মুক্তিযুদ্ধে কালীগঞ্জ উপজেলা (লালমনিরহাট)
কালীগঞ্জ উপজেলা (লালমনিরহাট) উপজেলার উত্তরে হাতীবান্ধা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণে রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া ও নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলা, পূর্বে আদিতমারী উপজেলা এবং পশ্চিমে নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলা। ৮টি ইউনিয়ন নিয়ে এটি গঠিত। ১৯৭০ সালের নিবার্চনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কালীগঞ্জ উপজেলার মানুষও তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার লাভ, শোষণ, জুলুম, বৈষম্যের হাত থেকে মুক্তি এবং মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। কিন্তু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা প্রদানে টালবাহানা করলে তারা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রতি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর থানা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-জনতা চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য সংগঠিত হতে শুরু করে।
৯ই মার্চ কালীগঞ্জ কে ইউ পি উচ্চ বিদ্যালয়ে করিম উদ্দিন আহমেদ এমপিএ-কে সভাপতি করে থানা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সংগ্রাম কমিটির অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন সিনিয়র সহ-সভাপতি অলি উদ্দিন আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক ডা. আব্দুল হামিদ, ভাষা সৈনিক মহেন্দ্রনাথ রায়, মদনপুর বৈরাতী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল গফুর প্রমুখ। সংগ্রাম কমিটিতে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, ভাসানী ন্যাপ-, মোজাফফর ন্যাপ ও অন্যান্য বামপন্থী সংগঠনের নেতৃবৃন্দও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ১১ই মার্চ কালীগঞ্জ কে ইউ পি স্কুল মাঠে এক সমাবেশে বিপুল সংখ্যক স্বাধীনতাকামী মানুষের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি করিম উদ্দিন আহমেদ এমপিএ। ২৯শে মার্চ ইপিআর নায়েক নুর মোহাম্মদের নেতৃতে ৩০ জন আনসার, ১২ জন পুলিশ ও ৯ জন ইপিআর সমন্বয়ে কালীগঞ্জে প্রথম মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়। ৩০শে মার্চ থেকে ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত করিম উদ্দিন আহমেদের গোলাবাড়িতে তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সুবেদার বোরহান উদ্দিন ও মো. তমিজউদ্দিন ২৫শে এপ্রিল এখানে যোগদান করেন এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। ২৯শে মার্চ থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত ভোটমারী ইউনিয়নের জব্বারিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে প্রশিক্ষণ চলে। দুটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে মোট ১৬২ জন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে অনেকেই প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান। তাদের মধ্যে মালগাড়ার এস এম শফিকুল ইসলাম কানু (পিতা অলি উদ্দিন আহমেদ) এবং নুরুল ইসলাম (পিতা উমর আলী) ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে কালীগঞ্জের বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন।
৩০শে মার্চ কালীগঞ্জ থানা অবরোধ করলে পুলিশ কর্মকর্তাসহ অনেকে আত্মসমর্পণ করে এবং অস্ত্রসহ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেয়। অস্ত্রসমর্পণে রাজী না হওয়ায় একজন অবাঙালি সিপাহি মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে নিহত হয়। ২রা এপ্রিল আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অলি উদ্দিন আহমেদ এবং নায়েক নুর মোহাম্মদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কালীগঞ্জ থানার গোড়ল ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী লোহাকুচি ইপিআর ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এতে ২ জন অবাঙালি ইপিআর নিহত হয় এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ ৭ জন ইপিআর সদস্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। একই রাতে মুক্তিযোদ্ধারা জাওরানী ইপিআর ক্যাম্প অবরোধ করলে ক্যাম্পের ৯ জন ইপিআর সদস্য এবং ৩রা এপ্রিল হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম ইপিআর ক্যাম্পের সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। পরবর্তীতে তমিজউদ্দিনসহ অনেকেই ভারতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
কালীগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন করিম উদ্দিন আহমেদ এমপিএ, অলি উদ্দিন আহমেদ, ডা. আব্দুল হামিদ, মহেন্দ্রনাথ রায় প্রমুখ। কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মাহতাব আলী সরকার, বীর প্রতীক, গেরিলা লিডার এস এম শফিকুল ইসলাম কানু ও নুরুল ইসলাম, নায়েক নুর মোহাম্মদ প্রমুখ। মুক্তিযোদ্ধারা এবং জনগণ রেললাইন উপরে ফেলে, টেলিফোন সংযোগ বিছিন্ন করে এবং ব্রিজ ধ্বংস করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকবাহিনী কালীগঞ্জ থানায় অনুপ্রবেশ করে এবং থানা সংলগ্ন কে ইউ পি উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে।
কালীগঞ্জ উপজেলায় হানাদার পাকবাহিনীর অন্যতম সহযোগী ছিল আসাদুজ্জামান মন্টু কাজী (মুসলিম লীগ-এর সাবেক এমপি, দলগ্রাম), জামায়াত নেতা হোসেন আলী (পিতা বছির উদ্দিন, বৈরাতী), তুষভাণ্ডার ইউনিয়নের রাজাকার কমান্ডার ফন্টু ও গোলাম রহমান। পাকবাহিনীকে সার্বিক সহায়তা প্রদান করে রহমান আলী মাস্টার, হাসান শহীদ মঞ্জু (-রাজাকার- কমান্ডার), আব্দুল লতিফ (চেয়ারম্যান, কাকিনা ইউনিয়ন, শান্তি কমিটির bসদস্য), নুরুজ্জামান (চাপারহাট) ও স্থানীয় মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী-র নেতরা। উপজেলার রাজাকার কমান্ডার ছিল বাচ্চা মিয়া, মনসুর আলী, জাময়াতে ইসলামীর মাওলনা সামসুল হক, কালীগঞ্জ থানার দারোগা মোজাম্মেল হক (কাশিরাম, তুষভাণ্ডার), মহিষ খোচা ইউনিয়নের আফছার আলী, হাফেজ উদ্দিন, আফতাব উদ্দিন খলিফা, ওসমান মৌলভী প্ৰমুখ। পাকসেনাদের দোসর হিসেবে রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা এলাকার সাধারণ মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, লুণ্ঠন ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা তুষভাণ্ডার ইউনিয়নের তালুকবানী নগর, মদাতী, ভোটমারী এবং হিন্দু অধ্যুষিত দলগ্রাম ইউনিয়নের শ্রীখাতাসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও নারীনির্যাতন করে। তারা সংগ্রাম কমিটির সদস্য আব্দুল গফুরকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে লাশ ক্যাম্পের পার্শ্বে কুয়ায় ফেলে দেয়। কাকিনার মানিক, আমজাদ ও জোবেদকে ধরে এনে মদাতি ইউনিয়নের বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহৃত পুকুরে হত্যা করা হয়। এলাকার কুখ্যাত রাজাকার ওসমান মৌলভীর প্রস্তাব মোতাবেক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা গুলির পরিবর্তে জবাই করে অনেককে হত্যা করে।
পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল কালীগঞ্জ কে ইউ পি উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্প। তাছাড়া কালীগঞ্জ থানা ও ভাকাড়ি ব্রিজও ছিল পাকবাহিনীর বন্দীশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্র। উপজেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি মদাতি ইউনিয়নের বধ্যপুকুর। একটি লাশের ওপর আর একটি লাশ বেঁধে পাটজাগের ন্যায় এখানে লাশ ফেলা হয়। দেশ শত্রুমুক্ত হলে স্থানীয় জনগণ এই বধ্যপুকুরে এবং পুকুর পাড়ে অসংখ্য মানুষের মাথার খুলি ও কঙ্কাল দেখতে পায়। এগুলোকে একত্র করে সেখানে গণকবর দেয়া হয়। এছাড়া ভোটমারিতে গণকবর রয়েছে।
কালীগঞ্জে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হলো ভোটমারী ইউনিয়নের ভাকারী ব্রিজের ক্যাম্প অপারেশন এবং তুষভাণ্ডার যুদ্ধ -। মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে হানাদার বাহিনীর ভাকারী ব্রিজ ক্যাম্প আক্রমণ করেন। আক্রমণে হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা পালিয়ে যায়। নভেম্বর মাসের শেষদিকে পাকবাহিনীর ঘাঁটি তুষভাণ্ডার মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে আক্রমণ করেন। একটি দলের নেতৃত্ব দেন মাহতাব আলী সরকার। এ-যুদ্ধে ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অপরপক্ষে অনেক পাকসেনা নিহত হয় এবং বাকিরা আত্মসমর্পণ করে। ৫ই ডিসেম্বর কালীগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- ক্যাপ্টেন মো. তমিজউদ্দিন, বীর বিক্রম।
কালীগঞ্জ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- ক্যাপ্টেন মো. তমিজউদ্দিন, বীর প্রতীক (পিতা ছয়ফুউল্লাহ প্রামাণিক, সুন্দ্রাহবি, তুষভাণ্ডার; ২৭শে মে পাটেশ্বরীর যুদ্ধে শহীদ), হাবিবুর রহমান (পিতা আব্দুর রেজ্জাক, কৈটারী, মদাতি), আব্দুল হাই (পিতা জমশের মোল্লাহ, মালগাড়া, গোড়ল), সৈদার রহমান (পিতা কসমত আলী, লতাবর, চন্দ্রপুর), সিপাহি জয়নাল হক (পিতা সাহার আলী), ফজলুল হক মানিক (পিতা আছির উদ্দিন), আমজাদ হোসেন (পিতা আবদুর রহমান) ও জোবেদ আলী (পিতা আ. জব্বার)।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে কালীগঞ্জ উপজেলায় একটি এবং মদাতি ইউনিয়ন বধ্যপুকুর বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ভোটমারী গণকবরে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। [এস এম শফিকুল ইসলাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড