You dont have javascript enabled! Please enable it!

কামালপুর বিওপি ক্যাম্প যুদ্ধ (বকশীগঞ্জ, জামালপুর)

কামালপুর বিওপি ক্যাম্প যুদ্ধ (বকশীগঞ্জ, জামালপুর) সংঘটিত হয় ১২ই জুন থেকে ৩রা ডিসেম্বর পর্যন্ত কয়েক দফায়। এতে উভয় পক্ষে ব্যাপক হতাহত হয়। ৪ঠা ডিসেম্বর ১০০ জন পাকিস্তানি সৈন্য, ৩০ জন রেঞ্জার ও বেশকিছু স্থানীয় রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।
জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার কামালপুর বিওপি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তরে মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জ সীমান্তের কাছে অবস্থিত ছিল। এ বিওপি-তে পাকবাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। অন্যদিকে মহেন্দ্রগঞ্জে ১১ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্স ছিল। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে আগস্ট মাসে এ সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব নেন কর্নেল আবু তাহের। মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের কামালপুর ঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য কয়েকবার আক্রমণ করেন। ফলে এখানে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধ হয়। জামালপুর জেলার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত যুদ্ধ হয় কামালপুরে। জামালপুর, শেরপুর ও ময়মনসিংহ এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ, মানকেরচর, ডালু ও পুরাকাশিয়ায় রিক্রুট হয়ে তুরা ও তেলঢালায় উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মে ও জুন মাসে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশে ঢুকে এলাকায় রেকি করে ফিরে যেতেন। এরপর তাঁরা গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন। গেরিলাদের রণকৌশল ছিল ‘হিট এন্ড রান’। তখন ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও সেনা সদস্যদের নেতৃত্বে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালিত হতো।
গোপনে বাংলাদেশে ঢুকে ১২ই জুন সর্বপ্রথম ইপিআর-এর নায়েক সুবেদার সিরাজের নেতৃত্বে ১৪৮ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানিদের কামালপুর বিওপি আক্রমণ করেন। ১৫ই জুন মুক্তিযোদ্ধা রইচ উদ্দিন ও তাঁর সহযোগীরা বকশীগঞ্জ-কামালপুর রোডে মাইন পুঁতে রাখেন। পরদিন সকাল ৮টায় পাকসেনাদের গোলাবারুদ ভর্তি একটি ট্রাক এখানে মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়। ঘটনাস্থলে কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। ২০শে জুন হাবিলদার হাকিমের নেতৃত্বে ১২০ জন মুক্তিযোদ্ধা আবার কামালপুর বিওপি আক্রমণ করেন। এদিন সম্মুখ যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা রইচ উদ্দিনের গুলিতে এক পাকসেনা নিহত হয়। নিহত পাকসেনার ৭.৬৪ এমএম টাইপের ১৯৫৬ নম্বর চাইনিজ হাতিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। এদিন কয়েকজন পাকসেনা আহত হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা ৩০শে জুলাই রাতে আবার পাকিস্তানিদের কামালপুর ঘাঁটিতে আক্রমণ করেন। ঘাঁটির উত্তর-পূর্ব দিক থেকে দুই কোম্পানি সৈনিক নিয়ে আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বাম দিকে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ-এর নেতৃত্বে ডেলটা কোম্পানি এবং ডান দিকে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে ব্র্যাভো কোম্পানি আক্রমণ করবে বলে পরিকল্পনা করা হয়। ব্যূহের পরবর্তী পর্যায়ে থাকবে ব্যাটালিয়ন অর্ডারস গ্রুপ (O Group), যেখানে মেজর মঈন ছাড়া ব্রিগেড কমান্ডার মেজর জিয়া উপস্থিত থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়। আক্রমণের সময় নির্ধারিত হয় ৩০-৩১ জুলাই রাত ৩টা ৩০ মিনিট। মুক্তিযোদ্ধাদের অনভিজ্ঞতার কারণে অগ্রসর হওয়ার কাজ বিলম্বিত হয়। অগ্রসর হয়ে আক্রমণ করামাত্র পাকবাহিনী প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণ করে। হানাদার বাহিনীর তীব্র গোলাবর্ষণের মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক সময় প্রতিপক্ষের আক্রমণের গতি শ্লথ হয়। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। দ্বিগুণ উৎসাহে তাঁরা অগ্রসর হন। এ পর্যায়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা বিওপি-র বহিরাংশ ছেড়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে প্রবেশ করেন এবং মাইন ফিল্ড আক্রমণ করে আরো অগ্রসর হন। পাকিস্তানি সৈন্যরা অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা এবং বাংকার থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে। যুদ্ধ ক্রমশ তীব্রতর হয়ে ওঠে। উভয় পক্ষে হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা সংকল্পবদ্ধ, কিছুতেই পিছু হটবেন না। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ তাঁর নেতৃত্বাধীন সৈন্যদের ইনার ডিফেন্স বা দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে নিয়ে যান। তিনি তাঁর সৈন্যদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেন। অকুতোভায় ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ যখন তাঁর সৈন্যদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তখন শত্রুবাহিনীর গোলা এসে তাঁর শরীরে লাগে। আহত ও মৃতপ্রায় অবস্থায়ও তিনি তাঁর নেতৃত্বাধীন সেনাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর তিনি শহীদ হন। ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিনের মৃতদেহ উদ্ধার করা যায়নি। তাঁদের প্রিয় নেতাকে উদ্ধারের চেষ্টায় ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁর হাতঘড়ি, স্টেনগান এবং কিছু কাগজপত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়। লে. হাফিজ এ-যুদ্ধে আহত হন। শত্রুর নিক্ষিপ্ত গোলার আঘাতে তাঁর স্টেনগান উড়ে যায়। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি কোম্পানি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যূহের পেছনে অবস্থিত কমিউনিটি সেন্টার হতাহত সৈনিকে ভরে যায়। সকাল সাড়ে ৭টায় মেজর মইন ব্যাটালিয়নকে আক্রমণ প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন।
এ-যুদ্ধে উভয় পক্ষের বহু সৈনিক হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী লড়াই প্রত্যক্ষ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বুঝতে পারে যে, বাঙালিরা শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। এ-যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিনসহ ২৮ জন নিয়মিত সৈনিক ও ৩৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ৬৫ জন আহত হন।
কামালপুরের উত্তর সীমান্তে পাকিস্তানিদের একটি সুরক্ষিত ঘাঁটি ছিল। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে এ ঘাঁটিতে দুবার মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। দুবারই মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম হন, কিন্তু তাঁরা ঘাঁটি দখল করতে পারেননি। মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটিতে প্রবেশ করার পরপরই পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে ব্যাপকভাবে ১২০ মিমি মর্টারের শেল নিক্ষিপ্ত হওয়ায় তাঁরা দখল টিকিয়ে রাখতে অসমর্থ হন।
কামালপুরস্থ পাকিস্তানিদের ঘাঁটির যোগাযোগ ব্যবস্থা বিছিন্ন করার জন্য কামালপুর-বকশীগঞ্জে সড়কে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক এন্টি-ট্যাংক মাইন স্থাপন করেন। এসব মাইন বিস্ফোরণে পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আগস্ট মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানিদের ৯টি সৈন্য বোঝাই ট্রাক এসব মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়। ৬ই সেপ্টেম্বর বিকেলে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল উঠান পাড়ার কাছে কামালপুর- বকশীগঞ্জ সড়কে এম্বুশ করে। সড়কের খুব কাছ দিয়ে কেমন করে অবস্থান নিতে হবে এ বিষয়ে পূর্বে মহড়া দেয়া হয়। মাঝরাতে এ দল নির্দিষ্ট স্থানে এম্বুশ করে। তাঁদের প্রতি নির্দেশ ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত এম্বুশস্থলে শত্রুরা প্রবেশ না করে ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করা। মুক্তিযোদ্ধাদের মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প থেকে আর এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন। রাত ২টার সময় তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় কামালপুর ঘাটির উত্তর-পূর্ব পাশে অবস্থিত বামুনের পাড়া গ্রামে। তাঁদের সেখান থেকে বনজঙ্গল ভরা পথ দিয়ে অগ্রসর হয়ে কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণের নির্দেশ দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ধারণা ছিল কামালপুর ঘাঁটি আক্রান্ত হলে বকশীগঞ্জ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে তাদের সহায়তায় এগিয়ে যাবে। তাই তাদের প্রতিহত করতে উঠান পাড়ার কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের দলটিকে এম্বুশে রাখা হয়। রাতের অন্ধকারে ৪টি মর্টার বান্দ রোডের উত্তর পাশে স্থাপন করা হয়।
ভোর ৪টায় মুক্তিযোদ্ধারা কামালপুর ঘাঁটিতে আক্রমণ করেন। তীব্র ও হঠাৎ আক্রমণের মুখে পাকসেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের নিক্ষিপ্ত গোলা ঘাঁটির পশ্চিম অংশে গিয়ে লাগে। কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁরা ঘাঁটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম হন। ঘাঁটির পূর্বের অংশ তখন পাকসেনাদের দখলে। পশ্চিম অংশের বাংকার থেকে তাদের ওপর ক্রমাগত মেশিনগানের গুলি ও মর্টারের শেল নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু এরপর পাকবাহিনীর পাল্টা আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। এ-সময় ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ১৭ জন আহত হন। সকাল ৭টায় উঠান পাড়ায় এম্বুশে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনাদের গুলি বিনিময় শুরু হয়। এতে ২ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। যখন এ গুলি বিনিময় চলছিল, তখন একদল পাকিস্তানি সৈন্য কামালপুর ঘাঁটি থেকে পালিয়ে বকশীগঞ্জ যাচ্ছিল। পলাতক দলটি সেই সময় এম্বুশরত মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে অবস্থান নেয় ও তাঁদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৪ জন পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পরেন। সামগ্রিকভাবে এটি সফল আক্রমণ ছিল। কারণ সমগ্র আক্রমণে ৩৩ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়।
১৪ই নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা আবার পাকিস্তানিদের কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণ করেন। এ আক্রমণে নেতৃত্ব দেন সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহের। নভেম্বরের এ অভিযান ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব সম্মুখ সমর। সৈয়দ মনিরুজ্জামান হেডকোয়ার্টার্স থেকে ওয়াকিটকি নিয়ে যোগাযোগ রাখছিলেন। ওয়াকিটকিতে মেজর তাহেরের নির্দেশ প্রেরিত হয় রণাঙ্গনের বিভিন্ন জায়গায়। ভারতীয় পক্ষ কামানের গোলা ছুড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার প্রস্তুতি নেয়। রাত ৩টা ৪৫ মিনিটে আক্রমণ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে একযোগে আক্রমণ করেন। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ও বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ চলতে থাকে। দুপক্ষের মধ্যে তীব্র গুলি বিনিময় হয়। মিত্রবাহিনী কামানের গোলা নিক্ষেপ করে। প্রচণ্ড আক্রমণ করা সত্ত্বেও পাকিস্তানিদের এ সুরক্ষিত ঘাঁটির খুব বেশি ক্ষতি করা যায়নি। তারা আত্মসমর্পণ করেনি। ভোরের দিকে গোলাগুলি বন্ধ হয়। হঠাৎ লে. মিজানের অগ্রবর্তী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে মেজর তাহের তাঁর অবস্থান থেকে মূল ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হন। লে. মিজানকে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে তিনি উৎকণ্ঠিত ছিলেন। ৯টার দিকে শত্রুপক্ষের একটি শেল এসে তাহেরকে সরাসরি আঘাত হানে। তাহের মাটিতে পড়ে যান, কিন্তু জ্ঞান হারাননি। বরং অকুতোভয় তাহের অন্যদের নির্দেশ দিতে থাকেন। কমান্ডার আহত হওয়ায় হেলাল, বেলাল, বাহার, সুজাসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। রক্তাক্ত তাহেরকে সহযোদ্ধারা ভারতীয় এলাকায় নিয়ে যান। তাঁর দেহ থেকে প্রায় বিছিন্ন হওয়া একটি পা কেটে ফেলে তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়। ভারতীয় ডা. মুখার্জী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সেক্টর ডাক্তার প্রেমাঙ্কুর রায় তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। প্রথম গৌহাটিতে ও পরে পুনা হাসপাতালে তাঁকে চিকিৎসা দেয়া হয়। পুনা হাসপাতালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে দেখতে যান।
১৪ই নভেম্বর মেজর তাহের আহত হওয়ার পর সাব-সেক্টরের কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। ১১ নম্বর সেক্টরের ২২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ১৯ হাজার এফএফ-এর সদস্য এবং ৩ হাজার নিয়মিত সৈনিক ছিলেন। ১৪ই নভেম্বরের পর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের কামালপুর ঘাঁটি অবরোধ করে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। ঘাঁটির চারদিকে এম্বুশ বসানো হয়। নভেম্বর থেকে ৪ঠা ডিসেম্বর পর্যন্ত এভাবে কামালপুরে পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা অবরুদ্ধ থাকে। এ অবরোধের মধ্যে তাদের সকল সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন ছিল। শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা কোথাও থেকে তাদের জন্য কোনো রসদ বা গোলাবারুদ পৌঁছেনি। ৩রা ডিসেম্বর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হয়। এ অবস্থায় কামালপুর ঘাঁটিতে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণের সুযোগ তৈরি হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ কমান্ড গঠিত হয়। ৯৫তম মাউন্টেন ডিভিশনের ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ার তখন এ এলাকার রণাঙ্গনে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নেয় আক্রমন না করে প্রথমে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠানো হবে। উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে প্রস্তাব করা হয় কে যেতে চান কামালপুরের পাকিস্তানি ক্যাম্পে। যদি পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণে রাজি না হয় তাহলে পত্রবাহকের মৃত্যু অনিবার্য। অসীম সাহসী ও বীর যোদ্ধা বশীর ও আনিসুর ইসলাম সঞ্জু হাত তুলে জানান যে, তাঁরা প্রস্তাব নিয়ে যাবেন। প্রথম চিঠি দিয়ে পাঠানো হয় বশীরকে। সবাই তাঁর প্রস্থানের দৃশ্য দেখেন। এক সময় তিনি দৃষ্টিশক্তির বাইরে চলে যান। এরপর শুরু হয় ভয়ংকর প্রতীক্ষা। সকাল থেকে কয়েক ঘণ্টা চলে যায়। তাঁর অবস্থা কী হলো কিছু জানা যাচ্ছে না। তারপর পাঠানো হয় সঞ্জুকে। তাঁর হাতে দেয়া চিঠিতে লেখা হয়, ১ ঘণ্টার মধ্যে জবাব না পেলে কামালপুর উড়িয়ে দেয়া হবে। সেই ১ ঘণ্টা পার হওয়ার পর ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার বিমান বাহিনীকে কামালপুরে আঘাত হানার সংকেত দেন। কিছুক্ষণ পর ভারতীয় যুদ্ধবিমানগুলো কামালপুরের চারদিকে ঘুরতে শুরু করে। এর মধ্যে সঞ্জু ফিরে আসেন। বশীর তখনো কামালপুরে। একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি নিয়মিত বাহিনীর এটি ছিল প্রথম আত্মসমর্পণ। ৪ঠা ডিসেম্বর অস্ত্র মাটিতে রেখে লাইন বেঁধে হাত ওপরে তুলে কামালপুর ঘাঁটি থেকে হানাদাররা বেরিয়ে আসে। ১০০ জন নিয়মিত সৈন্য, ৩০ জন রেঞ্জার এবং বেশকিছু স্থানীয় রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। কামালপুরের পতন মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক বিজয়ের পথকে ব্যাপকভাবে তরান্বিত করে। [রজব বকশী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!