কালীকচ্ছ শ্মশান গণহত্যা (সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
কালীকচ্ছ শ্মশান গণহত্যা (সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) সংঘটিত হয় অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে। এতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৭ জন মানুষ শহীদ হন।
সরাইল থানার উত্তরে কালীকচ্ছ ইউনিয়ন। কালীকচ্ছ শ্মশানটি কালীকচ্ছ বাজারের পশ্চিম পাশে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সেখানে শ্মশানকালীর একটি মন্দির আছে। শ্মশানের কাছাকাছি জেলেপাড়া ও দাসপাড়া। এই শ্মশ্মশানেই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়।
২৮শে মে কালীকচ্ছ গ্রামে হানা দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লোকেরা গিরীশ ডাক্তার ও গোপাল মাস্টারসহ পাঁচজনকে ধরে নিয়ে যায়। রসুলপুরের গণী দালাল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করে। কালীকচ্ছের বুড়ো ডাক্তার এবং চিন্তাহরণ ডাক্তারের বাড়িতেও তারা হানা দিয়েছিল। কিন্তু তারা তখন কালীকচ্ছ বাজারে ছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর আগমন টের পেয়ে সেখান থেকে তারা পালিয়ে যান। গণী দালাল তখন এ এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তার ভয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস পেত না। প্রায় প্রতিদিনই সে বিভিন্ন হিন্দুবাড়িতে চড়াও হতো। বাড়িঘর লুট করত, এলাকার লোকজনকে পাকবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিত। হিন্দুদের ধরে নিয়ে তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করত।
গণী দালাল একদিন টেক্সি নিয়ে কালীকচ্ছ বাজারে যায় লোক ধরার জন্য। সেদিন তার সঙ্গে পাকসেনারা ছিল না। এলাকার লোকজন তার ওপর খুবই ক্ষিপ্ত ছিল। সুযোগ পেয়ে এলাকার কয়েকজন সাহসী লোক তাকে টেক্সি থেকে জোর করে নামিয়ে বিলের কাছে নিয়ে গায়েব করে ফেলে। এরপর কেউ আর তার সন্ধান পায়নি৷
গণী দালালকে হত্যার পর কালীকচ্ছ এলাকায় রাজাকারদের অত্যাচার বেড়ে যায়। পাশাপাশি এলাকাবাসীও দালাল ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। তারা ৬ জন অত্যাচারী রাজাকারকে ধরে নিয়ে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়। এই ৬ জন রাজাকার জোট বেঁধে হিন্দুদের গরু-বাছুর, হাঁস-মুরগি, মূল্যবান আসবাবপত্র – এমনকি ঘর পর্যন্ত লুট করে নিয়ে বিক্রি করে দিত। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি পর্যায়ে সরাইলে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যতই বাড়তে থাকে, ততই তাদের এবং
আলবদর–রাজাকারদের অত্যাচার-নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা বাড়তে থাকে। গণী রাজাকারকে গুম করা এবং ৬ জন রাজাকারকে সলিল সমাধি দেয়ার পর এলাকার দালাল ও রাজাকাররা মরিয়া হয়ে ওঠে। এর ফলে ৭ই আগস্ট পাকবাহিনী অতর্কিতে হামলা করে কালীকচ্ছ গ্রাম থেকে দুজন হিন্দু মহিলাসহ সাতজন লোককে ধরে নিয়ে যায়। সরাইল থানায় আটক রেখে তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়। পরে তাদের কুমিল্লা সেনানিবাসে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দীর্ঘদিন আটক রাখার পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
কালীকচ্ছ এলাকায় মুক্তিবাহিনীও তৎপর ছিল। ২৮শে আগস্ট রাতে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল শান্তি কমিটির সদস্য বাবর আলী চেয়ারম্যানকে হত্যা করে। ৬ই অক্টোবর মুক্তিবাহিনী কালীকচ্ছ বাজারের উত্তর পাশে পাকবাহিনীর দুটি জিপ মাইন দিয়ে উড়িয়ে দেয়। এতে একজন ক্যাপ্টেনসহ কয়েকজন সৈনিক নিহত হয়। সরাইলের মুসলিম লীগ নেতা ও শান্তি কমিটির প্রভাবশালী সদস্য মন্নাফ ঠাকুর এ অপারেশনে নিহত হয়। এ ঘটনার পর পাকবাহিনী কালীকচ্ছ গ্রামের বিভিন্ন বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং ৬ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। গ্রামের অন্যান্য লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে পাকসেনা ও রাজাকাররা সরাইল-কালীকচ্ছ এলাকার গোপালচন্দ্র দেব, যোগেন্দ্ৰ চৌধুরী (মেম্বার), জীবেশবন্ধু চৌধুরী, ধরণী দেব, প্রাণকুমার সেন, বৈরাগী সেন, নীরোদ দাস, বীরু দাস, আনন্দ দাস, গোপালের বাবা, ধনঞ্জয় দাস, নীলমণির ভাই, কালাচান গোঁসাই, প্রিয়নাথ রায় প্রমুখকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় এবং তাদের মধ্য থেকে ৭ জনকে কালীকচ্ছ শ্মশানে নিয়ে হত্যা করে। রাজাকাররা এই শহীদদের লাশ পার্শ্ববর্তী মেঘনা নদীর সংযোগ খালে ভাসিয়ে দেয়। [মানবৰ্দ্ধন পাল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড