর্মণ, বেপারীপাড়া নীলগঞ্জ), হলধর বর্মণ (পিতা পরমেশ্বর বর্মণ, বেপারীপাড়া নীলগঞ্জ), সুভাষ চন্দ্র বর্মণ (পিতা নীলমোহন বর্মণ, বেপারীপাড়া নীলগঞ্জ), আব্দুর রহমান (পিতা ইজ্জত আলী, বেপারীপাড়া নীলগঞ্জ), আব্বাস আলী (পিতা সুরত আলী, মজুমদারপাড়া), নৃপেন্দ্র কর্মকার (পিতা রাজেন্দ্র কর্মকার, নীলগঞ্জ বাজার), রমজান আলী (পিতা ছাবেদ আলী, হাজীরগল), খোদা নওয়াজ ওরফে ফেঁপরা মিয়া (পিতা মকবুল, হাজীরগল), মো. হাফিজ উদ্দিন (চৌধুরীহাটি), হরিনারায়ণ চক্রবর্তী (পিতা রমণীমোহন চক্রবর্তী, পাতুয়াইর), হরেন্দ্র চন্দ্র ধর (পিতা নবীন চন্দ্র ধর, ভাস্করখিলা), ধরণী কান্ত ধর (পিতা শরৎ চন্দ্র ধর, ভাস্করখিলা), দেবেন্দ্র ভৌমিক (পিতা রামনারায়ণ ভৌমিক, ভাস্করখিলা), নগেন্দ্র ভৌমিক (পিতা দেবেন্দ্র ভৌমিক, ভাস্করখিলা), মধুসূদন ভৌমিক (পিতা নগেন্দ্ৰ ভৌমিক, ভাস্করখিলা), নগেন্দ্র চন্দ্র ধর (পিতা ইন্দ্র নারায়ণ ধর, ভাস্করখিলা), কৃষ্ণ মোহন নাহা (পিতা গৌর মোহন নাহা, ভাস্করখিলা), হীরেন্দ্র চন্দ্র নাহা (পিতা বিশ্বনাথ নাহা, ভাস্করখিলা), সুবোধ চন্দ্র দে (পিতা জয়নাথ দে, ভাস্করখিলা), বিজয় বিশ্বাস (পিতা বিপিন চন্দ্র বিশ্বাস, ভাস্করখিলা), হাদিউল ইসলাম ভূঞা মানিক (পিতা আবদুর রাশিদ ভূঞা, ঝিকরজোড়া), ক্যাপ্টেন আহসান উল্লাহ চৌধুরী (পিতা আলীম উল্লাহ চৌধুরী, ইস্রাইল মঞ্জিল, কিশোরগঞ্জ), সিপাহি মো. দুলাল খান (পিতা আমীর খান, কর্শাকড়িয়াইল), সিপাহি এস এম শফিকুল হক (পিতা শরীফ উদ্দিন, লতিবপুর) ও মো. খুরশিদ (পিতা আহেদ আলী, গাগলাইল)।
কিশোরগঞ্জের রাজাকাররা নিরীহ হিন্দুদের অনেককে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে। অনেকে অত্যাচার ও প্রাণভয়ে চিরাচরিত পোশাকের পরিবর্তে রাজাকারদের কথা ও নির্দেশমতো পোশাক পরতে বাধ্য হয়। কিছু লোককে রাজাকাররা নিজেদের ধর্মগ্রন্থ পাঠ না করতেও বাধ্য করে। কিশোরগঞ্জের রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর নানাভাবে নির্যাতন করে। মুক্তিযোদ্ধাদের পিতা-মাতাদের ভয় দেখিয়ে তাঁদের সন্তানদের ত্যাজ্য ঘোষণা করতে বাধ্য করে। মা-বোনদের ইজ্জত হারানো ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে রাজাকাররা ‘ত্যাজ্য’ করার কৌশল প্রয়োগ করে।
কিশোরগঞ্জ শহরের পুরান থানাস্থ পাবলিক লাইব্রেরির দোতলায় শান্তি কমিটির একটি তথাকথিত বিচারালয় ছিল। পাকিস্তান-বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে অনেক নিরীহ মানুষকে এ বিচারালয়ে হাজির করা হতো। বিচারকের ও পাবলিক প্রসিকিউটরের আসনে বসে যথাক্রমে সৈয়দ মুসলেহ উদ্দিন ও মো. রুস্তম আলী আটককৃত ব্যক্তিদের বিভিন্ন ধরনের শাস্তি প্রদান করত।
কিশোরগঞ্জের অনেকে এলাকা ছাড়াও দেশের অন্যান্য স্থানে বিশেষ করে ঢাকা ও কুমিল্লায় পাকবাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায়। কিশোরগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক কার্যালয়ের কর্মচারী তারাকান্ত তরফদারের ছেলে বরদাকান্ত তরফদার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র। সে জগন্নাথ হলের ৩১১ নং কক্ষের আবাসিক ছাত্র ছিল। ২৫শে মার্চ রাতে হানাদার পাকবাহিনীর গুলিতে সে নিজ কক্ষে মৃত্যুবরণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের এমএ ১ম পর্বের ছাত্র ছিল অষ্টগ্রাম থানার চালতাতলা ঠাকুরবাড়ির রাজমোহন ভট্টাচার্য (রাশু ঠাকুর)-এর ছেলে রমণী মোহন ভট্টাচার্য সেও জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র ছিল। ২৫শে মার্চ রাতে ঘাতক পাকবাহিনীর গুলিতে সে প্রাণ হারায়। বাজিতপুর উপজেলার বসন্তপুর গ্রামের হাফিজুর রহমানের ছেলে মো. হেলালউদ্দিন ছিল ভৈরব হাজী আসমত কলেজের বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ২৩শে মার্চ সে ঢাকায় আওয়ামী লীগের জনসভায় যোগ দেয়ার জন্য এসেছিল। তার সঙ্গে ঢাকায় গিয়েছিল তার আরেক সহপাঠী বসন্তপুর গ্রামের কেন্তু মিয়ার ছেলে মো. বাচ্চু মিয়া। উভয়ে আওয়ামী লীগের সভায় যোগ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে তাদের এক বন্ধুর রুমে দুরাত অবস্থান করে। ২৫শে মার্চ রাতে জগন্নাথ হলে তারাও হানাদার পাকবাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল সংলগ্ন সড়ক ও জনপথ বিভাগের একটি ছাপড়া ঘরে বসবাসরত এ বিভাগের কর্মচারী পাকুন্দিয়া থানাধীন এগারসিন্দুর গোয়ালঘাট গ্রামের মো. শহীদুল ইসলাম (পিতা মো. আব্দুল মজিদ), একই গ্রামের অধিবাসী রোকেয়া হলের কর্মচারী মো. নূরুল ইসলাম নূরু (পিতা মো. সাইদুর রহমান) এবং এ গ্রামেরই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. বাচ্চু মিয়া (পিতা শামছুল হক ভূঁইয়া) হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট-এর শিকার হয়ে ছাপড়া ঘরে আত্মাহুতি দেয়।
কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন বাজিতপুর থানার সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ডা. এ কে এম ফারুক। ৩০শে মার্চ রাতে তিনি সেখানে কর্মরত অবস্থায় পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। কিশোরগঞ্জ শহরতলীর কাটাবাড়িয়া (শ্মশানী) গ্রামের মো. আবদুল মান্নান মন্নাছ (পিতা মো. ইছব আলী) কুমিল্লা সেনানিবাসে সৈনিক পদে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে হানাদার পাকবাহিনী কর্তৃক বাঙালি সৈনিক নিধনকালে তিনি সেনানিবাসে নৃশংসভাবে প্রাণ হারান। কুমিল্লা সেনানিবাসে সৈনিক পদে কর্মরত ছিলেন করিমগঞ্জ থানাধীন নোয়াবাদ গ্রামের মরছব আলীর ২৭ বছরের পুত্র মোখলেছুর রহমান। ২৫শে মার্চ রাতে তিনি পাকিস্তানি সৈনিকদের গুলিতে শাহাদৎ বরণ করেন। একই দিন তার সঙ্গে শহীদ হয় ৯ম শ্রেণির ছাত্র তার আপন ছোট ভাই মো. লাল মিয়া। বড় ভাইকে বাড়িতে নিয়ে আসতে ছোট ভাই লাল মিয়া মার্চের ২২ তারিখ কুমিল্লা গিয়েছিল। কুমিল্লা সেনানিবাসে সৈনিক পদে কর্মরত ছিলেন তাড়াইল থানাধীন কলুমা (ধলা) গ্রামের হাজী মিয়া হোসেনের ছেলে আব্দুল গফুর ভূঁইয়া। ২৫শে মার্চের অপারেশনে ঘাতক পাকবাহিনীর হাতে কুমিল্লা সেনানিবাসে এ বাঙালি সৈনিক প্রাণ হারান। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন বাঙালি সৈনিক ছিলেন হোসেনপুর থানাধীন সাহেদল গ্রামের মো. আব্দুর রহিম (পিতা খোদা নেওয়াজ)। আব্দুর রহিমের বাড়ি নেত্রকোণা জেলায় হলেও তিনি বিয়ের পর সাহেদল গ্রামে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ঢাকা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন এবং ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে সেনানিবাসে শাহাদৎ বরণ করেন। কুলিয়ারচর থানার অনন্ত মনোহরপুর গ্রামের সুলতান গণির তরুণ পুত্র ২০ বছরের মো. দরবেশ মিয়া ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন নবীন সৈনিক। তিনি চট্টগ্রামস্থ ই বি আর সি এন্ড স্কুলে প্রশিক্ষণরত ছিলেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা ২৫শে মার্চ রাতে সেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তাকে গুলি করে হত্যা করে। একই থানার ছয়সূতি গ্রামের মো. লায়েছ মিয়ার ছেলে হারিছউদ্দিন ওরফে হারু ছিলেন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সৈনিক। কুলিয়ারচর থানাধীন উছমানপুর গ্রামের মো. তোফা চানের ছেলে শেখ বশিরউদ্দিনও তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে হাবিলদার পদে চাকরি করতেন। ২২ বছরের হারিছউদ্দিন এবং ২৮ বছরের শেখ বশিরউদ্দিনও ২৫শে মার্চ রাতে সেনানিবাসে শহীদ হন। কুলিয়ারচর থানার আরেক বাঙালি সেনা সদস্যের নাম আব্দুল আউয়াল (পিতা রিয়াছত আলী, বীরকাশিমপুর) ২৫শে মার্চ রাতে কুমিল্লা সেনানিবাসে পাকসৈন্যদের গুলিতে শাহাদৎ বরণ করেন। ভৈরব থানাধীন জগন্নাথপুর গ্রামের আফতাব উদ্দিনের পুত্র আব্দুল আউয়াল ইপিআর বাহিনীর একজন হাবিলদার ছিলেন। ঢাকার পিলখানায় ইপিআর-এর সিগন্যাল উইং-এ কর্মরত থাকাবস্থায় ২৫শে মার্চ রাতে হানাদার পাকবাহিনীর হাতে এই বাঙালি সৈনিক আটক ও নিহত হন। ২৫শে মার্চের নির্মম গণহত্যায় ঢাকা কিংবা দেশের অন্যান্য সেনানিবাসে কিশোরগঞ্জের আরও অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। ঢাকায় অবস্থানকারী কিশোরগঞ্জ জেলাধীন অষ্টগ্রাম উপজেলার বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. আব্দুল আলিম চৌধুরী বিজয়ের কয়েকদিন আগে ঢাকার বাসা থেকে আলবদর বাহিনীর হাতে আটক ও শহীদ হন।
কিশোরগঞ্জ শহরতলীর লতিবাবাদ ইউনিয়নের কাটাবাড়িয়া (শ্মশানী) গ্রামের মো. জমশেদ আলী (পিতা নাজিম উদ্দিন শেখ) সেনাবাহিনীর সৈনিক হিসেবে ১৯৬০ সালে অবসর গ্রহণের পর প্রথমে কুমিল্লায় পশুপালন বিভাগে এবং পরে পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স (পিআইএ)-এ চাকরি করেন। ঈশ্বরদীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করা অবস্থায় তিনি মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। ২৭শে মে মধ্যরাতে পাকসেনা ও রাজাকাররা তাঁর বাসায় চড়াও হয়। তিনি পেছনের দরজা দিয়ে প্রাচীর টপকে বেরিয়ে যান। এরপর আর ফিরে আসেননি। আশংকা করা হয়, পালাবার পথে ঘাতকদের হাতে ধরা পড়ে তিনি শহীদ হন।
কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশন সংলগ্ন জেলা বোর্ডের ডাকবাংলোকে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করত। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরীহ মানুষদের ধরে এনে এই ডাকবাংলোয় বন্দি করে রাখা হতো। বন্দিদের ওপর নির্মম নির্যাতনের পর গভীর রাতে বিভিন্ন রেল ও সড়ক ব্রিজে এবং নদীর পাড়ে নিয়ে তাদের নির্বিচারে হত্যা করে পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হতো। রেলস্টেশন সংলগ্ন স্টেশন মাস্টারের পরিত্যক্ত কোয়ার্টারকে আলবদর বাহিনী তাদের নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত।
কিশোরগঞ্জ সদরে বেশ কয়েকটি বধ্যভূমি রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে বরইতলা বধ্যভূমি সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়িঘাট বধ্যভূমি, শোলমারা ব্রিজ বধ্যভূমি, বড়পুল বধ্যভূমি, মণিপুরঘাট বধ্যভূমি, যশোদল বধ্যভূমি নীলগঞ্জ ব্রিজ বধ্যভূমি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া উপজেলায় কাটাবাড়িয়া বড়দিঘিরপাড় গণকবর রয়েছে।
শহরতলীর কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পুলিশলাইন্স সংলগ্ন বড়পুলে কয়েক দফায় ২৫-৩০ জন নিরীহ মানুষকে হানাদার পাকিস্তানি সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে। এখানে যারা প্রাণ হারান তাদের অধিকাংশের মরদেহ তাদের আত্মীয়-স্বজন এসে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। পরিচয় মেলেনি এমন অন্তত ৭ জনের লাশ স্থানীয় বাসিন্দারা কাটাবাড়িয়া খালপাড় সংলগ্ন বড় পুকুরের পূর্বপাশে একত্রে মাটিচাপা দেয়। সংরক্ষণ না করায় এ গণকবরের চিহ্ন এখন আর নাই।
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য ১৫ই এপ্রিল কিশোরগঞ্জ থেকে প্রথম দলে যে ২১ জন তরুণ ভারতের উদ্দেশ্যে কিশোরগঞ্জ 8 ত্যাগ করেন, তাদের একজন ছিলেন আতিকুর রহমান আতিক (পিতা মো. মতিয়ূর রহমান, কিশোরগঞ্জ শহরের। আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক)। আতিক তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সম্মান প্রথম বর্ষের ছাত্র। ভৈরবের কুখ্যাত দালাল মমতাজ পাগলাকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে সহযোদ্ধা নূরুল হক নুরু (পিতা মোহাম্মদ আলী, সররাবাদ, বেলাব, নরসিংদী) ও মোহনকে সঙ্গে নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিক ৪ঠা জুলাই সবজি বিক্রেতার ছদ্মবেশে ভৈরব বাজারের ছবিঘর সিনেমা হলের সামনে রমেজ মিয়ার গদিঘরে অবস্থান নেন। কথা ছিল আতিক প্রথমে স্টেনগান থেকে মমতাজ পাগলা ও তার – সহযোগীদের লক্ষ করে গুলি ছুড়বেন। সঙ্গে-সঙ্গে অন্য দুই সহযোদ্ধা নূরু ও মোহন দূর থেকে গদিঘর লক্ষ করে গুলি ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করবেন। পরিকল্পনামতো আতিক যথাসময়ে ব্রাশ ফায়ার করেন। সহযোদ্ধা নূরুও হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। কিন্তু গ্রেনেডটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আতিকের কাছে এসে বিস্ফোরিত হলে আতিক সেখানেই শহীদ হন। এ অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধা নূরু আহত অবস্থায় ধরা পড়েন। পরে পাকবাহিনীর নির্যাতনে শহীদ হন। অপর মুক্তিযোদ্ধা মোহন কোনোক্রমে প্রাণরক্ষা করতে সক্ষম হন। উল্লেখ্য, আতিকের ব্রাশফায়ারে মমতাজ পাগলা এবং তার সহযোগীদের প্রায় সবাই নিহত হয়।
৮ই ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ শহরের দক্ষিণাংশে মেলাবাজার ও বগাদিয়া এলাকায় রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দেন হান্নান মোল্লা। রাজাকারদের সংখ্যা ও রসদ বেশি থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা এক পর্যায়ে পিছিয়ে গিয়ে কামালিয়ারচরে যান। এ-যুদ্ধে গুলি বিনিময়ের সময় ধানক্ষেতে লুকিয়ে থাকা করমূলি গ্রামের অমর কৃষ্ণ পাল গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।
১১ই ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ শহরতলীর অধুনালুপ্ত ন্যাশনাল। সুগার মিলস এলাকায় (বর্তমানে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাস) মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মোতালিব বসু ও মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন গ্রুপের সঙ্গে আলবদর বাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা নজরুল আলম গেন্দু (করগাঁও, কটিয়াদী), বাজিতপুর থানার মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন (নিকলী) এবং ওসমান গণি (কাশাল্লা, গজারিয়া) শহীদ হন।
১১ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল বারী খানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে শহরতলীর শোলমারা এলাকায় আলবদর, আলশামস, রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে বাজিতপুর থানার গজারিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন (পুলিশ সদস্য) শহীদ হন।
১৪ই ডিসেম্বর শহরতলীর মারিয়া ইউনিয়নের কামালিয়ারচর এলাকায় রাজাকারদের সঙ্গে হান্নান মোল্লার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে প্রথমদিকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা কৌশলের কাছে রাজাকাররা অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়। তবে রসদের স্বল্পতা ও কৌশলগত কারণে মুক্তিযোদ্ধারা শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে আসেন।
১৬ই ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) হানাদার বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লে. জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ নিয়াজী তার নেতৃত্বাধীন ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের অধিনায়ক জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে পাকিস্তানের পরাজয় মেনে নেয়। অথচ নিয়াজীর দাসানুদাস কিশোরগঞ্জের রাজাকার-আলবদররা তখনও কিশোরগঞ্জে পাকিস্তান কায়েম রাখার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। অধ্যাপক জিয়াউদদ্দীন আহমদ ও হেলাল উদ্দিন মাস্টারের মধ্যস্থতায় রাজাকার বাহিনীর মূল সংগঠক মাওলানা আতাহার আলী ও অন্য শীর্ষ দালালদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দীর্ঘ আলোচনা চলে। রাত ১১টা পর্যন্ত জামিয়া ইমদাদিয়া ভবনে আলোচনা হয়। এরপর বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করে আতাহার আলী বিনাশর্তে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে অনুযায়ী একটি জিপে মাইক সংযোগ করে শহরের চতুর্দিকে রাজাকারদের পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণের ঘোষণা প্রচার করা হয়। রাজাকার কমান্ডার আব্দুর রহমান জামী (মুক্তিযুদ্ধকালীন কটিয়াদী থানার থানার ওসি) মাইকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সমঝোতা হওয়ার ঘোষণা প্রচার করে। ঘোষণা মোতাবেক ১৭ই ডিসেম্বর পাকিস্তানপন্থী সকল সহযোগী ফোর্স বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির মধ্য দিয়ে কিশোরগঞ্জের আকাশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- খন্দকার নাজমুল হুদা, বীর বিক্রম (পিতা খন্দকার মোয়াজ্জেম হোসেন), খায়রুল জাহান, বীর প্রতীক- (পিতা আব্দুল হাই তালুকদার, খড়মপট্টি), এ কে এম রফিকুল হক, বীর প্রতীক (পিতা এ কে এম নূরুল হক), মো. ইদ্রিস মিয়া, বীর প্রতীক (পিতা মো. মিয়া হোসেন, বড় কাপন, নীলগঞ্জ)। কিশোরগঞ্জের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- খায়রুল জাহান, বীর প্রতীক (প্যারাভাঙ্গা যুদ্ধে শহীদ), সম্রাট মিয়া (পিতা জমির উদ্দিন, বিন্নাটি; করমূলিতে শহীদ), জহিরুল ইসলাম ভূঞা (পিতা আব্দুল খালেক ভূঞা, কালাইহাটি; রেকি করতে গিয়ে আটক এবং পরে শহীদ), তাহের উদ্দিন ভূঞা (পিতা আফসর উদ্দিন ভূঞা, বেত্রাটি; তালজাঙ্গা এলাকায় শহীদ), মো. নিজাম উদ্দিন (পিতা ছমির উদ্দিন, বগাদিয়া; করমূলিতে শহীদ), জমশেদ আলী (পিতা নজম উদ্দিন শেখ, কাটাবাড়িয়া; অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য, পাবনার ইশ্বরদীতে শহীদ), এ বি এম শফিউদ্দিন শফি (পিতা মো. খলিল, যশোদল), মাইন উদ্দিন চিশতি (পিতা আবুল হাশেম, আখড়াবাজার; পাকবাহিনীর হাতে ধৃত এবং শহীদ) এবং সিরাজুল হক (পিতা মনসুর আলী, কুটিগির্দি; পাকবাহিনীর হাতে আটক ও শহীদ)।
কিশোরগঞ্জে যেসব স্মৃতিসৌধ ও স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে সেগুলো হলো— বরইতলা (শহীদনগর) স্মৃতিফলক (বরইতলার তিন শতাধিক শহীদের স্মরণে এ স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে দেখুন বড়ইতলা গণহত্যা)। বড়ইতলার নাম পরিবর্তন করে শহীদনগর করা হয়েছে), বত্রিশ এলাকার স্মৃতিফলক (বত্রিশ এলাকার শহীদদের স্মরণে), শহীদ খায়রুল স্মৃতি সংসদ (শহীদ খায়রুল জাহান, বীর প্রতীক- এর স্মরণে), শহীদ খায়রুল স্মৃতিফলক, প্যাড়াভাঙ্গা স্মৃতিফলক (শহীদ খায়রুল জাহান, বীর প্রতীক-এর স্মরণে), ময়মনসিংহ কারিগরি কলেজে শহীদ খায়রুল ছাত্রাবাস, শহীদ আতিক স্মৃতি জাদুঘর (অধুনালুপ্ত), শহীদ চিশতি স্মৃতি সংসদ, আখড়াবাজার (শহীদ মাইনুদ্দিন চিশতি স্মরণে), শহীদ ইয়াকুব আলী স্মৃতি সংসদ (বৌলাই), শোলমারা স্মৃতিফলক (শোলমারা ব্রিজে শহীদ স্মরণে), শহীদ জমশেদ আলী স্মৃতি পরিষদ (কাটাবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ সদর), শহীদ হায়দার রাইস মিলস, বৌলাই (শহীদ লে. কর্নেল এ টি এম হায়দার-এর স্মরণে), তাহেরগঞ্জ বাজার (নীলগঞ্জ), তাহের উদ্দিন খেলার মাঠ (নীলগঞ্জ), মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি সংসদ (নিউটাউন), জয়বাংলা বাজার (রশিদাবাদ), জয়বাংলা বাজার (ধলিয়ারচর), জয়বাংলা বাজার (নলুয়া), দৃশ্যপট ‘৭১ (কিশোরগঞ্জ; মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণা ও সাহিত্য কেন্দ্র), প্রজন্ম ‘৭১ (কিশোরগঞ্জ; মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংগঠন), আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান (মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংগঠন), বায়ান্ন-একাত্তর (সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন), বিন্নাটির মোড়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ, গুরুদয়াল সরকারি কলেজে শহীদ স্মৃতিফলক (শহীদদের নামখচিত ফলক), দানাপাটুলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে নির্মিত স্মৃতিসৌধ (ধুলদিয়া ব্রিজ বধ্যভূমির শহীদদের স্মরণে), হাজীপুর সিংগুয়া নদীর ত্রিমোহনায় নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ (শহীদদের স্মরণে) এবং মুক্তিসরণি। [জাহাঙ্গীর আলম জাহান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!