কামালপুর যুদ্ধ (বকশীগঞ্জ, জামালপুর)
কামালপুর যুদ্ধ (বকশীগঞ্জ, জামালপুর) সংঘটিত হয় ১০ই সেপ্টেম্বর, ৬, ১৩ ও ১৪ই নভেম্বর। প্রথম যুদ্ধে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং পাকসেনারা পিছু হটে। দ্বিতীয় যুদ্ধেও পাকসেনারা পিছু হটে। তৃতীয় যুদ্ধে পাকবাহিনীর ৪টি ১২০ মিমি মর্টার, ৬টি গাড়ি ও বহুসংখ্যক সৈন্য হতাহত হয়।
১০ই সেপ্টেম্বর বেলা আড়াইটার সময় মুক্তিযোদ্ধারা মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প থেকে এসে পাকিস্তানিদের কামালপুর ঘাঁটিতে আক্রমণ করেন। প্রায় দুই কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা এ আক্রমণে অংশ নেন। তাঁরা খাসীর গ্রামের দিকে অগ্রসর হন। প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানির কিছু মুক্তিযোদ্ধা উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌছার পূর্বেই গুলিবর্ষণ শুরু করেন। পাকিস্তানিরা ঐ গুলি উপেক্ষা করে নানা আগ্নেয়াস্ত্রসহ বেপরোয়াভাবে এগুতে থাকে। তারপর তারা পাল্টা গুলি করে। এতে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন নায়েক সুবেদার ও একজন জওয়ান শহীদ হন। সে-সময় বকশীগঞ্জ থেকে পাকিস্তানিদের অন্য একটি দল আক্রমণ করতে আসছে এ সংবাদ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং অনেকে নিজ অবস্থান থেকে সরে যান। এ-সময় ধানুয়া-কামালপুরের দিক থেকে একদল মুক্তিযোদ্ধা আসেন। তাঁদের হাতে একটি এলএমজি ছিল। এ এলএমজির গুলিতে অনেক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় এবং শেষ পর্যন্ত তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। যে মুক্তিযোদ্ধা এলএমজি চালাচ্ছিলেন তিনি উত্তেজনাবশত এলএমজির ব্যারেল বাম হাতে চেপে ধরে রাখেন। এতে তাঁর হাতের তালু সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। অনেক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হওয়া এবং পাকসেনাদের হটিয়ে দেয়ার কৃতিত্ব এ সাহসী মুক্তিযোদ্ধার। সন্ধ্যার পর ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী তাঁর নেতৃত্বাধীন কোম্পানিকে পূর্ব স্থানে ফিরিয়ে আনেন। এ-যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও আত্মনির্ভরতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওড় অঞ্চল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আসে।
৬ই নভেম্বর বিকেলে বকশীগঞ্জ থেকে গোলাবারুদ ভর্তি একটি ট্রাকের সঙ্গে মার্চ করে পাকসেনারা কামালপুরের দিকে অগ্রসর হয়। ভারতীয় মেজর জওহর সিংহের নেতৃত্বে এক কোম্পানি (২০০ জন) সৈন্যসহ ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা আগে থেকে রাস্তার পূর্ব পাশে গেদরা ও পশ্চিমে ভাটিয়া পাড়ায় এম্বুশে ছিলেন। পাকসেনাদের ট্রাক উঠান পাড়া ব্রিজের সামান্য দূরে যাওয়া মাত্র যৌথ কমান্ডের জওয়ানরা
দুপাশে থেকে রকেট লাঞ্চার ও মেশিনগানের গোলাবর্ষণ করেন। মুহূর্তের মধ্যে ট্রাকে আগুন লেগে তা ধ্বংস হয়। এ-সময় বকশীগঞ্জ পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে পাকসেনারা রকেট লাঞ্চার ও শেলিং করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা পাল্টা আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবর্ষণে পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরদিন সকালে কুখ্যাত আলবদর- সদস্য ইছার লাশ রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা বশীর আহমদ, মিজানুর রহমান মিঠু, ওসমান গণি, রিয়াজুল প্রমুখ বীরত্বের পরিচয় দেন। ১৩ই নভেম্বর যুদ্ধে কর্নেল আবু তাহের পাকসেনাদের ছোঁড়া শেলের আঘাতে তাঁর একটি পা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
১৪ই নভেম্বর বকশীগঞ্জ-কামালপুর সড়কে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এক যুদ্ধ হয়। সেদিন বকশীগঞ্জ ক্যাম্প থেকে ৬ ট্রাক গোলাবারুদ নিয়ে পাকসেনারা কামালপুর ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। বাট্টাজোড় কালা শিমুল গাছের আশেপাশে এম্বুশে ছিলেন একদল মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা আগে থেকেই রাস্তায় মাইন পুঁতে রেখেছিলেন। পাকসেনাদের ট্রাক কালা শিমুল গাছের নিচে আসামাত্র মাইনের বিস্ফোরণ ঘটে। এতে পাকবাহিনীর ৪টি ১২০ মিমি মর্টার, ৬টি গাড়ি ও বহুসংখ্যক সৈন্য হতাহত হয়। এ অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হক, হারুন-উর- রশিদ, জালাল উদ্দিন, আ. ছামাদ, আব্দুল আলী, হুরমুজ আলী, জহুরুল হক মুন্সী প্রমুখ অংশ নেন। [রজব বকশী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড