You dont have javascript enabled! Please enable it!

কামালপুর ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম অভিযান (বকশীগঞ্জ, জামালপুর)

কামালপুর ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম অভিযান (বকশীগঞ্জ, জামালপুর) ৩১শে জুলাই পরিচালিত হয়। এতে প্রায় ২শ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজসহ ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা এখানে শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধের উত্তর রণাঙ্গনে কামালপুর ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুরুত্বপুর্ণ ও দুর্ভেদ্য ডিফেন্স। সেখানে ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আহসান মালিকের নেতৃত্বে এক কোম্পানি সৈন্য ছিল। তাদের সহায়তার জন্য ছিল পাকিস্তানি রেঞ্জার ও মিলিশিয়াদের দুটি কোম্পানি। এছাড়া ছিল শতাধিক রাজাকার। তাদের এ গুরুত্বপূর্ণ ডিফেন্সের তত্ত্বাবধানে আর্টিলারিসহ বকশীগঞ্জে অবস্থান করছিল ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মেজর আইয়ুব।
উত্তর সীমান্তে বান রোডের অভ্যন্তরে এবং পূর্ব ও পশ্চিম দিকের সড়ক দ্বারা পরিবেষ্টিত তাদের কামালপুর দুর্গ অত্যন্ত সুরক্ষিত ছিল। এ দুর্গের চারদিক ছিল পরপর কয়েকটি স্তরে মোটা গাছের গুঁড়ি, ১ থেকে ৬ ফুট ব্যবধানে ভারী লোহার বিম এবং প্রতিটি স্তরে রি-ইনফোর্সড কংক্রিট বেরিয়ার, যা যেকোনো গোলার আঘাত প্রতিহত করার উপযোগী ছিল। বাংকারের ওপরের আবরণ ছিল কয়েক স্তরে (লগ, বালুর বস্তা, কংক্রিট) সাজানো। বাংকারগুলোতে সুরঙ্গ পথে যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল। এসব বাংকার যুদ্ধবিমান থেকে বাংকার ব্লাস্টার বা রকেট লাঞ্চার ছাড়া ধ্বংস করা সম্ভব ছিল না। এর চারদিকে এন্টি-ট্যাংক মাইন, ব্যুবি ট্র্যাপ এবং এন্টি-পারসোনাল মাইন স্থাপিত ছিল। এছাড়া ছিল কাঁটাতারের বেড়া। এ ঘাঁটিতে ৩টি ৮১ মিমি মর্টার ও তাদের সহায়তা দানের জন্য বকশীগঞ্জে স্থাপন করা হয়েছিল একটি ১২০ মিমি মর্টার ব্যাটারি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কামালপুর ঘাঁটিতে স্থল ও আকাশপথে নিয়মিত রেশন সরবরাহ ও লোকবল রিপ্লেসমেন্টের ব্যবস্থা রেখেছিল। এছাড়া পাকসেনারা বান রোডের উত্তর প্রান্ত বরাবর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ পথে অসংখ্য এন্টি-পার্সোনাল মাইন এবং সুঁচালো বাঁশের কঞ্চি স্থাপন করে নিজেদের অবস্থান আরো সুসংহত করেছিল।
এপ্রিলের শেষনা গাদ জামালপুরের মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেন্দ্রগঞ্জে অবস্থান নেন এবং সেখানে ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে ওঠে। প্রথমদিকে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ছোট-ছোট আক্রমণ করে ফিরে যেতেন। এসব আক্রমণ ছিল বিক্ষিপ্ত এবং এগুলোর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি বাহিনীকে যথাসম্ভব ক্ষতিগ্রস্ত করে ব্যতিব্যস্ত করে রাখা। ভারতের মাটিতে মহেন্দ্রগঞ্জ ছিল কামালপুর ঘাঁটির সবচেয়ে নিকটবর্তী। এজন্য মুক্তিযোদ্ধারা এ ক্যাম্প থেকেই কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণের পরিকল্পনা করেন।
মুজিবনগর সরকার-এর আদেশে জুলাইয়ের শেষনাগাদ ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কামালপুর ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। ব্যাটালিয়ন কমান্ডার মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী আক্রমণে নেতৃত্ব দেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন ৪টি কোম্পানি আক্রমণে অংশ নেয়। এখানকার এ, বি, সি ও ডি কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন, ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ ও লে. এম এ মান্নান। পরে সি ও ডি কোম্পানির কমান্ডার হন যথাক্রমে ক্যাপ্টেন আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন বজলুল গণি পাটোয়ারী।
এ অভিযানের পূর্বে ২৮শে জুলাই রাতে সি কোম্পানির কমান্ডার ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ, লে. আব্দুল মান্নান, সুবেদার হাসিম ও নায়েক সুবেদার সফিক কিছু সৈনিক নিয়ে কামালপুর পাকিস্তানি ডিফেন্স রেকি করতে যান। গভীর রাতের অন্ধকারে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিনের রেকি দল বান রোড অতিক্রম করতে গিয়ে শত্রুসেনাদের থার্ডলাইন বাংকারের ওপরে পৌঁছে একজন শত্রুসেনার সঙ্গে ধাক্কা খায়। এ অবস্থায় শত্রুসেনার সঙ্গে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিনের হাতাহাতি হয়। ধ্বস্তাধস্তিতে পরাজিত হয়ে পাকসেনারা ২টি রাইফেল ফেলে অন্ধকারে পালিয়ে যায়। ২টি জি-থ্রি রাইফেল নিয়ে ক্যাপেটন সালাহউদ্দিন দলসহ মহেন্দ্রগঞ্জে ফিরে যান। ৩০শে জুলাই গভীর রাতে অর্থাৎ ৩১শে জুলাই ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট কামালপুর দুর্গ আক্রমণ করে। এ- যুদ্ধের সার্বিক পরিচালনায় ছিলেন কমান্ডিং অফিসার মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, এটাক পার্টির দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ ও লেফটেন্যান্ট মান্নানের নেতৃত্বাধীন ডি কোম্পানি। ফলোআপ পার্টিতে ছিল ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বাধীন বি কোম্পানি এবং বকশীগঞ্জ- কামালপুর রোডে কাটআপ পার্টির দায়িত্বে ছিল ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে এ কোম্পানি। ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড-ইন- কমান্ড ক্যাপ্টেন বজলুল গণি পাটোয়ারী আর্টিলারি সমন্বয় সাধনের দায়িত্বে হাইডআউট অবস্থানে ছিলেন। ভারতীয় ৯৫ মাউন্ট ব্রিগেডের কয়েকটি সেকশন এ-যুদ্ধে আর্টিলারি সহায়তা দানের জন্য ১২০ মিমি কামান ও ৬ ইঞ্চি মর্টারসহ বামুনপাড়ায় মোতায়েন ছিল।
মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে কামালপুরের পার্শ্ববর্তী মুক্তিবাহিনীর এফইউপি (FUP) পর্যন্ত পৌঁছতে মাঝপথে প্রায় ১ কিলোমিটার জলাভূমি অতিক্রম করে যেতে হয়। এছাড়া অন্ধকারে দুর্গম পথে শত্রুর মাইনফিল্ড এড়িয়ে নির্দিষ্ট সময়ে কোম্পানির ৩টি অকুস্থলে পৌঁছতে কিছুটা বিলম্ব হয়। এর মধ্যে অগ্রবর্তী দলের সংকেত ছাড়াই এটাক ‘এইচ আওয়ার’ মোতাবেক মিত্রবাহিনী-র ভারী আর্টিলারির গোলাবর্ষণ শুরু হয়। অপরপক্ষে পাকবাহিনীও পাল্টা গোলাবর্ষণ শুরু করে। এতে আক্রমণকরী মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন দলের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। এতদ্সত্ত্বেও নতুন ছকে আক্রমণ পরিচালনা করে ডি-কোম্পানির কমান্ডার ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন শত্রুর থার্ড লাইন ও সেকেন্ড লাইন বাংকারগুলো দখল করতে সমর্থ হন। তিনি বীর বিক্রমে অগ্রসর হয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে কামালপুর দুর্গের এসেমব্লি এরিয়াতে প্রায় ঢুকে পড়ছিলেন। তিনি যখন শত্রুসৈন্যদের বারবার আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ শত্রুর নিক্ষিপ্ত গোলার আঘাতে তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে যায়। তাঁর মরদেহ উদ্ধার করতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন লেফটেন্যান্ট মান্নান। শত্রুর একটি বুলেট তাঁর উরুর এক পাশ দিয়ে ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এফএফ কমান্ডার আব্দুল বাতিন নিজে আহত হয়েও লেফটেন্যান্ট মান্নানকে পশ্চাদপসরণে সহায়তা করেন। অপরদিক দিয়ে দৌড়ে এগুচ্ছিলেন ফলোআপ পার্টির কমান্ডার ক্যাপ্টেন হাফিজ। শত্রুর গোলার আঘাতে তাঁর হাতের স্টেনগান বিচূর্ণ হয়ে যায় এবং তিনি নিজেও আহত হন। ওয়ারলেস জ্যাম হয়ে যাওয়ায় ব্যাটালিয়ন কমান্ডার যুদ্ধে লিপ্ত অগ্রবর্তী দলসমূহের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হন। ফলে সেদিনের মতো কামালপুর অভিযান অসমাপ্ত রেখেই মেজর মইন স্বীয় বাহিনীকে পশ্চাদপসরণ করতে আদেশ দেন।
এদিনের যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব না হলেও মুক্তিবাহিনীর রণনৈপুণ্য, বীরত্ব, মনোবল ও ক্ষিপ্রতায় এবং পাকসেনাদের হতাহতের ব্যাপকতায় সার্বিকভাবে শত্রুপক্ষের মনোবল ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়ে। এতে মুক্তিবাহিনী- নৈতিকভাবে বিজয়ী হয়। ৩১শে জুলাই কামালপুর যুদ্ধে নিহত পাকিস্তানি সেনাদের লাশ পরিবহনে ৩টি ট্রাকের প্রয়োজন হয়েছিল। স্থানীয় গ্রামবাসীরা পাকিস্তানি ইউনিফর্ম পরিহিত শতাধিক মৃতদেহ ট্রাকে উঠিয়ে নিতে দেখেন। পক্ষান্তরে মুক্তিবাহিনীর ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজসহ ৩৫ জন শহীদ হন। ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ, আহাদুজ্জামান ও আবুল কালাম আজাদের লাশ পাকবাহিনী বকশীগঞ্জ হাইস্কুল মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে মাটিচাপা দেয়। বাকি ৩২ জন মুক্তিযোদ্ধার লাশ ধানুয়া চেয়ারম্যান বাড়ির পশ্চিম দিকের রাস্তার পাশের জমিতে সমাহিত করা হয়। [সৈয়দ আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!