You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে কাশিয়ানী উপজেলা (গোপালগঞ্জ)

কাশিয়ানী উপজেলা (গোপালগঞ্জ) ১৯৭০ সালের নির্বাচন-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ অসহযোগ আন্দোলন-এ রূপ নিলে কাশিয়ানী উপজেলার সর্বস্তরের জনগণ তাতে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয়। এরপর ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠলে এ অঞ্চলের মানুষ তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে রাতইলের অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন নুরুদ্দোহা দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে গোপালগঞ্জে ছুটে আসেন। তিনি এখানকার ছাত্রনেতাদের সঙ্গে নিয়ে ১১ই মার্চ গোপালগঞ্জের সদর ট্রেজারি থেকে ৪৮টি রাইফেল, কয়েক পেটি কার্তুজ এবং গ্রেনেড সংগ্রহ করে রাতইল গ্রামে নিয়ে আসেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকহানাদার বাহিনী ঢাকায় হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে বিভিন্ন সেনানিবাসের বাঙালি জোয়ান, ইপিআর, পুলিশ ও সেনা সদস্যরা নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে দুর্গম রাস্তা পেরিয়ে অস্ত্র ও গুলিসহ কাশিয়ানী উপজেলায় প্রবেশ করেন। তাঁরা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ও ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে প্রতিরোধযুদ্ধের প্রস্তুতি নেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে কয়েক হাজার ছাত্র-জনতা বাঁশের লাঠি, ঢাল, সড়কি, রামদা, কুড়াল ও দেশীয় বন্দুক নিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য কাশিয়ানী হাইস্কুল মাঠে উপস্থিত হয়। ১৩ই মার্চ তারা উপজেলার রাতইল হাইস্কুল মাঠে প্রথমবারের মতো গেরিলা ট্রেনিং-এর মাধ্যমে মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করার শপথ নেয়। ক্যাপ্টেন নুরুদ্দোহা, সেনাসদস্য নাজির হোসেন ও ইপিআর সদস্য সূর্য মিয়ার নেতৃত্বে ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এ ক্যাম্পে ১৫০ জনের মতো ছাত্র, যুবক ও কৃষক নিয়মিত অংশ নেন। ২৯শে মার্চ থেকে কাশিয়ানী হাইস্কুল মাঠে ক্যাপ্টেন নুরুদ্দোহা, আলী আহমেদ শিকদার (বালা দারোগা), মৌলভী মাজেদ খান প্রমুখ সামরিক প্রশিক্ষণ দেন। পিঙ্গলিয়া বলের মাঠ ও ভাটিয়াপাড়া রেল মাঠে প্রাক্তন ব্রিটিশ সেনাসদস্য আব্দুল মাজেদ মোল্যা (বুড়ো গেরিলা) ও নাসিম মোল্যা প্রশিক্ষণ দেন। ফুকরার তারাইল মাঠে মোশারফ হোসেন (কটা সরদার) এবং সুবেদার চাঁন মিয়ার নেতৃত্বে সেনা, পুলিশ, ইপিআর সদস্য ও সাহসী যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। রামদিয়া কলেজ মাঠে প্রশিক্ষণ দেন সেনাসদস্য বাদশা মিয়া। মাজড়া হাইস্কুল মাঠ ও বাগঝাপায় প্রশিক্ষণ দেন সেনাসদস্য কওসার মোল্যা এবং আক্কাস শেখ। সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন হাবিবুর রহমান বাবু মিয়া। পারুলিয়া হাইস্কুল মাঠে প্রশিক্ষণ দেন সেনাসদস্য খোরশেদ আহমেদ, আজাহার আলী, জালাল হোসেন ও একল সর্দার। রাজপাট হাইস্কুল মাঠে জালালুদ্দিন খোকা শেখ বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রশিক্ষণ দেন। বাথানডাঙ্গা হাইস্কুল মাঠে নৌবাহিনীর সদস্য বাচ্চু মুন্সী এলাকার ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কাশিয়ানীর থানা কমান্ডার ছিলেন জগলুল কাদির জুলু এবং ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন এডভোকেট মোহাম্মদ আব্দুল হালিম। অন্যান্য কমান্ডাররা হলেন- মো. কাউসার আলী, মো. ফিরোজ খালিদ, মো. সাখাওয়াত হোসেন, মো. আমিন তালুকদার, আবুল খায়ের (রতন মোল্যা), মো. আজিজুর রহমান, এ এফ এম হাফিজুর রহমান, এডভোকেট মহিউদ্দিন আহমেদ, মো. ইদ্রিস আলী মিয়া, লিয়াকত আলী মৃধা এবং বাদশা মিয়া। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন নুরুল কাদির জুন্নু, আমজাদ হোসাইন মোল্যা, মোশারফ হোসেন (লায়েক চৌধুরী) প্রমুখ।
পাকবাহিনী ৭ই আগস্ট সকাল ১১টায় কাশিয়ানী বাজারের পুলিন সাহার মিল ঘরের দেড়শত মন খেসারি-কলাই ভাটিয়াপাড়ায় স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সংবাদ পেয়ে ৬ই আগস্ট মধ্যরাতে সেনাসদস্য মাজেদ মোল্যা, এনায়েত সর্দার, কোবাদ সর্দার, নওশের, আক্কাস শেখ, হাফিজুর রহমান, ওবায়দুর রহমান নান্টু, বাদশা শেখ, কুদ্দুস শেখ এবং হাকিম শেখসহ ১০-১২ জনের একটি দল চিন্তা ময়রার টিনের ঘরে ও নিতাই সাহার বাড়িতে সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নেন। খলিল ও মজিদসহ ৭ জন রাজাকার- চিন্তা ময়রাকে সঙ্গে নিয়ে তার বাড়িতে মিষ্টি খাওয়ার উদ্দেশ্যে এলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর গুলি বর্ষণ করেন। এতে চিন্তা ময়রা, পিঙ্গলিয়ার রাজাকার হারুন ও টগরবন্দে টুকু মারা যায়। পিঙ্গলিয়ার রাজাকার আবু শ্যাম মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে গ্রেপ্তার হয়।
এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে পাকবাহিনী ট্রেনে করে প্রথমে ভাটিয়াপাড়ায় অনুপ্রবেশ করে। তারা তাদের স্থানীয় দোসর সোলায়মান সর্দারের সহযোগিতায় পিঙ্গলিয়া গ্রামে ঢুকে থানা -আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেনের বাড়িসহ ৬-৭টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। মে মাসের প্রথম দিকে পাকসেনারা আবার ভাটিয়াপাড়ায় আসে এবং সেখান থেকে ৭ই মে কাশিয়ানীতে অনুপ্রবেশ করে। এরপর তারা রাজাকার বাহিনীকে সংগঠিত করে কাশিয়ানী হাইস্কুলে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। তারা ভাটিয়াপাড়া ওয়ারলেস স্টেশন ও খাদ্য গুদাম দখল করে সেখানেও ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়া পাকবাহিনী তাদের দোসর সোলায়মান সর্দারের বাড়িতে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে।
পাকবাহিনী স্থানীয় মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও পিডিপি নেতাদের সহযোগিতায় রাজাকার ও আলবদর বাহিনী এবং শান্তি কমিটি গঠন করে এলাকায় লুণ্ঠন, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারীধর্ষণসহ বিভিন্ন অত্যাচার ও নিপীড়িন চালাতে থাকে। সোলায়মান সর্দার (পিতা আব্দুল হামিদ সর্দার, পিঙ্গলিয়া), আব্দুল মান্নান ওরফে মনি মিয়া (সাধুহাটি), খেয়াল উদ্দিন মোল্যা (পিতা বচন মোল্যা, সড়ইকান্দি), হেমায়েত শিকদার এবং শাহ মো. জাকারিয়ার নেতৃত্বে এ উপজেলায় রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়। রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিল- পিঙ্গলিয়ার মজিবর রহমান মজিদ, খলিলুর রহমান, আতিয়ার রহমান, লুৎফর রহমান, আবু শ্যাম, আব্দুল কাদের সরদার, শামছুল হক সরদার, আবুল কাশেম তালুকদার, হারুন শেখ ইসমাইল শেখ ও আবুল হোসেন শেখ, বরাশুর গ্রামের হান্নান সরদার ও টুলু, কাশিয়ানী সদরের আবুল খায়ের মিয়া ও মো. নাহিদ, ফুকরার আব্দুল ফায়েক খাকী, খলিলুর রহমান খাকী, টুকু মুন্সী, নুরুল হক তালুকদার, ফায়েক সরদার, মোতালেব মৃধা ও বাহের মিনা, গুরুলিয়ার হারেজ শেখ, সড়ইকান্দীর আব্দুল রাজ্জাক মিয়া রাজু, রাহেন উদ্দিন মোল্যা, সিদ্দিক মোল্যা ও হায়দার আলী মোল্যা, সাধুহাটীর ডাক্তার সোলায়মান, হান্নান মিয়া, হাবিবুর রহমান, চুনা মিয়া, লুৎফর রহমান ও বাদশা শেখ, শ্যামপুরের রাঙ্গু মুন্সী, হরিদাসপুরের আকতার হোসেন, তিলছাড়ার হালিম ফকির কাংগাল, খারহাটের ঝিলু মোল্যা, আব্দুল মান্নান মোল্যা প্রমুখ।
আলবদর বাহিনীর সদস্য ছিল- ফলাসীর আব্দুস ছালাম মোল্যা, আব্দুর রাজ্জাক মোল্যা, মজিবর রহমান মোল্যা ও লোকমান মোল্যা, জোতকুরার আহাদ আলী মোল্যা, ঘোনাপাড়া হাইস্কুলের মৌলভী ওয়ালিউল্লাহ মোল্যা প্রমুখ। সোলায়মান সর্দারকে আহ্বায়ক করে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। সে প্রথম এ অঞ্চলে পাকবাহিনীকে স্বাগত জানায় এবং নিজ বাড়িতে পাকবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপনের ব্যবস্থা করে। সে বহু মানুষকে রাজাকার হতে বাধ্য করে। তার নির্দেশে রাজাকাররা পাকসেনাদের মনোরঞ্জনের জন্য নারী সরবরাহ করত। শান্তি কমিটির অন্য সদস্যরা হলো- আতাহার শেখ (পিঙ্গলিয়া), আকতার হোসেন শরীফ (বরাশুর), বাহাদুর খান (বরাশুর), ইসাহাক মুন্সী (খায়েরহাট), নুরু মিয়া (খায়েরহাট), দবির উদ্দিন খান (খায়েরহাট), আব্দুল ওয়াদুদ ফকির (খায়েরহাট), সামাদ শেখ (খায়েরহাট), রশীদ শরীফ (খায়েরহাট), আবু বক্কার শেখ (পিঙ্গলিয়া), আলাউদ্দিন খোকা মৌলভী (পোনা), নুরুল ইসলাম (পোনা), মান্নান মোল্যা (শংকরপাশা), মরিয়ম বেগম (শংকরপাশা), মৌলভী আব্দুর রাজ্জাক (শংকরপাশা), খেয়াল উদ্দিন মোল্যা (সড়ইকান্দি), জয়নাল মিনা (সড়ইকান্দি), আব্দুল মান্নান (মনি মিয়া) (সাধুহাটি), মোমরেজ মোল্যা (গোপালপুর), আব্দুল ওয়াহিদ মিনা (গোপালপুর), ফরমান মোল্যা (তিলছাড়া), খোকন ফকির (তিলছাড়া), আকু মোল্যা (তিলছাড়া), আব্দুর রউফ শেখ (খাগড়াবাড়ীয়া), আব্দুর রহমান খাকী (ফুকরা), মাওলানা শাহ মো. জাকারিয়া (মাজড়া), আকতার হোসেন (মাজড়া), মো. সামছুল হক (মাজড়া), নাবিউল ওরফে আবুল হোসেন (মাজড়া), আব্দুল আলী খান সাহেব (ঘোনাপাড়া), ইউসুফ মুন্সী (গোয়ালগ্রাম), হেমায়েত উদ্দিন শিকদার (সিতারামপুর), সামাদ খান (ভাট্টইধোপা), এডভোকেট মঈনুদ্দিন আহমেদ (ভাট্টইধোপা), মৌলভী এমদাদুল হক (ভাট্টইধোপা), নজ্জন খান (সাজাইল), আব্দুল মান্নান মুঞ্জন (কাশিয়ানী), আকরাম মোল্যা (কুসুমদিয়া), গফুর মোল্যা (বেথুড়ী), বারিক মোল্যা (জোতেকুরা), আব্দুল রহমান (ছোটখার কান্দী), আদেল মোল্যা (হরিদাসপুর), শামছুল হক শেখ (নিজামকান্দী), আশরাফ আলী মিয়া (রাজপাট) প্রমুখ।
৭ই মে বুধবার সকাল ১১টায় পাকবাহিনী পোনা গ্রামের কাদিরপাড়ার রওশন ডাক্তারের বাড়িতে ঢুকে নারীনির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ করে। একই গ্রামের নগরবাসী, তার ছেলে ভীষ্মদেব ও কালিদাশ দত্তকে গুলি করে হত্যা করে। সোলায়মান সর্দারের সহযোগিতায় পাকসেনারা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেনের বাড়িসহ ৬-৭টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তারা বরাশুর গ্রামের ৭৫টি ও জংগল মুকন্দপুর গ্রামের ৮০টি গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে। পাকসেনারা শংকরপাশা গ্রামের ৩০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং হাবিবুর রহমান, আওয়াল মোল্যা ও মকু শেখ সহ ১১ জনকে হত্যা করে। এটি শংকরপাশা গণহত্যা নামে পরিচিত। তারা হাতিয়াড়ার ১৪টি, পুইশুর ৬টি এবং বটবাড়ির ৫টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। রাজপাট ইউনিয়নের নাটগ্রামের বিলবাড়িতে বসবাসরত ১৬টি পরিবারের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
মে মাসের শেষদিকে পাকসেনারা স্পিড বোটে করে অপারেশনে যাওয়ার সময় চরভাটপাড়ার অনিল কুমার বিশ্বাস নামক এক যুবক নদীর চরে ঘাস কাটছিল। তারা অনিলকে দেখে স্পিডবোট থামিয়ে তাকে কাছে ডাকে। অনিল কাছে গেলে একজন পাকসেনা তাকে গুলি করতে উদ্যত হয়। আত্মরক্ষার্থে অনিল তাকে জাপটে ধরে। দুজনের মধ্যে কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর অনিল গুলিবিদ্ধ হয়। এরপর সে সৈন্যটির কাছ থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে ফায়ার করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সেটি নদীতে ফেলে দেয়। এতে পাকসেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে। আগস্ট মাসের ৩ তারিখ পাকবাহিনী কাশিয়ানী বাজার লুটপাট করে এবং ১০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এরপর মাজড়া বাজার লুটপাট করে এবং একজনকে গুলি করে হত্যা করে। এ-সময় পাকসেনাদের গুলিতে ৩ জন আহত হয়। ঐদিনই পাকসেনারা এক নারীকে ধর্ষণ করে। তারা বাঁশঝাপা গ্রামে ঢুকে আক্কাস আলী শেখকে গুলি করে হত্যা করে এবং ১৭টি বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। হরিদাসপুর গ্রামে আকতার মেম্বারের নেতৃত্বে পাকসেনারা ১১টি বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। সেপ্টেম্বর মাসের ১৩ তারিখ পাকসেনারা লঞ্চ নিয়ে তারাইল গ্রামে গিয়ে ১০০টির মতো বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। ৩১শে অক্টোবর পাকসেনারা লঞ্চ থেকে নেমে এসে ফুকরা গ্রামে গণহত্যা চালায়। ফুকরা গণহত্যায় ৪০ জন গ্রামবাসী নিহত হয়। ১০ই মে জুম্মার দিন পোনা গ্রামে ঢুকে ২৫টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ২১জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে। এটি পোনা গণহত্যা নামে পরিচিত কাশিয়ানী উপজেলা ৮ মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলে ছিল। এ-সময় এখানকার নারীরা চরম নির্যাতনের শিকার হন। মে, জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে প্রায়ই পাকসেনারা ভ্যান থামিয়ে কাশিয়ানীর বিভিন্ন গ্রামে (পোনা, মাজড়া, মাঝিগাতী, বাগঝাপা, হরিদাসপুর) ঢুকে বিশেষ করে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাত। মহেশপুর ইউনিয়নের জনৈক ব্যক্তির স্ত্রী রওশন আরাসহ আরো কয়েকজন নারী তাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। বরাশুর গ্রামের ১৮ বছর বয়সের মেয়ে শিরীনা বেগমকে (রাইস মিলে দীনমজুরের কাজ করত) জুলাই মাসে পাকসেনারা তুলে নিয়ে যায় এবং ৩ দিন তার ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন শেষে রক্তাক্ত অবস্থায় বাড়িতে ফেলে যায়। পোনা গ্রামের গৃহবধূ কাবিরোন নেছা এবং বুধপাশা গ্রামের আয়শা বেগম ও শ্যামেলা খাতুনসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অসংখ্য নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। আগস্ট মাসের ৩ তারিখে কাশিয়ানী বাজারে পাকবাহিনী ঢোকার সংবাদ পেয়ে সোমেদের মিস্টির দোকানের পাশের বাড়িতে কয়েকজন মহিলা আশ্রয় নেন। রাজাকারদের সহায়তায় সেনাসদস্যরা ঐ বাড়িতে ঢুকে পড়ে। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে মহিলাদের আর্ত চিৎকার ও পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দ শোনা যায়। চারজন মহিলা ঐসময় ধর্ষিত হয়। টগরবন্দ গ্রামের সন্ধ্যা রানীকে রাজাকার মজিদ রহমান মজি বাড়িতে এনে ১০ দিন ঘরের মধ্যে আটক রেখে তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। ওয়ারলেস স্টেশনের পাশেই পাকসেনাদের একটি প্রমোদ কক্ষের আশপাশে নারী নির্যাতনের আলামত পাওয়া গেছে। চারমাসে কাশিয়ানীতে প্রায় শতাধিক নারী ধর্ষণের শিকার হন।
মুসলিম লীগ নেতা ওয়াহিদুজ্জামানের দক্ষিণ হস্ত হিসেবে পরিচিত আব্দুল মান্নান মনি মিয়া, আবুল খায়ের চুনা মিয়া, ছলেমান মিয়া, কামরুল ইসলাম, লুথু মিয়া, এনায়েত হোসেন, মোর্শেদ মিয়া, ছাকা মিয়া ও বাদল মিয়া রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীদের ঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ করে। এরা সিতারামপুর নিবাসী মকবুল এবং আব্দুল কাদের মোল্যা, ছোট বাহিরবাগ নিবাসী সিরাজ এবং পরানপুর নিবাসী আব্দুস ছালাম মোল্যাকে বাড়ি থেকে ধরে এনে রামদিয়া বাজার ও অন্যান্য স্থানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। জুন মাসের ২৮ তারিখ রাজাকার মনি মিয়া মোশাররফ হোসেন এমপিএ-র জামাতা রামদিয়া কলেজের প্রফেসর আইয়ুবুর রহমান মিয়ার বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। রাজাকার আবুল খায়ের ও ছলেমান মিয়া অনেক নারীর ওপর নির্যাতন চালায়। উপজেলার খেয়াল উদ্দিন মোল্যা, সিদ্দিক মোল্যা, বাহের মিনা, জয়নাল মিনা, হারেজ শেখ প্রমুখ এবং ফুকরা ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খাকী পাকবাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে অপরাশেনে অংশগ্রহণ করে এবং নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর সংবাদ পাকসেনাদের সরবরাহ করে। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে রাজাকাররা তারাইল বাজারে ১২ জন লোককে ধরে এনে লাইনে দাঁড় করায়। এরপর পাকসেনারা ব্রাশ ফায়ার করে তাদের হত্যা করে, যা তারাইল গণহত্যা নামে পরিচিত।
কাশিয়ানী উপজেলায় পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ছিল ভাটিয়াপাড়া বাজার সংলগ্ন ইসরাইল ও ইব্রাহিম মিয়ার চাল ও আটার মিল, ভাটিয়াপাড়া রেল স্টেশনের মাল গুদাম ঘর ও ওয়ারলেস স্টাফ কোয়ার্টার্স। এখানে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সমর্থকদের ধরে এনে দিনের পর দিন আটক রেখে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। অনিল কাপালি, হোসেন শেখ (বরাশুর) এবং শাহজাহান সহ অসংখ্য লোককে এখানে হত্যা করা হয়। ভাটিয়াপাড়া বাজারের বারাসিয়া নদীর পাড়ের কুটি মিয়ার আড়াইতলা বাড়ি ও বাজারে অবস্থিত সিএসডি গুদাম ঘর ছিল পাকবাহিনীর বন্দিশিবির।
কাশিয়ানী উপজেলায় দুটি বধ্যভূমি ছিল- ভাটিয়াপাড়া সুইস গেইট বধ্যভূমি ও মধুমতি নদীর পাড় বধ্যভূমি। প্রায়ই সন্ধ্যায় পাকবাহিনীর দোসর রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা কিংবা গ্রেফতারকৃত মুক্তিকামী মানুষদের পিটমোড়া দিয়ে বেঁধে এদুটি স্থানে নিয়ে আসত। তারপর জবাই করে কিংবা গুলি করে বা বেওনেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাদের হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে দিত। লাশ নিয়ে শিয়াল, কুকুর ও শকুনের কাড়াকাড়ি ছিল প্রায় নিত্য দিনের ঘটনা। স্বাধীনতার পর ঐ এলাকায় অসংখ্য মানুষের হাড়গোড়, মাথার খুলি ও কংকাল পাওয়া গেছে। মধুমতি নদীর এ বধ্যভূমিটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে।
ভাটিয়াপাড়া রেলওয়ে স্টেশনের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে দুটি গণকবর রয়েছে, যা ভাটিয়াপাড়া রেলওয়ে স্টেশন গণকবর হিসেবে পরিচিত। পূর্ব পাশের গণকবরটি বেষ্টনী দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। পশ্চিম পাশের গণকবরটি এখনো অসংরক্ষিত রয়ে গেছে। স্টেশনের ঠিক সামনে দক্ষিণ পাশে আরো একটি গণকবর রয়েছে। এছাড়া পোনা গ্রামের উত্তরপাড়ায় মতিয়ার রহমান মতির বাড়িতে আরো একটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। এটি পোনা গণকবর নামে পরিচিত।
কাশিয়ানীর ওড়াকান্দি মিড হাইস্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের থানা হেডকোয়র্টার্স এবং রাতইলে সাব হেডকোয়ার্টার্সের ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। থানা হেডকোয়ার্টার্সের দায়িত্বে ছিলেন নুরুল কাদির জুনু। তাঁর নেতৃত্বে এখান থেকে যুদ্ধ পরিচালিত হয়। রাতইলে সাব হেডকোয়ার্টার্সের দায়িত্বে ছিলেন জগলুল কাদির জুলু। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও সভা-সমাবেশ হতো। গ্রামের মেয়েরা তিনবেলা তাদের জন্য ঘরে-ঘরে রুটি বানাতেন। তারাইল বাজারেও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপিত হয়। এ ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা মোশাররফ হোসেনের (কটা সর্দার) নেতৃত্বে সর্বপ্রথম রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তারাইল যুদ্ধে ৭ জন রাজাকার নিহত হয় এবং তাদের অস্ত্রসমূহ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
১৪ই আগস্ট রাতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা কাশিয়ানী থানায় অবস্থানরত পাক মিলিশিয়া বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন হায়দার আলী ফকির, আলাউদ্দিন, জয়নগরের মনু মিয়া ও মুস্তাফিজুর রহমানসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা এতে অংশ নেন। সারারাত যুদ্ধ চলে। কাশিয়ানী থানা যুদ্ধে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে মুক্তিযোদ্ধারা কাশিয়ানী থানায় পাকসেনাদের ওপর কয়েক দফা আক্রমণ করেন। এতে পাকসেনা ও রাজাকাররা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। একবার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ছৈয়া নৌকা করে ছদ্মবেশে থানার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন সেখানকার রাজাকাররা নৌকাগুলো তল্লাশি করার জন্য নদীর তীরে ভেড়াতে বলে। তীড়ে ভেড়ানোর সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা সামনে এসে ব্রাশ ফায়ার করে। এতে ঘটনাস্থলে কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়।
২রা সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ মহকুমা মুজিববাহিনীর কমান্ডার ইসমত কাদির গামার নেতৃত্বে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা ভাটিয়াপাড়া ওয়ারলেস স্টেশনে পাকসেনাদের ক্যাম্প আক্রমণ করেন। সারারাত উভয় পক্ষের বিরামহীনভাবে গুলি বিনিময় চলে। ভাটিয়াপাড়া ওয়ারলেস স্টেশন যুদ্ধে জয়নাল নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অবস্থান থেকে সরে আসেন ২০শে সেপ্টেম্বর গভীর রাতে ইসমত কাদির গামার নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা ঘোড়াখালি রেলওয়ে ব্রিজে পাহারারত রাজাকারদের ওপর কয়েক রাউন্ড গুলি বর্ষণ করলে তারা ভয়ে ব্রিজ ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরকের সাহায্যে ব্রিজটি ধ্বংস করে দেন। ফলে রেলপথে বোয়ালমারী ও ভাটিয়াপাড়ার সঙ্গে পাকসেনাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ঘোড়াখালি রেলওয়ে ব্রিজ অপারেশনে হাসান মোল্লা, পিটার গমেজ, রউফ মিয়া, আতিয়ার মোল্লা, পটু, বাবু, রহমান, কোমরপুরের খোন্দকার মুরাদ, আলীপুরের নাজমুল হাসান নসরু প্রমুখ অংশ নেন।
২৪শে সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের মুজিব বাহিনী-র কমান্ডার ক্যাপ্টেন নূর মোহাম্মদ বাবুল, গোপালগঞ্জের মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ইসমত কাদির গামা, আলফাডাঙ্গার ফ্লাইট সার্জেন্ট আব্দুর রাজ্জাক ও হেমায়েত তালুকদারের দলসহ আরো কয়েকটি দল ভোররাতে ভাটিয়াপাড়া ওয়ারলেস স্টেশনস্থ পাকসেনাদের ঘাঁটিতে তিনদিক থেকে আক্রমণ চালায়। উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর দুটি যুদ্ধ বিমান এসে হেভি মেশিনগান দিয়ে গুলি বর্ষণ শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ঘাঁটিতে ফিরে যান। বিমান হামলায় ৪-৫ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। অপরপক্ষে ৮ জন পাকসেনা নিহত এবং কয়েকজন গুরুতর আহত হয়।
৫ই অক্টোবর বিকেল ৪টায় ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ভাটিয়াপাড়া ওয়ারলেস স্টেশনে অবস্থানরত পাকসেনাদের ওপর পুনরায় আক্রমণ করেন। দেড় ঘণ্টাব্যাপী এ-যুদ্ধে ৭ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ৪ জন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। ভাটিয়াপাড়ায় পাকবাহিনীর ক্যাম্পের দখল নিয়ে দুটি মারাত্মক যুদ্ধ হয়। ৩১শে অক্টোবর ভাটিয়াপাড়া থেকে পাকসেনাদের তিনটি লঞ্চ গোপালগঞ্জ যাওয়ার পথে ফুকরায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ হয়। অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন আব্দুস সোবহানের নেতৃত্বে প্রায় ৩ ঘণ্টা এ-যুদ্ধ চলে।
ফুকরার যুদ্ধে ১০ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ৪০ জন গ্রামবাসী শহীদ হন এবং মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। ফুকরার যুদ্ধের পরের দিন পাকসেনারা ৩টি লঞ্চে করে গোপালগঞ্জ থেকে তালতলা খাল দিয়ে এসে রামদিয়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প আক্রমণ করে। অতর্কিত এ আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুতি না থাকায় তারা আত্মরক্ষার্থে অন্যত্র সরে পড়েন।
৬ই নভেম্বর ক্যাপ্টেন নূর মোহাম্মদ বাবুল, ইসমত কাদির গামা ও হেমায়েত উদ্দিন, বীর বিক্রম (কোটালীপাড়ার হেমায়েত বাহিনীর কমান্ডার)-এর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ করলে একটানা ১৫ ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। এ-যুদ্ধে ১৭ জন পাকসেনা ও ৫ জন রাজাকার নিহত হয়।
১৮ই নভেম্বর যশোর সেনানিবাস থেকে হানাদার বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের একটি সুসজ্জিত দল ডিঙ্গি নৌকায় মধুমতি নদী পার হয়ে ভাটিয়াপাড়ার ক্যাম্পে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ-সময় নৌকাটি নদীর পূর্ব পাড়ে কালনা ঘাটে পৌঁছানোর সঙ্গে-সঙ্গে পার্শ্ববর্তী শংকরপাশা গ্রামে ওঁৎ পেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল কমান্ডার মো. আজিজুর রহমান (বিমান বাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার)-এর নেতৃত্বে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। কালনা ঘাট যুদ্ধে ৮ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং সাব্বির খান নামক একজন পাকসেনা আহত অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পরের দিন যশোর সেনানিবাস থেকে পাকসেনাদের একটি বিশাল বাহিনী ঘাটের পশ্চিম পাড়ে অবস্থান নেয়। মুক্তিবাহিনী তাদের প্রতিরোধ করলে যুদ্ধ শুরু হয়। সারাদিন যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে সন্ধ্যার আগে পাকসেনারা যশোর সেনানিবাসে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। তৃতীয় দিন ২০শে নভেম্বর দিগনগর থেকে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রসহ পাকবাহিনীর তিনটি লঞ্চ কালনা ঘাটে হাজির হলে যুদ্ধ শুরু হয়। পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্রের অভাবে মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়। এ- যুদ্ধে আলফাডাঙ্গা উপজেলার চর নারানদিয়া গ্রামের আবুল হাসান, চরডাঙ্গা গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন এবং অপর একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
৭ই ডিসেম্বর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় ভাটিয়াপাড়া ক্যাম্প আক্রমণ করলে যুদ্ধ হয়। এতে সাধুহাটির মুক্তিযোদ্ধা ও রামদিয়া শ্রীকৃষ্ণ কলেজের ছাত্র জয়নাল আবেদীন শহীদ হন এবং ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। মুকসুদপুর থানা কমান্ডার জাফর আহমেদ মল্লিক মারাত্মকভাবে আহত হন।
১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় হলেও কাশিয়ানী উপজেলা হানাদারমুক্ত হয় ১৯শে ডিসেম্বর। ভাটিয়াপাড়া ওয়ারলেস স্টেশনটি ছিল পাকবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। ১৬ই ডিসেম্বর এখানকার পাকসেনাদের বারবার আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হলেও তারা তা না করায় এদিন খুব ভোরে নড়াইলের দিক থেকে মিত্রবাহিনীর লে. কর্নেল জোয়ান, ৮নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর মঞ্জুর, নড়াইল জোনের মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হুদা ও কমল সিদ্দিকী, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের দিক থেকে ইসমত কাদির গামা ও ক্যাপ্টেন নূর মোহাম্মদ বাবুলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে ভাটিয়াপাড়া ক্যাম্পে আক্রমণ চালান। ১৬, ১৭ ও ১৮ই ডিসেম্বর তিন দিনব্যাপী তুমুল যুদ্ধ শেষে ১৯শে ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে কাশিয়ানী উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— আব্দুর রউফ শরীফ, বীর প্রতীক (পিতা আলেম শরীফ, তাড়াইল), ইবনে ফজল বদিউজ্জামান, বীর প্রতীক- (পিতা শেখ ফজলুর রহমান, সুপ্ত), হাবিলদার আবদুল গফুর, বীর প্রতীক (পিতা হাতেম মোল্লা, রাজপাট) ও এ এন এম নজরুল ইসলাম, বীর প্রতীক (পিতা মমিন উদ্দিন, খাঁরহাট)।
কাশিয়ানী উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— ইবনে ফজল বদিউজ্জামান, বীর প্রতীক (৩রা ডিসেম্বর পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), আলী আকবর সরদার (পিতা হিঙ্গুল সরদার, ফুকরা; ৩১শে অক্টোবর ফুকরার যুদ্ধে শহীদ), রবিউল শিকদার (পিতা কছেদ শিকদার, দক্ষিণ ফুকরা, ঐ), রেজাউল কারিগর (পিতা ছায়েন উদ্দিন কারিগর, দক্ষিণ ফুকরা; ঐ), আবু কারিগর (পিতা মো. কানাই কারিগর, দক্ষিণ ফুকরা; ঐ), ইমাম মিয়া (পিতা মো. মোকসেদ মিয়া, বাহিরবাগ; ঐ), হাবিবর রহমান সরদার (পিতা মো. ফাগু সরদার, বাহিরবাগ; ঐ), আবুল হোসেন মোল্যা (পিতা আব্দুল বারেক মোল্যা, দহিসারা; ঐ), আব্দুল মান্নান (পিতা আব্দুল গনি মোল্যা, ধোপাপাড়া; ঐ), চান মোল্যা (পিতা মো. আব্দুল মজিদ, খাগাইল; ঐ), মজিবর রহমান (পিতা খালেক মুন্সী, কাগদী; ৮ই ডিসেম্বর ভাটিয়াপাড়া যুদ্ধে শহীদ), মো. হান্নান শেখ (পিতা হালিম শেখ, ডোমরাকান্দি; ১৪ই ডিসেম্বর ভাটিয়াপাড়া যুদ্ধে শহীদ), এ কিউ এম জয়নুল আবেদীন (পিতা আব্দুল মান্নান মিয়া, সাধুহাটি; ১৬ই ডিসেম্বর ভাটিয়াপাড়ার যুদ্ধে শহীদ), অনিল কুমার বিশ্বাস (পিতা অভিমন্যু বিশ্বাস, চরভাটপাড়া), আব্দুর রউফ ওর ফে বাবু মিনা (পিতা শফিজউদ্দিন মিনা, চাপতা; সাতক্ষীরার তালা থানার যুদ্ধে শহীদ), ছালাম মোল্যা (পিতা রিয়াজউদ্দিন মোল্যা, কুসুমদিয়া; সাতক্ষীরার জীবননগর যুদ্ধে শহীদ), হানিফ সরদার (পিতা মানিক সরদার, হরিদাসপুর বর্ডারের একটি যুদ্ধে শহীদ), মো. ফায়েক মোল্যা (পিতা মো. শাহজাহান মোল্যা, কামারোল; পুলিশ বাহিনীতে ছিলেন), ইউনুচ খন্দকার (পিতা নিজাম খন্দকার, নিজামকান্দী), মহসিন (পিতা সারেজান, পশ্চিম ফুকরা; সাতক্ষীরার একটি যুদ্ধে শহীদ), গোলাম মোস্তফা শাহেব (পিতা রাহেন উদ্দিন মুন্সী, পশ্চিম ফুকরা; সাতক্ষীরার একটি যুদ্ধে শহীদ), সুভাষ চন্দ্ৰ বিশ্বাস (পিতা কেশব লাল বিশ্বাস, খলিশাখালী; উলপুর যুদ্ধে শহীদ), সরোয়ার হোসেন খান (পিতা আমির হোসেন খান, খলিশাখালী; উলপুর যুদ্ধে শহীদ), আলাউদ্দিন (পিতা খবিরউদ্দিন আহম্মদ, রাতইল), আব্দুর রাজ্জাক (পিতা মোফাজ্জেল হোসেন, কাঠাম), কাদের মোল্যা (পিতা আছির উদ্দিন মোল্যা, সিতারামপুর), শাহাবুদ্দিন আলম (পিতা বাকা মিয়া, পোনা), সানোয়ার মল্লিক (পিতা আবসার উদ্দিন মল্লিক, খাগবাড়িয়া), নজরুল ইসলাম (পিতা মো. ইমান উদ্দিন, ফুকরা), মো. লোকমান মুন্সি (পিতা কুটি মিয়া মুন্সি, ফুকরা), আবুবকর মোল্লা (পিতা মো. কানু মোল্লা, ফুকরা), শাহাবুদ্দিন আলম (পিতা মিলু মোল্লা, দইসারা, রাজপট), মো. ওসমান আলী (পিতা কাঞ্চন শরীফ, বরাশুর; ইপিআর সদস্য), গোলাম মোস্তফা (পিতা ধলা মিয়া মজুমদার, ফুকরা; ইপিআর সদস্য), মতিউর রহমান সিকদার (পিতা আবদুল বারিক সিকদার, তেঁতুলিয়া রাজপাট; আনসার সদস্য), মোফাজ্জল হোসেন মোল্লা (পিতা আনতাজ মোল্লা, ফুকরা), ইমাম হোসেন মিয়া (পিতা মোকসেদ মিয়া, ছোট বহরবাগ; ইপিআর সদস্য), আক্তার হোসেন (পিতা বসিরউদ্দিন মোল্লা, হরিদাসপুর; ইপিআর সদস্য), আবদুল বারিক শরীফ (পিতা আবদুল আজিজ শরীফ, হরিদাসপুর; ইপিআর সদস্য), ইদ্রিস আলী মোল্যা (পিতা আলেফ মোল্যা, সাতাশিয়া; পুলিশ সদস্য), মো. হাকিম মোল্যা (পিতা মো. লতিফ মোল্যা, পরানপুর; সেনাসদস্য), সৈয়দ হাসমত আলী (পিতা মনসুর আলী, রাজপাট; ইপিআর সদস্য), আবদুল খালেক শেখ (পিতা মো. জিতু শেখ, রাতইল; ইপিআর সদস্য), হানিফ মিয়া (পিতা মোন্তাজ মুন্সি, রাতইল; পুলিশ সদস্য), মো. ইউনুস আলী (পিতা মো. হাসেন আলী সরদার, রাতইল), মোশাররফ হোসেন (পিতা লাবু সরদার, ফুকরা), আকরাম হোসেন (পিতা ইংগুল সরদার, ফুকরা), মো. ফজলু মোল্লা (পিতা সাফাজউদ্দিন মুন্সি, সাজাইল), মো. হালিম মোল্লা (পিতা মো. কালু মোল্লা, সাজাইল), মো. রবি মোল্লা (পিতা মো. কালু মোল্লা, সাজাইল), মো. জালাল মোল্লা (পিতা মো. ফজলু মোল্লা, সাজাইল), হাসমত আলী চৌধুরী (পিতা আকরাম চৌধুরী, শুক্তাগ্রাম), সৈয়দ আবুল বাসার টুলু (পিতা সৈয়দ আলাউদ্দিন, দস্তানা), আব্দুল কুদ্দুস (বামনডাঙ্গা যুদ্ধে শহীদ), আবুল কালাম (কেকানিয়া, বামনডাঙ্গা যুদ্ধে শহীদ) এবং ইয়াসির (রামদিয়া কলেজের ছাত্র, ভাটিয়াপাড়া যুদ্ধে শহীদ)।
কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়ার ভিএইচএফ ওয়ারলেস স্টেশনে নির্মিত হয়েছে ভাটিয়াপাড়া ওয়ারলেস স্টেশন স্মৃতিসৌধ। এখানে সম্মুখ যুদ্ধে যে-সকল মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, তাঁদের নাম-ঠিকানাসহ সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সংবলিত একটি স্বেত পাথরের প্লেট স্থাপন করা হয়েছে। ভাটিয়াপাড়া রেল স্টেশনের পূর্বপাশের গণকবরে গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে— ভাটিয়াপাড়া রেল স্টেশন স্মৃতিফলক। ফুকরার যুদ্ধে যে- সকল মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসী শহীদ হন, তাঁদের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মাণ করা হয়েছে ফুকরা স্মৃতিসৌধ। পোনা গ্রামে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মীর শওকত আলীর নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। [এ কে এম ফিরোজ আহমেদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!