কালিয়াকৈর গণহত্যা (কালিয়াকৈর, গাজীপুর)
কালিয়াকৈর গণহত্যা (কালিয়াকৈর, গাজীপুর) সংঘটিত হয় ১৭ই সেপ্টেম্বর। এদিন সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে কালিয়াকৈর, চাপাইর ও গাবতলী গ্রামে পাকহানাদার ও তাদের সহযোগী রাজাকার বাহিনী গণহত্যা সংঘটিত করে। এ হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় দুর্ধর্ষ রাজাকার আনুরুদ্দীনসহ পাকবাহিনীর এক প্লাটুন বালুচ সৈন্য অংশগ্রহণ করে। তাদের হাতে ১৭ জন সাধারণ মানুষ প্রাণ হারায়।
১৬ই সেপ্টেম্বর ছিল কালিয়াকৈর সাপ্তাহিক হাটের দিন। স্থানীয় লোকজন হাট থেকে কেনাকাটা শেষ করে বাড়ি ফিরছিল। বাজারে পাকসেনাদের অবস্থানের কারণে হাটে তেমন লোকজনের আসা-যাওয়া ছিল না। পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য বাজার সংলগ্ন নদীর তীরে, পূর্ব পাশে খালের পাড়ে এবং পুরাতন থানার আশেপাশে বালুর বস্তা দিয়ে বাংকার তৈরি করে রাজাকারদের দিয়ে সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করে। ১০-১২ জন পাকসেনা ও ৪০-৫০ জন রাজাকার কালিয়াকৈর ক্যাম্পে অবস্থান করছিল। এ-সময় তুরাগ নদী ছিল পানিতে পরিপূর্ণ। আফছার উদ্দিন বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল হাকিম ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে দুটি দলে বিভক্ত করেন। একটি দল চাপাইর গোদারা ঘাট থেকে থানা বরাবর এবং অপর দলটি কালিয়াকৈর খালের পূর্ব প্রান্তে আতর আলীর বাড়ি সংলগ্ন আখক্ষেতে রাত ১০টার দিকে এম্বুশ নেয়। তখন আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন, হালকা বৃষ্টিও হচ্ছিল। এর মধ্যেই উভয় স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা থানা ও বাংকার লক্ষ করে কয়েক রাউন্ড গোলা বর্ষণ করেন। পাকসেনা ও রাজাকাররা আতংকগ্রস্ত হয়ে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করতে থাকে। ভোর হবার সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিসেনারা স্থানীয় লোকদের নিরাপদ স্থানে সরে যাবার পরামর্শ দিয়ে স্থান ত্যাগ করেন। এদিকে ভীত পাকসেনারা তাদের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য টঙ্গী (TIC) ঘাঁটিতে সংবাদ দেয়। সকাল ৮টার দিকে পাকবাহিনীর ১ প্লাটুন বালুচ সৈন্য বিভক্ত হয়ে খালের পূর্ব প্রান্তে একদল, অপর দল তুরাগ নদীর উত্তর প্রান্তে চাপাইর গ্রামে রাজাকারদের সহায়তা নিয়ে প্রবেশ করে। তারা খাল পার হয়েই আতর আলীর বাড়িতে প্রবেশ করে। আতর আলী ও তার বড় ছেলে ইসমাইলকে ধরে এনে তুরাগ নদীর তীরে দাঁড় করায়। এরপর কোরবানী আলী ও তার ছোট ভাই নেহাজ উদ্দিনকে ধরে এনে চারজনকে গুলি করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। অতঃপর অফিসগামী মোজাফ্ফর আলী পিয়ন, কোরআন পাঠরত ইনসাদ আলী এবং তার ছোট ভাই তনুরুদ্দীনকে বাড়ির উঠানে গুলি করে হত্যা করে। পাকসেনাদের অপর দলটি তুরাগ নদী পার হয়ে চাপাইর গ্রামে প্রবেশ করে ফজল, আমিরচান, আলাউদ্দিন, আব্দুল মজিদ, কমর উদ্দীন, সাহা পাড়ার চন্দ্র মোহন ও ভবেশ সাহাকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর পার্শ্ববর্তী গাবতলীতে প্রবেশ করে কছিম উদ্দীন, সব্দুল আলী ও রহমান মাস্টারকে গুলি করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। হানাদার বাহিনী স্থান ত্যাগ করার পর স্থানীয় লোকজন নদী থেকে লাশ উদ্ধার করে দাফনের ব্যবস্থা করে। এ হত্যাকাণ্ডে মোট ১৭ জন নিরীহ লোক শাহাদত বরণ করে। [মো. মোয়াজ্জেম হোসেন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড