You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে কালকিনি উপজেলা (মাদারীপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে কালকিনি উপজেলা (মাদারীপুর)

কালকিনি উপজেলা (মাদারীপুর) মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার অন্তর্গত একটি থানা। ১৯৮৪ সালে এটি উপজেলার মর্যাদা পায়। সত্তরের নির্বাচন এবং নির্বাচনোত্তর আন্দোলন-সংগ্রামে মাদারীপুর জেলার অন্যান্য উপজেলার মতো এ উপজেলার জনগণও প্রচণ্ড উৎসাহে অংশগ্রহণ করে। কালকিনি সদরসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের সর্বস্তরের জনগণ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে -অসহযোগ আন্দোলন-এর কর্মসূচি সর্বৈবভাবে পালন করে। উজেলার সর্বত্র স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত বন্ধ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর মুক্তিযুদ্ধের আগাম প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ৮ই মার্চ কালকিনি থানার সাবরেজিস্ট্রার সিরাজুল হক কালকিনি পাইলট হাইস্কুল মাঠে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। পরের দিন ৯ই মার্চ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আসাদুজ্জামান রাঢ়ীর নেতৃত্বে এবং আবদুর রাজ্জাক মোল্লা, আবুল খায়ের, মোহাম্মদ আমির হোসেন, এ বি এম হাবিবুর রহমান, নজরুল ইসলাম, লিয়াকত হোসেন, আবদুল আজিজ সরদার প্রমুখের সহায়তায় সাহেবরামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠেও স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ-সময় ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি পরিবেশন করা হয়। একইদিন এডভোকেট আদেল উদ্দিন আহমেদ এমএনএ-র ভ্রাতুষ্পুত্র আলী আহসান আলো হাজার-হাজার জনতার সামনে ফাসিয়াতলা সংগ্রাম কমিটির কার্যালয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ১১ই মার্চ আবদুল কাদের হাওলাদার ও আবদুর রহমান হাওলাদার স্থানীয় যুবসম্প্রদায় এবং জনতাকে নিয়ে ডিক্রিরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ১৩ই মার্চ এডভোকেট এম এ কাদেরকে সভাপতি এবং আবদুল আজিজ সরদারকে সেক্রেটারি করে ৪১ সদস্যবিশিষ্ট কালকিনি থানা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন- ডা. লুৎফর রহমান খান, সিরাজুল হক বেপারী, আবদুল মান্নান বেপারী, আবুল খায়ের সরদার, যতীন্দ্রনাথ বাড়ৈ, গণেশ চন্দ্র বিশ্বাস, জিল্লুর রহমান, সিরাজুল হক সরদার, আবদুল খালেক বিএসসি, লতিফ মুন্সী, সেকেন্দার হাওলাদার, পান্না বেপারী, খালেক সরদার, মতিউর রহমান, মজিবর রহমান হাওলাদার প্রমুখ। সাহেবরামপুরেও একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন আবুল খায়ের সরদার (মাস্টার) এবং সদস্য ছিলেন আসাদুজ্জামান রাঢ়ী, আওলাদ মাস্টার, মোসলেম উদ্দিন সরদার, আবুল কালাম সরদার, আলতাফ সরদার প্রমুখ। ২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনীর বর্বর অপারেশন সার্চলাইট-এর পর ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁর নির্দেশে সারাদেশে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। কালকিনির মানুষও সে-যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
কালকিনিতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য সেনাবাহিনীর সুবেদার সিরাজুল হক শিকদারের নেতৃত্বে একটি সামরিক সেল গঠন করা হয়। এর সদস্য ছিলেন মুন্সী আবদুল জব্বার, আবদুল খালেক, নুরুল হক কবিরাজ, খালেক কাজী প্রমুখ। এঁরা সকলে ছিলেন সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদস্য। কালকিনি থানার ওসি চন্দ্রশেখর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য দুটি রাইফেল দেন। এই সেলের তত্ত্বাবধানে এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্যোগে থানার বিভিন্ন এলাকায় ছুটিতে আসা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিক, ইপিআর, আনসার ও পুলিশ সদস্য এবং অন্যান্য অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সহযোগিতায় ছাত্র- যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু হয়। প্রথমে কালকিনি পাইলট হাইস্কুল মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। স্কুলের শরীর চর্চার শিক্ষক সন্তোষ মাস্টার প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে এখানে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন সাহেবরামপুর নিবাসী সিরাজ উদ্দিন (লাহোরের মুলতানে কর্মরত আর্মির করণিক, ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলেন), নৌবাহিনীর সদস্য আবদুল মান্নান, মতিউর রহমান শরিফ, মোবারক হোসেন সরদার এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক মো. কামাল উদ্দিন। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্ব দেন কালকিনি ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি আবদুল সরদার, স্কুলের শিক্ষক আবদুল খালেক, আবদুল আজিজ, প্রফুল্ল কুমার পাল, অনিল মাস্টার, আবদুর রহিম মাস্টার, মোসলেম উদ্দিন, সাংবাদিক মজিবর রহমান হাওলাদার, মিজানুর রহমান মাস্টার, সতীশ ঠাকুর প্রমুখ।
এরপর সাহেবরামপুর হাইস্কুল মাঠ, কালিনগর হাইস্কুল মাঠ, খাসেরহাট, ডিগ্রিরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ, শশিকর হাইস্কুল মাঠ এবং নবগ্রাম হাইস্কুল মাঠেও প্রশিক্ষণ চলে। সাহেবরামপুর হাইস্কুল মাঠ কেন্দ্রে প্রশিক্ষক ছিলেন পাকিস্তান নৌবাহিনীর সৈনিক মন্নান মাল, সেনাবাহিনীর কামাল বেপারী ও সিরাজ উদ্দিন শরিফ। প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগ নেতা আবুল খায়ের সরদার (মাস্টার)। এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন ইব্রাহিম সরদার, আবদুল মালেক, সুলতান আহমেদ বেপারী, জাফর, সিরাজ, গিয়াসউদ্দিন (কমান্ডার), মিয়াজ উদ্দিন খানসহ প্রায় ৬০-৭০ জন ছাত্র-যুবক।
কালিনগর হাইস্কুল মাঠে প্রশিক্ষক ছিলেন আবদুল মালেক সরদার, অনিল পাল (শিক্ষক) ও শাহজাহান হাওলাদার। এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন আলী হাসান, আলম, ফরিদ আহমেদ মন্টু, এস্কান্দার সরদার, আলাউদ্দিন, খোকন, আনোয়ার বেপারী, নুরুল হক সরদার, চানমিয়া সরদার, ইউনুস সরদার প্রমুখ।
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর মো. মতিউর রহমান এমপিএ তাঁর উত্তর ছয়গাঁও গ্রামের বাড়িতে এসে স্থানীয় যুবকদের নিয়ে খাসেরহাট চত্বরে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করেন। এখানে ৪০-৫০ জন যুবককে বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষক ছিলেন আবদুল হামিদ কমান্ডার (অনসার), পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারি কোরের সৈনিক সিরাজ সিকদার ও মো. সিকিম আলী বেপারী। প্রশিক্ষণ শুরুর পূর্বে স্থানীয় বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা হযরত আলী খান, কাছির আহমেদ খান, আবদুল মান্নান খান, আলী আশ্রাফ বেপারী, সামসুদ্দিন খানসহ শতশত জনতার উপস্থিতিতে মো. মতিউর রহমান এমপিএ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এ-সময় ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি পরিবেশন করেন শিল্পী মোক্তেম হোসেন।
ডিগ্রিরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে প্রশিক্ষক ছিলেন ইপিআর সদস্য মহিষমারী গ্রামের আবুল কালাম বাশার। প্রশিক্ষণ শুরুর প্রাক্কালে আবদুর রহমান হাওলাদার স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
কালকিনি উপজেলার পশ্চিম প্রান্তে শশিকর হাইস্কুল মাঠ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রশিক্ষণ দেন শশিকর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ব্রজেন্দ্রনাথ বিশ্বাস এবং শশিকর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সতীশ চন্দ্র তালুকদার। এঁরা দুজনেই ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন নিরঞ্জন মিস্ত্রী, দুলাল সরকার, অমল কৃষ্ণ বাড়ৈ, প্রিয়লাল সরকার, বিজয় সরকার, সত্যরঞ্জন বল, নীহার রঞ্জন ভৌমিক, মনতোষ বাড়ৈ, ত্রৈলোক্যনাথ হালদার, মৃতুঞ্জয় বিশ্বাস, বীরেন্দ্রনাথ সরকার, সত্যরঞ্জন বিশ্বাস, যতীন্দ্রনাথ বিশ্বাস প্রমুখ। পরে এঁদের অনেকেই ভারতে গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন। স্থানীয় লোকজন তীর-ধনুক, লেজা, সড়কি, বল্লম প্রভৃতি দেশীয় অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়। ২৫শে মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর দেশব্যাপী প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হলে নবগ্রাম হাইস্কুল মাঠে তরণীকান্ত সরকার (শশিকর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক), লক্ষ্মীকান্ত বল (শশিকর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক), সিদ্ধেশ্বর সরকার, যতীন্দ্ৰনাথ বাড়ৈ, রাজেন্দ্রনাথ সরকার প্রমুখের উদ্যোগে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এখানে প্রশিক্ষক ছিলেন পুলিশ বিভাগের কর্মী আনোয়ার হোসেন। এখানে প্রায় ৫০ জন ছাত্র-যুবক প্রশিক্ষণ নেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন অনিল চন্দ্র মল্লিক, বিরাট চন্দ্র বাইন, রাজ্যেশ্বর বৈদ্য, চিত্ত রঞ্জন বল, গোকুল চন্দ্র বিশ্বাস, গুণধর বৈদ্য, বিজয় কৃষ্ণ মুন্সী, অনিল তালুকদার, অনিল চন্দ্ৰ বাড়ৈ, ধীরেন্দ্রনাথ বাড়ৈ, রাজ্যেশ্বর জয়ধর, গদাধর বিশ্বাস, মাখন লাল জয়ধর, অখিল চন্দ্র মণ্ডল, বিভূতিভূষণ মণ্ডল, সুভাষ চন্দ্ৰ হাওলদার, রমেশ চন্দ্র তালুকদার, ধীরেন্দ্রনাথ ভক্ত প্রমুখ। পরে যতীন্দ্রনাথ বাড়ৈসহ এঁদের অনেকে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁর চাঁদপাড়া ক্যাম্পে গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন। স্থানীয়ভাবে প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর কালকিনি উপজেলার বহু মুক্তিযোদ্ধা উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান। ১৭ই এপ্রিল স্টুয়ার্ড মুজিবের নেতৃত্বে মাদারীপুরের প্রথম যে দলটি ভারতে যায়, তার সঙ্গে কালকিনির ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁরা হলেন- আব্দুল মালেক, মো. ফারুক হোসেন, গোলাম ফারুক, আবু জাফর প্রমুখ। মে মাসের শেষদিকে এম এ রহমানের নেতৃত্বে আবদুল হাই, মালেক ও সিরাজুল হকসহ ২০ জনের একটি দল ভারতে যায়। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আব্দুল হাকিম তালুকদারের নেতৃত্বে আনোয়ার হোসেন, সেকেন্দার তালুকদার, আবদুল জলিল তালুকদার প্রমুখ ১০ জন ভারতে যান। ১২ই জুলাই আবদুল মালেক সরদারের নেতৃত্বে আজিজুর রহমান, এস্কেন্দার আলী সরদার, আবদুল হামিদ বাবুল, মোস্তাফিজুর রহমান আক্কাস প্রমুখ ৩২ জন ভারতে যান। এরপর মিয়াজ উদ্দিন খানের নেতৃত্বে ২৬ জন, এস্কান্দার আলী শিকদারের নেতৃত্বে ২১ জন এবং মিয়া আবদুর রহিমের নেতৃত্বে ৩০ জন ভারতে যান। এভাবে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত কয়েকশ ছাত্র-যুবক কালকিনির বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান। তাঁরা বনগাঁর চাঁদপাড়া, বিহারের চাকুলিয়া ও বেলফুলিয়াসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। শশিকর গ্রামের ত্রৈলোক্যনাথ হালদার, নীহার রঞ্জন ভৌমিক, হীরালাল গুপ্ত, রাজ্যেশ্বর মিস্ত্রী, নিরঞ্জন মিস্ত্রী, মৃত্যুঞ্জয় বাড়ৈ, সুধীর কুমার মিস্ত্রী, মনোজ কুমার রায়, পঙ্কজ কুমার রায়, মনতোষ বাড়ৈ, সুশীল কুমার রায়, অরুণ কুমার বৈদ্য, প্রিয়লাল রায়, সহদেব সরকার, শঙ্কর তালুকদার, দুলাল সরকার, অমল কৃষ্ণ বাড়ৈ, অনুকূল বিশ্বাস, নীলরতন হালদার, নারায়ণ হালদার প্রমুখ পশ্চিমবঙ্গের চাঁদপাড়া (বনগাঁ) এবং বীরভূম ও বিহারের সীমান্ত এলাকায় প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণের পর মুক্তিযোদ্ধারা কল্যাণীর ইনডাকশন ক্যাম্পে আসেন। সেখান থেকে প্রত্যেক কমান্ডার এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। মো. জালাল উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে কালকিনি থানায় মুজিব বাহিনীর একটি দল প্রবেশ করে। তিনি ছিলেন মুজিব বাহিনীর কালকিনি থানা কমান্ডার।
কালকিনি উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন এডভোকেট আব্দুল কাদের (কালকিনি পৌরসভা), আব্দুল আজিজ সরদার (ঐ), সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ (গোপালপুর), সুশীল চন্দ্র সরকার (ঐ), কাসিজদ্দিন মাতুব্বর (ঐ), আবুল হোসেন বেপারী (ডাসার), অতুল কৃষ্ণ বাড়ৈ (ঐ, শশিকর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক), মাজেদ তালুকদার (ডাসার), সূর্যকুমার বিশ্বাস (শশিকর, শশিকর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক), সুরেন্দ্রনাথ ভৌমিক (ডাসার ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য ও সমাজসেবক), জ্ঞানেন্দ্রনাথ হালদার (শশিকর, শিক্ষক ও সমাজসেবক), তরণীকান্ত সরকার (শশিকর, শশিকর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক), উদয় কুমার রায় (শশিকর, সমাজসেবক), যতীন্দ্রনাথ হালদার (শশিকর, শশিকর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক), নলিনী সরকার (নবগ্রাম), আব্দুল মোতালেব তালুকদার (কাজী বাকাই), বিশাই তালুকদার (ঐ), মোহাম্মদ আলী মুন্সী (ঐ), আউয়াল মাস্টার (বালিগ্রাম), কলিমুল্লাহ খান (ঐ), গোলাপ খান (ঐ), হাসেম সরদার (আলীনগর), আব্দুল মান্নান শরীফ (ঐ), জাবেদ আলী হাওলাদার (ঐ), ওয়াহেদ আলী মুহুরী (লক্ষ্মীপুর), সেকেন্দার আলী মোল্লা (ঐ), আব্দুল হামিদ খান (এনায়েতনগর), বসির বেপারী (ঐ), হাকিম সরদার (ঐ), মাস্টার হযরত আলী খান (বাঁশগাড়ী), কাঞ্চন তালুকদার (ঐ), সিদ্দিক তালুকদার (ঐ), সাহেবালী সরদার (শিকারমঙ্গল), রাজেন্দ্রনাথ সরকার (ঐ), আব্দুল হাকিম মাল (ঐ), নওয়াব আলী চেয়ারম্যান (চরদৌলতখান), আবুল কাসেম চৌকিদার (ঐ), জনাবালী হাওলাদার (ঐ), জিল্লুর রহমান ভূঁইয়া মানিক (সাহেবরামপুর), আবুল হাসেম বেপারী (রমজানপুর), আব্দুল কাদের মুন্সী (রমজানপুর), ইছাহাক জমাদ্দার (কয়ারিয়া), হাবিব ফকির (ঐ) প্রমুখ।
