You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.06 | কালিয়া থানা যুদ্ধ (কালিয়া, নড়াইল) - সংগ্রামের নোটবুক

কালিয়া থানা যুদ্ধ (কালিয়া, নড়াইল)

কালিয়া থানা যুদ্ধ (কালিয়া, নড়াইল) সংঘটিত হয় ৬ই ডিসেম্বর। নড়াইল জেলার অন্তর্গত এ উপজেলায় সেপ্টেম্বর মাসের দিকে পাকসেনা ও রাজাকারদের তৎপরতা কমে আসে। মুক্তিবাহিনীর ভয়ে তারা যখন-তখন অভিযানে বের হতো না। অন্যদিকে, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিব বাহিনীর যোদ্ধারা বেশ শক্তি সঞ্চয় করে দোর্দণ্ড প্রতাপে এলাকায় বিচরণ করতে থাকেন। কালিয়া থানার প্রশাসনিক কার্যক্রম চলতে থাকে থানা কমান্ডার আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে। এরূপ অবস্থায় কালিয়া মুক্তিবাহিনীর প্রধান কার্যালয় কলাবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ভবনে বসে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কালিয়া থানায় অবস্থিত পাকহানাদার ও রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের ব্যাপারে আলাপ করেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন কালিয়া থানা মুজিব বাহিনীর প্রধান সরদার আবদুল মজিদ, কালিয়া থানা মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ, হারুনুর রশিদ এলএলবি, কলাবাড়িয়া গ্রামের ডা. ইকরামুল হক বাচ্চু, সৈয়দুজ্জামান, শেখ আব্দুল হালিম, শেখ আবদুস সামাদ, শেখ ইমানউদ্দিন, মূলখানা গ্রামের হাবিবুর রহমান শিকদার, খড়রিয়া গ্রামের আশরাফ হোসেন মোল্যা, বাবরার এস এম আবু সাঈদ মিয়া, রামপুরা গ্রামের সহিদুর রহমান চৌধুরী (থানা প্রশাসন কমিটির সেক্রেটারি) এবং ডুমুরিয়া গ্রামের অধিবাসী ও থানা গণবাহিনীর প্রধান ওমর ফারুখ।
৫ই ডিসেম্বর কলাবাড়িয়া মুক্তিযোদ্ধা কার্যালয়ে কমান্ডার আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনিক কমিটির সদস্যরা এক সভায় মিলিত হন। এতে উপস্থিত ছিলেন থানা গণবাহিনী প্রধান ওমর ফারুখ, মুজিব বাহিনী প্রধান সরদার আবদুল মজিদ, শেখ আবদুল হালিম, মোল্যা খায়রুজ্জামান, আবু সাঈদ মিয়া, থানা প্রশাসন কমিটির সেক্রেটারি সহিদুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ৬ই ডিসেম্বর ভোরে কালিয়া থানা ক্যাম্প ঘেরাও করা হবে। এ-খবর পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন ক্যাম্পের কমান্ডারদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণের সমস্ত প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়।
কালিয়া থানায় পাকহানাদার ও রাজাকারদের ক্যাম্পটি ছিল একটি ছোটখাটো সেনানিবাসতুল্য। নবগঙ্গা নদীর তীরে কালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দুটি পাকাভবন, পাশের সরকারি চিকিৎসালয় এবং ডাকবাংলোসহ আরো কিছু এলাকা নিয়ে এর হেডকোয়ার্টার্স ছিল। এখানে সেনাবাহিনী ছাড়াও পাকিস্তানি আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য এবং রাজাকাররাও ছিল। তাদের মোট সংখ্যা ছিল ৩ শতাধিক। রাজাকারদের সাহায্যকারী হিসেবে ছিল শান্তি কমিটির সদস্যরা।
কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ আক্রমণের দিন কোন কমান্ডার তাঁর যোদ্ধাদের নিয়ে কোথায় অবস্থান নেবেন তা নির্দিষ্ট করে দেন। এর আগে বিশ্বস্ত লোক দিয়ে ক্যাম্প রেকি করানো হয়। অপারেশনে ২১ জন কমান্ডার অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা হলেন: তোফাজ্জল বিশ্বাস (খড়রিয়া, খড়রিয়া ক্যাম্প), কামাল বিশ্বাস (ঐ), সেলিম মোল্যা (ঐ), সাহিদুর রহমান (জোঁকা, দলুয়া ক্যাম্প), হেমায়েত মুন্সি (জয়নগর, খাশিয়াল ক্যাম্প), মনিরুজ্জামান মোল্যা (কলাবাড়িয়া, গাজিরহাট ক্যাম্প), মুন্সি কাওছার (টোনা, টোনা ক্যাম্প), মোল্যা নওসের (কলাবাড়িয়া, পাখিমারা ক্যাম্প), নুরু শরিফ (বাঐসোনা, বাঐসোনা ক্যাম্প), মোশাররফ (বড়নাল, মাথাভাঙা ক্যাম্প), সৈয়দ শহর আলী (বড়নাল, মাথাভাঙা ক্যাম্প), শওকত হোসেন (ইসলামপুর, রায়পুর ক্যাম্প), মফিজ মিয়া (চান্দেরচর, শুক্তগ্রাম ক্যাম্প), তবিবর রহমান (ইসলামপুর, ইসলামপুর ক্যাম্প), গোপাল মাতব্বর(মহাজন, মহাজন ক্যাম্প), হামিদ মোল্যা (ছিলুমপুর, গাজিরহাট ক্যাম্প), জিন্দার আলী খান (চন্দ্রপুর, খড়রিয়া। ক্যাম্প), আবদুস সালাম শেখ (চাঁচুড়ি, আটলিয়া ক্যাম্প), ফজর শেখ (ফুলদা, ফুলদা ক্যাম্প), আবদুস সাত্তার বেদুইন (বিষ্ণুপুর, বিষ্ণুপুর ক্যাম্প) এবং আকবর হোসেন (কলাগাছি, কাঠাদুরা ক্যাম্প)। এছাড়া থানা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার সরদার আবদুল মজিদ তাঁর কমান্ডের যোদ্ধাদের ৬ই ডিসেম্বর ভোরে থানা অপারেশনে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেন। রাত ১২টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা বর্তমান কালিয়া কলেজের পূর্বপাশে অবস্থান নেন।
উদয় শংকরের বাড়ি বলে কথিত কালিয়া ডাকবাংলো ছিল পাকহানাদারদের হেডকোয়ার্টার্স। এ ভবনের নিচতলা, দোতলা ও ছাদের ওপর বালুর বস্তা দিয়ে তারা বাংকার তৈরি করেছিল। কালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়সংলগ্ন ডাক্তারখানার নিচে ২০ জন পুলিশ এবং দোতলায় ও ছাদে ৩০ জন পাকিস্তানি সেনা পাহারায় ছিল। বিদ্যালয় ভবনসংলগ্ন মাঠের উত্তর দিকে পূর্ব-পশ্চিমে আড়াআড়ি দীর্ঘ বাংকার ছিল। এ বাংকারে কমপক্ষে অর্ধশত রাজাকার সবসময়ের জন্য পাহারায় থাকত। এছাড়া কালিয়ার সেনগুপ্ত ও দাশগুপ্তদের পুরনো বাড়িগুলোতে আরো অর্ধশত রাজাকার ছিল। বিদ্যালয়ের ছাদে ছিল একশ রাজাকার ও পাকসেনা। ছাদের ওপর ছিল চারটি এলএমজি বসানো। বিদ্যালয় ভবনের পেছনের বারান্দায় বালুর বাঁধ দিয়ে দুটি স্থানে দুটি এলএমজি রাখা হয়েছিল। এছাড়া ক্যাম্পসংলগ্ন নবগঙ্গা নদীর ঘাটে ছিল পাকবাহিনীর গানবোট। সব মিলিয়ে হানাদারদের এ অবস্থান ছিল খুবই শক্তিশালী এবং কৌশলগত দিক থেকে সুবিধাজনক।
৬ই ডিসেম্বর ভোররাতে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প আক্রমণ করেন। কালিয়া থানার পেছনে অবস্থান নেন কমান্ডার মোল্যা মনিরুজ্জামান। তাঁর সঙ্গের যোদ্ধারা হলেন জয়নাল বিশ্বাস, ইশারাত বিশ্বাস, মাকলুকার, টুকু মিয়া, মতলেব চেয়ারম্যান, মজিবর রহমান, হাবিব, মহসিন হোসাইন (কবি) প্রমুখ। এ অবস্থানটি ছিল কালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে। বিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান নেন মুজিব বাহিনীর যোদ্ধারা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শেখ একরাম আলি, এস এম ইকরামুল হক বাচ্চু, জাহাঙ্গীর ফারুখ সেলিম, এস এম দাউদ আলি, মোর্তজা আলি, আবদুল মান্নান শেখ, কবিরুল ইসলাম প্রমুখ। মুজিব বাহিনীর আরেকটি অংশ মোস্তাফিজুর রহমান পল্টু ও তরিকুল আলম মুন্নুর নেতৃত্বে থানা ঘেরাওয়ে অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন থানা মুজিব বাহিনীর প্রধান সরদার আবদুল মজিদ। বিদ্যালয় মাঠের দক্ষিণে অবস্থান নিয়েছিলেন শেখ গোলাম মোস্তফা, দুলদুল মিয়া, আবদুস সাত্তার ফকির, মোল্যা মজিবর রহমান, এ টি এম শামসুজ্জামান, ক্বারী আবু সাঈদ মোল্যা, জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া প্রমুখ। এঁদের পাশে অবস্থান নিয়েছিলেন শরিফ নুরুল হক এবং আকমান হোসেন মোল্যা। এঁদের পাশে আজিজুল মুন্সির নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুল হাই শেখ, আবদুর রহমান, বাসাউদ্দিন, হাসু শিকদার, কবির জমাদ্দার প্রমুখ। ডাকবাংলোর পাশে অর্থাৎ উত্তর-পূর্বদিকে নবগঙ্গার তীর পর্যন্ত জায়গায় অবস্থান নিয়েছিলেন মোশাররফ হোসেন টুকু, মুন্সি হেমায়েত, সৈয়দ শহর আলি, শেখ মফিজুর রহমান, আব্দুর রউফ সরদার, দাউদ আলি বিশ্বাস প্রমুখ। মাঠের দক্ষিণ পাশে গণবাহিনী কমান্ডার ওমর ফারুখের নেতৃত্বে ছিলেন উপ-গণবাহিনী প্রধান সাত্তারুজ্জামান, মো. মজিবর রহমান, আবদুল মান্নান তালুকদার প্রমুখ। আর এঁদের পাশে ছিলেন সাহিদুর রহমানের নেতৃত্বে অন্য মুক্তিযোদ্ধারা। দেবদুন গ্রামের হেমায়েত মুন্সির নেতৃত্বে ওয়ালিউর রহমান, গোলাম রহমান, রতন মোল্যা, মান্নান শেখ প্রমুখও ঘেরাওয়ে অংশ নিয়েছিলেন। নবগঙ্গা নদীর অপর পারে খুলনা থেকে সেনা সরবরাহ ও গানবোট ঠেকাতে টোনার কাওছার মুন্সি তাঁর দল নিয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন।
৬ই ডিসেম্বর ভোর থেকে যুদ্ধ শুরু হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে- সঙ্গে গোলাগুলির প্রচণ্ডতাও বাড়তে থাকে। দুই পক্ষেই সমানে গোলাগুলি চলে। কিন্তু এক পর্যায়ে পাকহানাদার ও রাজাকারদের মনোবল ভেঙে পড়ে। নবগঙ্গার ঘাটে পাকসেনাদের যে গানবোটটি ছিল, সেটি রাতের আঁধারে ঢাকার পথে পালিয়ে যায়; সঙ্গে নিয়ে যায় স্থানীয় কয়েকজন রাজাকার ও শান্তি কমিটির নেতাকে। এরূপ পরিস্থিতিতে রাজাকারদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ একজন হানাদারদের দিকে গুলি ছুঁড়লে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। এসময় মুজিব বাহিনীর শেখ আকরাম, আব্দুল মান্নান, মোক্তার হোসেন ও দবিরউদ্দিন হানাদারদের হাতে বন্দি হন। হানাদারদের গুলিতে আহত হন মুক্তিযোদ্ধা আবুবকর। গোপালগঞ্জে চিকিৎসার জন্য নেয়ার পথে ৯ই ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।
পাকহানাদারদের মনোবল ভেঙে গেলেও তারা বন্দি মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তি দিতে সম্মত হয়নি। বিকেল নাগাদ মনিরুজ্জামান, ওমর ফারুখ ও লুৎফর রহমান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নিচতলায় প্রবেশ করে বন্দি মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্ত করেন। ৯ই ডিসেম্বর বিকেল ৩টা নাগাদ আত্মসমর্পণ করার জন্য পাকহানাদার ও রাজাকাররা অস্ত্র ফেলে থানার পূর্বদিকে লাইন দিয়ে দাঁড়ায় এবং মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বন্দি করেন। হাজার হাজার জনতা এসময় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তোলে। বিকেল ৫টার দিকে হানাদার বাহিনীর হেডকোয়ার্টার্সে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়। শতশত মুক্তিযোদ্ধা পরিবেষ্টিত হয়ে কালিয়া থানা প্রশাসক ও কালিয়া থানা মুক্তিবাহিনীর প্রধান আবুল কালাম আজাদ পতাকা ওড়ান। আত্মসমর্পণের পর ১৮ জন পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও দুশতাধিক রাজাকারকে কলাবাড়িয়ায় বন্দি করে রাখা হয়। অনেক রাজাকার ও পাকমিলিশিয়া পালিয়ে যায়। নিহত হয় বেশ কয়েকজন রাজাকার ও দুজন পাকিস্তানি মিলিশিয়া সদস্য। স্বাধীনতার পর মিলিশিয়াদের খুলনায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। গুরুতর অপরাধী রাজাকারদের নড়াইল কারাগারে বন্দি করে রাখা হয় এবং অন্যদের মুক্তি দেয়া হয়।
কালিয়া থানা যুদ্ধে পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে একজন মুজিব বাহিনী এবং বাকি চারজন মুক্তিবাহিনীর সদস্য। তাঁরা হলেন- আবু বকর সেখ (নোয়াগ্রাম), আকমান মোল্যা (পিতা রাহেনউদ্দিন, বাঐসোনা), ছাদু মল্লিক (পিতা সায়েদ মল্লিক, আইচপাড়া), লুৎফর রহমান মোল্যা (পিতা লবণ মোল্যা, পাটকেলবাড়ি) এবং আইয়ুব আলী গাজী (সরসপুর)।
কালিয়া উপজেলা ৯ই ডিসেম্বর মুক্ত হলেও যেহেতু নড়াইল হানাদারমুক্ত হয় ১০ই ডিসেম্বর, সেহেতু ১০ই ডিসেম্বরকেই কালিয়া মুক্তদিবস হিসেবে পালিত হয়। [মহসিন হোসাইন]
তথ্যসূত্র: মহসিন হোসাইন, মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস : কালিয়া উপজেলা, ঢাকা ১৯৮৫; আসাদুজ্জামান আসাদ (সম্পাদিত), মুক্তিযুদ্ধে যশোর, ঢাকা ১৯৯৪; মহসিন হোসাইন (সম্পাদিত), নড়াইল জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ঢাকা ২০০৯

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড