মুক্তিযুদ্ধে কাহালু উপজেলা (বগুড়া)
কাহালু উপজেলা (বগুড়া) বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন- শুরু হলে -কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মোখলেছুর রহমান ও আব্দুর লতিফের নেতৃতে কাহালু উপজেলার মুক্তিকামী মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সংগঠিত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর এ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। আওয়ামী লীগ-এর এ কে মজিবুর রহমান আক্কেলপুরী এমএনএ, এম এ লতিফ (এসডিও), ভাষা-সৈনিক এডভোকেট গাজিউল হক, এডভোকেট আকবর আলী, হোসেন আলী (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা) প্রমুখের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম শুরু হয়। কাহালুর মালঞ্চা, নারহট্ট ও শেখাহার উচ্চ বিদ্যালয় এবং পিপড়া নামক স্থানে স্থানীয় তরুণদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এতে নেতৃত্ব দেন আছমত আলী (নারহট্ট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক), কালীপদ মজুমদার, জাহাঙ্গীর আলম, আব্দুর রশিদ বুলু, আব্দুল আজিজ চাঁন, এস এম আকতার আলী, সৈয়দ আলী মিয়া, ইদ্রিস আলী, এ বি এম ইয়াদ আলী, বিমল কুমার সরকার, জাহিদুর রহমান তোতা প্রমুখ ব্যক্তি। সৈয়দ আলী, অধ্যক্ষ হোসেন আলী, আসমত আলী, এ বি এম শাহজাহান (ছাত্রনেতা; স্বাধীনতাপরবর্তীকালে জাসদ-এর নেতা), আবুল হোসেন, আব্দুর রশিদ বুলু, খলিলুর রহমান, রিছালদার খয়বর আলী ও অছিম সিপাইসহ স্থানীয় জনগণ সংগঠিত হয়ে জাহাঙ্গির আলম, ইদ্রিস আলী, বিমল কুমার সরকার প্রমুখের সহযোগিতায় কাহালু থানার ওসি রবীন্দ্রনাথ সরকারের নিকট থেকে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ও গুলি সংগ্রহ করেন। বগুড়া শহরের স্বপন ও তপনের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের অর্থ ট্রাকযোগে কাহালু থানার মুরইল ইসলামীয়া মাদ্রাসায় নিয়ে আসে। পাকবাহিনী যুদ্ধবিমান থেকে বগুড়া রেল স্টেশন ও অন্যান্য স্থানে বোমাবর্ষণ করলে সেখান থেকে ঐ অর্থ মুরইল, সুবইল, পুড়াপাড়া, কাটনাহার, দামাই, শীতলাই, বড়মহর, ভালতা, শিকড় ও উলট্টসহ আশপাশের গ্রামের লোকজন নিয়ে যায়। এরপর উক্ত অর্থ আওয়ামী লীগের যুদ্ধকালীন কেন্দ্রীয় কার্যালয় বালুরঘাটে (ভারত) প্রেরণ করা হয়। কাহালু উপজেলার ছাত্র, যুবক ও সংগ্রামী জনতা সংগঠিত হয়ে এক অংশ কুরমাইল ক্যাম্পে ও পরে ভারতের দেরাদুনে মুজিব বাহিনী-র প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে পুনরায় অধ্যক্ষ হোসেন আলী ও এ বি এম শাহজাহানের নেতৃত্বে এলাকায় ফিরে আসে। অপর অংশ ডা. ননী গোপাল দেবদাস, কমরেড মোখলেছুর রহমান, মোশারফ হোসেন মণ্ডল, আব্দুল লতিফ, ওমর আলী, ডা. আব্দুল মান্নান বুলু ও আব্দুর রহমান (প্রধান শিক্ষক, পাঁচগ্রাম)-এর সহযোগিতায় কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে শিলিগুঁড়িতে (ভারত) প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এ উপজেলার যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন অধ্যক্ষ হোসেন আলী, মো. গোলাম মোস্তফা মন্টু ও আমজাদ হোসেন।
এপ্রিল মাসে পাকবাহিনী কাহালুতে অনুপ্রবেশ করে। তারা বগুড়া থেকে গোদারপাড়া হয়ে কাহালুর মুরইলে এবং সান্তাহার থেকে রেলপথ হয়ে কাহালু রেলওয়ে স্টেশন, কাহালু থানা ও শ্রী-বালাজী রাইস মিলস-এ ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকবাহিনীর সহায়তায় কাহালুতে রাজাকার- ও আলবদর বাহিনী এবং শান্তি কমিটি- গঠিত হয়। এর প্রধান সংগঠক ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী থেকে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্য মওলানা আবদুর রহমান ফকির। রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিল- সেফাত আলী মেম্বর (উলট্ট), মোজাফ্ফর কাজী (আখুঞ্জা), আব্দুস সামাদ (কাহালু), আব্দুল জলিল (উলট্ট), খায়রুল ইসলাম (দলগাড়া), কালু (পাল্লাপাড়া), ফজলু (জয়সারা), খোরশেদ আলম তালুকদার (কাহালু) প্রমুখ। আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিল মোমিন হাজী (মুরইল)। শান্তি কমিটির সদস্য ছিল লজাবত আলী (নারহট্ট) ও আব্দুল করিম তালুকদার (নারহট্ট)।
