You dont have javascript enabled! Please enable it!

কালীকচ্ছ মাইন অপারেশন (সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া)

কালীকচ্ছ মাইন অপারেশন (সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) পরিচালিত হয় ৬ই অক্টোবর। কালীকচ্ছ ইউনিয়নের ভেতর দিয়ে যাওয়া সরাইল-নাসিরনগর রাস্তায় এ অপারেশন এতদঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এতে পাকসেনাদের একটি গাড়ি এবং পেছনে থাকা শান্তি কমিটি ও রাজাকার দের একটি গাড়ি বিধ্বস্ত হয়। এর ফলে পাকবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ ১১ জন সৈন্য এবং সরাইল শান্তি কমিটির প্রধান মন্নাফ ঠাকুর নিহত হয়। সরাইল থানার মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি গ্রুপ মিলে এ আক্রমণ পরিচালনা করে। অপারেশনের মূল ভূমিকায় ছিলেন শাহবাজপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ওছমান উদ্দিন আহম্মদ খালেদ, নোয়াগাঁওয়ের মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের এবং হাফিজুর রহমান গ্রুপের আবদুল হক।
মুক্তিযোদ্ধা ওছমান উদ্দিন আহম্মদ খালেদ আগরতলায় ক্যাপ্টেন নাসিম ও লেফটেন্যান্ট হেলাল মোর্শেদের নিকট বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রের প্রশিক্ষণসহ বিশেষভাবে মাইন অপারেশনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। দেশের ভেতরে আক্রমণ পরিচালনার জন্য তাঁদের দুই প্রকার মাইন দেয়া হয়- এন্টিপার্সন মাইন ও এন্টিট্যাংক মাইন। এই গ্রুপের ৫ জনের প্রত্যেককে প্রশিক্ষণ শেষে একটি স্টেনগান, চারটি গুলিভর্তি ম্যাগাজিন, অতিরিক্ত ১৫০ রাউন্ড গুলি, ১২টি গ্রেনেড, ১২টি এন্টিপার্সন মাইন ও দুটি এন্টিট্যাংক মাইন দিয়ে দেশে পাঠানো হয়। এ গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার সুহিলপুর ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা কামাল মিয়া।
ওছমান উদ্দিন আহম্মদ খালেদ সরাইলের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা বিশেষত নরু মাস্টার, সাইফু মিয়া, আওলাদ ও হাসনাতের সঙ্গে যোগাযোগ করে এলাকায় এসে মাইন অপারেশনের স্থান অনুসন্ধান ও রেকি করতে থাকেন। এক পর্যায়ে তাঁরা কালীকচ্ছ পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পের পাশ দিয়ে যাওয়া হানাদারদের চলাচলের মূল রাস্তা নাসিরনগর সড়কটি নির্ণয় করেন। অক্টোবরের ৬ তারিখ নোয়াগাঁও গ্রামের আবু তাহের গ্রুপ এবং হাফিজুর রহমান গ্রুপের আবদুল হকসহ অন্য দু- তিনটি গ্রুপের সমন্বয়ে নিয়ামতপুরের শ্যামানন্দের (শ্যামা পাগলা) বাড়িতে বসে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী পার্শ্ববর্তী মলাইশ গ্রামের অনঙ্গ দাসের বাড়িতে পরের দিন রাত ৯টার মধ্যে মিলিত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সে- রাতে তাঁরা নৌকাযোগে কালীকচ্ছ গিয়ে নির্ধারিত স্থানে মাইন বসানোর ব্যবস্থা করতে যান। নৌকা সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন রিয়াজউদ্দিন সরকার। মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহেরের ওপর ছিল পথপ্রদর্শক হিসেবে নিরাপদে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মাইন অপারেশনের সমন্বিত দলটি কালীকচ্ছ ও ধর্মতীর্থের মাঝামাঝি স্থানে সরাইল-নাসিরনগর রাস্তায় গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে নৌকায় অবস্থান করেন দুজন। বাকিরা আবু তাহের ও রিয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বে দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে রাস্তার দু- পাশে এম্বুশ রচনা করেন। মাইন বসানোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন মুক্তিযোদ্ধা খালেদ এবং আবদুল হক। তাঁরা দুজন শাবল দিয়ে পাকা রাস্তা ভেঙে দুটি গর্ত খুঁড়ে দুটি মাইন সফলভাবে পুঁতে রাখেন। সে রাতের পাসওয়ার্ড ছিল ‘চন্দ্র- সূর্য’। কাজ সমাপ্তির পর সিগন্যাল পেয়ে সবাই নিরাপদে শাহবাজপুর ফিরে যান। পরদিন বিকাল চারটার দিকে পাকসেনাদের একটি জিপ গাড়ি এবং শান্তি কমিটি ও রাজাকার বহনকারী একটি গাড়ি সে-পথ দিয়ে যাওয়ার সময় মাইন দুটি বিস্ফোরিত হয়। এতে দুটি গাড়িই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এতে পাকবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ এগারো জন পাকসেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। পেছনে থাকা গাড়িতে সরাইল থানা শান্তি কমিটির প্রধান মুসলিম লীগ নেতা মন্নাফ ঠাকুর ছিল। সে-সহ গাড়িতে থাকা সবাই আহত বা নিহত হয়। মন্নাফ ঠাকুর আহত অবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করে। [মানবৰ্দ্ধন পাল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!