You dont have javascript enabled! Please enable it!

কামারপাড়া গণহত্যা (চিরিরবন্দর, দিনাজপুর)

কামারপাড়া গণহত্যা (চিরিরবন্দর, দিনাজপুর) সংঘটিত হয় ৭ই অক্টোবর। এতে ১৫-২০ জন সাধারণ মানুষ হত্যার শিকার হয়।
ঘটনার দিন ভোর ৫টার দিকে পাকসেনা ও রাজাকার-রা চতুর্দিক থেকে কামারপাড়া ঘেরাও করে ফেলে। তারা একের পর এক বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। সেদিন ডাক্তার কালিদাস কর্মকার, রমানাথ কর্মকার, সুরেন্দ্রনাথ অধিকারী, জিতেন কর্মকার, শশিমোহন রায়, বিজয় মোহন্ত, বিনয় মোহন্ত, ধনঞ্জয় মোহন্ত, প্রাণকৃষ্ণ মোহন্ত, ধীরেন মোহন্ত, হরিদাস মোহন্ত, কালিদাস মোহন্ত, পুর্ণচন্দ্র মোহন্ত, শাহামত আলী, মতিলাল কর্মকার, রবীন্দ্রনাথ কর্মকার, বিনোদ কর্মকার, ধনপতি কর্মকার, যতিন কর্মকার, নিরাশা কর্মকার, সুবাস কর্মকারসহ কর্মকারপাড়ার প্রায় সব বাড়িতে এবং আশপাশের দেড়-দুশ বাড়িতে আগুন দেয়া হয়। ডা. কালিদাসের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া ১৫-২০ জন মানুষকে হত্যা করে তাদের লাশ ঐ বাড়ির কুয়োর মধ্যে ফেলে দেয়া হয়।
কামারপাড়ার অবস্থান রানীরবন্দর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার এবং চিরিরবন্দর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে। নদীতীরবর্তী এ গ্রামটি ঘন জঙ্গলে আচ্ছাদিত থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যথেষ্ট নিরাপদ ছিল। মধ্য- কামারপাড়ার (বৈরাগীপাড়া) সুরেন্দ্র মোহন্ত, কালিদাস মোহন্ত, খর্গনারায়ণ মোহন্ত, পূর্ব কামারপাড়ার রমানাথ কর্মকার, পশ্চিম কামারপাড়ার ডা. কালিদাস কর্মকার, গঙ্গাধর ঠাকুর প্রমুখের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে- মধ্যে এসে থাকতেন। তাঁরা দিনে ঘুমিয়ে রাতে অপারেশনে বের হতেন। কামারপাড়ার মানুষ তাঁদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে, আগ্নেয়াস্ত্র লুকিয়ে রেখে এবং তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করত। পাড়ার সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি শেখ শাহমাত আলী কর্মকার (৮৫) সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন। তিনি ৬- দফার আন্দোলনসহ সকল রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাড়ি-বাড়ি গিয়ে চাল-ডাল সংগ্রহ ও রান্নার ব্যবস্থা করতেন। গ্রামের সরস্বতীবালা, সুমিত্রা কর্মকার, জয়ন্তী কর্মকার, জয়ারানী মোহন্তসহ আরো অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়া- দাওয়ার কাজে সহায়তা করেন। রান্না হতো সুরেন্দ্র মোহন্ত, কালিদাস মোহন্ত, ডা. কালিদাস কর্মকার, আমির আলীর বাড়িসহ বিভিন্ন বাড়িতে। ২২ বছরের যুবক কালিদাস মোহন্ত পূর্বে রানীরবন্দর-সৈয়দপুর সড়কের চম্পাতলী এলাকায় সাতাশজান ব্রিজ নামে একটি ব্রিজ উড়িয়ে দিতে ডিনামাইট ফিট করে আসেন। রাজাকারদের মাধ্যমে পাকসেনারা এ খবর পেয়ে কামারপাড়ায় অপারেশন চালায়।
পাকসেনা ও রাজাকারদের অপারেশনের সময় কামারপাড়ায় কিছু মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু তাঁদের দু-একজন ব্যতীত অন্যরা অস্ত্র ব্যবহার করার সুযোগ পাননি। তাঁরা সারারাত জেগে বাইরে অন্যত্র অপারেশন সেরে অস্ত্র মাটির নিচে গোপন জায়গায় রেখে ঘুমিয়ে ছিলেন। অকস্মাৎ চতুর্দিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়ায় তাঁরা অস্ত্র বের করার সুযোগ পাননি। ফলে হানাদার বাহিনী তদ্রূপ কোনো প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি। কোনো-কোনো মুক্তিযোদ্ধা প্রতিরোধের চেষ্টা করতে গিয়ে পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হন। এরূপ দুজন মুক্তিযোদ্ধা হলেন- লতিফুর রহমান ও আব্দুল বারী। লতিফুর রহমানের বাড়ি পার্বতীপুরের যশাই এবং আব্দুল বারীর বাড়ি চিরিরবন্দরের ৫নং আব্দুলপুর ইউনিয়নের ময়েজমারিতে। কামারপাড়ায় এই দুই মুক্তিযোদ্ধার পাকা সমাধি রয়েছে। মধ্য কামারপাড়ায় পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হন শাহমাত আলী কর্মকার। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যের যোগান দেয়াসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বিভিন্নভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাই কামারপাড়ার মানুষ তাঁকে সর্বদা মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদায় শ্রদ্ধা জানায়। [আজহারুল আজাদ জুয়েল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!