৫ই মে পাকবাহিনী সান্তাহার থেকে রেলযোগে বগুড়া যাওয়ার পথে কাহালু রেলস্টেশনে কতিপয় বিহারি ও এ-দেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় কাহালু জমিদার বাড়ি (বাবুর বাড়ি)-তে হানা দিয়ে চিরকুমার জমিদারের সেবায়েত ও গোবিন্দ জিউ বিগ্রহের সেবায়েত কালীপদ মজুমদারসহ পালপাড়া ও লক্ষ্মীপুর গ্রামের প্রায় ২১ জন হিন্দু-মুসলিমকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে ছিলেন পালপাড়া গ্রামের ভূপিন্দ্রনাথ মহন্ত, কুড়ানু চন্দ্র, কালা চন্দ্র, অভয় চন্দ্ৰ, রাধান্দ্রনাথ, কৃষ্ণ গোপাল মহন্ত ও গৌর গোপাল মহন্ত এবং লক্ষ্মীপুর গ্রামের শুকরা, ভুলু কসাই, মাহমুদ আলী, আমির আলী (আমু) প্রমুখ। এদের বগুড়ায় পাকবাহিনীর মেজরের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ট্রেনে ওঠায় এবং উপজেলার উলট্ট নামক স্থানে গিয়ে ট্রেন থেকে নামিয়ে পেছন দিক থেকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়। স্থানীয় জনগণ উলট্ট গণহত্যার শিকারদের লাশগুলো নিকটস্থ এক জমিদারের জমিতে গণকবর দেয়। এর দু-একদিনের মধ্যেই পাকবাহিনী ও বিহারিরা গিরাইল গ্রামে গণহত্যা চালায়। গিরাইল গণহত্যায় পেমা চন্দ্র, নারায়ণ চন্দ্র, ঝন্টু চন্দ্র, রুহিনাথ চন্দ্র, চান্দ চন্দ্র, রামাকান্ত চন্দ্র, ফতু চন্দ্র, তিলক চান, কর্ণধর ও তারা চন্দ্রসহ ২০ জনের অধিক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক নিহত হয়। ৮ই মে তারা নশিরপাড়া গ্রামে গণহত্যা চালায়। অশোক প্রামাণিক, খোসা প্রামাণিক, গোলাম উদ্দিন প্রামাণিক, ছলিমুদ্দি, আব্দুস সামাদ, লেবু প্রমুখ নশিরপাড়া গণহত্যার শিকার হয়। একই দিন সংগঠিত হয় জয়তুল গণহত্যা। জয়তুল গ্রামে তারা ৭০ জনের মতো মানুষকে হত্যা করে। কাহালু থানার নিকট তারা নারীধর্ষণের ঘটনা ঘটায় এবং মুরাইল গ্রামে গুরুদয়াল চাকীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে।
কাহালুতে পাকবাহিনীর নির্দিষ্ট কোনো নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল না। তাদের এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হতো হরিরাম আগরওয়ালার বাড়ির দ্বিতীয় তলার গদি ঘরে। জামায়াতে ইসলামীর মাওলানা আব্দুর রহমান ফকির (স্বাধীনতাপরবর্তী সংসদ সদস্য), মোজাফ্ফর কাজী, লজাবত আলীসহ রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর নেতৃবৃন্দ নিয়মিত এখানে বসে স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা চালাত।
কাহালু রেলস্টেশনের পশ্চিম পার্শ্ব, থানা চত্বর, রেল লাইনের দক্ষিণ পার্শ্ব (উলট্ট), কালাই রাজবাটি এবং নাগর নদী এলাকায় গণকবর রয়েছে।
কাহালু উপজেলার মুক্তিযুদ্ধ দুটি অঞ্চলে বিভক্ত করে পরিচালিত হয়— উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চল। নারহট্ট বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, নারহট্ট ইউনিয়ন পরিষদ ও কালাই রাজবাটি নিয়ে উত্তরাঞ্চল এবং কাহালু সদর ও জামগ্রামের পানাই নিয়ে দক্ষিণাঞ্চল। উত্তরাঞ্চলে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংরক্ষিত থাকত। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে উপজেলার কুড়িবামুজাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। এ বি এম শাহজাহান, অধ্যক্ষ হোসেন আলী ও গোলাম মোস্তফা (মন্টু)-র নেতৃত্বে ৮২ জন মুক্তিযোদ্ধা এতে অংশ নেন। সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত গোলাগুলি চলে। -কড়িবামুজা যুদ্ধ-এ ২ জন পাকসেনা ও ১ জন রাজাকার নিহত হয়। কাহালু উপজেলার কড়ই নামুজা গ্রামে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়, যা কড়ই নামুজা যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। নন্দীগ্রাম উপজেলার যুদ্ধকালীন কমান্ডার আবু বক্কর সিদ্দিক এবং মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরার পথে এ- যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধে ২৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১৩ই ডিসেম্বর কাহালু উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
কাহালু উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নুরুল আমিন (খাজলাল), হেলাল উদ্দিন (ধানপুজা) ও মাস্টার আমজাদ হোসেন (ডোমগ্রাম)।
কাহালু উপজেলা চত্বরে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি নামফলক স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া মহেশপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। [আব্দুল হান্নান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড