মুক্তিযুদ্ধে কালিহাতী উপজেলা (টাঙ্গাইল)
কালিহাতী উপজেলা (টাঙ্গাইল) কালিহাতী উপজেলায় বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী (স্বাধীনতা-পরবর্তী রাষ্ট্রপতি), আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এমপিএ, শাজাহান সিরাজ (কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক), আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম, আনোয়ার উল আলম শহীদ (স্বাধীনতা-পরবর্তী সচিব ও রাষ্ট্রদূত) প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে বিভিন্ন আন্দোলনে এঁরা নেতৃত্ব দেন। এঁদের ছাড়াও ছিলেন সাইদুর রহমান, সৈয়দ নূরুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক খান, আবুল কালাম, আনিসুর রহমান, কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙ্গাল, আবদুল হাকিম তালুকদার, আবুল হোসেন মল্লিক প্রমুখ। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো কালিহাতীতেও জনমনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এমতাবস্থায় উপর্যুক্ত ব্যক্তিবর্গের দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি হয়।
কালিহাতীতে আরো যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন- ওয়ারেজ আলী নূরু, রহিমা সিদ্দিকী, হাজেরা সুলতানা, মীর মিজানুর রহমান, খন্দকার নূরুল ইসলাম, স্বপন ভট্টাচার্য, মিজানুর রহমান মজনু (উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার) প্রমুখ। যুদ্ধকালীন কমান্ডাররা হলেন- সৈয়দ গোলাম মোস্তফা, বীর প্রতীক, সাইদুর রহমান, বীর প্রতীক, মনিরুল ইসলাম মনির, কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙ্গাল, আবদুল হাকিম তালুকদার, সুবেদার নবী নেওয়াজ খান, আমানুল্লাহ, ফেরদৌস আলম রঞ্জু প্রমুখ।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর দিকনির্দেশনামূলক ভাষণের পর থেকেই কালিহাতীর মানুষ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কালিহাতী আর এস হাইস্কুল মাঠে কামার্তী গ্রামের সেনাসদস্য আবদুল মোতালেবের নেতৃত্বে, গার্লস হাইস্কুল মাঠে কস্তুরিপাড়া গ্রামের সেনাসদস্য মনিরুল ইসলাম মনিরের নেতৃত্বে এবং গোলড়াতে সৈয়দ নূরুল ইসলামের নেতৃত্বে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ। এছাড়া নগরবাড়ী ইউনিয়ন বোর্ড অফিস মাঠেও প্রশিক্ষণ চলে। কালিহাতীর জোকারচরে টাঙ্গাইলের সোহরাওয়ার্দী ও আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে প্রাথমিক ট্রেনিং নেয়া ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি গ্রুপ ভূঞাপুর ডাকবাংলো মাঠে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে যোগ দেন। ২৯শে মার্চ কাদের সিদ্দিকী এবং অর্থমন্ত্রণালয়ের তৎকালীন যুগ্মসচিব ও টাঙ্গাইল হাইকমান্ডের উপদেষ্টা খন্দকার আসাদুজ্জামানের সহযোগিতায় টাঙ্গাইল ট্রেজারি বিল্ডিংয়ের মালখানা থেকে ৪৫০টি রাইফেল ও কয়েক হাজার গুলি উদ্ধার করা হয়। কাদের সিদ্দিকী নিজেও বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে বেশকিছু অস্ত্র ও গুলি হস্তগত করেন। তিনি ৩রা এপ্রিল সখিপুরের মরিচাতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ক্যাম্প স্থাপন করেন। ১০ই জুন বহেড়াতৈল-এ নিজের গঠিত কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধাদের শপথবাক্য পাঠ করান এবং পরবর্তীতে সখিপুরের মহানন্দপুরে এ বাহিনীর সদর দফতর স্থাপন করেন।
১৯শে এপ্রিল কালিহাতী ব্রিজ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে একজন অফিসারসহ ১০-১৫ জন পাকসেনা নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। পক্ষান্তরে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৭-৮ জন আহত হন। এ-যুদ্ধে শেষপর্যন্ত মুক্তিবাহিনী পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয় এবং পাকবাহিনী কালিহাতীতে প্রবেশ করে কালিহাতী থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীতে তারা বল্লাতেও একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। কালিহাতী উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে ডা. ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল বাছেত (সোমজানী), শহীদুল্লাহ খান ইউসুফজাই (চারান), অধ্যাপক মীর সোহরাব আলী (সিংনা), মুছা তালুকদার (দুর্গাপুর), ইছা তালুকদার (দুর্গাপুর), আবদুর রাজ্জাক আনসারী (বল্লা), নান্নু আনসারী (বল্লা), কাশেম আনসারী (বল্লা), মালেক মওলানা (বল্লা), সেন্টু খাঁ (বেতডোবা), আজগর আলী (বেতডোবা), ননী মিয়া (রাজাফৈর), আরফান আলী (পাছজোয়াইর), নূরুল্লাহ মাস্টার (কালিহাতী), বরকতুল্লাহ (চকপাড়া), সৈয়দ কিসলু (বাংড়া), জোয়াহের আলী (বেতডোবা), চান মিয়া (বাঘুটিয়া), আলাউদ্দিন (পলাশতলী), মাজম আলী দফাদার (কুচটি), সেকান্দর আলী (কুচটি), একাব্বর আলী (মালতি), ইন্নছ আলী (মালতি), পিয়ার আলী (পালিমা), মফিজ মেম্বার (কাচিনা), আশু ডাক্তার (মালতি), বাহাজ উদ্দিন তালুকদার (বাঁশজানা), সিরাজ মৌলবী (সোনাকান্দর), খোকা মেম্বার (জাবরাজান), লিয়াকত আলী (সল্লা), কেরামত মৌলবী (বাশিবাড়ী) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
পাকবাহিনী তাদের স্থানীয় দোসরদের সহযোগিতায় কালিহাতীতে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। এরূপ কয়েকটি গণহত্যা হলো ইছাপুর গণহত্যা, কামার্তী গণহত্যা, ঘোনাবাড়ি গণহত্যা, বেতডোবা গণহত্যা, তাতিহারা গণহত্যা, নগরবাড়ি গণহত্যা, বল্লা গণহত্যা, হিন্নাইপাড়া গণহত্যা ও পালিমা গণহত্য। এসব গণহত্যায় শতাধিক গ্রামবাসী শহীদ হন। এছাড়া পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা বল্লা বাজারসহ বিভিন্ন গ্রামে অগ্নিসংযোগ, নারীধর্ষণ এবং এলেঙ্গা জমিদার বাড়িসহ বিভিন্ন বাড়িতে লুটতরাজ করে।
কালিহাতী উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। সেসবের মধ্যে চারানের যুদ্ধ, বল্লার যুদ্ধ, ঘোনাবাড়ির যুদ্ধ এবং বাংড়া ব্রিজ যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২২শে মে চারানের যুদ্ধে ১৩ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং এক বাক্স গুলি ও ৪টি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। ১২ই জুন বল্লার যুদ্ধে ৫ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং বেশকিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। অক্টোবর মাসে ঘোনাবাড়ির যুদ্ধে ১৫-২০ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। বাংড়া ব্রিজ যুদ্ধ হয় আগস্টের শেষদিকে। এ-যুদ্ধে সুবিধা করতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করেন। ১০ই ডিসেম্বর কালিহাতী উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম, সাইদুর রহমান, বীর প্রতীক (পিতা সিরাজুর রহমান, কামার্তী) ও সৈয়দ গোলাম মোস্তফা, বীর প্রতীক (পিতা সৈয়দ ইউনুছ আলী, গোলড়া)।
কালিহাতী উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- হাবিবুর রহমান (পিতা হাজি কাজিম উদ্দিন, চর সিংগুলি; কোম্পানি কমান্ডার), নজরুল ইসলাম (পিতা আবদুল আজিজ মিয়া, গোহালিয়াবাড়ী), কায়েম উদ্দিন (পিতা ছবর আলী মণ্ডল, দৌলতপুর), আলী আজগর (পিতা আলীম উদ্দিন মুন্সি, সাতুটিয়া), জামাল হোসেন (পিতা আবদুল সরকার, চামুরিয়া), আবদুস সালাম (পিতা আবদুর রহিম, বল্লা), ওয়াহেদ আলী (পিতা আবদুস সামাদ, বল্লা), রফিকুল ইসলাম (পিতা আব্দুল ওয়ারেস, বল্লা), শফিউদ্দিন (পিতা শাহা আলী, বল্লা), আবদুল খালেক (পিতা আবদুস সালাম, বল্লা), নূরুজ্জামান (পিতা সরবেশ আলী, রামপুর), আবুল কাশেম (পিতা পলু সরকার, ছাতিহাটি), আবদুল মজিদ খান (পিতা নূর মোহাম্মদ খান, পাছচারান), ইছব আলী (পিতা কালু মিয়া, ঝাটিবাড়ী), ইব্রাহিম মিয়া (পিতা পানাউল্লাহ মিয়া, বাড্ডা), আবুবকর সিদ্দিক (পিতা মানিক শিকদার, খালুয়াবাড়ী), রমজান আলী (পিতা আহাম্মদ আলী, জোয়াইর), আবদুল হামিদ (পিতা খুদু ডুলি, জোয়াইর), আবদুর রশিদ তালুকদার (পিতা এরফান আলী তালুকদার, যোগীপাল), মজিবর রহমান খান (পিতা ওয়াজেদ আলী খান, চিনামুড়া), খন্দকার হাফিজ (পিতা খন্দকার কালু মিয়া, জাবরাজান), আবদুল আজিজ (পিতা বাহাজ উদ্দিন সরকার, বিলবর্ণী), শ্রীদাম চন্দ্র সাহা (পিতা আশুতোষ সাহা, বল্লা), শাহজাহান মিয়া (পিতা জনাব আলী সরকার, নাগবাড়ী), বাদল চন্দ্র শীল (পিতা শ্রীদাম চন্দ্র শীল, ভূক্তা), শামসুল হক (পিতা সবদুল হক, ভূক্তা), মনোরঞ্জন আচার্য (পিতা মুরারী মোহন আচার্য, বলধী), বাচ্চু হাওলাদার (পিতা আবদুর রহমান হাওলাদার, বেতডোবা), মোবারক আলী খান সুজা (পিতা মোহফেল আলী খান, গোলড়া), সাইফুল আলম খান ইয়াসিন (পিতা মৌলবী মফেল খান, গোলড়া), আতিয়ার রহমান খান নূরু (পিতা জিয়াউদ্দিন খান, গোলড়া), মীর আবু হানিফ সেলিম (পিতা মীর আবদুল হাকিম, গোলড়া), আবদুর রশিদ (পিতা কালু মামুদ, গোলড়া), আবদুল হক (পিতা গাদু বেপারী, শিংগাইর), সোহরাব আলী (পিতা খোরশেদ আলী, কালিয়াগ্রাম), আবু তালেব (পিতা আবেদ আলী, কস্তুরিপাড়া), লাল মামুদ মিঞা (পিতা বিদুর আলী, জোয়াইর), সৈয়দ আবু তাহের (পিতা সৈয়দ এ কে নেওয়াজ, পাছচারান) এবং আবুল কাশেম মিয়া (পিতা ওয়াহেদ আলী, খালুয়াবাড়ী)।
কালিহাতী উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষার্থে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বাঘুটিয়া বঙ্গবন্ধু টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ক্যাম্পাসে বিজয় একাত্তর স্মৃতিসৌধ, উপজেলা সদরে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স এবং এর সামনে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, কুরুয়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক, গোলড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া গোহালিয়াবাড়ী ইউনিয়নে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম সড়ক, সহদেবপুরে শহীদ আলী আজগর সড়ক, কালিহাতীতে কমান্ডার মনির সড়ক, সহদেবপুরে শহীদ জামাল উচ্চ বিদ্যালয়, গোলড়ায় মহাবীর নূরুল ইসলাম তোরণ, কালিহাতীতে শহীদ আলী আজগর স্মৃতিসংঘ নির্মিত হয়েছে। [শফিউদ্দিন তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড