You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে কালিয়াকৈর উপজেলা (গাজীপুর)

কালিয়াকৈর উপজেলা (গাজীপুর) গাজীপুর জেলার উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। এর পশ্চিমে টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলা, উত্তরে সখিপুর উপজেলা, দক্ষিণে ঢাকা জেলার ধামরাই ও সাভার উপজেলা এবং পূর্বদিকে গাজীপুরের জয়দেবপুর ও শ্রীপুর উপজেলা। উপজেলার চারভাগের তিনভাগ অপেক্ষাকৃত উঁচু ও বনাঞ্চল এবং বাকি অংশ নিচু জলাভূমি। বর্তমানে একটি পৌরসভা ও নয়টি ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে কালিয়াকৈর উপজেলা গঠিত।
উপজেলার মধ্য দিয়ে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক চলে গেছে। উপজেলাটি এক সময় বৃহত্তর ঢাকা জেলার অংশ ছিল। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ আকস্মিকভাবে ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন। ফলে পূর্ব বাংলার মানুষের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কালিয়াকৈর উপজেলা ঢাকা শহরের নিকটবর্তী হওয়ায় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের জনসভাসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ডে কালিয়াকৈরের মানুষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ৭ই মার্চের জনসভায় যোগ দেবার জন্য সকাল থেকেই বাস ও ট্রাক যোগে কালিয়াকৈরের অসংখ্য ছাত্র-জনতা অংশগ্রহণ করে। এর প্রেক্ষাপটে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্রনেতাদের সমন্বয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ডা. আলী হোসেনকে আহ্বায়ক এবং মো. জসিমউদ্দিনকে সম্পাদক করে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সংগ্রাম কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- মো. জাকির হোসেন জাগু, সমরজিৎ সাহা, নূর নবী, অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, মো. খলিলুর রহমান, দেওয়ান আবদুর রশিদ, আহসানউল্লাহ পাটোয়ারী, মো. ফজলুল হক প্রমুখ। এছাড়া দেওয়ান মো. ইব্রাহিম, মো. নাসির উদ্দিন আহেমদ, মো. নজরুল ইসলাম, মো. ইসমাইল হোসেন, মো. আকতারুজ্জামান, আবদুল হক, এস এম মজিবুর রহমান, আবু নাসির, আবদুল ওহাব মিয়া, আবুল বাসার, মীর্জা শামসুল আলম প্রমুখকে নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। ১৯শে মার্চ গাজীপুরে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধের পর জয়দেবপুরের সমরাস্ত্র কারখানা ও ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিপুল সংখ্যক বাঙালি সৈনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ কালিয়াকৈরের ফুলবাড়ীয়া, বোয়ালী, বড়ইবাড়ি প্রভৃতি এলাকায় অবস্থান নেন। সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের সহযোগিতায় তাঁদের নিরাপদ আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। তাঁদের রেখে যাওয়া অনেক অস্ত্র পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত হয়।
২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও ধ্বংসলীলার খবর এ অঞ্চলের মানুষ প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই জানতে পারে। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর তারা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের আর্টিলারি হাবিলদার মো. লাবিব উদ্দিন (পাইকপাড়া) এবং মো. নাসির উদ্দিন আহমেদের সহযোগিতায় বড়ইবাড়ী এ কে ইনস্টিটিউট এলাকার যুবকদের প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু হয়। মো. লাবিব উদ্দিন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স থেকে পালিয়ে আসা পুলিশ সদস্যদের নিকট থেকে বেশকিছু অস্ত্র সংগ্রহ করে কাঞ্চনপুরের গোলাবাহার টেকে প্রায় ৩০ জন যুবককে নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করেন।
উপজেলার ফুলবাড়ীয়া কাঁচিঘাটায় পাতার ক্যাম্পে (বিড়ি ক্যাম্প) আফছার ব্যাটালিয়নের ২৫-৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. আব্দুল হাকিমের নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ফুলবাড়ীয়া আক্কেল আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ আলী আইএসসি এবং মো. মোয়াজ্জেম হোসেন মিঠু সহযোগিতা করেন। স্থানীয় কিছু ইপিআর সদস্যও এ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। তাছাড়া বলধার নিকট নাকাসিলার টেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কমান্ডার আব্দুল হাকিম এতদঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ এবং সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তী সময়ে এখানকার অনেক মুক্তিযোদ্ধা উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান।
কালিয়াকৈরে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন আফছার উদ্দিন ব্যাটালিয়নের কোম্পানি কমান্ডার মো. আব্দুল হাকিম (বাটাজোড়-ভালুকা)। তাঁর অধীনে সহকারী কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন সুবেদার (অব.) দেওয়ান মো. সিদ্দিক হোসেন (উত্তর দাড়িয়াপুর)। এছাড়া কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে আজাদ কামাল (দেওহাট-মির্জাপুর), বিএলএফ কমান্ডার হিসেবে দেওয়ান মো. ইব্রাহীম (সাকাশ্বর) এবং মো. আনোয়ার হোসেন (চা-বাগান), বিএলএফ সেকশন কমান্ডার সামসুদ্দীন সরকার (ঠেংগারবান্দ), সেকশন কমান্ডার মো. হাবিবুর রহমান (হবিয়ারচালা), সেকশন কমান্ডার আব্দুস ছালাম (চাঁনপুর) প্রমুখ দায়িত্ব পালন করেন।
যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে লাবিব উদ্দিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের কতিপয় সদস্যদের নিয়ে বড়ইবাড়ী এ কে ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। পরবর্তীতে কিছু সদস্য নিয়ে কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দেন। আফছার ব্যাটালিয়নের কোম্পানি কমান্ডার মো. আব্দুল হাকিম মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডার আজাদ কামাল তাঁর বাহিনী নিয়ে এ এলাকায় তৎপর ছিলেন। শেষদিকে দেওয়ান মো. ইব্রাহিম ও আনোয়ার হোসেনের কমান্ডে এ বাহিনী পরিচালিত হয়। বিএলএফ (মুজিব বাহিনী ) কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল হাকিম কালিয়াকৈর উপজেলার প্রতিটি গ্রামে সহকারী মুক্তিবাহিনী গঠন করেন, যারা বিভিন্ন যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেন।
২৯শে মার্চ পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা কয়েকটি সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে টাঙ্গাইল অভিমুখে রওনা হয়। এ সংবাদ পাওয়ার পর কালিয়াকৈরের সাধারণ মানুষ সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির সদস্য মো. জসীম উদ্দীন, ডা. আলী হোসেন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে লতিফপুরের নিকট ভ্যাইলকা বিলের ব্রিজে (ঢাকা- টাঙ্গাইল রোড) বড়বড় গাছ কেটে পাকসেনাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করেন।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে কালিয়াকৈরে পাকিস্তানি বাহিনীর তৎপরতা শুরু হয়। ২২শে মে সন্ধ্যায় পাকবাহিনীর শতাধিক সদস্য সশস্ত্র অবস্থায় কালিয়াকৈর বাজারে অনুপ্রবেশ করে এবং ডাকবাংলোতে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। তাদের কতিপয় সদস্য কালিয়াকৈর দাতব্য চিকিৎসালয়ের ডাক্তার ও কর্মচারীদের বাসায় আশ্রয় গ্রহণ করে। পরদিন ভোরে পাকসেনারা বাজারের আশেপাশের গ্রাম চাপাইর, কালিয়াকৈর ও কালিয়াকৈর পালপাড়ায় অগ্নিসংযোগ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর একটি অংশ জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে তুরাগ নদী দিয়ে গানবোট সহকারে ক্যাম্প স্থাপনের উদ্দেশ্যে ফুলবাড়ীয়া যায়। পথিমধ্যে তারা বড়ইবাড়ী, নলুয়া, বোয়ালী ও ফুলবাড়ীয়া গ্রামে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা ফুলবাড়ীয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তজুমুদ্দিন সরকারের বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীতে ক্যাম্পটি ফুলবাড়ীয়া বাজারের ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে স্থানান্তর করা হয়। ক্যাম্প স্থাপনে মো. তজুমুদ্দিন (চেয়ারম্যান, ফুলবাড়ীয়া) এবং মো. আক্কেল আলী সরকার (ফুলবাড়ীয়া) সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে।
কালিয়াকৈরে পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশের পর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী লোকজনের সহায়তায় রাজাকার বাহিনী এবং শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। কমান্ডার মো. নেহাল উদ্দিনের (কাঁচারস) নেতৃত্বে উপজেলায় রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। রাজাকার বাহিনীর অন্য সদস্যরা হলো- লাল মিয়া (চাপাইর), হযরত আলী (চাপাইর), ছফি সিদ্দিক (বলিয়াদী), আনর উদ্দিন (কালিয়াকৈর), ইউসুফ আলী পুলিশ (বরিশাল), শুকুর আলী (কালিয়াকৈর), মুসলেম সদা, সামসুদ্দিন প্রমুখ। অপরদিকে বলিয়াদীর জমিদার পরিবারের সদস্য চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটির উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হলো— মো. সিদ্দিক হোসেন চেয়ারম্যান (বড়ইবাড়ী), আবু হোসেন সরকার (বাঁশতলী), তাজউদ্দিন আহমেদ (চাপাইর), তজুমুদ্দিন চেয়ারম্যান (ফুলবাড়ীয়া), আক্কেল আলী সরকার (ফুলবাড়ীয়া), টেপু মুক্তার (উত্তর হিজলতলী), হালিম মেম্বার (নলুয়া) প্রমুখ। এলাকার কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার নেহাল উদ্দিনের নেতৃত্বে রাজাকাররা বিভিন্ন গ্রাম থেকে লোকজনের মালামাল, গৃহপালিত পশু, নগদ টাকা-পয়সা ইত্যাদি লুণ্ঠন করে নিয়ে যেত। গ্রাম থেকে জোর করে লোকজন ধরে এনে পাকসেনাদের বাংকার নির্মাণসহ অন্যান্য কাজে লাগানো হতো। রাজাকাররা মেয়েদের ধরে এনে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে সরবরাহ করত।
কালিয়াকৈরে পাকবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপিত হওয়ার পর তাদের দোসরদের সহযোগিতায় অত্যাচার-নির্যাতন, হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও, লুটতরাজ ও নারীনির্যাতন শুরু হয়। জুন মাসের শেষদিকে কালিয়াকৈর বাজারের পার্শ্ববর্তী জানেরচালা গ্রামের জনৈক ব্যক্তির দুই কন্যা সূর্য বিবি ও রহিমা বিবিকে সিনাবহ গ্রাম থেকে রাজাকারদের সহায়তায় কালিয়াকৈর ক্যাম্পে ধরে আনা হয়। কয়েকদিন ক্যাম্পে রাখার পর তারা নিরুদ্দেশ হয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক বছর পর জানা যায় তারা উভয়ে পাকিস্তানে জীবিত আছে। পাকিস্তানি বাহিনী কালিয়াকৈর বাজারের নিকটবর্তী পালপাড়া, বোয়ালী প্রভৃতি স্থানে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ এবং ধর্ষণ কার্য চালায়। তারা ১৭ই সেপ্টেম্বর শনিবার কালিয়াকৈর গণহত্যা চালায়। তারা ঘটনার দিন কালিয়াকৈর গ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী চাপাইর ও গাবতলী গ্রামের কয়েকজন নিরীহ মানুষকে ধরে তুরাগ নদীর তীরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। এ-সময় পাকবাহিনী ঘরের মধ্যে লুকানো অবস্থায় মোজাফ্ফর পিয়ন (পিতা মক্কর আলী, কালিয়াকৈর), তনুরুদ্দিন (পিতা মক্কর আলী, কালিয়াকৈর), কছিম উদ্দীন (পিতা একাব্বর হোসেন, গাবতলী), সব্দুল আলী (পিতা মাদবর আলী, গাবতলী) ও রহমান মাস্টার (পিতা কলিমুদ্দিন, গাবতলী)-কে হত্যা করে। একই দিন তারা বাজারের পার্শ্ববর্তী গ্রামে প্রবেশ করে ফজলু ও আমির চান (পিতা কালু বেপারী, চাপাইর) নামে সহোদর দুই ভাইকে একত্রে গুলি করে হত্যা করে। এদের ছাড়া আলাউদ্দীন (পিতা হায়েত আলী, চাপাইর), মজিদ (আসাম) এবং সাহাপাড়া (চাপাইর) থেকে চন্দ্ৰ মোহন সাহা (পিতা পুলিন চন্দ্র সাহা), ভবেশ সাহা (পিতা রমেশ চন্দ্র সাহা), কমর উদ্দীন বেপারী (পিতা জামাল উদ্দিন বেপারী, চাপাইর)-কে হত্যা করে। তারা তুরাগ নদীতে মাছ শিকার করতে আসা নিতাই পাল চৌধুরী (পিতা যদুনাথ পাল চৌধুরী, ভৃঙ্গরাজ), সাহাবুদ্দীন (চা-বাগান)-সহ ৪ জন জেলেকে ধরে এনে নদীর তীরে গুলি করে লাশ লতিফপুর ব্রিজ থেকে নদীতে ফেলে দেয়। এছাড়াও উপজেলার অন্যান্য স্থানে মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল আজিজ (পিতা সবেদ আলী, নাটিয়াপাড়া, টাঙ্গাইল), মুক্তিযোদ্ধা নুমেজউদ্দীন ও মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ (সাকাশ্বর), ওয়াজ উদ্দিন (ফুলবাড়ীয়া), মিন্টু পাগলার (মৌচাক) ছোট মেয়ে, মতিয়ার হোসেন মতি (পিতা অলিমুদ্দীন, বড়দল), নাজিমুদ্দিন (পিতা আলিমুদ্দিন, শেওড়াতলী), মফিজ (গোয়ালবাথান), আব্দুল হক মোল্লা (পিতা ওয়াহেদ মোল্লা, গোসাত্রা), বাবুল (পিতা বিশু খলিফা, ডাকুরাই) ও আব্দুস সালাম (পিতা কলিমুদ্দি, পিপড়াসিট) পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হন। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা ফুলবাড়ীয়া যাবার পথে বড়ইবাড়ী বাসাকৈর গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে। তারা গোসাত্রা, বালিয়াদী, চাপাইর ও কালিয়াকৈর গ্রামের অনেক বাড়িঘরেও অগ্নিসংযোগ করে। ১৪ই ডিসেম্বর পলায়নরত পাকসেনারা পালপাড়ার গোবিন্দ চন্দ্র দাস (পিতা রামচন্দ্র দাস) এবং উত্তর হিজলতলীর ফজল করিম (পিতা কালু বেপারী)-কে গুলি করে হত্যা করে।
পাকবাহিনীর স্থায়ী ক্যাম্প ডাকবাংলো, রাজাকারদের কালিয়াকৈর বাজার ক্যাম্প এবং ফুলবাড়ীয়া ক্যাম্প ছিল নির্যাতনকেন্দ্র। এসব নির্যাতনকেন্দ্রে বিভিন্ন গ্রাম থেকে লোকজন ধরে এনে নানারকম শাস্তি দেয়া হতো। তাদের বাংকার তৈরি কাজে নিয়োগ করা হতো এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সম্বন্ধে তথ্য জানার জন্য টর্চার সেলে বেঁধে নির্যাতন করা হতো। পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পসমূহ এবং তুরাগ নদীর পাড় ছিল বধ্যভূমি।
কালিয়াকৈরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকগুলো যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে ফুলবাড়ীয়া যুদ্ধ, সালদা ব্রিজ যুদ্ধ , ভেল্কা বিল ব্রিজ যুদ্ধ, মৌচাক যুদ্ধ, চন্দ্ৰা যুদ্ধ, কালিয়াকৈর বাজার আক্রমণ, সাকাশ্বর-বেগমপুর যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। ফুলবাড়ীয়ায় তজুমুদ্দিন চেয়ারম্যানের বাড়িতে পাকসেনা ও রাজাকারদের ক্যাম্প স্থাপনের সংবাদ টাঙ্গাইলের সখিপুরে অবস্থানরত কাদেরিয়া বাহিনী জানার পর বাহিনীর দুজন সংগঠক মো. শওকত মোমেন শাহজাহান এবং মির্জা মজিবর রহমান (বিএসসি)-এর নেতৃত্বে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা ৩০শে জুন তজুমুদ্দিন চেয়ারম্যানের বাড়ি আক্রমণ এবং তজুমুদ্দিন চেয়ারম্যান ও আক্কেল আলী সরকারকে আটক করেন। রাজাকাররা আত্মরক্ষার্থে গুলিবর্ষণ আরম্ভ করলে উভয় পক্ষে দীর্ঘক্ষণ গুলি বিনিময় হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা মো. আজিজ শহীদ হন এবং মির্জা মুজিবুর রহমান আহত হন। তজুমুদ্দিন চেয়ারম্যান ও আক্কেল আলী সরকারকে বাজাইল নামক স্থানে গুইলা নদীতে গুলি করা হলে তজুমুদ্দিন চেয়ারম্যান মারা যান, কিন্তু আক্কেল আলী সরকার নদী সাঁতরে প্রাণে বেঁচে যায়।
৩০শে জুন ও ৩০শে আগস্ট দুবার ফুলবাড়ীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ফুলবাড়ীয়া যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার উভয়পক্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে।
ফুলবাড়ীয়া বাজার থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে বনপরিবেষ্টিত সালদাপাড়া গ্রামের পূর্বপাশ দিয়ে প্রবাহিত সালদা নদীর ওপর লোহার ব্রিজে ২৬শে অক্টোবর পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে আফছার উদ্দিন ব্যাটালিয়নের কমান্ডার মো. আফছার উদ্দিনের নেতৃত্বে প্রায় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধে পাকসেনাদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডার আজাদ কামাল ও লালটু কোম্পানি কমান্ডের নেতৃত্বে সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে কালিয়াকৈর বাজারের পূর্বদিকে লতিফপুর গ্রামে ঢাকা- টাঙ্গাইল রোডে ভেল্কা বিলের ব্রিজ ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১লা অক্টোবর ব্রিজ আক্রমণে ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। আক্রমণে ব্রিজ পাহাড়ারত ৬ জন রাজাকার ধরা পড়ে এবং তাদের ২ জন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। এরপর ২০শে নভেম্বর দ্বিতীয়বার ব্রিজের ওপর আক্রমণ হয়। এ আক্রমণে ৪ জন রাজাকারকে অস্ত্রসহ আটক করা হয়।
কাদেরিয়া বাহিনী কর্তৃক ব্রিজটি ধ্বংস করার পর পাকিস্তানি সেনারা ব্রিজটি চলাচলের জন্য মেরামত করে এবং পুনরায় সেখানে পাহারার ব্যবস্থা করে। ২০শে নভেম্বর আফছার ব্যাটালিয়নের কোম্পানি কমান্ডার মো. আবুল হাকিমের নেতৃত্বে রাত ৩টার দিকে ব্রিজ আক্রমণ করা হয়। আক্রমণে আবুল হোসেন, আব্দুল মালেক, মিজানুর রহমান, সুবেদার দেওয়ান মো. সিদ্দিক হোসেন, দিলদার (দুলাল)-সহ অর্ধশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। যুদ্ধে ৪ জন রাজাকার আটক হয়। তাদের নিকট থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।
২৩শে অক্টোবর বিকেল ৫টায় আব্দুল হাকিমের সহকারী কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার (অব.) দেওয়ান মো. সিদ্দিক হোসেনের নেতৃত্বে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের মৌচাকে অর্ধশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা এম্বুশ করেন। পাকসেনাদের ৫টি গাড়ি এম্বুশের মধ্যে পড়লে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের লক্ষ করে ঝটিকা আক্রমণ করেন। আক্রমণে অফিসারসহ ৫ জন পাকসেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। অবশিষ্ট পাকসেনারা তিনটি জিপ গাড়ি রেখে ২টি গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়। সিজি ৫ নামক পাকসেনাদের একটি জিপ গাড়ি মুক্তিযোদ্ধারা পরবর্তীতে তাঁদের কাচিনা ক্যাম্পে নিয়ে যান। পানসেনাদের কিছু অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা কেউ হতাহত না হলেও, স্থানীয় মিন্টুর ছোট মেয়েকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে।
২৬শে অক্টোরব সালদা গ্রাম সংলগ্ন খালের ব্রিজের পাশে – ত্রিশালের আফসার বাহিনী প্রধান আফসার উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকহানাদার বাহিনীর যুদ্ধ হয় হয়, সালদা ব্রিজ যুদ্ধ – নামে অভিহিত। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে।
৪ঠা নভেম্বর সুবেদার (অব.) সিদ্দিক হোসেনের নেতৃত্বে চন্দ্রায় ফরেস্ট অফিসে পাকিস্তানি সেনাদের তেলভর্তি ট্যাংকার লক্ষ করে ২০-২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা গজারিবন থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। উভয় পক্ষের যুদ্ধে পাকবাহিনীর তেলের ট্যাংকার ধ্বংস হয়। চন্দ্রা যুদ্ধে ৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর, সুলেমান, সুরেশ, নারায়ণ, অহিদ দেওয়ান, আক্তারুজ্জামান, দুলাল, ছামান উদ্দিন প্রমুখ অংশ নেন। এ-যুদ্ধে পাকসেনাদের প্রচুর গোলাবরুদ বিনষ্ট হয়।
কালিয়াকৈর বাজার যুদ্ধ- ১১ই ডিসেম্বর সংঘটিত হয়। এদিন রাতে কমান্ডার আব্দুল হাকিমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল কালিয়াকৈর থানা ও পাকসেনাদের ক্যাম্প লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করে। উভয় পক্ষের মধ্যে ঘণ্টাখানেক গোলাগুলির পর পাকিস্তানি সেনারা কালিয়াকৈর বাজার থেকে পালিয়ে যায়। ভোর সাড়ে ৫টায় মুক্তিযোদ্ধারা বাজারে প্রবেশ করে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এ-সময় পলায়নরত রাজাকার কমান্ডার নেহাল উদ্দিনসহ ২২ জন রাজাকার এবং শান্তি কমিটির ৪ জন কুখ্যাত সদস্যকে বন্দি করা হয়। উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। বন্দি পাকিস্তানি দালালদের গণআদালতে বিচার করা হয়।
১৩ই ডিসেম্বর ১৪ জন পাকসেনা ঢাকা অভিমুখে পালিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে বোয়ালী ইউনিয়ন পরিষদে অবস্থানরত বিএলএফ সেকশন কমান্ডার মো. হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২০-২৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল এবং দেওয়ান মো. সিদ্দিক হোসেনের নেতৃত্বে আবদুল হাকিম বাহিনীর একটি দল তাদের ধাওয়া করে। ১৪ই ডিসেম্বর সাকাশ্বর ও বেগমপুরের সীমানায় তুরাগ নদীর তীরে উভয় পক্ষের মধ্যে অনুষ্ঠিত সাকাশ্বর-বেগমপুর যুদ্ধ-এ ৪ জন পাকসেনা আহত অবস্থায় বন্দি হয়, বাকিরা বাঘিরায় অবস্থানরত মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। এ-যুদ্ধে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা মো. আজিজ এবং নোমেজ উদ্দীন শাহাদত বরণ করেন।
৯ই ডিসেম্বর সকাল ১১টায় মিত্রবাহিনীর ২টি বিমান কালিয়াকৈর বাজারের দক্ষিণ অংশে বিলে এবং উত্তর অংশে তুরাগ নদীতে পরপর কয়েক দফা বোমা বর্ষণ করে। এতে কালিয়াকৈরে অবস্থানরত পাকসেনা ও তাদের দোসররা মনোবল হারায় এবং কিছু রাজাকার পাকবাহিনীর পক্ষ ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। এ-সময় খাড়াজোড়া নামক স্থানে মিত্রবাহিনী বিমান থেকে পলায়নরত পাকসেনাদের ৩৫টি গাড়ি বহরের ওপর রকেট হামলা করা হয়। এতে পাকবাহিনীর অনেক সদস্য মারা যায় এবং তাদের বহু গাড়ি আগুনে পুড়ে যায়। অবশিষ্ট পাকসেনারা গাড়ি রেখে পালিয়ে যায়। ১২ই ডিসেম্বর কালিয়াকৈর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- কাজী কামাল উদ্দীন, বীর বিক্রম- (পিতা কাজী রইস উদ্দীন আহমেদ, সাকাশ্বর)।
কালিয়াকৈর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- লাবিব উদ্দিন (পিতা কমর উদ্দিন, পাইকপাড়া), মো. আব্দুল আজিজ (পিতা সুবেদ আলী ভূঁইয়া, নাটিয়া পাড়া), মো. নুমেজ উদ্দীন (সাকাশ্বর) এবং আব্দুল আজিজ (সাকাশ্বর)। মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য কাজী কামাল উদ্দীন (পিতা কাজী রইসউদ্দিন, সাকাশ্বর)-কে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কালিয়াকৈর বাসস্টেশন থেকে কালিয়াকৈর বাজার পর্যন্ত রাস্তার নামকরণ করা হয় শহীদ লাবিব উদ্দিন সড়ক। মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আজিজের নামে ফুলবাড়ীয়া বাজারের নামকরণ করা হয় আজিজ নগর। এছাড়া শহীদ আজিজের কবর পাকা করে বাঁধাই করা হয়েছে। [মো. মোয়াজ্জেম হোসেন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!