কালকিনি উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন আব্দুল মালেক শিকদার (থানা কমান্ডার, মুক্তিবাহিনী) ও মো. জালাল উদ্দিন আহমেদ (থানা কমান্ডার, মুজিব বাহিনী)। এছাড়া মুক্তিবাহিনীর প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন এম এ রহমান, মিয়াজ উদ্দিন খান, এস্কান্দার আলী শিকদার, আবদুল হাকিম তালুকদার, আব্দুর রহিম সরদার, সিরাজ শিকদার, আব্দুল মালেক সরদার, কামরুজ্জামান আবু, গিয়াসউদ্দিন হাওলাদার, মো. জহির উদ্দিন চানমিয়া, মতিউর রহমান সেলিম এবং আবুল বাশার হাওলাদার।
পাকবাহিনী ২৪শে এপ্রিল মাদারীপুর শহর দখল করে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তারা কালকিনি থানায় এসে কয়েকজন স্থানীয় লোককে নিয়ে বৈঠক করে আবার মাদারীপুরে ফিরে যায়। এরপর আগস্ট মাসে পাঞ্জাবি মিলিশিয়া বাহিনী এসে ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এখানে কোনো স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেনি।
কালকিনি উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে আব্দুল খালেক মোক্তার (জামায়াতে ইসলামী ), কাজী মোশারফ হোসেন (মুসলিম লীগ−), কালাই মোল্লা (মুসলিম লীগ), সৈয়দ কবির আহম্মদ (মুসলিম লীগ, ডাসার ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান), এডভোকেট জাহাঙ্গীর হোসেন, আবদুল লতিফ বেপারী, হাসেম পণ্ডিত, আহমদ খন্দকার (কাসেমপুর), কাজী মোশারফ হোসেন ওরফে মিন্টু কাজী (কাজী বাকাই), কালাই মোল্লা (গোপালপুর, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এরা মিলে শান্তি কমিটি গঠন করে। কমিটির সভাপতি ছিল এডভোকেট জাহাঙ্গীর হোসেন, সেক্রেটারি আবদুল লতিফ বেপারী এবং অন্যরা সদস্য। শান্তি কমিটির নেতৃত্বে রাজাকার-, -আলবদর- -আলশামস বাহিনী গঠিত হয়। এ তিন বাহিনীর কমান্ডার ছিল যথাক্রমে কামরুদ্দিন মোল্লা, মজিবুর রহমান সরদার এবং সিব্বির আহমেদ খান। এসব বাহিনীর অন্য সদস্যদের মধ্যে নুরুল হক রাঢ়ী, সিরাজুল হক মোল্লা, আব্দুল লতিফ, বাবুল জমাদ্দার, নান্না জমাদার, মমিন উদ্দিন হাওলাদার (এনায়েতনগর), মতি হাওলাদার (এনায়েতনগর), মো. ফারুখ খাঁ (আলীনগর), মাজেদ হাওলাদার (এনায়েতনগর), সেকেন্দার সরদার (দড়িচর লক্ষ্মীপুর), আনসার উদ্দিন মাল (এনায়েতনগর), ফিরোজ হাওলাদার (চর আলীনগর), জয়নাল বেপারী (চরলক্ষ্মী পখিরা), সেকেন্দার কারী (চর কালীনগর), আবুল কালাম মৃধা (বাঘাকান্দি), আব্দুর রহিম হাওলাদার (পাথরিয়ারপাড়), মোকছেদ হাওলাদার (বালীগ্রাম), রিজু মাতুব্বর (বালীগ্রাম), আহম্মদ হাওলাদার (দক্ষিণ ডাসার), ফটিক বেপারী (দক্ষিণ মাইজপাড়া), সেকেন হাওলাদার (পাথরিয়ারপাড়), ফটিক হাওলাদার (পাথরিয়ারপাড়), হাবিব হাওলাদার (পাথরিয়ারপাড়), সেকাম ঘরামী (দক্ষিণ ধুয়াসার), নুরুল ইসলাম (ভাঙ্গাব্রিজ, বালীগ্রাম), এস্কান্দার সরদার (দড়িচর লক্ষ্মীপুর), আলী আকবর (দড়িচর লক্ষ্মীপুর), আ. মতিন হাওলাদার (দড়িচর লক্ষ্মীপুর), আব্দুল আজিজ বেপারী (এনায়েতনগর), চান মিয়া ওরফে চান্দু (দক্ষিণ বেংগামারা), সোহরাব হোসেন (কা. ফা. মাদ্রাসা), আলতাফ হোসেন (এনায়েতনগর), সৈয়দ লিয়াকত হোসেন (ডাসার), মজিবর রহমান খন্দকার (ডাসার), খাদেম সরদার (লক্ষ্মীপুর ফকিরা), আতিকুর রহমান (বাবলু), মজিবর রহমান (নান্নু উকিল) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা কালকিনি উপজেলায় পাঁচটি গণহত্যা চালায়। সেগুলো হলো- উত্তর বড়াইকান্দি গণহত্যা-, ধামুসা গণহত্যা, ফাসিয়াতলা হাট গণহত্যা বীরমোহন গণহত্যা এবং নীলখোলা গণহত্যা। ১লা জুন পাকসেনা ও রাজাকাররা রমজানপুর ইউনিয়নের উত্তর বড়াইকান্দি গ্রামে কয়েকজনকে হত্যা করে এবং বহু বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। ৩০শে জুন তারা ডাসার ইউনিয়নের ধামুসা গ্রামে ২৩ জনকে হত্যা করে। ১০ই অক্টোবর পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা ফাসিয়াতলা হাটে আক্রমণ চালিয়ে বহু লোককে হত্যা, ৪-৫ জন মহিলাকে ধর্ষণ এবং বহু ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। ৪ঠা ডিসেম্বর আলবদররা বীরমোহন হাইস্কুলের সম্মুখস্থ বটতলায় ১৫ জনকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। একইদিন গোপালপুর গ্রামের নীলখোলায় ৯ জনকে হত্যা করা হয়। এছাড়া তারা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ড চালায় এবং ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। ৩০শে জুন দুজন পাকসেনা তাদের দোসরদের নিয়ে শশিকর গ্রামে প্রবেশ করে। যাওয়ার পথে তারা ধামুসা ছয় আনি গ্রামে রাজেন্দ্রনাথ বাড়ৈসহ অনেককে হত্যা এবং নারীদের অত্যাচার করে। এরপর উত্তর শশিকরে প্রবেশ করে তারা তরণীকান্ত সরকারের বাড়িতে ঢুকে কাউকে না পেয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এ-সময় ভয়ে ভুবন নামে একজন পুকুরে ঝাঁপ দিলে পাকসেনারা তাকে গুলি করে। তবে তিনি বেঁচে যান। এ বাড়ির উত্তর পাশের বাড়ির রাজেন্দ্রনাথ সরকারকে গুলি করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন, তবে তাৎক্ষণিক চিকিৎসায় তিনিও বেঁচে যান। একইদিন চারজন পাকসেনা তাদের দোসরদের নিয়ে ডাসার থেকে নবগ্রামে ঢুকে অবিনাশ হালদারের বাড়ি লুট করে এবং সিদ্ধেশ্বর হাওলাদারের বাড়িতে আগুন দেয়। তাদের গুলিতে বিরাট চন্দ্ৰ বাইন (পিতা নগেন্দ্রনাথ বাইন) নামে এক যুবক শহীদ হয়। হানাদারদের আরেকটি দল দোনারকান্দি যাওয়ার পথে বাকাই ঠাকুর বাড়িতে আগুন দেয় এবং এলোপাতাড়ি গুলি করে। এতে রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, তুলসী বৈদ্য এবং যোগেন বাইন নামে তিনজন সাধারণ লোক নিহত হয়।
কালকিনিতে পাকবাহিনী রাজাকারদের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল থানা ভবন। এ উপজেলায় একটি বধ্যভূমি রয়েছে লালব্রিজ বধ্যভূমি। এখানে পাকবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। ক্যাম্পে অবস্থানরত পাঞ্জাবি রেজিমেন্টের এক দুর্ধর্ষ হাবিলদার যুদ্ধের নয়মাসে দু’শতাধিক বাঙালিকে ব্রিজের ওপর নৃশংসভাবে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়।
মুক্তিযোদ্ধারা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আবদুল মালেক শিকদার, মো. জালাল উদ্দিন আহমেদ, গিয়াস উদ্দিন হাওলাদার, এম এ রহমান, এস্কান্দার শিকদার, মিয়াজ উদ্দিন খান, আব্দুল হাকিম তালুকদার ও মিয়া আব্দুর রহিমের নেতৃত্বে অস্ত্রসহ বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং সাহেবরামপুর, মিয়ারহাট, খাসেরহাট, ফাসিয়াতলা, কালীগঞ্জ, ডাসার, শ্রীখান, এনায়েতনগর, শিকারমঙ্গল, পাঙ্গাসিয়া, সিডিখান, ঘুইঙ্গাকুল, ভবানীপুর প্রভৃতি স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করেন। এরপর তাঁরা পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেন। উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলো হলো- নবগ্রাম-দোনারকান্দি যুদ্ধ, সাউদের খালপাড় যুদ্ধ, পিংলাকাঠী যুদ্ধ, কর্ণপাড়া-পান্তাপাড়া- পাথরিয়াপাড়া যুদ্ধ, কালকিনি ঠাকুরবাড়ি যুদ্ধ, ভুরঘাটা যুদ্ধ, পালরদী নদী যুদ্ধ, রাজদী ব্রিজ যুদ্ধ, হোগলপাতিয়া যুদ্ধ এবং জাইলার চর যুদ্ধ, কালীগঞ্জ শ্যাওলাপট্টি যুদ্ধ, কালকিনি থানা দখল যুদ্ধ। ৮ই ডিসেম্বর কালকিনি উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- মো. নূরুল ইসলাম, বীর বিক্রম (পিতা লাল মিয়া সিকদার, দক্ষিণ বাঁশবাড়িয়া, খাশেরহাট)।
কালকিনি উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- ইপিআর সদস্য মো. নূরুল ইসলাম, বীর বিক্রম (২৪শে সেপ্টেম্বর ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের গোপালপুর ব্রিজ ধ্বংসের সময় পাকবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ), সুবেদার আব্দুর রশিদ চৌধুরী (পিতা আনোয়ার উদ্দিন চৌধুরী, পশ্চিম মাইজপাড়া; কুমিল্লা ক্যন্টনমেন্ট যুদ্ধে শহীদ), অনিল চন্দ্র মল্লিক (পিতা জগবন্ধু মল্লিক, নবগ্রাম; ১৪ই মে নবগ্রাম-দোনারকান্দি যুদ্ধে শহীদ), মো. হোসেন খান (পিতা আহম্মদ খান, সূর্যমনি; ১৭ই জুন ডামুড্যা যুদ্ধে শহীদ), সিপাহি মকবুল হোসেন সরদার (পিতা মো. জয়নাল সরদার, গোপালপুর; ১৪ই জুলাই রামশীল যুদ্ধে শহীদ), আব্দুস সালাম তালুকদার (পিতা জাফর আলী তালুকদার, ডাসার; ঐ), গোলাম সরোয়ার (পিতা আব্দুস সামাদ মিয়া, গোপালপুর; ১০ই সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া জেলার চিলমারীচর যুদ্ধে শহীদ), সিপাহি আব্দুল মোতালেব (পিতা মঈনউদ্দিন মাতুব্বর, পূর্ব নবগ্রাম), সিপাহি জোনাবালী সরদার (পিতা সেলিম সরদার, দড়িচর লক্ষ্মীপুর), মমিন উদ্দিন ঢালী (পিতা আফাজউদ্দিন ঢালী, চরফতে বাহাদুরপুর), আব্দুল মালেক শিকদার (পিতা আমজেদ আলী শিকদার, আন্ডারচর), সাহেব আলী বেপারী (পিতা জয়নদ্দি বেপারী, পশ্চিম মাইজপাড়া), সুবেদার শহিদুল ইসলাম (পিতা আফতাব উদ্দিন, টুমচর), সুবেদার আলতাফ হোসেন (পিতা ফজলুল হোসেন খন্দকার, গোপালপুর), ফরিদ উদ্দিন (পিতা হামিজ উদ্দিন, পূর্ব মাইজপাড়া; এসআই), মো. গিয়াস উদ্দিন (পিতা আ. রশিদ হাওলাদার, ক্রোকিরচর; ৩রা নভেম্বর গৌরনদী কলেজ যুদ্ধে শহীদ), আয়নাল ফকির (পিতা জনাবালী ফকির, রমজানপুর; ৩রা ডিসেম্বর উজিরপুর উপজেলার জয়শ্রী যুদ্ধে শহীদ) এবং মো. এমদাদ হোসেন খান (পিতা আবুল কাসেম খান, মহিষমারী; ঐ)।
দোনারকান্দির খালপাড়ে যেখানে যুদ্ধ হয়েছিল এবং মুক্তিযোদ্ধা অনিল মল্লিক গুলিবিদ্ধ হন, সেখানে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা আকন মোশারফ হোসেনের উদ্যোগে ২০০৭ সালে খাসেরহাট বন্দরে একটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর স্থাপিত হয়েছে। [আকন মোশারফ হোসেন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড