You dont have javascript enabled! Please enable it!

কান্দাপাড়া গণহত্যা (বাগেরহাট সদর)

কান্দাপাড়া গণহত্যা (বাগেরহাট সদর) সংঘটিত হয় ১৮ই জুন। এদিন রাজাকার-রা জবাই করে অনেক মানুষকে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ গণহত্যা নিষ্ঠুরতার এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত।
বাগেরহাট সদর থানার বেশরগাঁতি গ্রামে এপ্রিল মাসে শেখ হবিবুর রহমান হবির নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প গড়ে ওঠে। বেশরগাঁতি, কান্দাপাড়া, পাইকপাড়া প্রভৃতি গ্রামের বহু তরুণ এ বাহিনীর সদস্য হন। কান্দাপাড়া স্কুলের শিক্ষক শেখ অলিউর রহমান এসব মুক্তিযোদ্ধার নাম-ঠিকানা জানিয়ে বাগেরহাটের ‘রাজাকার মেজর’’ নামে কুখ্যাত রজ্জব আলী ফকিরকে একটি চিঠি লেখে। চিঠি পেয়ে রাজাকার বাহিনী ১৮ই জুন বেশরগাঁতি ক্যাম্প ও নিকটবর্তী গ্রামগুলোতে আক্রমণ করে।
রাজাকার বাহিনীর একটি অংশ মুনিগঞ্জের নিকট ভৈরব নদী পার হয়ে চিতলমারী সড়ক দিয়ে কান্দাপাড়ার দিকে অগ্রসর হয়। অন্য অংশ ফকিরহাট থানার মূলঘর থেকে কুচিবগা খালের পথে কান্দাপাড়ার দিকে রওনা হয়। এ দলের নেতৃত্বে ছিল রজ্জব আলী ফকির, সিরাজ মাস্টার, জেলাল পাইক, একরাম মিয়া, দুলাল শেখ প্রমুখ। এদের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে পাইকপাড়ার কাজী আবদুর রহমান। সেদিন শুক্রবারের জুমার নামাজ পড়ার জন্য অনেকে মসজিদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তখন বেশরগাঁতি গ্রামে গিয়ে রাজাকাররা শেখ আবদুল আলী, শেখ মকবুল আলী ও শেখ আনসার আলী এ তিন সহোদরকে আটক করে। এরা ছিলেন শেখ হবিবুর রহমানের বাড়ির লোক। এ বাড়ি থেকে আরো ৫ জন তরুণকে আটক করা হয়। সবাইকে বেঁধে কান্দাপাড়া বাজারে নিয়ে আসা হয়। এরপর এ গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে রাজাকাররা হানা দেয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক হিসেবে যাদের তালিকা করা হয়েছিল তাদের ধরে আনা হয়। যাদের পাওয়া যায়নি, তাদের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। এদিন দেলোয়ার হোসেন মাস্টার ও ইব্রাহিম হোসেন মাস্টারের বাড়িতে রাজাকাররা অগ্নিসংযোগ করে। ফকিরহাটের পথে আসা রাজাকারদের সামনে পড়েছিলেন কদমতলা গ্রামের অজিত বসু এবং উৎকুল গ্রামের নারায়ণ চন্দ্র দাস। তাদেরও বেঁধে কান্দাপাড়ায় নিয়ে আসা হয়। সব মিলিয়ে মোট ২৫ জনকে কান্দাপাড়া বাজারে বেঁধে জড়ো করা হয়।
এরপর শুরু হয় জবাই ও গুলি করে মানুষের প্রাণ হরণ। রাজাকারদের প্রথম শিকার হন হামজা আলী। তিনি খুব শক্ত-সমর্থ পুরুষ ছিলেন। রাজাকারদের বাঁধন ছিঁড়ে তিনি যখন পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন রাজাকারদের ছোড়া গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়। পরে তাঁর মৃতদেহটি টেনে-হিঁচড়ে কান্দাপাড়া বাজারে নিয়ে আসা হয়। বাকি বন্দিদের কী করা হবে তা নিয়ে রজ্জব আলী ফকির স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতা কাজী আবদুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে। এক পর্যায়ে সিরাজ মাস্টার এসে ২৫ জনের মধ্য থেকে ৭ জনকে আলাদা করে। তারপর অদূরে নিয়ে একে-একে জবাই করে কাছের একটা গর্তের মধ্যে ফেলতে থাকে। প্রথম ৭ জনকে জবাই করা হলে রজ্জব আলীর নির্দেশে সিরাজ মাস্টার অবশিষ্টদেরও একই কায়দায় জবাই করতে থাকে। বন্দি মঞ্জুর মোল্লার গলায় ছুরি বসানোর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে মঞ্জুর তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে হাতের দড়ি খুলে ফেলেন এবং গলার কাছে আসা ছুরি ঠেকিয়ে সিরাজ মাস্টারের পেটে লাথি মেরে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। ততক্ষণে সিরাজ মাস্টার তার ছুরি মঞ্জুরের পেটে চালিয়ে দেয়। এতে মঞ্জুর মারাত্মকভাবে আহত হন।
সিরাজ মাস্টারের ছুরিতে সেদিন যাদের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়, তারা হলেন- হামজা আলী, শেখ আবদুল আলী, শেখ মকবুল আলী, শেখ আনসার আলী, শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ মহব্বত আলী, অজিত বসু, নারায়ণ চন্দ্র দাস, শেখ মোবারক আলী, জনাব আলী মোল্লা, শেখ বরকত আলী, শেখ তৈয়ব আলী, কাজী আকবর আলী, পাইক মনিরুল ইসলাম, শেখ আব্দুস সামাদ, ছবর উদ্দিন শেখ, কাঞ্চন শেখ এবং শেখ ইয়াকুব আলী। মারাত্মকভাবে আহত শেখ মকবুল আলী কয়েক ঘণ্টা জীবিত ছিলেন। [স্বরোচিষ সরকার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!