কালুরঘাট প্রতিরোধযুদ্ধ (চট্টগ্রাম মহানগর)
কালুরঘাট প্রতিরোধযুদ্ধ (চট্টগ্রাম মহানগর) সংঘটিত হয় ২৬শে মার্চ থেকে ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত। এতে পাকবাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে পাকবাহিনীর তুলনায় প্রতিরোধযোদ্ধাদের সংখ্যা খুবই অল্প হওয়ায় এবং অস্ত্র- শস্ত্রও কম হওয়ায় প্রতিরোধযোদ্ধারা শেষ পর্যন্ত পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হন।
কালুরঘাট প্রতিরোধযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে ষোলশহর সিডিএ মার্কেটে অবস্থিত ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে। অবাঙালি লে. এ আর জানজুয়া এ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার, মেজর জিয়াউর রহমান সহ- অধিনায়ক, মেজর মীর শওকত আলী কোম্পানি অধিনায়ক, লে. শমসের মুবিন চৌধুরী এডজুট্যান্ট, ক্যাপ্টেন অলি আহমদ কোয়ার্টার মাস্টার, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী কোম্পানি অধিনায়ক, ক্যাপ্টেন সাদেক হোসেন কোম্পানি অধিনায়ক, অবাঙালি ক্যাপ্টেন আহমেদ দীন কোম্পানি অধিনায়ক, লে. এ ওয়াই মাহফুজুর রহমান কোম্পানি অফিসার, অবাঙালি লে. আজিম উদ্দিন কোম্পানি অফিসার এবং অবাঙালি লে. হুমায়ূন আহমেদ কোম্পানি অফিসার ছিলেন। এই রেজিমেন্ট ষোলশহরে অবস্থান করছিল, কারণ মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের খারিয়ান সেনানিবাসে তাদের বদলির নির্দেশ ছিল। এ-কারণে তাদের জন্য অস্ত্র ও গোলা-বারুদও সরবরাহ করা হয়নি। প্রশিক্ষণের জন্য তাদের কাছে শুধুমাত্র ১২টি এলএমজি এবং ৩০০টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ছিল। এছাড়া ৫টি গাড়ি ছিল।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকীর বাটালী হিলস্থ ‘প্যানোরমা’ বাসভবনে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ ও ১৯৭০ সালে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের বিশেষ বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর একটি টেলিফোন মেসেজ তাঁর প্রতিবেশী মোশাররফ হোসেনের কাছ থেকে পাওয়া যায়। মেসেজটি ছিল এরূপ: ‘Liberate Chittagong/ Proceed to Comilla/Take over the local administration.’ ফলে এই বৈঠকে কিছু কার্যকর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং হালিশহর ইপিআর সদর দপ্তরের এডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম রাত ৮.৪৫-৯.০০টার মধ্যে ইপিআর সৈনিকদের নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহ করতে অনেক দেরি হয়। রাত ১০.৩০-১১.০০টার মধ্যে ইবিআরসি-তে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করে।
রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার এ আর জানজুয়ার নির্দেশে মেজর জিয়া রাত ১০.৩৫-১০.৪০-এর মধ্যে পাকিস্তান সরকারের আজ্ঞাবহ অফিসার হিসেবে বন্দরের উদ্দেশে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের কাজে যোগ দেয়ার জন্য রওয়ানা হয়ে আগ্রাবাদ পৌঁছার পর সেখানে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান এসে তাঁকে ক্যাপ্টেন রফিক ও অলি আহমদের বার্তা দেন যে, পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় গোলাগুলি ও নিরস্ত্র বেসামরিক লোকদের হত্যা করছে। এছাড়া চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ও শহরে সামরিক তৎপরতা শুরু করেছে এবং বহু বাঙালিকে হত্যা করেছে। ফলে রাত ১১.৪৫ মিনিটের দিকে জিয়াউর রহমান ষোলশহর হেডকোয়ার্টার্সে ফিরে এসে তাঁর সঙ্গে থাকা লে. আযম ও নাবিক এ দুজনকে বন্দি করেন। ইতোমধ্যে ক্যাপ্টেন অলির নির্দেশে অবাঙালি ক্যাপ্টেন আহমেদ আলী ও লে. হুমায়ুন খানকে বন্দি করা হয়। তখন রাত ১১.৩০টা। রাত ১২.০০টার পর মেজর জিয়া স্বয়ং জানজুয়াকে তাঁর বাসভবন থেকে বন্দি করে নিয়ে আসেন। রাত ১২.৩০টার আগে জানজুয়াসহ সব বন্দিকে হত্যা করা হয়। রাত ১২.৩০টার পর রেজিমেন্টের অফিসার্স মেসের বিপরীত দিকের ইপিআর অফিসার্স মেসে থাকা দুজন অবাঙালি সেনা মেজর আবদুল হামিদ ও ক্যাপ্টেন নজরকে কালুরঘাট প্রতিরোধ যুদ্ধ (চট্টগ্রাম মহানগর)
অলির নির্দেশে বন্দি করে হত্যা করা হয়। রাত ১.০০টার দিকে ইবিআরসি-র ১ জন হাবিলদার ও ২ জন সিপাহি পালিয়ে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টার্সে এসে জানায়, ২০ বালুচ রেজিমেন্ট ট্যাংক ও ভারী অস্ত্র নিয়ে ইবিআরসি-তে আক্রমণ করেছে। কিন্তু অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট চট্টগ্রাম শহর ও ইবিআরসি-তে যুদ্ধে যোগ দেয়া থেকে তখন পর্যন্ত বিরত থাকে। রাত ৩.০০টার আগে মেজর জিয়া অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব নিয়ে একটি ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়ে সৈনিকদের কালুরঘাটের দিকে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেন। রাত ৩.০০টায় রওয়ানা হওয়ার সময় ইবিআরসি থেকে পালাতে সক্ষম হওয়া সৈনিকদের অনেকে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁরা রওনা হওয়ার সময় পর্যন্ত রাস্তায় ব্যারিকেড সরানো ও সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করার কাজে নিযুক্ত সৈনিকরা ফিরে না আসায় হেডকোয়ার্টার্সে নায়েব সুবেদার আবদুল মালিকের নেতৃত্বে একটি ছোট সেনাদলকে তাঁদের নিরাপত্তার জন্য রাখা হয়। সৈনিকরা ফিরে এলে কী করবে, সে নির্দেশনাও সুবেদার আবদুল মালিককে দেয়া হয়।
অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পথিমধ্যে কালুরঘাটে ইপিআর- এর ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন কোম্পানির সাক্ষাৎ পায়। তাঁরা চট্টগ্রাম শহরে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু মেজর জিয়ার নির্দেশে ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী তাঁর কোম্পানি নিয়ে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে থাকতে বাধ্য হন। এরপর এই রেজিমেন্ট ও কোম্পানি বোয়ালখালী উপজেলার করলডেঙা পাহাড়ে পৌঁছায়।
২৬শে মার্চ সকাল ১০টার দিকে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান, আতাউর রহমান খান কায়সার এমএনএ ও ডা. এম এ মান্নান এমপিএ-র সঙ্গে বোয়ালখালী উপজেলার করলডেঙা পাহাড়ের একটি পুকুরপাড়ে মেজর জিয়া ও তাঁর সঙ্গী মেজর মীর শওকত আলী, লে. শমসের মুবিন চৌধুরী, লে. এ ওয়াই মাহফুজুর রহমান, ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ প্রমুখের সাক্ষাৎ হয়। তখন নেতৃবৃন্দ মেজর জিয়াকে চট্টগ্রাম শহরে ফিরতে অনুরোধ করলে তিনি জানান, তিনি পরিশ্রান্ত, রণকৌশল ঠিক করে ২৭শে মার্চের মধ্যে যোগাযোগ করবেন। নেতৃবৃন্দ বিদায় হওয়ার পর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কালুরঘাট এলাকাসহ চট্টগ্রাম শহরের জন্য একটি সামরিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তাতে কালুরঘাট এলাকা নিয়ে নিম্নোক্ত পরিকল্পনা করা হয়-
বোয়ালখালীর ফুলতলা প্রাইমারি স্কুলে ক্যাপ্টেন অলি আহমেদের অধীনে হেডকোয়ার্টার্স স্থাপিত হবে।
কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র ও চকবাজারে লে. শমসের মুবিন চৌধুরীর অধীনে অবস্থানে থাকবে একদল সৈনিক। কালুরঘাটে জরুরি অবস্থা মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে লে. এ ওয়াই মাহফুজুরের অধীনে সংরক্ষিত থাকবে একদল সৈনিক।
কালুরঘাট ও চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান একদল সৈনিক নিয়ে অবস্থান নেবেন।
২৬শে মার্চ সূর্যাস্তের পর প্রতিটি দলের স্ব-স্ব গন্তব্যে অবস্থান গ্রহণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। তাঁরা বিদায় নেয়ার পর করলডেঙা পাহাড় থেকে ২ কিলোমিটার দূরে একটি স্কুলে মেজর জিয়া ও ক্যাপ্টেন অলি রাত অতিবাহিত করেন।
এদিকে ২৫শে মার্চ রাত সাড়ে ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার যে মেসেজ টেলিফোনে আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসভবনে পৌঁছে, তা ২৬শে মার্চের শুরু থেকে সাইক্লোস্টাইল কপি ও মাইকিং-এর মাধ্যমে লোকজনের কাছে পৌঁছে যেতে থাকে। মেসেজটি ২৬শে মার্চ দিনের বেলা চট্টগ্রামের সলিমপুর আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অয়ারলেসযোগে কলকাতা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে, এমনকি সমুদ্রগামী বিভিন্ন বিদেশী জাহাজে পাঠানো হয়। ২৬শে মার্চ দুপুর ২.১০ মিনিটে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বকণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা প্রচার করেন। এসময় তাঁকে সহযোগিতা করেন আতাউর রহমান খান কায়সার এমএনএ, মোশাররফ হোসেন, মীর্জা আবু মনসুর প্রমুখ এমএনএ ও এমপিএ এবং ছাত্রলীগ নেতা রাখাল চন্দ্র বণিক। ২৬শে মার্চ রাত ৭.৪০ মিনিটেও এই বেতার কেন্দ্র থেকে একই ঘোষণা এম এ হান্নানের কণ্ঠে আবার প্রচারিত হয়। এই দুই অধিবেশনে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রকে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
২৬শে মার্চ সকালে চট্টগ্রাম শহরের ফিরিঙ্গি বাজারে আখতারুজ্জামান চৌধুরী এমপিএ-র জুপিটার হাউসে জহুর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ চট্টগ্রামে প্রতিরোধ আন্দোলন পরিচালনার জন্য চট্টগ্রামকে ৪টি সেক্টরে ভাগ করেন। একটির নাম রাখা হয় কালুরঘাট সেক্টর। এই সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়। এম এ হান্নান, ডা. এম এ মান্নান এমপিএ, আতাউর রহমান খান কায়সার এমএনএ ও ডা. এ কে এম আবু জাফরকে।
২৭শে মার্চ মেজর জিয়া পটিয়ায় গমন করেন। সেদিন অনিয়মিত বেতারকর্মী বেলাল মোহাম্মদ পটিয়ায় মেজর জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে প্রহরার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেন। ঐদিন ইপিআর সুবেদার মফিজ দুই ট্রাক সৈন্য নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে ২০ জন পুলিশ সদস্য তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। কিন্তু কালুরঘাটে তাঁকে থামিয়ে চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় প্রতিরোধমূলক অবস্থান গ্রহণের জন্য মেজর জিয়ার পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হয়। সেদিন বিকেলের মধ্যে ফুলতলা প্রাইমারি স্কুলকে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টার্স করা হয়। এছাড়া ২৭শে মার্চ রাতে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। এর পরের দিন জিয়া মেজর শওকতকে সঙ্গে নিয়ে কক্সবাজার চলে যান।
এদিকে ২৭শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর একটি কমান্ডো প্লাটুনকে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রসহ বহদ্দার হাট ধ্বংসের নির্দেশ দেয়া হয়। ফলে সেদিনই প্লাটুনটি স্পিড বোটে চড়ে কর্ণফুলী নদী হয়ে চর রাঙামাটিয়ার কাছাকাছি একটি ক্ষুদ্র খালে প্রবেশ করে লিভার ব্রাদার্সের কারখানা পার হয়ে খালের কিনারায় নামে এবং পায়ে হেঁটে কালুরঘাট কৃষিভবনে পৌছায়। ভবনটি তিনতলা বিশিষ্ট। স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় প্লাটুনটি ভবনটিতে অবস্থান নেয়। তখন রাত প্রায় ১২টা। লিভার ব্রাদার্স কারখানার নিরাপত্তা প্রহরী শফিকুর রহমান স্পিড বোটগুলো দেখতে পান এবং চর রাঙামাটিয়ার কৃষক মোহাম্মদ শফি বোটগুলোর আওয়াজ শুনতে পান। প্লাটুনটিতে সৈন্যসংখ্যা ছিল ৪০ জন। তারা কৃষিভবনে রাত অতিবাহিত করে। ২৮শে মার্চ সকালে এক কিশোরের কাছ থেকে পাকহানাদারদের আগমনের কথা জানতে পেরে লিভার ব্রাদার্স কারখানার নিরাপত্তা প্রহরী শফিকুর রহমান হাবিব ও জহির নামে তার দুজন ঘনিষ্ঠ ইপিআর বন্ধুকে তা অবহিত করেন। তাঁরা ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কৃষিভবনের দুশ গজের কাছাকাছি গেলে কৃষিভবন থেকে তাঁদের দিকে রাইফেলের গুলি ছোড়া হয়। তখন তাঁরা কালুরঘাট রোডে গিয়ে সেখানে অবস্থিত বাঙালি সৈনিকদের কাছে কৃষিভবনে পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থানের সংবাদ দেন।
২৯শে মার্চ লে. এ ওয়াই মাহফুজুর কালুরঘাট ব্রিজের দুপাশে ডিফেন্স নেন। সেদিন পাকিস্তানি সৈন্য বহনকারী একটি লঞ্চ কর্ণফুলী নদী থেকে কালুরঘাট ব্রিজ ও আশপাশের এলাকা দেখে যায়। একই দিন বিকেলে পাকিস্তানি সি-১৩০ বিমান কালুরঘাট ব্রিজের ওপর কয়েকবার চক্কর দেয়। ২৯শে মার্চ রাতটি ভীষণ অস্থিরতায় অতিবাহিত হয় মাহফুজুর ও তাঁর সৈনিকদের।
৩০শে মার্চ সকালে কালুরঘাট ব্রিজে লে. মাহফুজুরের কাছে আসফ নামে এক সাধারণ লোক এসে কৃষিভবনে পাকিস্তানি সৈন্যের অবস্থান গ্রহণের খবর নতুন করে জানালে তিনি তৎক্ষণাৎ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর সৈনিকদের সম্মিলিত একটি প্লাটুন নিয়ে সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে করে সেদিকে রওনা হন। সঙ্গে আসফকেও নেন। তাঁরা অনেকটা কাছে পৌঁছার সঙ্গে-সঙ্গে কৃষিভবন থেকে হামলার শিকার হন। তবে হামলা এড়িয়ে তাঁরা বাড়ি ও ঝোঁপের আড়াল দিয়ে কৃষিভবনের ৪০০-৫০০ গজের মধ্যে পৌঁছে কৃষিভবনে পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থান চিহ্নিত করতে সমর্থ হন। পাকিস্তানি সৈন্যরাও তাঁদের অবস্থান চিহ্নিত করে। তারা প্রথমে মেশিনগান, তারপর নানা ধরনের অস্ত্র দ্বারা মাহফুজুরের নেতৃত্বাধীন প্রতিরোধ বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। কিন্তু মাহফুজুর ও তাঁর সৈন্যদল ক্রলিং করে কৃষিভবনের ১০০-২০০ গজের মধ্যে পৌঁছে তিনদিক থেকে কৃষিভবনকে ঘিরে ফেলতে সক্ষম হন। এরপর উভয় পক্ষে শুরু হয় ভয়াবহ গোলাগুলি। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা লে. মাহফুজুর ও তাঁর প্লাটুনের ২ নং এলএমজি-ধারী ইপিআর সদস্য নুর মোহাম্মদের দিকে দুটি রকেট লঞ্চার ছুড়ে মারে। তবে তাঁরা অক্ষত থাকেন। এরপর মাহফুজুরও একটি রকেট লঞ্চার ছোড়েন কৃষিভবনের দিকে। সকাল সাড়ে ১০টায় পাকিস্তানি দুটি স্যাবর জেট বিমান মাহফুজ বাহিনীর অবস্থানের ওপর গুলি ছুড়লেও তাঁদের কোনো ক্ষতিসাধন করতে পারেনি।
২৭শে মার্চ রাতে কৃষিভবনে পাকিস্তানি সৈন্য অবস্থান নেয়ার পর কালুরঘাট ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার সংকল্প নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাপ্টেন সাজ্জাদের নেতৃত্বে আরো ৩০ জন সৈন্যের একটি প্লাটুন সেখানে অবস্থান নিয়েছিল। লে. মাহফুজুর ও তাঁর প্লাটুন ৩০শে মার্চ সারাদিন বীরদর্পে তাদের সঙ্গে লড়াই করেন। ৩১শে মার্চ সকালে মাহফুজুর ও তাঁর প্লাটুন কৃষিভবনে আক্রমণ রচনা করে সেখানে প্রবেশ করতে সক্ষম হন এবং এর পূর্বে পাকিস্তানি সৈন্যরা পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে লে. মাহফুজুর ও তাঁর প্লাটুনের তদ্রূপ কোনো ক্ষতি হয়নি। অন্যদিকে, পাকিস্তানি সৈন্যদের ৬ জন নিহত ও অনেকে আহত হয়। নিহতদের একজনের নাম মোহাম্মদ আকবর। সে পাকিস্তানি বাহিনীর তৃতীয় এসএসজি (কমান্ডো) ব্যাটালিয়নের হামজা কোম্পানির সদস্য ছিল। মাহফুজুর ও তাঁর দল কৃষিভবন থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের ফেলে যাওয়া বিপুল অস্ত্র-শস্ত্র উদ্ধার করেন। সেসব অস্ত্রের মধ্যে ছিল— ১টি এলএমজি ৭.৬২ চাইনিজ, ১টি অয়ারলেস সেট জিআরসি-৯, ১টি এসএমজি, ২টি জি-৩ রাইফেলস, ২টি এসএমজি ৭.৬২ চাইনিজ, ১টি এমজিআইএ-৩, ৩টি ৪০ এমএম রকেট লঞ্চার (রকেটসহ), ১টি কমান্ডো নাইফ, ১টি ৯ এমএম ওয়ালথার পিস্তল, ২টি লাইট পিস্তল, ৭.৬২ এম্যুনিশন-২০০০ গুলির বেল্ট ও ম্যাগাজিন, ৭ জোড়া কমান্ডো বেল্ট, ৮টি কমান্ডো ব্যারেট ও ৭ জোড়া কমান্ডো বুট। ৩১শে মার্চ সকাল ৮টায় উদ্ধারকৃত এসব অস্ত্র-শস্ত্র ফুলতলা প্রাইমারি স্কুলে স্থাপিত হেডকোয়ার্টার্সে জমা দেয়া হয়।
৩০শে মার্চ একদিকে কালুরঘাট কৃষিভবনে যুদ্ধ চলে, অন্যদিকে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র) পাকিস্তানি বিমান থেকে ভয়াবহ হামলা চালিয়ে উক্ত কেন্দ্রের বেশ ক্ষতিসাধন করা হয়। বিমান থেকে সেখানে মেশিনগানের গুলি ও বোমা বর্ষণ করা হয়। এ কারণে ৩১শে মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে রক্ষিত ১ কিলোওয়াট শক্তির ট্রান্সমিটার ডিসমেন্টাল করে ব্যাংকার সৈয়দুর রহমানের ট্রাকে করে সেনা প্রহরায় পটিয়া জমিরিয়া মাদ্রাসায় নিয়ে আসা হয়। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী এমএনএ ও ডা. এম এ মান্নান এমপিএ-র ব্যবস্থাপনায় ট্রান্সমিটারটি নিয়ে আসার ক্ষেত্রে বেলাল মোহাম্মদসহ কতিপয় বেতারকর্মীর সঙ্গে আরো ছিলেন হাফেজ মৌলভী আহমদুল হক (নাইখাইন), বজলুর রহমান (দোহাজারী), আবুল বশর (পিতা মাওলানা মো. ইসহাক, ভাই খলিফাপাড়া, উত্তর হাশিমপুর), দেলোয়ার হোসেন দেলু (দোহাজারী), মাহবুবুল আলম তসলিম (পটিয়া), এ কে এম শামসুল আলম (পটিয়া) প্রমুখ। পরে ট্রান্সমিটারটি দোহাজারী ও বান্দরবান হয়ে ভারতে পৌঁছানো হয়।
৩০শে মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে পাকিস্তানি বিমান হামলার পর ৩১শে মার্চ স্বল্প সময়ের জন্য মেজর জিয়া পুনরায় কালুরঘাট ফিরে এস সন্ধ্যা ৭.৩০টায় ক্যাপ্টেন অলি ও ২০ জন সৈনিক সঙ্গে নিয়ে রামগড়ের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ৪ঠা এপ্রিল মেজর মীর শওকত আলী কালুরঘাট ফিরে এসে সেখানকার প্রতিরোধ যুদ্ধের দায়িত্ববার গ্রহণ করেন। তিনি একটি সামরিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাতে কালুরঘাট নিয়ে নিম্নোক্ত পরিকল্পনা ছিল-
ক্যাপ্টেন অলি আহমদের অধীনে এক কোম্পানি সৈন্য অবস্থান নেবে কালুরঘাট ব্রিজের উত্তরে কর্ণফুলী নদীর পূর্বতীরে বোয়ালখালী থানার কদুরখীল ও চরণদ্বীপ এলাকায়। ক্যাপ্টেন হারুন আহমদ চৌধুরীর অধীনে এক কোম্পানি সৈন্য অবস্থান নেবে কালুরঘাট ব্রিজের পশ্চিম কূল, হামিদচর ও মোহরা এলাকায়৷
ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের অধীনে এক কোম্পানি সৈনিক কালারপুলের মুখ থেকে কালুরঘাট ব্রিজের দক্ষিণ পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর পূর্বকূলে অবস্থান গ্রহণ করবে।
কোম্পানি কমান্ডার লে. শমসের মুবিন চৌধুরীর অধীনে এক কোম্পানি সৈন্য চকবাজার থেকে আসা আরাকান সড়কের চর রাঙামাটিয়া ও এফআইডিসি রোড এলাকায় অবস্থানে থাকবে।
লে. মাহফুজুর রহমানের অধীনে এক কোম্পানি সৈনিক অবস্থান নেবে বাহার সিগন্যালের গোড়া থেকে কাপ্তাই রোডের মাথা হয়ে পেছনে মদুনাঘাট এলাকা পর্যন্ত।
ইতোমধ্যে ২রা এপ্রিল চট্টগ্রাম কোর্ট হিল পতনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম নগরী পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে গেলে ক্যাপ্টেন রফিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহের জন্য ভারতে রওনা দেন। ৭ই এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে আক্রমণ করে কেন্দ্রটি দখল করে নিয়ে কালুরঘাট ব্রিজের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সেদিন মেজর শওকত আলীর নির্দেশে লে. মাহফুজুর রহমান মদুনাঘাটে ডিফেন্স নেন। এখানে বিমান বাহিনীর কর্পোরাল সিরাজুল করিমও ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসার বাহিনীর সদস্য সম্মিলিত একটি কোম্পানি নিয়ে লে. মাহফুজুরের সঙ্গে যোগ দেন। পাকিস্তানি বাহিনী কালুরঘাট মন্টিট্যানারিতে এসে পড়ায় ৮ই এপ্রিল মেজর শওকতের নির্দেশে লে. শমসের মুবিন চৌধুরী কিছু সৈন্য নিয়ে মন্টিট্যানারিতে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যূহের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। এ-যুদ্ধে শমসের মুবিন চৌধুরীর দলের নায়েক নায়েব আলী পাকিস্তানি সেনার গুলিতে শহীদ হন। পরদিন ৯ই এপ্রিল মেজর মীর শওকত আলী মাত্র ১০ জন সৈন্য নিয়ে (যাঁদের মধ্যে হাবিলদার হামদু মিঞা ও নায়েক তাহের নামে দুজন সৈন্য ছিলেন) মন্টিট্যানারিতে আক্রমণ পরিচালনা করে পাকিস্তানি বাহিনীর ১ জন ক্যাপ্টেন ও ১ জন সুবেদারসহ মোট ২০ জন সৈন্যকে হত্যা করে মন্টিট্যানারি দখল করেন।
১০ই এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী কালুরঘাট ব্রিজের খুব কাছাকাছি চলে আসে। এদিন মেজর মীর শওকত আলী ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর নেতৃত্বাধীন সৈনিকদলকে পশ্চিম পটিয়ার কালারপুলে অবস্থান গ্রহণের নির্দেশ দেন। বোয়ালখালীর গোমদণ্ডি এলাকার ফুলতলা প্রাইমারি স্কুলে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর তথা কালুরঘাট প্রতিরোধযোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার্স স্থাপিত হওয়ায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক (আরাকান সড়ক) ধরে কালুরঘাট ব্রিজের ওপর দিয়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণে পাকিস্তানি বাহিনীর অনুপ্রবেশ সম্ভব ছিল না। ফলে তারা বরকল বা চানখালি খালের ওপর নির্মিত কালারপুলের দিক থেকে প্রতিরোধযোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার্স আক্রমণের পরিকল্পনা করে। এ-খবর মীর শওকতের পূর্বে জানা থাকায় তিনি ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীকে সেখানে অবস্থান গ্রহণের নির্দেশ দেন। কর্ণফুলী নদী থেকে বরকল বা চানখালি খালটি বেরিয়ে পটিয়া, আনোয়ারা ও চন্দনাইশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শঙ্খ নদীতে গিয়ে মিশেছে। খালটি বেয়ে কালারপুলে এসে পাঁচরিয়া দিঘির পাড়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে উঠে উত্তর কালুরঘাটের পথ ধরে প্রতিরোধযোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার্সেও আক্রমণ করা সম্ভব ছিল।
১০ই এপ্রিল ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর নেতৃত্বাধীন সৈনিকদল কালারপুলে অবস্থান গ্রহণ করে। এদিকে এদিন থেকেই কর্ণফুলী নদী থেকে কালুরঘাট এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আর্টিলারি হামলা হতে থাকে। ১১ই এপ্রিল খুব ভোরে মেজর মীর শওকত আলী কালারপুলের অবস্থা জানার জন্য সেখানে গমন করেন। সকাল সাড়ে ৮টায় এক সূত্রে তিনি জানতে পারেন যে, প্রায় ৭ থেকে ৮ শত পাকিস্তানি সৈন্য কালুরঘাট আক্রমণ করেছে, ক্যাপ্টেন হারুন আহমদ চৌধুরী গুরুতর আহত এবং লে. শমসের মুবিন চৌধুরী নিখোঁজ। এ-খবর পেয়ে তিনি ক্যাপ্টেন অলিকে প্রতিরোধযোদ্ধাদের একত্রিত করার চেষ্টা করতে বলেন
মেজর মীর শওকত আলী কালারপুলে যাওয়ার পরে পাকিস্তানি বাহিনীর কতিপয় সৈন্য মহিলা পোশাক এবং অপর কিছু সংখ্যক সৈন্য সিভিল পোশাক পরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে-দিতে কালুরঘাট ব্রিজে চলে আসে। লে. শমসের মুবিন চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন হারুন আহমদ চৌধুরী-সহ কয়েকজন বাঙালি অফিসার প্রথমে তাদের পাকিস্তানি হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেননি। ব্রিজে লে. শমসের মুবিন চৌধুরী বিভিন্ন র্যাঙ্কের ২০ জন সৈনিক ও ক্যাপ্টেন হারুন আহমদ চৌধুরী কিছু ইপিআর সৈনিক নিয়ে অবস্থান করছিলেন। তাঁদের সঙ্গে কিছু কলেজ ছাত্রও ছিল। তাঁরা সকলে বাংকার খনন করছিলেন। একই সঙ্গে ব্রিজ বরাবর একটি স্টিমরোলার স্থাপন করেছিলেন, যা বাংকারের জন্য বেরিকেড হিসেবে কাজ করছিল। সিমেন্ট দ্বারা নির্মিত ট্যাঙ্ক বেরিকেডও করা হয়েছিল। এ-সময় মহিলা ও সিভিল পোশাক পরিহিত পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্রিজে উঠে এলে বাঙালি অফিসাররা এবার তাদের চিহ্নিত করতে পেরে গুলি করতে শুরু করেন। কর্ণফুলী নদীতে পাকিস্তানি যে নৌ-জাহাজ ছিল, তা কালুরঘাটের কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়েছিল। ছদ্মবেশী পাকিস্তানি সৈন্যদের দিকে বাঙালি সৈন্যরা গুলি করার সঙ্গে-সঙ্গে উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলে নৌ- জাহাজ থেকে নেভাল গান দিয়ে ব্রিজে লে. শমসের মুবিন চৌধুরীর পজিশনে বম্বিং ও আর্টিলারি হামলা শুরু হয়। প্রতিমুহূর্তে হামলার তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। শেলিং-এর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে প্রায় ২০০ পাকিস্তানি সৈন্য লে. শমসের মুবিন চৌধুরীর পজিশনে আক্রমণ করে এবং উভয় পক্ষে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন হারুন আহমদ চৌধুরী গুরুতর আহত হলে লে. শমসের মুবিন চৌধুরী ছাত্রনেতা শওকত ও হারুনের মাধ্যমে তাঁকে ব্রিজের পূর্ব পাড়ে পাঠিয়ে দেন। সেখান থেকে তাঁকে একটি মাইক্রোবাসে করে পটিয়া থানা ডিসপেনসারিতে ডা. জহুরুল হক, ডা. কামাল ও ডা. হাশেমের অধীনে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। এখান থেকে তাঁকে দোহাজারী হাসপাতালে পৌছানো হয়। সেখানে চিকিৎসা নেয়ার পর সাতকানিয়ার কেউচিয়া ইউনিয়ন কাউন্সিলে (বর্তমান কালিয়াইশ ইউনিয়ন কাউন্সিল) পৌঁছলে সেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত আওয়ামী লীগ ও মোজাফফর ন্যাপের ২০ জনের একটি দল তাঁকে দোহাজারী সিএন্ডবি-র রাশিয়ান জিপে করে ডুলাহাজরা হাসপাতালে প্রেরণ করেন। পরে তিনি বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) চলে যান। তাঁকে যখন ব্রিজ থেকে পূর্ব পাড়ে সরিয়ে নেয়া হচ্ছিল, তখন তাঁকে লক্ষ করে বেশ শেলিং হচ্ছিল। তিনি আহত হওয়ায় তাঁর সঙ্গের ইপিআর সৈনিকদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে এ-সময় লে. শমসের মুবিন চৌধুরী নিজেদের পক্ষের নিহত ৮ জনসহ আহতদের ব্রিজের পূর্ব পাড়ে পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হন। পাকিস্তানি সৈন্যদের তুলনায় সংখ্যায় অল্প হওয়ায় তাঁরা টিকতে পারছিলেন না। এক পর্যায়ে তাঁরা পাকিস্তানি বাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যান। তিনি আর নিজেকে সেখান থেকে সরাতে না পেরে বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতি বেপরোয়াভাবে ফায়ার করতে শুরু করেন। এ-সময় তাঁর গুলিতে ৩ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত এবং একজন গুরুতর আহত হয়। ঠিক এমন সময় তিনি শত্রুর গুলির আঘাতে আহত হয়ে ব্রিজের ওপর শুয়ে পড়েন। তিনি এ-সময় পাকিস্তানি সৈন্যের কাছে ধরা পড়ার চেয়ে আত্মহত্যাকে শ্রেয় মনে করলেও তাঁর পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। কেননা তাঁর অস্ত্র ছিটকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল। ফলে অল্পক্ষণের মধ্যে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁকে ধরে ফেলে। তারা তাঁকে হত্যা করার পরিবর্তে তাদের কমান্ডারের কাছে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে।
এদিকে সকাল ৯টার দিকে কালারপুল থেকে মেজর মীর শওকত আলী কালুরঘাটে এসে সেখানকার ডিফেন্সের সবাইকে পিছু হটার নির্দেশ দেন। তাঁরা যতক্ষণ পিছু হটতে না পারেন ততক্ষণ লে. মাহফুজুরকে মদুনঘাট ডিফেন্সে অবস্থান করতে বলেন। এভাবে ১১ই এপ্রিল কালুরঘাটের পতন ঘটে। অতঃপর ইপিআর, পুলিশ এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ৪৫০ জন সৈনিক কালুরঘাট থেকে পটিয়াতে একত্রিত হয়ে মেজর মীর শওকত আলীর নেতৃত্বে বান্দরবানের উদ্দেশে রওনা হন। ১২ই এপ্রিল তাঁরা বান্দরবানে পৌঁছেন এবং সেদিনই তাঁরা কাপ্তাই হয়ে রাঙ্গামাটি পৌঁছে ডিফেন্স গ্রহণ করে মহালছড়িতে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার্স স্থাপন করেন। অন্যদিকে লে. মাহফুজুর পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আঘাত হেনে চললেও এক পর্যায়ে তাদের আক্রমণের মুখে টিকতে অসমর্থ হয়ে রাউজানের নোয়াপাড়া নামক স্থানে ডিফেন্স নেয়ার পর সেখান থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নতুন করে ডিফেন্স নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর মোকাবিলা করতে থাকেন। ১৪ই এপ্রিল তিনি তাঁর অধীনস্থ ২০০-র অধিক সৈনিক নিয়ে মেজর মীর শওকত আলীর নির্দেশে তাঁর সঙ্গে মহালছড়িতে একত্রিত হন।
২৬শে মার্চ থেকে ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত কালুরঘাট প্রতিরোধযোদ্ধাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য জীবিকা নির্বাহ ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তখন তাঁদের জীবিকা নির্বাহের জন্য অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী এমএনএ, আবু সালেহ এমএনএ, আতাউর রহমান খান কায়সার এমএনএ, সুলতান আহমদ কুসুমপুরী এমপিএ, ডা. বি এম ফয়জুর রহমান এমপিএ, ডা. এম এ মান্নান এমপিএ প্রমুখের নেতৃত্বে বোয়ালখালী, পটিয়া, সাতকানিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী থানা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ, থানাভিত্তিক সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ইউনিয়ন ও গ্রামভিত্তিক সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতা-কর্মীরা চট্টগ্রাম দক্ষিণাঞ্চলের স্বাধীনতাকামী জনগণের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য, রসদ ও অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করে তা জোগান দিয়েছিলেন। এ- ক্ষেত্রে বোয়ালখালী থানা সংগ্রাম পরিষদ, পটিয়া থানা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, দক্ষিণ পটিয়া (বর্তমান চন্দনাইশ উপজেলা) আঞ্চলিক সংগ্রাম পরিষদের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। তৎকালীন চকরিয়া, উখিয়া ও কক্সবাজার থেকেও খাদ্য, রসদ ও নানা সামগ্রী সরবরাহ করা হয়। [শামসুল আরেফীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড