বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ কপিরাইট সমস্যা যাতে না হয় সেকারণে সকল লেখা শুধুমাত্র ‘only Readable’, ‘non-downloadable’ ও ‘non-clickable’ রাখা হয়েছে। সংগ্রামের নোটবুকের সকল নথি-পত্রিকা-দলিল-সংকলন-বই থেকে নেয়া তথ্য-ছবি-ভিডিও শুধুমাত্র গবেষণার কাজে ব্যবহার্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার জন্য সংগ্রামের নোটবুক একটি অলাভজনক অবাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনমুক্ত ডোনেশনমুক্ত স্বেচ্ছাশ্রমে গড়া প্রচেষ্টা।
আমি সিরাজুল আলম খান – শামসুদ্দিন পেয়ারা – বইটি থেকে কিছু তথ্য জানা যায় যা গবেষণার উপাত্ত হিসেবে গণ্য। নিম্নে কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হল। তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য মূল বই দেখুন।
আমার সীমাবদ্ধতা
আমার সঙ্গে শামসুদ্দিন পেয়ারার যেটুকু কথোপকথন, তা থেকে বড় আকারের (২০০ পৃষ্টার বেশি) একটি বই হবে, সেটা আমার ধারণায় ছিল না।
স্কুল জীবনের কথা বাদ দিলেও কলেজ জীবন থেকে রাজনীতিতে আমার চলাফেরা শুরু এ চলাফেরার প্রথমদিকে আমি কল্পনাও করিনি আমাকে বড় ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে হবে। শৈশব- কৈশােতে আমার বাবার কাছ থেকে যেসব কথাবার্তা শুনেছি সেটাই রাজনীতিতে আমায় জড়িত হওয়ার প্রধান কারণ। সেসব কথা প্রাথমিকভাবে আমার রাজনৈতিক জীবন গড়ে উঠতে কিছুটা হলেও সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। ছোটবেলায় বাবার কাছে শেখা ‘ডিসিপ্লিন’ জিনিসটা আমার পুরাে জীবনকে প্রভাবিত করেছে প্রবলভাবে।
স্কুল জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন উপলক্ষে আমাকে ও আমার বড় ভাইকে প্রভাত ফেরীর দুই সারির সম্মুখভাগে থাকতে হতো। কলেজের নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের পছন্দ অনুযায়ী এটা করা হতাে। কী কারণে খুলনা জেলা স্কুল ও ঢাকা কলেজের ছাত্রাবস্থায় একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরীর সময় গান গাওয়ার জন্য সিনিয়ররা আমাকে দায়িত্ব দিতেন, সেটা আমি অনেক পরে বুঝেছি।
১৯৫৮ সালে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখনই আইয়ুব খানের মার্শাল ল’ জারি হয়। ১৯৫৯ সালে সাবসিডিয়ারি পরীক্ষার পর
পৃষ্ঠা: ১৫
লম্বা ছুটিতে আমি দিল্লি বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার বয়স তখন আঠার। ১৪ আগস্ট দিল্লিতে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে নিজেকে খুবই অসহায় মনে হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান নামের একটি প্রদেশের নাগরিক হওয়াটা যে কতাে অসম্মানের বা অপমানজনক সেদিন তা বুঝতে পেরেছিলাম ।
চিন্তার জগতে আমাকে স্বাধীনতা বিষয়টি বুঝতে সাহায্য করেছিল তৎকালীন আলজেরিয়ার মুক্তি সংগ্রাম, কিউবার বিপ্লবী আন্দোলন, ভিয়েতনামে আমেরিকার বিরুদ্ধে কমিউনিস্টলের লড়াই এবং ইন্দোনেশিয়াসহ পৃথিবীর নানা দেশে নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন-সংগ্রাম। এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলার (পর্ব পাকিস্তান) ‘স্বাধীনতা’র বিষয়টি এক সময় আমার মাথায় ঢুকে পড়ে।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ‘ভারতীয় বাঙালি’ ও ‘পাকিস্তানি বাঙালি’ অথবা ‘হিন্দু বাঙালি’ ও ‘মুসলমান বাঙালি’-বাঙালি জাতিসত্তার এই খণ্ডিত পরিচয়কেই অনেকে তার চুড়ান্ত বা শেষ পরিচয় বলে ধরে নিয়েছিল। উপমহাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জাৎ এবং পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের গবেষকদের মনেও এ ধারণা বন্ধমূল হয়ে যায়। বাঙালি যে আবার কোনোদিন নিজ পরিচয়ে পৃথিবীর বুকে অবস্থান করে নিতে পারে এটি ছিল তাদের কাছে কল্পনাতীত ব্যাপার। যদিও রবীন্দ্রনাথ লালন শাহ, শরৎচন্দ্র, নজরুলসহ অনেক মনীষী-লেখক-কবি তাদের দর্শন ও সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে বাঙালির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছিলেন। ১৯৩৪ সালে বিহার প্রদেশে অনুষ্ঠিত ‘প্রবাসী বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন’-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘ভৌগােলিকভাবে বাংলাদেশ ভারতের অংশ হলেও কার্যত বাংলা ও বাঙালি সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন দেশ এবং ভিন্ন সংস্কৃতির অধিকারী।’ এর পরেও বহুকাল বাঙালিকে তার জাতিসত্তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তার সূচনা হয়েছে।
১৯৬২ সাল। আমার বয়স তখন ২১ বছর। ঘটনাক্রমে একদিন আমি, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ একসঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি আমাদের আলােচনায় আসে। এভাবে অভিজ্ঞতা ছাড়া শুধুমাত্র তারুণ্যের স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষাকে সম্বল করে শুরু
পৃষ্ঠা: ১৬
হয় স্বাধীনতার জন্য আমাদের পথচলা। আমরা দশ বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করবাে এ সংকল্প নিয়ে কাজ শুরু করি। কিন্তু নয় বছরের মাথায়ই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন ধরে। আমাদের এ নয় বছরের পথপরিক্রমাকে আজকের হিসেবে মনে হবে কয়েক যুগ।
‘নিউক্লিয়াস’ (স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ) নামক একটি সংগঠনের মাধ্যমে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। সে সময় আমার, রাজ্জাকের ও আরেফের বয়স ছিল যথাক্রমে ২১, ২০, ১৯। ‘নিউয়িস’-এর রানৈতিক উইং হিসেবে আমরা ‘বিএলএফ’ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) গঠন করি। পরবর্তীতে শেখ ফজলুল হক মনি ও তোফায়েল আহমেদ বিএলএফ-এ যুক্ত হন। কাজী আরেফ আহমেদ ছিলেন বিএলএফ-এর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরােধ গড়ে তোলে ‘নিউক্লিয়াস’-এর এই রাজনৈতিক উইং বিএলএফ’ এবং সামরিক উইং ‘জয়বাংলা বাহিনী’। ‘বিএলএফ’-এর সদস্যসংখ্যা ছিল তখন ৭ হাজারের মতো।
‘নিউক্লিয়াস’, ‘বিএলএফ’ ও ‘জয়বাংলা বাহিনী’ গঠনের মাধ্যমে আমরা ছাত্র-যুবকদের মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রামের মন-মানসিকতা গড়ে তুললাম। আমাদের সেই প্রয়াস-প্রস্তুতি ও চলমান ঘটনাবলির পাশ কাটিয়ে আমাদের দেশের একচোখা বুদ্ধিজীবীরা ৭১- এর ২৫ মার্চের আগের দিনও বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে পেলেন না। এটা আমাদের জন্য এক লজ্জাকর কাহিনি।
শুধু বুদ্ধিজীবীরাই নন, আওয়ামী লীগসহ এদেশের ছােট-বড় কোনাে রাজনৈতিক দলই মার্চ মাসের আগে স্বাধীনতার বিষয়টিকে সমর্থন করেনি; এমনকি তাদের রাজনৈতিক চিন্তার মধ্যেও ‘স্বাধীনতা’ বিষয়টি ছিল না। তবে এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবস্থানটি ছিল একেবারেই ভিন্ন। ১৯৬৯ সালে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ থেকে মুক্তি লাভের পরই বঙ্গবন্ধুকে ‘ নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’ সম্পর্কে অবহিত করা হয়। তখন থেকে তিনি স্বাধীনতার প্রশ্নে শুধু আপােসহীনই ছিলেন না, ‘নিউক্লিয়াস’ ও “বিএলএফ’র কর্মকাণ্ড সমর্থন করতেন এবং আমাদের যে কোনাে পদক্ষেপে উৎসাহ যোগাতেন।
পৃষ্ঠা: ১৭
এখানে স্পষ্টভাবেই বলা প্রয়ােজন, দলগতভাবে আওয়ামী লীগ ‘স্বাধীনতা’র বিষয়টিকে সমর্থন করেনি। এমনকি বঙ্গবন্ধুও ১৯৬৯ সালের আগে “নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’-এর কর্মতৎপরতা সম্পর্কে জানতেন না। প্রথমদিকে আওয়ামী লীগ শ্লোগান হিসেবে ‘জয়বাংলা’র বিরােধিতা করলেও বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও অবস্থান এবং ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’-এর প্রচণ্ড চাপ ও সাংগঠনিক ক্ষমতার কারণে ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানকে তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়। এই ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানই স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে জনগণের মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণের প্রধান সহায়ক হয়েছিল। জেলা ও মহকুমা (বর্তমানে জেলা) পর্যায়ে আওয়ামী লীগের দু’-একজন ‘নিউক্লিয়াস’কে সক্রিয়ভাবে সহযােগিতা করেছেন । অন্যান্য দলেরও অনেকে ব্যক্তিগতভাবে ‘নিউক্লিয়াস’ নেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন এবং স্বাধীনতার বিষয়টি সমর্থন করতেন।
কাজী আরেফ আহমেদ আজ বেঁচে নেই। আব্দুর রাজ্জাকও চলে গেছেন। আমরা তিনজন সব বিষয়ে একমত পােষণ করতাম এবং একই পথে হাঁটতাম। ১৯৬২ থেকে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনাে বিষয়ে এক মুহূর্তের জন্যও আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য হয়নি।
এ বইটি মুদ্রণের ঠিক আগে শামসুদ্দিন পেয়ারা একবার হলেও পাণ্ডুলিপিটিতে চোখ বুলাতে বললেন। সে কারণে বইটিতে কী আছে আমি জানতে পারলাম। ৬ জানুয়ারি, ২০১৯-এ আমার বয়স আটাত্তর হয়েছে। শামসুদ্দিন পেয়ারা তার লেখায় আমার জীবনের যে পর্বটি তুলে ধরেছে, তা আমার জীবনের কেবল একাংশ। তবে আমার রাজনৈতিক জীবনের প্রথমভাগের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ তার লেখায় তুলে ধরা হয়েছে। কখনাে যদি আমার জীবন নিয়ে কোনাে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ (আত্মজীবনীমূলক) লেখা হয়, তবে তা হবে একটি অতি প্রয়ােজনীয় রাজনৈতিক সাহিত্য।
পাঁচ বছর জেলে থাকার পর ১৯৮১ সালে আমি মুক্তি লাভ করি । জেল থেকে বের হওয়ার পর আমি বুঝতে পারলাম গােটা দেশটাই এক জেলখানায় পরিণত হয়েছে। অন্যরা জেল থেকে মুক্ত হয়ে ভিন্ন জীবন বেছে নেয়; সংসার জীবন শুরু করে জীবিকা উপার্জনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দু-চারজন অবশ্য রাজনীতিকেই তাদের মূল জীবন করে তােলে। এরশাদ সাহেবের সামরিক শাসন বহাল থাকার সময়ে
পৃষ্ঠা: ১৮
আমি রাজনীতিতে আর শুধুমাত্র ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ হয়ে থাকলাম না। পাঁচ বছরের জেলজীবন আমার চিন্তাজগতে মৌলিক পরিবর্তন আনে, তা আমার রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনে সহায়ক হয়। সে সময়ে জেলখানায় আমি প্রতিদিন গড়ে ১৫/১৬ ঘণ্টা পড়াশুনা করতাম । একজন ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ কীভাবে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার মধ্য দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক সত্তায় পরিণত হয়, আমি তার এক দৃষ্টান্ত।
১৯৮৫ সালে ড. জিল্লুর রহমান খান-এর সঙ্গে আকস্মিক যােগাযােগ আমাকে নতুন রাজনীতির মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হতে সাহায্য করে। সেই সময় থেকে তিনি ও আমি একযােগে কাজ করতে থাকি। এর ফলে গত ৩০/৩৫ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতির জগতে নতুন চিন্তার ক্ষেত্র তৈরি হয়। সে বিষয়গুলাে শামসুদ্দিন পেয়ারার লেখায় অন্তর্ভুক্ত না হলেও তার এ লেখায় আমার সে বৌদ্ধিক- রাজনৈতিক জীবনের কিছু আভাস পাওয়া যাবে।
জানুয়ারি ২০১৯
সিরাজুল আলম খান
পৃষ্ঠা: ১৯
১৯৫৯ সাল। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের ছাত্র। সে সময় সাবসিডিয়ারী পরীক্ষার পর তিন মাসের মতাে ছুটি থাকতাে। সে ছুটিটা কিভাবে কাটানাে যায়, তা নিয়ে সহপাঠী বন্ধুরা এক সাথে মিলে নানান প্ল্যান-প্রােগ্রাম করতাে।
আমাদের ব্যাচের এটাই ছিল সবচেয়ে লম্বা ছুটি। এত লম্বা অবকাশ। কাটানাে ছিল সত্যিই খুব কষ্টকর। আমার বন্ধুরা প্রায় সবাই খণ্ডকালীন চাকুরি করত। আমি ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। ছুটিছাটায় সাধারণত বাড়িতে যেতাম না। তখন ঢাকায় ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনের একটি লাইব্রেরি ছিল। আমি সেখানে গিয়ে প্রচুর পড়াশুনা করতাম। আমার আরেক বন্ধু মাশুকুর রহমান তােজো, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ডাবল অনার্স পাওয়া ছাত্র, এ ব্যাপারে আমার সঙ্গী ছিল। আমার এ বন্ধুটি পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যােগ দেয় এবং ১৯৭১-এ সশস্ত্রযুদ্ধের প্রথমদিকেই মারা যায়।
আমি ইংরেজিতে দুর্বল ছিলাম। এই দুর্বলতার কথা মনে রেখে সব সময় চেষ্টা করতাম কী করে ভালাে ইংরেজি শেখা যায়। তখন ঢাকায় প্রেসক্লাবের ঠিক সামনে, রাস্তার অপর পারে, ছিল মার্কিন তথ্যকেন্দ্র। তবে ফুলার রােডে অবস্থিত ব্রিটিশ কাউন্সিলের মতাে তার অত শানশওকত ছিল না। আমি দু জায়গায়ই ইংরেজি বই ও পত্রিকা পড়তে যেতাম।।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লম্বা ছুটিতে বেশির ভাগ ছাত্রই গ্রামের বাড়ি চলে যেত। সে সময় হল প্রায় খালি হয়ে যায়। ডাইনিং হল চালু থাকে না । ফলে খাওয়া-দাওয়ার প্রাইভেট ব্যবস্থা করতে হতাে। ছাত্ররাই সেটা
পৃষ্ঠা: ২১
করতাে। সেবার ছুটিতে আমি ও আমার সেই বন্ধু মিলে ঠিক করলাম আমরা গ্রামের বাড়িতে যাব না, দিল্লি বেড়াতে যাবাে।
আমার দিল্লি ভ্রমণের ইচ্ছার পেছনে একটা বড় কারণ ছিল আমার ছােট চাচা ফিরােজ আলম খান তখন নয়াদিল্লির পাকিস্তান হাই কমিশনে কমার্শিয়াল শাখার সেকশন অফিসার ছিলেন।
আমার সেই চাচাকে একটা চিঠি লিখলাম। তিনি যদিও আমার চাইতে দশ-বারাে বছরের বড় ছিলেন, কিন্তু পিতৃকুলে বয়ােকনিষ্ঠ বলে তার সাথে আমার শিশুকাল থেকেই একটা সখ্য গড়ে উঠেছিল।
চিঠির উত্তর এসে গেল দ্রুত। ছােট চাচা জানালেন, আমার দিল্লি ভ্রমণের আগ্রহের কথা জেনে তিনি খুবই আনন্দিত। কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি কুটনৈতিক চ্যানেলে আমার কাছে ভিসার আবেদনপত্র পাঠিয়ে দিলেন। মাঝে আমাদের মধ্যে দুতিনবার চিঠির আদান-প্রদানও হলাে।
চাচার কাছ থেকে ভিসার আবেদনপত্র পেলাম ঠিকই। কিন্তু ভিসার আবেদন করার আগে তাে পাসপাের্ট করাতে হবে। পাসপাের্ট করতে লাগবে সত্তর থেকে একশত টাকা। আমার কাছে আছে মাত্র চল্লিশ টাকা। বাবাকে আশি টাকা পাঠাবার অনুরােধ জানিয়ে চিঠি লিখলাম।
আমার বাবা ছিলেন একজন উচ্চশিক্ষিত ও বােদ্ধা মানুষ। ১৯৫৯ সালে তিনি শিক্ষা বিভাগের ডিডিপিআই হিসেবে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বাবা মানিঅর্ডার করে আশি টাকা পাঠিয়ে দিলেন। পকেটের চল্লিশ আর বাবার পাঠানাে আশি মিলে হলাে মােট একশত বিশ টাকা। এখন নিশ্চিন্তে পাসপাের্টের আবেদন করা যায়।
কিন্তু যা ভেবেছিলাম পরিস্থিতি ঠিক ততটা সহজ ছিল না । পাসপাের্ট অফিসে তখন অবাঙালিদের একচেটিয়া প্রতাপ। উর্দুভাষী নিরাপত্তারক্ষী আমাকে পাসপাের্টে অফিসে ঢুকতেই দিল না। বললাে, পাসপাের্ট অফিসার ছুটিতে। কখন ফিরবেন তার জানা নাই। হতাশ হয়ে ফিরলাম। এভাবে পরপর কয়েকদিন পাসপাের্ট অফিসে যাতায়াত করলাম, প্রতিদিনই হতাশা নিয়ে ফিরে আসি। একদিন সেখানে এক ভদ্রলােকের সাথে দেখা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি খােরশেদ আলম খানের ছেলে?
আমি ইতিবাচক উত্তর দেয়ার পর তিনি জানালেন সম্পর্কে তিনি আমার মামা হন। বললেন, একজন বাঙালির জন্য পাসপাের্ট পাওয়া
পৃষ্ঠা: ২২
খুবই কঠিন। হয়তাে দেবেই না। পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগবে। হয়তো সেখানেই আটকে দেবে।
আমার এই মামা তখন পাসপোর্ট অফিসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মকর্তা। তিনি আমাকে তার আজিমপুরে বাসায় ডেকে নিয়ে কী করে পাসপোর্ট পাওয়া যেতে পারে সে বিষয়ে পরামর্শ দিলেন। বললেন, পাসপাের্টের আবেদনে লিখতে হবে দিল্পির পাকিস্তান হাইকমিশনে কর্মরত পিতৃব্য অত্যন্ত অসুস্থ। তাকে দেখতে যাওয়া জরুরি। বাকিটুকু তিনি দেখবেন। তার পরামর্শ অনুযায়ী পাসপাের্টের আবেদন করলাম। তিনি উদ্যোগ নিয়ে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই পাসপাের্ট করিয়ে দিলেন। এরপর ভিসার আবেদন। সেখানেও লােকে লােকারণ্য। লাইনে শত শত মানুষ। বুঝলাম, এভাবে করতে গেলে দিল্লি যাবার আগেই আমার ছুটি ফুরিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে আমি বুঝে ফেলেছি পাকিস্তানিদের সাথে কী ধরনের আচরণ করতে হয়।
আমি লাইন বাদ দিয়ে সরাসরি ভিসা অফিসারের কক্ষে ঢুকতে গেলাম। অবাঙালি গার্ড তেড়ে আসলাে। আমি আরও জোরে তেড়ে গেলাম। তারপর বচসা। হুলুস্থুল। অফিসারের আগমন। এসবই ঘটে গেল খুব দ্রুত। ভিসা অফিসার আমাকে তার কক্ষে ডেকে নিয়ে গেলেন। আমি বললাম, আমার জরুরি ভিত্তিতে ভিসা দরকার। অফিসার ব্যাপারটা বুঝলেন। আমাকে দুপুরের খাবার খাওয়ালেন এবং সেদিনই ভিসা দিয়ে দিলেন। তখন পর্ব পাকিস্তান থেকে ট্রেনে চড়ে ভারতের যে কোনাে জায়গায় যাওয়া যেত। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল।
ট্রেনে ঢাকা-দিল্লির ভাড়া ২৮ টাকা ১২ আনা। গােয়ালন্দ থেকে ট্রেন গিয়ে থামলাে শেয়ালদা। প্ল্যাটফর্মে নেমেই বুঝলাম ভারতীয়রা আমাদের উপস্থিতি পছন্দ করে না। চোখেমুখে বিরক্তি। তখন। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক ছিল। মাত্র কয়েক বছর আগে দেশ ভাগ হয়েছে। ভারত বিভাগের রূঢ় বাস্তবতা ভারতীয়রা তখনাে মেনে নিতে পারেনি।
হাওড়া থেকে দিল্লি। ট্রেনে প্রচণ্ড ভিড়। পৌছাতে দুই দিনের বেশি লেগে গেল। দিল্লিতে নেমে অনেকটা স্বস্তি পেলাম। ছােট চাচার বাসা খুঁজে পেতে কোনাে কষ্ট হলাে না। দিল্লি শহর ট্যাক্সি ড্রাইভার সিং
পৃষ্ঠা: ২৩
জি’র নখদর্পণে। তাছাড়া চাচার বাসাটা ছিল দিল্লির বেশ একটা সম্ভ্রান্ত এলাকায়। যেখানে বাড়িঘরগুলাে সুশৃঙ্খলভাবে সাজানাে।
দিল্লি পৌঁছানােটাই আমার কাছে খুব উদ্দীপক মনে হলাে। পরের দিন থেকে দিল্লির নানা জায়গা ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। দিল্লিতে দুই মাস চৌদ্দ দিন ছিলাম। এ সময়ে ১৪ আগস্ট চাচা আমাকে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে নিয়ে যান। এ কে ব্রোহি দিল্লিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত। পাকিস্তানে সে সময় সামরিক শাসন চলছে। অনুষ্ঠানে গিয়ে আমার জায়গা হলাে কয়েকশত গজ পেছনে। সারিবদ্ধভাবে লাইনে সবাই দাঁড়ানাে। আমার নিজস্ব অভ্যাসের কারণে আমি সামনে যেতে চাইলাম। পারলাম না। চাচা বললেন, সামনে বড় অফিসারদের জায়গা। তােমাকে ওখানে যেতে দেবে না। অনুষ্ঠান শেষে ফিরে আসছি, চাচাকে বললাম, আমরা এত পেছনে কেন? তিনি বললেন, সামনে বসতে হলে বড় অফিসার হতে হবে। বিষয়টা বুঝেও গ্রহণ করতে পারলাম না।
এদিকে সারাদিন দিল্লি ঘুরছি। বড় বড় রাস্তা। বিরাট দোকানপাট। লালকেল্লা, জামে মসজিদ, কুতুবমিনার। আগ্রা গেলাম । তাজমহল দেখলাম। এমনি আরাে অনেক বড় বড় দালানকোঠা। পুরােনাে আমলের প্রাসাদের ভগ্নাংশ। দেখলাম রাষ্ট্রপতি ভবন। অবিশ্বাস্য রকমের বড়। চাচাদের রােববার ছুটির দিন। সেদিন আমার সঙ্গে গল্পগুজব হয়। জিজ্ঞেস করতেন, কোথায় কোথায় গিয়েছি কী কী করেছি। বলতাম। এখানে সবকিছু এত বড় বড়, অথচ ঢাকায় তেমন কিছুই নাই। বায়তুল মােকাররম তখনও হয়নি। ঢাকায় রাস্তাঘাট দোকানপাট যা আছে দিল্লির তুলনায় তা আমার কাছে মামুলি মনে হলাে। এক রােববারে আলাপের সময় চাচাকে বললাম, আমাদের ঢাকায় তাে কিছুই নাই। চাচা বললেন, ঢাকায় নাই, কিন্তু করাচিতে আছে । করাচি তখন পাকিস্তানের রাজধানী। আরাে বললেন, রাজধানী না হলে বড় কিছু হয় না। আমরা তাে প্রদেশ। সে কারণে আমাদের বড় কিছু নাই।
এরপর মনে হয় আট-দশদিন ছিলাম দিল্লিতে। সে কয়দিন আর ঘর থেকে বের হইনি। দিল্লিতে ঐ সময়ে ভাল ভাল সিনেমা দেখেছি। বড় বড় সিনেমা হল। ‘মুঘল-ই-আজম’ ছবিটি প্রথম দেখি দিল্লিতে ।
পৃষ্ঠা: ২৪
সবেমাত্র রিলিজ হয়েছে। ওখানকার সিনেমা হলগুলাে খুব জাকজমকপূর্ণ। আমাদের একমাত্র আধুনিক ‘গুলিস্তান ‘হল তখন কেবল হয়েছে। বাকিগুলাে ছিল স্রেফ গুদাম ঘর।
আমি নােয়াখালীর মিডল ইংলিশ (এমই) স্কুল থেকে প্রাইমারী পাশ করি। এরপর নােয়াখালী বেগমগঞ্জ হাই স্কুলে দুই বছর লেখাপড়া করি। ম্যাট্রিক পাশ করি খুলনা জিলা স্কুল থেকে ১৯৫৬ সালে। আমি পূর্ব পাকিস্তান স্কুল শিক্ষা বাের্ডের অধীনে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেওয়া শেষ ব্যাচের ছাত্র। ১৯৫৬ সালেই ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। ছাত্র হিসেবে আমি খুব মেধাবী ছিলাম। ভাবতাম মেট্রিকে প্রথম স্থান অধিকার করব। শিক্ষকরাও তাই মনে করতেন। পরীক্ষার ফলাফল বের হবার পর দেখলাম আমার স্থান দশের মধ্যেও নেই । পরে খোজ নিয়ে জেনেছিলাম আমার স্থান ছিল ১৮তম।
জীবনে প্রথম একটা বড় রকমের ধাক্কা খেলাম। ধাক্কা সামলাতে সামলাতে দুই বছরের মাথায় ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। বাবা-মায়ের ইচ্ছা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হই। কিন্তু আমি তাে তা হব না। যেহেতু সায়েন্সের ছাত্র, ঠিক করলাম এমন সাবজেক্ট নেব যাতে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করতে হয় না। অর্থাৎ হাতে আমার অফুরন্ত সময় থাকতে হবে। অতএব গণিত বিষয়টিকেই বেছে নিলাম।
দিল্লি থেকে ফিরে এসে কিছুতে মন বসাতে পারতাম না। একটা চিন্তা আমাকে সারাক্ষণ পীড়িত করতাে। সেটা হলাে, কেন আমাদের কোনাে কিছুই বড় নয়। প্রশ্নটা সারাক্ষণ আমার মাথায় ঘুরতাে। খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা, লাইব্রেরিতে পড়াশুনা, সবটাতেই অনাগ্রহ শুরু হলাে। আমি থাকতাম ফজলুল হক (এফএইচ) হলের ইস্ট ব্লকের ২০৪ নম্বর কক্ষে। একই রুমে থাকতেন সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আজহার আলী ও দফতর সম্পাদক সৈয়দ রেজা কাদের চৌধুরী। আমার অন্যমনস্কতা তাদের চোখে পড়ে। জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে পারতাম না। রেজা কাদের ভাই জানার চেষ্টা করতেন। এক সময় আমার মনের অবস্থাটা তাঁকে খুলে বললাম। উনি আমাকে প্রায় প্রতিদিনই তার সাথে রমনা পার্কে নিয়ে
পৃষ্ঠা: ২৫
যেতেন এবং বােঝাতে চেষ্টা করতেন কেন আমাদের কোনাে কিছু বড় নয়। বড় কিছু থাকতে হলে স্বাধীন দেশের প্রয়ােজন। আমরা তাে প্রদেশ।
তখন দেশে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন চলছে। রেজা কাদের ভাই এক রােজায় আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রদের এক ইফতার পার্টিতে নিয়ে গেলেন। গিয়ে দেখি, কিসের ইফতার পার্টি? রীতিমত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন। সামরিক শাসকদের চোখ এড়াবার জন্য ইফতারের নাম করে ছাত্রলীগের নেতা ও সিনিয়র কর্মীরা একত্রিত হয়েছে। রেজা কাদের ভাই ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে আমার নাম ঢুকিয়ে দিলেন। সেবার সভাপতি হলেন শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি। হলে ফেরার পথে কাদের ভাই কেন তিনি ছাত্রলীগ সেন্ট্রাল কমিটিতে আমার নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন তা ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, তুমি একজন সচেতন তরুণ । তােমার মতাে ছেলের পার্টিতে খুব প্রয়ােজন।
এবারে একটু পেছনের কথায় আসি। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হবার আগের দুই বছর আমার কেটেছে ঢাকা কলেজে। থাকতাম হােস্টেলে । সে হােস্টেলের নাম ছিল বেশ বাহারী- ‘বান্ধবকুটির’। আমার কক্ষ নম্বর ছিল সাত। তখনকার দিনে পাকিস্তান অবজারভার দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ এগুলােই ছিল প্রথম শ্রেণির দৈনিক। আমি নিয়মিত সব পেপারই পড়তাম। সে সময়ের দুনিয়া কাপানাে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ আমি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে লক্ষ করতাম। যেমন ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবার মুক্তি সংগ্রাম, আহমদ বেন বেল্লাহর নেতৃত্বে আলজেরিয়ার মুক্তি সংগ্রাম, ইয়াসির। আরাফাতের নেতৃত্বে প্যালেস্টাইনের মুক্তি আন্দোলন এবং হাে চি মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনামের সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম। এছাড়া কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা, কেনিয়ার জোমাে কেনিয়াত্তা, তানজানিয়ার জুলিয়াস নায়ারেরে প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য নেতা এবং তাঁদের উপনিবেশবিরােধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই আমাকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে।
পৃষ্ঠা: ২৬
১৯৫৬ সালে সুয়েজ খালের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়ে মিসরের সাথে যুক্তরাজ্য-ফ্রান্সের যুদ্ধ হয়েছিল। আমি হােস্টেলের রেডিওতে কান লাগিয়ে সে সংবাদ আগ্রহের সাথে শুনতাম।
ছােটবেলায় বাবা আমাদের একবার চট্টগ্রাম নিয়ে যান। তিনি তখন সেখানে স্কুল ইন্সপেক্টর । প্রতি রােববার বাবা আমাদের নিয়ে বেড়াতে বের হতেন। একদিন তিনি আমাদের পাহাড়ের দিকে নিয়ে গেলেন। সেদিন সারা পথ তিনি আমাকে সূর্য সেনের গল্প বললেন। জীবনে সেই প্রথম আমি একজন বিপ্লবীর জীবন ইতিহাস শুনলাম। বয়স তখন আমার মাত্র সাত বছর। আরেকদিন বাবা আমাদের সিনেমা দেখাতে নিয়ে গেলেন। সিনেমার নাম ‘চন্দ্রলেখা’। বাবা এ কে ফজলুল হক সাহেবকে খুব পছন্দ করতেন। ১৯৫৪ সাল, বাবা তখন ময়মনসিংহে জেলা স্কুল ইন্সপেক্টর। চারদিকে জোর নির্বাচনী তােড়জোড় চলছে। একদিন বাবা বললেন, ‘নদীর পাড়ে হক সাহেবের মিটিং হচ্ছে, যাও শুনে আস।’ আমি ও আমার ভাই শফিকুল আলম খান দুজনই রওয়ানা হলাম। কিন্তু মিটিংয়ে যাবার পথে দেখলাম এক মাঠে ফুটবল খেলা হচ্ছে। আমি ভাবলাম, একটু খেলা দেখে নিই । খেলা দেখতে দেখতে এমনই মজে গেলাম যে জনসভায় যাওয়ার কথা আর আমার মনে থাকলাে না। বড় ভাই কিন্তু ঠিকই জনসভায় গেলেন, বক্তৃতা শুনলেন এবং ফেরার পথে খেলার মাঠে আমাকে পেয়ে বললেন, ‘তুমি যে মিটিংয়ে না গিয়ে ফুটবল খেলা দেখেছ, সেটা আমি আব্বাকে বলে দেব।’ খেলা শেষে আমি একটু ভয়ই পেলাম। আব্বা। কী করতে বললেন, আর আমি কী করলাম! তাৎক্ষণিকভাবে মাথা খাটিয়ে একটা উপায় বের করলাম। বক্তৃতা শুনিনি, কিন্তু যে মাঠে বক্তৃতা হয়েছে সেটা তাে দেখে আসি। তাহলে অন্তত মাঠটার বর্ণনা দিতে পারব। আমি হাঁটতে লাগলাম। একটা মাঠে বহু লােক দেখে বুঝলাম এখানেই সভা হয়েছে। আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে দেখি একটা গাড়ির চারপাশে বেশ ভিড়। কে একজন বললেন, তুমি কি চাও?’ বললাম, শের-এ-বাংলাকে দেখব।’ তিনি জিপে বসা মানুষটাকে বললেন, ‘স্যার, একটা বাচ্চা ছেলে আপনাকে দেখতে চায়।’ গাড়ি ঘিরে তখনও অনেক লােক। আমি কাছে যেতেই গাড়ি থেকে একজন হাত বাড়িয়ে দিলেন। নরম তুলতুলে হাত। আমি
পৃষ্ঠা: ২৭
দেখতে খুবই ছােট ছিলাম। আমাকে দুই হাতে উপরের দিকে উঠিয়ে তিনি বললেন, “এরাই আমাদের ভবিষ্যৎ”। বুঝলাম, ইনিই হলেন শের-এ-বাংলা।
সেদিন আমি এক ধরনের ঘােরের মধ্যে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরলাম। বড় ভাই সেদিন বাবার কাছে কোনাে অভিযােগ করেনি। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, তােমার দেরি কেন?’ আমি ঘটনা খুলে বললাম। বাবা বললেন, ‘এই মানুষটি অনেক বড় একজন মানুষ। তােমাকেও ওনার মতাে হতে হবে।’ প্রসঙ্গক্রমে আগে-পরের এ রকম আরাে দু-একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে।
১৯৪৬ সাল। মাহাত্মা গান্ধী নােয়াখালী গিয়েছিলেন সেখানকার দাঙ্গা-পরবর্তী পরিস্থিতি দেখতে। এ উপলক্ষে তিনি চৌমুহনির বিদ্যামন্দির হাইস্কুলের মাঠে এক জনসভায় বক্তৃতা করেন। আমার বাবা আগেভাগে খবরটা জেনে সে সময় চট্টগ্রাম থেকে বাড়ি চলে এসেছিলেন। মিটিংয়ের দিন আমাকে ও বড় ভাইকে নিয়ে তিনি ঐ স্কুলের মাঠে উপস্থিত হলেন। তখন বেলা বারােটার মতাে। মিটিং শুরু হওয়ার কথা পাঁচটায়। কিন্তু ততক্ষণে পুরাে মাঠ উৎসাহী জনতায় পূর্ণ হয়ে গেছে। যেহেতু আমরা দুজন বাচ্চাবয়সী সে কারণে আমার বাবা আমাদের নিয়ে মাঠের মাঝখানে জায়গা করে নিলেন। আমার বয়স তখন পাঁচ বছর।
সভার সামনে উঁচু করে মঞ্চ সাজানাে। আমাদের আসার অনেকক্ষণ পর দুই-তিনজন মহিলা একজন মানুষকে—যার গায়ে বলতে গেলে কোনাে কাপড়ই নাই—মঞ্চের উপরে উঠিয়ে বসালাে । আমি অবাক বিস্ময়ে লােকটি কে তা জানতে চাইলে বাবা বললেন, ইনিই মহাত্মা গান্ধী। ওনাকে দেখাতেই তােমাদের এখানে নিয়ে এসেছি।
১৯৫২ সাল। স্কুলে গেলাম কিন্তু স্কুল হলাে না। হবে না। কেন? স্ট্রাইক। স্ট্রাইক কী? বাড়ি গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম। উনি বােঝালেন স্ট্রাইক মানে সেদিন স্কুলে কোনাে ক্লাস হবে না। পরের দিন আবারও স্কুলে স্ট্রাইক হলাে। এদিন আমাদেরকে বাড়িতে যেতে না দিয়ে চৌমুহনী স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হলাে। এ কাজ করলাে স্কুলের উপরের ক্লাসের ছাত্ররা। ট্রেন আসা পর্যন্ত আমরা দাঁড়িয়ে থাকলাম।
পৃষ্ঠা: ২৮
পরপর কয়েকদিনই এভাবে চললাে। ট্রেন আসলে হুড়মুড় করে নেমে আসা যাত্রীদের জিজ্ঞেস করা হতো, ঢাকায় কি ঘটেছে? কয়জন মারা গেছে? ইত্যাদি। ঘরে গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করতাম, এসব কি হচ্ছে?
মা বলতেন, সরকার বাংলায় কথা বলতে দেবে না। ছাত্রদেরকে মারছে। তোমার আব্বা বাড়ি আসলে তার কাছ থেকে সবকিছু আরাে ভালােভাবে শুনতে পারবে।
ছাত্রলীগে কেন ও কীভাবে এলাম
১৯৫৬ সালে ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। প্রথম দিনেই স্ট্রাইক করলাম । অনেকটা না বুঝেই। সিনিয়র কয়েকজন ছাত্র আমাদের বললেন, কলেজ হােস্টেলের দাবিতে এই স্ট্রাইক। স্ট্রাইক কি তাও আমাদের বুঝালেন। প্রথম দিনই ক্লাসে যােগ না দেয়াটা কিছুটা বেখাপ্পা মনে হলেও আমরা সেদিন কেউ ক্লাস করিনি। আজ যেখানে ঢাকা কলেজ, এটা একটা নতুন কমপ্লেক্স। আমরাই সেখানে প্রথম ব্যাচ। ঐ সময়ে জানতে পারলাম কলেজের ছাত্ররা পাইওনিয়ার্স ফ্রন্ট (Pioneers’ Front) ওরফে পিএফ ও ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট (Democratic Front) ওরফে ডিএফ নামে দু’টি অংশে বিভক্ত। আমরা পাইওনিয়ার্স ফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত হলাম। যেহেতু বান্ধব কুটিরের প্রায় সবাই পিএফ-এর ছিল । এ সময় আমাকে পক্ষে টানার জন্য সিনিয়রদের মধ্যে এক ধরনের চেষ্টা লক্ষ করলাম। পরবর্তীকালে দেখলাম শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, যিনি ছাত্রলীগের একজন প্রভাবশালী নেতা, তিনি ডিএফ-এরও নেতা।তখন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরা ডিএফ ও পিএফ, এ দুটি দলে বিভক্ত হয়ে কাজ করতাে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সময় আমি পিএফ-এ ছিলাম। নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য সিনিয়রদের তাগিদ ছিল। কিন্তু আমি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিনি।
আগেই বলেছি, কলেজের পড়া শেষ করে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে অনার্স ক্লাসে ভর্তি হই। সাবসিডিয়ারি হিসেবে। নিয়েছিলাম পদার্থবিজ্ঞান ও পরিসংখ্যান। এবার সমস্যা দেখা দিল। কোন হলে থাকবাে। ঢাকা কলেজের ভিপি আজিজ খান (পরবর্তীকালে নারায়ণগঞ্জের একজন বড় ব্যবসায়ী) একটি চিঠি দিলেন খামে ভরে। চার লাইনের চিঠি। আমার হাতে দিয়ে আজিজ ভাই বললেন, ‘দেখাে,
পৃষ্ঠা: ২৯
কী লিখেছি।’ খুললাম। খুব সুন্দর করে আমার পুরাে নাম লেখা। উনি লিখেছেন, ‘আজহার ভাই, যাকে পাঠালাম তার মতো এমন দ্বিতীয়টি আর পাবেন না। সবকিছুতেই তুখােড়।
চিঠি পড়ে আজহার ভাই এফএইচ হলে তার রুমেই আমাকে থাকতে বললেন। সেই থেকে হল বদল না হওয়া পর্যন্ত আমি সেই রুমেরই বাসিন্দা ছিলাম। একে তাে রুমটাতে ছাত্রলীগ নেতারা থাকতেন, দ্বিতীয়ত খাওয়ার আগে-পরে, অনেকদিন ইউনিভার্সিটির ক্লাস শেষ হবার পর, সে রুমে বহু ছাত্রের আসা-যাওয়া ছিল। ইফতার পাটি আয়ােজনের মাধ্যমে গোপন সম্মেলনে ১৯৬১ সালে রফিউদ্দিন চৌধুরী ছাত্রলীগের সভাপতি, শাহ মোজাম্মেল হোসেন সাধারণ সম্পাদক ও আমি কার্যনির্বাহী সদস্য হই। সে সময়ে ছাত্ররাজনীতিতে কারা নেতৃত্ব দেবে সেটা মূলত ঢাকা কলেজের ছাত্রদের দ্বারাই নির্ধারিত হতো। ঢাকা কলেজের ছাত্ররা সে সময়ে ঢাকা শহরের রাজনৈতিক আন্দোলনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭২ সালে সামরিক শাসনের মধ্যে ইফতার পার্টির নামে গােপন সম্মেলনে শাহ মােয়াজ্জেম ছাত্রলীগের সভাপতি, শেখ ফজলুল হক মনি সাধারণ সম্পাদক এবং আমি সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হই। এভাবেই প্রথমদিকে শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে আমার পরিচয়। তারপর কয়েক দিনেই আমরা দুজন খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম।
এদিকে দিল্লি থেকে ফেরার পর আমি কেমন যেন হয়ে গেলাম। পড়ালেখায় সেভাবে আয় মন বসাতে পারছিলাম না। কিন্তু ডিগ্রি তাে নিতে হবে। তার জন্য যে পড়াশােনা দরকার তা অবশ্য করতাম। ক্লাসের পড়াশােনার চাইতে বাইরের বই পড়ার দিকে ঝোক বেড়ে গেল। সে সব বই পড়তেই আমার তখন বেশি উৎসাহ। নানা জায়গা থেকে বইপত্র জোগাড় করে এনে দিতেন আজহার ভাই ও রেজা কাদের ভাই। আমি বুঝলাম কেবল একই ধরনের বইপত্র পড়লে হবে না। রাজনৈতিক জ্ঞানের ক্ষেত্রেও আমি যে রাজনীতিতে বিশ্বাস করি কেবল সে রাজনীতি বিষয়ক আন অর্জন করলেই রাজনীতি বােঝার ক্ষমতা অর্জন করা যাবে না। বরং আমার বিশ্বাসের বাইরে আরাে যেসব রাজনৈতিক ধারা রয়েছে সেগুলাে সম্পর্কেও পুরােপুরি ধারণা
পৃষ্ঠা: ৩০
আয়ত্ব করতে হবে। এই বোধ থেকে আমি সব ধরনের বই পড়ার প্রয়োজনীতা অনুভব করলাম। সাহিত্যে ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, রাজনীতিতে আআত্মজীবনীমূলক বিভিন্ন বই বা রচনা যেমন ড. আহমেদ সুকর্ণের The Autobiography of Sukarno as told to Cindy Adams, My Experiment with Truth, ও নেহেরুর Glimpses of World History ইত্যাদি আমার বেশ ভাল করে পড়া হয়ে গেল। এছাড়াও গ্রীক, রোমান, ভারতীয়, জার্মান ও ইউরোপীয় দর্শনের উপরেও অনেক বই ইতিমধ্যে পড়ে ফেললাম।
সে সময়ে ইংরেজিতে ততটা দখল না থাকায় ইংরেজিবইগুলো দুইবার করে পড়তাম। অনেক সময় যারা ইংরেজিতে অনার্স পড়তেন তাদের সাহায্য নিতাম। রেজা কাদের ভাই ইংরেজিতে খুব ভালো ছিলেন। তিনি আমাকে লেখাপড়ার ব্যাপারে সব রকম সহযোগিতা করতেন। নানা বিষয়ে আমার এই পড়াশোনার কারণে আমি এ সময় সহপাঠী ও সিনিয়র নির্বিশেষে এফ এইচ হলের ছাত্রদের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হই। আমার অন্যান্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে ছিল টেবিল টেনিস, ভলিবল, ফুটবল, ক্রিকেট ও ক্যারাম খেলা।
সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন
১৯৬১-৬২ সালের কথা। আইয়ুব খানের সামরিক সরকারের হাতে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা ও ছাত্র ধর্মঘটের মতো কর্মসূচি নেয়ার জন্য ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে আলাপে বসে ছাত্রলীগ। মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিদান গােপনে সভা করলো। সন্ধ্যা থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত মিটিং চললো ও সিদ্ধান্ত ছাড়াই সে মিটিং শেষ হয়। আমরা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ধর্মঘটের গতি হিসাবে রাতে হাতে লেখা পােস্টার সেঁটে দিলাম হলগুলাের বাইরে ও ভিতরে মেইন গেইটে, ক্যান্টিনের সামনে ও রিডিং রুমে । তখন এফ এইচ হল, ঢাকা হল (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল), এসএম হল, জগন্নাথ হল, ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ও রােকেয়া হল এ কটিই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস। আমরা রােকেয়া হল ছাড়া সব কটি হলেই পোস্টার লাগিয়ে দিলাম।
পৃষ্ঠা: ৩১
ছাত্ররা হল থেকে বের হয়ে আসার পথে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার সময় পােস্টার দেখে ক্লাস থেকে বিরত থাকলাে। তখন ক্লাস হলো আমতলা এলাকায় (বর্তমান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে) ও কার্জন হলে।
ছাত্রলীগে তখন পােস্টার লেখার দায়িত্ব ছিল রেজা কাদের ভাইয়ের। তিনি নিজের হাতে ৫০টার মতাে পােস্টার লিখে দিলেন। পােস্টারে ছাত্রদের আহ্বান জানানাে হয় : “সোহরাওয়ার্দীর মুক্তির দাবিতে ছাত্র ধর্মঘট পালন করুন।”
আবদুর রাজ্জাক তখন সবেমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। আমি ও রাজ্জাক দুইজনই মূলত রাতের অন্ধকারে পােস্টার লাগাই । সামরিক আইনে এটা ছিল গুরুতর অপরাধ, যার শাস্তি ছিল বেত্রাঘাত। এখনকার মতাে গ্লসি পেপারে চাররঙা পােস্টার ছাপানাের কথা তখন কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারতাে না। পোস্টার লেখা হতো হয় পুরনাে সংবাদপত্রের কিংবা অল্পকিছু পয়সা জোগাড় করতে পারলে সাদা নিজউপ্রিন্টের উপরে মােটা কলমে হাতে লিখে।
ধর্মঘট হওয়ার কারণে ১-২ জানুয়ারি ১৯৬২ সালে মিলিটারিরা ঢাকা হল ঘেরাও করলাে। সব ছাত্রকে ধরে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেল তারা। সব মিলিয়ে প্রায় ২৫০ জন। দুইদিন তারা ছাত্রদের ক্যান্টনমেন্টে আটকে রাখলাে। আমি হলে না থাকার কারণে গ্রেফতার হলাম না। সামরিক শাসন থাকলেও তখন হলগুলাের নির্বাচন হতাে। হলের নির্বাচিত ভিপি ও জিএসসহ দশ-বারােজনকে রেখে বাকি সবাইকে মিলিটারি গাড়িতে উঠিয়ে টঙ্গির কাছাকাছি নিয়ে ছেড়ে দেয়। এই দীর্ঘ পথ হেঁটে সবাই হলে ফিরে আসে। সামরিক বাহিনীর লােকেরা আটক ছাত্রদের নানা ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ করে। পােস্টার লেখা ও লাগানাের পিছনে কারা ছিল তা বিশদভাবে জানতে চায়।
শিক্ষা আন্দোলন চলাকালে পাকিস্তানের সংবিধান রচনার বিষয়টিও গুরুত্ব পায়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধান রচনার জন্য একটি কমিশন বা কমিটি গঠন করেছিল। ফলে ছাত্রদের আন্দোলন কেবল শিক্ষা কমিশনের বিরােধিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সংবিধানের বিষয়টিও এ সময় একেবারে সামনে চলে আসে।
পৃষ্ঠা: ৩২
আমি অনেক রাতে হলে ফিরতাম। রাতে বিভিন্ন জায়গায় কিছু কাজ করতাম। সে জন্য ফিরতে অনেক দেরি হতাে। কিন্তু কেউ জানতাে না, কী কারণে আমার রাত হয়। কারণ দর্শানাের কোন নােটিশ না দিয়েই সন্তোষজনক উত্তর না দেওয়ার অপরাধে আমাকে ফজলুল হক হল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তখন হলের প্রভােস্ট ছিলেন ড. মাজহারুল হক । এফ এইচ হল থেকে বহিষ্কৃত হবার পর আমি ঢাকা হলের আবাসিক ছাত্র হলাম। সেখানেও এক বছরের মাথায় ‘কেন সে রাতের বেলা দেরি করে আসে, যার কারণ একমাত্র সে ছাড়া আর কেউ জানে না’—এ অভিযােগে প্রভােস্ট ড. মুশফিকুর রহমান আমাকে হল থেকে বহিষ্কার করেন। ঢাকা হলে ছিলাম এক বছর। এরপরে থাকা শুরু করলাম নিমতলির একটি প্রাইভেট বাসায়। ‘নিমভিলা’ নামক ঐ বাড়িটিতে অনেক প্রাক্তন ছাত্র থাকতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষে সিএসএস (পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিস) পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য তারা ঐ বাড়িটিতে থাকতেন। অনেক রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাও থাকতেন। তাদের মধ্যে ছিলেন মনােয়ার হােসেন ও শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকও সেখানে থাকতেন।
কোনাে দেশ যদি স্বাধীন না হয় তবে সে দেশে বড় কিছুই হয় না —এমন একটি ভাবনা আমাকে সর্বক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে।
আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা
আমার সমসাময়িক (যদিও দুই বছরের ছােট) আবদুর রাজ্জাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়। সে ছিল ফজলুল হক হলের ছাত্র । হলের নির্বাচনী রাজনীতিতে আমরা দুজন একসঙ্গে কাজ করি। সেই সুবাদে আমরা একে অপরের ঘনিষ্ঠ হলাম । দিনের বেলা দুজনের কথা বলা সম্ভব ছিল না। কারণ তখন সামরিক বাহিনীর গােয়েন্দারা ছাত্রদের ভেতর কাজ করতাে। সে সময় রাজ্জাক ছিল ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আর আমি সহ-সম্পাদক।
আমার রাজনৈতিক বই পড়ার আগ্রহ এবং নানা বিষয়ে জানাশােনা দেখে রাজ্জাক একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলাে, আমি আমার
পৃষ্ঠা: ৩৩
পাঠ্যবিষয়ের বাইরে এত লেখাপড়া করি কেন? আমি তাকে আমার বাবার উপদেশের কথাটি বললাম। বললাম পৃথিবীতে বড় হতে হলে জ্ঞান আহরণের প্রয়ােজন সবচেয়ে বেশি।
১৯৬২ সালে সােহরাওয়ার্দীর মুক্তির দাবিতে পােস্টার লাগানাের সেই ঘটনার পর আমাদের দুজনের আলাপ-আলােচনায় প্রথমে আকারে-ইঙ্গিতে ও তারপর সুস্পষ্টভাবে যে-কথাটা বেরিয়ে আসতে লাগলাে তা হলাে, স্বাধীনতা ছাড়া কোনাে জাতি বেশি দূর এগুতে পারে। উপরন্তু, বারশত মাইল দূরে থেকে একটি রাষ্ট্র কেবল সামরিক শক্তি দিয়ে আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করবে, তার উপনিবেশের মতাে ব্যবহার করবে, আমাদের সম্পদগুলাে নিয়ে যাবে এবং তার বদলে আমাদের উপর অত্যাচার-নিপীড়ন চালাবে, তা হতে পারে না। তেমন একটি দেশে বাস করার অর্থ নিজের চিন্তা-চেতনা ও স্বপ্নকে পরাধীনতার মােড়কে চিরতরে আবদ্ধ করে রাখা। পাকিস্তানের সঙ্গে থাকা সে-অর্থে আমাদের জন্য এক ধরনের পরাধীনতা। প্রায় প্রতি দিনই গভীর রাত পর্যন্ত আমরা এসব বিষয় নিয়ে আলােচনা করতাম ।
আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে আমার এসব আলােচনা হতাে মূলত কার্জন হল প্রাঙ্গণে ও ফজলুল হক হলের পুকুর পাড়ে। আমি ঢাকা কলেজে থাকাকালে একদিন কলেজ ছুটির পর কলেজ অডিটরিয়ামে কামরুদ্দীন আহমদের (তখন জাতিসংঘে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য) একক বক্তৃতার আয়ােজন করা হয়। সেদিন তার বক্ততা আমার শুধু ভালােই লাগেনি, আমার মনে হলাে রাজনীতির জ্ঞান অন্য সব জ্ঞানের উর্ধ্বে। বক্তৃতায় তিনি আন্তর্জাতিক বিষয়সমূহের অতি সুন্দর বিশ্লেষণ করলেন। যেমন, মিসরের বিরুদ্ধে সুয়েজ খালকে কেন্দ্র করে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ এবং প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে নেহেরু, স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের মধ্যে জোমাে কেনিয়াত্তার কথা বললেন। এঁদের ভূমিকা কিভাবে একটা জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারে সেটাও বুঝলাম। এসব আমার চিন্তার জগতে নতুন মাত্রা যােগ করলাে।।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কয়েক মাস পরে একদিন কামরুদ্দীন আহমদের সঙ্গে যােগাযােগের জন্য সদরঘাটে জেলা বার
পৃষ্ঠা: ৩৪
লাইব্রেরিতে গেলাম। তিনি এ্যাডভােকেট ছিলেন। দেখা হবার পর বাসায় যেতে বললেন। ঠিকানা নিলাম ও কয়েক দিনের মধ্যেই ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় তাঁর বাসায় গেলাম। প্রথমে আমি একা এবং পরে রাজ্জাক ও আমি নিয়মিত যেতাম। তবে সে যাওয়া সবসময়ই রাতের বেলায় হতাে। কারণ সামরিক গােয়েন্দারা আমাদের উপর কড়া নজর রাখতো বলে আমাদের ধারণা। সেটা ১৯৬০-৬১ সাল। কামরুদ্দীন সাহেব দেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ ও তাতে অংশগ্রহণের ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ দেখে নিয়মিত তার সাথে যােগাযােগ রাখতে বললেন। তিনি তাঁর আলােচনাতে সব সময় রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস ও দর্শনের উপরে গুরুত্ব দিয়ে রাজনীতিচর্চার কথা বলতেন।
এখানে বলা বােধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কামরুদ্দীন সাহেবের ছােট ছেলে আজাদ শহীদ হয়েছিলেন। ঐ নয় মাসে পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা কামরুদ্দীন সাহেবকে নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতন করে। জুলাই মাসে তাকে ধরে নিয়ে যায় ও তিন মাস জেলে বন্দি করে রাখে।
১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে আমি জেল থেকে বেরিয়ে লন্ডনে যাই। যাবার আগে একদিন কামরুদ্দীন আহমদ সাহেবের সাথে দেখা করি। তবে সেদিন তাঁর সঙ্গে সেভাবে আলােচনা করতে পারিনি। লন্ডনে গিয়ে তাকে চিঠি লিখি । তিনি আমার চিঠির উত্তর দেন এবং সে উত্তর থেকে আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারি। চিঠিতে তাঁর ছেলে আজাদের মৃত্যুর বিষয়টি ছিল। সেই সঙ্গে লিখেছিলেন, কোনাে এক গােয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সরকার তার সঙ্গে আমার যােগাযােগের ব্যাপারটি জানতে পারে এবং এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করে। ভবিষ্যতে কোনাে বড় ধরনের রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি আমাকে সতর্ক থাকতে বলেছিলেন। এটাই তােমার সাথে আমার শেষ যােগাযােগ। শরীর এতই খারাপ যে কয়েকদিনের মধ্যে মারা যাব। আমার কর্তব্য মনে করেই তােমাকে মৃত্যুর আগে কথাটি বলে গেলাম। আমি লন্ডনে থাকতে তিনি মারা যান।
পৃষ্ঠা: ৩৫
দিল্লি ভ্রমণের সময় যে প্রশ্নটা আমার মনে জেগেছিল, সেটা তখনও মাথায় রয়ে গিয়েছিল। মাঝে আমি একবার ছুটিতে বাবা-মার সাথে দেখা করতে বরিশাল ও নােয়াখালীতে গেলাম। তখন বাবার সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলাম। সব কথার পর তিনি আমাকে বললেন, তুমি যাই কর আমার আপত্তি নাই, কিন্তু তােমাকে কমপক্ষে ডিগ্রিটি নিতে হবে।
বাবা আমাকে তার যুক্তরাজ্যের এডিনবরাতে তিন বছর থাকাকালীন লেখা ডায়েরিগুলাে পড়তে দিলেন। সেটা ছিল আমার জীবনে আরেক নতুন অভিজ্ঞতা। পূর্ব পাকিস্তান বা পাকিস্তানের বাইরে অন্য কোনাে দেশ সম্পর্কে জানার জন্য এ ডায়েরি আমার খুবই কাজে লাগে। মিথ্যা কথা না বলা, অজুহাত না দেখানাে, যার যার নিজের কাজে মনােযােগী হওয়াসহ উন্নত দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যগুলাের সঙ্গে প্রথম আমি ঐ ডায়েরি পড়েই পরিচিত হই। বাবা ইংল্যান্ড থেকে ফেরার সময় কয়েকটি স্যুট নিয়ে এসেছিলেন। সাথে দুই জোড়া জুতাে, কয়েকটি পার্কার কলম। সেই থেকে পার্কার কলম ছাড়া আর কোনাে কলম আমি ব্যবহার করি না। এছাড়া ওমেগা ঘড়ি, হ্যাট, হাফপ্যান্ট, ঘােড়ায় চড়ার ব্রিচেস ও লাঠিসহ বিলাতি অনেক জিনিসের সঙ্গেও আমি পরিচিত হলাম।
বাবার সঙ্গে আমি রাজনীতির কথাও আলাপ করলাম। তিনি বললেন, দেশে যে রকম রাজনীতি হয় তাতে তুমি তার সঙ্গে জড়িত হলে তােমার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। আলাপের এক পর্যায়ে তিনি দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে ফজলুল হক ও সােহরাওয়ার্দী এবং ভারতের গান্ধী ও নেহেরুর কথা বললেন। ব্রিটেনের তৎকালীন বড় বড় রাজনীতিবিদের কথা বললেন। আমেরিকার আব্রাহাম লিংকনের কথাও বললেন । দেশের জন্য এরা যে নানা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সে কথা বললেন।
আমার বাবা নিজেও গণিতে গ্রাজুয়েট ছিলেন। পাশ করে তিনি চাকরি-জীবনে প্রবেশ করেন। এক পর্যায়ে সরকারি চাকরিতে ঢােকেন। তারপর ব্রিটিশ বেঙ্গল থেকে পাঠানাে দুইজনের একজন
পৃষ্ঠা: ৩৬
হিসাবে বৃত্তিসহ উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি বিলাতে যান। অপরজন ছিলেন ড. এফ আর খান ও ড. জিল্লুর রহমান খানের চাচা আবদুর রাজ্জাক খান।
নিউক্লিয়াস : স্বাধীন বাংলার শক্তিকেন্দ্র
আরেকটি বক্তৃতাও আমার মনে গভীর দাগ কেটেছিল। ১৯৫৮ সালে ঢাকায় বিজ্ঞানবিষয়ক একটি জাতীয় সংগঠনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কার্জন হলের সে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন যুক্তরাজ্যের রানী এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপ । প্রধান বক্তা ছিলেন পরবর্তীকালে নােবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. আবদুস সালাম। প্রফেসর সালামের বক্তৃতা আমি সম্মেলনে বসে শুনি ও বক্তৃতার ছাপানাে কপি সংগ্রহ করি। সে সময়ে নিরাপত্তার এত কড়াকড়ি ছিল না। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ তথা মানুষের জীবনের সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রকৌশলকে মিলিয়ে বুঝতে হবে—তার ঐ বক্তৃতা থেকে আমি এই শিক্ষা পেলাম। ছােট আকারের বুকলেটটি আমি কুড়ি বারের বেশি পড়েছি। রাজনীতি বুঝতে হলে তার জন্য যে ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি, সমাজ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি সম্পর্কে জ্ঞানের আবশ্যকতা রয়েছে, মিটিং-মিছিল ভিত্তিক রাজনীতি ছাড়াও ঐসব বিষয়ে জ্ঞানচর্চাও যে জরুরি, সেটা উপলব্ধির পর সে সব বিষয়ে জ্ঞান আহরণও আমার দৈনন্দিন কাজের অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে আলাপের পর ঢাকা শহরের বিভিন্ন কলেজ, বিশেষ করে ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, কায়েদে আযম কলেজ (বর্তমানের সােহরাওয়ার্দী কলেজ), তিতুমীর কলেজ ও ইডেন গার্লস কলেজ পর্যায়ে আমাদের সাংগঠনিক যােগাযােগের গুরুত্ব বেড়ে যায়। ১৯৬১ সালে শেখ ফজলুর হক মনি একটু অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমাকে এক বছরেরও বেশি সময়ের জন্য ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ সময় ঢাকা ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় জেলা পর্যায়ের নামকরা কলেজসমূহের সঙ্গে আমার যােগাযােগ স্থাপন করতে সুবিধা হয়। চিঠিপত্রের মাধ্যমে এই যােগাযােগ হতাে। খবরের কাগজের ভেতরের পাতায় তখন সারা
পৃষ্ঠা: ৩৭
দেশের বিভিন্ন কলেজের নবাগত ছাত্রছাত্রী সংবর্ধনার খবরাখবর ছোট আকারে হলেও ছাপা হতাে। আমি সেসব কলেজ সংসদের সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের নাম সংগ্রহ করে তাদেরকে নিয়মিত চিঠি লিখতাম। উত্তরও পেতাম। চিঠিপত্রে এই যােগাযােগের মাধ্যমে সারা দেশের নেতৃস্থানীয় ছাত্র ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের সাথে আমার নিয়মিত ও গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
এই বয়সেও অনেকে আমাকে বলেছেন, ঐ চিঠির কারণেই তারা ছাত্র রাজনীতি শুরু করেছিলেন। তাঁদের দুই-একজনের নাম এ প্রসঙ্গে না বললেই নয়। যেমন মুন্সিগঞ্জের মহিউদ্দিন (সংসদ সদস্য হয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা ছিলেন) ও যশােরের মরহুম আলী তারেক (তিনিও জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন)। এ রকম অনেকে সেই পুরনাে চিঠি আমাকে দেখিয়েছেন।
১৯৬১-৬২ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে আমি সারা বাংলাদেশের কলেজ পর্যায়ের ছাত্র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যােগাযােগ করে ফেলি। ইতিমধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি তাঁর প্পখালাতাে বােন সেরনিয়াবাত সাহেবের মেয়েকে বিয়ে করেন। একা বছর এগার মাস আমি ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করার পর হঠাৎ মনি এসে বললেন, তিনি আবার কাজ করবেন এবং ১৯৬২-এর শেষদিকে তিনি কাজ করতে শুরু করলেন। এ সময়ই খুবই তীক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন অথচ স্বল্পভাষী এক তরুণ কাজী আরেফ আহমেদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সে তখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। মাত্র আইএ পাশ করে বিএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। আরেফের মধ্যে
ঘটনার ভেতরে না থেকেও আড়াল-অন্তরাল থেকে ঘটনা পর্যবেক্ষণ, পরিকল্পনা ও কাজ করার যােগ্যতাসম্পন্ন একজন তরুণকে খুঁজে পেলাম সাধারণ আলাপ আলােচনার মধ্য দিয়ে আমরা একে অপরের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি।
প্রাথমিকভাবে দেখলাম ছাত্র হিসাবে অতি মেধাবী না হলেও কাজ করার যে দক্ষতা এবং শৃঙ্খলা ও নৈপুণ্য আরেফের আছে তা এর আগে আমি আর কারাে মধ্যে দেখিনি। আমরা দুইজন যখন আলাপ করতাম অনেক সময়ে প্রাথমিকভাবে দ্বিমত করলেও সিদ্ধান্তের পর
পৃষ্ঠা: ৩৮
মুহূর্তে সিদ্ধান্তের আগের দ্বিমতকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে সিদ্ধান্তভিত্তিক কাজ করার মানুষও আমি এর আগে পাইনি। প্রয়ােজনে-অপ্রয়ােজনে অনেককে সে সন্দেহের চোখে দেখতাে। এটা ছিল তার স্বভাবজাত । একদিন রাজ্জাককে আমি তার সম্পর্কে বিশদভাবে বললাম। একবার তিনজন এক সাথে বসলামও। স্থান, তখনকার দিনের আউটার স্টেডিয়ামের কাঠের গ্যালারি। সময়, রাত নয়টার পর। মাস, নভেম্বর- ডিসেম্বর। সাল ১৯৬২। এই সময়ে আরেক তরুণ ছাত্রনেতা ও দক্ষ সংগঠক আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে আমার যােগাযােগ হয়। চিঠির মাধ্যমে আমার সাথে যুক্ত হওয়াদের সেও একজন। যশাের এমএম কলেজের ছাত্র থাকার সময় সে ও আলি তারেক ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলনে যশাের-খুলনা এলাকায় ছাত্র সমাজের নেতৃত্ব দিয়েছিল। যশাের থেকে আসা এই ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিভাগে ভর্তি হবে সে বিষয়ে আমার কাছে পরামর্শ চাইলে আমি তাকে সমাজবিজ্ঞানে ভর্তি হতে বলি । অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে ঐ বিভাগে ভর্তি হয়। বিভাগটি সম্পর্কে সে সময়ে ছাত্রদের স্পষ্ট কোনাে ধারণা ছিল না। শিক্ষা আন্দোলন চলার সময় ঐ এক বছরেই আমি, রাজ্জাক, আরেফ ও আজাদ ঘনিষ্ঠ হই। শিক্ষা আন্দোলন ও প্রাসঙ্গিক রাজনীতি নিয়ে আমাদের মধ্যে নিয়মিত আলােচনা হতাে। আমাদের আলােচনার বিষয়ের মধ্যে ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য, অগণতান্ত্রিক সেনাশাসন, বাংলার পরিবর্তে কৌশলে সরকারের নানা কর্মকাণ্ডে উর্দুর প্রচলন, জেল-জুলুম-নির্যাতন ইত্যাদি। কেবল যে সে সব বিষয়েই আমরা কথা আলােচনা করতাম তা নয়। কী করে পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসা যায় সে বিষয় নিয়েও কথা বলতাম। বলতাম, পাকিস্তান থেকে আলাদা না হলে আমাদের গণতন্ত্র ও মুক্তি কোনােটাই আসবে না। সবাই আমরা এ বিষয়ে একমত হতাম,। কিন্তু তার পরে কী করতে হবে তা নিয়ে একমত হতে পারতাম না। লক্ষ্য নির্ধারণ করে ফেলেছি, এখন সে লক্ষ্য হাসিলের উপযুক্ত পথ পদ্ধতি বের করতে হবে।
সােহরাওয়াদী সাহেব মুক্ত হয়েই করাচি থেকে ঢাকার ছাত্রদেরকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে ইংরেজিতে বলেছিলেন, I kiss them, I hug them (আমি তাদের চুম্বন করি, আমি তাদের বুকে জড়িয়ে ধরি)। এই
পৃষ্ঠা: ৩৯
বাক্যটি নিয়ে তখন দেশের রাজনীতিতে হাস্য-কৌতুকের সৃষ্টি হয় এবং অনেকে এ নিয়ে হালকা রুচির মন্তব্যও করেন। অথচ এটি যে কত সুন্দর একটি অভিব্যক্তি তা অনেকেই বুঝতে পারেননি। ১৯৬২ এর পুরাে বছরটি ধরেই শিক্ষা কমিশন রিপাের্ট বিরােধী ছাত্রদের এআন্দোলন চলে। কমিশনের সুপারিশে তিন বছরের বিএ পাস কোর্স, অনার্সে সেমিস্টার ব্যবস্থা চালু ইত্যাদি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তিন বছরের বিএ পাস কোর্সের বিরােধিতা করতে গিয়েই এই আন্দোলন শুরু হয়। সরকার বাধ্য হলাে দাবি মেনে নিতে। অনার্সে সেমিস্টার দেওয়ার কোনো দাবি ছাত্রদের ছিল না, কিন্তু সেটিও বাতিল করা হলাে।
শিক্ষা আন্দোলন চলাকালে ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬২ মিছিলে পুলিশের গুলিতে মােস্তফা, বাবুল, ওয়াজিউল্লাহসহ এগারাে জন ছাত্রের মৃত্যু হয়। দোয়েল চত্বর থেকে সচিবালয়ে যাবার পথে হাইকোর্টের পুরােনাে গেটের সামনে, বর্তমান শিক্ষাভবনের পশ্চিম পাশে সেই শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে পাওয়া যায়। সেদিন আমি ছিলাম মিছিলের একেবারে প্রথম সারিতে। দলমত-নির্বিশেষে প্রায় সব। ছাত্রনেতাই সেদিন মিছিলে ছিলেন। প্রসঙ্গত বলা দরকার, সামরিক শাসন থাকার কারণে সে সময়ে সব রাজনৈতিক দলই বলতে গেলে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছিল। ছাত্রলীগের শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, শেখ ফজলুল হক মনি, আসমত আলী সিকদার (পরে সাংসদ); ছাত্র ইউনিয়নের কাজী জাফর আহমদ, হায়দার আকবর খান রনাে, রাশেদ খান মেনন, রেজা আলী, আবদুর রহিম আজাদ; এনএসএফ-এর আবুল হাসনাত ও আনােয়ার আনসারি খান, ছাত্রশক্তির রেজাউল হক সরকার ও ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতারা ঐ মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন।
পুলিশের গুলি হয়েছিল মিছিলের শেষভাগে। পুরনাে হাইকোর্টের গেট থেকে মিছিলের পিছন দিকের ছাত্ররা পুলিশকে ইট-পাটকেল ছুড়ছিল। গুলির পরপরই আমি মিছিলের সামনে থেকে পেছনে এসে বিশৃঙ্খল ভাব দেখলাম। দেখলাম একটি ছেলে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে। আমি তাকে কোলে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমতলার দিকে রওয়ানা হই। আমার পিছনে পুরাে মিছিলটি আমতলায় এসে জড়াে হলাে। প্রায় তিন-চার হাজার ছাত্র। ছেলেটিকে কোলে করে নেয়ার সময় আমার খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি রক্তে ভিজে গিয়েছিল।
পৃষ্ঠা: ৪০
সবাই মনে করলাে আমিই বুঝি গুলি খেয়েছি। এই মনে করে অনেকে গরম বক্তৃতাও দিয়ে ফেললেন। আমি হাতের ইশারায় জানালাম আমি গুলিবিদ্ধ হইনি। গুলিবিদ্ধ একজনকে বহন করে আনার ফলেই আমার গায়ে এত রক্ত। ফলে উত্তেজিত বক্ততা ওখানেই শেষ হয়। আমরা এরপর আবারও মিছিল নিয়ে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করি। তখনকার পৌরসভাভিত্তিক ঢাকা শহর ও আজকের দুই সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ঢাকা শহরের পার্থক্য এখন কল্পনাও করা যাবে না। ঢাকার জনসংখ্যা তখন ছিল বারাে লাখের মতাে। এখন প্রায় দুই কোটি। আমতলা অর্থাৎ এখনকার শহীদ মিনার থেকে শুরু করে সচিবালয়ের সামনে দিয়ে সলিমাবাদ রেস্টুরেন্ট (পীর ইয়ামেনি মসজিদের রাস্তার অপর পারে) হয়ে গুলিস্তানের পাশ দিয়ে গােটা নবাবপুর রােড, সদরঘাট, ইসলামপুর রােড, লালবাগ হয়ে সেন্ট্রাল জেলের পাশ দিয়ে চানখারপুল হয়ে আবার আমতলায় এসে মিছিল শেষ কললাম। আমি সব সময় সব মিছিলের সামনে থাকতাম। অন্যান্য দলের নেতারা পালাক্রমে থাকতেন। এছাড়াও সব ছাত্র সভার আয়ােজন, পােস্টার লাগানাে, মিছিল করা, বক্তৃতা দেয়া এইসব কাজ প্রধানত আমাকেই করতে হতাে। আমার এই সার্বক্ষণিক উপস্থিতি ও অংশগ্রহণের কারণে আমি ছাত্র নেতৃত্বের একজন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে সকলের কাছে পরিচিত হয়ে যাই।
আন্দোলনের এ পর্যায়ে আমরা চারজন (আমি, আবদুর রাজ্জাক, কাজি আরেফ আহমেদ ও আবুল কালাম আজাদ) ঘন ঘন একে অপরের সঙ্গে মিলিত হতে পারতাম। আমি, রাজ্জাক ও আজাদ হলে থাকতাম। আরেফ টিকাটুলিতে তাদের নিজস্ব বাড়িতে থাকতাে।
পল্টন ময়দানের কাঠের গ্যালারিতে প্রতি রাতেই আমাদের তিন- চার ঘন্টাব্যাপী আলাপ-আলােচনা হতাে। পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে টিকে থাকতে পারার সম্ভাবনাই ছিল সে সময় আমাদের এসব আলােচনার কেন্দ্রীয় বিষয়। ১৯৬২-র নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে আমরা স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে আসলাম এবং চারজন একসাথে কাজ করার শপথ নিলাম।
এরপর থেকে আমরা কাঠের গ্যালারিতে বসা কমিয়ে ইকবাল হলের মাঠে বসতে শুরু করলাম। এ পর্যায়ে আমাদের একটি সংগঠন
পৃষ্ঠা: ৪১
থাকা উচিত—এই উপলব্ধি থেকে আমরা চারজনকে নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় সেল (নিউক্লিয়াস) গঠনের সিদ্ধান্ত নিলাম। ছাত্র আন্দোলন চলাকালেই ১৯৬২-এর শেষভাগে কয়েকজন ছাত্রনেতার নামে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি করা হয়। শাহ মােয়াজ্জেম ও ফজলুল হক মনি প্রথম তালিকায় ছিলেন। সে তালিকায় আমার ও রাজ্জাকের নাম ছিল না। মােয়াজ্জেম ভাই ও ফজলুল হক মনি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আগের রাতে তারা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যান এবং পরদিন আত্মসমর্পণ করেন।
পরবর্তীকালে আমার মনে হয়েছে, ১৯৬১ সালে ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট (EPLF)-এর লিফলেট বিলির পর থেকেই তারা ছাত্র আন্দোলন থেকে দূরে সরে যান। আমরা বাকিরাও বিষয়টি অর্থাৎ ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট নিয়ে আর কোনাে কাজ করিনি।
ইপিএলএফ-এর লিফলেট
ইপিএলএফ-এর লিফলেটের মূল বিষয় ছিল পাকিস্তানের দুই অংশের অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র এবং এই সমস্যার একমাত্র সমাধান হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার বিষয়টিকে তুলে ধরা।
লিফলেটটি ছিল এক-ষােড়শাংশ ফৰ্মা, অর্থাৎ বইয়ের পাতার এক পৃষ্ঠা আকারের। ভাষা ও বানানের অনেক ভুল ছিল। ১৯৬১ সালের মাঝামাঝি এই লিফলেটটি বিলি করা হয়। আমি ঢাকা হলে, মনি জগন্নাথ কলেজ ও এসএম হলে, রাজ্জাক এফএইচ হলে এ লিফলেট বিলি করি । আমাদের প্রত্যেককে ২০০ কপি করে লিফলেট দেওয়া হয়েছিল।
শিক্ষা কমিশন ও আইয়ুবি সংবিধান প্রণয়ন বিরােধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের গােটা বছরটা কেটে গেল। আন্দোলনের কর্মব্যস্ততার মধ্য দিয়ে আমাদের চারজনের মেলামেশায় ও রাজনৈতিক আলাপ-আলােচনায় স্বাধীনতার বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্ব নিয়ে উঠে আসে। ১৯৬২-র নভেম্বর-ডিসেম্বরে আমরা আউটার স্টেডিয়ামের কাঠের গ্যালারিতে বসে স্বাধীনতার লক্ষ্যে গােপন সংগঠন গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
ইকবাল হলের মাঠে আমাদের চারজনের গােপন বৈঠকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে গঠিত এই গােপন বিপ্লবী গ্রুপের নাম ‘নিউক্লিয়াস’
পৃষ্ঠা: ৪২
রাখার সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তী সময়ে আমরা একে ‘স্বাধীন বাঙলা নিউক্লিয়াস’ও বলতে শুরু করি।
বছর জুড়ে আন্দোলন চলাকালে ঢাকা শহর ছাড়াও চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নােয়াখালী, বরিশাল, খুলনা, যশাের, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, রংপুর, টাঙ্গাইল, পাবনা, কুষ্টিয়া, বগুড়া ও মানিকগঞ্জে কোথাও একজন, কোথাও দুইজন করে স্বাধীন বাঙলা নিউক্লিয়াস-এর সাথে জড়িত হতে পারে এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আমাদের যােগাযােগ হয়ে যায়। অবশ্য এরা আগে থেকেই আমাদের মতাদর্শের অনুসারী ছিলেন। চট্টগ্রামে এম এ মান্নান (পরবর্তীকালে মন্ত্রী), কমিল্লায় হাবিবুল্লাহ চৌধুরী ও আনসার উদ্দিন, নােয়াখালীতে আ স ম আবদুর রব, মােস্তাফিজুর রহমান ও মাহমুদুর রহমান বেলায়েত, বরিশালে আবদুল বারেক ও জহিরুল ইসলাম খান পান্না, খুলনার শেখ কামরুজ্জামান টুকু, যশােরে মনি ও রবিউল আলম, রাজশাহীতে ডাক্তার এম এ করিম, ময়মনসিংহে চঞ্চল ওহাব মিঠু, রংপুরে সােহাগ, টাঙ্গাইলে সা’দত কলেজের ভিপি গােলাম কায়সার খান ফারুক, পাবনায় আহমদ রফিক, বগুড়ায় ফজলুর রহমান পটল ও সুরুজ, মানিকগঞ্জে বিন্টু ও কুষ্টিয়ায় আমিনুল হক বাদশাকে সরাসরি নিউক্লিয়াসের নাম না বলে ভিন্ন ভিন্নভাবে গােপন সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরা আন্দোলনের সময় বিভিন্ন স্কোয়াড গঠন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট করার কাজে নিয়ােজিত থাকতাে। জঙ্গি মিছিল করার সময় এদের ভূমিকা থাকতাে সবার চোখে পড়ার মতাে। ছাত্রলীগের বাছাই করা এ সদস্যরা পরবর্তী সময়ে নিউক্লিয়াস’-এর বিভিন্ন পর্যায়ের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে একটি স্কোয়াডে ছিলেন।
১৯৬২-র ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে তিন সপ্তাহ এবং পরের বছরও অর্থাৎ ১৯৬৩-এর ফেব্রুয়ারিতে আমাদের উদ্যোগে গাড়ির নাম্বার প্লেট ও দোকানের সাইনবাের্ড বাংলায় লেখার কার্যক্রমটি খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
এ সময়ই আমরা ‘বিপ্লবী বাংলা’ নামে অনিয়মিতভাবে একটি হাতে লেখা পত্রিকা গােপনে বের করতাম । মাসিক হিসেবে দশ-বারাে
পৃষ্ঠা: ৪৩
সংখ্যা প্রকাশের পর আমরা পত্রিকাটি বন্ধ করে দিই। এই পত্রিকাতেই আমাদের গােপন সংগঠনের রিক্রুটমেন্ট পদ্ধতিটা প্রথম প্রকাশিত হয়। যিনি রিক্রুট করবেন তিনি তার নিচের সবার পরিচয় জানবেন। তাকে যিনি রিক্রুট করেছেন তিনি কেবল তাকেই চিনবেন। যিনি রিক্রুট করবেন তার নাম নির্বিগ, তাকে যিনি রিক্রুট করেছিলেন তিনি হবেন ‘উবিগ’। সংগঠনের নিয়ম-শৃঙ্খলা ইত্যাদি বিষয়েও পত্রিকায় বিস্তারিত তুলে ধরা হতাে। মিথ্যা কথা না বলা, বিপ্লবী বইপত্র পাঠে মনােযোগী হওয়া, পায়ে হেটে বহুদূর অবধি যাতায়াত করা, রাত জাগা, গালগল্পে মেতে সময় নষ্ট না করা, সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে আরও শক্তিশালী করার কাজে নিয়ােজিত থাকা—এসবই ছিল তাদের প্রাত্যহিক কর্ম তালিকার অন্তর্ভুক্ত। আন্দোলন ও ছাত্রলীগের কাজে নিয়ােজিত থাকার সময়েই তারা যে বিভিন্ন পর্যায়ে স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’-এর পক্ষে কাজ করছে এবং সদস্য হয়েছে তা তাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যেত।
১৯৬২-‘৬৩ সালে ঢাকাসহ সারাদেশে নিউক্লিয়াস’-এর সদস্যসংখ্যা ছিল ৫০ থেকে ৬০ জন। এরা ছাড়াও প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ জন পর্যবেক্ষণে ছিলেন। ১৯৬৩ সালের প্রথমদিকে রাজ্জাক ও কিছুদিন পর আমি গ্রেফতার হয়ে যাই। ১৯৬৩-এর মাঝামাঝি সময়ে তৎকালীন পাকিস্তান মাঠে (বর্তমানে বাংলাদেশ মাঠ) ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়। সে সম্মেলনের মাধ্যমে ওবায়দুর রহমান সভাপতি ও আমি সাধারণ সম্পাদক হই। আমার সাধারণ সম্পাদক হবার ফলে ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’ সারাদেশের ছাত্র সমাজের মধ্যে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার একটি বড় ধরনের সুযােগ লাভ করে ।
সে সময়ে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের অধিকাংশই ছিলেন ‘নিউক্লিয়াস’-এর সদস্য। আমার নেতৃত্বে ও তাঁদের উদ্যোগে আমাদের গােপন সংগঠনের পরিধি অনেক বেড়ে যায়। আমার সম্পাদক পদ লাভে বাধা সৃষ্টি করার জন্য শেখ ফজলুল হক মনি ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আবদুল হাই সাচ্চুসহ আরও কয়েকজনকে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী করতে চেয়েছিলেন। ঢাকা শহরসহ সব জেলার প্রতিনিধিদের চাপে তাঁদের প্রচেষ্টা বেশি দূর এগুতে পারেনি। সে সময় কাজী আরেফ আমাকে সাধারণ সম্পাদক করতে বড় ভূমিকা
পৃষ্ঠা: ৪৪
পালন করেছিল। তখনও আমরা গােপনে ঢাকার বাইরে গিয়ে কিছু ছাত্র সংগ্রহ করে জেলা সম্মেলন করতাম। সেই সুযোগে জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে আমাদের গোপন সংগঠনের রিক্রুটমেন্ট করা সহজ হতাে। একই কারণে ঢাকাসহ কোনাে জেলা বা মহকুমাতে আমাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দাঁড়ানাে কারাে পক্ষে সহজ ছিল না। কখনও কখনও কোথাও যে দুই-একজন ‘নিউক্লিয়াস’-এর রিক্রুট করা সদস্যদের বিরােধিতা করার চেষ্টা করতাে, দেখা যেত তাদের প্রায় সকলেই ছিল শেখ ফজলুল হক মনির আশীর্বাদপুষ্ট ।
পাকিস্তান মাঠের ঐ সম্মেলনের মাস দুয়েক আগে শাহ মােয়াজ্জেম ভাই আমাকে একদিন জিন্নাহ এভিনিউর আলফা ইস্যুরেন্স কোম্পানিতে নিয়ে যান। আমাকে ওয়েটিং রুমে বসতে বলে তিনি ভিতরে চলে গেলেন। চার-পাঁচ মিনিট পরে এসে আমাকেও ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভিতরে গিয়ে আমি যাকে দেখলাম তিনি এ কোম্পানির বড় কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন সেটি জানতাম, কিন্তু আগে কোনাে দিন তার সঙ্গে আমার সরাসরি দেখা বা কথা হয়নি। শাহ মােয়াজ্জেম ভাই আমাকে শেখ মুজিবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। শেখ মুজিব তখন পূর্ব পাকিস্তানে আলফা ইস্যুরেন্স কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। শুনেছি তাঁর বেতন ছিল মাসে প্রায় দুই হাজার টাকা। আলফা ইস্যুরেন্সের মালিক ছিলেন পাকিস্তানের এক অতি ধনাঢ্য ব্যক্তি ও প্রখ্যাত শিল্পপতি ইউসুফ হারুন। ভাম এন্ড কোম্পানির পাশের বিল্ডিং-এর দোতলায় ছিল আলফা ইস্যুরেন্সের অফিস। শেখ সাহেবের রুমে মােয়াজ্জেম ভাই ও আমি বসলাম। তিনি আমাদের চা খাওয়ালেন। এক পর্যায়ে বললেন, ‘তাের এত কম বয়স, তুই রাজনীতি করবি? তাের ব্যাপারে আমি খোঁজখবর নিয়েছি। তাের আব্বা রিটায়ার করার আগে যখন ফরিদপুর-বরিশাল রেঞ্জে ডিডিপিআই ছিলেন তখন আমাদের বাড়ির হাইস্কুলের অনুমতি দেওয়ার আগে একবার ভিজিটে এসেছিলেন। আমাদের স্কুলের বাড়ি দেখে তাের আব্বা বলেছিলেন, যে স্কুলের এত বড় বিল্ডিং আছে সে স্কুলের কেন প্রতি দুই বছর অন্তর রেজিস্ট্রেশন করাতে হবে? এর তাে স্থায়ী রেজিস্ট্রেশন থাকা উচিত। তিনি স্থায়ী রেজিস্ট্রেশনের জন্য রিকমেন্ড করেন এবং তা বাস্তবায়িতও হয়েছিল।
পৃষ্ঠা: ৪৫
আলাপের এক পর্যায়ে তিনি একটা সাদা কাগজ নিয়ে তাতে কলম দিয়ে কয়েকটা নাম লিখলেন। শেখ ফজলুল হক মনি,ওবায়দুর রহমান, সিরাজুল আলম খান। তারপর মােয়াজ্জেম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মনি সভাপতি, ওবায়দুর রহমান সাধারণ সম্পাদক, সিরাজ সংগঠনিক সম্পাদক-‘দেখ তাে এভাবে কেমন হয়?’ এরপর কথা আর এগােয়নি। মােয়াজ্জেম ভাই আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন।
সে সময়ে আমার বয়স একুশ বছর। আমার মনে প্রথমেই যে প্রশ্নটি জাগলাে তা হলাে, ছাত্রলীগের ব্যাপারে উনি কেন মােয়াজ্জেম ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করলেন এবং তা-ও আবার আমাকে শুনিয়ে। মােয়াজ্জেম ভাইকে বিষয়টি জিজ্ঞেসও কললাম। পরে বলবাে বলে তিনি আমাকে থামিয়ে দিলেন। আমার কাছে বিষয়টি সেদিন একেবারেই ভালাে লাগেনি।
এর কয়েকদিন পর কনফারেন্সের আগে মােয়াজ্জেম ভাইয়ের কাছে বিষয়টি আবারও জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘হলে তুই জিএসই হবি, ওবায়েদ প্রেসিডেন্ট। মনি তাে কাজই করে না। তুই একা সব কাজ করিস।’ মােয়াজ্জেম ভাইয়ের কথার কার্যকারিতার প্রমাণ পরে সম্মেলনের সময় পাওয়া যায়।
সম্মেলনের পর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি অনেক বেশি কাজ করার সুযােগ পাই। এ সময় প্রত্যেক জেলার সঙ্গে আমি যােগাযােগ তৈরি করে ফেলি। আমাদের স্বাধীন বাংলা ‘ নিউক্লিয়াস’- এর সাংগঠনিক কার্যক্রম এর ফলে অনেক সম্প্রসারিত হয়। জেলা ছাড়াও মহকুমা পর্যায়ে ও বড় বড় কলেজগুলাের সঙ্গে এ সময় আমাদের যােগাযােগ গড়ে ওঠে। উল্লেখ্য, তখন জেলা ছিল ১৭টি। তাছাড়া সে সময় আজকের মতাে থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে এত কলেজ ছিল না।
জেলা পর্যায়ে আমরা তিনজনকে নিয়ে একটি করে সেল (cell) গঠনের কাজ শুরু করি। আমি প্রত্যেক জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অথবা তাদের যে কোনাে একজন সহ তিনজন এবং কলেজ পর্যায়েও তিনজনকে নিয়ে একটি করে সেল গঠনের উদ্যোগ নিই। এর
পৃষ্ঠা: ৪৬
ফলে জেলে যাবার আগ পর্যন্ত আমরা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ৩০০ জনের মতো ‘নিউক্লিয়াস’ মেম্বার সংগ্রহ করতে সক্ষম হই।
আমাদের গোপন সংগঠনে যেটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তা এই সদস্যদের প্রত্যেকে নিজেকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে উৎসর্গীকৃত মনে করতাে। আর দিনের চব্বিশ ঘন্টার প্রতিটি মুহূর্ত সংগঠনের গােপন কার্যক্রমের বিস্তৃতি ঘটানােকেই প্রধান কর্তব্য মনে করে নিজেকে তাতে নিয়োজিত রাখতাে।
আমি, আবদুর রাজ্জাক ও আবুল কালাম আজাদ কিছু দিনের মধ্যেই গ্রেফতার হয়ে জেলে চলে গেলাম। আরেফ বাইরে রইলাে। ঢাকা শহরে আমাদের গােপন সংগঠনের কার্যক্রম বিস্তারের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল সে। ফলে আমাদের অবর্তমানেও ঢাকা শহরে ‘নিউক্লিয়াস’-এর সদস্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ থেকে ছয়শত। জেলে বসেই আমরা এ খবরগুলাে পেতাম এবং আমাদের তিনজনের মতামত ও সিদ্ধান্ত আরেফের মাধ্যমেই সংগঠনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারতাম । জেলে আমরা প্রায় দুই বছর ছিলাম। এ সময়ে পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হলাে। সরকারি দলের প্রার্থী ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান আর সম্মিলিত বিরােধীদলের (‘কপ’) প্রার্থী পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছােট বােন মিস ফাতেমা জিন্নাহ। ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে কাজ করার সুযােগটা ব্যবহার করার কথাও আমরা আরেফকে জানালাম। যেহেতু তখন পর্যন্ত ছাত্রলীগই আমাদের গােপন সংগঠন বিস্তারের একমাত্র প্ল্যাটফরম, সেহেত ছাত্রলীগকে পুরােপুরিভাবে মিস ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনের কাজে যুক্ত থাকার সিদ্ধান্ত পাঠালাম আমরা। আমরা জেলে থাকতেই নির্বাচন হলাে। কাজী আরেফ ঐ অবস্থাতে ‘নিউক্লিয়াস’-এর মূল দায়িত্ব পালন করতে থাকে। ১৯৬৫-এর আগস্ট মাসে আমি, রাজ্জাক ও আজাদ একই সঙ্গে জেল থেকে ছাড়া পাই। ঢাকা শহর ছাত্রলীগের সম্মেলনে কাজী আরেফ সভাপতি হলাে। তাতে আবারও আমাদের সুযােগ এলাে ঢাকা শহরভিত্তিক সাংগঠনিক কাজ দ্রুততার সঙ্গে বাড়াবার । ছাত্রলীগের পরবর্তী কেন্দ্রীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে আমি আগস্ট-সেপ্টেম্বর দুই মাস সারাদেশে সংগঠনের আঞ্চলিক কনফারেন্সগুলাে করলাম। কোনাে কোনাে জেলা, মহকুমা ও কলেজ
পৃষ্ঠা: ৪৭
কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুজনকেই, আবার কোথাও কোথাও কমপক্ষে একজনকে ‘নিউক্লিয়াস’ সদস্যদের মধ্য থেকে করা হলাে। কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলাে ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বর। সেখানে আবারও ভিন্ন একটা প্রচেষ্টা দেখা গেল। কিন্তু তা সফল হলাে না। আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক হলাে এবং সৈয়দ মাজহারুল হক বাকি সভাপতি। বাকিও আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। ঐ কমিটিতেও দুই-একজন আমাদের সহমতের ছিলেন না, বরং বিপরীত চিন্তাই করতেন। তাদের মধ্যে ফেরদৌস কোরেশী ও আল-মুজাহিদীর নাম করা যায়। তখন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিল একত্রিশ জন।
সম্মেলনের শেষ দিন ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। আমি আমার সমাপনী বক্তৃতায় বলেছিলাম, এটাই হয়তো আগামী আট-দশ বছরের জন্য আমার শেষ বক্তৃতা। কথাটার মধ্য দিয়ে আমি কী ইঙ্গিত দিয়েছিলাম তা উপস্থিত প্রতিনিধিদের সবাই না বুঝলেও আমাদের রিক্রুট করা ‘নিউক্লিয়াস’-এর সদস্যরা (যাদের সংখ্যা ছিল শতকরা সত্তর থেকে আশি ভাগ) ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। দেশ স্বাধীন হবার আগ পর্যন্ত আমি আর কোনাে প্রকাশ্য সভায় মঞ্চে উঠিনি। একমাত্র ১৮ জানুয়ারি ১৯৭০ যেদিন পল্টনে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দেওয়া হয়েছিল সেদিন ছাড়া।
সম্মেলন শেষে আমরা ধারাবাহিকভাবে ‘নিউক্লিয়াস’-এর বৈঠক করতে থাকি। কোন পর্যায়ে কীভাবে সংগঠনের বিস্তার ঘটানাে হবে এবং আরও কাউকে কাউকে ‘নিউক্লিয়াস’ ভুক্ত করা যায় কিনা সে বিষয়ে আলােচনা শুরু হয়। নিউক্লিয়াস’-এর সদস্য সংখ্যা সে-সময়ের চার থেকে বাড়িয়ে কমপক্ষে সাত অথবা নয়জন করা যায় কিনা সেটা নিয়েও ভাবা হয়। সম্মেলনের কিছুদিন আগেই অবশ্য ‘নিউক্লিয়াস’-এর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চট্টগ্রামের এম এ মান্নানকে ‘নিউক্লিয়াস’ভুক্ত করা হয়। একইভাবে প্রত্যেক জেলা থেকে একজনকে নিয়ে ‘নিউক্লিয়াস’-এর পরিধি বাড়াবার চিন্তা থাকলেও সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। “নিউক্লিয়াস’-এর যে-কোনাে সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ‘ভেটো’ (veto) দেওয়ার ক্ষমতা ‘নিউক্লিয়াস’-এর প্রত্যেক সদস্যের ছিল। সেই ‘ভেটো’র কারণে ‘নিউক্লিয়াস’-এর বিস্তৃতির চিন্তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি), আ স ম
পৃষ্ঠা: ৪৮
আবদুর রব, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, কামরুজ্জামান টুকু, ডা. আবু হেনা (ময়মনসিংহ) ও আখতার আহমদ (সিলেট)-কে ‘নিউক্লিয়াস’ ভুক্ত করার চিন্তাভাবনা থাকলেও, শেষ পর্যন্ত মার্শাল মনিকে ‘নিউক্লিয়াস’ ভুক্ত না করেও তার সঙ্গে ‘নিউক্লিয়াস’-এর সব সিদ্ধান্তের বিষয়ে আলাপ-আলোচনার ব্যাপারে আমরা একমত হই । এরপর নতুন কাউকে ‘নিউক্লিয়াসভুক্ত করার বিষয়টি স্থগিত থাকে। তবে কেন্দ্র থেকে দায়িত্ব দিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে নানাজনকে দিয়ে কাজ করানাের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ‘নিউক্লিয়াস’ভূক্ত না করেও এভাবে কার্যক্রম চালানোর এই পরিকল্পনাটি বেশ কার্যকর প্রমাণিত হয়। সে-সময় এ রকম উপ-কমিটি ধরনের প্রায় বিশ-ত্রিশটি কাঠামাে গড়ে তােলা হয়েছিল। তাতে সংগঠনের কার্যক্রমের বিস্তার ঘটানাে সহজ হয়েছিল।
মার্শাল মনি ছাড়া আর কাউকে ‘নিউক্লিয়াস’-এর মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণের অংশীদার করা হয়নি, তবে ১৯৬৮-‘৬৯-এর ১১-দফাভিত্তিক আন্দোলন-সংগ্রামের দিনগুলােতে প্রতিটি জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে অনেকেই আমাদের গােপন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলােতে এবং পরবর্তী সময়েও ঢাকা শহরে বিভিন্ন ব্রিগেড গড়ে তুলতে গিয়ে পাঁচ-ছয় শ’ সংগঠকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে প্রায় সাত হাজার সংগঠক গড়ে ওঠে। এদের সকলেই বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ)-এর সরাসরি সদস্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
এ সময়টিতেই ‘নিউক্লিয়াস’- এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাদের কার্যক্রমকে রাজনৈতিক ও সামরিক এই দুইভাগে বিভক্ত করা হয়। মূলত ১৯৬৮-এর শেষ ভাগেই এ বিভক্তির প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। গণআন্দোলনের সময় অবাঙালিদের দ্বারা পরিচালিত প্রশাসন ভেঙে পড়ে। যানবাহন নিয়ন্ত্রণসহ ট্রাফিক পুলিশের কাজ, রাত্রিকালীন প্রহরা, শ্রমিক এলাকায় শৃঙ্খলা বজায় রাখা, ট্রেন-স্টিমার চালু, স্কুল- কলেজসমূহের নিরাপত্তা বিধান, ঢাকার বাইরে বড় বড় বাজার ও থানায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, মােটকথা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে চলমান আন্দোলনকে চাঙ্গা রাখার পাশপাশি জনজীবনের নিরাপত্তা বিধানের মৌলিক দায়িত্বও পালন করতে হয় এ সময় ‘বিএলএফ’ সদস্যদের।
পৃষ্ঠা: ৪৯
এ জন্য ছাত্র ব্রিগেড, যুব ব্রিগেড, শ্রমিক ব্রিগেড, কৃষক বিগ্রেড, নারী ব্রিগেড গড়ে তােলা হয়।
১৯৬৮-৬৯ সালেই ‘নিউক্লিয়াস’-এর রাজনৈতিক শাখা ‘উইং’ হিসেবে ‘বিএলএফ’ গড়ে তােলা হয়। ঢাকা শহরের ৪২টি ওয়ার্ডের সবকটিতে ‘বিএলএফ’-এর নেতৃত্বে ছাত্র ও নাগরিকদের সমন্বয়ে ‘সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। এই দুরূহ কাজটি করার জন্য নিউক্লিয়াস’-এর পক্ষ থেকে আ স ম আবদুর রবকে এবং তার সহযােগী হিসেবে স্বপন চৌধুরীকে (একাত্তরে শহীদ) দায়িত্ব দেওয়া হয়। একই সময়ে ‘বিএলএফ’-এর সামরিক শাখা হিসেবে গঠিত হয় ‘জয়বাংলা’ বাহিনী। ‘জয়বাংলা বাহিনী’র প্রাথমিক কাজ ছিল যে এর প্রশিক্ষণ নেওয়া, যুদ্ধাবস্থায় বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান করা, অস্ত্র ট্রেনিং দেওয়া, বােমা তৈরি করা ইত্যাদি। এই দায়িত্বে ছিলেন শরীফ নূরুল আম্বিয়া।
বিএলএফ’ ও জয়বাংলা বাহিনীর কার্যক্রমকে আলাদা করে বােঝানাে কঠিন হবে। জয়বাংলা বাহিনীর বিশদ ও বিস্তৃত কর্মযজ্ঞের মধ্যে ছিল একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে সামরিক কুচকাওয়াজ করা। এই বাহিনীর মূল কমান্ডার ছিলেন আ স ম আবদুর রব ও সহ-কমান্ডার ছিলেন কামরুল আলম খান খসরু। নারী ব্রিগেডের কুচকাওয়াজের নেতৃত্ব দিতেন মমতাজ বেগম। মহিলা সামরিক সংগঠকদের মধ্যে ফোরকান বেগম ছিলেন অন্যতম।
কারাজীবন
১৯৬৩-‘৬৫ সময়ের জেল জীবন ছিল আমাদের জন্য বৃহত্তর অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির জন্য সর্বোৎকৃষ্ট সময়। তখন চিন্তা করার সময় ছিল অফুরন্ত। আর জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য জেল জীবন যে সুযােগ করে দিয়েছিল তা বলতে গেলে নজিরবিহীন।
আমি, রাজ্জাক ও আজাদ একসঙ্গে একই জেলে ছিলাম দীর্ঘদিন। একটি দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সদিচ্ছাই যথেষ্ট নয়; এমনকি ত্যাগ স্বীকারের মনােভাবও পর্যাপ্ত নয়। স্বাধীনতার লক্ষ্যে সাংগঠনিক বিস্তৃতির পাশাপাশি জ্ঞানার্জন ও একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তােলাও আমাদের জন্য প্রয়ােজনীয় ছিল। ঢাকা জেলের লাইব্রেরিটিও ছিল অতি
পৃষ্ঠা: ৫০
উন্নতমানের। ব্রিটিশ আমল থেকেই যেসব স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিপ্লবীরা ঢাকা জেলে বন্দি ছিলেন তাদের পড়াশুনার মান যে কত উচ্চ পর্যায়ের ছিল, জেল লাইব্রেরির বইগুলাে দেখলে তা সহজে বােঝা যায়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটলের রচনা; পরবর্তীকালের ইউরােপীয় পণ্ডিত ও দার্শনিক যেমন কার্লাইল হিউম, ভলতেয়ার, রুশো, লক এঁদের লেখা; প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরােপের স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্রগুলাের উত্থানের ইতিহাস; রাশিয়ার ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের ইতিহাস; মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, ট্রটস্কি, প্লেখানভের রচনা—এসব পড়ার সুযােগ হয় আমার জেলখানায় বসেই। যুদ্ধবিগ্রহের ওপর আমি প্রথম যে বইটি পড়ি তা ছিল থুসিডাইডিসের পেলােপনেশিয়ান ওয়ার। পড়ি হেগেলের জার্মান ফিলােসফিসহ আরও অনেক বইপত্র। তাছাড়া ধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যের নানা বই, যেমন ইবনে খালদুনের আল-মুকাদ্দিমা, আলবেরুনীর ভারততত্ত্ব, উইনস্টন চার্চিলের হিস্ট্রি অব দ্য ইংলিশ স্পিকিং পিপল, হােমারের ইলিয়াড ও ওডিসি প্রভৃতির সঙ্গেও আমার প্রথম পরিচয় ঘটে জেলেই।
ক্রমানুসারে কোন বইটি আগে আর কোনটি পরে পড়তে হবে তা জানা না থাকার কারণে এলােপাথাড়িভাবে বই পড়েছি। ফলে বিষয় কিংবা দার্শনিকের দৃষ্টিভঙ্গি বােঝার দিকটি প্রথমদিকে গুরুত্ব পায়নি। এতে জ্ঞানের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়ে যায়। পরবর্তীকালে এসব বই ক্রমানুসারে পড়ি। তাতে কোনাে কোনাে বই দুবার করে পড়ার সুযােগ ঘটে। এতে আমার বােঝার দিকটা আরও সমৃদ্ধ হয়।
এ সময়ে আমরা জেলে একসঙ্গে ছাত্রলীগের মােয়াজ্জেম ভাই, ফজলুল হক মনি, ওবায়েদুর রহমান, শহীদুল হক মুন্সি; ছাত্র ইউনিয়নের বদরুল হক বাচ্চু (পরবর্তীকালে বিচারপতি), রেজা আলী, হায়দার আকবর খান রনাে, রাশেদ খান মেনন, আলী রেজা, আলী হায়দার খানসহ প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ জন ছিলাম। ছাত্র ইউনিয়নের রনােকে দেখতাম গভীর মনােযােগ সহকারে লেখাপড়া করতে। ১৯৬৫-এর জুলাই-আগস্টে আমরা সবাই মুক্তি পাই। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ছাত্রলীগের সম্মেলন করে আমি ছাত্র রাজনীতি থেকে সরে
পৃষ্ঠা: ৫১
আসি। তখন থেকে আমার নিজেকে মনে হয়েছিল ভিন্ন এক সিরাজুল আলম খান। প্রায় দুই বছরের জেল জীবন আমাকে, আমার দৃষ্টিভঙ্গিকে একেবারেই পাল্টে দেয়।
ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন
বাংলায় গাড়ির নাম্বার ও দোকানপাটে সাইনবোের্ড লেখা এবং পােস্টকার্ডে বাংলায় ঠিকানা লেখার মধ্য দিয়ে ১৯৬১-৬২ সালে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে সামান্য হলেও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার সঞ্চার ঘটে। সে সময়ে ছাত্র সভাসমূহে সাধারণত সকল ছাত্র সংগঠনই যােগ দিত। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে আমি ও ছাত্র ইউনিয়নের আবদুর রহিম আজাদ বাংলায় বক্ততা করতাম । এনএসএফ, ছাত্রশক্তি ও ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতারা বক্তৃতা করতেন ইংরেজিতে। তাদের বক্তৃতার সময় কিছুটা হৈ চৈ হতাে। ফলে দুই-চার মিনিট পরেই তাদের বক্তৃতায় ভাটা পড়তাে। কারণ কেউ সেগুলাে শুনতাে না। আমরা উপস্থিত ছাত্রদেরকে ধৈর্য ধরতে বলতাম এবং এভাবেই সভা শেষ হতাে।
ছাত্র ধর্মঘট চলার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের ছাত্ররা একই হারে ধর্মঘটে যােগ দিত, তা বলা যাবে না। আমরা ক্লাস চলাকালে শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে বিভিন্ন ক্লাসে ঢুকে ধর্মঘটের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে বলতাম। তাতে উদ্বুদ্ধ হয়েই ছাত্ররা ধর্মঘটে যােগ দিত। এ নিয়ে মাঝেমধ্যে টানাহেঁচড়া বা ধস্তাধস্তি যে একেবারেই হতাে না, তা নয়। তবে তা অল্পক্ষণের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি মাত্র ক্যাম্পাস। বিজ্ঞানের জন্য কার্জন হল এবং কলা, বাণিজ্য ও আইন বিভাগের জন্য আমতলার পাশের বিল্ডিং। আইন বিভাগের ক্লাস হতাে। বিকেলে। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও ক্লাসের সময়টুকু ছাড়া বাকি সময় ব্যয় করতাম কলা ভবনে।
আন্দোলনের বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য সর্বদলীয় একটি কমিটি থাকতাে। এর বাইরে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে আলাদা বােঝাপড়া হতাে এবং আমরা এ দুই সংগঠনের নেতৃবৃন্দ প্রায়ই পৃথকভাবে আলােচনা করতাম। তাতে সর্বদলীয় সভায় সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হতাে।
পৃষ্ঠা: ৫২
আমরা যারা ছাত্রলীগ করতাম, আমাদের উপরতলার কোনাে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনাে যােগাযােগ থাকতাে না। আওয়ামী লীগও কখনও আমাদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা চিন্তা করতাে না। আমরাও কখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতাম না। ছাত্রলীগে আমরা যে কয়জন সক্রিয় নেতা বা কর্মী ছিলাম তারাই মিলেমিশে সিদ্ধান্ত নিতাম। আমাদের একটি অত্যন্ত সক্ষম ও দক্ষ টিম ছিল।
১৯৬২ সালের পুরাে বছরটাই ছিল ছাত্র ধর্মঘটে পূর্ণ। ছাত্রদের দাবি ছিল শরীফ কমিশন ও হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ বাতিল করতে হবে। সামরিক শাসন প্রত্যহার করতে হবে। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের আন্দোলনের অনেক সাফল্যের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য হলাে চারুকলা স্কুলকে কলেজে উন্নীতকরণ। প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে একরকম লড়াই করে আমাদের এই দাবি আদায় করা হয়। আইয়ুব খানের অধীনে পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যারা সদস্য হয়েছিলেন, যেমন তমিজুদ্দিন খান, সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে আমরা একরকম জোর করে কথা আদায় করেছিলাম যে, তারা বাঙালির স্বার্থবিরােধী কিছু করবেন না এবং নেতৃবৃন্দের কেউ আইয়ুবের মন্ত্রী হবেন না। তারা অবশ্য সে কথা রক্ষা করেননি। তবে তাঁদের সঙ্গে সে সব আলােচনা ও বাকবিতণ্ডা ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে আমাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ও জ্ঞানের পরিধি বাড়ানােয় সহায়ক হয়েছিল। সহজেই যে আমরা এদের সঙ্গে কথা বলতে পারতাম তা নয়, আবার কথা বলার সময়ও হিসেব করে বলতে হতাে।
এ সময়ে সর্বদলীয় ছাত্রদের পক্ষ থেকে আমরা পূর্ব বাংলার সাত- আটজন প্রথম কাতারের রাজনীতিবিদ, যেমন শেরে-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক, আতাউর রহমান খান, আবু হােসেন সরকার, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখের সঙ্গে দেখা করতাম। ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি তাদের সমর্থন চাইতাম। মার্শাল ল’ থাকার কারণে তারা কোনাে রাজনৈতিক বিবৃতি দিতে চাইতেন না। বলতেন, দিলেও লাভ নেই,
পৃষ্ঠা: ৫৩
কোথাও ছাপা হবে না। আমরা বলতাম, ছাপা না হােক, তবু আপনারা বিবৃতিটি দিন। কিন্তু তারা বরাবরই এ ব্যাপারে তাদের অস্বীকৃতি জানাতেন। আমরা বুঝতাম ছাপা না হবার অজুহাত দিলেও, তারা আসলে গ্রেফতার হবার ভয়ে বিবৃতি দিতে চাইছেন না। শেখ মজিবুর রহমান ছিলেন এ ব্যাপারে একমাত্র ব্যতিক্রম।
মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে তখন পর্যন্ত আমার কোনাে দেখা-সাক্ষাত হয়নি। তবে ১৯৫৬ সালে ব্রিটেনের সুয়েজ খাল আক্রমণ করার প্রতিবাদে যে ছাত্র ধর্মঘট ও মিছিল হয় তার এক পর্যায়ে মওলানা ভাসানীকে নিয়ে আসা হয় মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। আগে তার নাম শুনেছি, সেবার তাঁকে দেখলাম। তিনি বললেন, ‘তােরা তরুণ, এত জোরে হাঁটিস! আমি বুড়াে, তােদের সঙ্গে হেঁটে পারবাে কী করে? তােরা আস্তে হাট’।
১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের এক পর্যায়ে আন্দোলনের প্রতি রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন আদায় করাকে আমরা একটি মুখ্য বিষয় হিসেবে গণ্য করি। একদিকে সামরিক শাসন, অন্যদিকে রাজনৈতিক সংবাদ ছাপানাের ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা। উপরন্তু জেল-জুলুম-নির্যাতন তাে আছেই। আমরা রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দেখা করলাম। এ সব ক্ষেত্রে আমাকে সবাই সামনের দিকে ঠেলে দিত। কারণ আমি নাকি দেখতে সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ছিলাম। রাজনৈতিক ঘটনাবলীর কারণে ১৯৬০-এর দশক ছিল সারা পৃথিবীর জন্য বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশবাদী শক্তিগুলাে তখন বিজয়ী-বিজিত নির্বিশেষে সবাই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি পূরণে ব্যস্ত। পরাধীন দেশগুলাে এ সুযােগে তাদের উপনিবেশবাদবিরােধী সংগ্রামকে আরও জোরদার করে তােলে। ফল দাড়ালাে, উপনিবেশবাদী শক্তিগুলাে, স্বেচ্ছায় হােক কি অনিচ্ছায়, পরাধীন দেশগুলাে থেকে তাদের হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। একইভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরােপের দেশগুলাে পরাধীনতা মুক্ত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার প্রায় অর্ধশতাধিক দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। বাকি যারা ছিল তারাও তখন প্রায় স্বাধীনতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মিসর, সিরিয়া,
পৃষ্ঠা: ৫৪
জর্দান, কঙ্গো, আলজেরিয়াসহ বহু দেশ আগে-পরে স্বাধীনতা লাভ করে। অপরদিকে বিশ্বমানচিত্রে আরও একটি নতুন ঘটনাও ঘটে এ সময়। বিজয়ী শক্তি হিসেবে রাশিয়া আরও ১৪টি দেশ নিয়ে সােভিয়েত ইউনিয়ন গঠন করে। পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রােমানিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া—এ দেশগুলাে রাশিয়ার বাফার জোন হিসেবে একরকম স্থায়ী রূপ নেয়।
আমরা যখন ১৯৬২-এর আন্দোলনে ব্যস্ত তার কিছুদিন আগে ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবা, আহমেদ বেনবেল্পার নেতৃতে আলজেরিয়া, নাসেরের নেতৃত্বে মিসর এবং বাথ পার্টির নেতৃত্বে ইরাক ও সিরিয়ার অভ্যুদয় ও অগ্রযাত্রা বিশ্ব রাজনৈতিক মানচিত্রে একটি ভিন্ন মাত্রা যােগ করে। কোরিয়ার যুদ্ধ, ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রাম এবং কম্বােডিয়া ও লাওসের ঘটনাপ্রবাহ সেসব দেশে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সফলতার প্রমাণ হিসেবে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তার আগে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে চীনের বিপ্লব ছিল বিশ্ব ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা, যা সারা পৃথিবীর মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপােষিত ইহুদি সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইনি জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামও একটি দৃষ্টান্ত যা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের সামনেও এই দৃষ্টান্তগুলাে ছিল। ১৯৬২-এর ছাত্র আন্দোলনের পর্যায়ে এগুলাে আমাদের স্বাধীনতার স্পৃহা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে যে দর্শন, সংগঠন ও কর্মযজ্ঞের প্রয়ােজন, আমাদের তখন তার অভাব ছিল। এ সময়টিতে “নিউক্লিয়াস’-এর সদস্য সংগ্রহের কাজও ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে। আমাদের সংগ্রামী চেতনায় ঘাটতি ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতা প্রশ্নটি সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়ােজনীয় সংগঠন ও নেতৃত্বের অভাব আমরা উপলব্ধি করতে পারছিলাম।
আমাদের প্রবীণ রাজনীতিবিদরা তখন হাত গুটিয়ে ঘরে বসে আছেন। তারা কোনাে ঝুঁকি নিতে চান না। তারা এমন কিছু করতে চান না যাতে তাদেরকে জেলে যেতে হতে পারে কিংবা অন্যভাবে তারা বিপদে পড়তে পারেন। আন্দোলনের সূত্রে যে দু-একজনের সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করি তারাও আমাদের হতাশ করেন। এ অবস্থায়
পৃষ্ঠা: ৫৫
নিজেদের শক্তির ওপর ভরসা করে এগিয়ে যাওয়ার কঠিন সংকল্প নেয়া ছাড়া আমাদের উপায় রইল না। সে সময়টাতে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় যাদেরকে আমরা আমাদের কাজের জন্য সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম তাদেরকে কঠিন থেকে কঠিনতর অবস্থার মুখােমুখি হতে হবে’ – এই দৃঢ় মনােভাবের অধিকারী করে তােলা সম্ভব হয়েছিল।
ছাত্র আন্দোলনের সময় অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে আমাদের যােগাযােগ অনেক গভীর ছিল। তখন আমরা লক্ষ্য করেছি ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা আন্দোলনের চাইতে ক্ষুদ্র পরিসরে যােগাযােগের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতেন। আর দেখতাম তারা কথাবার্তা ও আলাপ-আলােচনায় প্রয়ােজনে-অপ্রয়ােজনে যখন তখন রাশিয়া ও চীনের প্রসঙ্গ টেনে আনতেন। আমরা যেখানে প্রাদেশিক ও জাতীয় পর্যায়ের ঘটনাবলি নিয়ে মিটিং, মিছিল ও ধর্মঘট করতাম, তারা সেখানে রাশিয়া ও চীনের ব্যাপার এবং পুঁজিবাদী বিশ্বের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্বের বিষয়গুলাের ওপরই বেশি গুরুত দিতেন। আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্থাৎ স্বাধীনতার জন্য পড়াশােনার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমাদের পড়াশােনা যে তাদের চাইতে ভিন্ন প্রকৃতির হবে তা বুঝতে পারলাম এবং সে অনুযায়ী পড়াশােনার ওপর গুরুত্ব দিলাম।
আমাদের পড়াশােনার বইয়ের তালিকা বেশ লম্বা ছিল। আন্দোলনের প্রয়ােজনে সরকারি গােয়েন্দাদের চোখ এড়াতে সে সময় হল-হােস্টেলে থাকাটাই আমাদের জন্য বেশ নিরাপদ ছিল। এ সময় ব্যক্তিগতভাবে আমি ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে (সাইফুদ্দিন মানিক, কাজী জাফর, হায়দার রনাে প্রমুখ) বিতর্কে জড়িয়ে পড়তাম। তারা আমাকে ছােটদের রাজনীতি, ছােটদের অর্থনীতি পড়তে দিয়েছিলেন। পড়লামও। ভালােই লাগলাে। কিন্তু মার্ক্স- এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো পড়তে গিয়েই তাদের সঙ্গে আমার বিবাদ দেখা দিল। বিবাদের বিষয় কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোকে বাইবেল, কোরআন-হাদিসের মতাে বিশ্বাস করা নিয়ে। মাহবুবউল্লাহ তখন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। তিনিই আমাকে কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো জোগাড় করে দিয়েছিলেন। তখন এসব বই নিষিদ্ধ ছিল।
পৃষ্ঠা: ৫৬
কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোতে ‘থিংস উইল এডমিনিস্টার ইটসেলফ’ (বস্তুই নিজেই নিজেকে পরিচালনা করবে) কথাটির অর্থ বুঝতে না পেরে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি কোনাে উত্তর দিতে পারেননি।
সংগঠনগতভাবে ছাত্র ইউনিয়ন অন্ধের মতো সােভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতাে—আমরা যার ঘাের বিরােধী ছিলাম। প্রথমদিকে কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোসহ কিছু বইপত্র দিয়েই আমরা মার্ক্স ও এঙ্গেলসকে বােঝার চেষ্টা করি। ঐ প্রাথমিক পর্যায়ে যদিও কমিউনিজমের বিরােধিতা করার জন্যই আমরা এসব পড়াশােনা করেছিলাম, কিন্তু পরবর্তীকালে অর্থাৎ স্বাধীনতার আগে ও স্বাধীনতার পরে এ বিষয়ে আমাদের পড়াশােনা প্রচুর বৃদ্ধি পায়। এ পড়াশােনা থেকে আমি বুঝতে পারলাম ছাত্র ইউনিয়নের সমাজতন্ত্র হচ্ছে অন্ধের ন্যায় চীন বা রাশিয়ার অনুকরণ; মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিন প্রবর্তিত সমাজতন্ত্রের সঙ্গে এর কোনাে সম্পর্ক নেই। ফলে ১৯৭০ দশকের গােড়া থেকে শুরু করে প্রায় পঞ্চাশ বছর আমার যে পড়াশােনা, তা শুধু গভীরতাই লাভ করেনি, স্থান ও কালের ব্যবধানে এবং পরিবর্তিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আমার মনে তা সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার ভিন্ন একটি রূপ গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। এ সময় মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, ট্রটস্কি, প্লেখানভ, এম এন রয়, স্ট্যালিন, মাও সে তুং, কাস্ত্রোসহ সব সমাজতন্ত্রী তাত্ত্বিকের বই পড়ার সুযােগ হয়েছে আমার।
১৯৬২-তে আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দশ বছরের জন্য বহিষ্কত হই। আমার বাবা বিষয়টি সহজে মেনে নিতে পারলেন না। তিনি ঢাকা এলেন। ঢাকা হলের প্রভােস্ট ড. মুশফিকুর রহমানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি তাকে নিয়ে ভাইস চ্যান্সেলর ড. মাহমুদ হােসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অনার্স পরীক্ষা শুরু হওয়ার সাত দিন আগে আমার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। ঐ অবস্থাতেই আমি অনার্স পরীক্ষা দিই। প্রথম দিন পরীক্ষা শুরু হবার এক ঘণ্টা পরে আমার অ্যাডমিট কার্ড পাই। এ কারণে আমার খাতা জমা নেওয়ার জন্য শিক্ষকদেরকে অতিরিক্ত এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। সে বছর আমি ছিলাম সর্বশেষ পরীক্ষার্থী। আমার রােল নম্বর ছিল ৩১।
পৃষ্ঠা: ৫৭
পরীক্ষা শেষে আমি যেন বিরাট স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। পিঞ্জরাবদ্ধ পাখিকে মুক্তি দিলে তার যে আনন্দ, আমি শুধু সেরকম আনন্দই উপভােগ করলাম না, মনে হলাে সারা বিশ্ব আমার সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেছে। পরীক্ষার শেষ দিনে আমি আমতলা থেকে বক্তৃতা দিয়ে মিছিল বের করে তারপর কার্জন হলে পরীক্ষা দিতে গেলাম। চার ঘণ্টা পরীক্ষা শেষে গিয়ে দেখি তখনও মিটিং চলছে আর আমি যে শ্রমিকদের নিয়ে এসেছিলাম তারা আমার বক্তৃতা শােনার জন্য অপেক্ষা করছে। সেদিন সভা শুরুর বক্তৃতা যেমন আমি দিয়ে এসেছিলাম তেমনি সভা সমাপ্তির ভাষণটাও আমিই দিলাম । মাঝখানে আমার গােটা একটা পরীক্ষা দেওয়া হয়ে গেল। সভায় আমাকে দেখে তাে সবাই অবাক। আমাদের কাজের বিস্তার ও দক্ষতা সম্পর্কে বলা যায়—আমি ও আবদুর রাজ্জাক দুজনে দুই-তিনশত সংগঠকের কাজ করতে পারতাম । ঢাকা শহরের কাজ তখন কাজী আরেফ করতাে।
১৯৬৩ সালের প্রথমদিকে ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে আমি ছাড়া আর সবাই গ্রেফতার হয়ে গেলেন। আমার নামে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি হলেও আমি গ্রেফতার এড়িয়ে প্রায় এক বছর কাটালাম। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলােতে ছাত্রলীগ সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য এক ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করি। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় হল-হােস্টেল ও কলেজগুলাতে ছাত্রলীগের দ্রুত বিস্তার ঘটে। এ সময় আবার ছাত্র ইউনিয়ন তাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে দুই ভাগ হয়ে যায়। এক অংশের নাম হলাে ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), অপর অংশের নাম ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)। আমরা তাদের এ দ্বিধাবিভক্তির সুযােগকে ছাত্রলীগের শক্তিবৃদ্ধির কাজে লাগাতে চাইলাম।
১৯৬৩ সালে ছাত্র আন্দোলন অনেকটা স্তিমিত হয়ে এলেও গ্রেফতারকৃত ছাত্রনেতারা জেলেই রইলেন। তাদের মুক্তির দাবিটি তখন মুখ্য হয়ে উঠলাে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেও কোনাে লাভ হলাে না। একটি বিবৃতি দিতেও তারা সাহস করছিলেন না। তখনও দেশে মার্শাল ল’ চলছে। এ সময় ছাত্রলীগের পক্ষে আমি ও রাজ্জাক এবং ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ
পৃষ্ঠা: ৫৮
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে দিয়ে একটি বিবৃতি দেওয়ানাের উদ্যোগ নিই। সে উদ্যোগের ফল হিসেবে দুই মাসের মাথায় একটি বিবৃতি তৈরি করা হলো। যা ‘নয় নেতার বিবৃতি’ হিসেবে বিখ্যাত হয়েছিল । আতাউর বহমান খান, নুরুল আমীন, হামিদুল হক চৌধুরী, আবু হােসেন সরকার, শেখ মুজিবুর রহমান, মাহমুদ আলী এবং আরও তিনজন পূর্ব পাকিস্তানি নেতা এতে স্বাক্ষর করেন।
সামরিক শাসনের কঠোরতার মধ্যে এ বিবৃতি প্রকাশ করে সে সময় সংবাদপত্রগুলাে যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দেয়। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও তা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। সে সময় মােহাম্মদ ফরহাদের নেতৃত্বে ছাত্রদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির তৎপরতার কথাও আমরা জানতে পারি। ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যৌথ আন্দোলন গড়ে তােলার কাজ করতে গিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির গােপন সাংগঠনিক কর্মধারার বিষয়েও আমার ধারণা হয় । এসব ধারণা আমাদের ‘নিউক্লিয়াস’ গড়ে তােলার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলেছিল। ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রামের সময়ে ‘ভিয়েতকং’দের সাংগঠনিক কর্মধারা সম্পর্কে তাদেরই প্রচারিত বেশ কিছু বই-পুস্তিকা ও প্রচারপত্র আমি সংগ্রহ করি। প্রথমে নিউক্লিয়াস এবং পরবর্তীকালে ‘বিএলএফ’-এর বিস্তৃতির ক্ষেত্রে সেগুলাে খুবই সহায়ক হয়েছিল।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গঠন ও সাংগঠনিক কর্মধারা সম্পর্কে বিশদভাবে পড়ার আমার সুযােগ হলেও তা খুব বেশি কাজে আসেনি। আমার মনে হয়েছে তাদের চিন্তা ও কর্মে নিজস্বতার চাইতে রাশিয়া-চীনের অনুকরণের দিকটিই প্রাধান্য পেয়েছে। ফলে ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতিতে তারা সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি। আমরা আমাদের নিজস্ব রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতার আলােকে ও নিজস্ব প্রয়ােজনের প্রেক্ষিতে নিজেদের লক্ষ্য ও কর্মধারা নির্ধারণ করেছিলাম। আর সে লক্ষ্য, পরিকল্পনা ও কর্মপদ্ধতির কথা ‘বিপ্লবী বাংলা’ নামক গােপন পত্রিকার মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলাম। ১৯৬৩-এর মাঝামাঝি আমাদের মধ্যে শেষ ব্যক্তি আমি গ্রেফতার হয়ে যাই। তারপর প্রায় দুই বছর কাজী আরেফ (রাজ্জাকও তখন জেলে ছিল) আমাদের সাংগঠনিক বিস্তৃতির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে।
পৃষ্ঠা: ৫৯
আমাদের তিনজনের (আমি, রাজ্জাক ও আরেফ) দায়িত্ব ভাগ করা ছিল। কর্মী সংগ্রহের (রিক্রুটমেন্ট) কাজটি করতাে ঢাকা শহরে আরেক ও ঢাকার বাইরে জেলা পর্যায়ে আবদুর রাজ্জাক। আমার দায়িত ছিল মূলত তত্ত্বগত দিকে, যেমন লিটারেচার তৈরি। এছাড়া রিক্রুটমেন্টের বাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান এবং সার্বিকভাবে সাংগঠনিক কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দিক-নির্দেশনা দানও আমার দায়িত্ব ছিল। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল যে, রাজ্জাক প্রকাশ্য কাজে (বক্তৃতা, মিছিল ইত্যাদিতে) থাকবে। আরেফ আর আমার কোনাে অবস্থায় গােয়েন্দা সংস্থার নজরে পড়া ঠিক হবে না বলে আমরা দুজন জনসমক্ষে যাওয়া থেকে বিরত থাকতাম। এই দায়িত্বভাগ বা কর্মবণ্টন আমাদের জন্য তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য রকমের সুফল বয়ে আনে।
১৯৬৩ সালের নভেম্বরে ছাত্রলীগের সম্মেলনে আমি সাধারণ সম্পাদক হই, রাজ্জাক সহ-সম্পাদক ও আরেফ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৩-এর মাঝামাঝি আমি ও রাজ্জাক জেলে যাবার আগে পর্যন্ত ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করার মধ্য দিয়ে ঢাকাসহ সারা পূর্ব পাকিস্তানে নিউক্লিয়াস’-এর কাজের বহু গুণ বিস্তার ঘটে। বলতে গেলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এমনকি স্কুলের উচ্চশ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও ‘নিউক্লিয়াস’-এর আদর্শ বেশ জায়গা করে নেয় এবং তারা বাঙালির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে স্বাধীনতাকেই একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে।
এক হিসেব মতে আমার জেলে যাবার আগ পর্যন্ত ঢাকা শহরেই ‘নিউক্লিয়াস’-এর প্রায় ৩০০ এবং ঢাকার বাইরে ২০০ সদস্য সংগ্রহীত হয়। সদস্য সংখ্যার এই বিস্তৃতি সাংগঠনিক যােগাযােগ ও শৃঙ্খলারক্ষার ক্ষেত্রে বেশ সমস্যার সৃষ্টি করে। আমরা জেলে থাকা সত্ত্বেও ১৯৬৮ সালের আন্দোলন শুরুর আগ মুহূর্ত অবধি ‘নিউক্লিয়াস’- এর সদস্য সংখ্যা বেড়ে ১২০০-এ দাঁড়ায়। স্বভাবতই এ সংখ্যাকে সাংগঠনিক পর্যায়ে একক সমরৈখিক রূপদান (Linear Formation) অসম্ভব হয়ে পড়ে। মূলত এ কারণে এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক কাজকে বিভক্ত করতে ১৯৬৮ সালের শেষভাগে আমরা নিউক্লিয়াস’-এর সদস্য সংখ্যা আর বৃদ্ধি না করে এর রাজনৈতিক শাখা হিসেবে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) এবং সামরিক শাখা
পৃষ্ঠা: ৬০
হিসেবে ‘জয়বাংলা বাহিনী’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিই। সে অনুযায়ী ১৯৬৯ আছে ‘বিএলএফ’ও ‘জয়বাংলা বাহিনী’ গঠিত হয়। ১৯৬৮-৬৯ সালে গণআন্দোলনের প্রচণ্ড গতি লাভের মধ্যে আমরা আমাদের কাজকে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে নিতে সমর্থ হই।
এর আগে ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আমাদের মধ্যে একটি সরলরৈখিক চিন্তা ও কর্মপন্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করে । আমরা বুঝতে পারি, পশ্চিম পাকিস্তানকে বাদ দিয়েও পূর্ব পাকিস্তান (পর্ব বাংলা) বাঁচতে পারে; অর্থাৎ বাঙালিদের পক্ষে এককভাবে নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
৬-দফা আন্দোলন
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে তার ৬-দফা পেশ করলেন। সে সময়ে এ দেশ থেকে বেশ কয়েকটি দৈনিক সংবাদপত্র বের হতাে। এদের সবগুলােই ছিল পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার জন্য নিবেদিতপ্রাণ । পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের দ্বারা পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার খর্ব হচ্ছে। নানা কায়দা-কৌশলে তারা বাঙালিদের ওপর তাদের শাসন ও শােষণ চালিয়ে যাচ্ছে। বুনিয়াদি গণতন্ত্রের নামে দেশে আইয়ুবি একনায়কতন্ত্র চলছে। অথচ এ নিয়ে কারাের মধ্যে তেমন একটা উদ্বেগ নেই। এমনকি সে সময়ের আওয়ামী লীগপন্থি বলে পরিচিত পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাকও শেখ মুজিবের ৬-দফাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করলাে না। ইত্তেফাকে খবরটি দেওয়া হয় প্রথম পৃষ্ঠার মাঝামাঝি সিঙ্গেল কলামে মাত্র কয়েকটি লাইনে। শিরােনাম ছিল : ‘শেখ মুজিবের ৬-দফা’। ইংরেজি এবং বাংলা অন্য পত্র-পত্রিকাগুলােও খবরটিকে কোনাে গুরুত্ব দিলাে না। ছাপলেও চোখে প্রায় না পড়ার মতাে করে ছাপলাে। কোনাে কোনাে পত্রিকা ৬-দফার দাবিগুলাের উল্লেখ না করে একে দেশ দ্বিখণ্ডিতকরণের ষড়যন্ত্র বলতে দ্বিধা করলাে না।।
দুই মাস পর একদিন শেখ মনি আমাকে বললাে, দোস্ত, চল এক জায়গায় যাব। নিয়ে গেল আলফা ইস্যুরেন্স কোম্পানির অফিসে। আমাকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে চা খাওয়ার কথা বললাে। সে ভেতরে গেল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে চা এলাে, মনিও ফিরে এলাে। এসে টাইপ
পৃষ্ঠা: ৬১
করা একটি কাগজ আমার হাতে দিল। সেটা পড়তে বলে, ‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি’ বলে আবার ভেতরে গেল। আমি দুবার কাগজটি পড়লাম। চা খাওয়া হলাে না। আমি আজ বলতে পারবো না আমার মধ্যে তখন কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল। কাগজটা পড়ে আমি কেমন যেন হয়ে গেলাম। মনির ফেরত আসার অপেক্ষা না করেই আমি বেরিয়ে এলাম। তারপর কতক্ষণে কীভাবে যে ইকবাল হলে ফিরে এসে রাজ্জাক ও আরেফকে খবরটা দিলাম তা আমি বলতে পারবাে না! তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ল্যাম্পপােস্টের আলােতে আজ আমরা প্রত্যেকে একবার করে কাগজটি পড়লাম। কারাে মুখ থেকে কোনো কথা বেরুলাে না । তিনজন পরস্পরের দিকে তাকালাম। তারপর একে অপরের হাতে হাত রেখে বললাম : ‘এখন থেকে এটাই হবে আমাদের প্রথম কাজ।’
শপথ নেওয়ার ব্যাপারটি আমাদের কোনাে নিয়মনীতি বা শৃঙ্খলার মধ্যে ছিল না। তারপরও আমরা সেদিন সেটা করলাম। আর ঐ কাগজটি যে আমরা তিনজন কতবার পড়েছি তার কোন হিসাব নেই।
ঐ কাগজটির শিরােনাম ছিল ‘৬-দফা প্রস্তাব’। আমাদের কাছে এটি ছিল স্বাধীনতার প্রস্তাব। কয়েক দিনের মধ্যে ৬-দফা বিরােধী প্রচার শুরু হয়ে গেল। আইয়ুব খান হুঙ্কার দিলেন, প্রয়ােজনে অস্ত্রের ভাষায় ৬-দফার মােকাবেলা করা হবে। আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে ভয়ে চুপসে গেলেন। ৬-দফার প্রশ্নে দলের ভেতরে মতামত দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। এই পরিস্থিতিতে ৬-দফার পক্ষে ইতিবাচক সমর্থন এলাে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাবে। সভাপতি সৈয়দ মাজহারুল হক বাকি ও সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক এক যৌথ বিবৃতিতে ৬-দফার প্রতি শর্তহীন ও পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করলেন। মাজহারুল হক বাকি অবশ্য প্রথমদিকে একটু দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। আমি একাধিক বৈঠকের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে তার কাছে বিষয়টি স্পষ্ট করি। শেষ পর্যন্ত তিনি ৬-দফার বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে রাজি হন। বিবৃতিটি লিখে দিয়েছিলাম আমি। পরদিন দুই-একটি পত্রিকায় বিবৃতিটির কথা ছাপা হলেও এর বিষয়বস্তুর কোনাে উল্লেখ কোথাও ছিল না। এমনকি ইত্তেফাকেও ছাপা হলাে, ‘৬-দফাকে ছাত্রলীগের সমর্থন : বাকি ও রাজ্জাকের বিবৃতি। তাও আবার
পৃষ্ঠা: ৬২
ভেতরের পাতায়। মােটকথা সে সময়ের সংবাদপত্র ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ৬-দফার প্রতি কোনােভাবে সমর্থন জ্ঞাপন করেনি; বরং বক্তৃতা-বিবৃতিতে, পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধাদিতে ও আলােচনার
টেবিলে ৬-দফা যে ‘পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার একটি ষড়যন্ত্র’ অনবরত একথা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয়েছে। এ অবস্থায় আমাদের গোপন তৎপরতা ও সাংগঠনিক জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলাে। আমাদের সামনে উপস্থিত হলাে ইতিহাস রচনার এক নতুন সুযােগ। আগেই বলেছি, শেখ মুজিব ৬-দফা দেওয়ার পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকা সরাসরি অথবা পরােক্ষভাবে এর বিরােধিতা শুরু করে। একমাত্র ইত্তেফাক ছিল ব্যতিক্রম। সে সময়ে পত্রপত্রিকার সংখ্যা কম ছিল, আর মালিকানা যারই হােক না কেন সাংবাদিকরা দু-একজন বাদে সবাই ছিলেন মস্কোপন্থি কিংবা চীনপন্থি। আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসার পর চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধুত্বের সম্পর্ক গভীরতার দিকে নেওয়ার চেষ্টা করেন। যদিও চীন-পাকিস্তান সম্পর্কের সূত্রপাত করেছিলেন পাকিস্তানের পূর্বেকার প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। বামপন্থিরা কিন্তু এই সােহরাওয়ার্দী সাহেবকে তার মৃত্যু অবধি মার্কিনপন্থি বলেই অপবাদ দিয়ে গেছে। ভারতকে মােকাবেলার জন্য আইয়ুব চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বকে আরও উচ্চপর্যায়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেন। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই পাকিস্তান সফরের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন।
কুটনৈতিক পর্যায় ছাড়াও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার জন্য দেশের চীনপন্থি রাজনৈতিক নেতাদেরও কাজে লাগানাে যেতে পারে—এ চিন্তা থেকে আইয়ুব খান এ সময় মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেন। এভাবে সরকারের সঙ্গে মওলানা ভাসানী ও তাঁর অনুসারীদের একটা হৃদ্যতা সৃষ্টি হয়। মওলানা ভাসানীর পরামর্শ অনুযায়ী সরকার ছয়জন কমিউনিস্ট বা কমিউনিস্টপন্থি রাজনীতিবিদের ওপর থেকে হুলিয়া তুলে নেন। তাদের মধ্যে ছিলেন মােহাম্মদ তােয়াহা, আবদুল হক, অধ্যাপক আসহাবউদ্দিন, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ প্রমুখ। এঁদের মধ্যে একমাত্র অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ ছাড়া বাকি পাঁচজনই ছিলেন চীনপন্থি
পৃষ্ঠা: ৬৩
(মােজাফফর আহমদ রুশপন্থি ছিলেন)। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের এই সম্পর্ক উন্নয়নের ফলে এ সময় পূর্বপাকিস্তানে চীনা কমিউনিস্ট বইপত্রের ছড়াছড়ি পড়ে যায়। দোকানে দোকানে মাও সেতুং-এর ক্ষুদে ‘লাল বই’ দশ্যমান হতে থাকে। আইয়ুব-ভাসানী সমঝােতার অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল শেখ মুজিবের ৬-দফার বিরােধিতা করা।
এ সময়ে যারা ৬-দফার বিরােধিতা করতেন তারা ছিলেন মূলত চীন ও রুশপন্থি। ছাত্র ইউনিয়ন ৬-দফার বিরােধিতা করতাে। ছাত্র ইউনিয়ন ও জামায়াতে ইসলামের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ ৬-দফাকে পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র এবং আমেরিকা বা সিআইয়ের দলিল হিসেবে চিত্রিত করতাে। তারা বলতাে, আমেরিকা ৬-দফার মাধ্যমে পাকিস্তানকে দুই টুকরাে করে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানকে একটি মার্কিন উপনিবেশে পরিণত করতে চায়। তারা এও বলতে থাকে যে ৬-দফা আসলে শেখ মুজিব বা বাঙালিদের কেউ তৈরি করেনি; এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অর্থনীতিবিদ ও মার্কিন সামরিক বাহিনীর যৌথ চিন্তার ফসল। শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে তারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল বলতাে। আমরা সে সময় তাদের সে অপপ্রচারের জবাব দেবার চেষ্টা করতাম।
পঞ্চাশ বছরেরও পরে আজ আমরা কী দেখছি? সেদিন যারা ৬-দফার পক্ষে জীবন দিয়ে সংগ্রাম করেছিল, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিল, তাদের অধিকাংশই আজ ক্ষমতা এবং রাজনীতির মূলধারা থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়েছে। অথচ ৬-দফাকে সিআইয়ের দলিল এবং শেখ মুজিবকে সিআইয়ের দালাল বলা রাশেদ খান মেনন-মতিয়া চৌধুরীরা অনেকেই মন্ত্রী ও অন্যান্য পর্যায়ে রাষ্ট্র ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। এর আগের সরকারগুলােয় ইসলামী ছাত্র সংঘের তৎকালীন সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী ও আরেক নেতা আলী আহসান মুজাহিদ পূর্ণ মন্ত্রী মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।
রাজনৈতিক মেরুকরণ
৬-দফাকে কেন্দ্র করে ছাত্র রাজনীতিতেও এক মেরুকরণের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ছাত্র ইউনিয়নের মেনন-রনােরা ৬-দফাকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের চক্রান্ত এবং শেখ মুজিবকে ভারতের এজেন্ট হিসেবে
পৃষ্ঠা: ৬৪
প্রচার করতে থাকে। এ অবস্থায় একমাত্র ছাত্রলীগ ৬-দফাকে তাদের ম্যাগনা কার্টা (Magna Carta) বা অধিকারের দলিল হিসেবে ঘোষণা দেয়। যেহেতু আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে ‘স্বাধীনতা’র দিকে নিয়ে যাওয়া এবং সে মুহূর্তে আমাদের কাছে ৬-দফাই ছিল একমাত্র সে রকম রাজনৈতিক কর্মসূচি, তাই আমরা লক্ষ্য ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের উপযােগী করে ছাত্রলীগকে গড়ে তােলার প্রচেষ্টা চালাতে থাকি। পাশাপাশি মাঝে-মধ্যেই পােস্টার, দেয়াল লিখন (চিকা), বিবৃতি এবং ছাত্রলীগের ছােট-বড় সভা-সম্মেলনের বকৃতায় ‘স্বায়ত্তশাসন’, ‘স্বাধিকার ইত্যাদি কথাগুলাের মধ্য দিয়ে পরােক্ষভাবে হলেও পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রচার-প্রচারণা চলতে থাকে।
এ পর্যায়ে ‘নিউক্লিয়াস’কে সম্প্রসারিত করার সুযােগ বিশেষভাবে কাজে লাগানাে হয়। নিউক্লিয়াস’-এর সদস্য সংখ্যা এ সময় প্রায় চার হাজার হয়ে যায়। এ সংখ্যাকে কাঠামােভুক্ত করার ক্ষেত্রে আমরা বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হই। ইতিমধ্যে ঢাকায় রিকশা ও গাড়ির নাম্বার, দোকানপাট, অফিস-আদালতের সাইনবাের্ড সত্তর থেকে আশি ভাগ বাংলায় লেখা হয়ে যায়। জেলা পর্যায়ে এটি দাঁড়ায় প্রায় শতভাগ। ১৯৬৬ সালে ৬-দফা দেওয়ার পর আমার সঙ্গে শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠতা স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। তখনও আওয়ামী লীগের অফিস ১৫, পুরনাে পল্টনে। অফিস থেকে ফেরার পথে তিনি প্রায়ই গাড়িতে করে আমাকে তুলে হলের কাছাকাছি অথবা ধানমণ্ডির কোথাও নামিয়ে দিয়ে বাসায় যেতেন। তাঁর বাসা তখন ধানমন্ডি ৩২-এ। এ পর্যায়ে কোনােদিন তার সঙ্গে ‘নিউক্লিয়াস’ নিয়ে কোনাে আলাপ-আলােচনা হয়নি। তবে আমার কাজের গতি ও গভীরতা, যেকোনাে বিষয়ে আমার আগ্রহ, এসব তার নজরে পড়তাে। একদিন তিনি বললেন, ‘সিরাজ, আমি হয়তাে বেশি দিন বাইরে থাকতে পারবাে না।’ কথাটা শুনে আমার ভালাে লাগলাে না। আরেক দিন তার সঙ্গে গাড়িতে আসার সময় আমি বললাম, ‘মুজিব ভাই, আওয়ামী লীগকে বড় দলে পরিণত করতে হলে এবং দেশের সকল শ্রেণির মানুষের কল্যাণ করার উদ্দেশ্য যদি আমাদের থাকে তাহলে ব্রিটেনের লেবার পার্টির মতাে করে
পৃষ্ঠা: ৬৫
আওয়ামী লীগকে গড়ে তুলতে হবে। তার জন্য ছাত্র-যুবকদের প্রাধান্যের পরিবর্তে দলে শ্রমিক-কৃষকদের, বিশেষ করে শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্তি খুবই প্রয়ােজন।
শুনে তিনি বললেন, ‘আমি তাে কৃষক-শ্রমিকদের উন্নতি চাই।’ আমি বললাম, ‘মুজিব ভাই, এখন তাে তারা শুধুমাত্র ভােট দেওয়ার মালিক।
তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমরা দুজনেই গাড়ির পিছনের সিটে বসা। অত্যন্ত স্নেহভরে আমার ঘাড়ের ওপর হাত রেখে তিনি বললেন, ‘কী বলতে চাস, বলতাে?
আমি বললাম, “ব্রিটেনের লেবার পাটির মতাে শ্রমিক-কৃষকদের প্রাধান্য দিয়ে দলকে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য শ্রমিক এবং কৃষকদের মধ্যে দলকে নিয়ে যেতে হবে।”
আবারও তিনি আমার দিকে তাকালেন। বললেন, ‘সময় আসলে বলবাে কখন তাদের মধ্যে কাজ করবি। তােকে দিয়েই এ কাজ সম্ভব।’
আমি বললাম, আমাদের দেশটাকে ব্রিটেনের মতাে কল্যাণ রাষ্ট্র (Welfare State) হিসেবে গড়ে তােলা উচিত।’
গভীর বিশ্বাস নিয়ে তিনি আবারও আমাকে বললেন, ‘তুই-ই পারবি।’ এর মধ্যে ধানমণ্ডিতে তার বাসার কাছে আসতেই আমি নেমে গেলাম। আর একদিন আমি বললাম, মুজিব ভাই, ৬-দফার ওপরে একটি সেমিনার করলে কেমন হয়?
তিনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমাদের এই নপুংসক বুদ্ধিজীবীরা ৬-দফার কী বুঝবে রে? আর যদি সেমিনার করতে দেই, যদি না বুঝেই বিরােধিতা করে বসে, তাহলে তাে উপকারের চেয়ে ক্ষতিই হবে বেশি।’
‘ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে’এই বুদ্ধিজীবীদের কী ভূমিকা ছিল তা এখন আমরা সবাই জানি। যে ন্যাক্কারজনক, লজ্জাকর ও নেতিবাচক ভূমিকা তারা রেখেছে, মুজিব ভাইয়ের সেদিনকার কথায় আমি তার পূর্বাভাস পেয়েছিলাম। তখনকার শিল্পী-সাহিত্যিকদের ব্যাপারেও একই কথা। ৬-দফা ও ১১-দফা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে দু-একজন শিল্পী বাদে আর কাউকে আমরা
পৃষ্ঠা: ৬৬
স্বাধীনতার সংগ্রামে শামিল করাতে পারিনি। স্বাধীনতার পর তারা যে সরকারি পৃষ্ঠপােষকতা ও সুবিধা ভােগ করেছেন এবং করছেন তা আমাদের শিল্প-সাহিত্য জগতকে বিভ্রান্ত ও কালিমালিপ্ত করার জন্য দায়ী। এ কথা চলচ্চিত্র, সাহিত্য ও সংস্কৃতিসহ সব ক্ষেত্রের বেলায় প্রযােজ্য।
৬-দফা দেওয়ার পর এক বছর চার মাস সময়ে মুজিব ভাই সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন এবং এ সময় দলের তখনকার শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী জনগণের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী মারা যাবার পর আওয়ামী লীগ কার্যত দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায় । আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে একভাগ ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ)-এ থেকে যান এবং অপর ভাগ মুজিব ভাইয়ের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে নব উদ্দীপনায় রাজনীতি শুরু করে। এই অংশের সভাপতি হলেন মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ আর সাধারণ সম্পাদক মুজিব ভাই। কাজ না করে দল ভারি করার পক্ষে আমাদের দেশে কখনােই নেতার অভাব হয় না। এনডিএফ সে কারণেই নেতাভারি সংগঠন হয়ে রইল। অন্যদিকে আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচি সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ এক রকমের নড়বড়ে সংগঠনে পরিণত হলাে। দলের পূর্ণাঙ্গ জেলা, মহকুমা কমিটি দশটির বেশি ছিল না। থানা পর্যায়ে মুজিবভক্ত দুই-একজন করে ছিলেন। তাও সব থানায় নয়।
৬-দফা কর্মসূচি নিয়ে সারা দেশ চষে বেড়ানাের ব্যাপারে মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার ব্যাপক আলাপ-আলােচনা হতাে। জেলা পর্যায়ে জনসভা করার জন্য ঢাকা থেকে লিফলেট ছাপিয়ে মাজহারুল হক বাকি ও আ স ম আবদুর রবকে পাঠানাে হতাে। কোথাও আবার পাঠানাে হতাে আবদুর রাজ্জাক ও আ স ম আব্দুর রবকে। কিছু টাকা দিয়ে দেওয়া হতাে যাতে মিটিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা ঐ শহরে অবস্থান করতে পারেন। কোথাও কোথাও মাইকিং করার লােকও পাওয়া যেত না। সেক্ষেত্রে রব ও স্থানীয় কোনাে একজনকে নিয়ে মাইকিং করার ব্যবস্থা করা হতাে। দুই-একটা ছাড়া সব জেলা শহরেই তখন এভাবে মিটিং করার ব্যবস্থা হতাে। এ পর্যায়ে ছাত্রলীগকে নিজেদের সংগঠনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কাজকর্মও করতে
পৃষ্ঠা: ৬৭
হতাে। আর তা করতে গিয়ে রাজ্জাক আমাদের ‘নিউক্লিয়াস’ এর কাজও ত্বরান্বিত করার সুযােগ পেতাে।
ঢাকার বাইরে ‘নিউক্লিয়াস’-এর সংগঠন ও শক্তি গড়ে উঠতে থাকলাে দ্রুততার সঙ্গে। এ সময়ে মুজিব ভাইয়ের দেশব্যাপী সফর এবং তার জনসভাগুলােতে লােক-সমাগমের বিষয়টি সরকারের বিশেষ নজরে পড়তে শুরু করলাে। জেলা সফরের প্রায় শেষ পর্যায়ে সিলেটে
জনসভার পরপরই তাকে গ্রেফতার করা হলাে। সেদিনই তিনি কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে ঢাকায় এলেন। পরের সভাটি ছিল নারায়ণগঞ্জে। সভার আগের রাতে অফিস থেকে (৫১, পুরানা পল্টন) আমাকে গাড়িতে করে একসঙ্গে নিয়ে এসে ধানমণ্ডিতে নামিয়ে দেওয়ার সময় তিনিও নামলেন। রাস্তার একপাশে গাড়ি রাখতে বললেন ড্রাইভারকে। তারপর আমার ঘাড়ের ওপর হাত দিয়ে দশ-পনের গজ হেঁটে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কালকে নারায়ণগঞ্জ মিটিংয়ের পর আমাকে গ্রেফতার করবে এবং সরাসরি জেলে নিয়ে যাবে। তুই কিন্তু কাজ করে যাবি। তােদের কাজ যেন এক মুহুর্তের জন্যও থেমে না থাকে। তােরাই হচ্ছিস বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ। আওয়ামী লীগের অবস্থা তাে তুই জানিস। সরকার হয়তাে এবার আমাকে অনেকদিন জেলে রাখবে। জামিনও পাবাে না।’
আমার হাতে পনের শত টাকা দিয়ে বললেন, এটা রাখ। খুব অসুবিধায় পড়লে তাের ভাবির সঙ্গে দেখা করিস।’ আমি বললাম, এছাড়া আর কার সঙ্গে আমি যােগাযােগ রাখবাে?’ তিনি আওয়ামী লীগের কারাে নাম না বলে সেগুনবাগিচার একটি বাসার নম্বর দিয়ে বললেন, ‘নুরুল এসলাম।’ আমি বললাম, ‘নূরুল ইসলাম?’ তিনি বললেন, ‘হ্যা’। মনটা তার বেশ ভারি মনে হলাে। তিনি গাড়িতে উঠলেন। আমিও ইকবাল হলের দিকে চলে এলাম।
৫১ পুরানা পল্টনে অফিস নেওয়ার আগে আওয়ামী লীগের ১৫ পুরানা পল্টনের অফিসটি ছিল দুই রুমের একটি বাসা। অফিস খরচ চালাতে অসুবিধা হতাে। বিল না দিতে পারার কারণে বাড়িওয়ালা ইলেকটিক লাইন কেটে দিতেন। ফলে আমাদেরকে সন্ধ্যা অথবা রাতের বেলায় প্রায়ই হারিকেন জ্বালিয়ে কাজ করতে হতাে।
পৃষ্ঠা: ৬৮
মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে তাজউদ্দিন ভাইও জেলে যান। এ সময়ে মিজানুর রহমান চৌধুরী সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। কয়েক মাস পরে মিজান ভাইও গ্রেফতার হয়ে গেলেন। তখন দলের মহিলা সম্পাদিকা আমেনা বেগমকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হলো। ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী। গােলাম মােস্তফা ভাইও তখন জেলে। আমেনা বেগম প্রতিদিনই অফিসে আসতেন। আমি ও রাজ্জাক ছাড়া আরেফ দুই-একদিন অন্তর আওয়ামী লীগ অফিসে আসতাে।
শেখ সাহেবের ৬-দফা কর্মসূচি ঘােষণা দেশের মানুষের কাছে যেমন, তেমনি আমাদের কাছেও ছিল আকস্মিক একটি ঘটনা। পরবর্তীকালে শুনেছি ৬-দফা প্রণয়ন-এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন কাজী আহমেদ ফজলুর রহমান, রুহুল কুদ্দুস ও শামসুর রহমান খান (জনসন)। এরা তিনজনই ছিলেন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এছাড়া তাজউদ্দিন সাহেব তাে ছিলেনই। শেখ মুজিবের সম্মতিক্রমেই এই ৬-দফা প্রণয়নের কাজটি শুরু হয়। তিনিই তাজউদ্দিন ভাইয়ের এ কাজে ওতপ্রােতভাবে যুক্ত থাকার ব্যবস্থা করেন। উপরােক্ত সিএসপি কর্মকর্তাদেরও তাজউদ্দিনের এই অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে জানানাে হয়। আরও দুজনের অন্তর্ভুক্তির কথা শুনেছি। কিন্তু তারা কারা জানতে পারিনি। মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে আমার আলাপ হলেও তিনিও আমাকে এই তিনজনের বাইরে আর কারও নাম বলেননি। ৬-দফা প্রণয়নকারীরা শুধু যে উচ্চশিক্ষিতই ছিলেন তা নয়, জ্ঞান ও মেধার দিক থেকেও অনেক উপরের স্তরের মানুষ ছিলেন তাঁরা। ৬-দফা প্রণয়নকালে মুজিব ভাইয়ের রাজনীতির চূড়ান্ত লক্ষ্যের কথা তাদের মাথায় ছিল। আর মুজিব ভাইও ৬-দফাকে সেভাবেই বুঝতেন ।
৬-দফার দফাগুলাে সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে এটি স্পষ্ট হয়। যে, ভবিষ্যতে পাকিস্তানের দুই অংশ একত্রে থাকার কোনাে প্রশ্নই ওঠে না। প্রথমদিকে আমাদের কাছে যখন কর্মসূচিটি এলাে, আমাদের জ্ঞান ও বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, আমরা একে চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার কর্মসূচি হিসেবেই গ্রহণ করি।
পৃষ্ঠা: ৬৯
‘নিউক্লিয়াস’-এর তরফে এ সময়ে কয়েকটি বিষয়কে আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হয়। এক. ৬-দফার প্রচার ও বাস্তবায়নে প্রধানত ছাত্র-যুবশক্তিকে সংগঠিত করতে হবে। দুই. সংগঠিত হবার এ পর্যায়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের উভয় গ্রুপের সমর্থন জরুরি। তিন, এ পর্যায়ে ‘নিউক্লিয়াস’-এর সাংগঠনিক শক্তিবৃদ্ধি কেবল প্রয়ােজনীয়ই নয়, ‘নিউক্লিয়াস’-এর চূড়ান্ত লক্ষ্য যে স্বাধীনতা তা অর্জনের জন্যও এটি হবে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ । চার, জনগণের কাছে ৬-দফাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে হলেও একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি দেওয়া প্রয়ােজন। সে জন্য ছাত্র ধর্মঘটসহ হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ইতিমধ্যে মুজিব ভাই ও তাজউদ্দিন ভাই গ্রেফতার হয়েছেন। মিজান ভাই ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। আমি তিন ও চার নম্বর বিষয় দুটি তার কাছে উত্থাপন করলাম। মিজান ভাইয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল, আমাকে বিশ্বাসও করতেন পুরােপুরি। তিনি হেসে হেসে বললেন, “সিরাজ, তুমি তাে আমাকে বিপদে ফেলবা না?” কথাটা তিনি অবশ্য হাল্কা সুরেই বললেন। তারপর জানতে চাইলেন, “সিরাজ, আমাকে কী করতে হবে?”
আমি বললাম, আওয়ামী লীগ থেকে দুটি সাপাের্ট চাই। প্রথমত হরতালটা আহ্বান করতে হবে আওয়ামী লীগের নামে। ৬-দফার উল্লেখসহ মুজিব ভাইয়ের মুক্তি দাবি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দশ হাজার টাকা সংগ্রহ করে আপনার কাছে রাখবেন খরচের জন্য।’
তিনি হেসে বললেন, ‘আমার কিন্তু দুইটা কাজ, মনে রেখাে সিরাজ।’
হরতালের ব্যাপারটি নিয়ে আমরা প্রথমে আমাদের ‘নিউক্লিয়াস’-এ সিদ্ধান্ত নিই। মনির সঙ্গে আলাপ করি। তারপর আমি, মনি, রাজ্জাক ও মাজহারুল হক বাকি—এই চারজন আলাপ করি।।
হরতাল পরিচালনা
সিদ্ধান্ত চড়ান্ত করে পুরাে কাজটাকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করলাম। দায়িত্ব ও বণ্টন করলাম সেভাবে। ১. ছাত্রদের জন্য মনি, মাজহারুল হক বাকি ও রাজ্জাক ২. শ্রমিকদের জন্য আমি ও মেজবাহ (বর্তমানে
পৃষ্ঠা: ৭০
অঙ্কুর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী)। ছাত্রদের কাজ মনির তত্ত্বাবধানে সুন্দরভাবে হয়েছিল। আমরা হরতালের প্রস্তুতির জন্য সাতদিনের সময় নিয়েছিলাম। হরতালের তারিখ ছিল ১৯৬৬-এর ৭ জুন। শ্রমিকদের মধ্যে সংগঠনের কাজ করার জন্য আমার একটি পঞ্চাশ সিসি হােন্ডা মােটর সাইকেল ছিল। তখন ঢাকায় মােটর সাইকেল শ’চারেক। আমার মােটর সাইকেল দিয়ে আমি ও মেজবাহ টঙ্গি থেকে তেজগাঁও হয়ে ডেমরা-আদমজি পর্যন্ত চারদিনে শ্রমিকদের সঙ্গে প্রাথমিক যােগাযােগ করে ফেলি। এই যােগাযােগের সূত্র ছিল প্রধানত সেসব এলাকার কলেজগুলাের ছাত্রলীগ কর্মী ও আমাদের নিউক্লিয়াস’-এর সদস্যরা। তারা এই দুরূহ কাজটি কত সহজভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে করেছিল, আজকের দিনে কাউকে তা বলে বিশ্বাস করানাে যাবে না । দ্বিতীয় সূত্রটি ছিল, এলাকার শ্রমিক নেতারা যাদের অধিকাংশের বাড়ি ছিল নােয়াখালী। আমি এই নােয়াখালী সূত্রটিকে খুব সফলভাবে কাজে লাগাতে পেরেছিলাম ।
এসব শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক সংগঠনগুলাে ছিল অন্যদের দখলে। যেমন আদমজিতে ছিল নির্মল সেনদের দলের শ্রমিক সংগঠন, নারায়ণগঞ্জ ও মদনগঞ্জ (বন্দর) এলাকায় কাজ করতাে কাজী জাফরদের পূর্বপাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন। আদমজির দ্বিতীয় কাতারের নেতাদের মধ্য থেকে সাইদুল হক সাদুকে পেলাম। সাদুকে নিয়ে মদনগঞ্জ অর্গানাইজ করা হলাে। টঙ্গিতে ছিলেন নােয়াখালীর আবদুল মান্নান। তাঁকে পাওয়া গেল। তেজগাঁয়ে ছিলেন রুহুল আমিন। ভূঁইয়া। প্রায় একশত শ্রমিক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। তাঁকেও পেলাম। তারা ওসব এলাকায় হরতাল পালনের পুরাে দায়িত্ব নিলেন।
দ্বিতীয় সারির এসব শ্রমিক নেতা আমাদের জানালেন হরতাল কর্মসূচি সফল করার জন্য তাদের সর্বমােট এক হাজার টাকা প্রয়ােজন। মিজান ভাই দুদিন ঘােরাঘুরি করে টাকা সংগ্রহ করলেন। হরতালের দুদিন আগে এই নেতাদের পৃথকভাবে মিজান ভাইয়ের সামনে নিয়ে গেলাম। মাথায় একটা তােয়ালে মুড়ে মিজান ভাই ১৫, পুরানা পল্টনে আওয়ামী লীগ অফিসে এলেন। হরতাল পালনের বিভিন্ন কাজের জন্য শ্রমিক নেতাদের সর্বমােট ৮৭৫ টাকা দেওয়া হলাে।
পৃষ্ঠা: ৭১
তথন হরতালের সময় গাছের গুড়ি অথবা ট্রাকের টায়ার জ্বালিয়ে ব্যারিকেড (প্রতিবন্ধকতা) তৈরির প্রচলন ছিল না। ঢাকা শহরের চারপাশে নির্মাণ কাজ চলতে থাকে সারা বছর ধরে। এক ইঞ্চি দুই ইঞ্চি ফাঁকে ফাঁকে ইট বিছিয়ে কিছু কিছু জায়গায় পেট্রোল ঢেলে দিয়ে আগুন জ্বালানাের ব্যবস্থা করা হতাে। হরতালের আগের রাতে ছোট ছােট লাঠির মাথায় কাপড় অথবা পাট জড়িয়ে তাতে আগুন জ্বেলে মিছিল করা হতাে, যা পরবর্তীকালে মশাল মিছিল নামে পরিচিতি পায়। খণ্ড খণ্ড মিছিল করে হরতালের প্রচার করা হতাে। শ্রমিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রেখে এলাকার ছাত্রলীগ ও ‘নিউক্লিয়াস’-এর সদস্যরা গােপনভাবে হরতালকারী শ্রমিকদের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করতাে। কেন্দ্র থেকে তাদেরকে এভাবেই নির্দেশ দেওয়া হতাে।
ঢাকা শহরে ছাত্রলীগ কর্মীদের তিন থেকে পাঁচজনের খণ্ড খণ্ড গ্রুপ সরকারি ইপিআরটিসি-র (বর্তমানে বিআরটিসি) বাসগুলাের ওপর আক্রমণ চালাতাে। তার আগে বাস থামিয়ে যাত্রীদের নেমে যেতে বলতাে। মুসলিম লীগের গুণ্ডাপাণ্ডারা বা পুলিশ হামলা করলে হরতালকারী ছাত্র-শ্রমিকরা কখনও কখনও সেসব বাসে অগ্নিসংযােগ করতাে। সে সময়ে প্রাইভেট বাস বলতে গেলে ছিলােই না, ট্রাকেরও তেমন ব্যবহার বা চলাচল চোখে পড়ত না। হরতালের আগের দিন প্রাইভেট গাড়িসহ ঢাকা শহরের প্রায় ৫০টি জায়গায় গাড়ি থামিয়ে হরতালের কথা বলা হলাে। অনুরােধ করা হলাে কেউ যেন হরতালে গাড়ি বের না করেন। শহরে অসংখ্য খণ্ড মিছিল বের করা হলাে। পিকেটিং করার জন্য ৫০/৫৫টি স্থান নির্দিষ্ট করা হলাে।
হরতালের দুদিন আগে থেকে এসব কার্যক্রম পরিচালিত হলাে। দোকানপাট বন্ধের ব্যাপারে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মীরা বিরাট ভূমিকা রাখলাে। ৭ জুন হরতাল। অথচ ৬ জুন দুপুর ২টা থেকে ঢাকার রাস্তা গাড়িশূন্য হয়ে যায়। দোকানপাটগুলাে ৫টা বাজতেই বন্ধ হয়ে গেল। সারা শহরে রিকশার সংখ্যা তখন হাজার-পঞ্চাশ । তাদেরকে হরতালের পক্ষে সংগঠিত করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। ট্রেন চলাচল বন্ধের জন্য রাতেই কয়েকটি জায়গায় রেললাইন তুলে ফেলা, স্লিপার ও ফিশপ্লেট খুলে ফেলা এবং লাইনের উপরে আড়াআড়িভাবে লােহার রেল ফেলে রাখা হলাে। এসবের ফলে ৭
পৃষ্ঠা: ৭২
তারিখ সকাল পাঁচটা থেকে আটটার মধ্যে গােটা ঢাকা শহর যেন এক যুদ্ধবিধ্বস্ত নগরীতে পরিণত হলাে। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এলো। ছাত্রদের ও শ্রমিকদের খণ্ড খণ্ড মিছিল সেদিন ঢাকা শহরকে এক ভিন্ন চেহারা দেয়।
ঢাকার বাইরেও স্থানীয় কলেজ শাখা ছাত্রলীগের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলা শহর এবং ছােট ছােট শিল্প এলাকাগুলােতে হরতালের পক্ষে প্রচার ও মানুষকে সংগঠিত করার কাজ হয়। হরতালের দিন সেসব এলাকায় যেমন চট্টগ্রাম বন্দর, সীতাকুন্ড শিল্পাঞ্চল, খুলনার খালিশপুর ও উত্তরবঙ্গের সৈয়দপুরে জনজীবন অচল ও স্বাভাবিক কর্মপ্রবাহ থমকে দাঁড়িয়ে যায়। ১৯৬৬ সালের ঐ দিন পর্যন্ত সারা দেশে ‘নিউক্লিয়াস’- এর সদস্য সংখ্যা দেড় থেকে দুই হাজারে দাড়িয়েছিল। ঢাকার বাইরে হরতাল সফল করতে এই ‘নিউক্লিয়াস’ সদস্যরাই আসলে প্রধান ভূমিকা রাখে। সেদিন নদী-বন্দরগুলােয় কোনাে নৌকা বা লঞ্চ যাতায়াত করেনি। পুরাে প্রদেশে ট্রেন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা শহর ছিল অচল। দোকানপাট, শিল্পকারখানা ও স্কুল-কলেজ ছিল বন্ধ। দুপুরের পর থেকে ঢাকা শহর জনতার শহরে পরিণত হয়। ছাত্র-শ্রমিকরা এক হয়ে এটিকে মিছিলের নগরীতে পরিণত করে।
হরতাল পরিচালনার জন্য আমাদের দুটি কেন্দ্র ছিল। একটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে “ডাকসু’ অফিস। এলাকা হিসেবে জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা কলেজ ও তিতুমীর কলেজ ছিল তার উপকেন্দ্র। দ্বিতীয়টি আওয়ামী লীগ অফিস। এটি ছিল শ্রমিক এলাকা নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র। আমি ঐ কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলাম। ঢাকা শহরের হরতালের দায়িত্ব ছিল আমার। বিকেল ৪টার দিকে আনােয়ার হােসেন মঞ্জু আওয়ামী লীগ অফিসে এলাে তার প্রিন্স গাড়িটি নিয়ে। তাতে ‘সংবাদপত্র’ লেখা। সে আমাকে বললাে, “সিরাজ ভাই, তেজগাঁয়ে একজন শ্রমিক পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। ইত্তেফাক অফিসে খবরটি এসেছে।’ আমি আর মঞ্জু তার ‘সংবাদপত্র’ লেখা গাড়িটিতে করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের দিকে রওয়ানা হলাম। শাহবাগে এসে আমরা আর সামনে যেতে পারলাম না। রাস্তায় ইট বিছানাে থাকার কারণে রিকশা, গাড়ি বা বাস কোনাে ধরনের যানবাহনই চলতে পারছিল না। ফিরে আসতে আসতে দেখলাম ছােট ছােট কয়েকটি মিছিল। মিছিলগুলাে আওয়ামী লীগ অফিসে এলাে।
পৃষ্ঠা: ৭৩
সবকটি মিছিল তেজগাঁও থেকে আসা। মিছিলের লােকজনের কাছ থেকে আমি ও মঞ্জু হরতালের বিবরণ ও পুলিশের গুলির বর্ণনা বিশদভাবে শুনলাম। প্রায় এ সময়েই (বিকেল ৫টা) আওয়ামী লীগ অফিসে পুলিশের একটি গাড়ি এসে দাড়ালাে। জানতে চাইলাে, ‘এখানে সিরাজুল আলম খান কে আছেন’? আমরা বেশ কয়েকজন তখন ঐ অফিসে। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘আমি।’
একজন পুলিশ অফিসার বললেন, ‘আপনাকে আমাদের সঙ্গে যাত্রাবাড়ি পর্যন্ত যেতে হবে।’ বললেন, ‘যাত্রাবাড়ির ওখানে আদমজি ও ডেমরা থেকে আসা বিশ হাজার শ্রমিক দাঁড়িয়ে আছে। পাঁচ-সাত হাজার মশাল হাতে।’ অফিসার আরও বললেন, তাদের নেতা সাদ বলেছেন, তারা ঢাকায় হরতাল করতে এসেছে এবং আপনার সঙ্গে দেখা করবে। প্রথমে আমার বিশ্বাস হলাে না। কিন্তু
পুলিশের জিপে করে আসা আদমজির অন্য এক শ্রমিক নেতা শফি আমাকে বললাে, “সাদু ভাই আপনার হুকুম ছাড়া ফিরে যাবে না। পুলিশ আপনাকে নিয়ে যাবে বলে ওয়াদা করেছে।’ শফির কথা শুনে আমার বিশ্বাস হলাে।
আওয়ামী লীগ অফিসে তখন ছাত্ররাসহ আমাদের জনাবিশেক লােক ছিল। আর ছিল মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ (বর্তমানে অঙ্কুর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী)। আওয়ামী লীগের কেউ নেই। হরতাল সফল করতে পুরনাে ঢাকার চার-পাঁচটি এলাকায় আওয়ামী লীগের কয়েকজন কর্মী দায়িত্ব পালন করেছিল। আমি জীপে করে যাত্রাবাড়ি গেলাম । সেখানে যে চিত্র দেখলাম তা বর্ণনা করে বােঝানাে যাবে না। যুদ্ধে জয়ী সৈন্যরা যেভাবে পরস্পরের সঙ্গে গা মিলিয়ে কিছুটা সময় বিশ্রাম নেয়, অনেকটা তেমন।
স্থানীয় কয়েকজন লােক গ্লাসে করে লেবু পানি দিচ্ছিল সবাইকে। যাত্রাবাড়ি থেকে ডেমরা পর্যন্ত রাস্তায় খালি মানুষ আর মানুষ, অসংখ্য শ্রমিক। বিশ্রাম নিচ্ছে, কিন্তু চোখে-মুখে সংগ্রামের দৃঢ়তা। সেদিন পূর্ব বাংলার মানুষের যে সংগ্রামী চেহারা দেখেছিলাম তা থেকেই বুঝেছিলাম, আগামীতে এই সংগ্রাম কোনদিকে মােড় নেবে। ব্যারিকেড থাকার কারণে আমাদের যাত্রাবাড়ি পৌছতে দুই ঘণ্টা সময় লেগেছিল। সামনে থাকা
পৃষ্ঠা: ৭৪
পুলিশের গাড়ি থেকে নেমে পুলিশ সদস্যরা ইট সরিয়ে দিচ্ছে আর আমাদের গাড়ি আস্তে আস্তে সামনে এগুচ্ছে। পুলিশ অফিসার বললেন, ‘আসার সময় এভাবেই ইট সরিয়ে সরিয়ে আসতে হয়েছে। আমরা যাবার পর আবার ইট পাতা হয়েছে দেখছি।’
আমরা পৌছুতেই সাদু ও আরও দুই-একজন এগিয়ে এলেন। আমি ওদের বললাম, ‘হরতাল হয়েছে। তােমরা এবার ঘরে ফিরে যেতে পারাে।’ পুলিশ অফিসার বললেন, ‘এই হাজার হাজার শ্রমিকের মিছিলের সামনে পুলিশের গাড়ি থাকবে, পেছনেও পুলিশের গাড়ি থাকবে।
আমি বললাম, ‘ভালাে হবে।’
সাদুকে দেখে আমি বুঝলাম দু’তিন দিন তার ঘুম নেই । মদনগঞ্জের জুট মিল শ্রমিকদের সে সংগঠিত করেছে এবং নারায়ণগঞ্জের হরতালও তারাই সফল করেছে। যদিও নারায়ণগঞ্জে তােলারাম কলেজের ছাত্ররাই মূল দায়িত্ব পালন করে। তােলারাম কলেজের মনিরুল ইসলাম নামের বিএ প্রথম বর্ষের ও হাবিবুর রহমান খান (হাবিব) নামের এক স্কুল ছাত্র মূল ভূমিকায় ছিল । হাবিবুর রহমান খান বর্তমানে একজন সার্থক চলচ্চিত্র প্রযােজক।
সাদুকে বললাম, ‘তুমি পুলিশের গাড়িতে ওঠো।’ সে প্রথমে রাজি হলাে না। আমি তখন বললাম, “ওঠো! অন্তত যেতে যেতে একটু। বিশ্রাম হবে।’ পুলিশও বললাে, ‘আপনি আমাদের সঙ্গে থাকেন।’ ফিরে যাবার সময় মিছিলের গতি ছিল মন্থর। প্রায় তিন ঘণ্টা হেঁটে রাত সাড়ে দশটা নাগাদ মিছিলটি আদমজি পৌছায়। পরের দিন সংবাদপত্রগুলােতে হরতাল পালনের খবর খুবই দায়সারাভাবে ছাপা হয়। তেজগাঁয়ে শ্রমিক মনু মিয়া নিহত হবার খবরটি অবশ্য ছাপা হয়। তবে সেদিনের হরতালের খবরটি যেভাবে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তা পড়লে যিনি বিস্তারিত খবরাখবর রাখেন না কিংবা খবরকে তেমন গুরুত্ব দেন না, তার পক্ষে ৭ জুনের ঘটনার তাৎপর্য উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। একটি দিনের কর্মসূচি ও একজনের মৃত্যু। কোনাে দেশের রাজনীতিকে কতদূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, আন্দোলনের জনসম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে তা কী বিরাট ভূমিকা
পৃষ্ঠা: ৭৫
পালন করতে পারে, তার এক ঐতিহাসিক নিদর্শন হলাে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন।
সরকারের আরােপিত নানা বিধি-নিষেধ, সাংবাদিকদের অনাগ্রহ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের অংশগ্রহণ ছাড়াই ৭ জুন হরতালের সাফল্য প্রমাণ করলাে, রাজনৈতিক দল সমর্থন বা অংশগ্রহণ না করলেও জনতার সংগ্রাম থেমে থাকে না। ৭ জুনের হরতালে ছাত্রদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে শেখ ফজলুল হক মনির পরিকল্পনা এবং মাজহারুল হক বাকি ও রাজ্জাকের সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল তাদের জন্য এক মহাপরীক্ষা। আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে মিজান ভাই ছাড়াও মােয়াজ্জেম ভাইয়ের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
হরতালের আগে ও হরতালের দিন পুলিশের তৎপরতা থাকলেও কোনাে ধরনের মামলা বা হয়রানি খুব একটা দেখা যায়নি। কিন্তু হরতালের পর থেকে পুলিশের তৎপরতা আকস্মিকভাবেই বেড়ে গেল। শ্রমিক এলাকায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। আমরা জামিনে তাদের মুক্ত করলাম। ৭ জুনে সংঘটিত এত বড় ঘটনার পরেও ৬- দফার প্রতি সংবাদপত্র, সাংবাদিক সমাজ, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী মহলের কোনাে প্রকার আগ্রহ দেখা গেল না। ১৯৬০-এর দশকের প্রথমভাগে কবি-সাহিত্যিক-সংবাদিকদের প্রতি সরকারি পৃষ্ঠপােষকতার ফল এভাবেই ফলতে দেখা গেল। ১৯৬০ দশকের শেষার্ধে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর সরকারের বিধি-নিষেধ আরােপ করার পরই কেবল আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিকদের একাংশ এবং বামপন্থি বুদ্ধিজীবী (তাত্ত্বিক বিপ্লবী হিসেবে পরিচিত) মহলকে এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা দেয়। মাত্র কিছুদিন আগে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকে উপলক্ষ করে মুসলিম জাতীয়তা ও ইসলামি তাহজিব-তমদুনের প্রতি প্রেম যাদের ভাসিয়ে নিয়েছিল, তারাই যেন হঠাৎ এ সময় তাদের বাঙালি সত্ত্বা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠলেন।
৭ জুনের পর সারা দেশে রাজনৈতিক মহলে ৬-দফা প্রধান আলােচনার বিষয়ে (পক্ষে-বিপক্ষে) পরিণত হয়। আমাদের মনে হলাে এই আলােচনা-বিতর্কটা শেষ পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য অর্জনের সহায়ক হবে। হয়েছিলও তাই। ঐ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পূর্ব
পৃষ্ঠা: ৭৬
পাকিস্তানের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ছাত্রলীগ বিপুলভাবে জয়ী হয়। এর আগে এসব সংসদের ৬০-৬৫% নিয়ন্ত্রণ করতো ছাত্র ইউনিয়ন। ১৯৬৬, ৬৭ ও ‘৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের কলেজ ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচনে আমরা ৯০%-এর বেশি কলেজে জয়ী হই। এই সমর্থন আমাদের অতিরিক্ত মনােবল, আত্মবিশ্বাস ও সাহস যােগালাে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে এই সাফল্যকে আমরা ‘নিউক্লিয়াস’-এর সমর্থন ও শক্তিবৃদ্ধির কাজে লাগাতে পারলাম ।
এরই পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনকে আন্দোলনে আনার জন্য আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকে। ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের মাধ্যমে আমি ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। বহু অনুরােধের পর তার সঙ্গে সাক্ষাত হলাে । ফরহাদ ভাই তখন কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করার মূল দায়িত্বে ছিলেন। ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ-আলােচনায়। তার মনােভাব ছিল সহযােগিতামূলক। যদিও তিনি ৬-দফাকে আন্দোলনের মূল বিষয় হিসেবে গণ্য করতে রাজি হলেন না। তবে ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে তার আপত্তি ছিল না, বরং আগ্রহই লক্ষ করেছি।
ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে আলােচনা থেকে আমি তাদের আসল রাজনৈতিক মনােভাবটা বুঝতে পারলাম। তবু ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক বাদ দেওয়া উচিত মনে করলাম না। ‘মেনন গ্রুপ’ ছাত্র ইউনিয়ন তখন সংগঠিত হচ্ছে। তারা তাদের গঠনতন্ত্র, ঘােষণাপত্র ইত্যাদি তৈরি করার পর আমাকে পড়ে শােনালেন। তাদের রাজনীতির মূল কথা পাকিস্তানভিত্তিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আলাদাভাবে পূর্ব পাকিস্তান ভিত্তিক রাজনীতি করার অর্থ তাঁদের মতে সিআইএ এবং ভারতের কাছে রাজনৈতিক আত্মসমর্পণ । আমি তাদের মূল নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি কিনা জানতে চাইলে তারা বললেন, ‘তারা তাে আত্মগােপনে থাকেন। তারপরেও সম্ভব হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ডাক্তার মর্তুজার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। তাঁর রাজনৈতিক সম্পর্কের কথাও (কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য) আমি জানতাম। সেই সুবাদে কমিউনিস্ট নেতাদের কারও সঙ্গে কথা বলার সুযােগ হবে কিনা জানতে চাইলে
পৃষ্ঠা: ৭৭
ডা. মর্তুজা গােপনে তাঁদের সঙ্গে আমার আলাপের ব্যবস্থা করলেন। তােয়াহা ভাই (মােহাম্মদ তােয়াহা) ও হক ভাই (আবদুল হক) আমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হলেন। একদিন রাত ১১টা থেকে সকাল ৫ টা পর্যন্ত ইকবাল হলের ২/৩টি রুমে পর্যায়ক্রমে (নিরাপত্তার কারণে) মােট ছয় ঘণ্টা আলাপ হলাে। আলােচনায় তারা ৬-দফাকে এক কথায় সিআইএ প্রােগ্রাম বলে অভিহিত করলেন। এছাড়া তাদের স্থির বিশ্বাস শেখ মুজিব হলেন ভারতের এজেন্ট। আর রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি অত্যন্ত অযােগ্য ও নিম্নমানের। সুতরাং তার নেতৃত্বে কোনাে বড় কাজ করা সম্ভব নয়। তারা এও বললেন, মুজিবের নেতৃত্বে ৬-দফা আন্দোলনকে সামনে রেখে এগিয়ে গেলে সেটা হবে রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল। সেই সঙ্গে তারা আবার এও বললেন, ঐ মুহূর্তে পাকিস্তানভিত্তিক রাজনীতি করলেও, তাদের অবস্থান শেষ পর্যন্ত পর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষেই। তােয়াহা ভাই বরং আরও এক ধাপ এগিয়ে বললেন, ১৯৪৮ সালেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ছাড়া গত্যন্তর নেই—এ ধরনের রাজনৈতিক বক্তৃতা দিতেন আর সে সময়ই তিনি স্বাধীনতা চেয়ে একটি নিবন্ধও লিখেছিলেন। এসব বলে তাঁরা আমাকে বােঝাতে চাইলেন যে, তাঁরাও আসলে স্বাধীনতার পক্ষে, তবে ৬-দফা দিয়ে, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে কিংবা ভারত বা আমেরিকার লেজুড়বৃত্তি করে সে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়।
১৯৬৫-‘৬৬-এর পর থেকে ১৯৭১-এর মার্চ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত কোনাে কবি-সাহিত্যিক বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে কোনাে প্রবন্ধ, নাটক বা উপন্যাস লেখেননি। একটি ছড়া পর্যন্ত তারা লিখতে পারলেন না। ২৫ মার্চের ধ্বংসলীলার আগ পর্যন্ত এরা ছিলেন প্রায় নির্বাক। মনের নিভৃতে তাদের অনেকে হয়তােবা স্বাধীনতার গােপন বাসনা পুষে রেখেছিলেন। কিন্তু বাসনার ঐ শিখাটি আলাে দিতে পারেনি আর একজন মানুষকেও। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এদের অনেকে আরােহন করেছেন খ্যাতির শীর্ষে, অভিষিক্ত হয়েছেন নানা সম্মান পদ ও পুরস্কারে।
তবে কারাে জন্যই কোনাে কিছু অপেক্ষা করে থাকে না। বয়স্ক কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা দালালি করেছেন। কিন্তু ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের তরুণ-যুবারা তাঁদের শিল্প-সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে জাগরণের বাণী প্রচার করেছেন। এদের মধ্যে ছিলেন
পৃষ্ঠা: ৭৮
আহমদ ছফা, মাহবুব তালুকদার, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, নাসিরুল ইসলাম বাচ্চু, রাহাত খান, শামসুজ্জামান খান, আসাদ চৌধুরী, রশিদ হায়দার, মিলন মাহমুদ, সুমন মাহমুদ, আমিনুল হক বাদশা, কণ্ঠ শিল্পী আপেল মাহমুদ, ফকির আলমগীর প্রমুখ। সন্দ্বীপের কবিয়াল শফি আহমেদ তার রাজনৈতিক গান দিয়ে বড় বড় জনসভায় লােক জমায়েত করে রাখতাে।
স্বাধীনতার প্রস্তুতিপর্ব
১৯৬৬-‘৬৭ এ দুই বছর আমরা স্বাধীনতার বিষয়টিকে শুধু স্লোগানে সীমাবদ্ধ না রেখে পরবর্তী পর্যায়ের করণীয়সমূহ নিয়েও চিন্তাভাবনা করতে শুরু করি। এজন্য কেরানীগঞ্জ থানার কলাতিয়ায় রতন-গগন- মাখনদের বাড়িটিকে আমরা আমাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করতে থাকি। এই তিন ভাইয়ের বড়জন রতন আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। অবস্থাপন্ন এই পরিবারটি শুধু আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাই নয়, বরং আর্থিক ও অন্যান্যভাবে আমাদের সশস্ত্র কার্যক্রমেও সহায়তা করে।
১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে যােগাযােগের উদ্যোগ নেই। কিন্তু তাদের মধ্যে একমাত্র মওলানা ভাসানী ছাড়া আর কাউকেই স্বাধীনতার ধারণার সঙ্গে যুক্ত করতে পারিনি। এ পর্যায়ে আবু হােসেন সরকার, হামিদুল হক চৌধুরী, ফজলুল কাদের চৌধুরী, মওলানা ফরিদ আহমদসহ অনেকের সঙ্গে আমাদের যােগাযােগ হয়েছিল। তারা প্রত্যেকেই স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তাে ছিলেনই, উপরন্তু আমাদের স্বাধীনতার চিন্তাটি এক ধরনের কাল্পনিক ও রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক বিষয়, তা বলতেও দ্বিধা করেননি। ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবকে নিয়ে তােমরা চিন্তা করাে? সে তাে রাজনীতির কিছুই বােঝে না। অথচ এই ফজলুল কাদেরই এদেশে প্রথম রাজনীতিতে ব্যবহারের জন্য লাঠিয়াল ও গুণ্ডাবাহিনী তৈরি করেছিলেন। আতাউর রহমান খানকে আমরা একজন শিক্ষিত ও যােগ্য ব্যক্তি হিসেবে পেয়েছি। কিন্তু শিক্ষা ও মােগ্যতার বাইরে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আর যে
পৃষ্ঠা: ৭৯
গুনটির প্রয়ােজন, সেই সাহস জিনিসটি তার মধ্যে একেবারেই ছিল না। তার পেছনে আমাকে অনেকটা সময় নষ্ট করতে হয়েছিল।
উপরে যাঁদের সঙ্গে যােগাযােগ ও আলাপ-আলােচনার কথা বললাম সে-সব যােগাযােগ ‘নিউক্লিয়াস’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই হয়েছিল। এসব যােগাযােগ আমাদেরকে অনেক দিন ধরেই করতে হয়েছিল। পরবর্তী পর্যায়ে আরও যেসব নেতার সঙ্গে আমাদের যােগাযােগ হয়, যেমন অলি আহাদ, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, মাহমুদ আলী, এ টি এম তাহা, রফিকুল হক, তারা প্রত্যেকেই ছিলেন প্রতিভাবান। কিন্তু স্বাধীনতার বিষয়টি তাদের চিন্তার বাইরে ছিল। প্রাদেশিক রাজনীতিতে সফলতা অর্জনই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। স্বাধীনতার বিষয়টি যখন আলােচনায় আসতাে তখন দেখতাম তার জন্য যে সাহস ও অন্যান্য যােগ্যতার প্রয়ােজন তা তাদের মধ্যে পুরােপুরি অনুপস্থিত। এ অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানকে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা হিসেবে তুলে ধরা জরুরী হয়ে পড়ে। আমরা এ ব্যাপারে সুযােগের অপেক্ষায় ছিলাম।
১৯৬৭-এর শেষের দিকে আমরা শেখ মুজিবকে আমাদের স্বাধীনতা প্রক্রিয়ায় নেতা হিসেবে গণ্য করার পর্যায়ে সংগঠনের অভ্যন্তরে ‘ভেটো’ (veto) ক্ষমতার কারণে বিষয়টি কিছুদিন স্থগিত থাকে। দেখেছি, আমরা অনেক সময় কোনাে বিষয়ে উপস্থিত ও আবেগনির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে চাইলেও, আরেফের একটি গুণ ছিল এই যে, কোনাে ধরনের আবেগকেই সাধারণত সে গুরুত্ব দিত না। বরং সে কোনাে বিষয়ের ভালাে ও মন্দ দিকগুলাে অত্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তারপর তার নিজের সিদ্ধান্তে আসতাে। আরেফের এই বিশেষ গুণটি বহু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ‘নিউক্লিয়াস’- এর কাজে লেগেছে।
স্বাধীনতার বিষয়টি আলােচনার জন্য সর্বশেষ আমি মওলানা ভাসানীর কাছে যাই। তার কথা ছিল, ‘আমি তাে আর স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা হতে পারবাে না, আর আমার সঙ্গে যারা আছে তারা তাে কমিউনিস্ট। কমিউনিস্টরা তাে স্বাধীনতা চায় না, কমিউনিজম কায়েম করতে চায়। এই নিয়ে তাদের সঙ্গে আমার মিলে না। আর যেসব নেতা আছে, তাদের রাজনীতি হলাে মন্ত্রী হওয়ার
পৃষ্ঠা: ৮০
জন্য। একমাত্র শেখ মুজিবেরই বুকের পাটা আছে। তাকে তােমরা সঙ্গে পাবে।’
সকলের সঙ্গে যােগাযােগের পর তার ফলাফলের ভিত্তিতেআমাদের আলােচনায় আমরা শেখ মুজিবুর রহমানকেই নেতা হিসেবে মেনে নিয়ে স্বাধীনতার আন্দোলন গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত নিই। পরিস্থিতি বিবেচনায় ও আমাদের যুক্তি মেনে নিয়ে শেখ মুজিবের ব্যাপারে ‘ভেটো’ (veto) প্রত্যাহার করা হয়।
আমরা আগে থেকেই জানতাম, ঢাকায় নেতৃবৃন্দের মধ্যে আমাদের পক্ষে গাজী গােলাম মােস্তফা ছাড়া আর কাউকেই পাবাে না এবং পেলামও না। জেলা পর্যায়ে আমাদের প্রয়ােজন ছিল দলের জেলা কমিটির নেতাদের। ১৯৬৮ সালের শেষ নাগাদ চট্টগ্রামের এম এ আজিজ, খুলনার শেখ আবদুল আজিজ, যশােরের মােশাররফ হােসেন, কুষ্টিয়ায় নূরে আলম জিকু, দিনাজপুরের আজিজুল হক, মাগুরার সােহরাব হােসেন, সিলেটের দেওয়ান ফরিদ গাজী, চাঁদপুরের মিজানুর রহমান চৌধুরী, ঢাকার আমেনা বেগম, নেত্রকোনার আবদুল মােমেন, ময়মনসিংহের রফিকউদ্দিন ভুইয়া, চট্টগ্রামের এম এ হান্নান, খুলনার মােহাম্মদ মহসিন, মুন্সীগঞ্জের আবদুল হাই, নােয়াখালীর শহীদ উদ্দিন ইস্কান্দার, ঢাকার (গাজীপুর) শামসুল হক ও আবদুল হামিদ (কেরানীগঞ্জ), ফরিদপুরের ইমাম উদ্দিন আহমেদ ও ফণী ভূষণ মজুমদার, ঢাকার ফজলুল হক বিএসসি, দিনাজপুরের আবদুর রহিম। সরকার, ঠাকুরগাঁওয়ের মােহাম্মদ আজিজুর রহমান, খুলনার সালাহউদ্দিন ইউসুফ, বরিশালের আবদুর রব সেরনিয়াবত, ঢাকার মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগিশ, চট্টগ্রামের বিধান কৃষ্ণ সেন ও ভূপতি ভূষণ চৌধুরী (মানিক চৌধুরী) ও নােয়াখালীর নুরুল হক মিয়াকে আমরা আমাদের পক্ষে আনতে সমর্থ হই।
শ্রমিক নেতাদের মধ্যে আবদুল মান্নান, মােহাম্মদ শাহজাহান, রুহুল আমিন ভুইয়া, আবদুল মান্নান (টঙ্গী), আবদুর রহমান (নরসিংদী), সায়েদুল হক সাদু (আদমজি), আবদুল আজিজ (আদমজি), ছােট সাদু (আদমজি) ও শফিক সরদার (আদমজি) আমাদের সঙ্গে যুক্ত হন।
পৃষ্ঠা: ৮১
পরবর্তীকালে লেঃ কমাণ্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন, সুলতান উদ্দিন আহমেদ, ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজুল্লাহ, ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক, ক্যাপ্টেন খুরশিদ, স্টুয়ার্ড মুজিবসহ ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র অভিযুক্তদের প্রায় সকলেই ‘বিএলএফ’-এর সদস্য বা সমর্থক হয়েছিলেন।
আর নিউক্লিয়াস’ গঠনের মুহূর্ত হতে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত পুরো সময়টায় ‘নিউক্লিয়াস’ সদস্যদের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ রক্ষা করতেন এবং আমাদের পরামর্শ দিতেন কামরুদ্দীন আহমদ এবং ড. আহমদ শরীফ।
১৯৬৭-৬৮ সাল আমাদের জন্য অত্যন্ত ধৈর্যের এবং মানসিক প্রস্তুতির সময় ছিল। এ সময় ছাত্রলীগকে এককভাবে একটি শক্তি সংগঠনে পরিণত করা এবং সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করানাে আমাদের প্রধান করণীয় হয়ে দাঁড়ায়। এ ব্যাপারে আবদুর রাজ্জাক ও খালেদ মােহাম্মদ আলী বিশিষ্ট ভূমিকা রাখেন। পরবর্তী পর্যায়ে অর্থাৎ গণআন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ- সভাপতি হিসেবে প্রথমে তােফায়েল আহমেদ ও পরে আ স ম আবদুর রব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
৬-দফাভিত্তিক আমাদের আন্দোলন কার্যক্রমে ছাত্র ইউনিয়নের কোনাে গ্রুপকেই পাওয়া যায়নি। আন্দোলনের এ-পর্বটিকে একটি রণকৌশলগত কাল হিসেবে গণ্য করে সম্ভাব্য পরবর্তী আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়নকে (উভয় গ্রুপ) যুক্ত করা যায় কিনা, সে বিষয়টি আমি ‘নিউক্লিয়াস’-এ উত্থাপন করি। এবারও ভেটো’র কারণে সে কাজটি কয়েক মাস পিছিয়ে যায়। এ ব্যাপারে আমি ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বিশেষ করে খালেদ মােহাম্মদ আলীকে উদ্যোগী ভূমিকা পালনের দায়িত্ব দিই। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি মুখ্য হিসেবে চিন্তায় থাকলেও, ছাত্রদের সমস্যাগুলাে নিয়ে ছাত্র আন্দোলন গড়ে তােলার ওপর জোর দিতে বলি। প্রায় ২/৩ মাস সময় লাগে এই ছাত্র সমস্যাভিত্তিক কর্মসূচি দাঁড় করাতে। কিন্তু দেখা গেল রাজনৈতিক কর্মসূচি ছাড়া কেবল ছাত্র সমস্যা নিয়ে আন্দোলন গড়ে তােলা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের উভয় সংগঠনই একমত
পৃষ্ঠা: ৮২
পােষণ করে। অন্যান্য ছাত্র সংগঠনকেও সম্ভাব্য সে আন্দোলনে যুক্ত করা করা যায় কিনা তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেও খানিকটা সময় ব্যয় হয়। অবশেষে এনএসএফ-এর একাংশ (মাহবুবুল হক দোলন ও ফখরুল ইসলাম মুন্সীর নেতৃত্বাধীন) সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে যােগ দেয়। প্রথমেই আমরা ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) ও এনএসএফ (দোলন)-কে আন্দোলনের পক্ষে পাই। ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ)-কে সঙ্গে পেতে কিছুটা দেরি হয়।
ছাত্র সমস্যা ভিত্তিক আন্দোলনের কর্মসূচির সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মসূচি যুক্ত করার ব্যাপারটি নিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন দুই গ্রুপের তরফেই আপত্তি আসে। তাদের প্রস্তাব ছিল সাধারণ কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচি দেওয়া, যেমন মৌলিক গণতন্ত্র বাদ দিয়ে সরাসরি ভােটে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি। সেই সঙ্গে কৃষক-শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার অন্তর্ভুক্তির কথাও তারা বলে। জাতীয় রাজনৈতিক বিষয়গুলােকে তারা দায়সারাভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়।
বিপরীতে আমাদের প্রস্তাব ছিল রাজনৈতিক কর্মসূচিকে প্রাধান্য দেওয়া। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটিকে রাজনৈতিক কর্মসচির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা। ‘স্বায়ত্তশাসন’ শব্দটি যােগ করে রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়নে তাদের আপত্তি থাকলাে না। কিন্তু আমরা যখন ‘স্বায়ত্তশাসন’ বিষয়টি ব্যাখ্যাসহ উপস্থাপন করার প্রস্তাব দিলাম, তখন তারা শুধু এর বিরােধিতাই করলাে না, যৌথ আন্দোলনের বিষয়টিকে আর হিসেবের মধ্যে রাখতে চাইলাে না। আমাদের ‘স্বায়ত্তশাসন’-এর বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব ও তাদের তাতে অসম্মতি—এ দুইয়ের মধ্যে যুক্তিতর্ক ও সময় ব্যয় শেষে এক রকম ক্লান্তিকর পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়। শেষে আমি ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে যােগাযােগ করতে চাইলে সাইফুদ্দিন মানিক তার ব্যবস্থা করতে রাজি হন। কিছুটা গড়িমসি করে হলেও ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনির্ভাসিটির আহসানউল্লাহ হলে আমার বৈঠক হয়। সে বৈঠক চলে পাঁচ থেকে ছয় দিন। অতি দীর্ঘ আলােচনা। ফরহাদ ভাই তার দিক থেকে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিটি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিলেন। সহজেই আমি তাতে রাজি হলাম। তিনি স্বায়ত্তশাসন বলতে সাধারণভাবে পূর্বপাকিস্তান সরকারের কাজকর্মে কেন্দ্রীয়
পৃষ্ঠা: ৮৩
সরকারের হস্তক্ষেপ না করা—এ ধরনের অর্থে বিষয়টিকে গ্রহণ করতে রাজি হলেন। আমি ৬-দফার উল্লেখ না করেও, ‘স্বায়ত্তশাসনে’র বিষয়টিকে যে ব্যাখ্যা করা দরকার সেটা তাঁকে বিবেচনা করতে বললাম। ফরহাদ ভাই আরও এক সপ্তাহ সময় চাইলেন। আমি আরেকটু সহজ করে তাকে বললাম, “স্বায়ত্তশাসন’ প্রসঙ্গে ক, খ, গ, ঘ, ঙ ও চ দিয়ে কী ধরনের স্বায়ত্তশাসন আমরা চাই সেটা বলতে হবে।
আমার দিক থেকে আমিও দুই-তিন দিন সময় চেয়ে নিলাম। কারণ আমাদেরও ‘নিউক্লিয়াস’-এর মিটিংয়ে বিষয়টি নিয়ে আলােচনা জরুরি হয়ে পড়ে। দুই প্রদেশের দুই মুদ্রার বিষয়টি বাদ দিয়ে ‘স্বায়ত্তশাসন’কে ব্যাখ্যা করার আমার প্রস্তাবটি সেখানে ‘ভেটো’র মুখে পড়ে। এ নিয়ে প্রায় সাতদিন আমাকে অপেক্ষা করতে হলাে। ‘ভেটো’র পক্ষে যুক্তি ছিল : দুই মুদ্রা ব্যবস্থার কথাটা অবশ্যই থাকতে হবে। কারণ দুই মুদ্রা ব্যবস্থাই ক্রমান্বয়ে ‘স্বাধীনতা’কে সম্ভব করে তুলবে। অন্য কোনাে উপায়ে তা অর্জনের জন্য অনেক বেশি সময়, শ্রম ও প্রাণ দিতে হবে। সুতরাং দুই মুদ্রার কথাটা বাদ দেওয়া যাবে না । সাতদিন পর নিউক্লিয়াস’-এর তিনজনই আমরা দুই মুদ্রার প্রসঙ্গটি বাদ দিয়ে ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ এভাবে ৬টি দফায় স্বায়ত্তশাসন’কে ব্যাখ্যা করার বিষয়ে একমত হলাম। আমাদের সব প্রস্তাব ছাত্রলীগের মাধ্যমে উত্থাপিত হতাে। ৭/৮ দিন পরে আমি ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতে। দুই মুদ্রার বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা দেওয়ার কথা বলতেই তিনি এক বাক্যে তা সমর্থন করলেন। এও বললেন, দুই মুদ্রা ব্যবস্থার প্রস্তাবটি ‘প্রি-ম্যাচিউরড’ ও অপ্রয়ােজনীয়। তাঁর সিদ্ধান্ত ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে ছাত্রলীগের প্রস্তাবের পক্ষে এসে গেল ।
এনএসএফকে আগে থেকেই আমাদের পক্ষে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মেনন গ্রুপ সামান্য কিছু আপত্তি তুললেও তাদের যুক্তি ছিল খুবই দুর্বল। ফলে তা টেকেনি। অবশেষে চারটি সংগঠন একমত হয়ে যে কর্মসুচি প্রণয়ন করলাে সেটিকে ১১টি আলাদা দফায় ভাগ করা হয়। সেটাই হলাে ঐতিহাসিক এগারাে দফা।
এনএসএফ ছিল সরকারি ছাত্র সংগঠন। তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক গভর্নর ছিলেন মােনেম খান। তার উদ্যোগে ও পৃষ্ঠপােষকতায়ই এনএসএফ গঠিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৬৯-এ এসে
পৃষ্ঠা: ৮৪
আবার মােনেম খানের কারণেই এনএসএফ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। আন্দোলনে থাকলে তারা অনেক বেশি শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে—আমাদের এই যুক্তিটি এনএসএফ-দোলন গ্রুপের কাছে গ্রহণযােগ্য হলাে। কিছুটা গােপনে এরকম একটা সমঝােতাও আমাদের ছিল যে, ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যে কোনো বিষয় নিয়ে আলােচনায় বসার আগে দোলন গ্রুপের সঙ্গে বসা হবে ও সেখানে আমাদের একটা ঐকমত্য হবে। এ ব্যবস্থায় তারা বিশ্বাস করতে পারলাে যে, এনএসএফের তাদের (দোলনপন্থী) অংশটিই অতঃপর প্রধান বা একমাত্র এনএসএফ হিসেবে পরিচিত হবে।
উপরােক্ত বিষয়গুলােতে একমত হবার পরও রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি সংবলিত দফায় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’য় বন্দি শেখ মুজিবের নামটি নিয়ে আসা ছিল আমাদের জন্য এক কৌশলগত বিজয়। এটিও নানা কসরতের মাধ্যমে আমরা কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিলাম।
১১-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তােলার লক্ষ্যে যে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয় তার নেতৃত্ব ছিল এ রকম : ডাকসু—তােফায়েল আহমেদ (ভিপি), নাজিম কামরান চৌধুরী (জিএস); ছাত্রলীগ-আবদুর রউফ (সভাপতি), খালেদ মােহাম্মদ আলী (সাধারণ সম্পাদক); ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)—মােস্তফা জামাল হায়দার (সভাপতি), মাহবুবউল্লাহ (সাধারণ সম্পাদক); ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)—সাইফুদ্দিন মানিক (সভাপতি) ও শামসুদ্দোহা (সাধারণ সম্পাদক); এনএসএফ (দোলন)—মাহবুবুল হক দোলন (সভাপতি), ফখরুল ইসলাম মুন্সি (সাধারণ সম্পাদক)।
১৯৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি ছিল আন্দোলন শুরু করার প্রথম দিন।
১১-দফা আন্দোলন
১৯৬২-৬৩ সালের আন্দোলন ছিল আমাদের অভিজ্ঞতা এবং কিছুটা প্রাত্যহিকতার দ্বারা প্রভাবিত। সে আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ১৯৬৮-৬৯- এ ১১-দফা আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটিবিচ্যুতি কাটিয়ে আন্দোলনকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানাের কৌশল নির্ধারণে আমাদের সাহায্য করে।
পৃষ্ঠা: ৮৫
ছাত্র ইউনিয়নের একটা সুবিধা ছিল এই যে, আন্দোলনের কর্মসূচি ও অন্যান্য করণীয় নিয়ে তাদের মাথা ঘামাবার দরকার হতাে না। কমিউনিস্ট পাটি যা বলে দিত, তারা তাই করতাে। কিন্তু আমাদের ব্যাপার ছিল ভিন্ন। বাইরের কোনাে মুরুব্বি বা পথপ্রদর্শক না থাকাতে আমাদের সকল কাজের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হতাে। ৬-দফাকে মূল বিষয় করে আন্দোলন শুরু করা এবং সে আন্দোলনকে প্রাত্যহিক ঘটনাভিত্তিক না করে সনির্দিষ্ট লক্ষ্য, বক্তব্য ও কর্মসূচিভিত্তিক করার প্রয়ােজনীয়তা আমরা অনুভব করি। এ জন্য আমাদের ‘নিউক্লিয়াস’-এ বেশ কিছুদিন আলােচনা চলে। আতাউর রহমান খান সাহেবের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা থাকায় তাঁর সঙ্গেও আমি আন্দোলন ও কর্মসূচি বিষয়ে আলােচনা করি। ৬- দফাকে তিনি পুরােপুরি মেনে নিতে পারেননি। স্বায়ত্তশাসনের কথা সাধারণভাবে বলায় তার কোনাে আপত্তি ছিল না। কিন্তু ৬-দফাকে ভিত্তি করে স্বায়ত্তশাসনকে ব্যাখ্যা করার কথা তুলতেই তিনি বললেন, ‘সিরাজ, ৬-দফাকে পুরােপুরি রেখে কর্মসূচি প্রণয়ন করাটা আর পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীন করার কথা বলা প্রায় একই।’ এও বললেন যে, তা হবে অসময়ােচিত। আমার সাংগঠনিক দক্ষতা এবং চিন্তা-ভাবনার গভীরতার ওপর তার আস্থা ছিল। হয়তাে সে কারণে মাঝে মাঝে আমাকে সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দিতেন।
ইতিমধ্যে আমাদের নিউক্লিয়াসে ভেটো প্রত্যাহার হওয়ায় শেখ মুজিবকে প্রধান নেতা হিসেবে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে আর কোনাে বাধা রইলাে না। এরপর এলাে স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে কর্মসূচি প্রণয়ন প্রসঙ্গ। সবাইকে নিয়ে আন্দোলন করতে হলে সে আন্দোলনের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির প্রয়ােজন। এ বিষয়টি নিয়েও আমরা চিন্তাভাবনা করি ও সিদ্ধান্তে আসি। এ সময় খালেদ মােহাম্মদ আলীকে (ছাত্রলীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক) নিয়ে আবদুর রাজ্জাক পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সবক’টি জেলা সফর করে। এর মধ্য দিয়ে তখনকার ১৭ জেলার ১৬টিতেই একজনকে প্রধান করে তিন অথবা সাত সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। ঢাকা শহরে অঞ্চলভিত্তিক তিনজনের কমিটি এবং কলেজ পর্যায়ে ৩/৫ জনের কমিটি গঠন করা হয়। আরেফ এ কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করেছিল। ১৯৬৬-৬৭ সালে
পৃষ্ঠা: ৮৬
‘নিউক্লিয়াস’-এর সরাসরি সদস্য না হলেও, মার্শাল মনি, আ স ম আবদুর রব, শরিফ নুরুল আম্বিয়া, মেসবাহ উদ্দিনসহ কয়েকজনের সঙ্গে ‘নিউক্লিয়াস’-এর যে-কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আলােচনা করা হতাে।
১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে আন্দোলন শুরু করার পূর্বে আমাদের হিসেব অনুযায়ী ঢাকা শহরে “নিউক্লিয়া’সের সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় তিন হাজারে। ঢাকার বাইরে প্রায় দুই হাজার। জেলাগুলােতে যাদের ‘নিউক্লিয়াসে’র সহযােগী হিসেবে পেয়েছিলাম তাদের সঙ্গেও জেলা পর্যায়ের ‘নিউক্লিয়াস’ নেতাদের যােগাযোগ করতে বলা হয়। ১৯৬৭-৬৮-এ প্রায় ৯০ শতাংশ কলেজ সংসদে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহে ও টেকনিক্যাল কলেজসমূহে (পলিটেকনিকসহ) ছাত্রলীগ বিজয়ী হয়েছিল। এ সময় আমরা ৬-দফাকে ভিত্তি করে এবং শেখ মুজিবের নাম উল্লেখসহ রাজবন্দীদের মুক্তি করে বেশ কয়েকটি প্রচারপত্র ছাপি এবং সারা দেশব্যাপী তা বিতরণ করি। এ প্রচারপত্রসমূহ ছাপার ব্যাপারে পাইওনিয়ার প্রেসের জনাব মােহাইমেন সাহেবের কাছ থেকেই আমরা প্রধান সহযােগিতা পেয়েছিলাম। মােহাইমেন সাহেব, শাহ আজিজুর রহমান, আতাউর রহমান খান, সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া), চট্টগ্রামের এম এ আজিজ, খুলনার মহসিন, ইকবাল আনসারি খান ও খাজা খয়েরউদ্দিনসহ অনেকেই সে সময় আমাদেরকে আর্থিক সহযােগিতা দিয়েছিলেন। এদের বেশ কয়েকজন অবশ্য পরবর্তী সময়ে সহযােগিতা
বন্ধ করে দেন।
১১-দফা আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়নের পর সাংগঠনিক প্রস্তুতির জন্য আমরা মােটামুটিভাবে ‘নিউক্লিয়াস’-এর পথ নির্দেশনায় ছাত্রলীগকে তৈরি করি। এছাড়া ৭ জুনের হরতালকে কেন্দ্র করে শ্রমিক এলাকাগুলােতে আন্দোলনের যে ঢেউ উঠেছিল আমরা সেই সুযােগটাকে কাজে লাগানাের উদ্যোগ নিই। টঙ্গী, তেজগাঁও, পােস্তগােলা, ডেমরা, আদমজি, মদনগঞ্জ, চট্টগ্রামের বন্দর ও সীতাকুন্ড, খুলনার খালিশপুর এবং রংপুরের সৈয়দপুরসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় ‘নিউক্লিয়াস’-এর আদলে তিন, পাঁচ অথবা সাত সদস্য নিয়ে গােপন সংগঠনের কমিটি গড়ে তােলা হয়। এ
পৃষ্ঠা: ৮৭
জন্য আমাকে মােটর সাইকেলে ঢাকার শ্রমিক এলাকাসমূহে ব্যাপক তৎপরতা চালাতে হয়।
সে সময়ে ঢাকায় গণপরিবহন বলতে ছিল প্রধানত ইপিআরটিসি বাস। আমার সহায়তায় নুরুল ইসলাম নামের একজন সেখানে আমাদের একটি গােপন সেল’ গড়ে তােলে। হােটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে সিরাজ মিয়ার উদ্যোগে ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস (পিআইএ)-এও একইভাবে গােপন সেল গড়ে ওঠে। দোকান কর্মচারী জহির আমার নিজের তত্ত্বাবধানে ও মেসবাহর সহযােগিতায় আন্দোলনের কার্যক্রম পরিচালনা করতাে। খুলনায়ও অনুরূপভাবে আমার তত্ত্বাবধানে গােপন সেল গঠিত হয়। চট্টগ্রামে ও সীতাকুণ্ড শিল্পাঞ্চলেও একইভাবে শ্রমিকদের অনেকগুলাে জঙ্গী গ্রুপ। গড়ে ওঠে।
ঢাকা শহরের সবখানেই ‘নিউক্লিয়াস’-এর অঞ্চলভিত্তিক সেল ছিল। কলেজ আর হল-হােস্টেল বাদ দিয়ে ঢাকা শহরে বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তােলার ক্ষেত্রে এসব কমিটি নেপথ্য ভূমিকা পালন করে। ঢাকার ৪২টি ওয়ার্ডের সবকটিতে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তােলা হয়েছিল। আ স ম আবদুর রব, স্বপন চৌধুরী ও শেখ কামালকে (শেখ মুজিবের বড় ছেলে) বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এসব সংগ্রাম কমিটি গঠনের ব্যাপারে। ধানমন্ডি এলাকায় সংগঠন করার দায়িত্বে ছিল আনােয়ার হােসেন মঞ্জু, শেখ কামাল, তানভীর মাজহার তান্না ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার দায়িত্ব পালন করেনি। পরে ‘৭১-এ সশস্ত্র সংগ্রামের সময় সে স্বাধীনতার বিরােধী অবস্থান নেয়।
এ সময় (১৯৬৭-৬৮) ঢাকা শহরে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এনএসএফ সংগঠনের ‘মাসূল বাহিনী’ অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। এর নেতৃত্বে ছিল মাহবুবুর রহমান খােকা ও সাইদুর রহমান (পাসপাতু)। এরা যে কেবল দলীয় গুন্ডা হিসেবে কাজ করতাে তা নয়, মদ খেয়ে বহু রাতে হলে ফিরতাে এবং মাতাল অবস্থায় হৈ-হুল্লোড় করে হলের ছাত্রদের জাগিয়ে তুলতাে। এদের মধ্যে কেউ কেউ সাপ পুষতাে ও তা গলায় পেঁচিয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াতাে। মেয়েদের উত্যক্ত করতাে। অন্য দলের সমর্থকদের মারধাের করতাে। কেবলমাত্র
পৃষ্ঠা: ৮৮
সাধারণ ছাত্রদের সমর্থনের ওপর ভর করে এদের মােকাবেলা করা খুব কঠিন ছিল। আমরা তাই সুসংগঠিত এক প্রতিরােধ বাহিনী গড়ে তুলতে সচেষ্ট হই। এ কাজে সর্বপ্রথম যাকে পাওয়া যায় তার নাম কামরুল আলম খান খসরু। সে আমার আপন চাচাতাে ভাই। রংপুর থেকে বিএ পাশ করে ঢাকায় এমএ পড়ার সময় তাকে আমি ছাত্রলীগভুক্ত করি। সে ছিল একজন ভালাে খেলােয়াড়, কুস্তিগির ও শরীরচর্চাবিদ। কুস্তিগির হিসেবে সারা পাকিস্তানে সে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল। লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি তাকে আমি একটি প্রতিরােধ বাহিনী গড়ে তােলার ব্যাপারে উৎসাহিত করি। এ কাজে তার প্রথম সহযােগী হয় মােস্তফা মােহসিন মন্টু। ‘খসরু-মন্টু’ বাহিনী হিসেবে এদের নাম তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে এদের সঙ্গে যুক্ত হয় মহিউদ্দিন (মুন্সিগঞ্জ) ও ফিরু (বরিশাল)। এই চারজন আবার হলভিত্তিক ‘প্রতিরােধ বাহিনী’ গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়। এনএসএফ-এর সমর্থক বাহিনীটি ছিল অছাত্রদের নিয়ে আর তারা অসামাজিক কাজে লিপ্ত থাকতাে। পক্ষান্তরে ‘খসরু-মন্টু বাহিনী’কে কোনাে অবস্থাতেই সামান্যতম অছাত্রসুলভ আচরণ করতে দেখা যায়নি। এদের অনেকে ছাত্র হিসেবেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল নামকরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ঢাকা শহরেও অনুরূপ সুশৃঙ্খল বাহিনী গড়ে ওঠে। কাজী ফিরােজ রশিদ, তারন, ফজলুর রহমান ফ্যান্টোমাসদের প্রত্যেককে তখন সবাই এক নামে চিনতাে। ঢাকা কলেজ, তিতুমীর কলেজ, কায়েদে আযম কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদের মধ্য থেকে এই সুশৃঙ্খল বাহিনী গড়ে তােলা হয়েছিল । মতিঝিল কলােনীর সেলিম-বায়েজিদরা এবং পীরজঙ্গী মাজারের বাহিনীও যে কোনাে মিছিল-মিটিং ও আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতাে। সে সময়ে মতিঝিল আবাসিক এলাকার বাইরে কোথাও শহর গড়ে ওঠেনি। বাসাবাে, বাড্ডা, দক্ষিণ খান, উত্তর খান, খিলগাঁও এসব অত্যাধুনিক আবাসিক এলাকা তৈরি হয়নি। উল্লিখিত বাহিনীর সদস্যরা ‘নিউক্লিয়াস’-এর তত্ত্বাবধানে কাজ করতাে। এছাড়া ছাত্রলীগের সদস্যদের নিয়ে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও প্রতিরােধ বাহিনী গড়ে তােলা হয়। এরা যার যার এলাকার ‘নিউক্লিয়াস’-এর দ্বারা পরিচালিত
পৃষ্ঠা: ৮৯
হতো। সাধারণ ছাত্রলীগাররা বুঝতে পারতাে না তাদের এই সহযােগীরা কোন গােপন সংগঠনের সদস্য। মেয়েদের মধ্যে সংগঠনটা গড়ে তােলা হয়েছিল অবশ্য একটু ভিন্ন কায়দায়। ছাত্রলীগ হিসেবেই তাদের পরিচিতি ছিল। তাদের মধ্য থেকে তখন পর্যন্ত (১৯৬৭-৬৮) আমরা কাউকে ‘নিউক্লিয়াস’ সদস্য করতে পারিনি। আন্দোলনের উত্তাল সময়ে এই মেয়েরাই নারী বাহিনী গঠন করে। যার নেতৃত্বে ছিলেন মমতাজ বেগম।
১৯৬৯-এর আন্দোলনের শুরু থেকেই জনগণের বিভিন্ন অংশ যেমন শ্রমিক-কর্মচারীদের তরফ থেকে তাদের দাবি-দাওয়া উত্থাপিত হতে থাকে এবং সেগুলােও ১১-দফায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ-প্রতিবাদ মামলা বাতিল ও শেখ মুজিবসহ সকল অভিযুক্তের মুক্তি দাবিটিকেও আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার সুযােগ সৃষ্টি করে দেয়। এ সময়ে শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি, ৬-দফার বাখ্যা ভিত্তিক পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি এবং ছাত্র-শ্রমিক-কর্মচারীসহ সমাজের বিভিন অংশের দাবিকে প্রাধান্য দিয়ে আন্দোলনে গতি সঞ্চার করা নিয়ে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে আমাদের দেন-দরবার চলতে থাকে । আইয়ুব খান ও মওলানা ভাসানীর মধ্যেকার গােপন চুক্তির প্রধান শর্ত ছিল শেখ মুজিব ও ৬-দফার বিরােধিতা করা। বামপন্থীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছাত্র ইউনিয়নের উভয় গ্রুপকে কোনাে অবস্থাতেই সরকারবিরােধী ব্যাপক আন্দোলনে নামতে রাজি করা যাচ্ছিল না। এ অবস্থায় আমরা একটা কৌশল নিই। তা হলাে, ১১-দফাভিত্তিক শ্লোগান দেওয়ার। ১১-দফাতেই ৬-দফা এবং শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দির মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিলের দাবিটি অন্তর্ভুক্ত আছে।
‘নিউক্লিয়াস’-এর পরিকল্পনায় ছাত্রলীগ গােটা আন্দোলনে ব্যাপক জনগণের সম্পৃক্তি ঘটানাের উদ্দেশ্যে আন্দোলনের প্রচার (দেয়াল লিখন ও পােস্টারিং) ও পরিচালনার দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেয়। এ জন্য ঢাকা শহরকে অঞ্চলভিত্তিক কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। এর ফলে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর সিদ্ধান্ত গ্রহণে গড়িমসি এবং সময়ক্ষেপণের নীতিকে সহজেই মােকাবেলা করা সম্ভব।
পৃষ্ঠা: ৯০
হয়। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা না করে এ সব ‘আঞ্চলিক সংগ্রাম পরিষদ’ নিজেরাই অনেক বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারতাে। এদের পেছনে আসল যে শক্তিটি কাজ করতো তা হলো ‘নিউক্লিয়াস’। এসব কারণে এ সময় ‘নিউক্লিয়াস’-এর সদস্য সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে।
১৯৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র জমায়েত ও মিছিলের আয়োজন করা হয়। আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে সভা ও মিছিলটি সংগঠিত করার পরিকল্পনা করা হয়। তােফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে বটতলায় সংক্ষিপ্ত সভা শেষে মিছিল বের করার উদ্যোগ নিলে পুলিশ বাধা দেয়। এক পর্যায়ে পলিশের সঙ্গে ছাত্রদের ধস্তাধস্তি শুরু হয়। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এভাবে আন্দোলন শুরু করার পরিকল্পনাটি আমরা আগের রাতে ইকবাল হলে ‘নিউক্লিয়াস’-এর সভায় গ্রহণ করি। তােফায়েল, রব, আবদুর রউফ ও খালেদ মােহাম্মদ আলীর সঙ্গে আলাপ করে প্রত্যেককে যার যার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
সেদিন খুব ভােরে আমি ইকবাল হল থেকে বেরিয়ে ধানমন্ডিতে আনােয়ার হােসেন মঞ্জুর বাসায় গিয়েছিলাম। বেলা ১১টার দিকে মঞ্জ বটতলার অবস্থা আমাকে জানায়। শুনে আমি ডাকসু অফিসে চলে আসি। আমি যখন ক্যাম্পাসে পৌঁছাই তখনও সেখানে টিয়ার গ্যাসের ঝাঁঝ ছিল। আমি উদ্যোগী হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া ছাত্রদেরকে একত্রিত করলাম। তারপর আবারও ছাত্রসভা করে তােফায়েল-রব যখন পরদিনের কর্মসূচি ঘােষণা করছিল তখন পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় ডাকসুর জিএস নাজিম কামরান ও কয়েকজন খেলােয়াড় হকি প্র্যাকটিস শেষ করে হলের ফিরছিল। আমি কামরানকে ডেকে বললাম, কোনােভাবেই পুলিশকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। কামরান বললেন, ‘আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তৈরি হয়ে আসছি।’ কামরান ও তার সঙ্গে আরও বেশ কয়েকজন কেডস পায়ে ও হকিস্টিক হাতে বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনের গেটে গিয়ে দাঁড়ালাে। কামরান গলার স্বর উঁচু করে পুলিশকে বললাে, ‘যদি পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় গেট থেকে চলে না যায়, তাহলে আমরা তাদের পিটিয়ে
পৃষ্ঠা: ৯১
বের করে দেব।’ সে সময় আইন ছিল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কিংবা হলের অভ্যন্তরে পুলিশ ঢুকতে হলে ভিসি ও প্রভােস্টের অনুমতি নিতে হবে। কামরান পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারল তাদের কাছে কোনাে অনুমতিপত্র নেই। শুনে কামরান ও তার সঙ্গী হকিস্টিক নিয়ে ধাওয়া করতেই পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের বাই চলে যায়। [প্রসঙ্গত, এই পুস্তকের অনুলেখকও সেদিনের সে ঘটনায় হকিস্টিকধারীদের একজন ছিলেন।]
পরিকল্পনা অনুযায়ী পরদিন ১৮ জানুয়ারি আবারও বটতলা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় জঙ্গি মিছিল বের করা হয়। সেদিন উপাচার্যের বাড়ি ও রােকেয়া হলের সামনে কয়েকশত রায়ট পুলিশ অবস্থান নেয়। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইট পার হয়ে গুরুদুয়ারার সামনে আসতেই সামনের ও পিছনের দিক থেকে পুলিশ মিছিলের ওপর আক্রমণ করে ও লাঠিচার্জ করতে থাকে। ফলে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ১৯ তারিখেও মিছিল করতে গিয়ে একই রকম বাধা এলাে পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি করতে গিয়ে এদিন বেশ কয়েকজন ছাত্র আহত হয়। ১৭, ১৮ ও ১৯ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ছাত্ররা চারদিক থেকে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছােড়ে। তাতে কয়েকজন পুলিশ আহতও হয়। উল্লেখ্য, সেবারই প্রথম ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীরাও স্বস্তঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে শরিক হয়। তারা মিছিলে আসে, স্লোগান দেয়। আহত ছাত্রদের শুশ্রূষাও করে।
সেদিন দুপুর বেলাতেই আমি মঞ্জুর গাড়িতে চড়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার চারপাশের রাস্তাঘাটের অবস্থা দেখলাম। বিকেল পাঁচটা নাগাদ গেলাম ইকবাল হলে। তােফায়েলকে বললাম, ‘তুমি ভিপি হিসেবে ভিসিকে অনুরােধ করবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে গেইট পর্যন্ত পুলিশকে আসার অনুমতি না দিতে। পুলিশ যদি বাধা দিতে চায় তারা টিএসসি’র মােড় এলাকায় (তখন এ এলাকাটি আজকের মতাে ছিল না—গাছপালা, ঝােপ-জঙ্গলে পূর্ণ ছিল) এবং নীলক্ষেতের রেললাইনের মুখে মােতায়েন থাকুক। ভিসি ওসমান গণি গভর্নর মােনেম খানের সঙ্গে কথা বলে পুলিশকে টিএসসি মােড়ে ও নীলক্ষেত রেল গেইটে রাখার ব্যবস্থা করলেন। ২০ জানুয়ারি বটতলার নির্ধারিত
পৃষ্ঠা: ৯২
জনসভা খুব বড় আকারে করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। বক্তৃতার শেষ হলে প্রায় দশ হাজার ছাত্র ভিসির বাড়ির পাশ দিয়ে ব্রিটিশ কাউন্সিলকে ডানে রেখে ফুলার রােড ধরে সামনের দিকে এগোতে থাকে। মিছিলের এই গতিপথটাও আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়েছিল। শহীদ মিনার হয়ে মিছিল চানখার পুলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। যেহেতু মিছিলটি টিএসসি বা নীলক্ষেত রেললাইনের দিকে না গিয়ে ভিন্নপথ ধরে এগুতে থাকলাে ফলে পুলিশ তাতে বাধা দেওয়ার সুযােগ পেলাে না। ছাত্রনেতারা যেন কোনাে অবস্থাতেই গ্রেফতার না হয় সে জন্য আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদেরকে মিছিলের অগ্রভাগে না রেখে মাঝখানে কর্মীদের একটি কর্ডন তৈরি করে তার ভেতরে রাখা হয়েছিল। আমি সে সময় ব্রিটিশ কাউন্সিলের ভেতরে অবস্থান নিই। মিছিলের গতি ও তার সামনের অবস্থা আমাকে জানানাের জন্য কয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, যাদের সবাই ছিল বিভিন্ন হলের ‘নিউক্লিয়াস’ সদস্য। মিছিল থেকে পলিশকে লক্ষ করে যেন ইটপাটকেল ছোঁড়া না হয় সে ব্যাপারেও নির্দেশ ছিল। সেভাবেই স্লোগান দিতে দিতে সুশৃঙ্খলভাবে মিছিল এগুতে থাকে।
মিছিল মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সি গেটের (পূর্বেকার আমতলা) পাশ দিয়ে চানখারপুলের দিকে যাবার সময় পুলিশ বাধা দেয়। এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের হাতাহাতি শুরু হয়। পুলিশ গুলি চালানাের জন্য পজিশন নেয়। আমি কৰ্ডনের ভেতরে থাকা নেতৃবৃন্দকে কোনাে দিকে যেতে নিষেধ করলাম। সে পরামর্শ তারা মানলাে। এরই এক পর্যায়ে পুলিশ অতর্কিতে গুলি করলাে। মেডিকেলের পাশে গুলিবিদ্ধ হলাে হাতিরদিয়া কলেজের ভিপি মােহাম্মদ আসাদুজ্জামান। আমি মিছিলকে ফিরে আসতে বললাম। মিছিল ফিরে এলাে। সন্ধ্যায় এসএম হলের মাঠে গুলির প্রতিবাদ এবং আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করার জন্য ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর নেতারা বসলেন। এক পর্যায়ে আমি সেখানে উপস্থিত হলাম । অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতাদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমি ঐ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকি।
পৃষ্ঠা: ৯৩
গুলি হবার পরপরই আমি, রাজ্জাক ও আরেফ একত্রে বসে অল্প সময়ের মধ্যে আন্দোলনের একটা রূপরেখা তৈরি করলাম। এসএম হলের ভেতরের লনে বসে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করতে গিয়ে তাদের চিন্তাভাবনা, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচির সামঞ্জস্যহীনতা লক্ষ করলাম। ছাত্র ইউনিয়ন সময় নিতে চাইলাে। ছাত্রলীগ ঐ সময় নেওয়ার পর্বটাকেও আন্দোলনের আংশ হিসেবে কাজে লাগাবার প্রস্তাব দিল। ছাত্রলীগের পক্ষে তিনদিনের এক কর্মসচির কথা বলা হলাে। ২১ জানুয়ারি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কালাে পতাকা ও ব্যাজ নিয়ে শহরে বের হওয়া, ২২ জানুয়ারি মশাল মিছিল এবং ২৩ তারিখ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও মিছিল। এ তিনদিনের কর্মসূচি ঢাকা শহরের জীবনযাত্রায় এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। গােটা শহর জুড়ে কালাে পতাকা ও কালাে ব্যাজধারী ছাত্রদের মিছিল। ‘নিউক্লিয়াস’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্রলীগের সদস্যরা রাস্তার দু’পাশে দোকানপাটের মাথায় কালাে পতাকা উড়িয়ে দেয়, মালিক- কর্মচারীদের বুকে কালাে ব্যাজ পরিয়ে দেয়। ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ জানুয়ারির কর্মসূচি সে-সময় পত্রিকাগুলােতে ছােট আকারে, যেন না ছাপলেই নয় এমনভাবে, ছাপা হয়।
২২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশাল মিছিল বের করা হয়। ঢাকার ইতিহাসে এর আগে কেউ কখনাে এত বড় মশাল মিছিল দেখেনি। এমনকি কল্পনাও করতে পারেনি। হাজার হাজার মশাল হাতে ছাত্ররা তেজগাঁও হয়ে ঢাকার দিকে, গােপীবাগ ও সদরঘাট থেকে ঢাকার দিকে, মতিঝিল আবাসিক এলাকা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে, ঢাকা কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। পুরনাে ঢাকার সর্বত্র মশাল হাতে হাজার হাজার তরুণের সমাগম। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। বাড়িঘর থেকে পুরুষ-নারী সবাই বেরিয়ে এসে সে দৃশ্য দেখছে। পরের দিন ২৩ জানুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট। তারই আহ্বান নিয়ে মিছিল। সে মিছিল থেকে স্লোগান উঠলাে, ‘আগামীকাল হরতাল’। স্লোগানে স্লোগানে কেঁপে উঠলাে ঢাকা শহর। সারা শহর পরিণত হলাে মিছিলের নগরীতে। সেদিন শহরের কোথাও পুলিশের উপস্থিতি দেখা গেল না। কেবল সচিবালয় এলাকায় সেদিন পুলিশ
পৃষ্ঠা: ৯৪
প্রহরা ছিল। রাত ১০টার দিকেই ঢাকা নীরব হয়ে গেল। শহর গাড়ি- ঘােড়া, যানবাহনহনি। এমনকি রিকশাও বন্ধ হয়ে গেল ।
২১, ২২ ও ২৩ জানুয়ারি এ তিনদিনের কর্মসূচি ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর নামেই প্রচার করা হয়েছিল। কর্মসূচি সংবলিত লিফলেটও সে নামেই প্রচারিত হয়। ২৩ তারিখ রাতে সংগ্রাম পরিষদ’-এর সভা বসলে ছাত্রলীগ ছাড়া আর সবাই এ ব্যাপারে তাদের আপত্তি জানালাে এবং কে কোথা থেকে এ কর্মসূচির ঘােষণা দিল, লিফলেট বিলি করলাে, তা জানতে চাইলাে। তারা এ ব্যাপারে ছাত্রলীগের ওপর দোষ চাপালাে। সে রাতেই আহসানউল্লাহ হলে ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, ‘এ ধরনের কর্মসূচিতে আমাদের আপত্তি নেই। আমরাও হয়তাে এটাই করতাম। তবে সর্বদলীয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত না নিয়ে এভাবে এককভাবে আপনারা কর্মসূচি চালিয়ে গেলে তাতে ভবিষ্যতে আন্দোলনের ক্ষতি হবে।’ ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) আরও জোরেশােরে এভাবে কর্মসূচি ঘােষণার বিরােধিতা করলেও, ২০ জানুয়ারির শহীদ আসাদ তাদের সংগঠনের সদস্য হওয়ার কারণে কর্মসূচি মেনে নিলাে। ২৪ তারিখের হরতাল সফল করার ব্যাপারে ২৩ তারিখ রাতে আমাদের ‘নিউক্লিয়াস’-এর সদস্যদের বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে নির্দেশ দেওয়া হলাে। ততদিনে ‘নিউক্লিয়াস’ সদস্যের সংখ্যা ঢাকা শহরে তিন হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ঢাকার আশেপাশের এলাকায় (যেমন মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ) এই সংখ্যা ছিল আড়াই হাজার।
২৪ তারিখের হরতালের চেহারা ছিল একেবারে ভিন্ন। সেদিন ঢাকায় যানবাহন দূরে থাক কোনােকিছুই চলেনি। ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। এ হরতালে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযােগ্য। সবার চোখের আড়ালে ‘নিউক্লিয়াস’-এর সদস্যর শ্রমিকদের মধ্যে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায়। শ্রমিক ইউনিয়নগুলাে আমাদের সঙ্গে না থাকায় (সেগুলাে তােয়াহা, কাজী জাফর, মাহবুবুল হকদের অধীনে ছিল) আমরা সমান্তরালভাবে ‘শিল্পাঞ্চল সংগ্রাম পরিষদ’ গড়ে তুললাম। চট্টগ্রাম, খুলনায়ও অনুরূপভাবে শ্রমিকদের মধ্যে সংগঠন গড়ে উঠলাে। আওয়ামী লীগ এসব সংবাদ জানতাে না। জানবার আগ্রহ বা প্রয়ােজনও তারা মনে করেনি। ২৪ তারিখে
পৃষ্ঠা: ৯৫
হরতালের প্রধান মিছিলটি নিউমার্কেট, বিশ্ববিদ্যালয়, তােপখানা রােড হয়ে পুরনাে পল্টন অতিক্রম করে দৈনিক পাকিস্তান হয়ে মতিঝিল যাবার পথে পুলিশ সে মিছিলে গুলি চালায়। এ সময় চারদিক থেকে আসা শত শত মিছিল একত্র হয়ে এক জনসমুদ্রে পরিণত হয়। বায়তুল মােকাররম মসজিদের উত্তরে মুসলিম লীগ দলীয় এন এ লস্করের বাড়ি থেকে মিছিলে গুলি করায় জনতা তার বাড়ি আক্রমণ করে। পুলিশের গুলিতে নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক মারা যায়। বিক্ষুব্ধ জনতা তখন সরকারি প্রেস ট্রাস্টের মালিকানাধীন দৈনিক পাকিস্তান ও Morning News পত্রিকা দুটি পুড়িয়ে দেয়। শুধু ঢাকা শহরেই নয়, গােটা পূর্ব পাকিস্তান জুড়েই সেদিন ছিল একই চিত্র। ‘নিউক্লিয়াস’-এর পরিকল্পনা অনুযায়ী ছাত্রলীগ সর্বত্র আন্দোলনের সামনের সারিতে এসে যায়। ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর নামে সবকিছু হলেও, নেতৃত্ব এসে পড়ে আসলে ‘নিউক্লিয়াস’ নিয়ন্ত্রিত ছাত্রলীগের হাতে। ডাকসুর ভিপি তােফায়েল আহমেদ, ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুর রউফ, সাধারণ সম্পাদক খালেদ মােহাম্মদ আলী এবং অন্যান্য নেতা যেমন আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ এরা আন্দোলনের নেতা হিসেবে অগ্রণী ভূমিকায় চলে আসে। এ সময়ের আন্দোলনের কর্মসূচি ও চরিত্র সনাতনী ধারায় কেবল ছাত্রসমাজ ভিত্তিক না থেকে এক ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করে। অবাঙালি অধ্যুষিত ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা ও ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় রাত্রিকালীন প্রহরায় নিযুক্ত নৈশপ্রহরী নির্ভর প্রশাসন ভেঙে পড়ে। এ পর্যায়ে নিউক্লিয়াস ছাত্র ব্রিগেড ও যুব ব্রিগেড গঠন করে ঢাকার যান চলাচল ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও রাত্রিকালীন প্রহরার দায়িত্ব পালন করে।
১১-দফা আন্দোলনের পরিকল্পনা এবং এর সাংগঠনিক বিস্তারে বলতে গেলে ‘নিউক্লিয়াস’-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত সংগঠকরাই নেপথ্যে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১১-দফা কর্মসূচি প্রণয়ন এবং আন্দোলন পরিচালনার জন্য সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনে ‘নিউক্লিয়াস’ নেতাদের ভূমিকাই প্রধান ছিল। গণঅভ্যুত্থানে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় ‘নিউক্লিয়াস’ সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে বিকল্প সামাজিক শক্তি হিসেবে সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের ‘ব্রিগেড’ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিল্প অঞ্চল, পাড়া-মহল্লাসহ সর্বত্র এবং থানা পর্যায়
পৃষ্ঠা: ৯৬
পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি ছিল। পাড়া-মহল্লায় নৈশপ্রহরা, শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা, ট্রেন চলাচল, লঞ্চ-স্টিমার ও নৌবন্দর পরিচালনা, এমসিসি পাকিস্তান ক্রিকেট খেলা পরিচালনা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশকে সহায়তা, শিল্প কল-কারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রাখা ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনায় এ ব্রিগেডগুলোর ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ । ছাত্রনেতা আসাদ ও কিশোর মতিউর পুলিশের গুলিতে নিহত হলে তার প্রতিবাদে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তােলার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কৌশল নির্ধারণ করে ‘নিউক্লিয়াস’ এবং তা কার্যকর করে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’।
গণআন্দোলন পরে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। ফল প্রশাসনব্যবস্থা বিকল হয়ে পড়ে। পরিণতিতে আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন ও প্রধান সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের মনােনয়নপ্রাপ্তদের দুই-ততীয়াংশ ছিলেন ১৯৬৯-‘৭০-এর আন্দোলন থেকে বেরিয়ে আসা যুব নেতৃত্ব। মূল আওয়ামী লীগের অধিকাংশই কার্যত ৬-দফা ও ১১-দফাবিরােধী পিডিএম-এ চলে যায়, যার নেতৃত্বে ছিলেন আবদুস সালাম খান (শেখ মজিবের মামা) প্রমুখ। এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়ে। ‘নিউক্লিয়াস’-এর সক্রিয় সমর্থন থাকার কারণে আওয়ামী লীগ সে অবস্থা কাটিয়ে ওঠে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য দল মিলে ডেমােক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি (ডাক) গঠন করে। তাতে যেসব রাজনৈতিক দল অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল সেগুলাে হলাে আওয়ামী লীগ (৬-দফাপন্থি), আওয়ামী লীগ (পিডিএমপন্থি), কাউন্সিল মুসলিম লীগ, নেজাম-ই-ইসলাম, ন্যাপ (ওয়ালী), এনডিএফ এবং জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম। এই জোটেরও বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেপথ্য ভূমিকা পালন করে ‘নিউক্লিয়াস’। ‘নিউক্লিয়াস’ সৃষ্ট বিকল্প সামাজিক শক্তিসমূহই ছিল ছাত্র ব্রিগেড, যুব বিগেড, শ্রমিক ব্রিগেড, কৃষক ব্রিগেড, নারী ব্রিগেড ইত্যাদি। পরবর্তীকালে সশস্ত্র যুদ্ধকে সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে এগুলাে প্রধান ভূমিকা পালন করে। সে কারণে খুব দ্রুতগতিতে ‘এফ
পৃষ্ঠা: ৯৭
এফ’ (ফ্রিডম ফাইটার্স) ও ‘মুজিব বাহিনী (বিএলএফ) গড়ে ওঠে। ‘বিএলএফ’ ২৫ মার্চের অনেক আগেই বাংলাদেশে গােপনভাবে গড়ে উঠেছিল। বিএলএফ ছিল “নিউক্লিয়াস’-এর রাজনৈতিক উইং। সশস্ত্র যুদ্ধের সময় বিএলএফ ‘মুজিব বাহিনী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই সম্ভাব্য সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিবেচনায় রেখে নিউক্লিয়াস বাংলাদেশে ‘জয়বাংলা বাহিনী’ গড়ে তােলে, যার কমান্ডার ছিলেন আ স ম আবদুর রব এবং ডেপটি কমান্ডার ছিলেন কামরুল আলম খান খসরু। ছাত্রীদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় ছাত্রী ‘জঙ্গি বাহিনী’ যার নেতৃত্বে ছিলেন মমতাজ বেগমসহ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেত্রী। সশস্ত্র যুদ্ধ চলাকালে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য দ্বারা প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। সেই প্রবাসী সরকারকে উপদেশ দেয়ার জন্য ‘জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ’ গঠিত হয় ‘নিউক্লিয়াস’ নেতাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় । এ উপদেষ্টা পরিষদে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কয়েকজন সিনিয়র মন্ত্রী ছাড়াও মওলানা ভাসানী, প্রফেসর মােজাফফর আহমদ, কমরেড মণি সিংহ ও মনােরঞ্জন ধর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
নিউক্লিয়াস ও ছাত্র যুব-সংস্কৃতিসেবীরা
ঃনিউক্লিয়াস’-এর যে সকল সদস্য সে-সময় ছাত্র-যুব সংস্কৃতিসেবী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন তাদের মধ্যে ছিলেন আমিনুল হক, বাদশা, আল-মুজাহিদী, এনায়েতুর রহমান (ডাকসু-জিএস), মােহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, নাসিরুল ইসলাম বাচ্চু, (শহীদ) চিশতি শাহ হেলালুর রহমান, আফতাব আহমদ, কাদের মাহমুদ, শামসুজ্জামান খান, শামসুদ্দিন আহমেদ পেয়ারা, আনসার উদ্দিন আহমদ (সূর্যসেন হল), মফিজুর রহমান খান, বদিউল আলম মজুমদার, সা কা ম আনিছুর রহমান খান, রায়হান ফিরদাউস মধু, রেজাউল হক মােশতাক, মােস্তাফিজুর রহমান, একরামুল হক, খালেদ মােহাম্মদ আলী, রাখাল চন্দ্র বণিক, মােশারফ হােসেন, হরমুজ বিএসসি, খন্দকার ফারুক আহমেদ, আপেল মাহমুদ, মিলন মাহমুদ, সুমন মাহমুদ, আবদুল্লাহ সানি (ইঞ্জিনিয়ার), শিব নারায়ণ দাস, রফিকুল ইসলাম (লিটল কমরেড), হাবিবুর রহমান খান (নারায়ণগঞ্জ), সালাহউদ্দিন ইউসুফ,
পৃষ্ঠা: ৯৮
মইনুল ইসলাম চৌধুরী আজাদ, মােয়াজ্জেম হােসেন খান মজলিশ, (শহীদ) নজরুল ইসলাম (জগন্নাথ কলেজ), (শহীদ) নজরুল ইসলাম, (ঢাকা কলেজ), আবদুল মালেক শহীদুল্লাহ, আবদুল বাতেন চৌধুরী, গােলাম ফারুক (‘হিটলার ফারুক’), (শহীদ) আবদুল ওয়াদুদ, (শহীদ) সাকুর, (শহীদ) মামুন (রাজশাহী), মজিবুল হক, আগা খান মিন্ট, তৈয়বুর রহমান (মিরপুর), মােহাম্মদ উল্লাহ (আদমজী), আহমদ উল্লাহ, অজিত রায়, আবদুল লতিফ, আবদুল জব্বার (কণ্ঠশিল্পী), মুরাদ (গােপীবাগ), ডা. শেখ হায়দার আলী, আবু বকর সিদ্দিক, মহিউদ্দিন আহমদ বুলবুল, ডা. সােলায়মান মন্ডল, ডা. গাজী আবদুল হক, ডা. কলিমুর রহমান, নাজিমউদ্দিন আহমেদ (বর্তমানে প্যারিসবাসী), (ডাক্তার, মরহুম) রফিকুল ইসলাম (‘আন্তর্জাতিক মাতভাষা দিবস’ প্রস্তাবের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা), শিল্পী শাহাবুদ্দিন, শেখ জামাল (বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র), শিল্পী কামাল আহমেদ (বর্তমানে কানাডা প্রবাসী) সহ আরও অনেকে। ‘নিউক্লিয়াস’-এর উদ্যোগে ‘পাঠক্রম’ নামে একটি সাহিত্য সংগঠন গঠিত হয়েছিল। এর দায়িত্বে ছিলেন আমিনুল হক বাদশা, মেসবাহ উদ্দীন আহমেদ এবং আবদুল হাই (মুন্সিগঞ্জ)।
ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হয়েও আহমদ ছফা, আসাদ চৌধুরী, রশীদ হায়দার, সমুদ্র গুপ্ত, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, ফকির আলমগীর, রাহাত খানসহ বেশ কয়েকজন সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় ছাত্রলীগের সঙ্গে সহযােগিতা করতেন।
প্রবীণ সাংবাদিকদের মধ্যে তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া, জহুর হােসেন চৌধুরী, সিরাজউদ্দীন হােসেন, আসাফউদ্দৌলা রেজা, সত্যেন সেন, এম আনিসুজ্জমান, এনায়েতুল্লাহ খান (হলিডে)সহ সে সময়ের রাজনৈতিক-সাহিত্য রচনায় পারদর্শী সবার সঙ্গে ‘নিউক্লিয়াস’-এর ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ ছিল। মাহবুব তালুকদার, আবুল কাসেম ফজলুল হক, সাংবাদিক ওয়ালিউল্লাহর নামও এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। দি পিপল পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক আবিদুর রহমানের সঙ্গেও আমার যােগাযােগ ছিল । শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এবং পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গেও ‘নিউক্লিয়াস’ নেতৃবৃন্দ যােগাযােগ রাখতেন।
পৃষ্ঠা: ৯৯
সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, কে জি মােস্তফা, এহতেশাম হায়দার চৌধুরী (মিয়া ভাই), এন এম হারুন, মিজানুর রহমান, খােন্দকার আবু তালেব, নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী, আবদুল আওয়াল খান (দৈনিক আজাদ) আমার কাছ থেকে ‘নিউক্লিয়াস’-এর গােপন কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত হতেন।
ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম এবং ইত্তেফাক-এর কর্মাধ্যক্ষ এম এ ওয়াদুদ (মন্ত্রী দীপু মনির বাবা) ও আবদুল মােমিন তালুকদারের সঙ্গে ‘নিউক্লিয়াস’-এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
‘নিউক্লিয়াস’ প্রধানদের সঙ্গে যােগাযােগ রেখে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যারা বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতেন তাঁরা হলেন মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি), নূরে আলম জিকু, চিত্তরঞ্জন গুহ, সৈয়দ আহমদ, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, আনােয়ার হােসেন মঞ্জু, সুধীর কুমার হাজরা, হাসানুল হক ইনু, আ ফ ম মাহবুবুল হক, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, মাসুদ আহমেদ রুমি, সাইফুল গণি চৌধুরী, (শহীদ)স্বপন কুমার চৌধুরী, ফজলে এলাহী, স্বপন আচার্য, কামরুল আলম খান খসরু, মােস্তফা মােহসীন মন্টু, মহিউদ্দিন, কামাল উদ্দিন ফীরু, তারন, এস এম সুলতান টিটু, মাজহারুল হক বাকি, ঝিলু শামসুন্নাহার ইকু, ফরিদা খানম সাকি, আফরােজা হক রিনা, রাশেদা বেগম, শিরিন আখতার, লুৎফা হাসিন রােজি, ফেরদৌসী হক লিনু, মশিউল আলম, হান্নান, সৈয়দ আবেদ মনসুর, কে এম আখতারুল আলম খান, রেজাউল হক চৌধুরী, মােহাম্মদ হাবিব উল্লাহ, মাহবুবুর রহমান, হুমায়ুন কবীর ও ফখরুল আলম খানসহ অনেকেই।
চট্টগ্রাম কালুরঘাট থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কার্যক্রম পরিচালনার কাজে ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’-এর যারা সক্রিয় ছিলেন তারা হলেন শাহজাহান খান (বিমান), রাখাল চন্দ্র বণিক, এম এ হান্নান (আওয়ামী লীগ), ডা. এম এ মান্নান (বােয়ালখালী), আতাউর রহমান কায়সার (আনােয়ারা, বাঁশখালী), ইঞ্জিনিয়ার মােশাররফ হােসেন, শাহ-ই-জাহান চৌধুরী (বাঁশখালী), আবদুল হালিম, আবদুস সােবহান, আবদুল শাকুর (টিএনটি), ইঞ্জিনিয়ার মােছলেমউদ্দিন, আমিনুর রহমান, দেলােয়ার হােসেন, আহমেদ শরীফ মুনির, এস এম ইউসুফ, শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, কফিল
পৃষ্ঠা: ১০০
উদ্দিন (এডভােকেট), ইন্দু নন্দন দত্ত, ডাক্তার মাহফুজুর রহমান, সাবের আহমেদ আজগরী প্রমুখ। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ‘নিউক্লিয়াস’- এর অন্যতম শুভাকাঙ্গী ছিলেন।
সামরিক শাসন জারি
‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র বিরােধী আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলে মওলানা ভাসানীও তাঁর এতদিনের নীরবতা ভেঙে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করেন। পল্টনে অনুষ্ঠিত তাঁর জনসভা ফেরত উত্তেজিত জনতা ব্যুরাে অব ন্যাশনাল রিকস্ট্রাকশান (বিএনআর) অফিস, আবদুল গণি রােডে অবস্থিত প্রাদেশিক মন্ত্রী সুলতান আহমদ খান (কলি সুলতান) ও আগরতলা মামলার প্রধান বিচারপতির বাড়িতে (বর্তমানে বাংলা একাডেমি) আগুন লাগিয়ে দেয়। বিচারপতি লুঙ্গি পরে ক্যান্টনমেন্টে পালিয়ে যান এবং পরের দিন পশ্চিম পাকিস্তান চলে যান। তারপর দিন সরকারিভাবে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ প্রত্যাহার করা হয়।
১৯৬৯-এর ২৫ মার্চ আইয়ুব পদত্যাগ করেন। প্রধান সেনাপতি ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতায় আসেন। সামরিক শাসন জারির দিনটিতে আমি ছিলাম খুলনায়। ঢাকায় ফেরার সময় সন্ধ্যাবেলা পথের মধ্যে সামরিক শাসন জারির কথা রেডিওতে শুনলাম। আরিচা থেকে পদ্মা পার হয়ে মানিকগঞ্জ দিয়ে ঢাকায় আসার পথে মুজিব ভাইয়ের ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বাসায় ঢুকলাম। আমরা পাঁচ-ছয় জন ছিলাম। মুজিব ভাইয়ের বাসায় তখন কোনাে লােকজন নেই। বােঝা গেল সামরিক শাসনের কারণে হয়তাে লােকজন আসেনি, কিংবা মুজিব ভাই নিজেই যারা এসেছিল তাদেরকে চলে যেতে বলেছেন। আমি আমার সঙ্গীদের নিচতলায় রেখে দোতলায় যেতেই ভাবী (বেগম মুজিব) বললেন, আপনার ভাই ছাদে। ওখানে চলে যান।
মুজিব ভাই ছাদের কোণে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে বললেন, ‘তুই তাে খুলনায় গিয়েছিলি, এখন ফিরলি?’ বললেন, ‘ইয়াহিয়ার মনােভাব বুঝতে হবে। কদিন আসিস না। কাউকে আসতে বলিস না। সতর্ক থাকিস।’
পৃষ্ঠা: ১০১
সাতদিন পর আমি নিজেই মুজিব ভাইয়ের বাসায় গেলাম। দেখা হতেই বললেন, “কিরে, এ কয়দিনে একবারও আসলি না?’ আমি বললাম,’ আপনিই তাে বলেছেন না আসতে।’ তিনি বললেন, ‘আরে সেটা কি তােকে বলা নাকি? আমি তাে কীভাবে তােকে খবর দেব সেটাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না।’
তখন বিকেল। বাসায় কাউকে দেখতে পেলাম না। তিনি হেসে নিজে থেকেই বললেন, ‘আওয়ামী লীগাররা সব ভিতু। ওরা এমন দুর্দিনে আসবে?’
সেদিন অনেকক্ষণ থাকলাম। প্রায় দুই-তিন ঘণ্টা। কাজ নিয়ে আলাপ হলাে। সামরিক শাসন থাকায় জনসভা বা মিছিল করার ব্যস্ততা থাকবে না। এ সুযােগ কাজে লাগিয়ে সংগঠন গড়ে তােলার বিষয়ে। আলােচনা হলাে। হেসে আর কিছুটা আফসােসের ভঙ্গিতে বললেন, “আওয়ামী লীগের সংগঠন তাে, এমনিতে কিছু হবে না। সব কাজ তােদেরই। করতে হবে’। আমি বললাম, সারা দেশেই সংগ্রাম পরিষদের একটা কাঠামাে গড়ে উঠেছে। শ্রমিক এলাকায় শ্রমিকদের মধ্যে প্রাথমিক সংগঠন গড়ে উঠেছে। গ্রামের দিকে কৃষকদের মধ্যে সেভাবে সংগঠন গড়ে ওঠেনি। ছিটেফোঁটা কিছু আছে। বললাম, আরও সাত-আট দিন অপেক্ষা করে কাজ শুরু করবাে।
আমি বেরিয়ে আসার সময় মুজিব ভাই বললেন, ‘তুই রেগুলার আসা-যাওয়া করিস।’ হাসতে হাসতে বললেন,’কথা বলারও তাে লােক পাওয়া যায় না রে।’
এমনিতে মজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার বিষয়টা বলে বােঝানাে যাবে না। আমি তাে তাঁর পরিবারেরই একজন ছিলাম। তবে আমাকে যেতে না বললে আমি যেতাম না। কোনাে কারণে হয়তাে আমাকে পরের দিন আসতে বলেননি, আমিও যাইনি ।
তার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কী রকম ঘনিষ্ঠ ছিল একটি বিবরণ থেকে সেটা বােঝা যাবে। অনেকেই তাঁর সঙ্গে দেখা করছেন, কথা বলছেন, আমাকেও দেখলেন, আমি বসে আছি। আমার মতাে করে দোতলায়। বসার ঘরে সবাই। আমাকে ইশারা করতেন বাথরুমের পাশের
পৃষ্ঠা: ১০২
ড্রেসিংরুম পার হয়ে গিয়ে দাড়াতে । টয়লেটে যাবার আগে ড্রেসিংরুমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলতে শুরু করতেন আমার সঙ্গে। কিছু কথা বলে টয়লেটে যেতেন, আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম, এরপর তিনি বেরিয়ে এসে আরও অনেকক্ষণ ড্রেসিংরুমে আমার সঙ্গে অন্যান্য জরুরি কথাবার্তা সেরে নিতেন। তখনই বলে দিতেন আগামী দিন আমি কখন আসবো।
শ্রমিকদের মধ্যে কাজ
১৯৬৯-এ সামরিক শাসন বলবৎ অবস্থায়ই ‘নিউক্লিয়াস’-এর মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলাে, সময়টাকে আমরা সংগঠন গড়ে তােলার কাজে ব্যবহার করবাে। ‘নিউক্লিয়াস’-এর মিটিংয়ে আরও সিদ্ধান্ত হলাে, শ্রমিকদেরকে সংগঠিত করতে হবে। এর আগে শ্রমিকদের মধ্যে আওয়ামী লীগের কোনাে তৎপরতা বা কার্যক্রম ছিল না। শ্রমিক সংগঠন গড়ে তােলার প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেই ‘নিউক্লিয়াস’ কাজটি করার দায়িত্ব আমার ওপর দিল। এ যাবৎকাল ‘নিউক্লিয়াস’-এ আমার দায়িত্ব ছিল আন্দোলনের কৌশল-পরিকল্পনা এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যে তত্ত্বগত বিষয়াদি প্রণয়ন করা। সব ধরনের লিফলেট ও নির্দেশনামা তৈরি করা। হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ও ‘পিআইএ’-এতে সংগঠন গড়ে তােলার দায়িত্বও ছিল আমার। সাংবাদিকসহ বিদেশীদের থাকার জায়গা হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। আর পিআইএ অফিস ছিল ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সমাগমস্থল। এবার নতুন দায়িত্ব পড়লাে শ্রমিকদের মধ্যে সংগঠন গড়ে তােলার। সে এক দুরূহ কাজ। অবশ্য এর আগেই মিছিল, হরতালসহ আন্দোলন পরিচালনার জন্য শিল্প এলাকায় গােপনভাবে ‘নিউক্লিয়াস’ সেল এবং এক ধরনের লাইনভিত্তিক সংগঠন অর্থাৎ কমিটি গঠন করার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। তবে এ ধরনের কাঠামাে দিয়ে সাময়িক আন্দোলনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা গেলেও, বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তােলা সম্ভব হয় না।
তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্রই শ্রমিক সংগঠনগুলাে ছিল বামপন্থিদের—যেমন তােয়াহা-কাজী জাফর-আবুল বশর কিংবা নির্মল সেনদের দখলে। ব্যাপক ভিত্তিতে সংগঠন গড়ে তুলতে গেলে এদের
পৃষ্ঠা: ১০৩
সঙ্গে মুখোমুখি হতে হবে, এটি আমি জানতাম। এ অবস্থায় বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীদের দল ত্যাগ (defection) করানাের যে পদ্ধতি সেটিই আমি বেছে নিলাম। আবদুল মান্নানকে সমাজবাদী দল থেকে বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করতেই অতি সহজে রাজি হলেন। আগামীতে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হওয়া এবং শ্রমমন্ত্রী হওয়ার সুযােগ আছে বলাতে প্রথমে উনি বিষয়টিকে হালকাভাবে নিলেন। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে আমার দক্ষতা এবং মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক দেখে তিনি তা বিশ্বাস করলেন। কাজটি যে সমাজবাদী দলের নেতাদের অগােচরেই করতে হবে সেটাও তাকে বােঝাতে সক্ষম হলাম। শ্রমিক নেতা হিসেবে সারা দেশে শ্রমিকদের মধ্যে মান্নান ভাইয়ের ভালাে পরিচিতি ছিল। আমি তাকে নিয়ে চট্টগ্রাম, খুলনা,সিলেটের চা বাগান এবং উত্তরবঙ্গের সৈয়দপুরে ঘুরলাম । তার ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্যই এসব জায়গায় যে তার সমর্থন ও সংগঠন থাকা দরকার সেটাও আমি তাকে বােঝাতে সক্ষম হলাম। বলা বাহুল্য আমার নিজের এসব জায়গায় কোনাে পরিচিতি ছিল না। সংগঠন গড়ে তােলার বিষয়ে একটি মৌলিক ধারণা আমি পেয়েছিলাম সে সময়ের ‘ভিয়েতকং’দের সংগঠন কাঠামাে থেকে। এ বিষয়েও আমি ‘নিউক্লিয়াস’-এর অনুমােদন নিয়েছিলাম। ভিয়েতকংদের সাহিত্য পড়া ও তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে জানা ‘নিউক্লিয়াস’-এর সদস্যদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। ভিয়েতকংদের সংগঠনের বৈশিষ্ট্য ছিল ‘এগারজন নিয়ে একটি সেকশন গঠন করা—সামনের জন লিডার, মাঝখানে নয়জন, শেষ ব্যক্তি ডেপুটি লিডার’। স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রামের সময় আমরা এ ধরনের সেকশনভিত্তিক সাংগঠনিক কাঠামাে গড়ে তুলেছিলাম। উত্তরবঙ্গে এই সেকশন কাঠামাে গড়ার দায়িত্ব ছিল মার্শাল মনি ও মাসুদ আহমেদ রুমির ওপর। পশ্চিম অঞ্চলে এ কাঠামাে গড়ে তােলার কাজ করেছিলেন নূরে আলম জিকু (তােফায়েল আহমদের ডেপুটি)।
সংগঠন কাঠামাের ব্যাপারে আমি আইরিশ স্বাধীনতা আন্দোলনের কৌশলও ভালােভাবে আত্মস্থ করি। নগরভিত্তিক গেরিলা যুদ্ধের ধারণাটি এসেছে মূলত এ আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রাম বা যুদ্ধের ইতিহাস থেকে। ভবিষ্যতের সশস্ত্র সংগ্রামে এ কৌশলটি যে আমাদের
পৃষ্ঠা: ১০৪
কাজে লাগতে পারে, তা-ও আমি ভালােভাবেই বুঝেছিলাম । শ্রমিক এলাকায় এধরনের লাইনভিত্তিক সংগঠন গড়ার ধারণা মান্নান ভাইকে বলতেই তিনি সম্মত হলেন। তবে প্রত্যেক কারখানায় ও শিল্পাঞ্চলে যে আমাদের ‘নিউক্লিয়াস’-এর কোর-কমিটি আছে সেটা তাকে জানানাে হয়নি। এই পদ্ধতিতে কাজ করার ফলে প্রত্যেক শিল্পকারখানা ও শিল্পাঞ্চলে বিদ্যুৎগতিতে আমাদের সংগঠনের কাঠামাে গড়ে তােলা গেল। সমাজবাদী দল কিংবা কাজী জাফর, তােয়াহা-হক কেউই আমাদের সাংগঠনিক ব্যাপ্তি ও সক্ষমতা টের পেলাে না। ১৯৭০-এর নির্বাচনের সময় আমাদেরকে বড় বড় শ্রমিক সভা করতে দেখে তারা বিষয়টি আঁচ করতে পারলাে। বুঝলাে, বাধা দেওয়ার সময় শেষ হয়ে গেছে। একইভাবে চা বাগানের শ্রমিকদেরও আমরা সংগঠিত করি।
এ সময়ে মান্নান ভাই ‘বিএলএফ’-এর চার কমাণ্ডারের সঙ্গে (সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ) তাকে যুক্ত করে পাঁচ কমাণ্ডারভিত্তিক কাজ করার প্রস্তাব দেন। কৌশলগত কারণে আমি প্রথম সুযােগেই এ প্রস্তাবটিতে সম্মত হলাম এবং কাজ শুরু করলাম । নীতিগতভাবে মনি ও তােফায়েল ‘বিএলএফ’-এ শ্রমিকদের এ ধরনের অন্তর্ভুক্তি মানবে না– আমি এমনটাই ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু কার্যত দেখলাম, তারা ‘বিএলএফ’ ও শ্রমিকদের যৌথ কর্মকাণ্ডে সম্মত হলাে। এ সিদ্ধান্ত আমাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ে খুব সহায়ক হয়েছিল। এ পর্যায়ে আমরা অনেককেই শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে লাগাতে সমর্থ হই। সমান্তরালভাবে ছাত্র সংগঠনের কাজ এবং ‘নিউক্লিয়াস’-এর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধিও চলতে থাকলাে।
সামরিক শাসন জারি থাকার কারণে বড় শ্রমিক সভা করা সম্ভব হচ্ছিল না। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসার পরপরই এয়ার মার্শাল নুর খান চমক লাগানাে কিছু কাজ করলেন। সেসবের মধ্যে ছিল শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ (ওয়েজ বাের্ড) ও শ্রম আদালতে শ্রমিক প্রতিনিধির অন্তর্ভুক্তি। এ ধরনের কাজের ফলে সামরিক শাসনের বিষয়ে মানুষের মধ্যে ভয়ভীতি অনেকখানি কমে যায়। এ সময়ে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সরকারি উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণে নিয়ে যাওয়া হয়।
পৃষ্ঠা: ১০৫
১৯৭০-এর প্রথমভাগে সামরিক শাসন শিথিল করা হলাে। ‘ঘরােয়া রাজনীতি’ চালু হলাে। সুযােগটাকে আমরা কাজে লাগালাম। শ্রমিক সংগঠন, ছাত্রলীগ এবং নিউক্লিয়াসকে আরও সংগঠিত করার মাধ্যমে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হলাে ।
ডাকসু নির্বাচন ১৯৭০
সামরিক আইনের অধীনে ডাকসু নির্বাচন দেওয়া হলাে ১৯৭০ সালে । সেটিই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ছাত্রদের সরাসরি ভােটে ডাকসুর প্রতিনিধি নির্বাচন। এ সময় ভিপি পদের মনােনয়ন নিয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে বেশ টানাপােড়েন শুরু হলাে। শেখ শহীদ প্রথমদিকে ভিপি পদের জন্য আগ্রহী থাকলেও শেষ পর্যন্ত আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদুস মাখনকে নিয়ে (রব-মাখন) প্যানেল হলাে। এ প্যানেল বিপুল ভােটে জয়ী হলাে। এ জয় সাধারণ ঘটনা ছিল না। কারণ, আগেই বলেছি, ছাত্রদের সরাসরি ভােটে সেবারই প্রথম ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। রবের ভিপি পদে মনােনয়নের বিষয়টি ছিল কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘স্বাধীনতার লড়াই’-এর জন্য যুবনেতা হিসেবে ডাকসুর ভিপি পদে রবকে আমাদের প্রয়ােজন ছিল। শেখ শহীদ ভিপি হলে সে উদ্দেশ্য হয়তাে পূরণ হত না। এ ব্যাপারে শেখ মনি ও শেখ শহীদরা মুজিব ভাইয়ের হস্তক্ষেপ চেয়েছিল। মুজিব ভাই কিন্তু এ বিষয়ে একেবারেই নিরপেক্ষ ছিলেন। আমি নিজে এ নির্বাচন পরিচালনা করি। ইকবাল হল, মহসীন হল, সূর্য সেন হল, রােকেয়া হল, জগন্নাথ হল, এসএম হল, ঢাকা হল ও এফএইচ হল নিয়ে সমস্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা নির্বাচনের ১৫ দিন আগে থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত ভিন্ন এক চেহারা নেয়। সে সময় ঢাকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের সংসদ ছিল। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব হলের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বিশাল বিশাল মিছিল—আর সে সব মিছিলে বিভিন্ন আকারের পােস্টার, ফেস্টুন, শােষণের চিত্র সংবলিত কার্টুন, রব-মাখন ছাপ মারা গেঞ্জি, রাতের বেলা হাজার হাজার মশাল—সব মিলিয়ে সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য ও ঘটনা। নির্বাচনের আগের দিন যে র্যালি বের হলাে তা দেখে মনে হলাে যেন যুদ্ধ জয়ের পর বিজয় মিছিল।
পৃষ্ঠা: ১০৬
আ স ম আবদুর রব জিতেছিল ৮৬ ভােটে। এ নির্বাচন উপলক্ষে আমাদের নিরাপত্তার দিকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। খসরু, মন্টু, মহিউদ্দিন ও ফিরুর নেতৃত্বে আমাদের যে সংগঠিত ‘স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’, তারা নির্বাচনী প্রচারকালে এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় প্রতিটি হলে চীনের প্রাচীরের মতাে প্রতিরক্ষার দেয়াল তুলে রেখেছিল।
ছাত্রলীগের দুই ধারা
ডাকসু নির্বাচনের সময়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে দুটি বিপরীত ধারার অবস্থান সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি রব-শাজাহান সিরাজের নেতৃত্বে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং বিপরীতে স্বাধীনতার প্রশ্নে তখনও যাদের মনােভাব ছিল দ্বিধান্বিত তাদের এক ধরনের জোট। স্বাধীনতার পক্ষে ছিলাম আমরা ‘নিউক্লিয়াস’ ও ছাত্রলীগের রব-শাজাহান সিরাজ গ্রুপ । অন্যদিকে শেখ মনির নেতৃত্বে স্বাধীনতার প্রশ্নে দোদুল্যমান শেখ শহীদ ও নুরে আলম সিদ্দিকী গ্রুপ। গােপনে প্রচারটা ছিল এ রকম : রব-সিরাজরা স্বাধীনতার জন্য প্রয়ােজন হলে সশস্ত্র যুদ্ধ করতেও প্রস্তুত। অপরপক্ষে নূরে আলম সিদ্দিকী ও শেখ শহীদরা পাকিস্তানিদের সঙ্গে আপােস করে তাদের অধীনেই পাকিস্তানের অংশ হিসেবে থাকতে চায়।
১৯৭০-এর এ পর্যায়ে ছাত্রলীগের নামে ‘নিউক্লিয়াস’-এর বক্তব্য প্রচারিত হতাে বিভিন্ন প্রকারের প্রচারপত্রের মাধ্যমে। এ সময়ে প্রচারপত্র তৈরিতে আমি যে কজনের সহযােগিতা পেয়েছিলাম তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে—শামসুদ্দিন পেয়ারা, রেজাউল হক মুশতাক ও রায়হান ফিরদাউস মধু। এ কাজগুলাের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করতাে মাসুদ আহমেদ রুমি।
‘নিউক্লিয়াস’ এ সময়ে ঢাকায় স্বাধীনতার সরাসরি ঘােষণা সংবলিত কিছু পােস্টারিং করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নের জন্য আমি, রাজ্জাক, হাসানুল হক ইনু, শরীফ নূরুল আম্বিয়া ও আবদুল্লাহ সানী—এই পাঁচজনকে নিয়ে টিম গঠন করি। সর্বমােট ৫০টি পােস্টার সুন্দর ও আকর্ষণীয়ভাবে লেখা হয়। তৎকালীন নতুন ঢাকায় ৩০টি এবং পুরনাে ঢাকার নবাবপুর, সদরঘাট ও ইসলামপুর এলাকায় ২০টি পােস্টার লাগানাে হয়। কাজটি যাতে দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করা
পৃষ্ঠা: ১০৭
যায় তার জন্য হাসানুল হক ইনু তার বাবার গাড়িটি নিয়ে এসেছিল। আমরা রাত তিনটায় বেরিয়ে যাই। ভাের পাঁচটার মধ্যে পোস্টার লাগানো শেষ করা হয়। পােস্টারিং শেষে সকাল বেলায় আমরা সবাই মিলে ফুটপাতের দোকানে বসে চা খাই এবং সেই গাড়িতে চড়েই ফিরে আসি। এ পােস্টারিংই ছিল ‘স্বাধীনতার’ প্রথম সরাসরি আহ্বান।
এর আগে ১৯৬৯-এর দিকে আমরা নিউক্লিয়াস নিয়ে কিছু মৌলিক চিন্তা-ভাবনা শুরু করি। ৬-দফা ও ১১-দফায় উল্লেখিত স্বায়ত্তশাসনের দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে আমরা এ সময় জনগণ বিশেষ করে ছাত্র-যুবকদের মধ্যে স্বাধীনতার চিন্তাকে নিয়ে যাওয়ার আশু প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করি। এটি আমাদের চিন্তা জগতে এবং আন্দোলনের ক্ষেত্রে নতুন মােড় ফেরাতে পারে, সে সম্ভাবনা মাথায় রেখে সে অনুযায়ী কার্যবিধি গড়ে তােলার প্রচেষ্টায় নিয়ােজিত হই। আমাদের মনে হয়, জনগণের ব্যাপক অংশকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উদ্বুদ্ধ করার আগে ছাত্র-যুবকদের মধ্যে এক দফার (স্বাধীনতার) দাবিটিকে পরিচিত ও জনপ্রিয় করে তােলা প্রয়ােজন। এ জন্য ভবিষ্যতের সকল আন্দোলন-সংগ্রামে ৬-দফা ও ১১-দফা কর্মসূচি প্রচারের পাশাপাশি স্বাধীনতামুখী বিভিন্ন স্লোগান দেয়ারও পরিকল্পনা গ্রহণ করি। স্লোগান তৈরির জন্য আলাদা আলাদাভাবে তিনটি গ্রুপকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রথমটি আফতাব ও চিশতির নেতৃত্বে, দ্বিতীয়টি আবুল কালাম আজাদের (ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়) নেতৃত্বে আর তৃতীয়টি রফিকের (লিটল কমরেড) নেতৃত্বে এ সময়ে ঢাকার বিভিন্ন দেয়ালে ‘৬-দফা ও ১১-দফা, না হলে এক-দফা’, ‘তােমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘পিণ্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘জেলের তালা ভাঙবাে শেখ মুজিবকে আনবাে’, ‘আগরতলার মিথ্যা মামলা মানি না মানি না’—এ ধরনের স্লোগানগুলাে চিকা আকারে লেখা হতাে।
জয়বাংলা স্লোগান : পক্ষ-বিপক্ষ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সশস্ত্র যুদ্ধে ‘জয়বাংলা’ স্লোগানটি এক নির্ধারক ভূমিকা পালন করে। ‘জয়বাংলা’ এমন একটি স্লোগান যা বাংলাদেশের সশস্ত্র যুদ্ধের সময় মুক্তিযােদ্ধা তথা সমগ্র দেশবাসীকে
পৃষ্ঠা: ১০৮
স্বাধীনতার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ ও উদ্দীপ্ত করেছিল। এই স্লোগান ছিল সশস্ত্র যুদ্ধকালীন বাঙালির প্রেরণার উৎস। যুদ্ধে সফল অপারেশন পরে কিংবা যুদ্ধ জয়ের পর অবধারিতভাবে মুক্তিযােদ্ধারা মিলিত কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে চারপাশের জনগণকে বিজয়ের বার্তা পৌছে দিত। কোন পরিপ্রেক্ষিতে কখন, কীভাবে এবং কী বিশেষ প্রয়োজনে এ শ্লোগানটির উৎপত্তি হয়েছিল, তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এখানে দেওয়া প্রয়ােজন বলে মনে করি।
১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, সােমবার। সেদিন ঢাকা বিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটি সভা ছিল। মধুর ক্যান্টিনের সে সভায় ১৭ সেপ্টেম্বর ‘শিক্ষা দিবস’ যৌথভাবে পালনের কর্মসূচি প্রণয়ন নিয়ে আলােচনা চলছিল। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আহূত সে সভায় আলােচনার এক পর্যায়ে বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা (তৎকালীন জিন্নাহ হল, বর্তমানে সূর্যসেন হলের আবাসিক) আফতাবউদ্দিন আহমদ ‘জয়বাংলা’ স্লোগানটি উচ্চারণ করে। সভা চলাকালে অনেকটা আকস্মিকভাবেই সে সকলকে চমকে দিয়ে চিৎকার করে ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানটি দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আরও সাত-আট জন কর্মী সমস্বরে তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলায়। সেদিনের সেই সভায় আফতাব বেশ কয়েকবার ‘জয়বাংলা’ স্লোগানটি দেয়। শেষের দিকে উপস্থিত ছাত্রলীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মীরাও তার সঙ্গে এই স্লোগানে যােগ দেয়। এভাবেই কিছুক্ষণ ঐ স্লোগান চললাে। সেটাই এ বাংলার বুকে ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের সর্বপ্রথম উচ্চারণ। শ্লোগানদাতাদের অনেকেই ছিলেন ‘নিউক্লিয়াস’ বা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’-এর সদস্য। উল্লেখ্য, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ তখন হাতে লেখা তিন পাতার একটি পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশ করেছিল, যার নাম ছিল ‘জয়বাংলা’।
১৯৭০ সালের ১৮ জানুয়ারি, রবিবার। সেদিন পল্টনে আওয়ামী লীগের জনসভায় আমি ‘জয়বাংলা’ স্লোগানটি দিয়েছিলাম। স্লোগানটি সেদিন সকলের ভালাে লেগেছিল। সকলেই আন্তরিকতার সঙ্গে ও গভীর আবেগে ‘জয়বাংলা’ স্লোগানকে গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও এ স্লোগান বেশ মনে ধরে। এরপর ১৯৭০-এর ৭
পৃষ্ঠা: ১০৯
জুন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় তাঁর ভাষণে তিনি সর্বপ্রথম এ স্লোগানটি ব্যবহার করেন।
‘জয়বাংলা’ স্লোগানের বিষয়ে ছাত্রলীগের দুই-একজন এবং আওয়ামী লীগের সবারই (বঙ্গবন্ধু ছাড়া) ঘাের আপত্তি ছিল। আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটিতেও বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলােচনা হয়। সেখানে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভারতঘেঁষা রাজনীতি করার অপপ্রচারকে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান না দেওয়ার পক্ষে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়। শুধু জাতীয় কমিটির সে সভাতেই নয়, সাধারণভাবে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের প্রায় সকলেই (তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া) ‘জয়বাংলা’র বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
বস্তুত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বৃহত্তর অংশ সে সময় ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানের সরাসরি বিরােধিতা করেন। তারা এ স্লোগানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর কাছে অভিযােগও করেন। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি উত্তর ছিল, ‘এ বিষয় নিয়ে তােমাদের মাথা ঘামাবার দরকার নাই।’ বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে কোনাে রকম সমর্থন না পেয়ে ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের বিরােধিতাকারীরা এরপর ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে। তারা ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানকে ভারতের ‘জয় হিন্দ’ ও সিন্ধুর ‘জিয়ে সিন্ধ’-এর সঙ্গে মিলিয়ে এক ধরনের বিদ্রুপ করতাে। আর সুযােগ পেলে ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দেওয়া ছাত্রলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে বিষােদগা করতাে।
১৯৭০ এর ৪ জানুয়ারি, রবিবার। সেদিন ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের অনুষ্ঠানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রধান অতিথি। অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দেওয়া শুরু হলে দুই-একজন তাতে আপত্তি করেন এবং এ শ্লোগানটি বন্ধ করতে বলার জন্য সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অনুরােধ জানান। তা সত্ত্বেও অনুষ্ঠানে সেদিন বারবার ‘জয়বাংলা’ স্লোগান উচ্চারিত হতে থাকে।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর বক্তব্য প্রদানকালে ‘জয়বাংলা’র পক্ষে-বিপক্ষে তার অবস্থান পরিষ্কার করলেন না। বিষয়টি বুঝতে পেরে ‘নিউক্লিয়াস’-এর কর্মীরা চার-পাঁচজন করে মিলে একটি গ্রুপ হয়ে সন্ধ্যার পর থেকে রাত পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন কলেজের হল-হােস্টেলগুলােতে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিত। রাতের
পৃষ্ঠা: ১১০
অন্ধকারে হাতে লেখা পােস্টার লাগানাে হতাে ঢাকা শহরের সর্বত্র। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের আপত্তি ও অভিযােগ এক পর্যায়ে মুজিব ভাই পর্যন্ত গড়ালাে। আপওিকারীদের প্রতিনিধি হিসেবে কে এম ওবায়েদুর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর কাছে পাঠানাে হয়। ওবায়েদুর রহমান বঙ্গবন্ধুর কাছে ‘জয়বাংলা’কে একটি গুরুতর আপত্তিকর স্লোগান হিসেবে তুলে ধরেন। আমি ঐ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলাম। মুজিব ভাই কোনাে সিদ্ধান্ত না দিয়ে পরবর্তী সময়ে বিষয়টির সুরাহা করবেন বলে জানান।
আসলে এ বিষয়ে কোনাে সিদ্ধান্ত বা সুরাহার কাজটা ছিল সে সময় অত্যন্ত জটিল ও কঠিন। কিন্তু স্বাধীনতার লক্ষ্যে ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে এ বিষয়ে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব ‘নিউক্লিয়াস’-এর পক্ষ থেকে আমাকে দেওয়া হয়।
১৯৭০ এর ১৮ জানুয়ারি, রবিবার। সেদিন পল্টনে আওয়ামী লীগের জনসভা। আমাদের বিবেচনায় দিনটি ছিল স্বাধীনতার লক্ষ্যে পৌছানাের এক সন্ধিক্ষণ। সেদিনের কর্মসূচি সফল করার দায়িত্ব বির্তেছিল ‘নিউক্লিয়াস’-এর পক্ষ থেকে আমার ওপর। বলা বাহুল্য, সে দিনের গুরুত্বের কারণেই আমার ওপরে এ দায়িত্ব দেওয়া হয় । ১৯৬৫-৬৬ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন সৈয়দ মাজহারুল হক বাকি। ছাত্র রাজনীতির পর তিনি ‘বিজ্ঞাপনী’ নামে একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন, যার অফিস ছিল জিন্নাহ এভিনিউতে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ)। সে সময় কামাল আহমেদ (বর্তমানে কানাডা প্রবাসী) ছিলেন একজন খ্যাতিমান অঙ্কন শিল্পী। তিনি কোনাে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। বয়সে তিনি আমার চাইতে বড় হওয়া সত্ত্বেও আমার সঙ্গে তার সখ্য ছিল। সেদিন শিল্পী কামাল আহমেদকে আনা হলাে ‘ বিজ্ঞাপনী’ প্রতিষ্ঠানে। সে সময় রবিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সৈয়দ মাজহারুল হক বাকি ও কামাল আহমেদকে আমি ৪x১০ ফুট মাপের এক টুকুরাে কাঠের উপরে ‘জয়বাংলা’ শব্দটি লিখে দিতে বলি। লেখার পর কাঠটিকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। তখন বেলা তিনটা। পাঁচটায় আওয়ামী লীগের জনসভা শুরু হবে। সে সময়ে শহর আওয়ামী লীগের সক্রিয় সদস্য পনের-বিশ জনের বেশি ছিল না। বাকিরা সবাই খ্যাতিমান এ্যাডভােকেট আবদুস
পৃষ্ঠা: ১১১
সালাম খানের (বঙ্গবন্ধুর মামা) নেতৃত্বাধীন ৬-দফার বিরুদ্ধে গড়ে ৩৬ গড়ে ওঠা পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)-এ চলে যায়। ফলে আওয়ামী লীগের জনসভা ও অন্যান্য সাংগঠনিক কার্যক্রমে “নিউক্লিয়াস’ সদস্যদেরই দায়িত্ব পালন করতে হতাে। তখন “নিউকিয়াস’-এর রাজনৈতিক উইং হিসাবে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) গঠন করা হয়। এ সময়ে ঢাকা শহরের সব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং শহরের সবকটি ওয়ার্ডে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের পাশাপাশি ‘বিএলএফ’-এর সদস্য সংখ্যাও খুব দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। গােটা বাংলাদেশেই অবস্থাটা তখন এ রকম। শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ‘বিএলএফ’-এর সদস্য সংখ্যা তখন প্রায় সাড়ে তিন হাজারে পৌঁছে গেছে। আর জেলা ও থানা (বর্তমানের উপজেলা) পর্যায়ে এই সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। এ সংখ্যা গণআন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান পর্ব পেরিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামকালে প্রায় সাত হাজারে উন্নীত হয়।
সেদিনের জনসভায় লােক সমাগম, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব ‘বিএলএফ’ সদস্যদের ওপর দেওয়া হয়। মূল দায়িত্বে ছিলেন কাজী আরেফ এবং মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি)। অন্যান্য জনসভার মতাে সেদিনও কবিয়াল শফি আহমেদ সভার প্রারম্ভে প্রায় ঘন্টাব্যাপী তার জনপ্রিয় গান গেয়ে শােনালেন। কামাল আহমেদের রংতুলিতে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান লেখা সেই কাঠের খণ্ড দুটির একাংশ আগেই বেশ উঁচু করে নির্মাণ করা মঞ্চের মাঝামাঝি জায়গায় শামিয়ানায় আটকানাে হার্ডবাের্ডের ওপর লাগিয়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি অপর অংশ লাগানাে হয় জনসভা শুরু হওয়ার দশ-পনেরাে মিনিট আগে। বেলা চারটা নাগাদ জনসভায় আগত মানুষের দ্বারা পল্টন ময়দানের আউটার স্টেডিয়াম ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। যেসব খুঁটিতে মাইক লাগানাে হয়েছিল, প্রত্যেকটি খুঁটির গােড়ায় দুজন করে বিএলএফ সদস্য নিয়ােজিত ছিল। তাদের হাতে দেওয়া। হয়েছিল একটি করে ‘চিরকুট’। নির্দেশ ছিল আমি যখন মঞ্চ থেকে স্লোগান দেব ঠিক তখন এ ‘চিরকুট’ খােলা হবে। প্রায় ১০০টি মাইকের হর্ণ লাগানাে বাঁশের খুঁটির গােড়ায় ছাড়াও গােটা পল্টনের বিশেষ বিশেষ জায়গায়ও ‘বিএলএফ’ সদস্যদের দায়িত্ব ভাগ করে
পৃষ্ঠা: ১১২
দেওয়া হয়েছিল। নিচে, মঞ্চের সামনে, পেছনে এবং চারপাশেও ‘বিএফএল’ সদস্যরা বিশেষ নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল। একমাত্র মসজিদটি ছাড়া তখনকার আউটার স্টেডিয়ামে বলতে গেলে আর কোন স্থাপনা ছিল না। পেছনে ডিআইটির (বর্তমানে রাজউক) দিকে বাস্কেটবল খেলার জন্য ছােট ছোট কাঠের গ্যালারির মতাে কয়েকটি স্থাপনা ছিল। সে সময় পল্টন ময়দানে এক লক্ষের মতাে লােকসমাগম হতে পারতাে। লােকে লােকারণ্য অবস্থায় ১৯৭০ সালের ১৮ জানুয়ারীর জনসমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষভাবে নির্মিত সভার বকৃতা মঞ্চটি ছিল বেশ কিছুটা উঁচুতে। মঞ্চের শামিয়ানায় আটকানাে হার্ডবাের্ডের উপরে লাগানাে কাঠের খণ্ডে উজ্জ্বল লাল রঙের দুটি শব্দ ‘জয় বাংলা ’ জুলজুল করছিল। মঞ্চটি বেশ উচু হওয়ার কারণে দর্শকরা দূর থেকেও তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন। সভার শুরুতে তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর বক্তব্য রাখলেন। সভাপতি ছিলেন মুজিব ভাই।
মঞ্চে মজিব ভাই, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মােশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও গাজী গােলাম মোস্তফা ছাড়া আর কোনাে আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন না। গাজী গােলাম মােস্তফার ওপর একটি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, স্লোগান দেওয়ার জন্য মুজিব ভাই যেন আমাকে অনুরােধ করেন। তাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্যের সময় মুজিব ভাই বললেন, “সিরাজ, স্লোগান দে’। কথাটি তিনি দুবার বললেন। আমি এ মুহূর্তটির জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আমি অত্যন্ত আবেগমিশ্রিত ও বলিষ্ঠ কণ্ঠে জনতাকে উদ্দেশ করে বললাম, বাংলাদেশের জন্য আজকের এ দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রিয় ভাই-বােনেরা, আপনারা দেখছেন ঐ উপরে জুলজুল করছে দুটি শব্দ ‘জয়বাংলা’ । আসুন, সাত কোটি মানুষের পক্ষ হয়ে আমরা সকলকে জানিয়ে দিই, আমাদের পরিচয় আমরা বাঙালি। আসুন, যার কণ্ঠে যত জোর আছে সবটুকু দিয়ে আমরা একই সঙ্গে বলে উঠি, ‘জয়বাংলা’। আজ থেকে ‘জয়বাংলা’-কে আমাদের ভবিষ্যৎ আন্দোলনের স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করা হবে। আসুন, আমরা সবাই কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আওয়াজ তুলি ‘জয়বাংলা’। আমি আবারও বললাম, ‘জয়বাংলা’। লক্ষ কণ্ঠের গগন বিদারী ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানের ধ্বনি পল্টনকে মুখরিত করে তুললাে। প্রত্যেক খুঁটির গােড়ায় চিরকুট
পৃষ্ঠা: ১১৩
ইতিমধ্যে খােলা হয়ে গেছে। তাতে নির্দেশ ছিল মঞ্চের ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে ‘জয়বাংলা’ বলার। শুধু পল্টনেই না সভা শেষে ফিরে যাবার সময়ও সকলের মুখে মুখে ধ্বনিত হচ্ছিল ‘জয়বাংলা’! প্রত্যয়দীপ্ত এক শব্দ ‘জয়বাংলা, বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের ঘােষণা ‘জয়বাংলা’। সেই থেকে বাংলাদেশের মানুষ ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানকে তাদের রণধ্বনি ও বিজয়বার্তা হিসেবে গ্রহণ করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ‘নিউক্লিয়াস’ (স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ)-এর সিদ্ধান্ত অনুসারে সেদিন আওয়ামী লীগের জনসভাতেই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ও জনসমক্ষে ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের উদ্বোধন করা হয়। তাজউদ্দীন আহমেদের পর একে একে বক্তৃতা দিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মােশতাক আহমেদ ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। সবশেষে সভাপতি হিসেবে বক্তব্য দিলেন মুজিব ভাই। মুজিব ভাইকে বক্তব্য দেওয়ার আহ্বান জানানাের সময় আমি আবারও ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিলাম। তখন সভা থেকে লক্ষ কণ্ঠে প্রতিধ্বনি হলাে-‘জয়বাংলা’। লক্ষাধিক বাঙালির বাঁধভাঙ্গা আবেগ আর প্রত্যাশায় এ যেন এক নবজাগরণের ইঙ্গিত।
মুজিব ভাই বক্তৃতা করছেন, সে সুযােগে মঞ্চে বসা খন্দকার মােশতাক আহমেদ আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘ভাইডি, কামডা সাইরে দিসো। তুমি বলেই পারলা, আর কেউ পারতাে না! পৃথিবীর ইতিহাসে আর একজন মানুষ রাশিয়া বিপ্লবের স্লোগান হিসেবে দিয়েছিল, ‘জমি, রুটি, স্বাধীনতা’। জানাে, সে লােকটা ক্যাডা? লেনিন, লেনিন। মুজিব ভাইয়ের বক্তৃতা শেষ। জনসভার লক্ষাধিক মানুষের কণ্ঠে একই আওয়াজ—’জয়বাংলা’। এ স্লোগান ১৯৭১-এ বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। আর সশস্ত্র যুদ্ধকে করেছিল ত্বরান্বিত। এ স্লোগান কণ্ঠে নিয়ে বাঙালিরা ঝাপিয়ে পড়েছিল সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে। রণাঙ্গনে বুলেটের চেয়েও শক্তিশালী ছিল এ ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি। আন্দোলন-সংগ্রাম এমনকি সশস্ত্র যুদ্ধের কোনাে পর্যায়ে কোনােদিন বাঙালিরা ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ কিংবা ‘বাংলাদেশ চিরজীবী হােক’ বলেনি। সময়ের ব্যবধানে সে ‘জয়বাংলা’ আজ ষোল- সতের কোটি মানুষের প্রিয় স্লোগান। মুজিব ভাই তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়েই শেষ করেছিলেন।
পৃষ্ঠা: ১১৪
আজকাল দু-একজন অতি-পাণ্ডিত্য জাহির করতে গিয়ে বলার চেষ্টা করছেন, বঙ্গবন্ধু নাকি তার ৭ মার্চের ভাষণে জয়বাংলা বলার পর ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন। এরা আসলে পঞ্চম বাহিনীর লােক। এরা পাকিস্তান থাকতে পাকিস্তানিদের দালালি করতাে। ২৫ মার্চের আগের দিন পর্যন্ত এরা পাকিস্তানিদের হয়েই কাজ করেছে। শেষে না পেরে এরা ‘বাঙালি বন্ধু’ হয়ে ওঠে।
জাতীয় পতাকা
১৯৭১ সালের ২ মার্চ আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা প্রথম উত্তোলন করা হয়। ‘নিউক্লিয়াস’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তৈরির মূল দায়িত্বে ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ।
১৯৭০ সালের ৭ জুন, ৬-দফা দিবসে (১৯৬৬ সালের যে- দিনটিতে মনু মিয়া শহীদ হন) ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের পক্ষ থেকে পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবকে অভিবাদন দেওয়ার কর্মসূচি নেওয়া
হয়। ছাত্রলীগ সিদ্ধান্ত নেয় যে, একটি বাহিনী গঠন করে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হবে। ‘নিউক্লিয়াস’ নেতা কাজী আরেফ আহমেদের ওপর এই অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পড়ে। বাহিনীর নাম দেওয়া হয় ‘জয়বাংলা বাহিনী’। বাহিনীর অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় আ স ম আবদুর রবকে। সিদ্ধান্ত হয়, বঙ্গবন্ধুকে ‘ব্যাটালিয়ন ফ্ল্যাগ’ হিসেবে একটি পতাকা প্রদান করা হবে। ‘নিউক্লিয়াস’ থেকেই বাহিনীর জন্য সে ব্যাটালিয়ন ফ্ল্যাগ তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১৯৭০ সালের ৬ জুন সন্ধ্যায় ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর কক্ষে মার্শাল মনি, শাজাহান সিরাজ ও আ স ম আবদুর রবকে ডেকে কাজী আরেফ ‘নিউক্লিয়াস’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফ্ল্যাগ তৈরির কথা জানান। এ ব্যাটালিয়ন ফ্ল্যাগই যে পরবর্তীতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার সম্মান অর্জন করবে অর্থাৎ জাতীয় পতাকা হিসেবে গৃহীত হবে, সে কথাও তিনি তাদের জানিয়ে দেন। মার্শাল মনি ও আ স ম আবদুর রব তখন বলেন যে, পতাকার জমিন অবশ্যই বটলগ্রিন হতে হবে। আর শাজাহান সিরাজ বলেন, লাল রঙের একটা কিছু পতাকায় থাকতে
পৃষ্ঠা: ১১৫
হবে। এরপর কাজী আরেফ পতাকার নকশা তৈরি করেন। বটলগ্রিন জমিনের উপর মাঝখানে গােলাকার লাল রঙের সূর্য এঁকে তিনি, সবাইকে দেখান। সবাই একমত হন। তারপর আমার কাছ থেকে পতাকার সে নকশার অনুমােদন নেওয়া হয়। সে সময় পাকিস্তান সরকার জনগণকে বিভ্রান্ত করতে ইউনাইটেড স্টেটস অফ বেঙ্গল নামের এক কাল্পনিক রাষ্ট্রের প্রচারণা চালাচ্ছিল। তাই কাজী আরেফ প্রস্তাব করে পাকিস্তানি অপপ্রচারের মােকাবেলায় পতাকার লাল সর্যের মাঝে পর্ব বাঙলা বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সােনালী রঙের একটি মানচিত্র দেওয়া উচিত। বাঙালির ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠি প্রায়ই এসব আন্দোলনের পেছনে ‘ভারতের হাত আছে’, ‘ভারতীয় এজেন্টদের কার্যকলাপ’ কিংবা তাতে ‘ভারতীয়দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে’ বলে প্রচারণা চালাতাে। তাছাড়া ঐ সময়টাতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে পর্ব পাকিস্তান ও মিয়ানমারের আরাকানকে যুক্ত করে একটি কল্পিত ‘ইউনাইটেড স্টেটস অফ বেঙ্গল’-এর মানচিত্র তৈরি করে পাকিস্তানি প্রশাসনযন্ত্র বিলি করতাে। বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে নস্যাৎ করা ও জনগণের মধ্যে এ সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টিই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। এ ধরনের প্রচারণা থেকে আমাদের পতাকাকে রক্ষা করার জন্য পতাকার লাল সূর্যের মাঝে বাংলাদেশের সােনালী আঁশ ও পাকা ধানের রঙে একটি মানচিত্র রাখার সিদ্ধান্ত হয়। ‘নিউক্লিয়াস’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই পতাকার এই নকশা করা হয়।
পতাকার কাপড় কিনে তা তৈরি করতে পাঠানাে হয় কামরুল আলম খান খসরুকে। খসরু নিউমার্কেটের ‘অ্যাপােলাে’ নামক একটি দোকান থেকে গাঢ় সবুজ ও লাল রঙের লেডি হ্যামিলটন কাপড় কিনে বলাকা বিল্ডিংয়ের তিনতলায় ‘পাক ফ্যাশন’ থেকে পতাকাটি সেলাই করায়। যে দর্জি পতাকাটা সেলাই করেছিলেন তার নাম আবদুল খালেক এবং তার সহযােগী ছিল মােহাম্মদ নাসিরউল্লাহ। দুজনেই ছিল অবাঙালি।
পতাকা সেলাই করে আনার পর সমস্যা হয় এর মাঝখানের সােনালী মানচিত্রটা আঁকা নিয়ে। কীভাবে কাকে দিয়ে সেই সােনালি রঙের মানচিত্র আঁকা যায়? এ সময় কুমিল্লার শিবনারায়ণ দাসকে
পৃষ্ঠা: ১১৬
(‘নিউক্লিয়াস’-এর সদস্য) ইকবাল হলে ডেকে আনা হয়। তিনি জানালেন, মানচিত্রের ওপর শুধু রঙ করতে পারবেন, মানচিত্র আঁকতে পারবেন না। তখন হাসানুল হক ইনু ও সালাউদ্দীন ইউসুফ চলে গেলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এনামুল হকের আহসানউল্লাহ হলের ৪০৮ নম্বর কক্ষে। তার কাছ থেকে অ্যাটলাস নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকা হয় বাংলাদেশের মানচিত্র। সােনালী রঙ কিনে আনা হয়। শিব নারায়ণ দাস ট্রেসিং পেপার থেকে দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে লাল বৃত্তের মাঝে আঁকলাে মানচিত্র। মানচিত্রের ওপর দিল সােনালী রঙ। এভাবেই শিব নারায়ণ দাসকে দিয়ে লাল বৃত্তের মধ্যকার পূর্ব বাংলার ম্যাপের ডিজাইন আকিয়ে নেওয়া হয়। তৈরি হয় ‘১৫ফেব্রুয়ারি বাহিনী’র (পরে ‘জয়বাংলা বাহিনী’) পতাকা। শিব নারায়ণ দাসের কাজ শেষ হওয়ার মধ্য দিয়েই একটি নতুন দেশের নতুন পতাকার জন্ম হলাে।
সে রাতেই পতাকার সার্বিক অনুমােদনের জন্য ‘নিউক্লিয়াস’-এর বৈঠক হয় ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর কক্ষে। বৈঠকে পতাকাটি অনুমােদিত হয়। পরদিন সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঐ পতাকা ব্যাটালিয়ন ফ্ল্যাগ হিসেবে ‘জয়বাংলা বাহিনী’কে প্রদান করেন। বাহিনীর পক্ষ থেকে তা গ্রহণ করেন আ স ম আবদুর রব।
পতাকা তৈরির পুরাে কাজটি হয়েছিল খুবই গােপনে। ‘নিউক্লিয়াস’-এর মােট ২২ জন সদস্য এ পতাকা তৈরির কাজে অংশ নেন। তাঁরা হলেন কাজী আরেফ আহমদ, মনিরুল ইসলাম, আ স ম আবদর রব, শাজাহান সিরাজ, কামরুল আলম খান খসরু, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, হাসানুল হক ইনু, সালাউদ্দিন ইউসুফ, স্বপন কুমার চৌধুরী (‘৭১ সালে শহীদ), মােয়াজ্জেম হােসেন খান মজলিশ, রফিকুল ইসলাম (লিটল কমরেড), আবদুল্লাহ সানি, এনামুল হক, শিব নারায়ণ দাস, মনিরুল হক, নজরুল ইসলাম (‘৭১ সালে শহীদ), শেখ শহিদুল ইসলাম, চিশতী শাহ হেলালুর রহমান (‘৭১ সালে শহীদ), মইনুল ইসলাম চৌধুরী আজাদ, গােলাম ফারুক, জিনাত আলী, শেখ মােহাম্মদ জাহিদ। বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতীক সে পতাকা ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র
পৃষ্ঠা: ১১৭
সংগ্রাম পরিষদ আহূত লক্ষাধিক জনতার সামনে উত্তোলন করে ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব। এই পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে নিউক্লিয়াস’-এর সামরিক-রাজনৈতিক পরিকল্পনায় নতুন মাত্রা যােগ হয়।
৩ মার্চ ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে স্বাধীনতাকামী ছাত্র-জনতার বিশাল সমাবেশে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ পাঠ করেন। অনুষ্ঠানে ছাত্র নেতা আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদুস মাখন, নুরে আলম সিদ্দিকী এবং শাজাহান সিরাজের শপথবাক্য পাঠ শেষে ‘জয়বাংলা বাহিনী’র উপ-প্রধান কামরুল আলম খান খসরু আনুষ্ঠানিকভাবে গান ফায়ারের মাধ্যমে সশস্ত্র যুদ্ধের ঘােষণা দেয়।
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। জয়বাংলা বাহিনীর চারটি প্লাটুন কুচকাওয়াজের মাধ্যমে ঐ পতাকাকে অভিবাদন জানায়। পরে মুজিব ভাইয়ের বাসভবনে গিয়ে তার হাতে পতাকা তুলে দেওয়া হয়। তিনি তার বাড়িতে ও গাড়িতে বাংলাদেশের এই পতাকা উত্তোলন করেন। ঐ পতাকা পরবর্তী সময়ে প্রবাসী সরকার অনুমােদন করে। ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ও গাড়িতে মানচিত্র খচিত ক্ষুদ্র সাইজের পতাকা উত্তোলনের সময়ও ‘জয়বাংলা বাহিনী’র উপ-প্রধান কামরুল আলম খান খসরু গান ফায়ার করে।
স্বাধীনতার ইশতেহার এবং জাতীয় সঙ্গীত
১৯৭১ এর ২ মার্চ স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে প্রথম দিকনির্দেশনামূলক ঘটনা। এর পরের প্রধান কাজটি ছিল স্বাধীনতার ইশতেহার প্রণয়ন এবং ‘জাতীয় সঙ্গীত’ নির্ধারণ করা। এ জন্য আমাদের হাতে ছিল মাত্র কয়েক ঘন্টা সময়। কারণ পরদিন ৩ মার্চ পল্টনে নির্ধারিত জনসভা। ২ মার্চ রাতেই ইকবাল হলে ‘নিউক্লিয়াস’ নেতৃবৃন্দের বৈঠক হয়। কী কী বিষয় নিয়ে
পৃষ্ঠা: ১১৮
ইশতেহার রচিত হবে বৈঠকে নেতৃবৃন্দ তার সিদ্ধান্ত নেয়। ঘােষণায় নিম্নলিখিত বিষয়াদি থাকবে মর্মে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয় ;
ক. আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘােষণা;
খ. পশ্চিম পাকিস্তানকে, বিশেষ করে সামরিক শাসক এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা;
গ. জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ করা;
ঘ. ইতিপূর্বে নক্সা করা পূর্ব বাংলার মানচিত্রসহ প্রদর্শিত/ প্রকাশিত পতাকাকে স্থায়ীভাবে ‘বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা’ হিসেবে সুনির্দিষ্ট করা;
ঙ. বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে ঘােষণা করা ও মর্যাদা দেওয়া;
চ. স্কুল-কলেজসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, ব্যবসাকেন্দ্র ও শিল্পকারখানায় ‘নিউক্লিয়াস’/’স্বাধীন বাংলাবিপ্লবী পরিষদ’ / ‘বিএলএফ’-এর কমিটি বা ‘সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা;
ছ. ‘অসহযােগ আন্দোলন’কে পুরােপুরি সফল করার ব্যাপারে সক্রিয় হওয়া। সমান্তরাল প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে ছাত্র-যুব ব্রিগেড, নারী ব্রিগেড, শ্রমিক ব্রিগেড ও কৃষক ব্রিগেড গঠন করা।
জ. ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’/’বিএলএফ/নিউক্লিয়াস’-এর সদস্যদের (ইতিমধ্যে যাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল সাত হাজারে) বিভিন্ন স্কোয়াডে বিভক্ত করে প্রাথমিক চিকিৎসা, বােমা তৈরি, অস্ত্র সংগ্রহ এবং প্রাথমিকভাবে অস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া;
ঝ. স্থানীয় পুলিশ, আনসার বাহিনী, ইউওটিসি, প্রাক্তন অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনা ও ইপিআর সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করা;
ঞ. পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যে কোনাে হামলার মুখে শহর ছেড়ে গ্রাম এলাকায় আশ্রয় নেওয়া এবং স্বাধীনতার পক্ষে সম্ভব সকল কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া;
পৃষ্ঠা: ১১৯
ট. জনগণকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ‘জয়বাংলা’ সহ কী-কী স্লোগান দেওয়া হবে সে সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া;
ঠ. বঙ্গবন্ধুকে নেতা হিসেবে মেনে নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষে সকল কাজ সম্পন্ন করা ।
‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ প্রণয়নের কাজটি সম্পাদন করার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়। কাজ শুরু হয় তােফায়েল আহমেদের রুমে। যে কোনাে সময় যে কোনাে কাজে প্রয়ােজন হলে আমাদের দুজনকে যাতে পাওয়া যায়, সে জন্য রাজ্জাক ও কাজী আরেফ পাশের রুমে অপেক্ষমান থাকবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। আমি তােফায়েল আহমেদ ও ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আবদুর রউফকে নিয়ে কাজ শুরু করি। তােফায়েল কিছুক্ষণ সঙ্গে থেকে ‘সিরাজ ভাই যা বলেন তাই হবে’ বলে আরেকটি জরুরি কাজে চলে যায়।
এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার বিভিন্ন কলেজে ছাত্রলীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেশাত্মবােধক সঙ্গীত হিসেবে রবীন্দ্র, নজরুল, ডিএল রায় প্রমুখের লেখা বেশকটি দেশাত্মবােধক গান গাওয়া হতাে। সেগুলাের মধ্য থেকে তিনটিকে আমরা প্রাথমিক বিবেচনায় নিলাম : রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সােনার বাংলা…’, ডিএল রায়ের ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা…’ এবং নজরুলের ‘চল চল চল, উধ্ব গগনে বাজে মাদল’।
প্রায় এক ঘন্টা ধরে জাতীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিন্তা- ভাবনা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হলাে। নজরুলের ‘চল চল চল তারুণ্যদীপ্ত ও অনুপ্রেরণাদায়ক হলেও গানটিকে জাতীয় সঙ্গীতের পর্যায়ে ফেলা যায় না বলে প্রথমেই বাদ দেওয়া হলাে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা…’ গানটির চেয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সােনার বাংলা’ বেশি আবেদনময়, সর্বজনগ্রাহ্য বলে আমার মনে হলাে। আমি বললাম, ‘আমার সােনার বাংলা’ই হবে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। রাজ্জাক ও কাজী আরেফ পাশের কক্ষে বসে পরের দিন অর্থাৎ ৩ মার্চের পল্টনের জনসভায় জনসমাগমের জন্য ঢাকা শহরে ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’ সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ করছিলেন। আমি দ্রুত বেরিয়ে এসে ‘আমার সােনার বাংলা’কে জাতীয় সঙ্গীত
পৃষ্ঠা: ১২০
হিসেবে তাদের বিবেচনার জন্য উত্থাপন করি। ‘নিউক্লিয়াস’-এর তিনজনই আমরা এ ব্যাপারে একমত হই।
এরপর আমি ও আবদুর রউফ প্রায় তিন ঘন্টা সময় নিয়ে ইশতেহারের একটি খসড়া প্রস্তুত করি। এই তিন ঘন্টার মধ্যে আমি রাজ্জাক আরেফকে দু’বার ডেকে পাঠাই এবং কয়েকটি বিষয়ে তাদের মতামত নিই। অনেক কাটাছেড়া, গুরুত্ব অনুসারে শব্দ ও বাক্যের পরিবর্তন ইত্যাদির পর খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়। অতঃপর আমি পাশের রুমে যাই ও সেখানে বসে “নিউক্লিয়াস’-এর বৈঠকে এ বিষয়ে সর্বশেষ অনুমােদন নিই।
রাতের মধ্যেই ইশতেহারটি প্রচারপত্র আকারে ছাপানাের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই দায়িত্বে ছিল রায়হান ফিরদাউস মধু। ভাের হওয়ার আগেই পাঁচ হাজার কপি ছাপা হয়ে আসে। প্রচারপত্রটির শিরােনাম ছিল স্বাধীনতার ইশতেহার : জয়বাংলা। পরদিন পল্টন ময়দানে বিকেল তিনটার ছাত্র-জনসভায় ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজকে ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ ঘােষণা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই বিকেলে পল্টনে ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর জনসভায় সে ইশতেহারটি পাঠ করলাে। তার পড়া শেষে মুজিব ভাই আকস্মিকভাবে পল্টনে উপস্থিত হলেন। এটি ছিল তার অনির্ধারিত উপস্থিতি। তাই তার উপস্থিতিতে শাজাহান সিরাজ ইশতেহারটি আবার পড়ে শােনায়। স্বাধীনতার ইশতেহারটি ছিল নিম্নরূপ :
স্বাধীনতার ইশতেহার : জয়বাংলা
* স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘােষণা করা হলাে।
* গত তেইশ বছরের শােষণ, কুশাসন ও নির্যাতন একথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত করেছে যে, সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে গােলামে পরিণত করার জন্যে বিদেশি পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র তা থেকে বাঙালির মুক্তির একমাত্র পথ স্বাধীন জাতি হিসেবে স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিক হয়ে বেঁচে থাকা। গত নির্বাচনের
পৃষ্ঠা: ১২১
গণরায়কে বানচাল করে শেষবারের মতাে বিদেশী পশ্চিমা শোষকেরা সে কথার প্রয়ােজনীয়তা হাড়ে হাড়ে প্রমাণ করেছে।
৫৪ হাজার ৫ শত ৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগােলিক এলাকার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্যে আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’ । স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যমে নিম্নলিখিত তিনটি লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।
(১) ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ’ গঠন করে পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালি জাতি সৃষ্টি ও বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
(২) ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ’ গঠন করে অঞ্চলে-অঞ্চলে ও ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে বৈষম্য নিরসনকল্পে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করে কৃষক-শ্রমিক রাজ কায়েম করতে হবে।
(৩) ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ’ গঠন করে ব্যক্তি, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ নির্ভেজাল গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে।
বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্যে নিম্নলিখিত কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে :
(ক) বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, মহল্লা, থানা, মহকুমা, শহর ও জেলায় ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করতে হবে।
(খ) সকল শ্রেণির জনসাধারণের সহযােগিতা কামনা ও তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
(গ) শ্রমিক এলাকায় শ্রমিক ও গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের সুসংগঠিত করে গ্রামে গ্রামে ও এলাকায় এলাকায় ‘মুক্তিবাহিনী’ গঠন করতে হবে।
(ঘ) হিন্দু-মুসলমান ও বাঙালি-অবাঙালি সাম্প্রদায়িক মনােভাব পরিহার করতে হবে এবং সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে।
(ঙ) স্বাধীনতা সংগ্রামকে সুশঙ্খলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য পারস্পরিক যােগাযােগ রক্ষা করতে হবে এবং লুটতরাজসহ সকল প্রকার সমাজবিরােধী ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ১২২
স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারা নিম্নরূপ হবে :
(অ) বর্তমান সরকারকে বিদেশী উপনিবেশবাদী শােষক সরকার হিসেবে গণ্য করে বিদেশী সরকারের ঘােষিত সকল আইনকে বেআইনি বিবেচনা করতে হবে।
(আ) তথাকথিত পাকিস্তানের স্বার্থের তল্পিবাহী পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালি মিলিটারিকে বিদেশি ও হানাদার শত্রু সৈন্য হিসাবে গণ্য করতে হবে এবং হামলাকারী শত্রু সৈন্যকে খতম করতে হবে।
(ই) বর্তমান বিদেশী উপনিবেশবাদী শােষক সরকারকে সকল প্রকার ট্যাক্স-খাজনা দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
(ঈ) স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণরত যে-কোনাে শক্তিকে প্রতিরােধ, প্রতিহত, পাল্টা আক্রমণ ও খতম করার জন্যে সকল প্রকার সশস্ত্র প্রস্তুতি নিতে হবে।
(উ) বৈজ্ঞানিক ও গণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সকল প্রকার সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।
(ঊ) স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ‘আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালােবাসি…’ সঙ্গীতটি ব্যবহৃত হবে।
(ঋ) শােষক রাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানের সকল দ্রব্য বর্জন করতে হবে এবং সর্বাত্মক অসহযােগ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
(এ) উপনিবেশবাদী পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে হবে।
(ঐ) স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযােগিতা প্রদান করে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়তে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক। ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ’ গঠন আন্দোলনের এ পর্যায়ে নিম্নলিখিত জয়ধ্বনি ব্যবহৃত হবে।
‘জয়বাংলা’—বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসেবে ব্যবহৃত হবে
* স্বাধীন সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’—দীর্ঘজীবী হউক।
* স্বাধীন করাে স্বাধীন করাে-বাংলাদেশ স্বাধীন করাে।
পৃষ্ঠা: ১২৩
* স্বাধীন বাংলার মহান নেতা-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
* গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়াে—মুক্তি বাহিনী গঠন করাে ।
* বীর বাঙালি অস্ত্র ধরাে-বাংলাদেশ স্বাধীন করাে ।
* মুক্তি যদি পেতে চাও-বাঙালিরা এক হও।
বাংলা ও বাঙালির জয় হােক।
জয়বাংলা।
শ্রমিক লীগ গড়ে তােলা
স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে স্বাধীনতার সংগ্রামে উন্নীত করার পর্যায়ে শ্রমিক সংগঠন গড়ে তােলার গুরুত্ব বেশি করে অনুভূত হতে থাকে। আওয়ামী লীগের অনুমতির অপেক্ষা না করেই আমাদের উদ্যোগে ঢাকার আদমজি, ডেমরা, পােস্তগােলা, তেজগাঁও, টঙ্গী, চট্টগ্রাম বন্দর সীতাকুণ্ড ও নরসিংদীতে শ্রমিক সংগঠনের বিস্তৃতি ঘটতে থাকে।
ঈশ্বরদীতে শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠে আকস্মিকভাবে ও তরিতগতিতে। কমরেড সিরাজ ভাই নামে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পােড়খাওয়া একজন শ্রমিক নেতা, যিনি সম্ভবত ছিলেন একজন ট্রেন ডাইভার, ঐ এলাকা ও আশপাশের অঞ্চলে শ্রমিক সংগঠন গড়ে তােলার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেন। নীতিগতভাবে আমাদের দেশের কমিউনিস্টরা ৬-দফা ভিত্তিক আমাদের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন সমর্থন করেনি। ঈশ্বরদীর সিরাজ ভাই ছিলেন আমার সহপাঠী নজরুল ইসলামের (বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী) বড় ভাই। সেই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে আমি সিরাজ ভাইকে আমাদের পক্ষে কাজ করার জন্য অনুপ্রাণিত করি। সাহসী, দক্ষ ও নিষ্ঠাবান এই মানুষটি তাঁর ২৬ বছর বয়স থেকে কমিউনিস্টদের নিয়ন্ত্রণাধীন শ্রমিক আন্দোলন করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন তা কাজে লাগিয়ে গােটা উত্তরবঙ্গে রেলওয়ে এবং অন্যান্য শ্রমিক এলাকায় আমাদের সংগঠন গড়ে তােলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেন।
এ সব সাংগঠনিক উদ্যোগ কাজে লাগিয়ে শ্রমিক সংগঠন গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত হয় ‘নিউক্লিয়াস’-এ। মূল দায়িত্বে ছিলাম আমি। মান্নান ভাইকে এ কাজে পুরােপুরিভাবে পাই। ঢাকা শহরে চাকুরিজীবী কর্মচারীদের মধ্যে সংগঠন গড়ে তােলার ব্যাপারে অন্যতম ভূমিকা
পৃষ্ঠা: ১২৪
পালন করেন পর্ব পাকিস্তান ওয়াপদার আবদুল মান্নান (পরবর্তীকালে বিএলএফ এর দিনাজপুরের গঙ্গা বেইজ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন এই মান্নান)।
তবে আমাদের এই শ্রমিক সংগঠন গড়ে তােলার উদ্যোগে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ালাে আওয়ামী লীগ। মুজিব ভাই ১৯৬৬-তে জেলে যাবার আগে আওয়ামী লীগকে ব্রিটিশ লেবার পার্টির মতাে করে গড়ে তোলার যে ধারনা আমি তাকে দিয়েছিলাম তারই অংশ হিসেবে শ্রমিক সংগঠন গড়ে তােলার দিকে আমি মনােযােগ দিই। ছাত্র-যুবকদের পর স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্য জনগণের যে অংশটিকে সংগঠিত করা অতি আবশ্যক বলে আমার মনে হয়েছিল তা হলাে শ্রমিক সমাজ। স্বাধীনতার এর আগে এদেশে শ্রমিকের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। সাত- আট লাখের মতাে হতে পারে। সিরাজগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের তাতি এবং সিলেটের চা বাগান শ্রমিকদের নিয়ে সংখ্যাটি বড়জোর ১০ লাখের কাছাকাছি ছিল। জনসংখ্যার তুলনায় এই সংখ্যা খুব বেশি না হলেও এরা ছিল সংগঠিত শক্তি। স্বাধীনতার সংগ্রাম এগিয়ে নিতে এই সংখ্যা এক বিরাট শক্তি। কৃষকদের ব্যাপারে আমরা অবশ্য খুব একটা মনােযােগ দিতে পারিনি। এক্ষেত্রে ছিটেফোটা কিছু কাজ হলেও সাধারণভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা কৃষকদেরকে সংগঠিত করার কোনাে উপায় তখন পর্যন্ত আমরা বের করতে পারিনি।
শ্রমিকদের সংগঠিত করার লক্ষ্যে শ্রমিক সংগঠন গড়ে তােলার বিষয়টি মুজিব ভাইকে বলার একদিনের মধ্যেই তিনি অনুমতি দিলেন। এ কথাও বললেন, ‘তুই নিজে উদ্যোগ নিয়ে এ সংগঠন করবি।’ তার এ ধরনের নির্দেশের পেছনে আমার সাংগঠনিক দক্ষতা ছাড়া হয়তাে বা ব্রিটিশ লেবার পার্টির ধরনে সংগঠন গড়ে তােলার জন্য জেলে যাবার আগে আমার দেওয়া প্রস্তাবটি তার মনে ছিল। তবে এ বিষয়ে আমি কোনােদিন তাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
এক রকম গােপনীয়তার সঙ্গে এবং সমাজবাদী দলের মান্নান ভাইকে ভিড়িয়ে আমি শ্রমিক সংগঠন গড়ে তুলতে শুরু করি। ‘নিউক্লিয়াস’-এর পক্ষ থেকে মেসবাহ আমার প্রধান সঙ্গী হলাে। এছাড়া আরেকটি সঙ্গী ছিল; তা আমার হােল্ডা মােটর সাইকেলটি।
পৃষ্ঠা: ১২৫
অনেকটা গােপনেই আমি, মান্নান ভাই, ওয়াপদার মান্নান, দোকান কর্মচারী নেতা জহির এই শ্রমিক সংগঠন গড়ে তােলার উদ্যোগ নিই। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, সম্মেলন করেই এই শ্রমিক সংগঠন গঠন করা হবে। যতটা সম্ভব মুজিব ভাইকে বিষয়টা জানালাম ( তাকে খুঁটিনাটি সবকিছু জানানাে হতাে না)। সম্মতি তাে আগেই পেয়েছি। তাতে সম্মেলন উদ্বোধন করতে হবে এমন ধারণাও তাকে দিলাম। তিনি অনেকটা সম্মত বলেই মনে হলাে।
এদিকে আওয়ামী লীগে জানাজানি হয়ে গেল, শ্রমিক সংগঠন গড়ে তােলা হচ্ছে। গুঞ্জন থেকে পরে প্রকাশ্যে কথাবার্তা শুরু হলাে। মুজিব ভাই সম্মেলন উদ্বোধন করবেন, সে জন্য তার বক্তৃতা লেখার ভার আমার ওপর পড়লাে। এটিও জানাজানি হয়ে গেল। পুরাে আওয়ামী লীগ শ্রমিক সংগঠন গড়ে তােলার বিরুদ্ধে চলে গেল । শ্রমিক সংগঠন গড়ার উদ্যোক্তা ও সমর্থক ছাত্রলীগ নেতারা একদিকে অবস্থান নিলাে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন নেতা এর বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকাতে এবং নিজেদের মধ্যে অনির্ধারিত ও অঘােষিত মিটিং করতে শুরু করলেন। তাদের তরফে কে এম ওবায়েদুর রহমানকে প্রতিনিধি করে মুজিব ভাইয়ের কাছে পাঠানাে হলাে । ইতিমধ্যে শ্রমিক সম্মেলনে মুজিব ভাইয়ের উদ্বোধনী বক্তৃতার জন্য তাঁর কাছ থেকে পয়েন্টস নিয়ে আমার ভাষণ লেখা প্রায় সমাপ্তির পথে। একদিন আমি লেখা বক্তৃতাটি মুজিব ভাইকে শােনাবার জন্য তাঁর বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি ওবায়েদুর রহমান সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত। মুজিব ভাই পাঁচ মিনিটের মধ্যে নিচে নামলেন। দুজনকে একসঙ্গে দেখে হেসে বললেন, কী, হঠাৎ করে প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি একসঙ্গে?’
মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার এই দেখা করাটা পূর্বনির্ধারিত ছিল। কিন্তু আমি বিষয়টা তােলার আগেই ওবায়েদুর রহমান বললেন, ‘মুজিব ভাই, আওয়ামী লীগ থাকতে শ্রমিক সংগঠন গড়ে তােলার কোনাে প্রয়ােজন নাই। আওয়ামী লীগের প্রায় সকলেরই এ ব্যাপারে একই ধরনের মতামত। এভাবে যুবকরা, শ্রমিকরা, কৃষকরা, নারীরা আলাদা আলাদা সংগঠন গড়ে তুললে আওয়ামী লীগ রাখার আর দরকার কী? মাথায় একেবারে বাজ পড়ার মতাে অবস্থা! আওয়ামী লীগের
পৃষ্ঠা: ১২৬
নেতারা যে শ্রমিক শ্রমিক সংগঠন গড়ার বিষয়টি পছন্দ করছেন না, তা জানতাম। কিন্তু ব্যাপারটা এভাবে প্রতিরােধের পর্যায়ে এসে যাবে, তা ভাবতে পারিনি।
মজিব ভাই বললেন, ‘ওবায়েদ, আমি তাে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছি। আমি উদ্বোধন করবো এটিও বলেছি। সে জন্য উদ্বোধনী বক্তৃতা তৈরি করতে বলেছি সিরাজকে। আজকে সে বক্ততা ফাইনাল করার কথা। একেবারে দুই বিপরীতমুখী সিদ্ধান্তের কারণে মুজিব ভাই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। তিনি আমাদের দুজনকেই বললেন, ‘আমাকে দু-তিন দিন সময় দে, আমি জানাবাে।’ মুজিব ভাইয়ের এ ধরনের কথার অর্থ আমি বুঝি। তবুও চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমি ‘নিউক্লিয়াস’-এ জানালাম বিষয়টা। ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গেও বসলাম। ছাত্রলীগ এবং শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে মুজিব ভাইয়ের বৈঠকের
ব্যবস্থা করলাম। ছাত্রলীগ ও শ্রমিক নেতারা জোরালােভাবে মুজিব ভাইয়ের কাছে শ্রমিক সংগঠন গড়ার প্রয়ােজনীয়তা তুলে ধরলেন। যে একটি মাত্র যুক্তিতে মুজিব ভাই রাজি হলেন, তা হলাে, ভবিষ্যতে বড় কােনাে আন্দোলনে ছাত্র-যুবকদের পাশাপাশি শ্রমিকদের অংশগ্রহণ করাতে হলে তাদের নিজস্ব সংগঠনের দরকার হবে। অদ্ভুতভাবে মুজিব ভাই সাড়া দিলেন এবং ইংরেজিতে বললেন, ‘গাে অ্যাহেড’ (এগিয়ে যাও)। এরপর থেকে আওয়ামী লীগের বাধা খুব বেশি কাজে আসেনি। সারাদেশের সব সেক্টর থেকে প্রায় দুই হাজার প্রতিনিধি নিয়ে সম্মেলন হলাে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে। সংগঠনের নাম দেওয়া হলাে ‘জাতীয় শ্রমিক লীগ’। সভাপতি নুরুল হক মিয়া, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান (সমাজবাদী)। আমি কার্যনির্বাহী পরিষদের ১ নং সদস্য। আওয়ামী লীগের তরফে বাধা কমে যাওয়ার আরও একটি কারণ ছিল আমাদের মধ্যে এক ধরনের বােঝাপড়া। মুজিব ভাই সম্মেলন উদ্বোধন করলেন না, গেলেনও না। তার পক্ষ থেকে তার উদ্বোধনী বক্তৃতাটি আমাকেই পড়তে হলাে। এভাবে গড়ে উঠলাে শ্রমিক লীগ। সাড়া পড়ে গেল শ্রমিক এলাকায়। শ্রমিকদের মাঝে। সারাদেশে।
এতদিনকার শ্রমিক নেতাদের কাছেও এটি অসম্ভব একটা ব্যাপার বলে মনে হলাে। আমি কিছুটা গােপনভাবে সমাজবাদী দলের মূল নেতাদের সঙ্গে, রেলওয়ে শ্রমিকদের নেতা মাহবুবুল হক ও চা বাগান।
পৃষ্ঠা: ১২৭
শ্রমিকদের নেতা কাজী জাফরের সঙ্গে আলােচনা করলাম। তাদের মধ্যে কাজী জাফর বললেন, ‘সিরাজ, তুমি তাে আমাদের কোমর ভেঙ্গে দিলা।’ মাহবুবুল হক ভাইয়ের সহানুভূতি পেলাম। তােয়াহা ভাইয়ের সঙ্গেও দেখা করলাম। ছাত্র-যুবকদের ও শ্রমিক সমাজে সংঘশক্তিকে কতখানি কাজে লাগানাে সম্ভব তা প্রমাণের জন্য হরতাল ডাকা হলাে। সমান্তরালভাবে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পক্ষেও একটি ঘােষণায় একই দিনে হরতাল আহবান করা হলাে। মুজিব ভাইসহ রাজনৈতিক নেতারা করাচি থেকে এ হরতাল আহ্বান করেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানসহ সারা দেশে সেদিন সর্বাত্মক হরতাল হলাে। যে প্রয়ােজনে এ হরতালের আহ্বান তাতে আমরা শত ভাগ সফল হই।
‘বিএলএফ’-এর সদস্য সংখ্যা তখন ছয় হাজারের বেশি। তারা সংঘবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল। সামরিক শাসন কিছুটা শিথিল করা হলে ঘরােয়া রাজনীতি শুরু হলাে। সে সুযােগে আমরা শ্রমিক লীগকে বড় একটি সংগঠনে পরিণত করতে পারলাম। আমার প্রধান কাজ ছিল শ্রমিক লীগের গণসংগঠনের অভ্যন্তরে ‘নিউক্লিয়াস’ এবং ‘নিউক্লিয়াস’-এর সমর্থক সংগঠন গড়ে তােলা। এটা ছিল আমার জন্য এক বিরাট সুযােগ। আর আমি তা সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে পারলাম। এ পর্যায়ে যেসব শ্রমিক নেতা ‘নিউক্লিয়াস’-এর সদস্য বা সমর্থক হিসেবে স্বাধীনতা আন্দোলনের সামনের কাতারে চলে আসেন তাদের মধ্যে ছিলেন আবদুল মান্নান, রুহুল আমিন ভূঁইয়া প্রমুখ। এ ব্যাপারে মেসবাহর ভূমিকাও ছিল অসাধারণ। বলা যায় মেজবাহ শ্রমিক লীগে আমার প্রতিনিধিত্ব করতাে। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরেও এ সময় ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’-এর কাজ অনেক দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে। ১৯৭০-এর শেষভাগে ইকবাল হলের মাঠে ছাত্রলীগের সম্মেলন হলাে। তাতে নূরে আলম সিদ্দিকী ও শাজাহান সিরাজ যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। মুজিব ভাই এ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। ইতিমধ্যে আমরা বুঝতে পারলাম, গণআন্দোলন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। গণআন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে মিটিং-মিছিলে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে এবং সর্বস্তরে স্বাধীনতার কথা হয়তাে বলা যায়, কিন্তু স্বাধীনতা।
পৃষ্ঠা: ১২৮
অর্জনের কৌশলগত দিকটি বের করে নিয়ে আসাও খুবই জরুরি। শুধু গণআন্দোলন দিয়ে তা হবে না।
এ সময়ে স্বাধীনতার পক্ষে একক স্লোগান ‘জয়বাংলা’কে সামনে নিয়ে আসা প্রয়ােজনীয় হয়ে পড়ে। একটি স্বাধীন দেশের জন্য জাতীয় পতাকা প্রয়ােজন। তাও আমরা তৈরি করে ফেলি। ‘জয়বাংলা’ স্লোগান ও স্বাধীন বাংলর পতাকা তৈরির পেছনে উদ্দেশ্য ছিল জনগণের কাছে স্বাধীনতার ধারণাকে প্রাথমিকভাবে তুলে ধরা।
১৯৭০ এর নির্বাচন ও তার পর
সামরিক শাসনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘােষণা এলাে। মওলানা ভাসানী ও তার সমর্থক ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের চীনপন্থী অংশ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিরােধিতা করে। সিরাজ সিকদারের পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টিও নির্বাচনের বিরােধিতা করলাে। আমরা নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট নেওয়ার সুযােগে স্বাধীনতার পক্ষে জনসমর্থনকে কাজে লাগাবার কৌশল গ্রহণ করলাম। সে সময়ে আওয়ামী লীগে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে প্রার্থী মনােনয়ন দেওয়ার মতাে যােগ্যতাসম্পন্ন যথেষ্ট প্রার্থী ছিল না। আমি মুজিব ভাইকে বললাম চলমান আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসা প্রায় ২০০ জনকে মনােনয়ন দিতে। তিনি তাই করলেন। এর ফলে প্রার্থী যাচাইয়ের সংকট থেকে আওয়ামী লীগ কিছুটা মুক্ত হলাে-একথা তিনি আমাকে বলেছিলেন। আমরা এ দুইশত প্রার্থীকে জয়ী করার জন্য এক কঠিন কর্মসূচি হাতে নিলাম। প্রতি প্রার্থীর নির্বাচনী এলাকায় তিন থেকে পাঁচজন করে বিএলএফ কর্মীকে গণসংযােগ ও প্রচারণার জন্য নিয়ােজিত করলাম। এভাবে নিউক্লিয়াস-এর প্রায় দেড় হাজার সদস্য মাঠ পর্যায়ে এ কাজের সঙ্গে যুক্ত হলাে। এটি ছিল একটি সূক্ষ্ম ধরনের কাজ যার সম্পর্কে আওয়ামী লীগ এমনকি মুজিব ভাইও জানতেন না। এই দুরূহ কাজটি নির্ভুলভাবে সম্পাদন করার দায়িত্ব ছিল মার্শাল মনির ওপর এবং তার সহযােগী ছিল আ ফ ম মাহবুবুল হক। আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ ও নূরে আলম সিদ্দিকীসহ ছাত্রনেতারা সবাই প্রার্থীদের পক্ষে দেশব্যাপী জনসভা করলাে।
পৃষ্ঠা: ১২৯
সে সময়ে ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বর ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলাচ্ছ্বাসের যে ঘটনাটি ঘটেছিল, তাতে দক্ষিণবঙ্গের প্রচার কাজে মুজিব ভাই ১৫ দিন ধরে ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। আমিনুল হক বাদশা তখন তার প্রেস সেক্রেটারি। তাকে দিয়ে টেলিগ্রাম করালাম যেন তিনি ফিরে আসেন। কোনাে উত্তর পাওয়া গেল না। তারপর আমার নাম দিয়ে টেলিগ্রাম করা হলাে। তিনি সফর কিছুটা সংক্ষিপ্ত করে ঢাকায় ফিরলেন।
ইতিমধ্যে ঢাকায় আমরা নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে ছাত্র-শ্রমিক মিছিল করতে লাগলাম। কারণ গুজব উঠেছিল জলােচ্ছাসের কারণে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমরা কোনাে অবস্থাতেই নির্বাচন পেছানাের পক্ষে ছিলাম না। ৬-দফা ও ১১-দফা, না হলে ১-দফা (স্বাধীনতা)-এ আওয়াজ সারা দেশে গ্রাম-গঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। একে অন্য কোনাে দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার সুযােগ যাতে কেউ না পায় তার জন্য আমরা নির্বাচনের পক্ষে একনিষ্ঠভাবে প্রচারণা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ঢাকায় ফিরে এসেই মুজিব ভাই তৎকালীন শাহবাগ হােটেলে সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন। বিকাল ৫টায় সাংবাদিক সম্মেলনে যাওয়ার আগে বেশ কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে তার একান্ত কথাবার্তা হলাে। নির্বাচন স্থগিত বা পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষে কোনাে কথাই যেন না ওঠে সে বিষয়ে তিনি একমত হলেন।
এত বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কোনাে সাহায্য-সহযােগিতা এলাে না, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের এ বিমাতাসুলভ মনােভাবের বিষয়টি তিনি তুলে ধরবেন, এটাই মােটামুটি স্থির হলাে। সাংবাদিকদের জন্য এ সম্পর্কে একটা লিখিত বক্তব্য তৈরি হলাে। দেশীয় সাংবাদিকদের তুলনায় বিদেশী সাংবাদিকের সংখ্যা ছিল প্রায় দ্বিগুণ। লিখিত বক্তব্য পাঠের পর প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি আবারও সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাবে পাকিস্তান সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ ও বাঙালিদের প্রতি অবহেলার বিষয়টি তুলে ধরলেন।
সংবাদ সম্মেলনটি প্রায় এক ঘন্টার মতাে চলেছিল। একেবারে শেষ মুহর্তে লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিক মুজিব ভাইকে প্রশ্ন
পৃষ্ঠা: ১৩০
করে বসলেন, ‘In that case will you declare independence? ( যদি তাই হয়, আপনি কি স্বাধীনতা ঘােষণা করবেন?) দু-তিন সেকেন্ডের জন্য আমি বিহ্বল হয়ে গেলাম। কী বলবেন নেতা? স্বাধীনতার কথা বলা যাবে না, আবার সে সম্ভাবনাকে একেবারে অস্বীকার করাও যাবে না। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি উত্তর দিলেন ‘Not yet’. (এক্ষুণি না)। এ কথার অর্থ, এখন নয়, স্বাধীনতার প্রয়ােজন যখন হবে তখন। তার এ উত্তর ছিল একজন পরিপক্ব রাজনীতিবিদের, যা ছিল মুজিব ভাইয়ের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। তার সে উত্তরে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম।
নির্বাচনের কাজকে আরও গতিসম্পন্ন করে জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার আবেগ সৃষ্টি করতে পারবাে—এ চিন্তার ভিত্তিতে নির্বাচনকে কাজে লাগানাের জন্য প্রার্থীদের অঞ্চলে দায়িত্ব দেওয়া বিএলএফ সদস্যদের আমরা নির্দেশ পাঠালাম। কাজও হলাে সেভাবে। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেল, জাতীয় পরিষদের দুটি আসন (ময়মনসিংয়ের নান্দাইল ও পার্বত্য চট্টগ্রাম) ছাড়া বাকি সবগুলােতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়ী হয়েছে। প্রাদেশিক পরিষদের নয়টি ছাড়া সবকটি আসন পেয়েছে আওয়ামী লীগ। মুজিব ভাইও এ ধরনের ফলাফল আশা করেননি। যদিও এরকম একটি ভূমিধস বিজয়ের সম্ভাবনার কথা আমি তাকে নির্বাচনের দিন কয়েক আগেই বলেছিলাম। নির্বাচনী এলাকা থেকে বিএলএফ কর্মীদের পাঠানাে রিপাের্ট বিশ্লেষণ করে আমি ঐ সিদ্ধান্তে উপনীত হই। ইতিপূর্বে তাঁর সঙ্গে আমার যেসব আলােচনা হয়েছে তাতে মুজিব ভাই ১৫০টি সিটের কথাও ভাবতে পারেননি। আমি তাকে ছাত্রলীগের মাধ্যমে গণসংযােগের কথা বলেছিলাম, ১৬৭টি সিট পাবেন তাও বলেছিলাম। ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকায় বিলম্বে নির্বাচন হয়। সেখানেও সবক’টি আসনেই আওয়ামী লীগ জয়ী হয়।
নির্বাচনের পর জনমত যাতে কোনােভাবেই ভিন্নদিকে চালিত না হয় এবং নির্বাচিত সদস্যরা ভিন্নমত পােষণ করতে না পারেন, সেজন্য বিজয়ী প্রার্থীদের শপথ নেওয়ার কর্মসূচি হিসেবে রেসকোর্স ময়দানে মুজিব ভাইকে জনসভা করার কথা বলতেই তিনি রাজি হয়ে গেলেন। ৩ জানুয়ারি, ১৯৭১ লক্ষ লক্ষ লােকের উপস্থিতিতে সেই জনসভা পৃষ্ঠা: ১৩১
হলাে। জনসভাতেই শপথ অনুষ্ঠান হলাে। এ জনসভায় জনসমাগমের দায়িত্ব ছিল বিএলএফ’ সদস্যদের। এ সভাতেই তিনি ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় পাকিস্তান’—দুটি স্লোগানই দেন। এটি ছিল তার রাজনৈতিক রণকৌশলের অংশ। শত্রুকে বিভ্রান্ত করার নানা উপায়ের একটি। তবে, যারা তার ৭ মার্চের বক্তৃতার সঙ্গে এটিকে মিলিয়ে ফেলেন তাঁদের
মতলব ভিন্ন।
নির্বাচনে বিরাট সাফল্যের পর আমরা বুঝলাম সামনে সশস্ত্র লড়াই অনিবার্য। সে যুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারতের সমর্থন প্রয়ােজন। অথচ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান প্রায় শূন্য। এ অবস্থায় আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, “নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’-এর পরিকল্পনা ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মুজিব ভাইকে বিস্তারিত জানানাে প্রয়ােজন। একদিন তাকে বললাম, আপনার সঙ্গে আমাদের জরুরি কথা আছে। আমার মনে হলাে আমার কথার গুরুত্ব তিনি বুঝলেন। বললেন, ‘আগামীকাল ভাের পাঁচটায় আসবি।’
আমি ও রাজ্জাক ভাের পাঁচটায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে তাঁর বাসায় গেলাম। নিচের তলার বেডরুমে তিনি ও ভাবী শুয়ে আছেন। মুজিব ভাই জেগে। বললেন, “এদিকে আয়।’ আমি তার পালঙ্কের এক পাশে বসলাম। রাজ্জাক নিচে মােড়ার ওপরে। ভাবী অন্যদিকে ফিরে ঘুমিয়ে । মুজিব ভাইয়ের হাতটা বাড়ানাে ছিল। আমি ও রাজ্জাক দুজনে তার হাত ধরলাম। বললাম, আমরা অনেক দূরে এগিয়ে গিয়েছি। দশ- পনের সেকেন্ড পর বললেন, ‘আমাকে কী করতে হবে, বল?’ আমরা বললাম, ‘বিদেশী সাহায্য, বিশেষ করে ভারতের সাহায্য প্রয়ােজন।’ আধা মিনিট সময় নিয়ে তিনি বললেন,’যা, হবে। আমি তাে লন্ডন যাচ্ছি, ব্যবস্থা হবে।’
বঙ্গবন্ধুর লন্ডন অবস্থানকালে মিরপুর-মােহাম্মদপুরে বাঙালি- অবাঙালি রায়ট শুরু হয়। ঢাকার অন্য কোথাও যেন এ ধরনের ঘটনা কেউ ঘটাতে না পারে তার জন্য আমরা আমাদের ছাত্র ও শ্রমিক ব্রিগেডকে সতর্ক করে দিলাম । আমি নিজে মােহাম্মদপুর-মিরপুর যেতে চাইলাম। পরিস্থিতি দেখে আর গেলাম না। তাজউদ্দীন ভাইকে বললাম, আমাদের পক্ষে এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব না। মুজিব ভাইকে দরকার। পরের দিন মুজিব ভাইয়ের বাসার টেলিফোন থেকে
পৃষ্ঠা: ১৩২
তাজউদ্দীন ভাই তাঁকে ফোন করলেন, ঢাকার পরিস্থিতির কথা জানালেন। লন্ডন সফর সংক্ষিপ্ত করে ফিরে আসতে বললেন তাকে। ফোন করার সময় আমি তাজউদ্দীন ভাইকে বললাম, আমি যে পাশে আছি সে কথা মুজিব ভাইকে জানাতে। তাজউদ্দীন ভাই তআই করলেন।
তিন- চারদিনের মধ্যে সফর সংক্ষিপ্ত করে মুজিব ভাই ঢাকা ফিরে এলেন। কখন আসবেন আমরা জানতাম। তৎকালীন তেজগাঁও এয়ারপাের্টে বিরাট মিছিল নিয়ে গিয়ে আমরা তাকে স্বাগত জানালাম। বিমানবন্দর থেকে ফেরার পথে তার সঙ্গে একই গাড়িতে তাজউদ্দীন ভাই ও আমি ছিলাম । বাড়ি ফিরে তাজউদ্দীন ভাইয়ের সঙ্গে সামান্য কী যেন বললেন, আমি শুনিনি। এরপর তাজউদ্দিন ভাই চলে গেলেন। রাজ্জাককে আমি আগে থেকেই মুজিব ভাইয়ের বাসায় থাকতে বলেছিলাম। তখন তার দু’পাশে আমি ও রাজ্জাক। আমাদের ঘাড়ে হাত দিয়ে তিনি বললেন, ‘সব ঠিক করা হয়েছে। ভারত অস্ত্র দেবে দেশের মধ্যে ট্রেনিংয়ের জন্য। পরে ভারতেও ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা হবে । বর্ডারের দই জায়গা দিয়ে অস্ত্র আনার ব্যবস্থা কর তােরা। সাতদিনের মাথায় আমরা সীমান্তের দুটি জায়গা দিয়ে অস্ত্র আনার সম্ভাবনা বের করলাম। একটি চুয়াডাঙ্গা। সেখানকার এসডিও ছিলেন তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী। দ্বিতীয়টি ঝিনাইদহ। ওখানকার এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমদ (এসপি মাহবুব)। আমার সঙ্গে তৌফিকের পারিবারিক সম্পর্ক এবং মাহবুবের সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক থাকার কারণে সহজে স্থান দুটি নির্ধারণ করার সুযােগ হয়।
১৯৭০-এর ১৮ ডিসেম্বর ভাের বেলায় মুজিব ভাই মনি, রাজ্জাক,তােফায়েল ও আমাকে তার বাসায় যেতে বললেন। সময় মতাে গিয়ে দেখলাম মুজিব ভাই নিচের তলার বারান্দার সামনে দাড়িয়ে একজন কারাে সঙ্গে কথা বলছেন। আমরা যেতেই ভদ্রলােককে বললেন, ‘এ চারজনকে দিয়েই সব কাজ।’ আমরা আমাদের নাম বললাম। ভদ্রলােক তার নাম বললেন, চিত্তরঞ্জন সুতার। কলকাতার ঠিকানা দিলেন। এদিনের ঘটনা সম্পর্কে কিছুটা বিবরণ অন্য প্রসঙ্গে আগেই দিয়েছি।
পৃষ্ঠা: ১৩৩
১৯৭১-এর ১৮ জানুয়ারি দুপুর বেলা মুজিব ভাই আমাদের চারজনকে তাঁর বাসায় খেতে বললেন। গিয়ে দেখি তাজউদ্দিন ভাই ও আছেন। বললেন, আমার অবর্তমানে তাজউদ্দিনের সঙ্গে আলোচনা করে সব কাজ করবে। কলকাতার ঠিকানাটা আবার স্মরণ করিয়ে দিলেন। আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের কাজ সঠিকভাবে এগুচ্ছে। এখন প্রয়ােজন দেশের ভেতরে কারা ও কী কী ট্রেনিং নেবে তা ঠিক করা।
অস্ত্র সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হলাে ‘খসরু বাহিনী’কে। ফাস্টএইড প্রশিক্ষণ এবং বােমা তৈরির জন্য জায়গা ঠিক করা হলাে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠকে। বেছে বেছে বিএলএফ সদস্যদের মধ্য থেকে টেনিংয়ের জন্য সদস্য সংগ্রহ করা হলাে। ট্রেনিং চলতে থাকলাে। এ ট্রেনিং-এর দায়িত্বে ছিল শরীফ নূরুল আম্বিয়া ও হাসানুল হক ইনু। যুদ্ধের সময় বেতার যােগাযােগ স্থাপনের জন্য বুয়েটের ট্রান্সমিশন যন্ত্রটি ব্যবহার করা যায় কি না তা শরীফ নূরুল আম্বিয়ার মাধ্যমে আমি একদিন দেখতে চাইলাম। বিষয়টি আমার জ্ঞানের মধ্যে না থাকার কারণে আম্বিয়া আমাকে ইলেকট্রিক বিভাগের প্রফেসর নুরুল্লাহর কাছে নিয়ে গেল। প্রফেসর নুরুল্লাহ জানালেন, ট্রান্সমিটারটি অকেজো হয়ে আছে, তবে যন্ত্রপাতি লাগিয়ে ঠিক করা যাবে। প্রফেসর নুরুল্লাহকে নিয়ে আমি ও আম্বিয়া মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য গেলাম । মুজিব ভাই প্রফেসর নুরুল্লাহকে ট্রান্সমিটার ঠিক করতে বললেন। এর জন্য যে অর্থের প্রয়ােজন হবে তারও ব্যবস্থা করা হবে বললেন। প্রফেসর নুরুল্লাহ ফিরে গিয়েই ইলেকট্রনিকস বিভাগের এক মেধাবী ছাত্র ফজলুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে কাজ শুরু করলেন। সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিল শরীফ নুরুল আম্বিয়া। সশস্ত্র যুদ্ধের সময় এই ট্রান্সমিশন যন্ত্রটিকে কেরানিগঞ্জ থেকে চালু করা হবে এমনই সিদ্ধান্ত হলাে।
ইকবাল হলের মাঠে খসরু (তার সহযােগী ছিল মােস্তফা মােহসিন মন্ট) প্রায় ৭০ জন বিএলএফ সদস্যকে অস্ত্র ট্রেনিং দিতে শুরু করে । রাতের বেলা এই ট্রেনিং দেওয়া হতাে। প্রশিক্ষক ছিলেন সিরাজুল ইসলাম দুদু ও গাজী মতিউল হক পেয়ারু। একইভাবে অস্ত্র সংগ্রহের কাজও চলছিল। ঢাকা শহরের তখনকার অভিজাত এলাকাগুলােতে যাদের কাছে অস্ত্র ছিল তাদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করা হলাে। দু’টি
পৃষ্ঠা: ১৩৪
বড় অস্ত্রের দোকান থেকে আধুনিক রাইফেল নিয়ে আসা হলাে । মালিকরা প্রথমে বাধা দিলেও পরে স্বেচ্ছায় দিয়ে দেয়। তারা শুধু পুলিশে ডায়রি করে রাখে।
সেবার ২১ ফেব্রুয়ারি পালন উপলক্ষে বাংলা একাডেমিতে মুজিব ভাইয়ের বক্তৃতা দেওয়ার কথা। সেই বক্তৃতায় তিনি আগামীতে পূর্ব পাকিস্তানের নাম কী হবে তা তুলে ধরবেন। সেই সময় পূর্বদেশ পত্রিকা ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তানের নাম কী হতে পারে সে বিষয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ প্রতিবেদনে সম্ভাব্য কয়েকটি নামের মধ্যে ছিল বঙ্গদেশ, পূর্ব বাংলা ও বাংলাদেশ।
বাংলা একাডেমিতে বক্তৃতা দিতে আসার আগে মুজিব ভাই আমাকে ও রাজ্জাককে তার বাসায় ডাকলেন। আমরা নিউক্লিয়াস থেকে নাম ঠিক করে গিয়েছিলাম ‘বাংলাদেশ’ । বাসায় গিয়ে মুজিব ভাই ঘুম থেকে ওঠার আগে ভাবীর সঙ্গে কথা বলতে তিনিও বললেন, পূর্ব পাকিস্তানের নাম বাংলাদেশই হওয়া উচিত। কাপড় পরতে পরতে মুজিব ভাই বললেন, আজকে তাে আমাকে নামের ব্যাপারে কিছু বলতে হবে। কোনটা বলবাে, তােরা বল?’
আমরা বললাম, আপনি কী ঠিক করেছেন বলেন। সেটাই হবে।’
তিনি বললেন, আমার মতে নামটা হওয়া উচিত বাংলাদেশ। ভাবী, আমি ও রাজ্জাক শব্দ করে একসঙ্গে হেসে উঠলাম। তিনি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন, কী হয়েছে?
ভাবী বললেন, ‘ওরা তাে এ নামটাই ঠিক করে এসে আমাকে বললাে। আমিও বলেছি বাংলাদেশ হলেই ভালাে হয়।’
মুজিব ভাই বললেন, এ ধরনের কঠিন বিষয়ে তােমরা যদি তােমাদের ভাবীসহ আগেভাগেই সিদ্ধান্ত নিতে পারাে, তাহলে তাে আমার কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়।
এদিকে বাংলা একাডেমিতে সাধারণত এ ধরনের সভায় কোনভাবেই দুই হাজারের বেশি শ্রোতা হয় না। আমরা বিএলএফ সদস্যদের বিপুল সংখ্যায় সুশৃঙ্খলভাবে ঐ সভায় উপস্থিত থাকতে বলি। তারা প্রায় পাঁচ হাজারের মতাে উপস্থিত ছিল। তাদের করণীয় সম্পর্কে আগেই নির্দেশ দেওয়া ছিল। মুজিব ভাই ‘বাংলাদেশ’ বলার
পৃষ্ঠা: ১৩৫
সঙ্গে সঙ্গে ‘পূর্ব পাকিস্তান না বাংলাদেশ?-বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ এই শ্লোগানে জনসভা ফেটে পড়লাে।
ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি আমরা অস্ত্র আনার জন্য ডাক্তার আবু হেনাকে শ্ৰী চিত্তরঞ্জন সুতারের সঙ্গে যােগাযােগ করতে কলকাতা পাঠাই। আবু হেনা ফিরে এসে ফেব্রুয়ারির শেষ ও মার্চের প্রথমদিকে অস্ত্র পাঠানাের কথা আমাদের জানালেন। আমরা সীমান্তবর্তী ঐ দুটি স্থানের কথা শ্ৰী চিত্তরঞ্জন সুতারকে জানিয়ে দিলাম । ইতিমধ্যে ট্রেনিং এর জন্য সারা দেশে আরও কিছু কেন্দ্র আমরা খুললাম।
৭ মার্চের ভাষণ
এবার আলােচনা করবাে, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ প্রসঙ্গটি নিয়ে।
১৯৭১ সালে অসহযােগ আন্দোলন চলাকালে পুলিশ, বিডিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে ‘ডিফেকশান’-এর পরিকল্পনা করে ‘নিউক্লিয়াস’। ৭ মার্চের পর থেকে স্বাধীনতার পক্ষে যাবতীয় প্রচার কর্মকাণ্ড বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামেই পরিচালিত হতাে। ‘নিউক্লিয়াস’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩ মার্চ ঘােষিত ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’-এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলা আছে। নিউক্লিয়াস’ (সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদ), ‘বিএলএফ’ হাই কমান্ড (সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, শেখ ফজলুল হক মনি এবং তােফায়েল আহমেদ) ও আওয়ামী লীগ হাই কমান্ড (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, খন্দকার মােশতাক আহমেদ ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী)—সবার সঙ্গে আলােচনা করেই মুজিব ভাই তার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন এবং অসহযােগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘােষণা করেন।
৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর মখে উচ্চারিত এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাক্যটি সংযােজনের একটি পটভূমি আছে। যেমন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সােহরাওয়াদী উদ্যান) বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পেছনেও রয়েছে এক ঐতিহাসিক ঘটনা।
পৃষ্ঠা: ১৩৬
১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসের প্রথমদিকে আমি ও আবদুর রাজ্জাক মুজিব ভাইয়ের ভাইয়ের সঙ্গে বৈঠক করি। বৈঠকে ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’ গঠন এবং এর সাংগঠনিক বিস্তৃতি সম্পর্কে তাকে অবহিত করি। ‘নিউক্লিয়াস’ সম্পর্কে তিনি আগে থেকে অবগত ছিলেন না। এ বৈঠকেই আমরা মুজিব ভাইকে আশ্বস্ত করি যে, স্বাধীনতার লক্ষ্যে ‘নিউক্লিয়াস’ এবং ‘বিএলএফ’-এর কর্মী বাহিনী সাংগঠনিকভাবে
প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও দক্ষ। দেশের সর্বত্র এমনকি প্রতিটি থানা পর্যায়ে এই সংগঠিত ও প্রশিক্ষিত সদস্যরা স্বাধীনতার সপক্ষে জনসমর্থন সষ্টি ও অন্যান্য সাংগঠনিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা অভ্যন্তরীণ যে কোন পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক গণআন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম।
বৈঠকে আমরা আরও বলি, এখন প্রয়ােজন বিদেশের বিশেষ করে প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতের-সঙ্গে এ বিষয়ে যােগাযােগ স্থাপন করা। ভবিষ্যতে বিদেশি সাহায্য-সহযােগিতার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং প্রয়ােজনবােধে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ ও ট্রেনিং প্রদানের ব্যবস্থা করা।
ঐ বৈঠকের কয়েক দিন পরে মুজিব ভাই লন্ডনে যান এবং সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে আলাপ-আলােচনা করেন। লন্ডন থেকে দেশে ফিরে তিনি ‘নিউক্লিয়াস’ নেতৃবৃন্দকে ডেকে ভারতের সঙ্গে তার যােগাযােগের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। সে অনুযায়ী আমরা ‘নিউক্লিয়াস’ নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের দু’টি সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারত থেকে অস্ত্র সংগ্রহের ব্যবস্থা সম্পন্ন করি। এরপরই মার্চের ২৫ তারিখ পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণের মুখে ভারত থেকে অস্ত্র আনার বিষয়টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত হয়, যা পরে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধের রূপ গ্রহণ করে।
১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে প্রথম সাক্ষাতেই শ্ৰী চিত্তরঞ্জন সুতার বিএলএফ নেতৃবৃন্দকে ২১, ড. রাজেন্দ্র রােড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা-৭০০০২১ এই ঠিকানাটি মনে রাখতে বলেন। আমরা চারজন ঐ ঠিকানাটি কয়েকবার মুখে মুখে উচ্চারণ করি এবং মুখস্থ করে রাখি। মুজিব ভাই নিজেও কয়েকবার ঠিকানাটি আওড়ান।
পৃষ্ঠা: ১৩৭
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি মুজিব ভাই বিএলএফ-এর চার নেতা ও আওয়ামী লীগ হাই কমান্ডের নেতা তাজউদ্দীন আহমেদকে নিয়ে স্বাধীনতার বিষয়ে আলােচনায় বসেন। বৈঠকে মুজিব ভাই তাজউদ্দীনকে স্বাধীনতার প্রশ্নে ‘বিএলএফ’-এর
চার নেতার ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে অবহিত করেন। বৈঠকে তিনি বলেন ভবিষ্যতে কখনও যদি তার অনুপস্থিতি ঘটে তাহলে বিএলএফ-এর চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেই স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সমস্ত কৌশল নির্ধারণ করবে। বৈঠকে এ ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে যােগাযােগের বিষয়টিও পুনরায় তিনি আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার বেতার ভাষণের মাধ্যমে ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য গণপরিষদের অধিবেশন বাতিল করলে ছাত্র-জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দিলকুশার হােটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি দলের বৈঠকে ছিলেন। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলে তিনি তাদেরকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার হুকুম, দেন। শুরু হয় স্বাধীনতার জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রাম।
মার্চের ৩ তারিখ মধ্যরাতে মুজিব ভাই ‘বিএলএফ’-এর চার নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়। এ সময় বিএলএফ-এর পক্ষ থেকে মুজিব ভাইকে আওয়ামী লীগের একটি হাইকমান্ড গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। মুজিব ভাই বললেন, তিনি নিজেও এরকমই ভেবেছেন। মার্চের ৪ তারিখে বঙ্গবন্ধু ‘বিএলএফ’- এর চার নেতাকে (আমি, শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক ও তােফায়েল আহমেদ) ডেকে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড গঠন সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি জানান, তাঁর নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড গঠন করা হয়েছে। হাইকমান্ডে অন্য যারা সদস্য রয়েছেন তারা হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মােশতাক আহমেদ ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। হাইকমান্ড গঠনের পর থেকে মুজিব ভাই প্রতি রাতে আন্দোলনের সকল বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের চার নেতা এবং বিএলএফ-এর চার নেতার সঙ্গে আলােচনায় বসতেন।।
পৃষ্ঠা: ১৩৮
৭ মার্চের ভাষণের বিষয় নিয়ে ৫ মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধু প্রথমে বিএলএফ নেতাদের সঙ্গে আলােচনা করেন। সেদিনই আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের সঙ্গেও তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত আলােচনা করেন। সে সময় হাইকমান্ড সদস্যদেরকে তিনি বিএলএফ-এর প্রস্তাবসমূহের ব্যাপারে অবহিত করেন। একই দিনে পৃথকভাবে আবারও বিএলএফ- এর আমাদের সঙ্গে ভাষণের বিষয়াদি নিয়ে তিনি আলােচনায় বসেন। সেদিন অধিক রাতে ৭ মার্চের ভাষণের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। তা হলাে ভাষণটি খুবই আবেগময় হতে হবে এবং মূল ভাষণটি তিন ভাগে বিভক্ত থাকবে। আমাদের তরফে যে তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় তা হলো –
এক. সংক্ষেপে অতীত ইতিহাসের বর্ণনা।
দুই. নির্বাচনের ম্যান্ডেট অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবির পাশাপাশি যুগপৎভাবে অসহযােগ ও স্বাধীনতার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ।
তিন. ‘স্বাধীনতার আহ্বান জানিয়ে বক্তৃতা শেষ করা ।
৬ মার্চের সকাল থেকেই মুজিব ভাই বিএলএফ ও আওয়ামী লীগ হাই কমান্ডের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। বৈঠকের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড ‘মুক্তির সংগ্রাম’ শব্দটি দিয়ে বক্তৃতা শেষ করার কথা বলেছে। তখন বিএলএফ-এর পক্ষ থেকে আমরা স্পষ্টভাবেই বলি, ‘মুক্তির সংগ্রাম’ ও ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ দুটো কথাই বক্তৃতার এক লাইনে থাকতে হবে এবং সে লাইন দিয়েই বক্তৃতা শেষ করতে হবে। তখন মুজিব ভাই আবার আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের কাছে বিষয়টি তুলে ধরেন। ৬ তারিখ বিকাল নাগাদ ‘আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ এই ঘােষণা দিয়ে বক্তৃতা শেষ করার বিষয়ে একমত হয়েছে বলে মুজিব ভাই আমাদের জানালেন।
উল্লেখ্য, ৪, ৫ ও ৬ মার্চ এই তিনদিন প্রতি দুই-তিন ঘণ্টা অন্তর আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড ও বিএলএফ হাইকমান্ডের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক হতাে। প্রতিটি সভার প্রসঙ্গ ছিল ৭ মার্চের বক্তৃতার বিষয়বস্তু। তবে ৬ মার্চ সন্ধ্যায় বিএলএফ-এর পক্ষ থেকে
পৃষ্ঠা: ১৩৯
মুজিব ভাইকে জানানাে হয়, উক্ত লাইনটি ঘুরিয়ে বলতে হবে- অর্থাৎ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এভাবে বলতে হবে। এর কিছুক্ষণ পরে মুজিব ভাই আমাদের জানালেন যে, আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড আমাদের প্রস্তাবে একমত হয়েছে। তখন বিএলএফ হাইকমান্ড ৭ মার্চের বক্তৃতার জন্য মুজিব ভাইকে পয়েন্টগুলাে লিখে দেয়। প্রায় দু’ঘণ্টা পরে মুজিব ভাই প্রথম বারের মতাে বিএলএফ হাইকমান্ডকে তিনি কীভাবে জনসভায় বক্তৃতা করবেন তা শােনালেন। ৬ মার্চ রাত ১২টায় বিএলএফ হাইকমান্ডের সঙ্গে মুজিব ভাইয়ের পুনরায় আলােচনা হয়। তিনি তখন আবারও বক্তৃতাটি আওড়ালেন। তিনি ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে তাঁর বক্ততা শেষ করে আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন হলাে?’
‘আলােচনার এ পর্বে বিএলএফ হাইকমান্ড খুব সূক্ষ্ম একটি বিষয় মুজিব ভাইয়ের কাছে তুলে ধরে। তা হলাে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ কথাটা উচ্চারণের পর জনসভা থেকে যে গর্জন উঠবে সে শব্দে ঐ লাইনের শেষ অংশ ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ভালােভাবে শােনা যাবে না। সে কারণে জনতার গর্জন শেষ হওয়ার পর মুজিব ভাই যেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাক্যটি দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করেন এবং ‘জয়বাংলা’ বলে বক্তৃতা শেষ করেন।
আজ বিষয়টিকে সামান্য বলে মনে হলেও সে সময়ের জন্য এ লাইনটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একভাবে দেখতে গেলে সেটাই ছিল প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-ঘােষণা। তার ঐ বক্তৃতার অসম্পাদিত রেকর্ডে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ দুবার শােনা যায় এবং ঠিকই প্রথমবার জনতার জয়ধ্বনির কারণে ঐ লাইনের শেষাংশটি চাপা পড়ে গিয়েছিল। পুনরাবৃত্তি করার কারণে বক্তৃতাটি সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আজ ৭ মার্চের বক্তৃতাটি যখন মাঠে-ময়দানে বাজানাে হয় তখন দ্বিতীয়বারের উচ্চারণটি শােনা যায়। প্রথমবারেরটি সম্পাদনা করে বাদ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ বেতারের আর্কাইভে তার অসম্পাদিত বক্তৃতাটি এখনও সংরক্ষিত আছে।
পৃষ্ঠা: ১৪০
৬ মার্চ মধ্যরাতের ঐ আলােচনায় মুজিব ভাই উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে তিনি বললেন, বক্তৃতা করতে গিয়ে আবেগ ও উত্তেজনায় ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাক্যটি বলতে যদি তিনি ভুলে যান তাহলে পাশ থেকে কেউ একজন যেন তাকে তা স্মরণ করিয়ে দেয়। সিদ্ধান্ত হলাে আ স ম আবদুর রব মঞ্চে তার পাশে বসবে এবং তিনি যদি দ্বিতীয়বার ঐ কথাটি উচ্চারণ করতে ভুলে যান তাহলে সে তার পাঞ্জাবীর কোনা ধরে হালকা একটু টান দেবে, যাতে করে তিনি বুঝতে পারেন বক্তৃতার শেষ বাক্যটি তাকে আবারও বলতে হবে।
এই হলো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের ইতিহাস!
চরম আর্থিক সংকট
১৯৬৮ থেকে ‘৭০-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত আড়াই বছর আমরা চরম অভাব-অনটনের ভেতর দিয়ে কাটাই। বড় কষ্টে এ দিনগুলাে অতিবাহিত করেছি। ইকবাল হল কেন্দ্রিক আমাদের কাজকর্মে ৫০/৬০ জন সংগঠককে নিয়মিত উপস্থিত থাকতে হতাে। হাতে হাতে রিলে পদ্ধতিতে যােগাযােগের ব্যবস্থা ছিল আমাদের। ইপিআরটিসি, রেলওয়ে ও ট্ৰেলিগ্রাফ অফিসে আমাদের বিভিন্ন ‘সেল’ ছিল। এই সেলগুলাে সংবাদ আদান-প্রদানের ব্যাপারে একনিষ্ঠভাবে কাজ করতাে। ঢাকাভিত্তিক ‘বিএলএফ’ সংগঠকদের প্রতিদিন যাতায়াত ও খাওয়া-দাওয়ার বাবদ যে অর্থের প্রয়ােজন, তার ব্যবস্থা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সারাদিনে এক বেলা খেয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাটাতে হতাে। শ্রমিকদের মধ্যে ২০ জন ও ছাত্রলীগের মধ্য থেকে (বিএলএফ) ৩০ জন করে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কাজ করতাে। পায়ে হেঁটে ঢাকা শহরের এ মাথা থেকে ও মাথায় যেতে-আসতে হতাে। এর জন্য কাউকে বাস ভাড়া দেওয়া সম্ভব হতাে না। রাত জেগে থাকাটাও ‘নিউক্লিয়াস’ও ‘বিএলএফ’-এর ট্রেনিংয়ের অংশ ছিল। এমনও দিন গিয়েছে দুই-আনা চার-আনা করে মােট দেড় টাকা সংগ্রহ করতে পেরেছি। পায়ে হেঁটে মিরপুর, সেখান থেকে দশ-বারাে আনা দিয়ে বিরাট একটা কাঁঠাল কিনে মাথায় করে নিয়ে আসা, তারপর আট
পৃষ্ঠা: ১৪১
আনার মুড়ি কিনে তা দিয়েই দশ-বারাে জনের রাতের খাবারের প্রয়ােজন মেটাতে হতাে।
মাঝে মাঝে আমিনুল হক বাদশা ও আবু বকর সিদ্দিক হলের খাবার তাদের রুমে আনিয়ে রাখতাে। গভীর রাতে ফিরে আমি তার অর্ধেক খেতাম। সে খাবার খেয়েই পরের দিন রাত পর্যন্ত থাকতে হতাে। মাঝে-মধ্যে হলের প্রভাবশালী ছাত্ররা দু’তিন সের চালের ভাত এবং তার সঙ্গে বড় গামলায় বেশি করে ডাল, টমেটো ও পেয়াজ সংগ্রহ করে রাখতাে। ওগুলাে মিশিয়ে পনের-বিশ জনে খেতাম। মাঝে।মধ্যে একেবারে না খেয়েও থাকতে হয়েছে আমাদের অনেককে।
১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি একদিন মুজিব ভাবী একজন লােক মারফত আমাকে বাসায় ডেকে পাঠালেন। আমি যেতেই তিনি আমার হাতে একটা খাম দিলেন। খুলে দেখি ২০০ টাকা। ভাবী বললেন, ‘আপনার ভাই প্রতি মাসে আমার কাছ থেকে আপনাকে এই টাকাটা নিতে বলেছেন।’ মুজিব ভাই জেল থেকে বের হওয়া পর্যন্ত প্রতি মাসে (দুই-এক মাস বাদ গিয়েছে) ভাবী আমাকে খামটা দিতেন। আমাকে মাসের একেবারে প্রথমদিকে ফোন করতে বলতেন। আমাদের কোড ওয়ার্ড ছিল ‘ইটালা’ (ইটওয়ালা)। উনি সে অনুযায়ী আমাকে যেতে বলতেন। পরে জেনেছি মুজিব ভাই জেল থেকেই ভাবীকে বলেছিলেন ঐ টাকাটা আমাকে দিতে।
১৯৬৭-৬৯ মধ্যে ‘নিউক্লিয়াস’ (বিএলএফ)-এর সদস্য সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে প্রায় এক হাজার সদস্য প্রতিদিন নিয়মিতভাবে আমাদের কাজে অংশ নিত। এরা ছিল সার্বক্ষণিক কর্মী ও সংগঠক। বাড়িঘর ও বাবা-মার সঙ্গে এদের সম্পর্ক ছিল না বললেই। চলে। এই সদস্যদের স্তরভেদ ছিল। আর সে অনুযায়ী তাদের কষ্ট সহ্য করার বিশেষ ধরনের ট্রেনিং দেওয়া হতাে। যেমন—রেল লাইন ধরে সাত-আট মাইল হাঁটা ও ফিরে আসা। রাত জেগে থাকা। খাবার এমনিতেই জুটতাে না, তার পরেও কম খাওয়া এবং পানি ছাড়া কিছুই না খেয়ে ২/৩ দিন থাকার ট্রেনিং ছিল বাধ্যতামূলক। একেবারে উপরের পর্যায়ের ১০০ ‘নিউক্লিয়াস’ সদস্যের জন্য নিয়মিত লেখাপড়া করা ছিল বাধ্যতামূলক। ভবিষ্যত রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপযােগী করে নিজেকে গড়ে তােলাই ছিল এ ধরনের কঠোর প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য।
পৃষ্ঠা: ১৪২
এছাড়াও মার্জিত স্বভাব-চরিত্র এবং সাধারণ জীবনযাপন, নিজেকে বুদ্ধিদীপ্ত ও আকর্ষণীয় করে গড়ে তােলা এবং বিয়ে না করা ছিল অন্যতম শর্ত। ‘নিউক্লিয়াস’ সদস্যের জন্য কষ্ট স্বীকারের প্রশিক্ষণ হিসেবে এক পর্যায়ে আগুনের উপর আঙুল বা হাত রাখা, গাড়ির বা ঘরবাড়ির দরজার সংযোগস্থলে হাত রেখে দরােজা বন্ধ করার প্রস্তাব দিলেও ‘ভেটো’র কারণে দ্বিতীয়টি বাতিল হয়ে যায়। একইভাবে অর্থ সংগ্রহের জন্য প্রয়ােজনে ডাকাতির প্রস্তাবও ‘ভেটো’তে বাতিল হয়ে যায়।
১৯৭১ এর প্রথম দিকে ‘বিএলএফ’ ও ‘জয়বাংলা বাহিনী’র সদস্য সংখ্যা এবং সেই সঙ্গে কর্মকাণ্ডের পরিসর বৃদ্ধি পায়। কেরানীগঞ্জে রতন-গগন-মাখনদের বাড়ি এ সময় নিউক্লিয়াস ও বিএলএফ এর কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে । আমাদের তিনজন ছাড়াও ‘নিউক্লিয়াস’-এর কেন্দ্রীয় সদস্য নয় কিন্তু উপরের দিকের সদস্য যেমন মার্শাল মনি, আ স ম আবদুর রব, মেসবাহউদ্দিন, শরীফ নূরুল আম্বিয়া, হাসানুল হক ইনু, নুরে আলম জিকু, কামরুল আলম খান খসরু ও মােস্তফা মােহসীন মন্টুসহ প্রায় ৫০ জনকে এ ঠিকানাটির সঙ্গে পরিচয় করানাে হয়। তাদের সঙ্গে আলােচনায় ভবিষ্যৎ কার্যক্রম, যথা—’বিএলএফ’-এর সংগঠন ‘রেখা
(লাইন) এবং ‘জয়বাংলা বাহিনী’র ভবিষ্যৎ কার্যক্রম (গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কিত) প্রাধান্য পেতাে। খসরু-মন্টুদের সংগৃহীত অস্ত্র দিয়ে ট্রেনিংয়েরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ভবিষ্যতে বাড়িটির কোনদিকে কোন কোন জায়গায় অস্ত্র লুকিয়ে রাখা যাবে তাও ঠিক করা হয়েছিল। ভারত থেকে আনা অস্ত্র সেখানে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হয়। চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ পয়েন্ট হয়ে অস্ত্র গ্রহণ করার মূল দায়িত্ব দেওয়া হয় খসরু, মন্ট, আম্বিয়া ও ইনুর উপর।
১৯৭১ সালের প্রথমদিকেই আমরা নিশ্চিত হলাম যে, স্বাধীনতার জন্য গেরিলা যুদ্ধই উত্তম পন্থা। এই ভাবনা মাথায় রেখে আমরা সারা দেশের জন্য সম্ভাব্য গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনা করি। এ সময় ঢাকার বাইরে জেলা পর্যায়েও ‘জয়বাংলা বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। তাদের ট্রেনিং দেওয়ার কথাও ভাবা হয়।
পৃষ্ঠা: ১৪৩
আমরা “বিএলএফ’-এর চারজন (আমি, মনি, রাজ্জাক ও তােফায়েল) প্রায়ই মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে ভবিষ্যতের আন্দোলন নিয়ে আলাপ-আলােচনা করতাম। তিনি আমাদের পরিষ্কারভাবেই বলতেন, কেবল গণতান্ত্রিক পথে অর্থাৎ মিটিং-মিছিল দিয়ে স্বাধীনতা আসতে পারে না। সম্ভাব্য সশস্ত্র যুদ্ধের কথাও তার মুখ দিয়ে প্রায়ই বেরিয়ে আসতাে। এ ব্যাপারে তিনি আমাদের চারজনকে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়ার কথাও বলতেন। আমার সঙ্গে তার ঢাকাসহ গােটা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সামরিক প্রতিরােধ গড়ে তােলার বিষয়েও বিশদ আলােচনা হতাে। এ প্রসঙ্গে (আমাদের ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’-এ উল্লেখিত) প্রয়ােজনে শহর ছাড়াও গ্রাম এলাকায় ঘাঁটি গড়ার কথাও বলতেন। পাকিস্তানিদের আক্রমণের মুখে শহরে আমাদের প্রতিরােধ দুর্বল হয়ে গেলে তখন গ্রামে গ্রামে প্রতিরােধ গড়ার ওপর গুরুত্ব দিতেন। অবশ্য তার এবং আমাদেরও ধারণায় ২৫ মার্চের অতর্কিত, ব্যাপক ও নৃশংস আক্রমণের বিষয়টি ছিল না।
তখন সারা দেশে সড়কভিত্তিক যােগাযােগ ও পরিবহন ব্যবস্থা এখনকার তুলনায় পাঁচ শতাংশও ছিল না। রেল এবং ইপিআরটিসির বাসই যাতায়াত ও পরিবহনের প্রধান মাধ্যম ছিল। যদিও তারও আওতা ছিল খুবই সীমিত। অবশ্য নদীপথে যােগাযােগের ব্যবস্থা রাস্তাঘাটের চাইতে ভালাে ছিল।
রেল ব্যবস্থায় প্রতিরােধ সংগঠন শক্তিশালী করার উপর জোর দিতে তিনি আমাকে বলতেন। সে অনুযায়ী বিএলএফ’ চট্টগ্রাম, লাকসাম, আখাউড়া, সিলেট, সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, দর্শনা, যশাের, খুলনা ও গােয়ালন্দসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিরােধের কেন্দ্র গড়ে তুলেছিল। প্রতিরােধ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে স্লিপার তুলে ফেলা, কালভার্টগুলাে অকেজো করে দেওয়া, বিশেষ বিশেষ জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে বাধা সৃষ্টি করা—এসব পরিকল্পনা নেওয়া হয়। প্রয়ােজনে বিস্ফোরক তৈরি করে এসব কাজে লাগানাে, সিগন্যাল ব্যবস্থা অকেজো করে দেওয়ার প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছিল। আবদুর রাজ্জাকের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হলাে (মুজিব ভাইই দিলেন) সারাদেশের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বিশেষ করে ‘বিএলএফ’ কর্মীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যােগাযােগ রক্ষার। এ জন্য
পৃষ্ঠা: ১৪৪
রাজ্জাক সারাদেশকে চার ভাগে ভাগ করে (চট্টগ্রামমুখী, সিলেটমুখী, খুলনামুখী ও রাজশাহীমখী এভাবে) ‘টিম’ গঠন করে এবং তাদের সঙ্গে দ্রুততার সঙ্গে যোগাযােগ করার ব্যবস্থা তৈরি করে। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একদিন মজিব ভাই বললেন, ‘আমরা সময় পাবাে কি না তাও সন্দেহ হয়।’
শহবের প্রতিরােধ ভেঙে পড়লে আমাদের শহরতলী ও গ্রামে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য আমরা নির্দেশনামা হিসেবে সর্বত্র দুটি লিফলেট পাঠিয়েছিলাম।
শেখ ফজলুল হক মনির ওপর মুজিব ভাই দায়িত্ব দেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর সৈনিকদের সেনাবাহিনী থেকে বের করে নিয়ে আসার । এ বিষয়ে প্রথমদিকে মনি বা আমাদের কোনাে ব্যবস্থাই ছিল না। মুজিব ভাই তার দেওয়া একটি সূত্র ব্যবহার করার কথা বললেন। সেটি ব্যবহার করে আমরা কেবল এক ‘ক্যাপ্টেন বেগ’-এর সঙ্গে যােগাযােগ করতে সক্ষম হই। তাঁকে নিয়ে আমরা রতন-গগনদের বাড়িতে যাই। বাড়িটি আমাদের সম্ভাব্য ট্রেনিংয়ের জায়গা হিসেবে নির্ধারণ করা ছিল। তবে এ বিষয়ে আমরা খুব বেশি অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি।
তােফায়েলের ওপর দায়িত্ব ছিল সে মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে যুক্ত থাকবে এবং মুজিব ভাইয়ের বিশেষ কোনাে নির্দেশ থাকলে তা আমাদেরকে জানাবে।
১৯৭১-এর ২১ ফেব্রুয়ারির পরপরই মুজিব ভাই আমাদের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। রাজ্জাক ও তােফায়েল তখন নির্বাচিত সংসদ সদস্য। আমাদের সঙ্গে আলােচনার এক পর্যায়ে মুজিব ভাই সংসদ নেতা, উপনেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও হুইপ নির্বাচনের প্রয়ােজনীয়তার বিষয়টি উত্থাপন করেন। তিনি ময়মনসিংহের সৈয়দ নজরুল ইসলামকে জাতীয় পরিষদের ডেপুটি লিডার, প্রফেসর ইউসুফ আলীকে স্পিকার এবং শাহ মােয়াজ্জেম হােসেনকে হুইপ করার কথা বলেন। আসন্ন জাতীয় সংসদের বৈঠক সামনে রেখে ১ মার্চ দেশব্যাপী সভা-সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত হয়।
১ মার্চ একদিকে ঢাকার পূর্বাণী হােটেলে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের সভা আর তাদের ওপর চাপ রাখার জন্য পাশাপাশি একই সময়ে দেশব্যাপী সভা-মিছিলের আয়ােজন করা হয়। এসব কর্মসূচি
পৃষ্ঠা: ১৪৫
চলাকালেই দুপুরে পাকিস্তান বেতারের সংবাদে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক ৩ মার্চের সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করার কথা জানা যায়। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতাে এ ঘােষণা গোটা জাতিকে স্তম্ভিত করে দেয়।
খবরটা পাওয়ার পর আমি মােটর সাইকেলে ইকবাল হল থেকে হােটেল পুবাণীর দিকে রওয়ানা হলাম। ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রলীগের সদ্যপ্রাক্তন সভাপতি আবদুর রউফ ও সাধরণ সম্পাদক খালেদ মােহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে ছাত্রদের মিছিল শুরু হয়। তার সঙ্গে চারদিক থেকে বন্যার মতাে আরও মিছিল এসে যুক্ত হয় এবং সবাই শহীদ মিনারে জড়াে হয়। সেখান থেকে ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব ২ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রতিবাদ সভার ঘােষণা দেন।
আমি মােটর সাইকেলে হােটেল পূর্বাণীতে যাওয়ার পথে মােহাম্মদ শাহজাহানের নেতৃত্বে পােস্তগােলা থেকে আগত ঢাকা ম্যাচ ফ্যাক্টরির শ্রমিকদেরসহ বিরাট একটি মিছিল দেখতে পাই। আমি তাকে পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের সভায় সবাইকে যােগ দেওয়ার ঘােষণা দিতে বলি। এরপর আমি হােটেল পূর্বাণীতে গেলাম। তখন সংসদীয় দলের সভা প্রায় শেষ পর্যায়ে। একটি সাদামাটা বিবৃতি দেওয়া হলাে অবিলম্বে সংসদ আহ্বানের দাবি জানিয়ে। ঐ সন্ধ্যায় আমরা জিন্নাহ হলের নাম পরিবর্তন করে মাস্টার দা সূর্যসেন হল রাখি। সেদিন আর মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা করার সুযােগ হলাে না। ‘বিএলএফ’ নেতাদের সঙ্গেও বসা সম্ভব হলাে না। ছােট পরিসরে ‘নিউক্লিয়াস’-এর বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম, পরের দিন অর্থাৎ ২ মার্চের সভায় বাংলাদেশের নতুন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। আ স ম আবদুর রবকে ডেকে এই সিদ্ধান্ত জানানাে হলাে।
কথাটা শােনার পর তাকে খুবই উত্তেজিত দেখলাম। সে উত্তেজনা কেবল নতুন একটি পতাকা উত্তোলনের আবেগ থেকে নয়, তার চেয়েও বড় কিছু করার প্রত্যয় যেন তার চোখেমুখে ফুটে ওঠে। যথারীতি ২ মার্চ কলাভবনের গাড়ি বারান্দার ছাদ থেকে পতাকা উত্তোলন করা হয়। ডাকসুর জিএস আবদুল কুদুস মাখন, ছাত্রলীগ সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজের
পৃষ্ঠা: ১৪৬
উপস্থিতিতে রব পতাকা উত্তোলন করে। এই পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে লক্ষাধিক ছাত্র-জনতার সমাবেশে স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় মনােভাব প্রকাশ পায় ।
২ মার্চের ঐ সমাবেশ থেকে ৩ মার্চ পল্টনে জনসভা অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর আগে ১ মার্চ রাতেই ‘নিউক্লিয়াস’-এর পক্ষ থেকে আমরা পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচি আর ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ এর নামে পরিচালনা করার প্রয়ােজন নেই বলে সিদ্ধান্তে আসি। কারণ আমাদের মনে হলাে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ নিয়ে এগুতে গেলে ভবিষ্যতে ছাত্রলীগ ও ডাকসু ছাড়া অন্যদের (ছাত্র ইউনিয়নের দুই গ্রুপ ও এনএসএফ) তরফ থেকে বাধা আসতে পারে। এ চিন্তা থেকে আমরা ডাকসু ও ছাত্রলীগ দিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। “নিউক্লিয়াস’-এ তা অনুমােদিত হয়। এভাবেই ২ মার্চের পতাকা উত্তোলন-এর মতাে ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনাটি ঘটানাে সম্ভব হয়। সেদিন সন্ধ্যা হতে হতেই আমরা নিউক্লিয়াস’ থেকে ৩ মার্চের জনসভায় স্বাধীনতার ইশতেহার ঘােষণার সিদ্ধান্ত নিই।
৩ মার্চ পল্টনের জনসভায় শাজাহান সিরাজের ইশতেহার পাঠের প্রায় শেষ পর্যায়ে হঠাৎ দেখলাম মুজিব ভাই পনের-বিশজনকে নিয়ে পল্টনের মঞ্চের দিকে আসছেন। তাঁর আসার এ খবরটা আমার জানা ছিল না। তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে কোনাে আলাপও এর আগে আমার হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই ইশতেহার পাঠ বন্ধ হয়ে গেল। মুজিব ভাই মঞ্চে উঠলেন। মুজিব ভাইয়ের সামনেই ঘােষিত হলাে ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম হলাে।’
সভার অন্যান্য ঘােষণার মধ্যে ছিল জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত এবং সামনের দিনের সশস্ত্র সংগ্রামের ইঙ্গিত ও নির্দেশনা।
মুজিব ভাই পাঁচ মিনিটের মতাে বক্তব্য দিলেন। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভার কথা বললেন। ইতিমধ্যে তাঁর সঙ্গে আমার ৭ মার্চের জনসভা সম্পর্কে কথা হয়েছে। আমি আজও জানি না কী কারণে মুজিব ভাই সেদিন অপ্রত্যাশিতভাবে পল্টনের জনসভায় হাজির হয়েছিলেন। ঐ সভায় উপস্থিত জনতার আকাঙ্ক্ষা ছিল হয়তাে মুজিব ভাই সেখান থেকেই সরাসরি স্বাধীনতার ঘােষণা দেবেন। কিন্তু ৭ মার্চের সভার কথা বলার পর বিষয়টি আর এগুলাে না।
পৃষ্ঠা: ১৪৭
৭ মার্চের জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধু অসহযােগ আন্দোলনের ঘােষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা বাস্তবায়নের সব দায়িত্ব এসে পড়ে ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’-এর ওপর। ইতিমধ্যে গঠিত ছাত্র-যুব- শ্রমিক-কৃষক ও নারী-ব্রিগেডের নেতৃত্বে সারা দেশে আন্দোলন চলছিল। এ বিষয়ে মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের, বিশেষ করে আমার ও রাজ্জাকের প্রতিদিন দুই-তিনবার আলােচনা হতাে। ওসব আলােচনার বিষয় ছিল অসহযােগ আন্দোলনের সাফল্য। মুজিব ভাই আমাদেরকে (বিএলএফ) বলেছিলেন, ‘তােদের ছাড়া অসহযােগবা অন্য কোনাে কর্মসূচি সফল হবে না।’
২০ মার্চ থেকে ঘটনাপ্রবাহ দ্রুতগতিতে এবং ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। মিটিং-মিছিল ভিত্তিক আন্দোলন অপ্রয়ােজনীয় ও অযথেষ্ট হয়ে পড়ছিল। জনগণ নিজেরাই প্রতিরােধ গড়ে তুলতে আরম্ভ করলাে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে। গাজীপুর, টঙ্গী, চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর এসব স্থানে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে সরাসরি সংঘাত শুরু হলাে।
১৫ মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকায় এলেন মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আলােচনা করতে। আলােচনায় মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মােশতাক আহমেদ ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলীও ছিলেন। এক পর্যায়ে ভূট্টোও ঢাকায় এলেন। ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো আলােচনা হলাে। আলােচনার পর প্রতিদিন প্রেসনােট ইস্যু করা হতাে। আওয়ামী লীগের তরফে আলােচনার ফলাফল জানিয়ে প্রেসনােট লিখতেন তাজউদ্দীন সাহেব।
১ মার্চের পর থেকে সংবিধান রচনার জন্য আওয়ামী লীগের তরফে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। যার সদস্য ছিলেন ড. কামাল হােসেন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, প্রফেসর নুরুল ইসলাম, ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, রেহমান সােবহান ও নূর মােহাম্মদ মিয়াসহ বেশ কয়েকজন। এ সময় আমি একদিন মুজিব ভাইকে বললাম, ‘এরা যে সংবিধান তৈরি করছেন সেটি কি পাকিস্তানের না বাংলাদেশের? আর ওখানে আপনার প্রতিনিধি কে?’ তিনি বললেন, ‘ঠিকই তাে বলেছিস! তুই ওদের সঙ্গে একটু বসবি?’
পৃষ্ঠা: ১৪৮
আমি পরের দিন গেলাম। আমাকে আমার বক্তব্য বলতে বলা হলো। আমি বললাম, সংবিধানে ৬-দফার পূর্ণাঙ্গ অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। বিশেষ করে দুই মুদ্রা এবং পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে এক লক্ষ মিলিশিয়া থাকতে হবে। তারা সকলে এক বাক্যে বললেন, সেক্ষেত্রে তাে পাকিস্তান থাকে না। তবে আমাদের এখানে বসে লাভ কী?’
সেদিন সন্ধ্যে বেলায়ই ঐ কমিটির পক্ষ থেকে মুজিব ভাইকে বলা হলো, ‘সিরাজের কথা শুনলে তাে পাকিস্তানই থাকে না। সেক্ষেত্রে আমাদের এ সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রয়ােজন কী?’
এদিকে পরিস্থিতি ক্রমে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে লাগলো। মুজিব ভাই তার সঙ্গে ইয়াহিয়ার এবং ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সঙ্গে তার কী কী আলােচনা হয় তা জানানাের জন্য প্রতিদিন রাত ১০টার পরে আমাকে তার বাসায় থাকতে বলতেন। সবাই চলে যাবার পর তিনি আমার সঙ্গে বসতেন।
প্রথমদিন আলােচনার পর মুজিব ভাই বললেন, “সিরাজ, আলােচনা তাে একদিনে শেষ হবে না। এটি গড়িয়ে গড়িয়ে চলবে।’
আমি আমার সে সময়কার বুদ্ধি ও মেধা দিয়ে বললাম, ‘মুজিব ভাই, আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্যটি যেন কোনােভাবেই ইয়াহিয়া বুঝতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন।’
তিনি বললেন, ‘ঠিকই বলেছিস।’
ইয়াহিয়া বা ভুট্টোর সঙ্গে আলােচনায় যাবার আগে মুজিব ভাই আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডকে তার বাসায় আসতে বলতেন। আমাকেও যেতে বলতেন। তিনিসহ আওয়ামী লীগাররা যেন মুজিব কোট পরে আলােচনায় যায়, সেটি যাতে নিশ্চিত করা হয়, আমি তা বলতাম। খন্দকার মােশতাক আহমেদ ছাড়া আর সবাই মুজিব কোট পরতেন। তারা ফিরে আসা পর্যন্ত আমি মুজিব ভাইয়ের বাসায় থাকতাম। সংবাদপত্র ও বিদেশি গণমাধ্যমগুলাে আলােচনায় অগ্রগতি হচ্ছে বলে সংবাদ দিত।
২১ মার্চ মুজিব ভাই বৈঠক থেকে ফিরে এসে জানালেন, নামেমাত্র এক পাকিস্তান রেখে দুই অংশের জন্য দুই প্রধানমন্ত্রী এই ঐকমত্যের ভিত্তিতে আলােচনা শেষ হয়েছে। ২২ মার্চ ফলাও করে
পৃষ্ঠা: ১৪৯
এ সমঝােতার কথা প্রচারিত হলাে। সংবাদপত্রগুলাে লিখলো আলােচনা সফল হয়েছে।
সে রাতে মুজিব ভাইকে খুব গম্ভীর ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখলাম । পরেএ দিন ২৩ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে প্রতিরােধ দিবস’। ঐদিন মজিব ভাই ইয়াহিয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকারে যান।
‘নিউকিয়াস’ থেকে আমরা ঠিক করলাম, মুজিব ভাই গাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। মুজিব ভাই এতে আপত্তি জানালেন। তিনি স্পষ্টতঃ এর বিপক্ষে ছিলেন। পরে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর চাপে তিনি তাঁর গাড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা লাগাতে রাজি হন। যাবার আগে খসরু রাইফেলের ফাকা আওয়াজ করে তাঁকে অভিবাদন জানালাে, আমাদের দিক থেকে যা ছিল আসলে সশস্ত্র যুদ্ধের ইঙ্গিত। হাসানুল হক ইনু মুজিব ভাইয়ের গাড়িতে পতাকা লাগিয়ে দিল। এভাবেই মুজিব ভাই ইয়াহিয়ার সঙ্গে কথা বলতে গেলেন। পরের দিন আবারও সংবাদপত্রে সফল আলােচনা ইত্যাদির কথা বলে খবর পরিবেশিত হলাে।
২৩ মার্চ রাত ৮টার দিকে মুজিব ভাইয়ের বাড়ি থেকে প্রায় সবাই চলে যায়। যথারীতি আমি ১০ টায় ৩২ নম্বরে উপস্থিত ছিলাম । রাজ্জাক এসে বললাে, “সিরাজ ভাই, কী করবেন? আমি তার দিকে তাকাতেই পেছনে দেখলাম মনি, তােফায়েল, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ ও শেখ শহীদ। আমি ও রাজ্জাক দুজনেই দুজনকে বললাম, এ বিষয়ে আমাদের বসতে হয়। তখন ‘নিউক্লিয়াস’-এর আলাদাভাবে বসার সময় নেই।
বসার জন্য সেখান থেকে সবাই আমরা একসঙ্গে আওয়ামী লীগের ট্রেজারার খুলনার মােহসীন ভাইয়ের বাসায় গেলাম। তার বাসা লালমাটিয়ায়। যাওয়ার আগে মুজিব ভাইয়ের সামনে যেতেই বললেন, ‘কিরে, কোনাে কথা আছে’? তখন তিনি একা। তাকে খুবই চিন্তিত দেখলাম। বললাম, আমরা রাতে দেখা করবাে। তিনি ২টার পরে আমাদের আসতে বললেন।
মােহসীন ভাইয়ের বাসায় আমরা প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে কথা বললাম। প্রথমে আমি বৈঠকের ফলাফলের কথা জানালাম। অন্যরা বললাে, “সে তাে আমরাও জানি। এখন মুজিব ভাইকে কীভাবে রাজি
পৃষ্ঠা: ১৫০
করানাে যায়? দুই প্রধানমন্ত্রীর ফর্মুলা কোনােভাবেই গ্রহণযােগ্য নয়।’ আমি বললাম আমরা সবাই একমত থাকলে মুজিব ভাই রাজি হবেন। রাত ঠিক আড়াইটায় মুজিব ভাইয়ের বাসার দোতলায় আমি, রাজ্জাক, মনি, আ স ম রব, শাজাহান সিরাজ ও শেখ শহীদ মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে বসলাম। সেখানে আরও ছিলেন বেগম মুজিব ও মমিনুল হক খোকা মামা। মুজিব ভাই-ই কথা তুললেন। তিনি বললেন, কী করতে হবে বল। কীভাবে কী করবাে?’
আমরা বললাম, এ চুক্তি বাংলার মানুষ কোনােভাবেই গ্রহণ করবে না আর এবার না হলে কোনােদিনই বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার পক্ষে আনা যাবে না।
উনি বললেন, ‘আমিও তা-ই মনে করি। কিন্তু কী বলে আলােচনা ভাঙতে হবে?’ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “সিরাজ, তুই কী বলিস?’তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যা বলার কাল সকালেই বলতে হবে। ইয়াহিয়া কাল চলে যাবে।
মুজিব ভাইসহ আমরা সবাই কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম। আমি বললাম, একটাই সমাধান আছে, আলােচনা ভেঙ্গে দিতে হবে। মুজিব ভাই বললেন, ‘কোনটা?’ পরক্ষণেই বললেন, ‘ও হ্যা বুঝেছি’। তখন ভাের সাড়ে চারটা। মুজিব ভাইয়ের চোখ লাল। তামাকের পাইপ কামড়ে ধরেছেন। এটি তিনি সাধারণত কঠিন সময়েই করতেন। পরে বললেন, তােরা যা। একটা উপায় বের করতে হবে।’ আমরা বেরিয়ে আসার সময় আমাকে বললেন, ‘তুই পাঁচ মিনিট পরে যা।’
অন্য সবাই নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম, ‘দুই মুদ্রা ব্যবস্থা চুক্তির মধ্যে থাকতে হবে।’
মুজিব ভাই বললেন, ‘হ্যা, আমিও তাই ভাবছি’।
আমি এরপর এক লক্ষ মিলিশিয়ার কথা যােগ করলাম। তিনি বললেন, ‘মিলিশিয়ার ব্যাপারে আমি তাদেরকে আগেই বলেছি। এখন দুই মুদ্রার বিষয়টাই আলােচনা ভাঙার একমাত্র উপায়।’ তিনি আমাকে পরদিন সকাল দশটার দিকে আসতে বললেন। আমি বললাম, “দরকার নেই। আপনি আলােচনা থেকে ফিরে এলেই আমি আসবাে।”
পৃষ্ঠা: ১৫১
আমি দুপুরে গেলাম। তিনি বললেন, ইয়াহিয়া আমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে।’
মুজিব ভাই বললেন, ‘আগামীকাল রাতেই ওরা আক্রমণ করবে। প্রথম পর্যায়েই প্রতিরােধটা যেন শক্ত হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে।’ আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘কাউকে বলিস না। আমি বাসাতেই থাকবাে। আমাকে না পেলে ওরা উন্মাদের মতাে আচরণ করবে আর সে সুযােগে আমাকে মেরেও ফেলবে ।
এটিই স্বাধীনতার আগে তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা।
২৫ মার্চ রাতে মুজিব ভাই জাতির উদ্দেশে পুলিশের মাধ্যমে যে বার্তা দিয়েছিলেন তা হলাে : The enemy has struck us. Hit them back. Victory is ours, Insha Allah. Joy Bangla. Mujibur Rahman, (শত্রুরা আমাদের আঘাত করেছে। আপনারা পাল্টা আঘাত করুন। ইনশাল্লাহ বিজয় আমাদের হবেই। জয়বাংলা। মুজিবর রহমান)।
এ বার্তার ব্যাপারে মুজিব ভাই আমার সঙ্গে আগে আলাপ করেছিলেন এবং এর ২/৩টা খসড়াও তৈরি করেছিলেন। ড. কামাল হােসেন এটির মুসাবিদা করে দেন। তাজউদ্দীন ভাই ও আমাকে দেখিয়ে তিনি বললেন, এটি মুজিব ভাইয়ের কাছে নিয়ে যান।
ঐ তিনটি বাক্যই জাতির উদ্দেশে মুজিব ভাইয়ের শেষ আহ্বান ছিল।
আমি ২৫ মার্চ ভাের রাত পাঁচটা পর্যন্ত লালবাগ থানার ওসির রুমে কাটিয়েছি। সেখানে এই বার্তা আমি নিজে শুনেছি। ২৬ মার্চ সকালে আমি বুড়িগঙ্গা নদী পার হই। ২৬-২৭ মার্চ কেরানিগঞ্জে মন্টুদের এলাকায় ছিলাম। ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমানের ঘােষণা শুনি । ২৭ তারিখ রাতে ‘নিউক্লিয়াস’-এর সবাই আমরা রতন-গগনদের বাড়িতে জড়াে হলাম। আমি, রাজ্জাক, আরেফ, মনি, তােফায়েল, রব, শাজাহান সিরাজ, খসরু ও ক্যাপ্টেন বেগ। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডাক্তার আবু হেনা, শেখ মনি, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান কলকাতা চলে গেলেন। আমি, রাজ্জাক, খসরু, সুমন মাহমুদ বাবুল, ক্যাপ্টেন বেগ একসঙ্গে খুলনা পর্যন্ত গেলাম। সেখান থেকে দুই ভাগ হয়ে রাজ্জাক ও খসরু সাতক্ষীরা দিয়ে কলকাতা গেল।
পৃষ্ঠা: ১৫২
আমি প্রথমে পটুয়াখালি গেলাম। সেখানে মেজর জলিলের সঙ্গে আমার দেখা হলো। নাজমুল হক নামে একজন ম্যাজিষ্ট্রেটও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। কাজী আরেফ ঢাকার দায়িত্বে থাকলাে। বলা হলাে, যতদিন সম্ভব সে এখানে থেকে ‘বিএলএফ’ সদস্যদের সঙ্গে যােগাযোগ করবে।
এরপর আমি, নুরুল ইসলাম (প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য) ও নাজমুল হক চুয়াডাঙ্গায় গিয়ে সেখানে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ও তৌফিক-ই- লাহির সাক্ষাৎ পেলাম। তারা বললেন, কলকাতা থেকে তাদের কাছে বার্তা এসেছে, যে কোনােভাবেই হােক আমাকে যেন নিরাপদে কলকাতায় পাঠাবার ব্যবস্থা করা হয়।
আমি নুরুল ইসলাম ভাইসহ গেদে বর্ডার দিয়ে পশ্চিম বাংলায় ঢুকলাম। ৩১ মার্চ আমি কলকাতা পৌছাই। কলকাতায় পৌছানাের পর মালেক উকিল আমাকে শ্ৰী চিত্তরঞ্জন সুতারের বাড়িতে নিয়ে যান। যাবার সময় মালেক উকিল বললেন, ‘তােমার জন্য বারবার দিল্লি থেকে বার্তা আসছে।’ চিত্ত সুতারের বাড়িতে গিয়ে সেখানে মনি, রাজ্জাক ও তােফায়েলকে পেলাম। এরপর প্রবাসী সরকারের সঙ্গে আমাদের যােগাযােগ হলাে। আমাদের উদ্যোগে তাদের মধ্যেকার ভুল বােঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে সরকার গঠনের কাজ চূড়ান্ত করা হলাে। শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট, তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী ও খন্দকার মােশতাক আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রবাসী সরকার শপথ নিল। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের চারজনকে (আমি, মনি, রাজ্জাক ও তােফায়েল) সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য মুক্তিযােদ্ধা রিক্রুটমেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হলো। ইতিমধ্যে আমরা আমাদের আগের যােগাযােগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলাম। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একজন প্রতিনিধি মেজর জেনারেল সুজন সিং উবান (S S Uban)-এর সহায়তায় আমরা সংগঠিত হতে শুরু করি। দেরাদুনের টাওয়া ও আসামের হাফলংয়ে ‘বিএলএফ’-মুক্তিযােদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা হয়। এভাবে সাত হাজার ‘বিএলএফ’ সদস্যকে আমরা ট্রেনিং দিতে সক্ষম হই। প্রশিক্ষণ শেষে তারা অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং
পৃষ্ঠা: ১৫৩
অন্য সকল মুক্তিযােদ্ধা (এফএফ)-এর সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। নভেম্বরের শেষ নাগাদ ‘বিএলএফ’ ও ‘এফএফ’-এর মিলিত শক্তি সমগ্র বাংলাদেশের শহর ও গ্রাম এলাকায় জনগণকে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়।
ডিসেম্বরের ৪ তারিখ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। মাত্র এগারাে দিনের মাথায় ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর সম্পূর্ণ পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সে যুদ্ধ শেষ হয়। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রমনা রেসকোর্সে (বর্তমানের সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে ৯৫ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত সারাদেশে থানা, মহকুমা ও জেলা পর্যায়ে প্রবাসী সরকারের অধীনে মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা নিজস্ব প্রশাসন চালু রাখে ।
বস্তুত ঐ ২৪/২৫ দিনই প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে দেশ পরিচালিত হয়েছিল। এর আগে বা পরে, আজ পর্যন্ত, আর কখনােই তা হয়নি। মুজিব ভাই ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ দেশে ফিরলেন। ১২ জানুয়ারি তিনি রাষ্ট্রপ্রতির পদে ইস্তফা দিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে নিজেই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তাজউদ্দিনকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ ঘটনাটি ঘটে আমাদের সম্পূর্ণ অমতে। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে আমি মুজিব ভাইকে একটি ১৫-দফা সুপারিশমালা দিই।
১৫-দফা সুপারিশমালা
১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের কোনাে এক সময় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ (বিএলএফ)-এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বৈঠক হয়। বঙ্গবন্ধু আমাদের চারজনকে (সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক ও তােফায়েল আহমেদ) দেশ পরিচালনার বিষয়ে একটি সুপারিশমালা দিতে বলেন। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে আমি ১৫-দফা কর্মসূচির একটি খসড়া তাঁকে দিই । নতুন
পৃষ্ঠা: ১৫৪
রাষ্ট্রটি কীভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত, এ কর্মসূচিতে আমি তা উল্লেখ করেছিলাম। প্রস্তাবগুলাে ছিল নিম্নরূপ :
১. অসম্পূর্ণ সশস্ত্র যুদ্ধ সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায় রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত একটি ‘বিপবী জাতীয় সরকার’ দ্বারা দেশ পরিচালিত হবে। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেওয়া সকল দল ও গ্রুপের সমন্বয়ে গঠিত এ সরকারের প্রধান থাকবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
২. কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হবে সশস্ত্র যুদ্ধের পরীক্ষিত নেতৃত্ব দ্বারা, যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা ধারণ করেন।
৩. বঙ্গবন্ধুর মর্যাদার বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বঙ্গবন্ধু থাকবেন সকল দলের উর্ধ্বে। প্রয়ােজনবােধে তিনি রাজধানীর বাইরে অবস্থান করবেন। তাঁকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির চেতনা বিকাশের ধারা প্রবাহিত হবে।
৪. বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হবে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনার আলােকে, কোনাে দেশের অনুকরণে নয়। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেওয়া সকল দল ও গ্রুপের প্রতিনিধিদের নিয়ে সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হবে।
৫. চিরাচরিত প্রথার সেনাবাহিনী গঠন না করে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায় জাতীয় পর্যায়ে ‘রেভল্যুশনারি (বিপ্লবী) গার্ড বাহিনী গঠন করা হবে। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিক, এফএফ এবং বিএলএফ-সহ মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে এ বাহিনী তৈরি করা হবে। এর সমান্তরাল অন্য কোনাে বাহিনী থাকবে না।
৬. রেভল্যুশনারি গার্ডের মধ্যে থাকবে —
ক. বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী’, যা হবে ‘পিপলস আর্মি’।
খ. কৃষিকাজে সহায়তা দেওয়ার জন্য রেভল্যুশনারি ‘কৃষক ব্রিগেড’।
গ. শিল্প এলাকার জন্য রেভলুশনারি ‘লেবার ব্রিগেড’।
পৃষ্ঠা: ১৫৫
৭. নির্যাতনকারী পুলিশ বাহিনীর বদলে পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সমন্বয়ে ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী’ করা হবে। ‘পুলিশ’ নামটি ব্যবহার করা হবে না।
৮. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলাে আপাতত বন্ধ থাকবে। মুক্তিযােদ্ধা, শিক্ষক-ছাত্রদের নিয়ে ছােট ছােট ‘স্কোয়াড’ তৈরি করে বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্য সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। এক বছরের মধ্যে ৬০ শতাংশ মানুষকে সাক্ষরতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
৯. উচ্চশিক্ষার সুযােগ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। শিক্ষার জন্য ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা হবে। উচ্চ শিক্ষার জন্য গৃহীত ব্যাংকঋণ শিক্ষা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে যােগ দিয়ে পরিশােধের ব্যবস্থা থাকবে।
১০. ব্রিটিশ-পাকিস্তানি আমলের ধারাবাহিকতায় জেলা-মহকুমা- থানায় প্রশাসনের কোনাে ক্যাডার বা গােষ্ঠী’কে জনপ্রশাসনের দায়িত্বে রাখা যাবে না।
১১. সশস্ত্র যুদ্ধের সময় যারা জেলা-মহকুমা-থানা পর্যায়ে ‘কমান্ডার’-এর দায়িত্ব পালন করেছেন, তারাই জনপ্রশাসনের দায়িত্বে থাকবেন।
১২. জনপ্রশাসনে ব্রিটিশ-পাকিস্তানি আদলে প্রথম-দ্বিতীয়- তৃতীয়- চতুর্থ এসব শ্রেণিবিন্যাস থাকবে না। কাজের ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের জন্য যে স্তর হয়, তা অবশ্যই থাকবে।
১৩. সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত হবে ১:৭।
১৪. ‘সমবায় ভিত্তিক অর্থনীতি’ চালু হবে। পরিত্যক্ত
কলকারখানা মুক্তিযােদ্ধা- শ্রমিক- কর্মচারীদের সমবায়ের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। ‘সমবায়’-এর জন্য ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণের ব্যবস্থা করা হবে।
১৫. কেবল ভারত ও রাশিয়ার ওপর নির্ভর না করে চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।
কর্মসূচিটি দেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেটা তাঁর টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দেন। সর্বদলীয় সরকারের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর প্রাথমিক সম্মতি ছিল । তবে তার মনে হয়েছিল, এটির বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।।
পৃষ্ঠা: ১৫৬
তাঁর সঙ্গে আমার এ বিষয়ে আলােচনার সারাংশ –
মুজিব : অন্য কোনাে দল আসবে না। সুতরাং ঐ চিন্তা বাদ দাও।
আমি: কথাবার্তা বলতে হবে সবার সঙ্গে। তােয়াহা (কমিউনিস্ট নেতা মােহাম্মদ তােয়াহা) ভাইকে আমি যেমন করেই হােক ম্যানেজ করবাে। সিরাজ শিকদারকেও আমি আনতে পারবাে।
মুজিব: আমার মনে হয় না এটি সম্ভব হবে। আমার দলের অনেকেই এটি পছন্দ করবে না।
তখনকার গণভবনের সবুজ চত্বরে একদিন সন্ধ্যায় আমার কাঁধে হাত রেখে বঙ্গবন্ধু অনেকক্ষণ হেটেছিলেন। এক পর্যায়ে বলেই ফেললেন, ‘পারলাম না রে, সিরাজ!’ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সকলেই এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করেছিলেন ।
ছাত্রলীগের দ্বিধা-বিভক্তি
স্বাধীনতার আগেই ১৯৭০ সালের ১২ আগস্ট ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সংগঠনের প্রচার সম্পাদক স্বপন চৌধুরী ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ গঠনের যে প্রস্তাব উত্থাপন করেন তা ছাত্রলীগের ভেতরে দুটি ভাগকে স্পষ্ট করে তােলে। দেখা যায় একভাগ স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের পক্ষে, অন্যভাগ কেবল স্বায়ত্তশাসনের দাবিতেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে চায়।
আমরা (আমি, রাজ্জাক, আরেফ) ‘বিএলএফ’কে এমনভাবে সংগঠিত করার উদ্যোগ নিই যাতে তা কোনােভাবেই কোন্দলের শিকার না হয়। বিশেষ করে আসন্ন সশস্ত্র সংগ্রামের দিনগুলােতে এ ধরনের কোন্দল যে প্রাণহানি ঘটাতে পারে, সে সম্পর্কে আমরা সচেতন ছিলাম, আর এ ব্যাপারে আমার সতর্ক দৃষ্টি ছিল। ফলে সফলভাবেই আমরা সেই পর্যায়টি অতিক্রম করি। স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগের দুই জায়গায় দুটি সম্মেলন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই বিভক্তিটা প্রকাশ্য ও চূড়ান্ত রূপ নেয়।
স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগের প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২-এর ২১-২৩ জুলাই। ১৯৬০-এর দশকের শুরু থেকেই ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে একটি প্রগতিশীল রাজনীতির ধারা জন্ম নিয়েছিল। ‘নিউক্লিয়াস’-এর সৃষ্টিও হয় এ প্রগতিশীল ধারার ভেতর
পৃষ্ঠা: ১৫৭
থেকেই। এই ধারাটি মূলত বাঙালিদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে গােপনে ছাত্রলীগ সদস্যদের মধ্যে প্রচারকার্য চালাতাে। এ ধারার আরেকটি লক্ষ্য ছিল ভবিষ্যতের স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামাে কী হবে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে একটি স্পষ্ট ধারণা সৃষ্টি করা। সে সময়ে বিশ্ব জুড়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বেশ শক্তিশালী ছিল। বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকার উপনিবেশগুলােতে যেসব জাতীয় মুক্তি আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছিল তারও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য ছিল সমাজতন্ত্র। ছাত্রলীগের প্রগতিশীল অংশ বিশ্বব্যাপী উপনিবেশবাদ বিরােধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনগুলাের ব্যাপারে খোঁজ-খবর রাখতো ও তাদের সঙ্গে একাত্মতা বােধ করতাে। সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতিপর্বে, যুদ্ধ চলাকালে এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘নিউক্লিয়াস’-এর নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের এই প্রগতিশীল ধারাটি ছাত্রলীগের মূলধারায় পরিণত হয়।
এ সময়ে এ ধারার বিরােধী একটি অতি দুর্বল ধারাও ছাত্রলীগে ছিল যাদের আদর্শ জাতীয়তাবাদেই সীমাবদ্ধ ছিল। অর্থাৎ জাতীয় মুক্তি অর্জনের পরে রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আগের মতােই ঔপনিবেশিক ও পুঁজিবাদী থেকে যাবে এমনটাই তারা চাইতাে।
১৯৭২-এর ছাত্রলীগ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে এই দুই ধারার বিরােধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু যেহেতু নিজে সশস্ত্র যুদ্ধের পুরাে সময়টা পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন, তিনি যুদ্ধের এই সশস্ত্র পর্বটা সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে জ্ঞাত ছিলেন না। এদিকে তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের একমাত্র তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া বাকি নেতাদের সকলেই ছিলেন একেবারে সাবেকী ধরনের রাজনীতির ধারক ও বাহক। রাষ্ট্রীয় চার নীতিতে সমাজতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত হলেও এদের কেউই সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন না। অনেকে ছিলেন এমনকি কট্টর পুঁজিবাদের সমর্থক। দেশ স্বাধীন হওয়ার মুহূর্ত থেকেই শেখ ফজলুল হক মনিও ঐ দলের হয়ে গেলেন।
বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে সশস্ত্র যুদ্ধের সংগঠন ও পরিচালন প্রক্রিয়া এবং তার অগ্রগতির বিবরণ, যদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর বাইরেও ছাত্র- শ্রমিক- কৃষক বিশেষ করে তরুণদের ভূমিকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করতে পারেননি। এ সম্পর্কে তার বাস্তব ও পূর্ণাঙ্গ ধারণা
পৃষ্ঠা: ১৫৮
ছিল না। ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলশক্তিটিকে তিনি কখনােই বুঝতে বা ঠিকমতো মূল্যায়ন করতে পারেননি।
ছাত্রলীগের প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী অংশ আলাদাভাবে তাদের সম্মেলনের আয়ােজন করে। প্রগতিশীল অংশ তাদের সম্মেলনের স্থান নির্ধারণ করে পল্টন ময়দানে। অন্য অংশ রেসকোর্স ময়দানে তাদের প্যান্ডেল খাটায়। উভয় গ্রুপই তখনও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি সমভাবে অনুগত ছিল। উভয় গ্রুপই তাকে তাদের সম্মেলনে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানালে তিনি উভয় গ্রুপকেই তাদের সম্মেলনে যাবেন বলে কথা দেন। সম্মেলনের আগের রাতেও ছাত্রলীগের প্রগতিশীল অংশের নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তায় তিনি জানিয়েছিলেন যে তিনি কোনাে সম্মেলনেই যাবেন না। অন্য গ্রুপকেও তিনি ঠিক একই কথা বলেন। কিন্তু পরদিন সকালে বঙ্গবন্ধু পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের প্রগতিশীল অংশের বিশাল সম্মেলনে উপস্থিত না হয়ে হাজির হলেন রেসকোর্সে কয়েকশত ছাত্রের উপস্থিতিতে ছাত্রলীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের সম্মেলনে। বঙ্গবন্ধুর এই প্রকাশ্য অবস্থান ছাত্রলীগের ভাঙনকে স্থায়ী রূপ দেয়।
একই দিনে দু জায়গায় ছাত্রলীগের দুই অংশের দুটি সম্মেলন অনুষ্ঠানের আগের রাতেও মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার একান্ত আলােচনা হয়। তিনি আমাকে ধারণা দিয়েছিলেন দুই সম্মেলনের কোনােটিতেই তিনি যাবেন না। রবদের সম্মেলনের জন্য আমাকে কয়েক হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “সিরাজ, আমি কমিউনিস্ট হতে পারবাে না।’ একথা বলার সময় তার অভিব্যক্তি থেকে মনে হলাে, তিনি কোনােমতেই রবদের সম্মেলনে যাবেন না। আবার ‘আমি কমিউনিস্ট হতে পারবাে না’—একথার অর্থ এও হতে পারে যে, আমার ও তার রাজনীতি ভবিষ্যতে আর এক পথ ধরে এগুবে না।
রাত দেড়টার দিকে আমি তার বাসা থেকে বের হই। তখন সেখানে আর কেউ নেই। আমি এসএম হলে ফিরে আসি। ভাের পাঁচটার দিকে দৈনিক বাংলা থেকে একজন আমার কাছে এসে বললাে, শেখ সাহেব রেসকোর্সের ছাত্রলীগ সম্মেলনে যাবেন, এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং গভীর রাতে মনিকে তা জানিয়েছেন। অর্থাৎ আমি তার বাসা থেকে বের হবার পর অজ্ঞাত কোনাে কারণে মুজিব ভাই আমাকে
পৃষ্ঠা: ১৫৯
দেওয়া তার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারলেন না। মুজিব ভাই কাউকে কিছু না জানিয়ে বলা যায় নিজেই এই সিদ্ধান্ত নেন। সেদিন পল্টনে ছাত্রলীগ সম্মেলনের নেতৃত্বে ছিলেন আ স ম আবদুর রব আর রেসকোর্সে ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী।
এভাবে দুই জায়গায় দুটি সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছাত্রলীগের দ্বিধাবিভক্তি চূড়ান্ত হয়ে গেল। এ বিভক্তির পরেও আ স ম আবদুর রবের অনুসারী ছাত্রলীগ মুজিব ভাইয়ের প্রতি অনুগত ছিল। ইতিমধ্যে ড. কামাল হােসেনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের নতুন সংবিধান রচিত হলাে। আমরা এ সংবিধানকে ভারত-পাকিস্তান-ব্রিটেনের অনুকরণে রচিত সংবিধান বলে আখ্যায়িত করলাম। বস্তুত এটি ছিলও তাই। স্বাধীনতা সংগ্রামের আকাঙ্ক্ষার কোনাে ধরনের প্রতিফলন এ সংবিধানে ছিল না। তা সত্ত্বেও এ আধাখেঁচড়া ও বিদেশী সংবিধানের অনুকরণেতৈরি দলিলকেই আমরা “A bad constitution is better than no constitution’ (বাংলা প্রবাদে যেমন বলা হয় ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালাে’) হিসেবে গ্রহণ করি।
সে সময় আমাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের জন্য ১ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল থেকে ‘গণকণ্ঠ’ নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হতাে। পত্রিকাটি স্বাধীনতা যুদ্ধের আদর্শ-উদ্দেশ্য ও চেতনা ধারণ করে পাঠক মহলে, বিশেষ করে তখনও যুদ্ধের উত্তাপে টগবগ করতে থাকা যুব সমাজের মধ্যে যে অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছিল তা কেবল সে সময়ে যারা এটি দেখেছেন তারা ছাড়া আর কারও পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়।
একটি পত্রিকা কী করে একটি জাতির সুপ্ত আশা-আকাক্ষার শিখা হয়ে উঠতে পারে গণকণ্ঠ ছিল তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের মাধ্যমে পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রায় আড়াইশ সাংবাদিক ও প্রেসকর্মী এর ফলে বেকার হয়ে পড়েন।
১৯৭২-এর জানুয়ারিতে বিভক্তির পর সারা দেশে ছাত্রলীগের দুটি সংগঠন পরস্পর বিরােধী ও সংঘাতমূলক অবস্থানে চলে যায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে দুই গ্রুপের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষও ঘটতে থাকে। ১৯৭৩-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে রবপন্থী ছাত্রলীগের আ ফ ম মাহবুবুল হকের নেতৃত্বাধীন প্যানেলের
পৃষ্ঠা: ১৬০
বিপুল ভােটে জয়লাভের সম্ভাবনা দেখে হলে হলে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করা হয়। অভিযােগ করা সত্ত্বেও মুজিব ভাই এ ব্যাপারে কোনাে ব্যবস্থা নিলেন না। এ সময় শ্রমিকদের নিয়ে ‘লাল বাহিনী’ গঠন করে তাদেরকে অত্যাচারের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হলাে। মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কিছুটা শীতল হলেও তখনও পর্যন্ত আমাদের মধ্যে নিয়মিত যােগাযােগ ছিল। আমি তাঁকে নিরপেক্ষ থাকার জন্য অনুরােধ করি। মাঝে মধ্যে মনে হতাে তিনি বুঝি বা নিরপেক্ষ। আবার দেখতাম ছাত্রলীগের এক পক্ষকে (নূরে আলম সিদ্দিকী) শর্তহীন আশীর্বাদ দিয়ে যাচ্ছেন।
আমি মুজিব ভাইকে বারবার কৃষক সংগঠন গড়ে তােলার জন্য অনুরােধ করি। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে সারা দেশে ‘কৃষক ব্রিগেড’ গড়ে তােলা হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশেও তিনি ‘কৃষক ব্রিগেড’ গড়তে রাজি ছিলেন। একদিন হঠাৎ সংবাদপত্রে দেখলাম আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে প্রেসিডেন্ট করে কৃষক লীগ গঠন করা হয়ে গেছে । আমি মুজিব ভাইকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ‘এটা মনি করেছে।’ আমি তার এ কথাটি গ্রহণ করতে পারলাম না। মনে হলাে আমাদের পথ আলাদা হয়ে যাচ্ছে। অনন্যোপায় হয়ে আবদুল মালেক শহীদুল্লাহকে সভাপতি ও হাসানুল হক ইনুকে সাধারণ সম্পাদক করে আমরা পৃথক কৃষক লীগ গঠন করি।
এদিকে ১৯৭২-এর অক্টোবরে শেখ মনিকে সভাপতি ও মােস্তফা মােহসীন মন্টুকে সাধারণ সম্পাদক করে ‘যুবলীগ’ গঠিত হয়। আমরা ‘নিউক্লিয়াস’-এর তিন সদস্য (আমি, রাজ্জাক ও কাজী আরেফ) এ নিয়ে আলােচনায় বসি। তখন আর ‘বিএলএফ’ কার্যকর ছিল না। দীর্ঘ সময় ধরে আমরা আলােচনা করলাম। এ জটিল পরিস্থিতিতে কী করণীয় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে দেখলাম যে, আমাদের ‘নিউক্লিয়াস’-এরই সদস্য আবদুর রাজ্জাক আমাদের চাইতে শেখ মনির গ্রুপের প্রতি অধিক সহানুভূতিসম্পন্ন এবং মুজিব ভাইয়ের প্রতি আনুগত্যে একেবারে অন্ধ। ১৯৬২-তে ‘নিউক্লিয়াস’ গঠনের পর থেকে দীর্ঘ ১০ বছর আমাদের তিনজনের মধ্যে কখনাে কোনাে বিষয়েই মতপার্থক্য ঘটেনি। এই প্রথম আমাদের মধ্যে ভিন্নমত দেখা গেল।
পৃষ্ঠা: ১৬১
এরকম একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় রাজ্জাকও উদ্বেগ প্রকাশ করলাে। আমি ও আরেফ আমরা দুজনও “নিউক্লিয়াস’-এর মধ্যে এভাবে ভিন্নমত দেখা দেওয়াতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। বহু আলােচনার পর আমরা রাজ্জাককে মুজিব ভাইয়ের পক্ষে থাকার এবং রাজনীতিতে পুরোপুরিভাবে সক্রিয় হবার ব্যাপারে অনুমতি দিলাম। একই সময়ে আমরা এই সিদ্ধান্তও নিলাম যে, পরস্পর বিরােধী শিবিরে অবস্থা করলেও আমাদের দুজনের সঙ্গে রাজ্জাকের সুসম্পর্ক বজায় থাকবে। মনির নেতৃত্বে যুবলীগ গঠিত হওয়াতে আমাদেরও বিকল্প সংগঠন গড়ে তােলা ছাড়া উপায় ছিল না। এর প্রধান দুটি কারণ। প্রথমত, সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসা হাজার হাজার ‘বিএলএফ’ সংগঠক, কর্মী ও সদস্য সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে এবং শেষ পর্যন্ত তারা মনির যুবলীগের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয় কারণটি ছিল আরও জটিল । আমি আওয়ামী লীগের কোনাে পদে ছিলাম না। এমনকি সদস্যও নয়। সে অবধি রাজনীতিতে আমার ভূমিকা এবং সশস্ত্র যুদ্ধে আমাদের অংশগ্রহণ আওয়ামী লীগ বা কোনাে রাজনৈতিক দলের পক্ষ হয়ে ছিল না। পরিস্থিতি যখন এ রকম তখন যে সমস্যাটি সবচেয়ে প্রকট হয়ে দেখা দিল তা হলাে, আমাদের পক্ষের হাজার হাজার কর্মী-সংগঠক কী করবে? আদর্শগত দিক থেকে মনি এবং আমি দুটি আলাদা স্রোতের মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই মনি মুজিব ভাইয়ের পক্ষে থাকবে। অথবা বলা যায়, মুজিব ভাই মনির পক্ষে থাকবেন।
আমার চিন্তায় তখন যে বিষয়টি প্রাধান্য পেল তা হচ্ছে, আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে একটি যুব সংগঠন গড়ে তােলা যায় কিনা তা দেখা। তা না হলে আমাদের হাজার হাজার সংগঠক, কর্মী ও সমর্থকরা কোথায় যাবে? তারা কি আওয়ামী লীগ করবে? তা তাে সম্ভব নয় । তাহলে তাদের জন্য একটি রাজনৈতিক স্পেস (স্থান) সৃষ্টি করা খুবই জরুরি এবং সেটা হতে পারে একটি নতুন রাজনৈতিক সংগঠন।
সাধারণভাবে এবং বিশেষ করে নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের দিনগুলােতে আওয়ামী লীগ নেতাদের রাজনৈতিক চরিত্র ও নৈতিকতার যে চিত্র আমাদের সংগঠকরা দেখেছে, তাতে তাদের পক্ষে আওয়ামী লীগ করার কোনাে প্রশ্নই আসে না। মুজিব ভাইও নিরপেক্ষতা বজায়
পৃষ্ঠা: ১৬২
না রেখে মনি ও নূরে আলম সিদ্দিকীর দিকে ঝুঁকতে থাকেন। মােটকথা, নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের পর মাঠ পর্যায়ে তখন অন্য একটি রাজনৈতিক -দার্শনিক পরিস্থিতি দৃশ্যমান হয়ে উঠলাে।
সআরাদেশে তখনকার সাংগঠনিক পরিবেশে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অব্যবহিত নিচের স্তরের কর্মী-সংগঠকদের শতকরা আশি ভাগই ছিল আ স ম আবদুর রবের সমর্থক। আওয়ামী লীগ থেকে সম্ভবত তাদের হাই কমান্ড মনে করতে থাকলো যে, ঐ সময় সারা দেশে সকল স্তরের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে যারা আসবে তাদের প্রায় সবাই হবে রব গ্রুপের। এমন অবস্থা হােক, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কোনভাবেই সেটা চাননি। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম কয়েক মাসের মধ্যেই রব গ্রুপের মেধাসম্পন্ন অনেক সংগঠক সশস্ত্র গ্রুপের হত্যাকাণ্ডের শিকার হলাে। সে সময়ের প্রশাসন সশস্ত্র গ্রুপগুলােকে প্রচ্ছন্ন বা সরাসরি সহায়তা দান করতে।
এ জটিল পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় নির্ধারণ করার জন্য আমু ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’-এর উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলােচনার প্রয়ােজন বােধ করলাম। দীর্ঘ আলােচনার পর রাজনৈতিক দল গঠন করা ছাড়া ঐ পরিস্থিতি মােকাবেলার আর কোনাে উপায় আছে বলে আমাদের মনে হলাে না। নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে তােলার বিষয়ে আমি ও আরেফ একমত হই। কৌশল হিসেবে এ ব্যাপারেও আমরা একমত পােষণ করি যে, আমাদের নবগঠিত রাজনৈতিক দল কোনােভাবেই মুজিব বিরােধী ভূমিকা নেবে না। তবে রাজনৈতিকভাবে এ দল আওয়ামী লীগের বিরােধী হবে।
আদর্শগত দিকটি নিয়ে আলােচনার পর আমরা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকে দলের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করলাম। সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জেগে ওঠা একটি জাতি বা জনগােষ্ঠীর সমগ্র জনগণকে যাতে শ্রেণিশােষণের হিংস্রতার মুখে পড়ে থাকতে না হয় তার জন্য আমরা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে আমাদের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিই। রবপন্থি ছাত্রলীগ ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে সুসংগঠিত হতে থাকে। এরপর প্রশ্ন দেখা দেয়, নতুন রাজনৈতিক দলটিকে কোন আদলে দাড় করানাে যায়।
পৃষ্ঠা: ১৬৩
অতীতে রাজনৈতিক দলগুলাে যেভাবে গড়ে উঠেছে, সে পুরানাে সাংগঠনিক ও আদর্শিক চরিত্র বজায় রেখে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সদ্য বেরিয়ে আসা বাংলাদেশের বিরাট যুবশক্তিকে নতুন কোনাে রাজনৈতিক সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ করা যাবে না। এছাড়া, সেই একই সশস্ত্র সংগ্রামের কারণে জনগণের বিভিন্ন অংশ নিম্নোক্তভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, এই পরিবর্তিত বাস্তবতাও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। যেমন:
১. যুব সমাজ, যারা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল শক্তি। রাজনীতি সচেতন আদর্শবাদী দেশপ্রেমিক মুক্তিযােদ্ধারা এর অন্তর্ভুক্ত।
২. নিয়মিত সৈনিক, যারা স্বাধীনতার সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছে।
৩. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা।
৪. জনপ্রিয় এবং কলুষমুক্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
এ চার ক্যাটাগরি থেকে ছয়জনকে নিয়ে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’- এর আহ্বায়ক কমিটি ঘােষণা করা হয়। মেজর জলিল ও আ স ম আবদুর রব হন সে কমিটির যুগ্ন আহ্বায়ক । আহ্বায়ক কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন শাজাহান সিরাজ, সুলতান উদ্দিন আহমদ, বিধান কৃষ্ণ সেন, নূরে আলম জিকু ও রহমত আলী (পরে তিনি আওয়ামী লীগে ফিরে যান)। যুবলীগ গঠনের পর মাত্র চার-পাঁচদিন সময়ের মধ্যে এর চাইতে ভিন্ন কিছু করা সম্ভব ছিল না। আমরা ভাবলাম, কিছু দিনের মধ্যে সম্মেলন অনুষ্ঠান করে এ আহ্বায়ক কমিটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দলে রূপান্তর করা যাবে, অর্থাৎ তার জন্য প্রয়ােজনীয় সময় আমরা পাব।
জাসদের আদর্শ
অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়ে কী চরিত্র নিয়ে নতুন রাজনৈতিক দলটি সংগঠিত হতে যাচেছ সে চিন্তাভাবনা আমাকে আলােড়িত করে। আমি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি ।
১. যে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দেশ স্বাধীন হলাে সে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ দলের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে থাকতে হবে ।
পৃষ্ঠা: ১৬৪
২. জাতীয়তাবাদকে ধারণ করার পাশাপাশি আমাদেরকে সমাজতন্ত্রের অভিমুখে নিজেদের চালিত করতে হবে।।
৩. বাংলাদেশের জনগণের অভ্যন্তরীণ নানা পার্থক্য ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যগুলােকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
৪. সদ্য সশস্ত্র সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসা যুবসমাজ স্বভাবতই হবে স্বাধীনচেতা। সেই যুব সমাজকে প্রধান শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেই দলকে সংগঠিত করতে হবে।
৫. আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে এ সংগঠন যাতে কোনাে বিশেষ দেশ বা শক্তির ক্রীড়নকে পরিণত না হয়, তাও বিবেচনায় রাখতে হবে।
উপরোক্ত পাঁচটি বিষয়কে প্রধান শর্ত হিসেবে বিবেচনা করে সারা দেশে গড়ে উঠতে লাগলাে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা ‘জাসদ’-এর সংগঠন।
এ সময় কোনাে কোনাে মহল ‘জাতীয় সমাজতন্ত্র’ কথাটার সঙ্গে নাৎসিদের ‘ন্যাশনাল সােস্যালিজম’-এর মিলের উল্লেখ করে নতুন এই দলের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে। তবে তাদের সে অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই নবগঠিত এ দলটি জনগণের মধ্যে বিপুল আগ্রহ এবং যুবসমাজের মধ্যে ব্যাপক আলােড়ন সৃষ্টি করে। সে সময়কার প্রতিষ্ঠিত দলগুলাে, বিশেষ করে অধ্যাপক মােজাফফর আহমদের নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) সরকারকে নিঃশর্ত সমর্থন দিচ্ছিল। অন্যদিকে সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি সরকারের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়ােগের চেষ্টা করছিল। জাসদ ও সর্বহারা পার্টির রাজনৈতিক কর্মসূচি সরকার ও আওয়ামী লীগকে ব্যতিব্যস্ত করে তােলে । জাসদ মূলত হরতাল বা ধর্মঘটের কর্মসূচি দিয়ে এবং সর্বহারা পার্টি সশস্ত্র উপায়ে সরকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলে।
মজিব ভাইয়ের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও কিছু কিছু ভুল সিদ্ধান্তের সুযােগ নিয়ে তাঁরই দলের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা একটি গােষ্ঠী সুকৌশলে সেনাবাহিনীর একাংশকে কাজে লাগিয়ে তাকে ও সে-সময় বিদেশে থাকা তার দুই কন্যা বাদে পরিবারের আর সবাইকে হত্যা
পৃষ্ঠা: ১৬৫
করে। এভাবে মুজিব ভাইকে সরিয়ে তার দলই খন্দকার মােশতাক আহমেদের নেতৃত্বে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে শাসকশ্রেণির মধ্যে একইভাবে ক্ষমতার পালা বদল চলতে থাকে। পঁচাত্তরের সেই বিয়ােগান্তক হত্যাকাণ্ডের সময় জাসদ নেতৃত্বের সবাই ছিলেন কারাগারে। এর আগে দলটির হাজার হাজার কর্মী, সংগঠক ও সমর্থক রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারের শিকার হয়।
পাকিস্তান থেকে ফেরত আসার পর শেখ মুজিবুর রহমান নামের যে মানুষটি—তার জন্য কোনাে পদ বা বিশেষণের প্রয়ােজন ছিল না। গান্ধী ও মাও সে তুং-এর মতােই তার দেশের মানুষের কাছে তাে বটেই, বিশ্বের কাছেও তিনি ছিলেন একজন অতি মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী। অথচ দুঃখজনকভাবে প্রধানমন্ত্রী হওয়াটাই তাঁর কাছে বড় হয়ে দেখা দিল। এ বিষয়ে আমি তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ আমাকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চায়।’
যেদিন তিনি গণভবন (সুগন্ধা) ছেড়ে ৩২ নম্বরকে প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর ও পরে রাষ্ট্রপতির বাসভবন হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন, তা যে নিরাপত্তার দিক থেকে একেবারেই দুর্বল—এ কথা আমি তাকে বারবার বলার পরও, তিনি তা অগ্রাহ্য করলেন।
মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎ তার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাসখানেক আগে। বাকশাল গঠন প্রশ্নে আমি কখনােই তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারিনি। সম্ভবত তিনি বাকশালকে তার রাজনীতির নতুন কৌশল হিসেবেই নিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে ‘জাতীয় সরকার’ গঠন আর ১৯৭৫-এ ‘বাকশাল’ গঠন যে এক কথা নয়, তা তিনি সম্ভবত অনুধাবন করতে পারেননি।
শেষ সাক্ষাতে তিনি আমাকে ভারতে চলে যেতে বললেন। তখন বাকশাল কায়েম হয়েছে। আমি তাঁর কাছে ঢাকার সর্বমহলে সামরিক শাসনের গুঞ্জনের কথা তুলতেই তিনি বললেন, ‘আমি জানি, ওটা আমার বিরুদ্ধে নয়। ওটা তাজউদ্দীনদের বিরুদ্ধে।’ এটি শুনে আমি নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি আরও বললেন, ‘বেশি কিছু হলে তারা
পৃষ্ঠা: ১৬৬
আমাকে রেখেই যা করার করবে। আর তার চেয়ে বেশি খারাপ কিছু হলে আমাকে মনপুরায় নিয়ে রাখবে।’
আমার মনে হলাে, এ কী শুনছি?
১৯৭৫-এর আগস্টের বা দুই তারিখে আমি ভারতে গেলাম। এরপরেই ঘটলাে দুঃখজনক ১৫ আগস্ট। বেলা ১১টার দিকে রেডিওতে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা শুনলাম। তখন আমি কোলকাতায়। ঘটনাটিকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারিনি। তার পরিণতি রাজনৈতিকভাবে না হয়ে, এভাবে যে মর্মান্তিকভাবে হলাে, আর সেটাও পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ-এ সত্যটি মেনে নিতে আমার খুবই কষ্ট হয়েছে। কারাে রাজনৈতিক বিরােধিতা আর তাকে সপরিবারে হত্যা দুটো এক জিনিস নয়।
ভারতে আমার ভিসার মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ায় আমি ভিসার মেয়াদ বাড়ানাের আবেদন করেছিলাম। তার জন্য পাসপাের্ট জমা দিই। পাসপাের্ট জমা দেওয়ার ১৫ মিনিট পরই আমাকে অফিসের ভেতরে ডেকে নিয়ে যায়। একজন বড় অফিসারের সামনে বসতে দেওয়ার পর তিনি আমাকে বললেন, আপনার তাে পাসপাের্ট বাতিল করা হয়েছে। আমি বিষয়টি বুঝতে না পারায় অফিসার বললেন, আপনার তাে পাসপাের্ট এখন বৈধ না। কারণ আপনাকে পারসােনা নন-গ্রাটা (অবাঞ্ছিত ব্যক্তি) ঘােষণা করা হয়েছে। আমি জানতে চাইলে আরও বললেন, ‘বৈধ পাসপাের্ট না হলে ভিসা দেওয়া যায় না। হয় আপনি ভারত ছেড়ে খুব তাড়াতাড়ি চলে যান, নতুবা নতুন পাসপাের্ট সংগ্রহ করুন।’ আমি দিল্লিতে আমাদের হাইকমিশন অফিসে যােগাযােগ করতেই বলা হলাে, ১১ আগস্ট আমার পাসপাের্ট বাতিল করা হয়েছে।
পরবর্তী সময়ে জিয়ার শাসনামলেও সরকারি দমননীতির পাশাপাশি জাসদ এক রাজনৈতিক কূটকৌশলের শিকার হয়। এ সময় দল ভাঙাভাঙির সরকারি ষড়যন্ত্রে জাসদ বিভক্ত হয় । আমি নিজে কখনাে কোনাে রাজনৈতিক দলের সদস্য হইনি। এটি আমার ঘােষিত নীতি। তবে আমি জেলে থাকার সময়
পৃষ্ঠা: ১৬৭
(১৯৭৯-‘৮১) একবার জাসদ আমাকে তাদের সংগঠনভুক্ত করে।কিন্তু জেল থেকে বেরিয়ে আমি পদত্যাগ করে আমার অদলীয় রূপ বজায় রাখি।
ছাত্রলীগের বিভক্তির মধ্য দিয়ে নতুন রাজনীতির যাত্রা শুরু
জাসদ গঠনের অব্যবহিত পরের কয়েকমাস সময় ছিল দেশের জন্য খুবই ঘটনাবহুল। দলীয়ভাবে সরকারের কিছু কিছু কার্যক্রম দেশে দারুণ অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করে। পরিত্যক্ত বাড়িঘর দখল, ব্যবসা- বাণিজ্যের নামে লাইসেন্স-পারমিট নিয়ে তা বিক্রি করা ছিল ক্ষমতাসীনদের কাজ। সে সময়ে সরকার সমর্থক ছাত্রলীগকে ‘মুজিববাদী ছাত্রলীগ’ বলা হতাে এবং ছাত্রলীগের উভয়গ্রুপের কর্মীদের মধ্যে প্রায়ই মারামারি হতাে। জাসদ নেতৃবৃন্দকে জেলে না পুরে বরং জাসদ সমর্থক বিরাট জনগােষ্ঠীকে রক্ষীবাহিনী দিয়ে নির্যাতন, হয়রানি ও অত্যাচারের মাত্রা ক্রমে বাড়তে থাকে। সরকার ও সরকারি দলের কৌশল ছিল জেলা- মহকুমা পর্যায়ের জনপ্রিয় জাসদ নেতৃবৃন্দকে আঘাত না করে কর্মী ও সমর্থকদের ওপর চাপ প্রয়ােগ করে তাদেরকে নিজেদের দলে ভেড়ানাে। এ কৌশল প্রয়ােগ করে তারা অনেকখানি সফলও হতে শুরু করেছিল।
আমরা তখন জাসদ রাজনীতিকে এককেন্দ্রিকতা থেকে সরিয়ে একাধিক অংশে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঠিক করলাম, জাসদ হবে প্রকাশ্য রাজনীতির ধারক। জাসদ রাজনীতির মূল নিয়ামক শক্তি হিসেবে ১৯৬২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’-এর সঙ্গে যুক্ত প্রধান প্রধান ব্যক্তিদেরকে গােপনে সংগঠিত করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে সারাদেশ থেকে বেছে বেছে সত্তর-আশিজনকে নিয়ে ‘সেন্ট্রাল অর্গানাইজিং কমিটি’ (সিওসি) গঠন করা হলাে। এছাড়া গােপনভাবে কাজ করা ও আদর্শিক দিক-নির্দেশনার জন্য এগারজনের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন এবং ‘লড়াই’ নামে একটি প্রকাশনার মাধ্যমে সংগঠনের প্রকাশ্য ও গােপন কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি ঘটানাের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। শামসুদ্দিন পেয়ারাকে ‘লড়াই’ সম্পাদনার দায়িত্ব দেয়া হয়।
পৃষ্ঠা: ১৬৮
এ সময় তৃণমূল পর্যায়ে সরকার দলীয় কর্মী ও রক্ষী বাহিনীর নির্যাতনের মুখে জাসদের অনেকের মধ্যেই আওয়ামী লীগে যােগদানের প্রবণতা দেখা দেয়। সে অবস্থায় জাসদকে সংগঠিত রাখার লক্ষ্যে আমরা কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করি। যার অন্তর্ভুক্ত ছিল আওয়ামী লীগকে ব্যস্ত রাখা, পাকিস্তানপন্থি অযােগ্য আমলাদের পরিচয় জনগণের সামনে প্রকাশ করা, দলের কিছু শক্ত ঘাঁটি তৈরি করা, পর্যায়ক্রমে ঢাকাসহ জেলা ও মহকুমাগুলােয় প্রাত্যহিক আন্দোলনের ধারা সৃষ্টি করা। তারপর এ দুইয়ের সমন্বয়ে অর্থাৎ শক্ত ঘাঁটি ও শহরে উপর্যুপরি আন্দোলনের ধাক্কা সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। এ কৌশলের অংশ হিসেবে ‘সিওসি’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা শহরের বাইরে সারা বাংলাদেশে ঘাঁটি আকারে গড়ে তােলার জন্য ৪০টি স্থান নির্দিষ্ট করা হয়। এ জন্য প্রয়ােজনীয় নির্দেশনা ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হয়। এ ব্যাপারে প্রস্তুতিও সমানভাবে চলতে থাকে।
আওয়ামী লীগ সরকারের অনিয়মের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য জনসভা ও মিছিলকে প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ উদ্দেশ্য সামনে রেখে জাসদ-এর নেতৃত্বে সারাদেশে জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ে নিয়মিত সভা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হতে থাকে। ১৯৭৪-এর অক্টোবর-নভেম্বরে আওয়ামী লীগ সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার সময় নির্ধারণ করে আন্দোলনের এ পর্যায়ে ১৭ মার্চ ১৯৭৪ ঢাকায় বড় আকারে জনসভা করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সেদিন কর্মসূচি অনুযায়ী পল্টনে বিরাট জনসভা শেষে মেজর জলিল ও আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে একটি মিছিল মন্ত্রিপাড়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাসার সামনে উপস্থিত হয়। মিছিলটি ছিল একেবারেই শান্তিপূর্ণ। অথচ কোনাে রকম উস্কানি ছাড়াই পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী সে মিছিলে বেপরােয়াভাবে গুলিবর্ষণ শুরু করে। গুলিতে জাসদ-এর এগারজন কর্মীর মৃত্যু ঘটে। মেজর জলিল ও আ স ম আবদুর রব গ্রেফতার হন। রক্ষীবাহিনী, পুলিশ ও বিভিন্ন বাহিনীর এই
পৃষ্ঠা: ১৬৯
সংঘবদ্ধ আক্রমণ সহ্য করা নিরস্ত্র কর্মীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। জাসদ কর্মী ও সমর্থকরা এক ধরনের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থার মধ্যে পতিত হয়। আন্দোলনে ভাটা পড়ে। এ অবস্থায় সরকার পদত্যাগের বাধ্য করার আন্দোলন-কর্মসূচি পরিবর্তন করা হয়।
গ্রেফতারের বাইরে থাকা নেতৃবৃন্দ অতঃপর লােকচক্ষুর আড়ালে অর্থাৎ গােপন অবস্থানে (আন্ডারগ্রাউন্ড) চলে যান। প্রকাশ্য রাজনীতি সীমিত হয়ে আসতে থাকে। দলের তরফে এ সময় গােপন রাজনীতির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। জেলা ও মহকুমা শহরগুলােতে ছাত্রদের মধ্যে জাসদের আদর্শকে কেন্দ্র করে কর্মপরিধি বাড়ানাে হয়। শ্রমিকদের সমর্থনের জন্য তাদের মধ্যেও গােপন রাজনীতি অব্যাহত রাখা এবং দ্রুততার সঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
গ্রাম পর্যায়ে কৃষি-মজুর ও কৃষকদের সমর্থন লাভের জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এ ‘স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’র কাজ ছিল গ্রামের গরিব কৃষককে জমিজমার কাজে সহায়তা করা। কীভাবে চাষাবাদ করলে গরিব ও প্রান্তিক চাষীরা তাদের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে পারবে এবং মধ্যস্বত্বভােগীদের দৌরাত্ম থেকে সাধারণ কৃষকরা রক্ষা পেতে পারে তার উপায় খুঁজে বের করা। ‘সিওসি’ পর্যায়ে বিশেষ উপায় উদ্ভাবন করা এবং তা যেন কার্যকর করা যায় তার ব্যবস্থা করা। এর ফলে জাসদের পক্ষে গ্রামের কৃষক ও ক্ষেত মজুরদের সমর্থন বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষ করে ক্ষেতমজুর, ছােট কৃষক এবং বর্গাচাষীদের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কাজের ফলে জাসদের রাজনীতির প্রতি তাদের আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছিল। সে কারণে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যদের নির্যাতন করা হয় ও বিভিন্ন অজুহাতে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা শুরু হয়। বগুড়া, পাবনা, রংপুর, যশাের, খুলনা, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও নােয়াখালীতে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী সদস্যরা এই ধরনের অত্যাচারের শিকার বেশি হয়। এ সময় কোনাে কোনাে স্থানে রক্ষী বাহিনীর সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যদের মুখােমুখি সংঘর্ষও হয়। সে সময় আত্মরক্ষার জন্যই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’ কোথাও কোথাও রক্ষীবাহিনীর কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয় এবং তারা তিনটি থানার (মাদারীপুরের
পৃষ্ঠা: ১৭০
রাজৈর, টাঙ্গাইলের ঘাটাইল ও বগুড়ার ধুপচাচিয়া) অস্ত্র লুট করে। মাদারীপুরে শাহজাহান খানের নেতৃত্বে এই থানা লুট হয়। এছাড়াও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী বাহিনী’ চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও বগুড়ার ধুপাচিয়া থানার কয়েকজন ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়ি থেকে টাকা আদায় করেছিল । সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ‘স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’ রুখে দাঁড়ানাের কারণেও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর বহু সদস্যকে রক্ষীবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়।
এ পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রশাসনের কাছে ‘গণবাহিনী’ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এটি ‘বিপ্লবী গণবাহিনী’ নামে পরিচিত হতে থাকে, যদিও “সিওসি’ অথবা জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটি কখনও এ নামের কোনাে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেনি কিংবা কাউকে তা করার অনুমতি দেয়নি।
‘গণবাহিনী’র নামে সে সময়ে নানা ধরনের সত্য-মিথ্যা রটনা ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৬-এর সেপ্টেম্বরে সিওসির শেষ মিটিংয়ে (ঢাকায় সাইদ ভাইয়ের বাসায়) ‘গণবাহিনী’র কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বাস্তবে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কার্যক্রমকেই গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ ‘গণবাহিনী’র কার্যক্রম বলে মনে করতাে। এটি ছিল জাসদ সম্পর্কিত গণবিভ্রান্তির একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সিওসির কোনাে রকম অনুমােদন ছাড়াই এবং তাদের অজান্তেই বিচ্ছিন্নভাবে ‘স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’র কিছু কিছু সদস্য কোথাও কোথাও কিছু কিছু অঘটন ঘটিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে থানা আক্রমণ ও বিত্তশালীদের কাছ থেকে জবরদস্তিমূলক অর্থ আদায়।
‘গণবাহিনী’র কার্যক্রম স্থগিত হওয়ার কিছুদিন আগে ঢাকা শহরে ‘গণবাহিনী’র নাম ব্যবহার করে কিছু কর্মকাণ্ড এই শহরের অধিবাসীদের মধ্যে এক আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ১৯৭৫- এর নভেম্বর নাগাদ এসব ঘটনা ঘটানাে হয়েছিল, যার সঙ্গে কেন্দ্রীয় জাসদ বা সিওসি’র কোনাে যােগাযােগ ছিল না। যেমন : হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিস্ফোরণ, বায়তুল মােকাররমে সাইকেল বােমা, কয়েকটি বাসে যাত্রী নামিয়ে দিয়ে আগুন লাগানাে, জিয়াউল আবেদিনকে গােয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট সন্দেহ করে ‘সিওসি’র
পৃষ্ঠা: ১৭১
অনুমােদন ছাড়া হত্যা করা। ২৬ নভেম্বর ভারতীয় হাইকমিশনানের ওপর সশস্ত্র আক্রমণসহ বেশ কয়েকটি ঘটনাও এভাবেই ঘটেছিল। এসব কোনাে ঘটনাই “সিওসি’কে জানিয়ে বা তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হয়নি। আসলে অতিউৎসাহী কিছু যুবক নিজেদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণে ‘গণবাহিনী’র নাম ব্যবহার করেছিল। ভারতীয় হাইকমিশনে অভিযানের ব্যাপারে কোনাে কেন্দ্রীয় অনুমােদন যে ছিল না শুধু তাই নয়; যারা সেই হামলা করেছিল তাদের আট-দশজনের বাইরে আর কেউ এ বিষয়ে কিছু জানতােই না।
বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা
গণঅভ্যুত্থানের পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়ায় আমরা রাজনীতির ভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করি। এর মধ্যে প্রধান হলাে, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ‘বিপ্লবী সৈনিক’ সংস্থা গড়ে তােলা। ১৯৭৩-এর মাঝামাঝি থেকে জাসদ সভাপতি মেজর জলিলের নেতৃত্বে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের প্রায় সব ইউনিটে এবং বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সংগঠন
গড়ে ওঠে।
ঢাকার চারপাশে প্রায় ৪০টি স্থানে ঘাঁটি গঠন এবং ঢাকাসহ জেলা ও মহকুমা শহরে গণবিস্ফোরণমূলক আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারের পতন ঘটানাের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবার পর ক্ষমতা দখলের ভিন্ন একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সেটি হলাে, সেনাবাহিনীর মধ্যে ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র নেতৃত্বে সিপাহীদের অভ্যুত্থান এবং যুগপভাবে সে অভ্যুত্থানের সমর্থনে ঢাকাসহ শহর এলাকায় ছাত্র-যুবক এবং শ্রমিকদের গণঅভ্যুত্থান ঘটানাে। এভাবে ছাত্র ও শ্রমিকদের গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা দখল করা।
ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে পরিচালিত আমাদের এ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য ছিল ৩ নভেম্বর খালেদ মােশারফের নেতৃত্বে সংঘটিত সেনাঅভ্যুত্থান ও তার মাধ্যমে সামরিক বাহিনীতে তাঁর একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার প্রতিক্রিয়ায় যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল, সেই সুযােগকে কাজে লাগানাে।
পৃষ্ঠা: ১৭২
কর্ণেল আবু তাহেরের ওপর এ অভ্যুথানের নীলনকশা প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সে লক্ষ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য ৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় ‘সিওসি’ র একটি বৈঠক বসে। সেখানে কর্ণেল তাহের তার পুরো পরিকল্পনাটি তুলে ধরেন। আলােচনার শেষ পর্যায়ে জিয়াউর রহমানের অবস্থান কী, এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি ইংরেজিতে বলেন “He we will be at my knees” (সে আমার হাঁটুতে পড়ে থাকবে।) এরপর আমি পরিকল্পনা অনুযায়ী অভ্যুত্থান ঘটানাের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কমিটিকে পরামর্শ দিই এবং কমিটি তা সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে। সভার শেষে বিদায়ের সময় আমি কর্নেল তাহেরকে বললাম, ‘কোনাে অবস্থায় যেন এটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানে পরিণত না হয়।’ তিনি বললেন, ‘It will happen right at one O’clock.’ (রাত ঠিক ১টায় এটি ঘটবে)।
অভ্যুথানের পর ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম যে কথাটি ঘােষণা করা হলাে তা ছিল, “বাংলাদেশের বীর বিপ্লবী জনগণ, ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ ও ‘বিপ্লবী গণবাহিনীর নেতৃত্বে বাংলাদেশে সিপাহী-জনতার বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা হয়েছে। জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয়েছে।’ বাংলাদেশ বেতার তখন শাহবাগে। সেখান থেকে শামসুদ্দিন পেয়ারা টেলিফোনে আমার নির্দেশ মতাে এ ঘােষণাটি লিখে তা স্বকণ্ঠে বেতারে প্রচার করে।।
এরই প্রতিক্রিয়া হিসাবে সারাদেশের বেশ কয়েকটি জেলায় পুলিশ, আনসার ও বিডিআর সদস্যরা গণবাহিনীর নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। কয়েক ঘণ্টা বিলম্বে হলেও ঢাকা শহরে ছাত্রদের এবং ঢাকার আশেপাশে সৈনিকদের মিছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে আসতে থাকে। সিওসি হাই কমান্ডের সিদ্ধান্ত ছিল জিয়াউর রহমান ও কর্ণেল তাহেরের সঙ্গে বিপ্লবী সৈনিকরা শহীদ মিনারে এসে ছাত্র-শ্রমিকদের সঙ্গে মিলিত হবে। সেখানে ‘কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল’ গঠন হবে। কাউন্সিলের পক্ষ থেকে সৈনিকদের প্রস্তাবিত ১২-দফা মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে। এবং কমান্ড কাউন্সিলের পরিকল্পনা অনুযায়ী। ‘জাতীয় সরকার গঠন করা হবে।
পৃষ্ঠা: ১৭৩
কিন্তু এ সময়ই খন্দকার মােশতাক আহমেদের সমর্থক এক দল আমলা ও সেনাকর্মকর্তা আমাদের এ সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালাে। জিয়াউর রহমানও সেই বাধার বিরুদ্ধে কিছু করতে না পেরে তাদের সহযােগিতা করলেন।
৩ নভেম্বর খালেদ মােশারফের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান পদ গ্রহণ করার বিষয়টি সাধারণ সৈনিক ও বেশিরভাগ অফিস মনঃপুত ছিল না। খালেদ মােশারফ যে জিয়াউর রহমানকে বন্দি করলেন সেটিও সাধারণ সৈনিক ও বেশির ভাগ অফিসার মেনে নিতে পারলেন না। এতে সেনাবাহিনীতে এক অনিশ্চিত অবস্থার সষ্টি হয়। তার ফলে রাষ্ট্রক্ষমতায় কেবল বিশৃঙ্খলাই নয়, এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় আমরা মনে করি, এটাই আমাদের (জাসদ, গণবাহিনী, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা) ক্ষমতা গ্রহণের উপযুক্ত সময়। নভেম্বরের সে কয়দিন ঢাকা শহরে এবং শ্রমিক এলাকাগুলােতে ছাত্র- যুবক এবং শ্রমিকরা গণআন্দোলনের স্রোত সৃষ্টি করে।
৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় আমি, ড. আখলাকুর রহমান ও কর্ণেল তাহের লালমাটিয়ায় আখলাকুর রহমান সাহেবের বাসায় মিলিত হই। এই প্রথমবারের মতাে ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র সৈনিকদের সংগঠিত অবস্থার কথা ড. আখলাক ও কর্ণেল তাহেরকে জানাই। ১৯৭৪-এর ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে স্মারকলিপি দিতে গিয়ে জলিল-রবের গ্রেফতারের পর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কাজ সমন্বয়হীন হয়ে পড়ে। মেজর জলিল এ দায়িত্ব পালন করতেন। ক্যান্টনমেন্টে তাদের নিজস্ব একটি ‘কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল’ ছিল।
আমরা তিনজন (আমি, আখলাক, তাহের) মিলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি যে, দেশে তখন যে অনিশ্চয়তা ও ক্ষমতাবলয়ে যে শূন্যতা বিরাজ করছিল, তা থেকে দেশকে রক্ষা করতেই বাইরের ছাত্র-যুবক-শ্রমিক এবং ভেতরের সৈনিক সংস্থার যােগসাজশে একটি বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটানাে অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। ড. আখলাক ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে যােগাযােগের লিঙ্ক প্রতিষ্ঠা ও তার জন্য বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র সহায়তার কথা তুললে কর্ণেল তাহের বললেন, “I shall find it out. (আমি সেটা খুঁজে বের করবাে)।
পৃষ্ঠা: ১৭৪
কর্ণেল তাহের এরপর ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যােগাযােগ করতে সক্ষম হলেন। প্রশ্ন উঠলো, কে ছাত্র-শ্রমিক- সৈনিকদের এ অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকবেন? তখনকার পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই জিয়াউর রহমানের নাম আসে। এ ব্যাপারেও কর্ণেল তাহের বললেন, ‘I can handle that too’ (আমি সে ব্যাপারটাও সামলাতে পারবাে)।
নভেম্বরের ৪, ৫ ও ৬ তারিখ অভ্যুথানের আয়ােজন ও প্রস্তুতিতে চলে গেল। এর মধ্যেই ‘ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র মাধ্যমে কর্ণেল তাহেরের কাছে জিয়াউর রহমান বার্তা পাঠালেন, ‘Free me Taher, save me’ (তাহের আমাকে মুক্ত কর, আমাকে বাঁচাও)।
কর্ণেল তাহের এসব ঘটনা আমাদের কাছে রিপাের্ট করলেন এবং সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে একটি সফল বিপ্লব যে ঘটানাে সম্ভব, তাও জানালেন। এ বিষয়ে সৈনিক সংস্থার সঙ্গে তার আলােচনা ও বিস্তারিত পরিকল্পনার কথাও জানালেন। এসব প্রস্তুতির আলােকে ৬ নভেম্বর রাত একটায় (৭ তারিখ) অভ্যুত্থানের সময় নির্ধারণ করা হয়। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই ক্যান্টনমেন্টের বাইরে ছাত্র-শ্রমিকদের মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি ঘটিয়ে সেনাবিদ্রোহের সঙ্গে তাকে একাকার করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী সংযােগ স্থাপনে এ শক্তিসমূহ প্রচণ্ড ব্যর্থতার পরিচয় দেয়।
সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, ৭ নভেম্বরের ভাের বেলা (অনুমান ৬টার দিকে) জিয়াউর রহমান ও কর্ণেল তাহেরের নেতত্বে ক্যান্টনমেন্ট থেকে সামরিক অফিসার ও সৈনিকরা ট্যাঙ্ক, সাজোয়া যান ও অন্যান্য সামরিক বাহন নিয়ে শহীদ মিনারে আসবে। একই সময়ে ছাত্র-যুব- শ্রমিকরাও তখন শহীদ মিনারে উপস্থিত হবে। ছাত্ররা আসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার বিভিন্ন কলেজ থেকে। আর শ্রমিকরা মূলতঃ আদমজি, তেজগাও ও পােস্তগােলা থেকে মিছিল করে শহীদ মিনারে আসবে । ওখানেই ‘বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল’ গঠন ও ঘােষণা করা হবে। পরবর্তী ধাপে কমান্ড কাউন্সিলের অধীনে সকল রাজনৈতিক দল, সৈনিক, শ্রমিক ও ছাত্র-যুবকদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে।
পৃষ্ঠা: ১৭৫
ক্যান্টনমেন্টের ব্যারাকগুলােতে এ সময় ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ ছাড়াও স্বার্থান্বেষী আরাে কিছু গােষ্ঠী অতিদ্রুত সক্রিয় হয়ে উঠলো। বাইরে মাহবুবুল আলম চাষীসহ একদল আমলাও আন্তর্জাতিক যােগাযােগের মাধ্যমে সমগ্র ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। কার্যত তারাই জিয়াউর রহমানকে তাদের পক্ষে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এ সময় ক্যান্টনমেন্টের বাইরের চিত্র হলো, সময়মতাে ছাত্র-যুব-শ্রমিকরা শহীদ মিনারে সমবেত হয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে তাদের এগিয়ে যাবার পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করতে পারলাে না। ছাত্র-যুবক-শ্রমিকদের সমবেত করার জন্য নির্দিষ্ট করে যাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তারাও তা কার্যকর করতে পারেনি। আমাদের প্রধান প্রধান নেতারা সেই সময় জেলে ছিলেন। তাঁদের অনুপস্থিতিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তাদের যােগ্যতা প্রমাণে চরমভাবে ব্যর্থ হন। পরবর্তী সময়েও এ ব্যর্থতাকে অতিক্রম করার সুযােগ না নিয়ে একটি অসময়ােপযােগী সিদ্ধান্তের ফলে সবকিছুই এক পর্যায়ে আমাদের হাতের বাইরে চলে যায়।
৯ নভেম্বর ১৯৭৫ জলিল-রব মুক্তিলাভ করেন। এরপর সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আমরা আলােচনায় বসি। আলােচনার গতি দেখে আমি বুঝলাম, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে দুটি স্পষ্ট ভাগ। একটি ভাগের মত হলাে : দুই-চারদিনের মধ্যেই ৭ নভেম্বরের মতাে করে সিপাহী- জনতার আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটানাে। দ্বিতীয় মতটি হলাে : জিয়াউর রহমানকে তার ক্ষমতা সংহত করার সুযােগ দিয়ে আরও সংগঠিতভাবে অভ্যুত্থান ঘটানাের চেষ্টা করা। দুটি ভিন্ন মতামতের কারণে আমি ক্ষুদ্রাকারের একটি অ্যাকশন কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিলাম। অবস্থা বুঝে এই ‘অ্যাকশন কমিটি’ জাসদ ও ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র হাই কমান্ডের কাছে রিপাের্ট করবে এবং তার আলােকে ও বাস্তবতার নিরিখে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। নভেম্বরের ১৫ কি ১৬ তারিখে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২৩ নভেম্বর হঠাৎ করে আমার কাছে সংবাদ এলাে, কোনাে একটি সভা থেকে মেজর জলিল, আ স ম রব ও কর্ণেল তাহেরকে গ্রেফতার করা হবে। ঐ দিনই এসএম হলের হাউজ
পৃষ্ঠা: ১৭৬
টিউটরের বাসা থেকে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ইনুও গ্রেফতার হলো । এদের গ্রেফতারে আমি বিস্মিত হলাম । গ্রেফতার মতো এমন কোনাে ঘটনা বা সিদ্ধান্ত তাে হয়নি।
এ ঘটনার প্রায় ৩০ বছর পরে (২০০৫ সালে) আমি জানতে পারলাম, আমার অনুপস্থিতিতে, আমাকে না জানিয়ে বা আমার মতামত না নিয়ে, মাত্র কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, আবারও কয়েকদিনের মধ্যে ক্যান্টনমেন্টে অভ্যুথান ঘটানাে হবে। সেই প্রস্তাবের উত্থাপক ছিলেন কর্নেল তাহের ও মেজর জলিল। বলা বাহুল্য জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করতেই এই অভ্যুথান ঘটানাের চিন্তা করা হয়েছিল।
ক্ষুদ্রাকারের সেই ‘অ্যাকশন কমিটি’তে ছিলেন মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব, কর্ণেল তাহের, হাসানুল হক ইনু ও আমার অনুরােধে কাজ করা শরীফ নূরুল আম্বিয়া। আমার অনুপস্থিতিতে, আমাকে না জানিয়ে দ্বিতীয় অভ্যুত্থান ঘটনানাের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এই বিষয়টি আমি পরে শরীফ নুরুল আম্বিয়ার কাছ থেকেই জানতে পারি ।
বৈপ্লবিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা দখলের জন্য যে সংগঠিত শক্তি ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে সৈনিক ও অফিসারদের মধ্যে এবং বাইরে ছাত্র-যুব-শ্রমিকদের মধ্যে থাকা দরকার, মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে তা সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত হয়ে পড়েছিল। সর্বোপরি ক্ষমতায় যারা থাকে তাদের সঙ্গে ক্ষমতার বাইরে থাকা জনগণের যে পরস্পর বিরােধী অবস্থান থাকা প্রয়ােজন—যার ভিত্তিতে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটানাে সম্ভব—তাও একেবারেই অনুপস্থিত ছিল।
আমার অনুপস্থিতিতে যে সভাটিতে দ্বিতীয় অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত হয়েছিল তার পূর্বেকার একটি সভায় যখন কথাটা উঠেছিল, আমি জানতে চেয়েছিলাম, সেনাবাহিনীর মধ্যে (অফিসারসহ) সমর্থন এবং সাজ-সরঞ্জামের দিক থেকে অভ্যুত্থানের পক্ষে কী পরিমাণ প্রস্তুতি আছে। তার উত্তরে বলা হয়েছিল, একটি ট্যাঙ্ক আমাদের পক্ষে থাকবে। সৈনিক ও অফিসারদের কোনাে সংখ্যা কেউ দিতে পারলেন না। শুধু বললেন, যেহেতু ইতিপূর্বে সৈনিকরা আমাদের পক্ষে ছিল অতএব তাদেরকে সংগঠিত করতে বেশি সময় লাগবে না। আমি ছাত্র-
পৃষ্ঠা: ১৭৭
যুব-শ্রমিক সংগঠনের অবস্থা উল্লেখ করতে গিয়ে বললাম, পুনরায় এদেরকে সংগঠিত করতে হলে কমপক্ষে ছয় মাস সময় লাগবে। এ সভার পরেই আমাকে ছাড়া দ্বিতীয় অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
জাসদ রাজনীতিতে তাহেরের অন্তর্ভুক্তি
মুক্তিযুদ্ধের সময় কামালপুরে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের নিয়মিত সেনাবাহিনীর মুখােমুখি যুদ্ধে কর্ণেল তাহের গুরুতর আহত হন, তার একটি পা কেটে বাদ দিয়ে দিতে হয়। ভারতে প্রশিক্ষণ চলাকালেই আমি কর্ণেল তাহেরের নাম শুনি। জাসদ গঠনের সময়ই আমাদের সেনাবাহিনীর যারা স্বাধীনতার সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাদেরকে নতুন এ দলে অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তা আমার মাথায় ছিল ৷ জাসদে ‘বিএলএফ’ সদস্যদের, আগরতলা মামলার অভিযুক্তদের এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনা সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টিকে আমরা সাংগঠনিক কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম। সে অনুযায়ী মেজর জলিল, কর্ণেল তাহের, মেজর জিয়াউদ্দিন, সুলতানউদ্দিন আহমদসহ অনেকেই জাসদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। কর্ণেল তাহের তখনও নিয়মিত সেনাবাহিনীর সদস্য থাকার কারণে জাসদের প্রথম জাতীয় কমিটিতে তিন নম্বর ভাইস প্রেসিডেন্ট (যে-পদটা শূন্য দেখানাে হয়েছিল) হিসেবে তার নাম দেখানাে সম্ভব হয়নি। গণকণ্ঠ অফিসে একদিন তাকে আসতে দেখলাম। আলােচনা প্রসঙ্গে আমি যে তার নামের সঙ্গে পরিচিত, সে কথা বললাম। তিনিও আমার সঙ্গেই দেখা করার জন্য এসেছেন বলে জানালেন। এরপর থেকে আমরা ঘনিষ্ঠ হই।
বহুদিন পর একদিন তিনি আমাকে বললেন, ‘সিরাজ ভাই, যদি কোনােদিন সুযােগ আসে আমাকে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাবার কাজে লাগাতে পারবেন।’ আমি বললাম, সে কাজটি আপনি যদি কখনাে করেন, ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে বসে করতে পারবেন না।
তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার পর তাঁর অনেক ইচ্ছের কথা তিনি আমাকে বলেছিলেন। যেমন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে তিনি একটি
পৃষ্ঠা: ১৭৮
উৎদনমখী জনগণের সেনাবাহিনী (People’s Army) হিসেবে গড়ে তুলতে চান। শুনে আমি বলেছিলাম, স্বাধীন হবার পরপরই মুজিব ভাইকে আমি এরকম ‘পিপলস আর্মি’ করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম।
এ ধরনের আরও বহু ইচ্ছের কথা তিনি আমাকে বলেছিলেন। তার সঙ্গে আমার প্রায় চার-পাঁচ বছরের আসা-যাওয়া, আলাপ- আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। জলিল ভাইয়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার সূত্রে তিনি জাসদ রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে এসে গিয়েছিলেন। পরবর্তী সময় ড. আখলাকের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা হয়। এভাবে সব মিলিয়ে তিনি জাসদ রাজনীতির অংশ হয়ে পড়েছিলেন। তাকে আমি একজন অত্যন্ত সাহসী এবং দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে দেখেছি। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে নামী কমান্ডাে ছিলেন। জনগণের জন্য তার গভীর দরদ ও আবেগময় ভালােবাসা ছিল।
আমাদের আলাপ-আলোচনায় সব সময় তিনি তার সামরিক প্রশিক্ষণকে কীভাবে জনগণের স্বার্থে ব্যবহার করা যায় তার উপায় বের করার উপর গুরুত্ব দিতেন। তাঁর অনুপ্রেরণায়ই তার সকল ভাইবােন সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এভাবে একটি পরিবারের সবার স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের নজির খুবই কম। আর এ দেশে সূর্যসেনের পর কর্নেল তাহেরই প্রথম ব্যক্তি রাজনৈতিক কারণে যাঁর ফাসি হয়েছে।
ছাত্রলীগের দ্বিধা বিভক্তির পরও আমি রব-গ্রুপ ছাত্রলীগকে শেখ মুজিবের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে আনার কোনাে চেষ্টাই করিনি। ছাত্রলীগ (রব) তখন এবং পরবর্তী সময়েও বেশ কয়েক বছর দেশের বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন হিসেবে অবস্থান করছিল। ছাত্রলীগের নূরে আলম সিদ্দিকী গ্রুপ এবং ছাত্র ইউনিয়নের দুই গ্রুপ মিলেও ছাত্রলীগ রব- গ্রুপের মােকাবেলা করার সামর্থ্য রাখতাে না। মােটকথা, সারা দেশে রব-শাহাজান সিরাজের নেতৃত্বে ছাত্র সমাজ একটি স্বাধীন ও স্বকীয় সত্তা নিয়ে ছিল। আমি কোনাে অবস্থাতেই তাকে ছাত্রলীগ নূরে আলম সিদ্দিকী গ্রুপের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের দিকে যেতে দিতে চাইনি। আমি
পৃষ্ঠা: ১৭৯
এর ঘাের বিরােধী ছিলাম। একইভাবে আমিও মুজিব ভাই থেকে কোনভাবেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইনি। আমি নিজে শ্রমিক লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলাম। শ্রমিক সংগঠন দ্বিধাবিভক্ত হােক সেটাও কখনাে আমার মাথায় আসেনি।
কিন্তু দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছিল। পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী কোনাে কারণ ছাড়াই দেশের বহুস্থানে রব-গ্রুপ বিরােধী অভিযান চালাতাে। অর্থনীতিতে তখন অব্যবস্থা দেখা দিয়েছিল। রেশনে চাল ও কিছু নিত্যপ্রয়ােজনীয় সামগ্রী দেওয়া শুরু হলাে। সঠিকভাবে এ ব্যবস্থা চলছে কিনা তা দেখার জন্য সেনাবাহিনী নামানাে হয়। কিন্তু দেখা গেল আওয়ামী লীগের সমর্থক এক পরিবারের কাছেই দশ-বারটা রেশন কার্ড। পরিস্থিতি যেন আয়ত্বের বাইরে চলে না যায় তার জন্য অবৈধ রেশন কার্ড উদ্ধারের কাজে নিয়ােজিত সেনাবাহিনীর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হলাে। এর ফলে খাদ্য পরিস্থিতি আরও নাজুক অবস্থায় চলে গেল । মুজিব ভাই তখন প্রতি ইউনিয়নে লঙ্গরখানা চালু করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু দেখা গেল লঙ্গরখানার জন্য বরাদ্দ চাল-গম ও অন্যান্য তৈজসপত্রও দায়িত্বপ্রাপ্তরা আত্মসাৎ করে ফেলছে। এ সময় ভারত ও বার্মা (এখনকার মিয়ানমার) থেকে খাদ্য আমদানি করাও সম্ভব হলাে না।
এ সময় আবার আমেরিকা মাঝ সমুদ্র থেকে বাংলাদেশে পাঠানাে তাদের খাদ্যশস্যবাহী জাহাজ ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তাদের আরােপিত নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বাংলাদেশ এ সময় কিউবায় কিছু পরিমাণ চটের বস্তা রপ্তানি করেছিল। তারই শাস্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র পিএল ৪৮০ চুক্তির অধীনে পাঠানাে ঐ গম ফেরত নেয়। ১৯৭৪ এর খাদ্যাভাবে সরকারি হিসাবেই একত্রিশ হাজার মানুষ মারা যায়। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা অনেক বেশি।
এ হলাে একদিকের চিত্র। অন্যদিকের চিত্র হলাে দলের কিছু লােকজন রাতারাতি বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়ে গেল। চোরাকারবারি, মজুতদারি, মুনাফাখোরি এসবের মাধ্যমে তারা অর্থবিত্তের পাহাড় গড়ে তুললাে। সংবাদপত্রে এসব দুর্নীতি ও
পৃষ্ঠা: ১৮০
অনিয়মের খবর প্রকাশিত হলেও সরকার থেকে তা নিয়ন্ত্রণের কোনাে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হলাে না।
১৯৭৩ সালে জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতা অন্তর্ভুক্ত করে সংবিধান সংশোধন করা হয়। বিনাবিচারে আটক রাখার বিধানসহ নিরাপত্তা আইন জারি করা হলাে। মাত্র ৪ টি ছাড়া সব সংবাদপত্র বন্ধ ও সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হলাে। রাষ্ট্রপতির হাতে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয় এবং শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি হয়ে যান। ‘বাকশাল’ ঘােষণার আগে মুজিব ভাইয়ে সঙ্গে আমার দুবার দেখা হয়। তিনি জাসদকে ‘বাকশাল’-এর অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আমাকে অনুরােধ করেন। পরিবর্তে আমি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দল ও সমাজশক্তিকে (সেনাবাহিনী ও আমলাদেরসহ) একত্র করে একটি জাতীয় সরকার গঠনের অনুরােধ করি। তিনি সরাসরি আমাকে বললেন, কোয়ালিশন ভিত্তিক সরকারের অত্যন্ত খারাপ স্মৃতি তার রয়েছে। আমি বললাম, সেটি ছিল প্রাদেশিক সরকার, আর তা ১৯৫৬ সালে। এখন জাতীয় রাষ্ট্র বাংলাদেশে কােয়ালিশন ভিত্তিক জাতীয় সরকার গঠনের বিশেষ দৃষ্টান্ত আমরা স্থাপন করতে পারি। কিন্তু তিনি আমার কথা আমলে নিলেন না।
এমনি ধরনের অনেক ভুল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত সারা দেশে জনগণের মধ্যে আওয়ামী লীগ বিরােধী মনােভাব তৈরি করে। এ সময় আবার মানুষের মধ্যে সামরিক অভ্যুত্থানের গুঞ্জন সৃষ্টি হয়। এ বিষয়টিও মুজিব ভাইকে বলা হয়েছিল। গােয়েন্দা রিপাের্টেও এ ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা তাকে জানানাে হয়েছিল বলে জানি। কিন্তু তিনি সে সব কোনাে কিছুকেই গুরুত্ব দিলেন না। ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতিকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। এরই মধ্যে ঘটলাে ১৫ আগস্টের নির্মম ঘটনা।
আমার গ্রেপ্তার ও মুক্তি
৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান লক্ষ্যচ্যুত হবার পর পুনরায় আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটানাের অবিবেচনাপ্রসুত ও অপ্রয়ােজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে জাসদ, গণবাহিনী ও শ্রমিক লীগ নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হয়ে
পৃষ্ঠা: ১৮১
যান। এ ধরনের একটি সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন যে তখন একেবারেই অসমব ছিল তা নেতাদের পক্ষে বােঝাও সম্ভব হয়নি। জিয়াউর রহমানের নির্যাতন এরপর সংগঠন হিসেবে জাসদকে প্রায় অস্তিত্বহীনতার পর্যায়ে নিয়ে যায়।
গােপন আদালতের বিচারে প্রধান আসামি কর্ণেল তাহেরকে প্রাণদণ্ড এবং বাকি সবাইকে আজীবন কিংবা দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২১ জুলাই ১৯৭৬ ফাসিতে কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ঐ বছরেরই ২৬ নভেম্বর আমি গ্রেফতার হই। দীর্ঘ পাঁচ বছর কারাবাসের পর ১৯৮১ সালের ১ মে আমি মুক্তি লাভ করি। আ স ম আবদুর রব অসুস্থ থাকায় চিকিৎসার জন্য তাকে জার্মানি পাঠানাে হয়েছিল । সেও ১ মে জার্মানি থেকে মুক্তি লাভ করে।
১৮২
পরিশিষ্ট
পরিশিষ্ট : ১
সিরাজুল আলম খান সম্পর্কে আ স ম রব
[ সিরাজুল আলম খানের সাক্ষাৎকার গ্রহণের পরে আমি তার একনিষ্ঠ অনুসারী ও দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী আ স ম আবদুর রবের সঙ্গে জনাব খানকে নিয়ে কিছু আলােচনা করি। আমার উদ্দেশ্য ছিল এই আলােচনার মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক দীক্ষাদাতা বন্ধু-দার্শনিক ও পথপ্রদর্শক সম্পর্কে জনাব রবের অভিজ্ঞতাজাত মূল্যায়ন সম্পর্কে ধারণা লাভ করা। ২০১৮ সালের ৭ মে তারিখে নেওয়া জনাব রবের সাক্ষাৎকারটির সারাংশ এখানে দেওয়া হলাে [শা.পে.]।
সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৬২ সালে। তার বাবার মৃত্যুর পর জেল থেকে সাত দিনের প্যারােলে বেরিয়ে আসা জনাব খানের সঙ্গে আমার দেখা হয় নােয়াখালী বেগমগঞ্জের আলিপুর গ্রামে। আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন খালেদ মােহাম্মদ আলী। আমি, মাহমুদুর রহমান বেলায়েত ও শামসুজ্জামান চৌধুরী বাবুল একসঙ্গে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি সেখানে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা- কর্মী গিজগিজ করছে। খালেদ ভাই তাকে বললেন, ‘আপনি যাদের খুঁজছেন তাদের দুজনকে আমি নিয়ে এসেছি।’ একথা বলে তিনি আমাকে ও বেলায়েতকে দেখিয়ে দিলেন। সিরাজুল আলম খান সম্পর্কে খালেদ ভাই পূর্বেই আমাকে ব্রিফ করেছিলেন। জানিয়েছিলেন বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য তিনি একটি গােপন সংগঠন গড়ে
তুলেছেন। বলেছিলেন, ‘তােমরা এটির সদস্য হবে। কাজ করবে। তােমরা দুজন ছাড়া আর কেউ যেন না জানে। সংগঠনের নিয়ম হলো, যে যার মাধ্যমে রিক্রুট’ হবে সে ও রিক্রুটার-এ দুজন ছাড়া আর কেউ এ ব্যাপারে কিছু জানতে পারবে না।’
আমি তখন চৌমুহনি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বেলায়েতও তাই। এরপরে জেলা পর্যায়ে আমরা নােয়াখালীতে এবং থানা পর্যায়ে ফেনী ও লক্ষীপুরে ‘রিক্রুট’-এর কাজ শুরু করি। শর্ত ছিল সাহসী, ভালাে বক্তা, স্লোগান দিতে পারে, পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি করতে পারবে, দীর্ঘদিন আত্মগােপন করে থাকার মনােবল আছে, জেল- জুলুমসহ সব ধরনের অত্যাচার সয়ে দেশ স্বাধীন করার কাজে লিপ্ত থাকার মানসিকতা সম্পন্ন এমন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হতে হবে। এছাড়া তারা বিয়ে করবে না। লােভ-লালসা এবং পরিবারের প্রতি বিশেষ আনুগত্যের উর্ধ্বে থাকবে। মিথ্যা কথা বলবে না। ফাকিবাজি, ধোঁকা দেওয়া, অসততা, কারও প্রতি অবিচার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকবে এবং কেন্দ্রের যে কোনাে নির্দেশকে জীবনবাজি রেখে হলেও বাস্তবায়িত করার জন্য কাজ করে যাবে। সিরাজ ভাইয়ের নির্দেশে ১৯৬২ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপাের্টের বিরুদ্ধে দেশের অন্যান্য এলাকার মতাে আমরা নােয়াখালীতেও ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলি।
১৯৬৪ সালে মিস ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচন। তিনি ছিলেন মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর বােন। আমরা মনে করলাম, এ নির্বাচনকে কাজে লাগিয়ে আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হাসিলের জন্য উপযুক্ত নেতা- কর্মী তৈরি করা যাবে। তাদের খুঁজে বের করে রিক্রুট করতে হবে। ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনী জনসভায় যােগ দিতে আমরা নােয়াখালী থেকে এক বিরাট দল নিয়ে চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। ছাত্রলীগের জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মােহাম্মদ হানিফ ও খালেদ মােহাম্মদ আলী, আমি ও বেলায়েতসহ জেলার বিভিন্ন থানা থেকে কলেজ ও স্কুলের ছাত্রসহ কয়েকশত কর্মী ও সদস্য আমরা চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম । তখন বাংলাদেশের সর্বত্র স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ছাত্রলীগের তেমন শক্তিশালী সংগঠন না থাকলেও, নােয়াখালীতে আমরা সকল কলেজ ও স্কুলে, এমনকি প্রাইমারি স্কুলে পর্যন্ত ছাত্রলীগের ইউনিট গঠন করতে সক্ষম হই।
পৃষ্ঠা: ১৮৬
এর আগে ঢাকার পাকিস্তান মাঠে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনেও (১৯৬০- ‘৬২) আমি নােয়াখালি জেলার একজন প্রতিনিধি হয়ে এসেছিলাম। ঐ সম্মেলনে সিরাজুল আলম খান (দাদা) সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে শামসুজ্জামান বাবুল আমাকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সেদিন তার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, তিনি ভিন্ন ধরনের চিন্তা করেন। তবে সেবারে ঐ পরিচয় ছাড়া তার সঙ্গে আর ঘনিষ্ঠতার সুযােগ হয়নি।
১৯৬৪ সালে মােনায়েম খানের উপস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান ভণ্ডুল করার অপরাধে সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, রাশেদ খান মেনন ও আসমত আলী শিকদারসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র নেতাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয় । এ বহিষ্কারাদেশের বিরুদ্ধে সারাদেশের মতাে নােয়াখালীতেও আমরা ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলি।
ছাত্রলীগ সম্মেলনে যােগদান
১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের দুদিন আগে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন। ঐ সম্মেলনে ডেলিগেট হিসেবে যােগ দিতে আমরা নেয়াখালী থেকে ঢাকায় আসি। সে সময় সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে কথাবার্তা হয়। তিনি বিভিন্ন জেলা নেতৃবন্দের সঙ্গে আলােচনা করে গােপন সংগঠনের জন্য আরও নতুন কর্মী রিক্রুট করতে বললেন। তখন ওবায়দুর রহমান ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট ও সিরাজুল আলম খান সাধারণ সম্পাদক। সে সময় শুনেছিলাম যে, ছাত্রলীগের সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদকের যে কোনাে একজন মুজিব পরিবারের হতে হবে। ১৯৭০ সালে আমিও অনুরূপ বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। সেবার তােফায়েল আহমদের কারণে সে বাধা টেকেনি। বঙ্গবন্ধু যখন তােফায়েলকে ডেকে বললেন, ‘তােমাকে ছাত্রলীগের সভাপতি হতে হবে, তখন তােফায়েল বলেছিলেন, তাহলে রব হবে সাধারণ সম্পাদক।’ অবশ্য সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে কাজ করবার যে শপথ আমি নিয়েছিলাম, তা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করতে গিয়ে সারাদেশে আমার যে ব্যাপক যােগাযােগ ও পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত
পৃষ্ঠা: ১৮৭
হয়েছিল, আমার এই সাধারণ সম্পাদক হবার পেছনে তার বড় ভূমিকা ছিল।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু তার ৬-দফা ঘােষণা করলেন। এরপর দাদার সঙ্গে ঢাকায় দেখা হতে তিনি বললেন, ‘৬-দফাকে নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সারা দেশে সভা, মিছিল, ধর্মঘট, হরতাল ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করা হবে। তােমরা নিজ নিজ এলাকায় এসব কর্মসূচির প্রতি সমর্থন দেবে ও তা সফল করার জন্য কাজ করবে।’ এসব সভা-সমাবেশ থেকে আমরা ৬-দফা না হলে ১-দফা এই কথাটি বলতাম। তবে সে এক-দফাটা কী সেটা ব্যাখ্যা করা হতাে না। যারা বােঝার তারা বুঝতাে।
১৯৬৬ সাল। রূপ ভারতী সিনেমা হলে নােয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন। শাহ মােয়াজ্জেম, ওবায়দুর রহমান, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও সুধীর কুমার হাজরা এ সম্মেলনে উপস্থিত হন। ছাত্রলীগের এত বর্ণাঢ্য সম্মেলন ইতিপূর্বে কখনও হয়নি। সে সময়ে নােয়াখালী ছিল ছাত্রলীগের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি। সম্মেলন থেকে আমাকে নােয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। আমি এই দায়িত্ব গ্রহণের ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলাম। দাদা বললেন, ‘রব স্টিয়ারিং হুইল তাে সাধারণ সম্পাদকের হাতে। তােমাকে ঠিক জায়গায় রাখা হয়েছে। আমি তখন সম্মত হলাম।
ঐ বছরেরই শেষের দিকে আমি ঢাকায় আসি। তােফায়েল ভাই তখন ডাকসুর ভিপি। তার সহায়তায় আমি বাংলা বিভাগে ভর্তি হই। তখন থেকে প্রতিটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে আমি সিরাজুল আলম খানের নির্দেশ মেনে চলে আসছি। আজ পর্যন্ত এর ব্যতিক্রম হয়নি।
১৯৬৭ থেকে ‘৬৯ সাল পর্যন্ত আমি ইকবাল হলের (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) অনাবাসিক ছাত্র ছিলাম। সে সময়ে দাদাও ঐ হলে থাকতেন। আমি ও শাজাহান সিরাজ তখন হলের ১১৬ নম্বর কক্ষে থাকি। খালেদ মােহাম্মদ আলীকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক করার প্রশ্নে দাদার নির্দেশে আমি বিশেষ ভূমিকা পালন করি। জেলা
পৃষ্ঠা: ১৮৮
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের মবিলাইজ করি। কারণ খালেদ মোহাম্মদ আলী ছিলেন আমাদের গোপন সংগঠনের সদস্য।
১৯৬৬- ‘৬৯ সময়ে ৬-দফা ও ১১-দফা আন্দোলন এবং তারপর গণঅভ্যুথানের জন্য ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করা, তাদের পরিচালনা করা নানা নির্দেশনা দেওয়া, বিভিন্ন কর্মসূচি প্রণয়ন, সবই করা হতাে সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে। ১১-দফা প্রণয়নের পেছনে তার অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি ছিলেন এ আন্দোলনের নেপথ্য সংগঠক। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের তাে বটেই, এমনকি রেল- সড়ক- লঞ্চসহ পরিবহন ও অন্যান্য খাতের শ্রমিকদের সংগঠিত করা, তাদেরকে আন্দোলনে আনা এবং পরিচালনার ব্যাপারেও মূল পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশক ছিলেন সিরাজুল আলম খান।
আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলায় আটক বঙ্গবন্ধুকে আইয়বের গোলটেবিল বৈঠকে যােগদান করানাের জন্য তাঁকে প্যারােলে বের করে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া ও এডভোকেট আবদুস সালাম খানসহ কয়েকজন। এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বঙ্গবন্ধুর গাড়ির চালক ইকবাল হলে আমার রুমের দরজায় টোকা দিচ্ছেন। তিনি বললেন, বেগম মুজিব গাড়ি পাঠিয়েছেন। সিরাজ ভাইকে নিয়ে যাবার জন্য। সিরাজ ভাই তখন রুমে ছিলেন না। আমি তাকে খুঁজে বের করে ৩২ নম্বরে পাঠিয়ে দিলাম। দাদা ফিরে আসার পর পুরাে ঘটনা আমাদের বললেন।
শেখ মুজিবের প্যারােলে মুক্তির ব্যাপারে বেগম মুজিব কী করতে হবে তা বুঝতে পারছিলেন না। দাদা তাঁকে বললেন, ‘ওভাবে মুজিব ভাইকে বের করার মানে হবে তাঁকে জাতির কাছে বেইমান ও বিশ্বাসঘাতক প্রমাণ করা। তার প্যারােলে মুক্তির প্রশ্নই ওঠে না। তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েই জেল থেকে বেরিয়ে আসবেন।’
বেগম মুজিব দাদাকে বললেন, তা হলে আপনি এক টুকরা কাগজে কথাটা লিখে দেন। আমি উকিলদের মারফত তার কাছে পাঠিয়ে দেব।’ দাদা তখন কিংস্টর্ক সিগারেটের প্যাকেটের কাগজ ছিড়ে তার ওপর লিখে দিলেন, আপনি কিছুতেই প্যারােলে আসবেন না- সিরাজ’। দাদার এই কথাকে গুরুত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারের প্যারােলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
পৃষ্ঠা: ১৮৯
১৯৭০-এর নির্বাচনে দাদা আমাদের নির্দেশ দিলেন,আমরা যেন আওয়ামী লীগের আয়ােজিত কোনাে জনসভায় যােগদান না করি। তবে ছাত্রলীগের আয়ােজিত সব জনসভায় যেন আওয়ামী লীগ নেতাদের আমন্ত্রণ জানাই এবং সেসব সভায় ৬-দফা আদায় না হলে এক-দফা অর্থাৎ ‘স্বাধীন বাংলা’র জন্য সংগ্রাম করা হবে বলে ঘােষণা দেই এবং তার নির্দেশ মতাে ছাত্রলীগের আয়ােজিত জনসভাগুলােতে আমরা যেসব স্লোগান দিতাম তার মধ্যে ছিল : ‘৬-দফা না ১-দফা’ ‘১-দফা, ১-দফা।’
১৯৭০-এর নির্বাচনকেও আমাদের লক্ষ্য অর্জনের কাজে লাগানো হয়। সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে আমরা আওয়ামী লীগ যাতে পূর্ব পাকিস্তানের সবগুলাে আসনে জিততে পারে তার জন্য জীবন বাজি রেখে কাজ করি। তার নির্দেশে এভাবে ছাত্রলীগের ব্যাপক কর্মীবাহিনীর সার্বক্ষণিক শ্রম ও সম্পৃক্তি ছাড়া ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয় সম্ভব হতাে না। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও, বাঙালি মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবীসহ শিক্ষিত সমাজের নেতারা সেদিন বুঝে ফেলেন যে, নির্বাচনে যদি পাকিস্তান সরকার কোনাে বাধা সৃষ্টি করে তাহলে সে আন্দোলন গণতান্ত্রিক এলাকা ছাড়িয়ে সশস্ত্র রূপ নেবে। বাস্তবে হয়েছেও তাই। নির্বাচনে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা জনগণের রায় মেনে না নেওয়ায় তা সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হয়।
বঙ্গবন্ধু যখন ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’য় অভিযুক্ত হয়ে কারাগারে তখন আওয়ামী লীগ অফিসে বাতি জ্বলতাে না। বিল দিতে না পারার কারণে বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া হয়েছিল। আমেনা বেগম তখন আওয়ামী লীগের কার্যকরী সাধারণ সম্পাদক। আমি ও দাদা পলাশি মােড় থেকে বাসে পুরনাে পল্টন যেতাম । ভাড়া ছিল ১৫ পয়সা। আমার ও দাদার পকেটে কোনাে পয়সা নেই। ইকবাল হলের ক্যান্টিনের সামনে এর-ওর কাছ থেকে চেয়ে চার আনা পয়সা জোগাড় করতে পারলেই তা নিয়ে পুরনাে পল্টন আওয়ামী লীগ অফিসে চলে যেতাম। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হবার পর এমনই আর্থিক অনটনে পড়ি যে, সাতদিন বলতে গেলে প্রায় উপবাসের মতােই কাটে আমাদের। এ সময়ে অনেকটা পানি খেয়েই দিন কাটিয়েছি। ইকবাল হলের তিন
পৃষ্ঠা: ১৯০
তলায় আবু বকরের রুমে লেপ গায়ে দিয়ে দিনভর শুয়ে থাকতাম । গ্রেফতারের সম্ভাবনা এড়াতে প্রায়ই রুম বদলাতাম।
ইকবাল হলের এক কর্মচারী ছিল, তাকে সবাই ল্যাবা’ বলে ডাকতো। তখর রােজার মাস। সে ইফতারের সময় আমাদেরকে ‘বুট-বড়া’ এনে দিতে। সেটাই ছিল আমাদের একমাত্র খাবার। যেদিন আওয়ামী লীগ অফিসে যেতাম, সেদিন আমেনা বেগম এক টাকার মুড়ি দুই টাকার ছোলা ও পেয়াজ মেখে সকলের জন্য যে ইফতার বানাতেন তা থেকে আমরাও খেতাম।
সার্জেন্ট জহুর যেদিন মারা যান, সে সন্ধ্যায় দাদার নির্দেশে নীলক্ষেত এলাকার পথশিশুদের’দের নিয়ে একটি মিছিল বের করি এবং সে মিছিল থেকেই প্রথম স্লোগান দিই : ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’,’জহুরের রক্ত, স্বাধীনতার মন্ত্র।’ সে রাতে আমাকে আরও সাবধানে থাকতে বললেন। এ সময় তিনি আমার অত্যন্ত নির্ভরশীল ছিলেন। আমি গ্রেফতার হলে বিপদ হতাে। আমার প্রতিদিনের সকল কার্যকলাপ তখন তার নির্দেশ মতােই চলতো। আগের রাতে তিনি বলে দিতেন পরদিন আমাকে কী করতে হবে। আমিও সে অনুযায়ী চলতাম।।
১ মার্চ ও তারপর
১৯৭১-এর ১ মার্চ দুপুরে ইয়াহিয়া খান তার বেতার ভাষণে ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দেন। ভাষণের পর দাদা আমাকে সরাসরি বায়তুল মােকাররম চলে যেতে বললেন। মাখনকেও তাই বললেন। পল্টন ময়দানে তখন মওলানা ফরিদ আহমদের নেজামে ইসলাম পার্টির একটি সভা হচ্ছিল। আমরা সেই মঞ্চ দখল করে বক্তৃতা দিলাম। একই সময়ে বঙ্গবন্ধু পূৰ্বাণী হােটেলে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করছিলেন। ইয়াহিয়ার বক্তৃতার পর তিনিও সে বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে প্রেস কনফারেন্স করলেন। আমরা সেখানে গিয়ে পাকিস্তানের পতাকা পােড়ালাম ও বঙ্গবন্ধুর কাছে স্বাধীনতা ঘােষণার দাবি জানালাম। তিনি আমাদের বললেন, ‘আমার কাজ আমি করছি, তােমাদের কাজ তােমরা করাে’।
পৃষ্ঠা: ১৯১
সে রাতে দাদার নির্দেশে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ২ মার্চ কলাভবন চত্বরে আমি স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি। এটা সেই পতাকা যা ইতিপূর্বে পল্টন ময়দানে শ্রমিক লীগের সংবর্ধনা সভা ও ‘৭১-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুর বাহিনীর (পরে ‘জয়বাংলা বাহিনী’ ও শেষে ‘মুজিব বাহিনী’) মার্চপাস্টে ব্যবহার করা হয়। একই পতাকা স্বাধীন বাংলার পতাকা হিসেবে দাদার নির্দেশে ২ মার্চ আমার হাতে হস্তান্তর করেন ঢাকা শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ জাহিদ হােসেন। ‘জয়বাংলা বাহিনী’র প্রধান হিসেবে পতাকাটা আমি বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিই। এই পতাকাই ২৩ মার্চ ‘পাকিস্তান দিবসে’ (আমরা যে-দিনটি ‘প্রতিরােধ দিবস’ হিসেবে পালন করি) সারাদেশে পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলার পতাকা হিসেবে উত্তোলিত হয়। ২৪ মার্চ রাতে ইকবাল হলের প্রভােস্টের টেলিফোনে আমার কাছে একটি গােপন টেলিফোন আসে। তা থেকে বলা হয় ২৫ মার্চ রাত ৮টায় আমাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়া হবে, আমি যেন সে সময়ে টেলিফোনের কাছে থাকি। আমি দাদাকে বিষয়টি জানালাম। তিনি বললেন, ‘সে সময় আমি ও রাজ্জাক মুজিব ভাইয়ের বাসায় থাকবাে। তুমি খবরটা পাবার সঙ্গে সঙ্গে ৩২ নম্বরে চলে আসবে।’ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলার আশঙ্কায় আমি আগে থেকেই ঢাকা শহর থেকে চলে যাওয়ার সকল প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। সে রাতে ঠিক ৮ টায় ফোনটি এলাে। ও প্রান্ত থেকে কেউ একজন বললাে, আমি কে বা কোথা থেকে বলছি, জানার চেষ্টা করবেন না। আজ রাত ১২টা ১ মিনিটে ‘আর্মি ক্র্যাকডাউন’ হবে এবং শেখ মুজিব এবং আপনাদের সকল ছাত্রনেতাকে মেরে ফেলবে। এর পরেই তিনি লাইন কেটে দিলেন। আমি তক্ষুণি ৩২ নম্বরে চলে গেলাম। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মােহাম্মদ হানিফ (পরবর্তীকালে ঢাকার মেয়র) আমাকে গাড়ি বারান্দার দোতলায় যেখানে চালকরা ঘুমান, সেখানে চলে যেতে বললেন। গিয়ে দেখি সেখানে বঙ্গবন্ধু, দাদা, মনি ভাই, তােফায়েল ভাই ও রাজ্জাক ভাই আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি বলার পর বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এ তথ্য আমিও জানি। তার জন্য আমার প্রস্তুতিও আছে।’
পৃষ্ঠা: ১৯২
আমি বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আমাদের মধ্যে বােধ হয় আমিই সর্বপ্রথম ঢাকা শহর ত্যাগ করি। ২৫ মার্চ রাত ১২টায় ক্র্যাকডাউনের পর ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’,’স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ও আওয়ামীলীগের মধ্যে যাদের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে এবং জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে পরবর্তী করণীয় কী হবে তা নিয়ে আলােচনা হচ্ছিল, তাদের অনেকে কেরানিগঞ্জে রতন-গগনদের বাড়িতে একত্রিত হলাম। সেখানে দাদা ছাড়াও শেখ মনি, রাজ্জাক, তােফায়েল ও আরেফসহ অনেকে ছিলেন। ঐ বাড়িতে বসেই সিদ্ধান্ত হয়, চার যুবনেতা অর্থাৎ দাদা, মনি, রাজ্জাক ও তােফায়েল যাবেন এবং সেখানে অস্ত্র ও ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করবেন। দাদা আমাকে ভারতে না গিয়ে আপাতত দেশে থাকতে বললেন। বললেন অস্ত্র পাঠানাে হবে। একটি সংকেত দেওয়া হলাে। সেটি ছিল, যেদিন রাত ৮ টায় আকাশবাণী কোলকাতা থেকে হেমন্ত মুখােপাধ্যায়ের গলায় বিশেষ একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানাে হবে, বুঝতে হবে ভারত থেকে অস্ত্রের চাল ন রওয়ানা হয়ে গেছে। তারা আমাকে খুঁজে বের করবে। আমাকেও রাজশাহীর কাছে পদ্মা নদীতে তাদেরকে খুঁজতে হবে।
মে মাসের প্রথমদিকেও অস্ত্র না আসায় রায়হান ফিরদাউস মধুকে সঙ্গে নিয়ে আমি আগরতলা হয়ে কলকাতায় যাই। পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চিত্ত সতারের বাসায় দাদার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। দাদা ছাড়াও মনি ভাই, রাজ্জাক ভাই ও তােফায়েল ভাইকে সেখানে পেলাম। দাদার তার কাছ থেকে জানলাম ভারত সরকারের সঙ্গে আলােচনা হচ্ছে। অস্ত্র, টেনিং, রসদ সব কিছুরই ব্যবস্থা হবে। আমাকে তিনি আগরতলায় ফিরে যেতে বললেন। আমি আগরতলায় ফিরে এলাম।
সম্ভবত আগস্ট কি সেপ্টেম্বরে আমি আবার কলকাতায় যাই । আগরতলায় আমার কাজ করতে কিছু অসুবিধা হচ্ছিল। তবু দাদা আমাকে আগরতলায় থেকেই কাজ করবার নির্দেশ দিলেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নােয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী ও বরিশাল অঞ্চলের ‘বিএলএফ’ (মুজিব বাহিনী’) সদস্যদের দেশের ভেতর থেকে নিয়ে এসে একত্র করে প্রশিক্ষণ শেষে অস্ত্রসহ তাদেরকে আবার দেশের ভেতরে গেরিলা যুদ্ধের জন্য পাঠাতে হবে। দেশের ভেতরে গিয়ে একজন দশজনকে ‘রিকুট’ করবে। তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেবে ।
পৃষ্ঠা: ১৯৩
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। এসব নির্দেশনা তিনি আমাকে দিলেন ।
অক্টোবর-নভেম্বরে আমি আরেকবার কলকাতা যাই এবং দেশের ভেতরে গিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণের ইচ্ছে প্রকাশ করি। দাদা জানালে ডিসেম্বরের মাঝামাঝির আগে আমার কোনােক্রমেই দেশের ভেতরে যাওয়া চলবে না। গেলে আমাদের নিজেদের ভেতরের লােকরাই আমাকে মেরে ফেলবে।
১৬ ডিসেম্বরের পর কয়েকদিন দাদার সঙ্গে যােগাযােগবিচ্ছিন্ন ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর নিকট মুজিব বাহিনীর অস্ত্র হস্তান্তরের পূর্বে তিনি আমাকেসহ অনেককে বললেন, ‘মনে রেখাে যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। সমাজ পরিবর্তনের ঘােষিত লক্ষ্য সশস্ত্র যুদ্ধের আদর্শ অর্জন ও মুক্তিযােদ্ধাদের সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের লড়াই চলবে।’
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন
সঠিক তারিখটা আমার মনে নেই। তবে ১৯৭২-এর প্রথমদিকে হবে। সেদিন আওয়ামী লীগের অর্থবিষয়ক সম্পাদক ইসলাম ভাই (নুরুল ইসলাম)-এর বাসায় দাদা (সিরাজুল আলম খান), মােহাম্মদ শাহজাহান, নুরে আলম জিকু ভাই, আমি, শাজাহান সিরাজ, নুরুল ইসলাম ভাই এবং আরও দুই-একজন (যাদের নাম এখন মনে করতে পারছি না) এক সভায় মিলিত হই। সেখানে দাদা বললেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ও স্বপ্ন সমাজতন্ত্র আওয়ামী লীগের দলীয় সরকার দিয়ে অর্জন করা সম্ভব হবে না। অতএব সমাজতন্ত্রের আদর্শভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে হবে। তারপর এ বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ কয়েকমাস ধরে ঐ বাসায় ও আরও নানা জায়গায় ধারাবাহিকভাবে আমরা আলােচনায় মিলিত হতে থাকি। আমাদের ছাড়াও দাদা আরও অনেকের সঙ্গে আলাপ করতেন। তাদের মধ্যে রুহুল আমিন ভুইয়া ও রহমত আলী ছিলেন অন্যতম।
১৯৭২-এর আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে মেজর জলিল কারামুক্ত হবার পর তার যে কোনাে একটি রাজনৈতিক দলে অংশগ্রহণ করার ইচ্ছে প্রকাশ করে পত্র-পত্রিকায় নানা সাক্ষাৎকার প্রকাশ হতে থাকে। সম্ভবত সেপ্টেম্বর মাসের এক সময়ে মুক্তিযােদ্ধা বিচ্ছু আলম
পৃষ্ঠা: ১৯৪
(বরিশাল) দাদা ও আমাকে এসে বললো, আজ রাতে বা আগামীকাল মেজর জলিল কাজী জাফরের সঙ্গে দেখা করে ভাসানী ন্যাপে যােগ দেবেন৷ আমরা চাই না মেজর জলিল ভাসানী ন্যাপে যােগ দিন। আমরা চাই সিরাজুল আলম খান ও আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে কোন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটলে তিনি তার সঙ্গে থাকুন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাত্রলীগের অন্তর্দ্বন্দ্বের সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে৷ বিচ্চু আলম বলল, আজ রাতেই দাদা ও আপনার সঙ্গে মেজর জলিলের বৈঠক হওয়া প্রয়ােজন। সে একটি বৈঠকের আয়ােজন করলী। বৈঠক হলাে। মেজর জলিল তখন পুরানা পল্টনে বরিশালের অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের পুত্র মনিরুল ইসলাম মনির বাসায় থকতেন। ওখানে দাদা ও আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তিনি ভাসানী ন্যাপ-এ যােগ না দিয়ে আমাদের সঙ্গে থাকতে রাজি হন। তার ন্যাপে যােগদান স্থগিত হয়ে যায়।
৩০ অক্টোবর ১৯৭২-এর সন্ধ্যায় এলিফেন্ট রােডে উড়ােজাহাজ মার্কা মসজিদের পাশের বাড়িতে দাদা ও কাজী আরেফের উপস্থিতিতে মেজর জলিলকে সভাপতি করে শাজাহান সিরাজ, রহমত আলী, জিকু ভাই ও ইসলাম ভাইসহ জাসদের প্রথম কমিটি গঠন করা হয়। ঐ সভাতেই তাজউদ্দীন আহমদের মন্ত্রিপাড়ার বাসায় সম্ভবত কমলাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ময়েজউদ্দিন (মেহের আফরােজ চুমকির বাবা) ও পুরনাে ঢাকার রিয়াজুদ্দিন এ দুজনের সঙ্গে রাত ১২টা থেকে শুরু করে ভাের ৫টা পর্যন্ত বৈঠক চলে। এরা দুজন আওয়ামী লীগের মধ্যে তাজউদ্দীন সাহেবের সমর্থক ছিলেন। তাজউদ্দীন ভাইয়ের স্বভাব ছিল দীর্ঘ সভা চললে তিনি মাঝে মাঝে একটু ঘুমিয়ে নিতেন। ভাের হবার আগে আগে তাজউদ্দীন ভাই বললেন, ‘সিরাজ সাহেব, শেখ মুজিব যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন আমার পক্ষে অন্য কোনাে রাজনৈতিক দল করা সম্ভব হবে না।’
একথা সত্য যে, সে সময়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক সম্পর্কের টানাপােড়েন চলছিল। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের নজরদারি এড়াবার জন্য আমরা সূর্য ওঠার আগে আগেই তাজউদ্দীন ভাইয়ের বাসা থেকে বেরিয়ে আসি।
পৃষ্ঠা: ১৯৫
৩০ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সিদ্দিক মস্টারকে গুলি করে মেরে ফেলে। দাদার পরামর্শ অনুযায়ী ৩১ অক্টোবর সিদ্দিক মাস্টারের লাশ পাশে রেখে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে মেজর জলিলকে সভাপতি, আমাকে সাধারণ সম্পাদক ও শাজাহান সিরাজকে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক করে জাসদের কমিটি ঘােষণা করা হলাে। জাসদ প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলের আন্দোলন, সংগ্রাম সম্পর্কিত সকল বিষয়ে দাদার সঙ্গে আলােচনা ছাড়া কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। শুধু তাই নয়, আমি যতদিন এ দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছি এবং দাদা যতদিন বেঁচে থাকবেন জাতীয়-আন্তর্জাতিক কোনাে বিষয়েই তার মতামত ছাড়া আমার পক্ষে কোনাে গুরুতপর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সম্ভাবনা নেই। কারণ, বাংলাদেশের সমাজ বিশ্লেষণে—বাঙালি সমাজের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত বিচারে তার চেয়ে বাস্তবধর্মী পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর কারও আছে বলে আমার মনে হয় না।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ না করলেই নয়। সেটি গণবাহিনী প্রসঙ্গ। গণবাহিনীর সঙ্গে অনেকেই সিরাজুল আলম খান ও জাসদের সম্পৃক্ততার কথা বলে থাকেন। এ বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া প্রয়ােজন। ব্যক্তিগতভাবে জাসদের কোনাে কোনাে নেতা বা কর্মী গণবাহিনীর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন, কিন্তু সাংগঠনিকভাবে জাসদের এ বিষয়ে কোনাে সিদ্ধান্ত ছিল না। যখন গণবাহিনী গঠিত হয় তখন আমি কারাগারে ছিলাম। আমি এ সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। ব্যক্তিগতভাবেও আমি ‘গণবাহিনী’ গঠন ও এর কার্যক্রমের সঙ্গে দ্বিমত পােষণ করতাম। আমি মনে করি, আমাদের দেশের মতাে সমতল ভূমিতে রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনীর সমান্তরাল কোনাে সশস্ত্র বাহিনীর দ্বারা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটানাে, মুক্ত এলাকা গঠন ও তা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
অনেকে বলেন, ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ির সামনে রক্ষীবাহিনীর ওপর রমনা পার্কের ভেতর থেকে গুলি করা হয়েছিল । বলা হয় জাসদের লােকজনই তা করেছিল। ১৬ মার্চ রাতে দাদার সঙ্গে আমাদের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হয়েছিল, আমরা পল্টন ময়দান থেকে মিছিল
পৃষ্ঠা: ১৯৬
নিয়ে প্রথমে খাদ্যমন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদারের বাড়িতে যাব । পরে সে সিদ্ধান্ত পাল্টানাে হয়। ফণী বাবু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, ফলে তার বাড়িতে মিছিল নিয়ে যাওয়ার বিরূপ রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে ভেবে আমাদের কর্মসূচিতে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। সিদ্ধান্ত হয় রক্ষীবাহনীর নির্যাতনের প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ মিছিলের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে স্মারকলিপি প্রদান করা হবে। এর বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত জাসদের ছিল না, এবং জাসদের মিছিল থেকে সেদিন কেউ কোনাে গুলিবর্ষণ করেনি।
পৃষ্ঠা: ১৯৭
পরিশিষ্ট : ২
প্রশ্নোত্তর : আমেরিকায় শ্যামলিপি শ্যামার সঙ্গে
প্রশ্ন : আপনার পুরাে নাম সিরাজুল আলম খান, কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে আপনি ‘দাদা’ নামেই অধিক পরিচিত। এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি কী?
উত্তর : হ্যা, এখন তাে মনে হয় আমার আসল নাম সিরাজুল আলম খানের বদলে ‘দাদা’ নামটিই বেশি ব্যবহৃত হয়। আমি আরও লক্ষ্য করেছি, আমার পরিবার এবং অন্য পরিবারের অনেক বাবা-মা যেমন আমাকে ‘দাদা’ বলে ডাকে, তাদের ছেলেমেয়েরাও ‘দাদা’ ডাকে। বলতে পারাে ‘দাদা” শব্দটা এখন আমার নাম হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। আমার জন্ম ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি। নােয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলিপুর গ্রামে। বর্তমানে এটি চৌমুহনী পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত। আমাদের এখনকার বাড়িটিকে আমার বয়স দিয়ে হিসেব করা হয়। এর আগে আমাদের বাড়ি ছিল নােয়াখালীর দক্ষিণে শেষ প্রান্ত শান্তাসীতায়। সম্ভবত জায়গাটি এখন বঙ্গোপসাগরের তলদেশে কিংবা কোনাে চরে পরিণত হয়েছে। শান্তাসীতার নাম অনেক বিখ্যাত লেখকের লেখায় পাওয়া যাবে। বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী লেখক বুদ্ধদেব বসুর বাল্য-কৈশােরের দিনগুলাে কেটেছে সাগরবিধৌত নােয়াখালীর ‘শান্তাসীতায়’।
আমার বাবার নাম খােরশেদ আলম খান। তার জন্ম ১৯০৩ সালে। মৃত্যু ১৯৬৫ সালের ২৮ মার্চ। তিনি ছিলেন বিভাগীয় স্কুল
ইন্সপেক্টর। আমার মার নাম সৈয়দা জাকিয়া খাতুন। তার জন্ম ১৯২১ সালে, মৃত্যু ১৯৯৬ সালের ২৬ নভেম্বর। আমরা ৬ ভাই ও ৩ বােন। ভাইবােনদের মধ্যে আশার স্থান দ্বিতীয়।
প্রশ্ন: আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সশস্ত্র যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লেখা বইগুলাে সম্পর্কে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
উত্তর: যারা সশস্ত্র যুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে বই লিখেছেন বলতে গেলে তাদের কেউই ১৯৭১-এর মার্চ মাসের আগে পর্যন্ত স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়টি মাথায় রেখে রাজনীতি করতেন না বা সে লক্ষ্যে কোনাে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেননি। একটি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে দর্শন এবং আদর্শিক পটভূমির প্রয়োজন হয় আমাদের তৎকালীন লব্ধপ্রতিষ্ঠ রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীরা কেন তা তৈরি করতে পারলেন না অথবা সেই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করলেন না, এটি তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতা নাকি জাতি হিসেবে বাঙালির তৃতীয় জাগরণকে অস্বীকার করা, তা এখনও নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না।
প্রশ্ন : ‘তৃতীয় জাগরণ’ বলতে আপনি কী বােঝাতে চাইছেন?
উত্তর : ‘বাঙালির প্রথম জাগরণ’-এর কাল হােসেন শাহ ও শ্রীচৈতন্যের সময়-যা বেশীদিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ‘দ্বিতীয় জাগরণ’ বা ‘বেঙ্গল রেনেসা’র সময় হলাে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ইংরেজি শিক্ষা চালু হবার পরে । কিন্ত তা-ও বেশীদিন ধরে রাখা যায়নি। সমাজবিদরা প্রায় ধরেই নিয়েছিলেন বাঙালির জীবনে আর জাগরণ আসবে না। পাকিস্তানি অথবা ভারতীয় হিসেবেই বাঙালির পরিচিতি এবং পরিণতি ঘটবে। কিন্তু বাঙালির স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে যুব সমাজের উদ্যোগে গঠিত নিউক্লিয়াস তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ ও সংস্কৃতিসেবীদের চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের সীমাবদ্ধতা এবং তাদের মধ্যবিত্ত মানসিকতাকে অতিক্রম করে বাঙালিকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে মুখ্য ভূমিকা রাখে।
প্রশ্ন : ‘মধ্যবিত্ত মানসিকতা’ বলতে কী বােঝাতে চাইছেন?
উত্তর : ১৯৬০-‘৭০ দশক ছিল বাঙালি জীবনে উজ্জীবনের ‘দশক’। জাতিগত বিচ্ছিন্নতা এবং সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে উন্নত
পৃষ্ঠা: ১৯৯
জাতিগােষ্ঠীর জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে বিশ্বপরিসরে বাঙালি জাতিকে তুলে ধরার দশক। কিন্তু তৎকালী বুদ্ধিজীবী মহল এ সহজ-সরল বিষয়টি উপলব্ধি করতে কেন দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। সুতরাং স্বাধীনতার প্রশ্নে ছাত্র-যুব সমাজের যে উদ্যোগ গ্রহণ এবং চূড়ান্ত পরিণতিতে স্বাধীনতা অর্জন তা ছিল এক ধরনের সীমাবদ্ধতা নিয়ে গড়া স্বাধীন দেশের কাঠামাে মাত্র। তার ওপর রয়েছে প্রত্যন্ত প্রদেশ হিসেবে এক হাজার বছর ধরে বাংলার অবস্থানগত বাস্তবতা। যে কারণে স্বাধীন রাষ্ট্রের উপযােগী শাসন কাঠামাে বা নীতি প্রণয়নে বাঙালির যে দক্ষতার প্রয়ােজন ছিল তা তখনও সৃষ্টি হয়নি। দেশ শাসন, প্রতিরক্ষা, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে এই সমস্যা দেখা যায়। ১৯৭১ সালের পর সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনায় অনভিজ্ঞ এবং অদক্ষ লােকেরা স্থান পেল। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল শক্তি ও পেশার সমন্বয়ের পরিবর্তে শুধুমাত্র দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেশ পরিচালনার চেষ্টা চললাে। একদিকে বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতা, অপরদিকে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় প্রাদেশিক এবং ঔপনিবেশিক ধ্যান- ধারণার প্রভাব নিয়ে স্বাধীন দেশের যাত্রা শুরু হলাে। একদিকে অনভিজ্ঞতা, অন্যদিকে রাজনীতির লক্ষ্য মানে কেবলমাত্র শাসক বা শাসকদলের পরিবর্তন—এই ধারণা নিয়ে পরিচালিত হলাে একটি দেশ। আমরা আজো সেই ধারায় চলেছি। আমরা নিজেরাও এই সীমাবদ্ধতার উর্ধে নই। আবার আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যে এ সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন, তাও না।
প্রশ্ন : এর জন্য আমাদের সমাজব্যবস্থার ভিত্তিমূলে কোন দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতাকে আপনি চিহ্নিত করবেন?
উত্তর : আমাদের ব্যাপক জনগােষ্ঠী নিম্নবিত্ত অবস্থান থেকে উঠে আসা মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এটি অবশ্য সামগ্রিক অর্থে কোনাে অপরাধ বা অন্যায় নয়। প্রত্যেক জাতির বেলায়ই এমনটি ঘটে থাকে। কিন্তু যারা এই সীমাবদ্ধতা ও দুর্বল সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থানের কথা অস্বীকার করে, তাদের জীবন আচ্ছন্ন হয় ঘাের অমানিশায় কিংবা এক ধরনের বিচ্ছিন্নতায়। এর ফল খুবই মর্মান্তিক। বাংলাদেশের ৪৭ বছরের অসহনীয় বাস্তবতাকে আমাদের এভাবেই বিচার-বিবেচনা
পৃষ্ঠা: ২০০
করতে হবে। আমাদের জনগণকে এ বিষয়টি স্মরণে রাখতে হবে যে, আমাদের নিম্নবিত্ত মানসিকতাকে স্বীকার করে এবং একে যোগসূত্র হিসেবে ধরে নিয়েই মধ্যবিত্ত অবস্থা ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিন্তা- চেতনাকে ধারণ করে আমাদের জীবনমান সাজাতে হবে। তাহলেই আমরা আমাদের সঠিক ইতিহাস খুঁজে পাবাে। আর তখনই আমরা সামনের দিকে এগুতে পারবাে। আমাদের ইতিহাসের অনেক খণ্ডিত দিক আছে। ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রেও রয়েছে অসংলগ্নতা। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে লক্ষ্যহীন অনুকরণের ফলে তা জোড়াতালির রূপ নিয়েছে। এসব কিছুকে স্বীকার করে আমাদের অবস্থান নির্দিষ্ট করতে হবে।
সারা পথিবীব্যাপী বাঙালিরা ছড়িয়ে আছে । কম বেশী সব দেশেই আমাদের অবস্থান রয়েছে। কিন্তু বাঙালির দেশ একটিই—সে হলো বাঙালির এই ‘জাতিরাষ্ট্র’ বাংলাদেশ। সুতরাং আমরা বাঙালিরা যে যেখানেই থাকি না কেন, আমাদের এই নৃতত্ত্বভিত্তিক জাতিত্বকে স্বীকার করেই আমাদের অবস্থান। এমনিভাবে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে চীনা ভাষাভাষী, ইংরেজ ভাষাভাষী, স্প্যানিশ ভাষাভাষী আবর ভাষাভাষীরাসহ আরও অনেক জনগােষ্ঠী। এখন চলছে বাঙালির তৃতীয় জাগরণ এর কাল। এই তৃতীয় জাগরণ- এর কালে আমরা যদি আমাদের নৃতাত্তিক পরিচয় অর্থাৎ বাঙালি জাতিকে সামাজিক- সাংস্কৃতিক ভাবে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করাতে পারি, তাহলে আমরাও অন্যসব জাতির মতাে একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতা গঠনে অংশীদার হতে পারবাে।
স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সশস্ত্র যুদ্ধ বিষয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে, এ কথা সত্য। কিন্তু যেহেতু এসব বইয়ের রচয়িতারা কেউই ২৫ মার্চের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বাধীনতার কথা ভাবতে পারেননি তাদের লেখায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ পড়ে গেছে। এটা স্বাভাবিক। তারা নিজের মতাে করে যা দেখেছেন বা ভেবেছেন তাদের লেখায় সেসব বিষয়ই স্থান পেয়েছে। সশস্ত্র যুদ্ধের ইতিহাস লেখা অনেক বিশাল কাজ এবং তা অনেক সময়সাপেক্ষও। দীর্ঘদিনের গবেষণার মধ্য দিয়ে যদি কোনাে লেখক-গবেষক বা ইতিহাসবিদ এ কাজে হাত দেন তবে অবশ্যই তার পক্ষে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের যথার্থ ও বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস লেখা সম্ভব।
পৃষ্ঠা: ২০১
প্রশ্ন : বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ‘নিউক্লিয়াস’-এর সম্পর্ক ছিল কী?
উত্তর :১৯৬০ দশকের মাঝামাঝিতে এমন একজন বাঙালি বুদ্ধিজীবীকেও পাওয়া যাবে না, যিনি জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে রাজনৈতিক সাহিত্য রচনা করেছেন। ১৯৬৫-এর পর আমাদের কোনাে কবি, লেখক বা সাহিত্যিক স্বাধীনতা সংগ্রামকে উজ্জীবিত করতে পারে এমন একটি গল্প, উপন্যাস, কবিতা এমনকি একটি ছড়াও লিখেছেন এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে না। যেসব লেখা পাওয়া যায় সেগুলাে হলাে শ্রেণীভিত্তিক লেখা। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লেখা। ১৯৭১-এর মার্চ মাসের পূর্ব পর্যন্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কোনাে লেখা দেখা যায়নি। ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’-এর প্রভাবে সে সময়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের তরুণ সাহিত্য-সংস্কৃতি কর্মীরা এ দিক থেকে ব্যতিক্রম ছিল। তারা যেসব রাজনৈতিক সাহিত্য সৃষ্টি করেছে সেগুলােই ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রধান কাজ। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে কার্টুন তৈরি, পােস্টার লেখা, নিয়মিত দেয়াল পত্রিকা ও বিভিন্ন সম্মেলন উপলক্ষে ম্যাগাজিন প্রকাশ, জাতীয় দিবস উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ঢাকার আর্ট কলেজে শিল্পকর্ম প্রদর্শন—এসব কর্মকাণ্ডই ছিল ছাত্র-যুব সমাজের মতামত প্রকাশের প্রধান বাহন।
“নিউক্লিয়াস’ নেতবৃন্দের সঙ্গে দুজন বুদ্ধিজীবী সরাসরি যােগাযােগ রক্ষা করতেন। তারা হলেন, এডভােকেট কামরুদ্দীন আহমদ এবং ড. আহমদ শরীফ। ১৯৬০-এর দশকের প্রথম থেকে ১৯৭০-এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে যেসব বুকলেট, লিফলেট, হ্যান্ডবিল ও পত্রিকা প্রকাশ হয় তার সবকিছুর তত্ত্বাবধানে ছিল “নিউক্লিয়াস’। ‘নিউক্লিয়াস’-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গাড়ির নাম্বার, দোকান-পাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাইনবাের্ড বাংলায় লেখার আন্দোলন সংঘটিত হয়। এ সময় গােপনভাবে ‘বিপ্লবী বাংলা’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ হতাে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের অনুপস্থিতিতে বক্তব্য-বিবৃতি ও দলীয় সকল কার্যক্রম ‘নিউক্লিয়াস’-এর উদ্যোগেই পরিচালিত হতাে। এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের মূল বক্তব্য ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
পৃষ্ঠা: ২০২
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ তিনি ‘নিউক্লিয়াস’ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলােচনা করেই দিয়েছিলেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে ‘নিউক্লিয়াস’ নেতৃবৃন্দের মতবিরােধও হয়েছিল । অসহযােগ আন্দোলন চলাকালে ভেঙে পড়া প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে বিভিন্ন ব্রিগেড বা কর্মী বাহিনী দিয়ে পরিচালনা করা, বিডিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসা সৈন্যদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা ও আস্তানা গড়ে তােলার উদ্যোগও গ্রহণ করেছিল ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’। ‘বিএলএফ’ ছিল ‘নিউক্লিয়াস’-এর রাজনৈতিক উইং ।
প্রশ্ন: সশস্ত্র যুদ্ধ সম্পর্কে যে সব লেখালেখি হয়েছে সেই বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
উত্তর: মধ্যবিত্ত মানসিকতায় আচ্ছন্ন কোনাে লােকের পক্ষে আত্মজীবনমূলক রচনা বা ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। প্রায় সবার ক্ষেত্রেই কথাটি প্রযােজ্য। এখানে যে সীমাবদ্ধতা কাজ করে তা হচ্ছে স্বভাবজনিত কারণেই আমাদের ভুলত্রুটি, দুর্বলতা, দৈন্য, সংকীর্ণতা-মােটকথা যে-কোনাে বিষয় বা ঘটনাকে বাড়িয়ে বলা বা ছোট করে দেখা। একইভাবে আবার কাউকে ‘দেবতা’ বানানাে। এ দূর্বল মানসিকতাপূর্ণ আমাদের চিন্তা-চেতনা। বাস্তব সামাজিক অবস্তাকে অস্বীকার করে, নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া ও বিষয়বস্তুর গভীরতাকে আত্মস্থ না করে আত্মজীবনীমূলক রচনা বা ইতিহাস লেখা কি আদতে সম্ভব? আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক- অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুণগত শিক্ষা ও মানের যে অনগ্রসরতা, পশ্চাদপদতা ও দুর্বলতা রয়েছে তা কি আমরা জানি বা স্বীকার করি? দেশ-কাল-সমাজভেদে মূল্যবােধের যে ভিন্নতা হয় তা কি সত্যিসত্যি আমরা বুঝি? ধর্মীয় বা সামাজিক মূল্যবােধ যে সমার্থক নয়, সে ধারণা কি আমাদের আছে? এসব সীমাবদ্ধতা নিয়ে আত্মজীবনীমূলক রচনা বা ইতিহাস বিষয়ক লেখাকে আমি সাজানাে বা সুন্দরভাবে গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলার সমতুল্য বলে মনে করি। তবে কেউ যদি তার জীবনের কিছু ঘটনা নিয়ে জীবনকাহিনী লেখেন সেটি ভিন্ন কথা। পৃথিবীতে সেরকম স্মৃতিকথা আত্মজীবনী লেখকের সংখ্যা হাতে গােণা মাত্র। এসব কিছু বুঝেই আমি যদি কখনাে কিছু লিখি তার শিরােনাম হবে ‘আমার সীমাবদ্ধতা’।
পৃষ্ঠা: ২০৩
প্রশ্ন : বাংলাকে কেন একটি প্রকৃত স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারা গেল না?
উত্তর : ১৯৪৭ সালের ভারতবিভক্তি সর্বস্তরের নেতৃত্বের মধ্যে এ ধারণা জন্ম দিয়েছিল যে, ধর্মই হচ্ছে উপমহাদেশের জনগণের জাতীয়তার ভিত্তি, ভাষা বা সংস্কৃতি নয়। তারা ধরে নিয়েছিলেন যে, হিন্দু ও মুসলমান জাতিভিত্তিক ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টি উপমহাদেশের রাজনীতিতে জাতিভিত্তিক নতুন দেশ সৃষ্টির শেষ কথা। এর অনেক আগেই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যু হয়েছে। সুভাষ বসু ১৯৪০ সাল পর্যন্ত থেকেও উঠতি পুঁজিপতি ও সম্প্রদায়িক শক্তি নিয়ন্ত্রিত ভারতের রাজনীতির ষড়যন্ত্রের শিকার। শের-এ-বাংলা, সােহরাওয়ার্দী, শরৎ বসু, আবুল হাশিমদের রাজনীতি জিন্নাহ ও গান্ধীর রাজনীতির কাছে তখন পরাজিত । অবিভক্ত বাংলা গঠনের প্রথম চেষ্টা নিষ্ফল হওয়ায় পাকিস্তান ও ভারতকে মেনে নিয়েই রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নিলেন সকলে। বুদ্ধিবৃত্তির জগতেও হিন্দুত্ব বা মুসলমানিত্বের প্রবণতা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জগৎকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। পরপর কয়েকবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বিষয়টিকে আরও জটিল করে তােলে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিও ভারত-পাকিস্তানকে মুখােমুখি দাঁড় করাবার প্রতিযােগিতায় নামলাে। একদিক থেকে এটি ছিল পাকিস্তান ও ভারতের জন্য বৃহত্তর অর্থে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র । শিক্ষাব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাব দুটি দেশের দূরত্বকে আরও বাড়িয়ে দিল। উপমহাদেশের শাসন পদ্ধতির ভিন্নতা, সর্বোপরি বৃদ্ধিবৃত্তির শূন্যতা, আর সেই শূন্যতা পূরণ করার জন্য ভারতে বৈদিক হিন্দুত্ব আর পাকিস্তানি শাসকদের স্বকপােলকল্পিত ইসলামী ভাবধারা আমদানি করা হলাে। ফলে উপমহাদেশের সার্বিক উন্নয়নে সৃষ্টি হলাে জটিলতা, দেখা দিল রাজনৈতিক সংকট ও অস্থিরতা।
এতসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও রাজনীতির একটি ভিন্ন ধারা কিন্তু প্রবহমান ছিল। উপরন্তু পূর্ব বাংলার উপর পশ্চিম পাকিস্তানের শােষণ আর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত এখানকার মধ্যবিত্তের চিন্তা- চেতনায় বাঙালি জাতিত্বের বিষয়টি আবার জাগিয়ে তুললাে । অপরদিকে পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা নিজেদের বাঙালির চাইতে
পৃষ্ঠা: ২০৪
ভারতীয় হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি গর্ববােধ করতাে। তেমনি একটি পরিস্থিতিতে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলার গণচেতনায় একটি নতুন মাত্রা যােগ করলাে। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের রায় বাঙালিত্বের পক্ষে যেন একটি ম্যান্ডেট হিসেবে ঘােষিত জাতিত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য হতে পারে, অতীতের জাতিত্বের সংজ্ঞার সঙ্গে তা একটি নতুন বিষয় হিসেবে যুক্ত হলাে । কিন্তু দলীয় কোন্দল, ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব এবং সামরিক শাসনের ফলে পুনরায় মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাটি চাপা পড়ে যায় এবং উপযুক্ত সাংগঠনিক কাঠামাে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচির অভাবে বাঙালি জাতীয়তাভিত্তিক রাজনীতি পেছনে পড়ে। যায়। এ পর্যায়ে পাকিস্তানভিত্তিক রাজনীতি করার বিষয়টি আবার প্রাধান্য পেতে থাকে।
প্রশ্ন : স্বাধীন বাংলা ‘নিউক্লিয়াস’-এর শুরু কী করে হয়?
উত্তর: ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন রিপাের্টের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের দাবিতে বছর ধরে ছাত্র আন্দোলন চলে। কেন্দ্রীয় সরকার বিরােধী এ আন্দোলন আমার মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তােলে। এ আন্দোলন চলাকালেই আমি, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমদ আমরা তিনজন একে অপরের ঘনিষ্ঠ হই। স্বাধীন দেশের উপযােগী শিক্ষাব্যবস্থা পরাধীন পাকিস্তানে সম্ভব নয়—এই উপলব্ধি আমাদের তিনজনের সম্পর্ককে আরও গভীর করে তােলে। আলােচনার এক পর্যায়ে স্বাধীনতার চিন্তাটি আমাদের আলােচনায় চলে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সে সময়টিতে পরাধীন দেশগুলাের স্বাধীনতার জন্য আর্তি, এশিয়া-আফ্রিকার অনেকগুলাে দেশের স্বাধীন জাতি হিসেবে অভ্যুদয়ের ঘটনাও আমাদের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তােলে। প্রাথমিক পর্যায়ে তৎকালীন পল্টনের আউটার স্টেডিয়ামে গভীর রাতে আমাদের বৈঠক হতাে। সেসব বৈঠকের সূত্র ধরে পরে ইকবাল হলের মাঠে (টেনিস গ্রাউন্ড) স্বাধীনতা আন্দোলনের অঙ্কুর হিসেবে ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন করা হয়। শুরুতে এতে আমরা চারজন সদস্য ছিলাম—আমি, রাজ্জাক, আরেফ ও আবুল কালাম আজাদ। আজাদ দুই বছর ‘নিউক্লিয়াস’-এ সক্রিয় থাকার পর পারিবারিক প্রয়ােজনে নিজেই অব্যাহতি নেয়।
পৃষ্ঠা: ২০৫
অব্যাহতি নেওয়ার পরেও ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সে গ্রুপের একজন আন্তরিক ও একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে আমাদের সহায়তা করেছে।
প্রশ্ন : নিউক্লিয়াস ও ছাত্রলীগের পারস্পরিক সম্পর্ক কী ছিল?
উত্তর : ছাত্রলীগের অভ্যন্তর থেকে ‘নিউক্লিয়াস’-এর সদস্য সংগ্রহের উদ্দেশ্য ছিল মূলত ছাত্রলীগকে শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে দাঁড় করানাে। ছাত্রলীগকে ‘নিউক্লিয়াস’-এর ছাতা হিসেবে ব্যবহার করা হতাে এবং এর ছায়ায় থেকে গােপন কাজ করা অনেক সহজ ছিল। ১৯৬৫ সালে আমি জেল থেকে বেরােনাের পর ‘নিউক্লিয়াস’-কে একটি রাজনৈতিক ছাপ দেওয়ার প্রয়ােজন বােধ করি। আর তা থেকেই ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ গঠন করা হয়। ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ ছিল আসলে একই সংগঠন। কাজের সুবিধার জন্য কখনও ‘নিউক্লিয়াস’, আবার কখনও ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নাম ব্যবহার করা হতাে।
প্রথম দুই-তিন বছর বিপ্লবী পরিষদের কাজ ছিল সদস্য সংগ্রহ করা। মামুলি ধরনের রাজনৈতিক (মিছিল-মিটিং) কাজে সীমাবদ্ধ না থেকে তখন জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের উপর গুরুত্ব দেওয়া হতাে। স্বাধীনতার লক্ষ্যে কাজ করার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে বই-পুস্তক সংগ্রহ ও পড়া বাধ্যতামূলক ছিল। সে সময়ে এসব বিষয়ের ওপর লেখা বইপত্র ছিল ইংরেজিতে, তা দুষ্প্রাপ্যও ছিল।
এ পর্যায়ে সােভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও ভিয়েতনামসহ কমিউনিস্ট আন্দোলনের ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ কম ছিল। এসব দেশ ও তাদের সমাজতন্ত্রের নীতিমালা স্বাধীন চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে সহায়তা না করলেও এসব দেশের ঘটনাবলী এবং তাদের সাহিত্য পাঠে আমি ব্যক্তিগতভাবে উৎসাহী ছিলাম, অন্যদেরও পড়ার পরামর্শ দিতাম। তবে কোনাে বাধ্যবাধকতা ছিল না।
প্রশ্ন : ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ ও পাকিস্তানের কাঠামােতে থেকে ‘স্বায়ত্তশাসন’– ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে এই দুই ধারা কীভাবে চলতাে?
উত্তর : আমাদের কৌশল ছিল ছাত্রলীগের প্রধান নেতৃত্বেও পদ (সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক) যাতে স্বাধীনতার পক্ষের দখলে থাকে তা নিশ্চিত করা। দুজন না হলেও, একজন তাে হতেই হবে। এই কৌশল ‘নিউক্লিয়াস’-এর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধিও পক্ষে খুবই সহায়ক।
পৃষ্ঠা: ২০৬
হয়েছিল। ছাত্রলীগের তরফে তাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণে বিষয়টি প্রচারের ওপর গুরুত্ব দিতে বলতাম। জেলা পর্যায়ের ছাত্রলীগ সম্মেলনের পর ছােটখাট জনসভা করে পাকিস্তানি শাসকদের এই বৈষম্য-বঞ্চনার কথা প্রচার করতে বলতাম। সে সময় অন্য কোনাে ছাত্র বা রাজনৈতিক সংগঠন আমাদের মতাে করে এ বক্তব্য দিত না ।
১৯৬৫ থেকে ৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে দক্ষ ব্যক্তিরা পাকিস্তানভিত্তিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। শেখ মুজিবুর রহমান ৬-দফা উত্থাপন করার পর বামপন্থী রাজনীতিবিদরা ৬-দফাকে সমর্থন করা তাে দূরের কথা, ৬-দফাকে সিআইএ-ও কর্মসূচি এবং শেখ মুজিবকে ভারতের এজেন্ট হিসেবে চিত্রিত করতাে। এ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে একমাত্র ছাত্রলীগই পূর্ব পাকিস্তানের স্বতন্ত্র রাজনীতির পক্ষে শিল্প-সাহিত্য ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের নিয়ােজিত রেখেছিল। ছাত্র ইউনিয়নেরও অনেকে যেমন আহমদ ছফা, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা প্রমুখ বিচ্ছিন্নভাবে সংগ্রামী ধারার শিল্প-সাহিত্য চর্চার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নের তরুণ সংস্কৃতি কর্মীদের এই তৎপরতার মুখে প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীরা এক রকম রাজনীতির আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে অবশ্য এই শ্রেণীটি তাদের অতীত কলঙ্ককে আড়াল করে আওয়ামী লীগের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। এ হলাে সাপের খােলস বদলানাের মতাে ব্যাপার।
প্রশ্ন : সে সময় শেখ মুজিব স্বাধীনতা সম্পর্কে কী ভাবতেন?
উত্তর : মুজিব ভাই ও আমার সম্পর্কেও গভীরতা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। যে কোনাে আলােচনায় আমার অন্তর্ভুক্তি এবং তার সার্বক্ষণিক সাহচর্যেও সুযােগ আমাকে বলতে গেলে তার পরিবারের একটি অংশে পরিণত করেছিল। আলাপ-আলােচনায় তাঁকে আমি কোনােদিনই ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি উচ্চারণ করতে শুনিনি। তাঁর আলাপ- আলােচনার বিষয় ও ধরন এত গভীর ও বহুমুখী ছিল যে, তিনি ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি ব্যবহার না করলেও বক্তব্যের মর্মবস্তু যে ‘স্বাধীনতা’ তা বুঝতে কখনােই আমার অসুবিধা হয়নি। যে বুদ্ধিজীবীরা বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার ক্ষেত্রে দাস্য মনােবৃত্তির পরিচয় দিয়েছেন, ‘স্বাধীনতা’র বিরুদ্ধে
পৃষ্ঠা: ২০৭
থেকেছেন, এখন তাঁরাই দেখি ‘স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। এরা বলতেন, ‘শেখ মুজিব তাে স্বাধীনতা চাননি, ছাত্রদের চাপের মুখে তিনি স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যান।’ মুজিব ভাইয়ের ব্যাপারে এই ধারণার আমি শুধু বিরােধীই নই, মুজিব ভাইয়ের কূটনৈতিক কৌশল অনেক সময় আমাকে অবাক করেছে। গার্ডিয়ান পত্রিকার এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন : ‘Do you declare Independence’? উত্তরে মুজিব ভাইয়ের দুই শব্দের ‘Not yet’ আমাকে অবাক করে দিয়েছিল। আমি কখনোই তাঁকে ‘ধন্যবাদ’ ইত্যাদি শব্দ দিয়ে কোনােকিছু বলতাম না। সাংবাদিক সম্মেলনের পর একই সঙ্গে মুজিব ভাই, আমিনুল হক বাদশা ও আমি ৩২ নম্বরে তার বাসায় ফিরে আসি। আমি নিজেই তার ‘Not yet’ প্রসঙ্গটি তুলতেই তিনি বললেন, ‘খুশি হয়েছিস তাে?’
মুজিব ভাই আমাকে কখনাে কোনাে কাজের জন্য ফরমায়েশ দিতেন না। তিনি বুঝতেন আমার চব্বিশ ঘণ্টাই ছিল রাজনীতির জন্য। জেল থেকে মুক্ত হয়ে রেসকোর্স ময়দানে জনসভার পর তাঁকে আমি আদমজি নগরে জনসভা করতে বললাম। জনসভা শেষে ফিরে আসার সময় আমি তার জিপের বনেটের সামনে বাম্পারের ওপর বসে ছিলাম। আসার পথে দু’পাশে সারিবদ্ধ মানুষের হাততালি এবং মাঝে-মধ্যে ডাইভার ব্রেক কষে গাড়ির গতি হ্রাস করার এক পর্যায়ে আমি পড়ে গিয়ে গাড়ির তলায় চলে যাই। আমার হাত-পা কেটেছিড়ে যায়। পায়ের গােড়ালিতে বড় ধরনের ব্যথা পাই। তিনি চিৎকার করে গাড়ি থামাতে বললেন। আমাকে তুলে এনে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। আমি তার পাশে দাঁড়ানাে। গাড়ি চলছে। আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে বললেন, ‘সিরাজ, আজ যদি তাের কিছু হতাে, আমার রাজনীতি শেষ হয়ে যেত।’
গাড়ি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এলাে। এক্সরে ও ব্যান্ডেজ করা পর্যন্ত তিনি থাকলেন এবং গাড়িতে করে আমাকে এসএম হলে নামিয়ে দিয়ে দুদিন বিশ্রাম নিতে বললেন।
প্রশ্ন : ১৯৭০-এর নির্বাচনে কী ভূমিকা রেখেছিলেন?
উত্তর : ১৯৭০-এর নির্বাচন নিঃসন্দেহে ছিল আওয়ামী লীগের পক্ষে বিরাট গণরায়। মওলানা ভাসানী সে নির্বাচন বর্জন করার ঘােষণা
পৃষ্ঠা: ২০৮
দিয়েছিলেন। ন্যাপ (মুজাফফর) নির্বাচনে অংশ নিলেও তারা ছিল শক্তিহীন। নির্বাচনী প্রচারণার শেষদিকে তারা অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের প্রতি সমর্থন দিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় । ইয়াহিয়ার নির্বাচন ঘােষণার পরপরই আমরা (নিউক্লিয়াস) সিদ্ধান্ত নিলাম৷ গণআন্দোলনে জনগণের উচ্ছাসের অভিব্যক্তি ঘটে থাকে, সেটা প্রকৃত অর্থে জনমত নয়। জনমতের প্রমাণ পাওয়ার একমাত্র উপায় নির্বাচন । অন্য কেউ নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে’র পক্ষ থেকে আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করি। আমাদের এই ঘােষণায় মুজিব ভাই খুবই খুশি হয়েছিলেন। নির্বাচনটা ছিল আমাদের রাজনীতির এক জটিল অধ্যায়, বিশেষ করে সে সময়কার নির্বাচন। এই নির্বাচনকে আমরা ‘৬-দফা ও ১১-দফা-না হলে ১-দফা’ এ বক্তব্য ছড়িয়ে দেওয়ার উপযুক্ত সময় ও কৌশল হিসেবে গ্রহণ করি।
‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’-এর তিন হাজার সদস্যকে আমরা সে সময় প্রার্থীদের নির্বাচনী এলাকায় সার্বক্ষণিকভাবে থাকার নির্দেশ দিই। তাদের নির্বাচনী এলাকায় যাবার খরচটি আমরা সংগ্রহ করে দিতাম। তাদেরকে নির্বাচন পর্যন্ত বাকি সময়টুকু এলাকাতে থেকে একেবারে নির্বাচন শেষ করে ঢাকায় আসতে বলা হয়। মনিরুল ইসলামের (মার্শাল মনি) নেতৃত্বে ঢাকা থেকে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে এ কার্যক্রমটি পরিচালিত হয়েছিল। ঢাকা শহরের দায়িত্বে ছিল কাজী আরেফ । নির্বাচনের সাত দিন আগে আমি মুজিব ভাইকে বলেছিলাম, আমরা ১৬৯ সিটের মধ্যে ১৬৭টিই পাবাে। বিশ্বাস করার কথা নয়। তবে মুজিব ভাই মনে হয় বিশ্বাস করেছিলেন। আমাদের আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল, এ নির্বাচনে ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে আসা বড় একটি অংশকে মনােনয়ন দেওয়া। আমাদের পরামর্শ মতাে মুজিব ভাই তাও করেছিলেন।
ঐ সময় আমার মনে হতাে জনগণকে সংগঠিত করা ও জনসমর্থন আদায় করার ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণভাবে আমাদের ওপর নির্ভর করতেন। আমি তখন তাকে আমার কোনাে বক্তব্যের বিরুদ্ধে কিছু বলতে বা করতে শুনিনি বা দেখিনি।
পৃষ্ঠা: ২০৯
আমি এও দেখেছি সংগঠনসহ বহু বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্নে তিনি বলতেন, ‘ওটা সিরাজের কাছ থেকে জেনে নিস।’
প্রশ্ন : তখন আপনারা কোথায় কোথায় বসতেন?
উত্তর : ছাত্রলীগের এক বিরাট অংশ যারা ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদেরকে নিয়ে প্রতিদিন গভীর রাতে গ্রুপ আকারে আমি, রাজ্জাক, মার্শাল মনি, মাহবুব, ইনু, আম্বিয়াসহ অনেকেই আমরা ভাগ ভাগ করে নীলক্ষেতের আনােয়ার হােটেল, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী হাসিনা হােটেল, পপুলার রেস্টুরেন্ট, কাফে কাশ রেস্টুরেন্টে বসতাম। সেক্রেটারিয়েটের পেছনে কিসমত ও আরেকটি রেস্টুরেন্টও আমাদের আলাপ-আলােচনার জন্য ব্যবহৃত হতাে।
প্রশ্ন : জেনারেল জিয়াউর রহমানকে আপনি কীভাবে দেখেন?
উত্তর : ২৭ মার্চ, ১৯৭১-এ চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে মেজর জিয়ার আহ্বান সে সময়ে হতাশাগ্রস্ত জনগণকে স্বাধীনতার ব্যাপারে আশান্বিত করে তােলে। স্বাধীনতা যুদ্ধেও পরিকল্পনা প্রণয়নের একেবারে প্রথম পর্যায়ে সেনাপ্রধান জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীর সঙ্গে তৎকালীন সেনাধ্যক্ষরা ও ‘বিএলএফ’ হাই কমান্ডের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় মেজর জিয়াউর রহমানও উপস্থিত ছিলেন। যুদ্ধ তখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। কেবল তারাই নন, আমরাও যে যুদ্ধেও জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, সে কথা ঐ সভায় তাদেরকে জানানাে হলাে। এ ছাড়াও ২৫ মার্চেও আগে ‘বিএলএফ’-এর কার্যকলাপের প্রাথমিক ধারণাও সেনাপ্রধান ওসমানী সাহেব তাদের কাছে তুলে ধরেন।
যুদ্ধ চলার সময় জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমার আর কোন দেখাসাক্ষাত হয়নি। ১৯৮১ সালের ৯ মে তিনি যখন প্রেসিডেন্ট তখন আরেকবার তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। সে মাসের ৩০ তারিখেই তিনি নিহত হন।
প্রশ্ন : জেনারেল এরশাদ সম্পর্কে কী বলবেন?
উত্তর : এরশাদের সঙ্গে আমার সব মিলিয়ে চারবার দেখা হয়েছে। প্রথম সাক্ষাতেই আমার ১৪-দফা কর্মসূচির প্রাথমিক খসড়া নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলােচনা হয়। উপজেলাভিত্তিক প্রশাসন ব্যবস্থা আমার ও তাঁর উভয়েরই প্রস্তাবিত কর্মসূচি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাঁরই
পৃষ্ঠা: ২১০
দলের সংসদ সদস্যদের চাপে তিনি উপজেলা ব্যবস্থার বহু কিছুতে সদস্যদের প্রভাব খাটানাের সুযােগ করে দেন, যা ছিল স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য-বিরােধী।
পরের তিনবারের মধ্যে দুবার তার সঙ্গে আমার সাক্ষাতে আলােচনার বিষয় ছিল, সংসদে উচ্চকক্ষ গঠন। মুখে মুখে তিনি বিষয়ে রাজি হলেও কোনাে কিছুই করেননি।
আমাদের দেশের বড় বড় সেনাধ্যক্ষরা যুদ্ধ না করেই বাহিনীতে দীর্ঘদিন চাকুরিরত থাকার ফলে সিনিয়রিটির ভিত্তিতে প্রমােশন পেয়ে পেয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পর্যন্ত হয়ে যান। জেনারেল এরশাদকে আমার কাছে অন্য সেনাপ্রধানদের মতােই একজন বলে মনে হয়েছে। তার সঙ্গে আমার তৃতীয় বৈঠকটি হয়েছিল প্রথম কুয়েত যুদ্ধের সময়। আমি তাকে বলেছিলাম, ভারতকে না জানিয়ে ঐ যুদ্ধে বাংলাদেশের পাঁচ হাজার সেনাসদস্যকে সৌদি আরবে পাঠানাে এক বড় ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত এবং এতে আন্তর্জাতিকভাবে কেউ কেউ খুশি হলেও তা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি বিরােধী আর তাতে ভারত অসন্তুষ্ট হবে। পরবর্তীকালে এরশাদের পতনের পেছনে সুক্ষ্মভাবে হলেও এটি কাজ করেছিল। এ প্রসঙ্গে একটু বিশদভাবে জানতে চাইলে আমি এরশাদকে বলেছিলাম, আর এক মাস পর ভারত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিকল্প সদস্য হবে। আমেরিকার কাছে আমাদের পাঁচ হাজার সৈন্য পাঠানাের চাইতে নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের সমর্থনের প্রয়ােজন অনেক বেশি।
শেষবার তার সঙ্গে আমার দেখা হয় তার ক্ষমতা ত্যাগের একদিন আগে। বললেন, তিনি পদত্যাগ করছেন। আমি ঐ সাক্ষাতের সময় তাঁকে দুবার সেনাপ্রধান নূরুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। দুবারই তিনি নুরুদ্দিনকে সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা দখল করতে বলেন। নূরুদ্দিন তার কথা শােনেননি।
পৃষ্ঠা: ২১১
পরিশিষ্ট : ৩
প্রশ্নোত্তর : শামসুদ্দিন পেয়ারার সঙ্গে
প্রশ্ন : প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক কেমন ছিল?
উত্তর : প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আমাদের (বিএলএফ) সবার সম্পর্ক একই ধরনের ছিল না। শেখ মনি তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে আপােসহীন মনােভাব পােষণ করতাে। কী কারণে তার এ অবস্থান আমি আজ পর্যন্ত জানি না। অথচ মুজিব ভাই নিজেই আমাদের চারজনকে ডেকে তাজউদ্দীন ভাইয়ের সামনে বলেছিলেন, আমার অবর্তমানে তােমরা তাজউদ্দীনের সঙ্গে আলােচনা করে কাজকর্ম করবে।
অনেকে বাইরে থেকে আমার ও মনির মধ্যে শীতল সম্পর্কের আভাস পেতেন। কিন্তু কার্যত মনির সঙ্গে আমার শীতল সম্পর্ক অথবা ঠাণ্ডা লড়াইয়ের কোনাে কারণই ঘটতাে না। যুদ্ধের সময় তাঁর দায়িত্ব ছিল পূর্বাঞ্চলে। আমার দায়িত্ব ছিল উত্তরাঞ্চলে। উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের দায়িত্বে ছিল আবদুর রাজ্জাক ও পশ্চিমাঞ্চলে তােফায়েল আহমেদ।
আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধের সব অর্থ সংস্থান করতাে ভারত। ট্রেনিং দিত ভারত। অস্ত্র দিত ভারত। এফএফ-এর জন্য কত বাজেট, তা আমরা জানতাম না। ‘বিএলএফ’-এর বাজেট আমরা তৈরি করেছিলাম সর্বমােট ৭৮ (আটাত্তর) লাখ ভারতীয় রুপি। এর মধ্যে ৫৬ (ছাপান্ন) লাখ আমাদের মাধ্যমে খরচ হয়েছিল।
অঅভ্যন্তরীণ সংকট কাটিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রক্রিয়ায় আমরা (বিএলএফ) সরাসরি জড়িত হয়ে তাজউদ্দীন আহমদ ও খন্দকার মােশতাক আহমেদের দ্বন্দ্ব সাময়িকভাবে হলেও নিরসন করেছি। প্রবাসী সরকারের প্রথম দিককার সবকটি সভায় আমরা (বিএলএফ-এর চারজন) উপস্থিত থাকতাম, যদিও সরকারের কোন প্রকার পদ বা পদবি আমরা ধারণ করতাম না ।
প্রবাসী সরকার গঠন এবং সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয় গঠনের এক পর্যায়ে আমি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সামনে স্বাধীনতায় বিশ্বাসী আরও কয়েকটি দলকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা সম্ভব কি না—এ বিষয়ে আলােচনা তুলতেই সৈয়দ নজরুল বলে বসলেন, ‘কেন তারা সরকারে থাকবে?’ আমি বললাম, তাতে স্বাধীনতার বিষয়টি দলের উর্ধ্বে জাতীয় রূপ পাবে। আমি দুই-তিনবার কথাটা বললাম। তিনি আমার কথার উত্তর তাে দিলেনই না, বরং বললেন, ‘যাদের দশজন সমর্থকও নেই, তাদেরকে তুমি সরকারে নিতে বলাে?’ আমি তখন ন্যাপ (উভয়)-এর কথা বলতেই তিনি কটা করে বললেন, সরকারে যােগ দিতে হলে তাদের সাইনবাের্ড নামিয়ে আওয়ামী লীগে আসতে হবে। এক সময় মুজিব ভাইও এ কথাই বলতেন। কিন্তু মুজিব ভাইয়ের বলা এবং সৈয়দ নজরুলের বলার মধ্যে পার্থক্য ছিল। আমি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বললাম, যুদ্ধ শুরুর দু’মাস পরে উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের চাইতে যুদ্ধের শুরুতে প্রবাসী সরকারের মধ্যে ন্যাপকে অন্তর্ভুক্ত করলে আজ ভারত- রাশিয়ার ডিকটেশনে চলতে হতাে না। আমরা চারজন বিভিন্ন বেইস এলাকা থেকে যখনই কলকাতায় আসতাম, প্রবাসী সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করতাম। তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া আর কাউকে খুব বেশি কাজে ব্যস্ত থাকতে কখনও দেখিনি। বাদবাকি মন্ত্রীরা যার যার এলাকার এমপিদেরকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। আমরা কোনাে বিষয়ে মন্ত্রীর পরামর্শ চাইলে বলতেন, এসব ভারত সরকারের সঙ্গে আলােচনা না করে বলতে পারবাে না।’ এতে তাদের নিজেদের অক্ষমতা ছাড়াও ভারত সরকারের কাছে তারা যে অস্তিত্বহীন সেটাই প্রমাণিত হতাে। তাজউদ্দীন ভাইয়ের বিষয়টি ছিল একেবারে আলাদা। সকাল ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত
পৃষ্ঠা: ২১৩
বিরতিহীনভাবে কাজ করার দক্ষতা তার ছিল। ভারত সরকার তার সঙ্গেই নিয়মিত যােগাযােগ রক্ষা করার প্রয়ােজন বােধ করতাে।
১৭ এপ্রিল প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভা শপথ নেবার পরে কোলকাতায় ফিরে এলে আমি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে জিজ্ঞেস করলাম, তার বক্তৃতা রাষ্ট্রপতির উপযুক্ত বক্তৃতা হয়েছে কিনা। আরও বললাম, তার বক্তৃতায় মুজিব ভাইয়ের প্রসঙ্গটা কী ধরনের ছিল?
আমার প্রশ্নটা শেষ না হতেই তিনি যা বললেন, তাতে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লাে। আমি এক কথায় বােকা বনে গেলাম। তার সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ে আমি উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। সে সময়ে আমার সঙ্গে তােফায়েল আহমেদও ছিলেন। আমরা দুজনেই বেরিয়ে এলাম। এরপর সৈয়দ নজরুলের সঙ্গে প্রায় দুই মাস পর দেখা। আমি একটু অসৌজন্যমূলকভাবে সালাম না দিয়েই সােফায় বসলাম। সৈয়দ নজরুল বললেন, ‘সিরাজ কতদিন পরে আসলা? তােমার রাগ ভাঙতে এতদিন লাগলাে?’ এবার আমরা দুজন ছিলাম । কিছু জরুরি কথা বলে চলে এলাম।
প্রবাসী সরকারের অন্য মন্ত্রীদের সঙ্গেও দাওয়াত খাওয়া ছাড়া আর কোনাে প্রয়ােজনে আমার যাওয়া হতাে না। মন্ত্রী হিসেবে তাদেরও কোনাে কাজ ছিল বলে মনে হতাে না। তাজউদ্দীন ভাইয়ের সঙ্গেই আমার যােগাযােগ ছিল। নিয়মিত আলাপ-আলােচনা হতাে। রাত ১০টায় সাক্ষাৎ করার সময় দিয়ে কখনােই রাত একটার আগে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতে পারতেন না। এতই ছিল তাঁর ব্যস্ততা। ওনার অফিসেই আমি সােফায় বসে আমি এ দুই-তিন ঘণ্টা কাটাতাম। প্রায় সাক্ষাতের দিনই এ রকম হতাে। কাজ শেষ করে গােসল করতেন। খাবারে বসতেন আমাকেসহ। সামান্য খাবার খেতেন। তারপর দুই ঘণ্টার মতাে কথা হতাে। অফিস রুমের পেছনেই ছিল তার শােয়ার ঘর। একটি পালঙ্ক। পরিপাটি বিছানা। এসব কাজে সহায়তা করার জন্য তার একজন সহকারী ছিল। সকাল ৮টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে নাশতা খেয়েই কাজে বসে যেতেন। কোনরকম অবান্তর বা অবাস্তব কথা বলতেন না। আমাদের কাজ কেমন হচ্ছে বিস্তারিত জানতে চাইতেন না। ভালাে হচ্ছে কি না এই শুধু জিজ্ঞেস করতেন।
পৃষ্ঠা: ২১৪
সরকার পরিচালনায় ভারতের সঙ্গে তার সুবিধা-অসুবিধার কথা জিজ্ঞেস করলেই বলতেন, ‘সিরাজ সাহেব, পরের উপর নির্ভর করে সংসারও চলে না, দেশ চালানাে তাে আরও অনেক বিরাট চ্যালেঞ্জ। বিস্তারিত জানতে চাইলে বলতেন, ‘সুবিধার চাইতে অসুবিধাটাই বেশি। তবু কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’
প্রত্যেক বারই আমি চলে আসার সময় বলতেন, ‘সময় হয়তাে বেশি দিতে পারি না। আসবেন। জরুরি কিছু করতে হলে জানাবেন।’
প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সে সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন নূরুল কাদের খান, মওদুদ আহমেদ, আনিসুজ্জামান, জেনারেল নূরুল ইসলাম শিশু (প্রধানমন্ত্রীর এডিসি) ও আমিনুল হক বাদশাসহ কয়েকজন।
প্রশ্ন : ভারতে ‘বিএলএফ’-এর ট্রেনিং কীভাবে হয়েছিল? এর দায়িত্বে কে ছিলেন?
উত্তর : রতন-গগনদের বাড়িতে সিদ্ধান্ত হওয়ার পর আমি পিরােজপুর-পটুয়াখালী হয়ে খুলনার মােরলগঞ্জ থানায় সুমন মাহমুদ বাবলকে রেখে (তার বাবা মােরলগঞ্জ থানার ওসি ছিলেন) লঞ্চে রাজবাড়ি ও কুষ্টিয়া হয়ে চুয়াডাঙ্গা গেলাম। সেখানে আবু ওসমান ও তৌফিক ইলাহি চৌধুরী (সাদি) আমাকে বললাে, আপনাকে জরুরিভিত্তিতে কোলকাতা যেতে বলা হয়েছে। গেদে বর্ডার দিয়ে প্রথম পশ্চিম বাংলা যাই, সেখান থেকে ট্রেনে করে শেয়ালদা স্টেশনে পৌছে কোলকাতায় পশ্চিম বাংলা প্রাদেশিক পরিষদ (রাজ্য বিধানসভা) সদস্যদের আবাসিক হােস্টেলে যেতে প্রথমে নুরে আলম সিদ্দিকীকে পেলাম। আমাকে দেখে সে হতচকিত হয়ে গেল। তারপর আবদুল মালেক উকিল আমাকে নিয়ে ২১ ড. রাজেন্দ্র রােডে গেলেন। সেখানে আমি রাজ্জাক, তােফায়েল ও মনির দেখা পেলাম । এ ঠিকানাটি আগেই আমাদের ভারতের সঙ্গে যােগাযােগের জন্য নির্দিষ্ট করা ছিল। সাত-আট দিন পর মনি ও আমি আগরতলা গেলাম। সেখানে ‘বিএলএফ’-এর অনেক সদস্যের সঙ্গে দেখা হলাে। আমাদের সাময়িক যােগাযােগের ঠিকানা হিসেবে ‘শ্রীধর ভিলা’কে ঠিক করা হলাে। তিন- চারদিন পর আমি আবার কোলকাতায় ফিরলাম। তখন আমার গায়ে জ্বর। কোলকাতায় পৌছে বুঝলাম আমার জলবসন্ত হয়েছে। একটি
পৃষ্ঠা: ২১৫
আলাদা রুমে আমাকে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হলাে। খুব ছোট বেলায়, আমার বয়স যখন দশ-এগারাে বছর, আমার একবার গুটিবসন্ত হয়েছিল। মনে আছে সুস্থ হবার আগে পর্যন্ত আমাকে মশারির নিচে থাকতে হয়েছিল।
চিত্তদার বাড়িতে তাে আমাকে পুরােপুরিভাবে আলাদা করে রাখা হলাে। দুজন নার্স সেখানে আমার দেখাশােনা করতাে। বৌদি (মিসেস চিত্তরঞ্জন সুতার) খাবার তৈরি করে পাশের ঘরে দিয়ে যেতেন। মাছের ঝােল, ডিম-বসন্ত রােগীর খাবার যেমন হয়। একুশ দিন এভাবে আলাদা ছিলাম। বার-তের দিনের মাথায় চিত্তদার কাছ থেকে জানলাম দিল্লি থেকে একজন জেনারেল আসছেন আমাদের সঙ্গে যােগাযােগের জন্য। আমি, রাজ্জাক ও তােফায়েল একই বাসায় থাকি। চার-পাঁচদিন পর খবর পাঠিয়ে মনিকে আগরতলা থেকে আনা হলাে। জেনারেল সুজন সিং উবান দূর থেকে আমাকে দেখে বললেন, তিনি দশ দিন পর এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন। এর মধ্যে আমি সুস্থ হলাম। ঠিক দশ দিনের মাথায় তিনি আসলেন। ইতিমধ্যে চিত্তদা আমাদের জানিয়েছেন, দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে জেনারেল উবানকে আমাদের কাছে পাঠানাে হয়েছে। আমাদের সবকিছুর দায়িতে থাকবেন তিনি।
আমরা তিনদিন ধরে ম্যারাথন সিটিং দিলাম। চিত্তদাও তাতে উপস্থিত থাকতেন। সামরিক বাহিনীর কোনাে জেনারেলের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ আমাদের জীবনে এই প্রথম। আলােচনার শুরুতেই আমরা বললাম, ‘যুদ্ধ করার কোনাে অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। কিভাবে কী করতে হবে তাও জানি না।’
হাসিমুখে জেনারেল বললেন, ‘আমিও এক সময় কিছুই জানতাম না। শিখেছি। আপনারাও সব শিখে ফেলবেন।’
তাঁর এই কথায় এবং কথা বলার ধরনে আমরা কেবল আশ্বস্তই হলাম না, অবাক হবার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাস ও মনে অনেক জোরও পেলাম। তিনি সাদা কাগজে আমাদের কিছু করণীয় সম্পর্কে লিখে দিলেন। বুঝিয়ে দিলেন।
তিনি বলে গেলেন, আমাদের প্রাথমিক কাজ হবে বাংলাদেশের চারপাশ ঘিরে ভারতের যেসব এলাকা এবং বাংলাদেশ থেকে যে-যে
পৃষ্ঠা: ২১৬
এলাকা দিয়ে ভারতে আসার স্বীকৃত সহজপথ রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করা৷পূর্ব পাকিস্তানের একটি বড় ম্যাপ সংগ্রহ করা। ট্রেসিং করে ম্যাপ তৈরি করা এবং বিভিন্ন ধরনের চিহ্ন দিয়ে বর্ডার এরিয়ার বাংলাদেশের জেলাগুলাে মার্কিং করা।
তিনি যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়গুলো এত সহজ করে আমাদের কাছে তুলে ধরলেন যে মনে হলো, দেশ যেন স্বাধীন হয়ে গেছে। তিনি আরও বললেন যে কোনাে দেশের সেনাবাহিনীকে এভাবেই গড়ে তালা এবং তাদের যুদ্ধের কৌশল এভাবেই ঠিক করা হয়। তার কথা শুনে আমরা নিজেদেরকে অনেকটা হালকা ও আত্মবিশ্বাসী বােধ করলাম।
আলােচনা শেষে তিনি বললেন, সাত দিনের মাথায় তিনি আবার একদিনের জন্য আসবেন। বললেন, ‘get ready for your war independence’। তিনি জাতিতে ছিলেন শিখ। ছয়ফুট দুই-তিন ইঞ্চি লম্বা। বয়স মধ্য-পঞ্চাশ। চুল-দাড়ি শিখদের মতাে। সুঠাম দেহ। সুন্দর ইংরেজিতে কথা বলেন।
তিনি চলে যাওয়ার পরদিন চিত্তদা আমাদের জানালেন, দিল্লি থেকে বার্তা আছে। আপনাদের বিষয়টি দিল্লি অনুমােদন করেছে।
জেনারেল উবান আমাদের কাছে যে তথ্যগুলাে জানতে চেয়েছিলেন তার একটা খসড়া ফিরিস্তি নিচে দেওয়া হলাে :
১. বর্ডার এলাকার কোনাে অঞ্চল দিয়ে ভারতে যাওয়া ও সেখানে রিক্রুট সেন্টার করা হবে?।
২. কতজনকে ট্রেনিং দেওয়া হবে?
৩. রিক্রটমেন্ট সেন্টারের জন্য কী পরিমাণ অর্থের প্রয়ােজন হবে?।
৪. রিক্রুটমেন্ট সেন্টার থেকে কলকাতা, গােহাটি, আগরতলা, শিলিগুড়ি পর্যন্ত বিএলএফ সদস্যদের যাতায়াত খরচ ও খাবার বাবদ কত টাকার প্রয়ােজন হবে?
৫. এই চার-পাঁচটি প্রধান কেন্দ্রে থাকা ও খাওয়া ছাড়াও অন্যান্য কী কী খাতে আনুমানিক কত খরচ হতে পারে?
৬. সশস্ত্র যােদ্ধাদের প্রত্যেককে জরুরি খরচের জন্য কত টাকা করে দিতে হবে?
পৃষ্ঠা: ২১৭
৭. বর্ডার থেকে গন্তব্যস্থল পর্যন্ত আর বিশেষ কাজে কত খরচ লাগতে পারে?
৮. বর্ডার এরিয়ার যারা শান্তি কমিটির সদস্য অথচ একই সঙ্গে আমাদের যুদ্ধের সহায়ক তাদের জন্য কী পরিমাণ টাকা লাগতে পারে?
যােদ্ধাদের জন্য ট্রেনিং, অস্ত্র ও খাদ্য সরবরাহ ভারত সরকার করবে বলে ঐ খসড়াতে উল্লেখ করা হয়। বাকি ব্যাপারে যেন একটি, খসড়া বাজেট আমরা আগে থেকে তৈরি করে রাখি।
সাত দিনে এসব কাজ সম্পন্ন করা প্রথমে আমাদের কাছে খুব দুরূহ মনে হলাে। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের একটি ম্যাপ সংগ্রহ করতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়েছিল। উপরন্তু সে ম্যাপের ট্রেসিং করা, জায়গা চিহ্নিত করার কাজগুলাে তাে ছিলই আমার এবং মনির ওপর সার্বিক দায়িত্ব পড়লাে। বর্ডার এরিয়ার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ক্যাম্প খােলার জন্য স্থান নির্ধারণের দায়িত্ব রাজ্জাক ও তােফায়েলকে দেওয়া হলাে। জিপ গাড়ি, তেল, পথের খরচ, রাতে অবস্থান—এ সব ব্যবস্থাই রেডি করে দেওয়া হলাে রাজ্জাক ও তােফায়েলকে। ম্যাপ সংগ্রহের পরে ট্রেসিং পেপারে তাদেরকে ম্যাপ-এর এক কপি দিয়ে দেওয়া হলাে। আমরা চারজনই তখন দারুণ উত্তেজিত। ওরা দুজন বেরিয়ে পড়লাে। তিনদিন পর ওদের ফিরে আসার কথা। এদিকে আমরাও কাজ শুরু করলাম । চিত্তদা সব সময়ের জন্য আমাদের সঙ্গে আছেন। ভারত সরকারের একজনকে আমাদের সাহায্যের জন্য দেওয়া হলাে। পরে বুঝলাম তিনি খুবই একজন দক্ষ ব্যক্তি।
আমাদের কাজগুলাে যে সহজ নয় তা বুঝলাম। কিন্তু কাজ করতে নেমে আমরা দারুণ উৎসাহ পেলাম। কাজ এগিয়ে চললাে। ম্যাপ সংগ্রহ এবং ট্রেসিং পেপারে সুন্দর ও সামরিক অভিযানের পক্ষে ব্যবহারােপযােগী করে তা কপি করার কাজে ভারত সরকারের ঐ ব্যক্তির সহযােগিতা ভুলবার নয়। তিনদিন পর রাজ্জাক ও তােফায়েল ফিরে এলাে। চিত্তদাসহ আমরা চারজন বসলাম। হিসেব করে দেখা গেল, আমাদের সর্বমােট
পৃষ্ঠা: ২১৮
৭৮ লক্ষ ভারতীয় রুপির প্রয়ােজন হবে। এ হিসেবটি তৈরি করতেও ঐ ভারতীয় ব্যক্তি আমাদের যথেষ্ট সহায়তা করেন। প্রথমে টাকার অঙ্ক বেশি ধরলেও চূড়ান্ত বাজেটে তা নামিয়ে আনা হয়।
দুদিনের মধ্যে দিল্লি থেকে খবর এলাে আমাদের এই প্রাথমিক কাজের অনুমােদন পাওয়া গেছে। বাজেট ৭৮ লক্ষ ভারতীয় রুপি থেকে কমিয়ে ৫৬ লক্ষ রুপি ধরা হয়েছে। মনি ও রাজ্জাক এরপর আগরতলা ও গৌহাটি চলে গেল। আমি শিলিগুড়ির পাংগায় বাংলাদেশ সীনান্তের ৫০ গজের মধ্যে ক্যাম্প করলাম। এ জায়গাটিতে আগে বিএসএফ-এর ক্যাম্প ছিল। তেঁতুলিয়া বর্ডারের পাশেই ছিল এই পাংগা ক্যাম্প।
এই ব্যবস্থায় আমরা সর্বমােট সাত হাজার (৬,৮০০) ‘বিএলএফ’ সদস্যকে ট্রেনিং দিতে সক্ষম হয়েছিলাম।
প্রশ্ন : ৭ নভেম্বরের ‘সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান’ ব্যর্থ হলাে কেন?
উত্তর : জাসদের বিস্তৃত কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবেই ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ ও পরবর্তীতে ‘গণবাহিনী’ গড়ে উঠেছিল। ‘সিওসি’ (সেন্ট্রাল অর্গানাইজেশন কমিটি) ছিল এসব কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রক কেন্দ্র। জাসদের পরিকল্পনা অনুযায়ীই ৭ নভেম্বর সিপাহী অভ্যুত্থান হয়েছিল। কিন্তু এই অভ্যুত্থান স্বল্প সময়ের মধ্যেই জাসদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সে সময়ে ক্ষমতার শীর্ষে বেশ কয়েকটি শক্তি অবস্থান করছিল। ১৫ আগস্টের নায়করা এক প্রকার আত্মসমর্পণ করে দেশ ছেড়ে চলে যায়। খন্দকার মােশতাক আহমেদের আশাও ভেস্তে যায়। জিয়াউর রহমান তৎকালীন সামরিক বাহিনীর মধ্যস্থলে গড়ে ওঠা ক্ষমতা কেন্দ্রের মধ্যে অবস্থান করে তার শক্তিভিতকে সুদৃঢ় করেন। এই ক্ষমতা সংহত করার ক্ষেত্রে যাকে যাকে তার বাধা মনে হয়েছে । তাদেরকে তিনি নির্মূল করলেন। এভাবে ক্ষমতার লড়াইয়ে জাসদ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জাসদের রাজনীতিতে না হলেও বিস্তৃত সংগঠনে নেমে আসে বিশৃঙ্খলা। আমাদের দীর্ঘ পাঁচ বছরের কারাবাসকালে সংগঠনের মধ্যে বিভিন্ন চিন্তা ও গ্রুপ-কেন্দ্র গড়ে ওঠে। রব ও জলিল তাে আরও বেশি দিন কারাগারে ছিলেন।
পৃষ্ঠা: ২১৯
প্রশ্ন : আপনি ‘কমিউনিস্ট লীগ’ নামে কোনাে সংগঠন গড়ার কথা ভেবেছিলেন কি? কিংবা এই নামে কখনাে কোনাে সংগঠন গড়েছিলেন?
উত্তর : এ ধরনের কোনাে সংগঠন গড়া তাে দূরের কথা, আমি এর নামও শুনিনি।
প্রশ্ন : ‘অখণ্ড স্বাধীন বাংলা’ গঠনের সম্ভাবনায় কি আপনি তত্ত্বগতভাবে বিশ্বাস করেন?
উত্তর : ‘অখণ্ড স্বাধীন বাংলা’ একটি অলীক ধারণা। নেপাল, ভুটান, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রদেশসমূহ, বাংলাদেশ, চীনের কুনমিং এবং মিয়ানমারের উল্টরাঞ্চল মিলিয়ে অর্থনৈতিক সহযােগিতামূলক ধারণাকে ‘যুক্ত বাংলা’, ‘বৃহৎ বাংলা’ ইত্যাদি গঠনের ষড়যন্ত্র নাম দিয়ে ও তার সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে অনেক কথাই বলা হয়েছিল। এই অভিযােগে ১৯৯২ সালে আমাকে কারারুদ্ধ করা হয়। আমার এই গ্রেফতারের ব্যাপারে বিএনপি, আওয়ামী লীগ এবং ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার একমত হয়েছিল। অবাক কাণ্ড, এখন বাংলাদেশ ও ভারত সরকার উভয়েই বিভিন্ন উপআঞ্চলিক জোট গঠন করছে এবং আমার প্রস্তাবিত সে সহযােগিতাভিত্তিক উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
প্রসঙ্গত ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ের বিরাট অংশ জুড়ে আছে কলকাতা শহর ও সেখানকার মানুষের অবদান। ১৯৮১ সালে আমি যখন ইংল্যান্ডে যাই তখন লন্ডনকেও আমার কলকাতা শহরেরই ক্ষুদ্র একটি রূপ বলে মনে হয়েছে। এসব বিবেচনায় কলকাতাকে আমার ভালাে লেগেছে। সেখানকার মানুষদের সঙ্গে মিশে বাঙালিকে কলকাতার চরিত্র দিয়ে বােঝার চেষ্টা করেছি। তাতে আমার জন্য শিক্ষণীয় অনেক কিছু ছিল। একই বাংলাভাষা, হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় পার্থক্য থাকলেও, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমাদের প্রচুর মিল রয়েছে। কলকাতা আজ অবাঙালিদের দাপটের শিকার। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প- কারখানা সবকিছু তাদের দখলে। এমনকি বাংলাদেশের তুলনায়ও পশ্চিম বাংলা অনেকদিক থেকে পিছিয়ে আছে। যেমন : কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ব্যবসা-বাণিজ্যে বাংলাদেশ
পৃষ্ঠা: ২২০
আজ এগিয়ে। আলাদা স্বাধীন দেশ হওয়ায় বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি বাংলাদেশকে পশ্চিমবঙ্গের চাইতে অনেক দ্রুত গতিতে বিশ্বায়নের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এসব দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেক এগিয়ে আছে। যদিও সংস্কৃতি চর্চায় কলকাতা আমাদের তুলনায় নানাভাবে এগিয়ে আছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসে এবং তারপরও আমি কলকাতাসহ সমগ্র উত্তর ভারত ভ্রমণ এবং হিমালয় পর্বতমালা দর্শন করি। বাংলাদেশের ছােট আঙিনা থেকে বেরিয়ে বৃহৎ পরিসরে এই পরিভ্রমণ আমার জ্ঞান ও চিন্তার পরিধি বিস্তারে সাহায্য করে। ১৯৯০ সাল থেকে আমি প্রতি বছরই (১৯৯২ বাদ দিয়ে) যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম এসব দেশে গিয়েছি। প্রত্যেকবারই এই সফরে বহুদিন কাটিয়েছি।।
যেহেতু আমার এসব ভ্রমণ ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ে, ফলে সে সব দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং শিল্প- সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে আমার প্রত্যক্ষ ধারণা লাভের সুযােগ হয়েছে। উত্তর আমেরিকায় ‘বেঙ্গল স্টাডি কনফারেন্স’ (বিএসসি)-এর সম্মেলনে যােগ দিয়ে আমার রাষ্ট্রবিষয়ক ধারণা ও চিন্তাকে বিদেশী পণ্ডিত ও বিদ্বানদের সামনে তুলে ধরার সুযােগ পেয়েছি। এসব কনফারেন্সে আমি লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেছি। কনফারেন্স চলাকালে শ্রোতারা আমার বক্তব্য গভীর আগ্রহ সহকারে শুনেছেন ও আমার সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। এ রকম ঘটনা প্রতিবারই ঘটেছে, যতদিন পর্যন্ত বিএসসি অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিএসসি-ও সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৬ সালে বাংলাদেশে। এর আগে বিএসসি কখনাে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে সম্মেলন করতাে না। আমার এবং ড. জিল্লুর রহমান খানের প্রচেষ্টায়ই ঢাকায় প্রথমবার বিএসসি অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে বিএসসি বন্ধ আছে। বিএসসি উপলক্ষ্যে দেওয়া আমার লিখিত বক্তব্য এ বছর (২০১৮) ‘নির্বাচিত রাজনৈতিক রচনাবলী’ আকারে
প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় সাত বছরের নির্জন কারাবাস, তাছাড়া দীর্ঘকালব্যাপী আহার-ন্দ্রিার অনিয়মের কারণে কিছু কিছু কঠিন রােগ
পৃষ্ঠা: ২২১
আমার শরীরে প্রবেশ করেছে। শরীরে সর্বক্ষণই ব্যথা-বেদনা অনুভব করি। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে যাওয়া-আসার ফলে আমার সে সব রােগের চিকিৎসা করানাে সুযােগ হয়েছে। বিদেশে এসব রােগের উন্নত চিকিৎসা আছে। গত ৩০ বছরে প্রতি বছরই আমি দেশের বাইরে গিয়েছি এবং এখনও যাই। এসব সফরকালে বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের অধ্যাপক এবং অন্য জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা থেকেও আমি অনেক কিছু জেনেছি ও শিখেছি। এসব দেশের কোনাে সরকার বা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমি কোনদিনই কোনাে যােগাযােগ করিনি। প্রয়ােজনও বােধ করিনি।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে ভারতের সঙ্গে আমার বা আমাদের যােগাযােগ সেটার প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। স্বাধীন হবার পর ভারতের সঙ্গেও আমার সেরকম কোনাে যােগাযােগ গড়ে ওঠেনি। এত বছর ধরে এভাবে বিদেশে যাওয়া-আসা এবং দীর্ঘদিন সেখানে থাকার জন্য অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে আমি আমার রাজনৈতিক সহকর্মীদের ওপরই নির্ভর করেছি। কোনাে দেশের কোনাে সরকারি অর্থায়ন আমার প্রয়ােজন হয়নি। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসি’ হতাে, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে সম্মানী পেতাম। এটা শুধু আমার জন্য নয়, এসব কনফারেন্সে যারা উপস্থিত হতেন সবাইকেই দেওয়া হতাে। দেশের ভেতরে আমি যেমন খুব সাধারণ জীবন-যাপন করি দেশের বাইরেও আমার জীবন-যাপন ছিল সে-রকম।
প্রশ্ন : মওলানা ভাসানীকে কীভাবে দেখেন?
উত্তর : মওলানা ভাসানী এক ভিন্ন ধাঁচের মানুষ। ভিন্ন ধরনের রাজনীতিবিদ। ক্ষমতায় না গিয়েও রাজনীতির মাধ্যমে জনগণের কল্যাণ সাধন মওলানা ভাসানীর অনন্য বৈশিষ্ট্য। পাকিস্তান সৃষ্টির আগে তিনি আসামের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন। পাকিস্তান হবার পর রাজনীতিতে গণদরদী নেতা হিসেবে এমন নজির সৃষ্টি করলেন যার তুলনা অন্য কোনাে দেশের রাজনীতিতেও দেখা যায় না। পাকিস্তান হবার পর পাকিস্তানিদের চক্রান্ত যদি একজন মানুষও বুঝে থাকেন তিনি হলেন মওলানা ভাসানী।।
পৃষ্ঠা: ২২২
আমি তার সঙ্গে মােট চারবার দেখা করেছি। কোনােটাই রাজনৈতিক বৈঠক ছিল না। সবগুলােই ছিল অনির্ধারিত। তিনি কী কারণে আমার চেহারা চিনে রেখেছিলেন, আমি বলতে পারবাে না। চতুর্থবার দেখা হওয়ার সময় যাদু মিয়া ও তােয়াহা সাহেবের সামনে মওলানা ভাসানী বলেন, ‘তােমরা যদি একজনও সিরাজের মতাে হতে পারতা তাহলে আমি অনেক কিছু করতে পারতাম।’ তিনি আরও বললেন, ‘মুজিবের শক্তিই তাে হলাে সিরাজ’। তিনি কীভাবে এ সিদ্ধান্তে এসেছিলেন আমি জানি না। ১৯৬৯ সালে অসুস্থতার কারণে তিনি ধানমন্ডিতে ডা. রাব্বির একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন। যাদু মিয়া নিয়ে এসেছিলেন। আমি তখন আদমজির শ্রমিক নেতা সাদুকে নিয়ে ঐ ক্লিনিকে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম। সে সময় তিনি ঐ মন্তব্য করেন।
মওলানা ভাসানী মানুষ হিসেবে অবশ্যই সৎ ও চরিত্রবান। সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী। রাজনীতিতে কাউকে তােয়াক্কা করে কিছু বলতেন না। শেখ মুজিবকে তিনি পূর্ব বাংলার রাজনীতির পক্ষের মানুষ হিসেবে গণ্য করতেন। শেষদিন পর্যন্ত তিনি মুজিব ভাইকে সাহস যুগিয়েছিলেন।
পল্টনের জনসভায় তার বক্তৃতা আমি শুনেছি অনেকবার । জনসভায় তাঁর বক্তৃতা ছিল জনগণকে রাজনীতির ‘কোচিং করানাের মতাে। কোনােরকম দুর্বোধ্যতার আশ্রয় না নিয়ে একজন ভালাে অধ্যাপকের মতাে তিনি রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে পারতেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে তিনি ছিলেন একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তােলার ব্যাপারেও তিনি ভূমিকা রেখেছিলেন।
প্রশ্ন : হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদী সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
উত্তর : পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার স্বল্পকালীন কার্যকালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে সফল হন। তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ । আইনজীবী হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। ছিলেন ‘বিসিএল’ ডিগ্রিধারী । তার আগে
পৃষ্ঠা: ২২৩
পূর্ব পাকিস্তানে আর কেউ বােধহয় ‘বিসিএল’ ছিলেন না। সােহরাওয়ার্দী সাহেব ছিলেন সম্রান্ত পরিবারের সন্তান। তার পিতা ছিলেন কোলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি। মা ছিলেন মুসলমানদের মধ্যে প্রথম স্নাতক ডিগ্রি ধারিণী।
সবশেষে বলতে চাই, রাজনৈতিক জীবনের প্রথম ভাগে অর্থাৎ স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে সকল দল, মত ও পথের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমার পরিচয় ও সুসম্পর্ক ছিল। আমি তাদের শ্রদ্ধা ও সম্মান করতাম। তারাও আমার সম্পর্কেউচ্চ ধারণা পােষণ করতেন।
—X—