You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে কালীগঞ্জ উপজেলা (ঝিনাইদহ)

কালীগঞ্জ উপজেলা (ঝিনাইদহ) ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা। কারণ, তখন যশোর সেনানিবাস থেকে ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা-কুষ্টিয়া যাওয়ার অন্যতম যোগাযোগ মাধ্যম ছিল সড়কপথ এবং কালীগঞ্জ থেকে পশ্চিমে একটি রাস্তা কোটচাদপুর হয়ে ভারত সীমান্তবর্তী মহেশপুর হয়ে চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছেছে। এ উপজেলার অধিবাসী মো. বিলায়েত হোসেন স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনীতিতে একজন সুপরিচিত ব্যক্তি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ এ রাজনীতিবিদ ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন-এ অন্যদের সঙ্গে নেতৃত্ব দান করেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৬৬-র ৬-দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর নিরঙ্কুশ বিজয় সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে না দেয়ায় তাঁর আহ্বানে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন- প্রভৃতি সংগ্রামে কালীগঞ্জের মানুষ সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। এতে নেতৃত্ব দেন সাবেক এমএলএ এবং সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত এমএনএ ইকবাল আনোয়ারুল ইসলাম। তখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বাংলার মানুষ ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাতই মার্চের ভাষণ- শুনে তারা উপলব্ধি করে যে, পাকিস্তানিদের সঙ্গে তাদের আর থাকা সম্ভব হবে না। তাই বঙ্গবন্ধুর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এ ঘোষণা শুনে তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। কিন্তু প্রথম পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য কালীগঞ্জে কোনো প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছিল না। তাই আনসার কমান্ডার আবুল হোসেনসহ অন্যান্য আনসার ও মুজাহিদ সদস্য ভারতে গিয়ে বনগাঁর বিএস ক্লাবের সেক্রেটারি অলোক ঘোষের সহযোগিতায় সেখানকার ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। এ ক্যাম্পের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মুখার্জী। পরবর্তীকালে কালীগঞ্জেই প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা হয়। সহকারী কমান্ডার হেলাল উদ্দীন সরদারসহ আরো কয়েকজন সাব-কমান্ডারের নেতৃত্বে মালিয়াট ইউনিয়নের বেথুলী-মল্লিকপুর বটতলা এবং মনোহরপুর গ্রামের খেলার মাঠে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
এপ্রিলের শেষার্ধে এ ফ এ ফ (মুক্তিবাহিনী এবং বিএলএফ (মুজিব বাহিনী) যোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যান এবং টালিখোলা, মতিগঞ্জ হাইস্কুল, রাণাঘাট, টাকিপুর, হাসনাবাদ, কল্যাণী, চাঁপাবেড় (বিহার) প্রভৃতি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। উলাদ হোসেন (পিতা গোলাপ বিশ্বাস, মান্দারবাড়িয়া), হেলাল উদ্দীন সরদার (পিতা আনোয়ার হোসেন সরদার, ফয়লা), ক্যাপ্টেন আবু জাফর (ফয়লা), আনোয়ার হোসেন (নোয়াদাগা), শামসুর রহমান (মনোহরপুর), আব্দুল মজিদ (মনোহরপুর), আবুল কাশেম নালা (বাদুরগাছা), আয়নাল হোসেন (মালিয়াট) প্রমুখ চাঁপাবেড় ও আসামে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মুজিব বাহিনীর যোদ্ধারা দেরাদুন (উত্তর প্রদেশ), হাফলং (আসাম) প্রভৃতি স্থানে প্রশিক্ষণ নেন।
কালীগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন ইকবাল আনোয়ারুল ইসলাম এমএনএ, ভাসানী ন্যাপ- নেতা মাহমুদুল হক ওরফে মনি পীর (কালীগঞ্জ) ও কাজী নওশের আলী (সিংগী), আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সাত্তার মিয়া (ফয়লা, থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি), এহিয়া মোল্লা (হেলাই, থানা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি), ডাক্তার নূরুল ইসলাম শুকুর (কালুখালী), ডাক্তার শমসের আলী (ঘোপপাড়া, বারোবাজার), মহিউদ্দীন মিয়া (আড়পাড়া) প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৮নং সেক্টরের সাব- সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন এ টি এম আব্দুল ওয়াহ্হাব (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল), কালীগঞ্জ থানা কমান্ডার ছিলেন উলাদ হোসেন, সহকারী থানা কমান্ডার ছিলেন হেলাল উদ্দীন সরদার, আব্দুল ওয়াদুদ (জগদীশপুর, বর্তমান চৌগাছা উপজেলা), এডভোকেট আব্দুল আজিজ (দুললপুর, বর্তমান চৌগাছা উপজেলা), কমান্ডার আবুল হোসেন (পিতা শমশের আলী, বেজপাড়া; আনসার), প্রশিক্ষক সহিল উদ্দীন (শ্রীরামপুর, প্রাক্তন সেনাবাহিনীর সদস্য) এবং প্রশিক্ষক অকিল উদ্দীন (শ্রীরামপুর, আনসার)। সাব-কমান্ডার ছিলেন আমজাদ হোসেন (চাপালী), আব্দুল মান্নান (হেলাই), আব্দুস সাত্তার (হেলাই, পরবর্তীকালে থানা কমান্ডার), আবুল কাসেম (নালা, বাদুরগাছা) এবং আয়নাল হোসেন (মালিয়াট)।
ঝিনাইদহ মহকুমার এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমেদ এবং ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন শফিকউল্লাহর নেতৃত্বে কালীগঞ্জের আনসার বাহিনী ও সাধারণ জনতা ২৮শে মার্চ যশোর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে। তখন ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লে. কর্নেল আনোয়ার হোসেন (কুমিল্লা) পাকসেনাদের গুলিতে আহত হন এবং পরের দিন ২৯শে মার্চ ক্যান্টনমেন্টের উত্তর দিকে হৈবতপুর ব্রিজের নিকট তাঁর মৃত্যু হয় (স্থানীয় কাজী নজরুল ইসলাম কলেজের প্রবেশপথের পূর্বদিকে কবরস্থ)। ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচিতে মাহমুদুল হক (মনি পীর) গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এ অভিযানে যাঁরা অংশগ্রহণ করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন— আবুল হোসেন (বেজপাড়া, আনসার কমান্ডার), হেলাল উদ্দীন সরদার (হেলাই, বর্তমানে উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার), অকিল উদ্দিন (শ্রীরামপুর, আনসার), সহিল উদ্দীন (শ্রীরামপুর, সেনাবাহিনীর সদস্য), ইউসুফ আলী (আলাইপুর, আনসার), আবু জাফর (ফয়লা) এবং আবুল কাশেম নালা (বাদুরগাছা)। বাদুরগাছা গ্রামের ওসমান আলী লস্কর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে গিয়ে শহীদ হন।
৩রা এপ্রিল যশোর সদর থানার উত্তর ও কালীগঞ্জ থানার দক্ষিণ সীমান্ত এলাকা মহিষাহাটি-মুরাদগড়ে পাকিস্তানি সেনারা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত বাহিনী আগে থেকেই তাদের আসার খবর পেয়ে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করেছিল। পাকসেনারা এখানে আসামাত্রই বাঙালি ইপিআর- এর নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনী তাদের গতিরোধ করে।
১লা এপ্রিল শতাধিক গাড়ির বহর নিয়ে পাকবাহিনী যশোর সেনানিবাস থেকে কুষ্টিয়া অভিমুখে অগ্রসর হয়। তাদের গাড়িবহর কালীগঞ্জ অতিক্রম করার সময় মাহতাব উদ্দীন কলেজের সন্নিকটে মহর আলী মিয়াকে (ফয়লা) গুলি করে হত্যা করে। এদিন বিষয়খালীতে পাকসেনাদের একটি বড় বহর মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা প্রচণ্ডভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এ-সময় তাদের দুটি গাড়ি ধ্বংস হয় এবং কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। এসডিপিও মাহবুব উদ্দীনের নেতৃত্বে ইপিআর, মুজাহিদ ও আনসারদের সমন্বয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে মোকাবেলা করে। ফলে তারা পিছু হটে যশোর সেনানিবাসে ফিরে যায়। এ প্রতিরোধযুদ্ধে মাহতাব উদ্দীন (বিষয়খালী)-সহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ইকবাল আনোয়ারুল ইসলাম এমএনএ-এর এক পুত্র আলেকজান্ডার মোবারকগঞ্জ চিনিকলের সামনে পাকসেনাদের বহরের সামনে পড়লে তারা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। অপর পুত্র গোলাম মোস্তাফাকে পাকসেনারা বিষয়খালীতে গুলি করে হত্যা করে। ৩রা এপ্রিল মহিষাহাটি-মুরাদগড় যুদ্ধের পর পাকসেনারা বারোবাজার থেকে পূর্বদিকে সোনালীডাঙ্গা পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় আলতাফ হোসেন (বেলাট), আব্দুল আজিজ (সোনালীডাঙ্গা) ও আব্দুল ওয়াদুদকে (বাদুরগাছা) ধরে নিয়ে হত্যা করে। এরপর তারা বারোবাজারের পশ্চিম দিকে সাঁকোমথনপুর পর্যন্ত অভিযান চালায়। ১২ই এপ্রিল এসডিপিও মাহবুব উদ্দীনের নেতৃত্বে ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরী ও সুবেদার মুজাফ্ফরের অধীনে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধাকে দুলালমুন্দিয়া বাজারের পাশে মোতায়েন করা হয়। এখানে মহাসড়ক ও রেলপথ পাশাপাশি অবস্থিত। কিছুদূর এগিয়ে রেলপথ পশ্চিম-দক্ষিণে চুয়াডাঙ্গার দিকে এবং সড়কপথ ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়ার দিকে চলে গেছে। এ কারণে দুলালমুন্দিয়া বাজারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই মুক্তিযোদ্ধারা এখানে সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের এরূপ তৎপরতার কারণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এ উপজেলায় স্থায়ীভাবে কোনো ক্যাম্প স্থাপন করেনি। তবে বারোবাজারের পোস্ট অফিস এবং কালীগঞ্জ থানার সামনে লক্ষ্মীবাবু ও শ্রীমন্ত বাবুর বাড়িতে রাজাকার- বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। সেখানে পাকসেনারা এসে মাঝে-মধ্যে অবস্থান করত। তারা মূলত অপারেশন চালাত পার্শ্ববর্তী যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসে।
কালীগঞ্জ উপজেলায় পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী হিসেবে প্রধানত রাজাকার বাহিনী তৎপর ছিল। কালীগঞ্জ থানার সামনে তাদের ক্যাম্প ছিল। মমিন মৌলভী (কয়ারগাছি, আদিবাড়ি কুমিল্লা জেলায়) ও রফি উদ্দীন বিশ্বাস (পাইকপাড়া)-এর নেতৃত্বে রাজাকাররা শান্তি কমিটি গঠন করে, যার একটি শাখা ছিল বারোবাজারে। এর নেতৃত্বে ছিল মহসীন আলী মিয়া (বারোবাজার), ফজলুর রহমান ওরফে ফজলু ডাক্তার (ঘোপপাড়া, বারোবাজার) ও আনছার আলী (ঝনঝনিয়া)।
কালীগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা হলো— মমিন মৌলভী (শান্তি কমিটির সভাপতি), মুজিবুর মাস্টার (পিরোজপুর, শান্তি কমিটির সেক্রেটারি), ইবাদত হোসেন মণ্ডল (নাটোপাড়া, রাজাকার থানা কমান্ডার), রফি উদ্দীন বিশ্বাস (পাইকপাড়া), মহসীন আলী মিয়া (বারোবাজার), ফজলুর রহমান ওরফে ফজলু ডাক্তার (ঘোপপাড়া, বারোবাজার), আনছার আলী (ঝনঝনিয়া), আবু সাইদ (ফুলবাড়িয়া), আবুবকর সিদ্দিক মামুন (ফয়লা), মকছেদ আলী (ফারাসপুর), শফি বিশ্বাস (উল্লা, জামাল), আনোয়ার হোসেন (বলরামপুর), আব্দুল গণি (বলরামপুর), ইব্রাহিম (কাদিরকোল), ফজলু রহমান (পিরোজপুর), খলিলুর রহমান (মঙ্গলপৈতা), গোলাম রহমান (রঘুনাথপুর) প্রমুখ। সড়ক ও রেলপথ কালীগঞ্জ থানাকে পূর্ব ও পশ্চিমে দুভাগে বিভক্ত করেছে। পূর্বদিক থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের এ-দুটি রাস্তা অতিক্রম করে ভারতে যেতে হতো। দুলালমুন্দিয়া ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের রুট। তাই আলবদর- ও রাজাকাররা প্রায়ই এখানে হানা দিত। তারা শরণার্থীদের মালামাল ও টাকা-পয়সা লুট করে নিত এবং নারীদের নির্যাতন করত।
পাকসেনারা বারোবাজার ইউনিয়নের মহিষাহাটি গ্রামের মৃধা বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। সেখান থেকে ফেরার পথে আরো অনেক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে গ্রামটিকে ধ্বংস্তূপে পরিণত করে এবং মহিষাহাটি গ্রামের দেলবার মৃধা ও ফজলুর রহমানকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁদের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। মহিষাহাটি গ্রামে ধবংসযজ্ঞ চালানোর পর পাকসেনারা বারোবাজারের
দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে পূর্বদিকে সোনালীডাঙ্গা পর্যন্ত অগ্রসর হয়। তারপর তারা পুনরায় বারোবাজারে ফিরে এসে রাস্তার দুপাশের গ্রামগুলোতে গুলিবর্ষণ করতে-করতে কালীগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। এ- সময় বাদেডিহি গ্রামের বদরউদ্দীন মণ্ডল ও খোরশেদ মণ্ডলসহ কয়েকজন অজ্ঞাত লোক নিহত হয়। পাকসেনাদের দলটি যশোর সেনানিবাসে ফিরে যাওয়ার সময়ও বারোবাজারে রাস্তার দুপাশের দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। ১৪ই আগস্ট দুপুরের দিকে পাকসেনারা যশোর থেকে ঝিনাইদহে যাওয়ার সময় মুরাদগড়ের নিকট মহিষাহাটি গ্রামের মো. শাহাদত মৃধা (পিতা নিয়ামত আলী মৃধা) নামে একজন সাধারণ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে।
কালীগঞ্জ থানার সামনে লক্ষ্মীবাবু ও শ্রীমন্ত বাবুর বাড়িতে রাজাকার বাহিনীর বন্দিশিবির ছিল। এখানে রাজাকার কমান্ডাররা তাদের সহযোগীদের নিয়ে সাধারণ লোকদের ধরে এনে নির্যাতন ও হয়রানি করত এবং কখনো অর্থের বিনিময়ে তাদের ছেড়ে দিত। কালীগঞ্জ থানা শহরের বাইরে বারোবাজারের পোস্ট অফিসেও তাদের একটি নির্যাতনকেন্দ্র ছিল। এখানেও তারা সাধারণ লোকদের ধরে এনে একই কায়দায় নির্যাতন করত এবং তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করত।
কালীগঞ্জ উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলো হলো- মহিষাহাটি মুরাদগড় যুদ্ধ বনখিদা যুদ্ধ, কাশিপুর যুদ্ধ, দুলালমুন্দিয়া যুদ্ধ ও বেথুলীর যুদ্ধ। মহিষাহাটি- মুরাদগড় যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৩রা এপ্রিল। এতে ফজলুল হক নামে একজন বাঙালি ইপিআর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সঙ্গত কারণে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করলে পাকসেনারা মহিষাহাটি, সাঁকোমথনপুর ও সোনালীডাঙ্গা গ্রামে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায় এবং বেশ কয়েকজন বেসামরিক লোককে হত্যা করে।
