কালকিনি থানা দখল যুদ্ধ (কালকিনি, মাদারীপুর)
কালকিনি থানা দখল যুদ্ধ (কালকিনি, মাদারীপুর) সংঘটিত হয় তিনবার – ১৪ই আগস্ট, ১৮ই সেপ্টেম্বর ও ২৭শে নভেম্বর। প্রথম ও দ্বিতীয় আক্রমণ ব্যর্থ হয়। তৃতীয়বার মুক্তিযোদ্ধারা সফল হন। তবে চতুর্থবার বিনাযুদ্ধে চূড়ান্তভাবে থানা দখল করেন।
প্রথম আক্রমণ পরিচালিত হয় ১৪ই আগস্ট। সেদিন পাকিস্তানের আজাদি দিবস ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা এদিন মাদারীপুর মহকুমা জুড়ে ব্যাপক আক্রমণ পরিচালনা করেন। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুর রহিম কালকিনির লালব্রিজে টহলরত রাজাকারদের ওপর হামলা চালালে অনেকে হতাহত হয়। একই রাতে তাঁরা মাদারীপুর সদর থানার বীর মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান খানের নেতৃত্বে কালকিনি থানা আক্রমণ করেন। কিন্তু এ আক্রমণ ব্যর্থ হয়। শত্রুবাহিনীকে পরাজিত বা তাদের তেমন ক্ষতিসাধন করা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় আক্রমণ হয় ১৮ই সেপ্টেম্বর। কমান্ডার খলিলুর রহমান খান, শিকারমঙ্গলের সালাউদ্দিন মাণিক ও জাহাঙ্গীর এবং পাঙ্গাসিয়ার সিরাজ হাওলাদার যৌথভাবে কালকিনি থানায় গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করেন। কমান্ডার খলিলুর রহমান খান ও সালাউদ্দিন মাণিক পালপাড়া খালের ওপার থেকে গ্রেনেড হামলা করে থানায় অবস্থানরত পাকসেনাদের নাস্তানাবুদ করেন। তবে পাকিস্তানি সেনারা এসএমজি থেকে বৃষ্টির মতো অবিরাম গুলিবর্ষণ শুরু করলে ও মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের রেঞ্জ ও ক্ষমতা কম থাকায় এবং গ্রেনেড চার্জে টেকনিক্যাল অসুবিধার কারণে তাঁদের পক্ষে সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি। অপরদিকে পাঙ্গাসিয়া থেকে এসে এক দল মুক্তিযোদ্ধার থানার দক্ষিণ প্রান্তে পজিশন নেয়ার কথা থাকলেও তাঁরা আসতে বিলম্ব করেন। এর মধ্যে ভুরঘাটা থেকে পাকিস্তানি সেনারা অগ্রসর হয়ে কালকিনি থানার অদূরে বর্তমান কলেজের কাছে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ভারী মেশিনগানের উপর্যুপরি গোলাবর্ষণ শুরু করে। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের বাধ্য হয়ে পজিশন ত্যাগ করতে হয়।
অপারেশন ব্যর্থ হয়। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধা সালাউদ্দিন মাণিক গ্রেনেডের স্প্রিন্টারের আঘাতে গুরুতর আহত হন।
কালকিনি থানায় তৃতীয় আক্রমণ পরিচালিত হয় ২৭শে নভেম্বর রাত সাড়ে ১২টায়। কমান্ডার এস্কান্দার শিকদারের টু-ওয়াই-সি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক সিরাজ শরিফের নেতৃত্বে একটি চৌকস দল এ আক্রমণ করে। আক্রমণে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস ছাত্তার মাল, কাজী হুমায়ুন কবির, আবদুল হক, শাহ জাহাঙ্গীর কাজী, আজাহার, ডা. শাহজাহান, কমান্ডার জহির উদ্দিন চান মিয়া, জব্বার তালুকদার, ইপিআর সদস্য আবদুল মান্নানসহ ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। তাঁরা দুটি নৌকায় এসে পালরদী নদীর দুই পাড়ে অবস্থান নেন। কালকিনি সদর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে পজিশন নিয়ে এসএলআর থেকে এন ওয়ান ফায়ার করা হয়। আক্রান্ত হয়ে পাকিস্তানি সেনারা থানার ভেতর থেকে অবিরাম গুলি ছুড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা পরিকল্পনামাফিক ফায়ার করতে থাকেন এবং থানার চতুর্দিকে পালপাড়া, কালকিনি, ভুরঘাটা রোড, থানা থেকে বাজার ও ঠেঙ্গামারা-পাঙ্গাসিয়া রাস্তা কৌশলে অবরোধ করে ফেলেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকসেনাদের গোলাবারুদ ও রসদ ফুরিয়ে এসেছে বুঝতে পেরে মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে শত্রুর ওপর আক্রমণ তীব্রতর করেন। ফলে পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। দুজন বাঙালি পুলিশ হুমায়ুন ও ওবায়দুরসহ পাকিস্তান রাইফেলসের ১০ সদস্য ও পাকিস্তানি সেনাসহ ২২ জনকে বন্দি করা হয়। ৪৩টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, ৩টি এসএমজি ও ১৩-১৪ হাজার রাউন্ড গুলি, পাকিস্তানি ৬০০ টাকা এবং ১টি ইংরেজি টাইপ রাইটার মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। এ অপারেশনের পর মুক্তিযোদ্ধারা থানা থেকে তাঁদের বেইজে চলে যান।
৮ই ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা সমাদ্দার ব্রিজের কাছে মাদারীপুর শহর থেকে পলায়নরত পাকসেনা, -আলবদর- ও আলশামস বাহিনীর গতিরোধ করেন। শুরু হয় মাদারীপুরের শেষ ও চূড়ান্ত যুদ্ধ। পাকিস্তানি সেনাদের পালিয়ে যাবার খবর দ্রুত কালকিনি থানা সদরে পৌঁছে। কালকিনি থানায় অবস্থানরত বাঙালি পুলিশ ও রাজাকারদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। থানা দখলে উৎসাহিত হন মুক্তিযোদ্ধারা। ৯ই ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিত শক্তি নিয়ে কোনো যুদ্ধ ছাড়াই চূড়ান্তভাবে কালকিনি থানা দখল করে নেন। [বেনজীর আহম্মদ টিপু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড