You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে কালীগঞ্জ উপজেলা (সাতক্ষীরা) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে কালীগঞ্জ উপজেলা (সাতক্ষীরা)

কালীগঞ্জ উপজেলা (সাতক্ষীরা) বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর কালীগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি হয়। অসহযোগ আন্দোলন-এর পাশাপাশি চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। ৩রা মার্চের মধ্যে গঠিত হয় কালীগঞ্জ সংগ্রাম পরিষদ। এ পরিষদের সভাপতি ছিলেন ডা. হজরত আলী এবং সম্পাদক ছিলেন খান আসাদুর রহমান। পরিষদের অন্য সদস্যরা হলেন- শেখ ওয়াহেদুজ্জামান, শেখ নাসির উদ্দীন (ভাড়াশিমলা), শেখ আকবর হোসেন, শেখ আব্দুর রহমান (কালাচান), শেখ আব্দুল আফু, শেখ আতাহার রহমান, শেখ শহর আলী, শেখ আলাউদ্দীন, শেখ মনির আহমেদ, আব্দুস সোবহান (গণপতি), আব্দুল বারেক মাস্টার (শীতলপুর), ডা. সরোয়ার হোসেন, গাজী সাইদুর রহমান, জেহের আলী মাস্টার, সহিল উদ্দীন (কাঁকশিয়ালি), শেখ শফিউল্লাহ (শীতলপুর), কাজী তরিকুল ইসলাম (মৌতলা) প্রমুখ। সংগ্রাম পরিষদের প্রথম ১১ জন সদস্য সর্বপ্রথম ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
কালীগঞ্জ উপজেলার যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন শেখ ওয়াহেদুজ্জামান (পিতা শেখ আবদুল খালেক, বাজারগ্রাম, রহিমপুর; বর্তমানে কালীগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি)। যুদ্ধকালীন ক্যাম্প সিকিউরিটি কমান্ডার ছিলেন শেখ নাসির উদ্দিন (পিতা শেখ রমজান আলী, ভাড়াশিমলা; উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কামান্ডার)।
পাকবাহিনী ২০শে এপ্রিল কালীগঞ্জে অনুপ্রবেশ করে ডাকবাংলো ভবন, ওয়াপদা ভবন, বসন্তপুর চন্দ্রদের পরিত্যক্ত ভবন, কালীগঞ্জ হাসপাতাল, দমদম ফেরিঘাট, খানজিয়া ইপিআর ক্যাম্প, সুইলপুর আক্কাস গাজির বাড়ি, নাজিমগঞ্জ করিম গাইনের বাড়ি, পিরোজপুর ও ভাড়াশিমলার গফফার চেয়ারম্যানের বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে।
কালীগঞ্জে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামী-র কর্মী-সমর্থকরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত ছিল। মথুরেশপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখ আলিম বকস ছিল কালীগঞ্জ শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। কমিটির অন্য সদস্যরা হলো- আহম্মদ আলী, জি এম ওকালত আলী, আব্দুল গাফ্ফার, গোলাম বারী (চেয়ারম্যান, ভাড়াশিমলা ইউনিয়ন), ইসরাইল আলী (চেয়ারম্যান, ভাড়াশিমলা ইউনিয়ন), ইসহাক আলী (চেয়ারম্যান, নলতা ইউনিয়ন), শেখ সিরাজুল ইসলাম মাস্টার, এলাহী বক্স, আবুল হোসেন, আব্দুর রহিম, ইমান আলী, আহাদ আলী, জোবেদ মেম্বর, ফজলে মাস্টার, আব্দুল জব্বার, শাকির আহমদ প্রমুখ।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা কালীগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়।
এলাকা পশ্চিম বালাগ্রাম, চাওড়াবাড়ী ও সালোগ্রামে তারা ব্যাপক নির্যাতন চালায়। পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের অত্যাচার-নির্যাতনের ভয়ে এখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন পালিয়ে ভারত যাওয়ার চেষ্টা করে। ২৭শে এপ্রিল মঙ্গলবার সকাল ১১টায় পাকবাহিনী এখানে ভারতগামী তিন শতাধিক শরণার্থীকে হত্যা করে, যা কালীগঞ্জ গণহত্যা নামে
পরিচিত।
গান্দুলিয়া, রায়ের হাট, নলতার হাট ও পানিয়া এলাকায় পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্রও বন্দিশিবির ছিল।
পাকবাহিনী কালীগঞ্জ হাসপাতালের পেছনের দিক, বিলগুলির খালের পশ্চিম পাড়ে বুড়ির বাড়ি, দমদমার বটতলা ও ওয়াপদা ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের শুড়িকে বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করে। তারা ভারতগামী শরণার্থীদের ধরে এনে এসব স্থানে হত্যা করত। এছাড়া পাকবাহিনী বহু মানুষকে ডাকবাংলোর সামনে হত্যা করে কাকশিয়ালি নদীতে ভাসিয়ে দিত।
১২ই জুন গভীর রাতে ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে ১৫ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা বসন্তপুর বিওপি সংলগ্ন চন্দ্র মহাশয়ের দোতলা বাড়িতে পাকসেনাদের ঘাঁটিতে অভিযান চালান। বসন্তপুর ক্যাম্প অপারেশন-এ ২০ জনের মতো পাকসেনা আহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা ৬০টি রাইফেল, ২টি এলএমজি এবং বেশকিছু গুলি উদ্ধার করতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধারা বসন্তপুর ক্যাম্প দখলের পরিকল্পনা করেন এবং ১০ই জুলাই ৬টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে দ্বিতীয়বার বসন্তপুর ক্যাম্প আক্রমণ করেন। কিন্তু সফল হতে পারেননি। এ অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার ইউসুফ ও শহিদুল আহত হন।
কালীগঞ্জ উপজেলার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী দুর্গম স্থান খানজিয়ায় পাকসেনারা এক শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তোলে। ৩রা জুলাই রাত ১০টার দিকে ক্যাপ্টেন হুদা ও লেফটেন্যান্ট বেগের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে অপারেশন চালান। খানজিয়া অপারেশন-এ একজন পাকসেনা আহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা একটি এলএমজি ও কিছু গুলি উদ্ধার করেন। ২৪শে সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা ভারত সীমান্ত থেকে ৫ কিলোমিটারের মতো পূর্বে এবং কালীগঞ্জ ক্যাম্প থেকে ৪ কিলোমিটারের মতো দক্ষিণে সিএন্ডবি সড়কের পশ্চিম পাশে মথুরেশপুর ইউনিয়নের পিরোজপুরে পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করেন। সারা রাতব্যাপী উভয়পক্ষের মধ্যে যুদ্ধে বেশ কয়েকজন রাজাকার ও পাকসেনা হতাহত হয়। পিরোজপুর যুদ্ধ-এ একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। ২৯শে সেপ্টেম্বর দুদলি নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের কাছে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সারা রাতব্যাপী তুমুল যুদ্ধ হয়। দুদলির যুদ্ধ-এ ৫০ জনের অধিক মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। মুক্তিযোদ্ধা রজব আলী এ-যুদ্ধে আহত হন। অক্টোবরের প্রথম দিকে নাজিমগঞ্জ করিম গাইনের বাড়ির দোতলায় অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা অভিযান চালান। নাজিমগঞ্জ রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন-এ রাজাকার কমান্ডার ইয়াছিন ২০ জন সদস্যসহ আত্মসমর্পণ করে। বাকিরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ২০শে নভেম্বর কালীগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
কালীগঞ্জ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আবুল কালাম আজাদ (পিতা ডা. জাবেদ আলী, ঘোনা, নলতা) এবং মো. ইউনুছ (কুষ্টিয়া নিবাসী, কালীগঞ্জে বসবাস করতেন)। কালীগঞ্জ ডাকবাংলোর মোড়ে রাস্তার পূর্ব পার্শ্বে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। [এম এম নজমুল হক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড