You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে কালিয়া উপজেলা (নড়াইল)

কালিয়া উপজেলা (নড়াইল) ১৯৭১ সালে যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত একটি থানা ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে এ উপজেলার মানুষ হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের অস্ত্র দিয়েই প্রতিরোধ করে। তারা নিজ উপজেলার বাইরেও বেশকিছু যুদ্ধে অংশ নেয়। যুদ্ধের সময় উপজেলার বহু নারীপুরুষ গণহত্যাসহ নানা নির্যাতনের শিকার হয় এবং তাদের ঘরবাড়ি লুণ্ঠিত বা ভস্মীভূত করা হয়। অনেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়।
১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় নির্বাচনে -আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধু তথা আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করে। ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সারা দেশের মতো কালিয়া উপজেলার জনগণও ২রা মার্চ থেকে -অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট খন্দকার আব্দুল হাফিজ এমএনএ, শাহীদ আলী খান এমপিএ, এখলাসউদ্দিন আহমদ, সরদার আব্দুস সাত্তার, এডভোকেট আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তাঁরা বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। তবে তাঁরা বুঝতে পারেন যে, পাকিস্তানিরা সহজে বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তাই কালিয়ার জনগণ যে-কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর সাতই মার্চের ভাষণ এ বাঙালি জাতির জন্য পরবর্তী দিকনির্দেশনা দেবেন এই আশা নিয়ে এডভোকেট খন্দকার আব্দুল হাফিজ এমএনএ, শাহীদ আলী খান এমপিএ, এখলাসউদ্দিন আহমদ, সরদার আব্দুস সাত্তার, এডভোকেট আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ নেতা কালিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সমবেত হন। তাঁদের আহ্বানে হাজার-হাজার লোকের সমাগম ঘটে। কিন্তু রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারিত না হওয়ায় সমবেত জনতা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরের দিন ৮ই মার্চ রেডিওতে প্রচারিত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে তারা বুঝতে পারে যে, মুক্তিযুদ্ধ অত্যাসন্ন। তখন থেকেই তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কালিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আবুল কালাম আজাদ ছুটিতে আসা সেনাসদস্য মোল্লা মনিরুজ্জামানকে নির্দেশ দেন এলাকার যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে। তিনি কলাবাড়িয়া গ্রামের দশানিমোল্লাপাড়া ও ছয়ানিপাড়ার মধ্যবর্তী স্থানে প্রায় একশত যুবককে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। পরবর্তীতে এই প্রশিক্ষণের কাজ চলে কলাবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে। প্রথম দিকে ১৫টি একনলা ও ৫টি দোনলা বন্দুক এবং কাঠের তৈরী ডামি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ চলে। পরে নড়াইল ট্রেজারি থেকে উদ্ধারকরা কিছু রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। কলাবাড়িয়া বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ভবনে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়। অস্ত্রসহ পালিয়ে আসা পুলিশ, আনসার ও সেনা সদস্যরাও এদের সঙ্গে যোগ দেন। পরবর্তীতে এ উপজেলা থেকে এডভোকেট বজলুর রহমান, এডভোকেট মোল্লা খবিরউদ্দিন প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ৫নং টালিখোলা ক্যাম্পে গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। কালিয়া উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এডভোকেট খন্দকার আব্দুল হাফিজ এমএনএ, শাহীদ আলী খান এমপিএ, এখলাসউদ্দিন আহমদ (বেন্দা; যশোর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক), সরদার আব্দুস সাত্তার (বড়নাল; শিক্ষক, আইনজীবী ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ৫নং টালিখোলা ক্যাম্পের রাজনৈতিক মোটিভেটর), আব্দুস সালাম (হাড়িভাঙ্গা; কালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি, পরে যশোর সেনানিবাসে পাকসেনাদের হাতে শহীদ), এডভোকেট আবুল কালাম আজাদ (কলাবাড়িয়া; বিশিষ্ট রাজনীতিক, আইনজীবী, পরে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার), বজলুর রহমান (ডুমুরিয়া; আইনজীবী, আওয়ামী লীগের নড়াইল জেলা কমিটির সভাপতি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ৫নং টালিখোলা ক্যাম্পের রাজনৈতিক মোটিভেটর), মোল্লা খবিরউদ্দিন আহমদ (গাছবাড়িয়া; আওয়ামী লীগ নেতা), মানিক শিকদার (কালিয়া সদর; ব্যবসায়ী), শামসুর রহমান (খড়রিয়া; পুলিশ অফিসার), মোল্লা মনিরুজ্জামান (কলাবাড়িয়া; সেনাসদস্য) প্রমুখ।
কালিয়া উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর কোনো প্রাথমিক প্রতিরোধযুদ্ধ হয়নি। তবে এ উপজেলার বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ২৯শে মার্চ যশোরের ঝুমঝুমপুর ইপিআর ক্যাম্পের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
২০শে এপ্রিল পাকবাহিনী কালিয়ায় প্রবেশ করে এবং এপ্রিলের শেষদিকে কালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, তৎসংলগ্ন ডাকবাংলো এবং সরকারি হাসপাতালে ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকবাহিনী কালিয়ায় প্রবেশ করার পর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বিভিন্ন দল গড়ে ওঠে। কালিয়া থানা মুসলিম লীগ-এর সাবেক এমএলএ গাজী আব্দুল লতিফ (বড়নাল), ইউপি চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান (চাঁদপুর), আব্দুল ওয়াদুদ (চাঁদপুর; মুসলিম লীগ নেতা), ইসরাফিল মল্লিক (বড়নাল) প্রমুখের উদ্যোগে এপ্রিল মাসের শেষদিকে গঠিত হয় শান্তি কমিটি ও -রাজাকার বাহিনী। এদের কার্যালয় করা হয় থানার পার্শ্বস্থ রণজিৎ দত্তের দোতলা বাড়ির নিচতলায়। এখান থেকে প্রতিটি ইউনিয়নে শান্তি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়।
শান্তি কমিটি গঠিত হওয়ার পর খুলনা ও গোপালগঞ্জ থেকে পাকসেনারা নিয়মিত কালিয়ায় আসা-যাওয়া করত। ঐ সময় কালিয়ায় বসবাসকারী খলিলুর রহমান হিলালী ছিল অবাঙালি ও সাবেক সেনাসদস্য। সে হানাদার বাহিনীর কাছে মুক্তিবাহিনীর খবর সরবরাহ করত। এপ্রিলের শেষদিকে কলাবাড়িয়া থানা মুক্তিবাহিনী কার্যালয় থেকে এক অভিযান চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। শান্তি কমিটির অন্যতম নেতা খলিলুর রহমানের বাড়ি ঘেরাও করলে সে পালিয়ে যায়।
কালিয়ায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হওয়ার পর তাদের সহায়তায় পাকবাহিনী কালিয়ায় হত্যা, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। ২৪শে এপ্রিল কুলসুর গ্রামে পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনী ভোমবাবু, কেশবলাল ও বিনয়ভূষণ সাহার বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং ঐ এলাকায় ব্যাপক লুটপাট চালায়। ২রা মে জননেতা এখলাসউদ্দিন আহম্মদ, সরদার আব্দুস সাত্তার, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও কালিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুস সালাম (বিলবাউচ) এবং এডভোকেট আবুল কালাম আজাদ ভারতের উদ্দেশে রওনা হন। কালিয়া উপজেলার বনগ্রামে পৌছানোর পর পাকিস্তানপন্থী ইউপি চেয়ারম্যান তবিবর রহমানের প্রচেষ্টায় রাজাকাররা তাঁদের কৌশলে নৌকায় করে চিত্রা নদী দিয়ে নড়াইল ক্যাম্পে নিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু তাঁরা এক পর্যায়ে বিষয়টি বুঝতে পেরে রাজাকারাদের কাবু করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং সাঁতরে পাড়ে ওঠেন। এরপর আব্দুস সালাম ভুলবশত নড়াইলের মুসলিম লীগপন্থী কালা মিয়ার বাড়িতে আশ্রয় নিলে সে তাঁকে রাজাকারদের হাতে ধরিয়ে দেয়। রাজাকাররা তাঁকে ক্যাম্পে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতনের পর যশোর সেনানিবাসে পাঠিয়ে দেয়। পাকবাহিনীর জল্লাদরা আব্দুস সালামকে দিয়ে কবর খুঁড়িয়ে সেই কবরে তাঁকে মাটি চাপা দিয়ে হত্যা করে। এর আগে ৩০শে মার্চ বারোইপাড়ার আবু বকর (আনসার সদস্য) নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা যশোর সেনানিবাসে শহীদ হন। তিনি ২৮শে মার্চ ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচিতে কালিয়া- কলাবাড়িয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন।
মে মাসের প্রথমদিকে উপজেলার উত্তর-পূর্ব পার্শ্বে মধুমতির দক্ষিণ তীরের কয়েকটি গ্রামে পাকবাহিনী হামলা চালায়। একই সময়ে মধুমতির উত্তরপাড়ে গোপালগঞ্জ জেলার কয়েকটি গ্রামেও তারা হামলা করে। ১২ই মে মধুমতির দুই পাড়ের গ্রামের নিরীহ লোকদের ওপর আক্রমণ চালায়। পাখিমারা, সরসপুর, বাগুডাঙ্গা, যোগানিয়া, ডুমুরিয়া, রামপুরা, গাছবাড়িয়া, পুটিমারি, পানিপাড়া, বড়দিয়া, পাটনা প্রভৃতি গ্রামের বহু ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এ-সময় তাদের হাতে ১৩ জন নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়। এ ঘটনা মধুমতি নদীতীর গণহত্যা- নামে পরিচিত।
মে মাসের মাঝামাঝি রাজাকাররা কলাবাড়িয়া গ্রামের দশানি মোল্যাপাড়ার খোকন মোল্যা (পিতা তোফাজ্জল মোল্যা)-কে কালিয়ার নবগঙ্গা নদীতে নামিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
২৮শে মে কালিয়ার শান্তি কমিটির নেতা খলিলুর রহমানের নির্দেশে রাজাকাররা বড় কালিয়ার খ্যাতিমান ফুটবলার নরেন বিশ্বাস, সুরেন বিশ্বাস, বিমল রায় ও কুমুদ (চানপুর)-কে ধরে নিয়ে যায় এবং থানা ক্যাম্পের কাছে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখে। দুপুর বেলা খুলনা থেকে পাকবাহিনী এলে তাদের হাতে ৪ জনকে তুলে দেয়া হয়। পরে তাঁদের লাশ নদীতে ভাসতে দেখা যায়।
১২ই জুলাই কালিয়া সদর থেকে পাকহানাদার ও রাজাকার বাহিনী নবগঙ্গা নদীতীরবর্তী মাধবপাশা ও বিষ্ণুপুর গ্রামে প্রবেশ করে শেখ মনসুরুল হক, রফিউদ্দিন লেন্টু ও আইউব সরদারকে হত্যা করে। ৩রা আগস্ট কলাবাড়িয়া গ্রামেরআব্দুল জলিলের ভাই শহিদ শিকদারকে তেরখাদার রাজাকার বাহিনীর প্রধান শামসুল হক বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে নলিয়া নদীতে ফেলে দেয়।
৩রা সেপ্টেম্বর তেরখাদা থেকে লঞ্চভর্তি পাকহানাদার ও রাজাকাররা কলাবাড়িয়ায় হামলা করে। তারা কলাবাড়িয়া স্কুল মাঠের পূর্বপাশের মাঝিদের ও ছয়ানিপাড়ার গফুর শেখের বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং কালীপদ সরকারের ব্যবসায়িক মালভর্তি নৌকা লুট করে নিয়ে যায়। এ-সময় গোলাগুলিতে পাচু শিকদার (পিতা আবদুল গনি শিকদার) ও ডাক্তার রামচন্দ্র শীল (পিতা ধরণীধর শীল) নামে দুজন গ্রামবাসী শহীদ হন।
কালিয়া উপজেলায় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। তার মধ্যে রণজিৎ দত্ত ভবন রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, খড়রিয়ার যুদ্ধ, বনগ্রামের যুদ্ধ, চোরখালির যুদ্ধ, মহাজনের যুদ্ধ, পাটনা মোড়ের যুদ্ধ এবং কালিয়া থানা যুদ্ধ- উল্লেখযোগ্য। ৯ই জুলাই মোল্লা মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা রণজিৎ দত্ত ভবনে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এ অভিযানে ১১ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে এবং ১৯টি রাইফেল ও কয়েকটি পিস্তল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। খড়রিয়া যুদ্ধ হয় দু-দফায়। ২রা আগস্ট পাকবাহিনী ও রাজাকাররা খড়রিয়া গ্রামে হামলা করে। তারা সেখানে লুটপাট ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এ-খবর পেয়ে কমান্ডার শামসুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে ছুটে যান এবং উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী পিছু হটে নড়াইলে পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে খড়রিয়ার অধিবাসী মোহর মিয়া ও আব্দুল হাকিমের স্ত্রী শহীদ হন। দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় ৮ই নভেম্বর। এ-যুদ্ধেও শত্রুরা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
বনগ্রামের যুদ্ধ হয় আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে। এ- সময় রাজাকার বাহিনী নড়াইল থেকে কালিয়ার চাঁচুড়ি বাজারে গিয়ে গোলাগুলি শুরু করে এবং বাজারে অগ্নিসংযোগ করে। এ সংবাদ পেয়ে খড়রিয়া থেকে আমির হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী চাঁচুড়ির উত্তরদিকে এবং রাজাকারদের নড়াইল ফেরার পথ বনগ্রামে অবস্থান নেয়। বনগ্রাম ব্রিজের কাছে পৌছলে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের আক্রমণ করেন। নৌকায় অবস্থানরত রাজাকাররা পানিতে ঝাঁপ দেয়। রাজাকারদের তিনখানা নৌকা ডুবে যায়, সাত রাজাকার – আত্মসমর্পণ করে এবং অন্যরা মোল্যাডাঙ্গা হয়ে পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধের সংবাদ ও গোলাগুলির শব্দ শুনে সাখাওয়াত হোসেন রানার নেতৃত্বাধীন একটি মুক্তিযোদ্ধা দল ঐ এলাকায় ছুটে যায়। নৌকায় করে পলায়নপর ছয় রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এ-যুদ্ধে আমির হোসেন, জিন্দার আলী খান, হাবিব, নিমাই, অরুণ, তবি দাউদ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা বিশেষ বীরত্বের পরিচয় দেন।
চোরখালির যুদ্ধ হয় ৪ঠা নভেম্বর। কালিয়া উপজেলার বিখ্যাত নদীবন্দর বড়দিয়ায় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নিলে হানাদার বাহিনী কালিয়া থেকে লঞ্চযোগে বড়দিয়া রওনা হয়। পথে চোরখালির চরে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বাধা দেন। উভয় পক্ষে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়। এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা এ-যুদ্ধে মোল্লাহাটের ইদ্রিস নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং আহত হন টোনা গ্রামের লাভলু ও মোল্লাহাটের আব্দুর রাজ্জাক। মহাজনের যুদ্ধ হয় ১৪ই নভেম্বর। এদিন পাকবাহিনী পুনরায় বড়দিয়ায় হামলা করার জন্য লঞ্চযোগে রওনা হলে মহাজন ঘাটে দুপক্ষে যুদ্ধ শুরু হয়। আধঘণ্টাব্যাপী এ-যুদ্ধে শত্রুদের পরাজয় ঘটে। যুদ্ধে মহাজনের একজন কৃষক শহীদ হন এবং কালিয়ার রাজাকার কমান্ডার আব্দুল ওয়াদুদ আহত হয়।
পাটনা মোড়ের যুদ্ধ হয় ১৭ই নভেম্বর। কালিয়া রাজাকার ক্যাম্প থেকে পাকসেনা ও রাজাকাররা তৃতীয়বারের মতো দুটি লঞ্চযোগে বড়দিয়া অভিমুখে রওনা করলে মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর সদস্যরা নবগঙ্গা নদীর দুই তীরে অবস্থান নেন। লঞ্চদুটি পাটনা মোড়ের কাছে পৌছানোমাত্র মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। কিছু সময় গোলাগুলির পর শত্রুরা কালিয়ায় ফিরে যায়।
কালিয়া থানাযুদ্ধ শুরু হয় ৬ই ডিসেম্বর ভোররাতে। কমান্ডার আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে এ-যুদ্ধ চলে ৯ই ডিসেম্বর বিকেল ৪টা পর্যন্ত। এ-সময় পাকহানাদার ও রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করলে কালিয়া শত্রুমুক্ত হয়। যুদ্ধে চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। কালিয়া উপজেলা ৯ই ডিসেম্বর মুক্ত হলেও ১০ই ডিসেম্বর নড়াইল মুক্ত হওয়ায় কালিয়ায়ও ১০ই ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত দিবস পালন করা হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- মো. হাবিবুল আলম, বীর প্রতীক।
কালিয়া উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মুন্সী লায়েক হোসেন (বাবুপুর), মসরুরুল হক (বিষ্ণুপুর), বদিউদ্দিন লেন্টু (পারবিষ্ণুপুর), আইয়ুব সরদার (বিষ্ণুপুর), আবুবকর, লুৎফর রহমান (পাটকেলবাড়ি), ইদ্রিস আলি (মোল্লাহাট), মোহর মিয়া (খড়রিয়া), আব্দুর রশিদ মোল্লা (পারবিষ্ণুপুর), আকমল হোসেন মোল্লা (বাঐসোনা), মহিউদ্দিন মোল্লা (পারবিষ্ণুপুর), ছাদেক হোসেন ছাদু (আইচপাড়া), গাজী আইয়ুব আলী (যোগানিয়া), সৈয়দ ভূঁইয়া (কালীনগর), শুকুর ফকির (বাঐসোনা), কুরায়েদ শিকদার (বাঐসোনা), মোফাজ্জেল মোল্লা (কলাবাড়িয়া), আলতাপ মোল্লা (কলাবাড়িয়া), সৈয়দ খোরশেদ (বাবরা), গোলাম সরোয়ার (বিষ্ণুপুর) এবং জাফর আহমদ (কলিমান)।
কালিয়া উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এখলাসউদ্দিন আহমদের নামানুসারে পৌরসভা মার্কেটের নামকরণ করা হয়েছে এখলাসউদ্দিন মার্কেট। মুক্তিযুদ্ধের আরেক সংগঠক শহীদ আব্দুস সালামের নামানুসারে কালিয়া মহাবিদ্যালয়ের নতুন নামকরণ করা হয়েছে কালিয়া শহীদ আব্দুস সালাম মহাবিদ্যালয়। কুলসুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নতুন নামকরণ করা হয়েছে কুলসুর এখলাসউদ্দিন আহমদ উচ্চ বিদ্যালয়। গাজিরহাট ছিলুমপুরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হামিদুর রহমানের স্মরণে ইউনিয়ন পরিষদের নতুন নামকরণ করা হয়েছে হামিদপুর ইউনিয়ন পরিষদ। এছাড়া কালিয়া ইউনিয়ন ও কলাবাড়িয়া ইউনিয়নের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত নতুন ইউনিয়নের নামকরণ করা হয়েছে সালামাবাদ ইউনিয়ন পরিষদ। [মহসিন হোসাইন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!