You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে কালাই উপজেলা (জয়পুরহাট)

কালাই উপজেলা (জয়পুরহাট) মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল ক্ষেতলাল থানার অন্তর্গত। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার পর সারা দেশের মতো কালাইয়েও তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার খবর এখানে পৌছার পর ২৭শে মার্চ কালাই এম ইউ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ক্ষেতলাল -আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি কাজী হাবিবুল হাসান হেনা (এম ইউ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক) ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে মনিশ চৌধুরী, ফিরোজ আকন্দ এবং বিদ্যালয়ের দপ্তরি মহির বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অত্র এলাকার ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রবীণ নেতা ডা. আব্দুল কাদের চৌধুরী ভারতের আকাশবাণী রেডিওতে এক সাক্ষাৎকারে পাকসেনাদের নির্মম নির্যাতন ও গণহত্যার কথা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন। এতে তরুণদের মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং তারা দলে-দলে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের নিয়োজিত করে।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর থেকেই এলাকার মুক্তিকামী মানুষ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে স্বতস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে যোগ দিতে থাকে। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে কাজী হাবিবুল হাসান হেনাকে সভাপতি এবং কবি আলাউদ্দিনকে সেক্রেটারি করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। তাঁদের নেতৃত্বে কালাই এম ইউ উচ্চ বিদ্যালয় ও মূলগ্রাম মাঠের আষাঢ়া আমগাছের নিচে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। ক্যাম্পে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য নিয়াজ উদ্দিন ফকির ও কাজী হাবিবুল হাসান হেনা। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে কবি আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে অনেক মুক্তিযোদ্ধা উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান।
বৃহত্তর ক্ষেতলাল উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে কাজ করেন কাজী হাবিবুল হাসান হেনা, কবি আলাউদ্দিন, মোজাফ্ফর হোসেন চৌধুরী অঙ্গু (দুধাইল), শাহজালাল মাস্টার (উদয়পুর), মোবারক মাস্টার (পূর্ব কৃষ্টপুর), মহাতাব মাস্টার (ঐ), রাজ্জাক আলী মণ্ডল (তালোড়া বাইগুনি), আব্দুল বারী প্রামাণিক (ঐ), খন্দকার হালিমুল আলম জন (পূর্ব সড়াইল), শামসুদ্দিন হীরা (ঐ), মকবুল ফকির (বুড়ইল), মোকছেদ আলী ফকির (পুনট) প্রমুখ। আর কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আজিজুল বারী, আজাহার আলী ও শাকিল উদ্দিন আহমেদ এবং সহকারী কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন আব্দুর রহিম তালুকদার, আব্দুল মান্নান ও শেখ সালেক।
এপ্রিল মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী কালাই উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে এবং উপজেলার বাখড়া নুনগোলা খাড়ির পাশে বাঙ্কার খুঁড়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। তাদের সহযোগিতা করার জন্য শান্তি কমিটি – ও রাজাকার- বাহিনী গঠন করা হয়। সাইদুর রহমান চৌধুরী বিএ (বেগুনগ্রাম)-কে চেয়ারম্যান, মৌলানা বজলার রহমান চৌধুরী (দুধাইল)-কে ভাইস চেয়ারম্যান এবং নুরুল ইসলাম চৌধুরী মংলাকে জেনারেল সেক্রেটারি করে ক্ষেতলালে থানা শান্তি ও প্রতিরক্ষা কমিটি গঠিত হয়। কমিটিতে আব্দুল গফুর মণ্ডল (বালাইট, সহ-সেক্রেটারি), খাদেম হোসেন সরকার (পুর, সহ-সেক্রেটারি), আজাহারুল ইসলাম তালুকদার (মাত্রাই, সহ-সেক্রেটারি), শেখ আব্দুল বারী (করিমপুর, পাবলিসিটি সেক্রেটারি), মৌলানা রিয়াজ উদ্দিন ফকির ওরফে বাক্স মৌলভী (বুড়াইল, সহকারী পাবলিসিটি সেক্রেটারি) এবং মাজিম আলী মণ্ডল (সদস্য হিসেবে), আবদুস সামাদ শেখ (হারুঞ্জা), হাতেমুজ্জামান ফকির (বহুতী), মহাফেজ উদ্দিন মণ্ডল (হারুঞ্জা), বেলায়েত হোসেন প্রামাণিক (বফলগাড়ি), মোহাম্মদ আলী ফকির (পুনট), হাস্কর আলী মণ্ডল (দুধাইল), তোফাজ্জেল হোসেন আকন্দ (হারুঞ্জা), আছির উদ্দিন সরকার (দেওগ্রাম), হারেজ উদ্দিন মণ্ডল (মূলগ্রাম), ইয়াকুব আলী ফকির (কাদিরপুর), আবদুল করিম চৌধুরী (কাদিরপুর) প্রমুখ ছিল।
ক্ষেতলালের মো. হাফিজুর রহমান (পিতা শুকুর আলী ফকির, শিফটা)-এর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। থানার অন্য রাজাকাররা হলো- তছকিন উদ্দিন তালুকদার (তালুকদারপাড়া), তাইফুল ইসলাম তালুকদার খোকা (ঐ), লালচান (মূলগ্রাম), খলিলুর রহমান তোতা (ঐ), নওশের আলী (আকন্দপাড়া), মোশারেফ হোসেন (পূর্ব দুর্গাপুর), হবিবর রহমান (ঐ), নজরুল ইসলাম (থল), মোসলেম উদ্দিন আকন্দ (থল), নাছিরউদ্দিন ফকির (ভেরেন্ডি), নূরুল ইসলাম মণ্ডল (ইটাইল), আবদুর রাজ্জাক (ইটাইল) প্রমুখ। মো. হাফিজুর রহমান ছিল তাদের কমান্ডার।
৩০শে মে ক্ষেতলাল থানা শান্তি ও প্রতিরক্ষা কমিটির জেনারেল সেক্রেটারি ও কুখ্যাত দালাল নুরুল ইসলাম চৌধুরী মংলার নেতৃত্বে স্থানীয় রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্য শেখ আব্দুস সামাদ ও আব্দুল কাদের, ক্ষেতলাল থানার ছোট দারোগা দানেজ মিঞা, কনস্টেবল গোড়া, কনস্টেবল জাহাঙ্গীর, জমাদার ইমান আলী, মুসলিম লীগ- নেতা আব্দুর রহমান সরদার ও জামায়াতে ইসলামী-র নেতা আব্দুল কাদের যৌথভাবে কালাইয়ের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা হারুঞ্জা গ্রামে হামলা চালায়। তারা হারুঞ্জা গ্রামের সুশীল চন্দ্র দেব বাদল ও বগুড়ার কাহালু থানার ভূগোইল গ্রাম থেকে আগত তাঁর আত্মীয় শচীন্দ্রনাথ সরকার ভানুসহ কয়েকজনকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পাকবাহিনীর জয়পুরহাট ক্যাম্পে পাঠায়। এরপর খঞ্জনপুর কুঠিবাড়ি ব্রিজের কাছে পাকসেনারা তাদের হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়ার পথে আনসার সদস্য মোজাম্মেল হক সরদার ও আবুল কালাম মণ্ডল পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। পরবর্তীতে খঞ্জনপুর কুঠিবাড়ি ব্রিজের কাছে তাঁদের হত্যা করা হয়।
ক্ষেতলাল থানা শান্তি ও প্রতিরক্ষা কমিটির সহ-সেক্রেটারি বালাইট গ্রামের আব্দুল গফুর মণ্ডল ও হারুঞ্জা গ্রামের কুখ্যাত দালাল আব্দুস সামাদ শেখ হিন্দুদের মালামাল গচ্ছিত রাখার অভিযোগে বিভিন্ন গ্রামের অনেক মানুষের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালায় এবং নানা অজুহাতে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে। কমান্ডার মো. হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে রাজাকাররা হিন্দু অধ্যুষিত পুনট, কামারপাড়া, মালিপাড়া ও ইটাইলসহ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে নিরীহ মানুষদের বাড়ি থেকে গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি ধরে এনে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে সরবরাহ করত। তারা বাসুড়া হিন্দুপল্লির তারাপদ কুণ্ডুর বাড়ির টিন খুলে নেয় এবং পুকুরের মাছ লুট করে। কালাইয়ের পুরনো গোডাউনের পূর্বপাশে রাজাকারদের নির্যাতনকেন্দ্র ছিল।
পাকবাহিনী কালাইয়ে অনুপ্রবেশের পর তাদের দোসরদের সহযোগিতায় আশপাশ এলাকার নিরীহ মানুষদের ওপর নির্যাতন ও তাদের বাড়িঘর লুটপাট করার প্রতিবাদে মে মাসের প্রথমদিকে নসিরপুর, জিয়ানগর, সমন্তাহার ও গোপীনাথপুরসহ আশপাশের এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা শেখ সালেকের নেতৃত্বে বাখড়া-নুনগোলা খাড়ির পাশে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালান। উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল গোলাগুলি হয়। প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী পিছু হটে বগুড়ার দিকে পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে যেসব মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন, তাঁরা হলেন- আজাহার আলী, প্রফেসর আব্দুর রশিদ, আব্দুল মান্নান, শেখ সালেক, নূরল মাস্টার, বুলু চৌধুরী, সুমির প্রামাণিক, মজির মেম্বার প্রমুখ। পরদিন পাকবাহিনী এ ক্যাম্প পুনর্দখল করে অধিক সংখ্যক সেনা মোতায়েন করে। বাখড়া ক্যাম্প যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের চলাচলের একমাত্র রাস্তা বগুড়া- জয়পুরহাট ভায়া মোলামগাড়ি সড়কের নোনগোলা খাড়ির ওপর নির্মিত ব্রিজটি ভেঙ্গে দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৪ই ডিসেম্বর কালাই উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। কালাই উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেন নায়েক মো. আফজাল হোসেন (পিতা আব্দুল জোব্বার ফকির, মূলগ্রাম)।
তিনি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বাঙালি ও পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে মস্তাশাহ মোড় থেকে করিমপুর ত্রিমোহনী ফিডার পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ সালেক সড়ক। [শফিউল বারী রাসেল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!