You dont have javascript enabled! Please enable it!

কামারখোলা যুদ্ধ (শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ)

কামারখোলা যুদ্ধ (শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ) সংঘটিত হয় ২৫শে অক্টোবর। মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার গোয়ালীমান্দ্রার যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য বীরত্বগাথা। এ-যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল শ্রীনগর উপজেলার কামারখোলা যুদ্ধের মাধ্যমে।
ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে অস্ত্রসহ দেশে ফেরা প্রথম ব্যাচের মুক্তিযোদ্ধারা কোলাপাড়া ইউনিয়নের নন্দন ওঝার পরিত্যক্ত বাড়িতে একটি শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করেন। এ ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন আতিকউল্লাহ খান মাসুদ (বর্তমানে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক)। তাঁরা প্রথমে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী ও শান্তি কমিটির নেতাদের হত্যার মাধ্যমে এলাকাবাসীদের একটি বার্তা পৌছে দেন যে, তাদের কোনো ভয় নেই, মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আশেপাশেই রয়েছে।
দালাল খতমের পর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের গতিবিধির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখেন। তাঁরা লক্ষ্য করেন, শ্রীনগর ডাকবাংলো ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা মাঝে- মধ্যেই শ্রীনগর খাল দিয়ে বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে লুটতরাজ ও নারীদের ওপর নির্যাতন চালায়। তাদের এ অপকর্ম বন্ধ করার উদ্দেশ্যে কমান্ডার আতিকউল্লাহ খান মাসুদ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেন যে, সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণ করা হবে। এ ব্যাপারে তিনি ভাগ্যকূল ক্যাম্প ও কাজির পাগলা ক্যাম্পের কমান্ডার যথাক্রমে আবদুশ শহীদ ভূঁইয়া ও মো. সোলায়মানের সঙ্গে আলাপ করেন। আলাপ-আলোচনার পর তাঁরা একমত হন। তাঁদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোলাপাড়া, কাজির পাগলা ও ভাগ্যকূল ক্যাম্পের সকল মুক্তিযোদ্ধা ২৫শে অক্টোবর একত্রিত হয়ে দক্ষিণ পাইকসা গ্রামের কালী শিকদারের বাড়ির পশ্চিম দিকের ছাড়া বাড়িতে এম্বুশ নেন এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এ-সময় তাঁরা খবর পান যে, দুটি কেরায়া নৌকায় করে পাকবাহিনী শ্রীনগর খাল দিয়ে দক্ষিণ পাইকসা গ্রামের দিকে আসছে। এ খবর পেয়ে তাঁরা সবাই সতর্ক হয়ে যান। পাকিস্তানি সৈন্যরা কালী শিকদারের বাড়ির কাছাকাছি এলে দক্ষিণ পাইকসার গ্রামের এক বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের কথা তাদের জানিয়ে দেয়। বৃদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের নৌকার গতিপথ পরিবর্তন করে দ্রুত শ্রীনগরের দিকে ফিরে যেতে থাকে। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা এম্বুশ ছেড়ে ৬-৭টি কোষানৌকা নিয়ে তাদের ধাওয়া করে কামারখোলা পর্যন্ত নিয়ে যান। কিন্তু পাকসেনারা নাগালের বাইরে থাকায় তাঁরা নতুন কৌশল গ্রহণ করেন। কমান্ডার আতিকউল্লাহ, কমান্ডার সোলায়মান এবং জয়নাল আবেদীন কয়েকজন সুঠামদেহী মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে তিনটি কোষা নৌকায় দ্রুত কামারখোলা গ্রামের খালপাড়ের একটি বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। সেখানে পজিশন নিয়ে তাঁরা পাকিস্তানি সৈন্যদের নৌকা লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকেন। তাঁদের আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্যরা দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নৌকা ছেড়ে খালের পানিতে লাফিয়ে পড়ে এবং পাড়ে উঠে তাঁদের দিকে গুলি ছুড়তে থাকে। এভাবে গুলি ছুড়তে-ছুড়তে পাকসেনারা শ্রীনগরের দিকে পালিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে শ্রীনগর ডাকবাংলোর অন্য সৈন্যদের নিয়ে গানবোটে চড়ে তারা মর্টার শেল নিক্ষেপ ও এলএমজি থেকে ব্রাশ ফায়ার করতে-করতে শ্রীনগর খাল দিয়ে কামারখোলার দিকে এগুতে থাকে। কামারখোলায় এলে মুক্তিযোদ্ধারা এর পাল্টা জবাব দেন। শুরু হয় মুখোমুখি যুদ্ধ। ২-৩ ঘণ্টার এ-যুদ্ধে ৮ জন পাকসেনা নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়।
কামারখোলা যুদ্ধের ২-৩ দিন পর পাকিস্তানি সৈন্যরা বড় একটি লঞ্চে করে কামারখোলা গ্রামে বিশেষ ধরনের শেল নিক্ষেপ করে। এতে গ্রামের কৃষকদের ১০-১২টি বাড়ি পুড়ে যায় এবং গোয়ালঘরে থাকা গরু অগ্নিদগ্ধ হয়। এই সৈন্যদের সঙ্গেই লৌহজং থানার গোয়ালীমান্দ্রায় মুক্তিবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়।
কামারখোলা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন: আতিকউল্লাহ খান মাসুদ, মো. সোলায়মান, আবদুশ শহীদ ভূঁইয়া, বাহারুল ইসলাম, আবদুশ হামিদ খসরু, হাবিলদার বাহাউদ্দিন এবং ভাগ্যকূল, দোলামাড়া ও কাজির পাগলা ক্যাম্পের আরো ১০-১৫ জন। [মো. জয়নাল আবেদীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!