You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে কাহারোল উপজেলা (দিনাজপুর)

কাহারোল উপজেলা (দিনাজপুর) ১৯৭০ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয় যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সহজে ক্ষমতা বাঙালিদের হাতে অর্পণ করবে না। তাই তাদের অধিকার আদায়ের জন্য কঠোর হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। এমতাবস্থায় ১৯৭১ সালের শুরুর দিকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে পড়ুয়া ছাত্ররা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে সংগঠিত হতে থাকেন। মার্চ মাসের ৫-৬ তারিখে সর্বস্তরের জনগণকে নিয়ে কাহারোল গণ সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভাপতি ছিলেন মীর মাসুদ আলী চৌধুরী (ছাত্রলীগ নেতা ও স্কুল শিক্ষক) এবং সাধারণ সম্পাদক গোপেশ চন্দ্র রায় (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়ন – নেতা)। কমিটি গঠনে সহায়তা করেন কাহারোল থানার সার্কেল অফিসার মো. আব্দুল মতিন এবং রামচন্দ্রপুর স্কুলের সহকারী শিক্ষক মো. আশরাফুল হক। পরবর্তী সময়ে মীর মাসুদ আলীকে তাঁর দায়িত্ব পালনে বিশেষভাবে সাহায্য করেন অধ্যাপক মো. রফিকুল ইসলাম (অধ্যক্ষ, কাহারোল কলেজ)। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতা-কর্মীরা এ উদ্যোগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার পর সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা কাহারোলের বিভিন্ন হাট-বাজারে সভা করে মানুষকে সংগঠিত করতে থাকেন। চাঁদা সংগ্রহ, প্রশিক্ষণের জন্য যোগাযোগ, খাজনা বন্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করা প্রভৃতি কাজ তাঁরা করেন। এছাড়া মিছিল-মিটিং, বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে জমায়েত হওয়া ইত্যাদি চলতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অনেকে যুদ্ধাহতদের সেবা দিয়েছেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার তৈরি করেছেন। কেউ-কেউ কাহারোল সদর উপজেলার কুঠিবাড়ি ও দশ মাইল এলাকায় খবর সরবরাহ করতেন। এসব কাজে নিয়োজিতদের মধ্যে এডভোকেট আব্দুল মান্নান, বিজয় মোহন্ত, প্রফুল্ল কুমার রায়, মুকুল চন্দ্র রায়, রামাজিও হাসদা, মহব্বত আলী মোবা (খোসালপুর), হাজী আব্দুর রউফ, জসিমউদ্দিন (ব্যাংকার) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ছাত্রদের মধ্যে রাজেন দেবনাথ,
ব্রজেশ্বর শীল শর্মা, ইসমাইল হোসেন, মনিরাম রায়, শহীদুল ইসলাম, ফুলচাঁদ রায়, সুশীল চন্দ্র রায়, মহসিন আলী, আব্দুল খালেক সরকার বিএসসি এবং সাখাওয়াত আলীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দশ মাইল এলাকার সাখাওয়াত আলী এবং গোলাম রহমানের ব্যবস্থাপনায় ভারতের কালিয়াগঞ্জে অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মীর মাহবুব আলী, শহীদুল ইসলাম (যুবনেতা), ওয়াছিম উদ্দীন শাহ (আওয়ামী লীগ নেতা), মহব্বত আলী মোবা, পুরানচন্দ্র রায় প্রমুখ শিলিগুঁড়ি, হামজাপুর, তরঙ্গপুর, পানিঘাটা ও বটেশ্বরী ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এঁদের অনেকেই পরে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের সময় স্থানীয় ডাক্তার তমিজউদ্দিন মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রূষা ও সাহায্য করতেন।
কাহারোল উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন জহুরুল ইসলাম (গাইবান্ধা, কামড় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক), আনোয়ারুল হক চৌধুরী (মরিচা, বীরগঞ্জ) এবং গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন নীলচরণ (বীরগঞ্জ)।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে সৈয়দপুর থেকে পাকসেনারা দশ মাইল পার হয়ে সদর উপজেলায় প্রবেশের চেষ্টা করে। ৯ই এপ্রিল সদর উপজেলার রামডুবি মোড় থেকে দশ মাইল পর্যন্ত এলাকায় তাদের সঙ্গে স্থানীয় জনগণের তুমুল লড়াই হয়। ১৩ই এপ্রিল প্রতিরোধ ভেঙ্গে গেলে প্রতিরোধকারীরা কাহারোল ইউনিয়ন পরিষদে এসে আশ্রয় নেয়। সেখানে আহত কয়েকজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। পরে চিকিৎসার জন্য ভারতে নেয়ার পথে দুজনের মৃত্যু হয়।
মুক্তিসেনারা পাকসেনাদের গ্রামে প্রবেশের পথ বন্ধ করার জন্য হরিশচন্দ্রপুরে নদীর ওপরের পুল ও মুরারীপুর এলাকার কালভার্ট ধ্বংস করে দেন। পার্শ্ববর্তী এলাকার মোল্লাপাড়ায় তাঁরা একজন রাজাকারকে হত্যা করেন এবং এহসানুল হক নামে অপর একজনকে গুলিবিদ্ধ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলটি গোপনে খানসামা ও বীরগঞ্জ এলাকায় অস্ত্র সরবরাহ করত।
কাহারোল উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রভাব এবং এলাকাটি কিছুটা বিচ্ছিন্ন হওয়ায় পাকবাহিনী এখানে স্থায়ী কোনো ক্যাম্প স্থাপন করেনি। তবে মাঝে-মধ্যে এসে অপারেশন চালাত। কাহারোল উপজেলায় পাকসেনাদের ঘাঁটি না থাকলেও শান্তি কমিটির তৎপরতা ছিল। শান্তি কমিটির প্রথম চেয়ারম্যান ছিল মাওলানা কফিলউদ্দিন (কাহারোল থানা জামায়াতে ইসলামীর পেসিডেন্ট) এবং পরে ইসাহাক মাস্টার (৬ নং ইউনিয়ন)। এদের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয় এবং এই দুই বাহিনীর সদস্যরা এলাকায় অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালায়। যুদ্ধের প্রথম দিকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতিকালে সাদুল্যাপুর গ্রামের কয়েকজন তাদের হাতে শহীদ হন। ১৮ই এপ্রিল হাজী মশির উদ্দিন (২নং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান)-এর নেতৃত্বে অশ্বিনীপাড়ায় ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালানো হয়। তার নেতৃত্বে ভাতগাঁর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হককে পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়। পার্শ্ববর্তী থানার মঞ্জুর হোসেন হাজী মশিরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্যাপক লুটপাট চালায়। ৪ঠা মে পাকসেনারা সদরপুর ময়দানের কাছে জনৈক ইফারউদ্দিনের ছেলে মো. ধুলুকে গুলি করে হত্যা করে।
মির্জাপুর গ্রামের শহীদুল ইসলাম, বেরগাঁ গ্রামের কমান্ডার ধ্বনিবুল্লাহ, টিকিরাম মেথর ও তার মা, বোকদর গ্রামের ফাতের আলী, কমরেড খলিল এবং অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম এঁরা সকলেই ছিলেন ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। রাজাকার আজাহারের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে এঁরা একবার চরম বিপদের মুখে পড়েছিলেন।
আগস্ট মাসের দিকে জগন্নাথপুর এলাকার মহোদীপুর স্কুলের কাছে পাকসেনারা সাধারণ মানুষের ওপর ব্যাপক অত্যাচার চালায়। এ-সময় হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। সেদিন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন কেরামত, বজলু ও জিন্নাহ নামে তিন গ্রামবাসী। টাঙ্গন নদীর দমনীঘাট দিয়ে ভারতে পালিয়ে
যাওয়ার সময় পাকসেনা ও রাজাকাররা অনেককেই ধরে নিয়ে হত্যা করে।
পাকবাহিনী হেলেঞ্চাকুরী গ্রামে অগ্নিসংযোগের পর আছির উদ্দিন (পিতা কসেতুল্লাহ), দফুর উদ্দিন (পিতা খয়েরতুল্লাহ), আব্দুল্লাহ (পিতা গেলগেলা প্রধান) এবং সত্যানন্দ (পিতা দওশাহ)-কে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ২৬শে মে (১১ই জ্যৈষ্ঠ) পাকবাহিনী শিঙ্গারী গাঁ গ্রামে এক ভয়াবহ গণহত্যা চালায়। শিঙ্গারী গাঁ গণহত্যায় সেদিন ৪৭ জন সাধারণ মানুষ প্রাণ হারায়। পাকসেনারা মহেশচন্দ্র নামে একজন মুক্তিযোদ্ধার শরীরের চামড়া তুলে সেখানে লবন লাগিয়ে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এছাড়া তারা অনীল (তারাপুর), ঢেলারাম রায় (ছাতইল), গোবিন্দ (নয়াবাদ), মহেশবাবু (তরলা), গঙ্গারাম রায় (তরলা), যোগীন্দ্র বর্মণ (ওলোন), জঙ্গুলু (ওলোন), অনীল চন্দ্ৰ বৰ্মণ (সুলতানপুর), বীরেন্দ্রনাথ শীল (সুলতানপুর), নাগর শাহ (কাঁকর), কালটাং (কাঁকর), কৈলাশ (বাহেরপুর), মন্টু মোহাম্মদ (পিতা মঙ্গল মোহাম্মদ, সাহাপুর), মাখন রায় (পিতা মঙ্গল চন্দ্র রায়, নিমইল), দীননাথ রায় (পিতা দীপচরণ রায়, ওলোন), গণেশ চন্দ্র রায় (পিতা শশীমোহন রায়, ওলোন) এবং জাবিল (বাইশপুর)-কে হত্যা করে। এ সময়ে ভরণ্ডা গ্রামেও একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়, যা ভরণ্ডা গণহত্যা- নামে পরিচিত। এ গণহত্যায় ১৪ জন সাধারণ লোক প্রাণ হারায়। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকাররা এ গণহত্যা সংঘটিত করে।
কাহারোল ও বোচাগঞ্জ উপজেলার সীমান্তে পাকুড়া বর্ডারে পাকসেনারা একটি বড় ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। বোচাগঞ্জ উপজেলার তেতরা বর্ডার দিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় হিন্দু- মুসলিম নির্বিশেষে শরণার্থীদের এ ক্যাম্পে ধরে এনে হত্যা করা হতো।
পাকবাহিনী মার্চ মাসের ২৩-২৪ তারিখ সৈয়দপুর থেকে দিনাজপুর শহরে প্রবেশের চেষ্টা করলে স্থানীয় লোকজন তাদের বাধা দেয়। পরে তারা আরো শক্তি সঞ্চয় করে এগুতে থাকলে ইপিআর বাহিনী এগিয়ে আসে। মার্চের ২৭- ২৯ তারিখ বীরগঞ্জ-কাহারোল সীমান্তের মদনপুর এলাকায় আনসার বাহিনীর সঙ্গে পাকসেনাদের একটি খণ্ডযুদ্ধ হয়। সে-সময় কাহারোল থানার ওসি মোজাহারুল ইসলাম অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেন।
মুক্তিযোদ্ধারা একবার ৫ জন রাজকারকে ধরে ফেলেন। তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অনেক গোপন কাগজপত্র পাওয়া যায়। কমান্ডার আনোয়ারুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে বোচাগঞ্জ থানার মাধবপুর গ্রাম-সংলগ্ন নদীতে নামিয়ে তাদের দুজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসব রাজাকারদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ৩টি রাইফেল উদ্ধার করেন।
ঠাকুরগাঁ থেকে পালিয়ে আসা দুজন পাকসেনা পাইকপাড়া বড়বট গাছের পাশ দিয়ে এলাকায় ঢুকে পড়লে জনগণ তাদের তাড়া করে। আব্দুল আউয়াল ও পুরাণ চন্দ্র রায় নামে দুজন তাদের ধরতে গেলে পাকসেনাদের গুলিতে আব্দুল আউয়াল শহীদ হন। নিজ বাড়ির সামনে তাঁকে সমাহিত করা হয়। পরে জনগণের হাতে পাকসেনা দুজনও নিহত হয়। ৬ই ডিসেম্বর কাহারোল উপজেলা শত্রুমুক্ত হয়।
কাহারোল উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁদের নাম জানা গেছে, তাঁরা হলেন— ভটরা শিং ওরফে খরগমোহন রায় (পিতা দর্পনারায়ণ রায়, ডহচী), শহীদুল ইসলাম (পিতা মজিবর রহমান, তরলা), রামাজিও হাঁসদা (পিতা দুর্গাচরণ হাঁসদা, তরলা), মহেশ চন্দ্র রায় (পিতা রতন চন্দ্র রায়, তরলা), আউয়াল, নরেন্দ্র চন্দ্র (পিতা ফুটুং চন্দ্র, উথরাইল) এবং ঢেনা মুরমু (পিতা বাতাশু রাম রায়, ছাতইল; বিরল উপজেলার শ্যামপুর এলাকায় দুজন সঙ্গীসহ তীরধনুক নিয়ে একজন পাকসেনাকে হত্যা করতে উদ্যত হলে পাকসেনার গুলিতে শহীদ হন)।
শিঙ্গারী গাঁ গণহত্যায় শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ২০১২ সালে শিঙ্গারী গাঁ যুব উন্নয়ন সংঘের উদ্যোগে এলাকায় একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। পরবর্তীতে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উপজেলা কার্যালয় প্রাঙ্গণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়, যা শিঙ্গারী গাঁ স্মৃতিসৌধ- নামে পরিচিত। এর এক পাশে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাসহ মোট ৬৫ জন শহীদের নাম খোদাই করা আছে। অপর পাশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান–এর প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ করা হয়েছে। এছাড়া পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ আব্দুল আউয়ালের নামে কাহারোল উপজেলা পরিষদের পার্শ্ববর্তী রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে শহীদ আউয়াল সড়ক। [মারুফা বেগম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!