বনখিৰ্দ্দা যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৫ই এপ্রিল। এতে আবুল কাশেম (ষাটবাড়ীয়া) ও আফসার উদ্দিন বিশ্বাস (বলিদাপাড়া) নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা মহসীন আলী (হেলাই) গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
কাশিপুর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১১ই এপ্রিল। নবম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহি ড্রাইভার কালা মিয়াকে কোটচাঁদপুর থানায় কয়েকটি জীপ ও ট্রাক সংগ্রহ করার জন্য পাঠানো হয়। তিনি সেখানে যাওয়ার পথে জানতে পারেন যে, কোটচাঁদপুর থেকে পাকবাহিনীর একটি কনভয় কালীগঞ্জের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সঙ্গে-সঙ্গে তিনি স্থানীয় কয়েকজন মুজাহিদ, আনসার ও সাধারণ লোকের সহায়তায় কালীগঞ্জ থেকে দুই কিমি পশ্চিমে কালীগঞ্জ-কোটচাদপুর সড়ক সংলগ্ন কাশিপুর গ্রামের সামনে পাতিবিলা ব্রিজের নিকট এম্বুশ করেন। তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি আসতে দেখে একটু সামনে অগ্রসর হয়ে ব্রিজটি উড়িয়ে দেন। এতে পাকবাহিনীর তিনটি গাড়ি বিধ্বস্ত এবং বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। কালা মিয়া পাকসেনাদের দিকে গ্রেনেড ছুঁড়তে গিয়ে বুলেটবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।
দুলালমুন্দিয়া যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১২ই এপ্রিল সুবেদার ফিরোজ খানের নেতৃত্বে। এ-যুদ্ধে ৪০-৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ২২ জন সাধারণ লোক শহীদ হন। অপরদিকে, ১৫-২০ জন পাকসেনা নিহত হয়।
বেথুলীর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২৬শে অক্টোবর কমান্ডার হেলাল উদ্দীন সরদারের নেতৃত্বে। এ-যুদ্ধে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন রাজাকার অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করে। ৯ই ডিসেম্বর কালীগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
কালীগঞ্জ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- ওসমান আলী লস্কর (পিতা সিফাতুল্লাহ লস্কর, বাদুরগাছা; ২৮শে মার্চ যশোর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও অভিযানে শহীদ), মহর আলী মিয়া (পিতা হাসান আলী, ফয়লা; ১লা এপ্রিল বিষয়খালীর যুদ্ধে শহীদ), আতর আলী মীর (পিতা আনোয়ার আলী মীর, বালিয়াডাঙ্গা; ৩রা এপ্রিল মহিষাহাটি-মুরাদগড় যুদ্ধে শহীদ), আবুল কাশেম (পিতা আতর আলী, ষাইটবাড়িয়া; ৫ই এপিল বনখিদা যুদ্ধে শহীদ), আফসার উদ্দিন বিশ্বাস (পিতা মনির উদ্দিন বিশ্বাস, বলিদাপাড়া; ঐ), মহসীন আলী (পিতা মজিবর রহমান, হেলাই; ঐ) এবং আজিজ উল্লাহ (পিতা লাল মিয়া, খামারমুন্দিয়া; ১২ই এপিল দুলালমুন্দিয়া যুদ্ধে শহীদ)। এছাড়া ৩রা এপ্রিল মহিষাহাটি- মুরাদগড় যুদ্ধে কুষ্টিয়া জেলার ফজলুল হক (ইপিআর সদস্য) নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং ১২ই এপ্রিল দুলালমুন্দিয়া যুদ্ধে এ উপজেলার বাইরের একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। [মো. জুলফিকার আলী ভূট্টো]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!