মুক্তিযুদ্ধে কাপাসিয়া উপজেলা (গাজীপুর)
কাপাসিয়া উপজেলা (গাজীপুর) বানার নদী, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ ও শীতলক্ষ্যা নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত। এক সময় বর্তমান কাপাসিয়া, শ্রীপুর ও কালীগঞ্জ উপজেলা মিলে ছিল কাপাসিয়া থানা। তাজউদ্দীন আহমদ-এর জন্মস্থান কাপাসিয়ার মানুষ বরাবরই ছিল রাজনীতি-সচেতন। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর নিরঙ্কুশ জয়লাভের পর পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এ স্বাধীনতার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা কাপাসিয়ার ছাত্র-যুবকসহ সকল মুক্তিকামী মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে।
৭ই মার্চের ভাষণের পর কাপাসিয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাট-বাজারে প্রতিদিন মিছিল, মিটিং ও সভা-সমাবেশের মাধ্যমে ছাত্র-যুবক ও সাধারণ জনগণকে স্বাধীনতার পক্ষে সংগঠিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ বিভিন্ন বিভিন্ন স্থানে অস্ত্রবিহীন প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এ-সময় স্থানীয় ছাত্রনেতা আ. বাতেন খানকে আহ্বায়ক করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এ পরিষদের সদস্য ছিলেন শামসুজ্জামান লাল মিয়া সিদ্দিকুর রহমান, নূরুল ইসলাম, ফজলুর রহমান মোল্লা, শাহজাহান, ফজলুর রহমান ডিপটি প্রমুখ। মার্চের শেষদিকে -ছাত্রলীগ-এর কেন্দ্রীয় নেতা খালেদ খুররমের কাপাসিয়ার বাড়িতে মাহমুদুল আলম খাঁন বেনু, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ফজলুর রহমান, মো. উবায়দুল্লাহ, আ. মান্নান ও শামসুজ্জামান লাল মিয়াসহ ৭ জন এ মর্মে শপথ গ্রহণ করেন যে, জীবনের বিনিময়ে হলেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করবেন। ১৯শে মার্চ গাজীপুরে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে উঠলে গাজীপুর সমরাস্ত্র কারখানার কর্মকতা-কর্মচারীরা স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে কারখানা ত্যাগ করেন। এ সুযোগে মুক্তিকামী মানুষ কারখানা থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে শুরু করে। এ-সময় সমরাস্ত্র কারখানার প্রকৌশলী আব্দুস সালাম কাপাসিয়ায় এসে ছাত্রলীগ নেতা মাহমুদল আলম খান বেনুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরবর্তীতে তাঁর নির্দেশনা ও সহযোগিতায় ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও তাঁর সহযোগীরা জয়দেবপুর এলাকার বিভিন্ন গ্রাম থেকে চাইনিজ এলএমজি, রাইফেল ও কয়েক বাক্স গোলাবারুদ সংগ্রহ করেন। ১লা মে রাতে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা কাপাসিয়া থানা অক্রমণ করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করেন। এসব অস্ত্র দিয়ে কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের বোর্ডিং মাঠ, বানারহাওলা খালেদ খুররমের বাড়ির পশ্চিমের টেক, রায়নন্দার টেক, হরিমুঞ্জুরী পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, পেচরদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঈদগাহ উচ্চ বিদ্যালয়, চরখামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দিগধা সিনিয়র মাদ্রাসা ও কপালেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। মার্চের শেষদিক থেকে শুরু করে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত এসব ক্যাম্পে নিয়মিত প্রশিক্ষণ চলে। এসব ক্যাম্পে প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মুজাহিদ বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক জালাল উদ্দিন (ভাকোয়াদী, চাঁদপুর), পুলিশ বাহিনীর সদস্য মমতাজ উদ্দিন (রাউকোনা) প্রমুখ। পাকসেনারা যাতে প্রশিক্ষণের স্থানসমূহ জানতে না পারে সেজন্য একেক দিন একেক স্থানে প্রশিক্ষণ হতো। পরবর্তীকালে কাপাসিয়ার মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, মফিজ উদ্দিন মাস্টার, সিরাজুল ইসলাম মাস্টার, আব্দুল কবির মাস্টার, হযরত আলী মাস্টার, আ. হেকিম মোল্লাহ, কৃষকনেতা মোহাম্মদ আতাউল হক, নূর মোহাম্মদ প্রমুখ। এছাড়া ছাত্রনেতাদের মধ্যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন ছাত্রলীগের মাহমুদুল আলম খান বেনু, নুরুল ইসলাম, কামাল উদ্দিন নান্নু ও শামসুজ্জামান লাল মিয়া এবং ছাত্র ইউনিয়নের মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও মো. ওবায়দুল্লাহ।
মুক্তিযুদ্ধে কাপাসিয়ায় এফএফ, বিএলএফ ও ভিএফ বাহিনী এবং নিয়মিত বাহিনী যুদ্ধ করে। এফএফ বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন মাহমুদুল আলম খান বেনু, সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, গ্রুপ কমান্ডার ফজলুর রহমান মোল্লা, সদর উদ্দিন, শ্রমিকনেতা আব্দুল হাসেম, মাহবুবুল আলম চৌধুরী, মতিউর রহমান চৌধুরী, মহিবুর রহমান খান, বজলুর রশীদ মোল্লা, শামসুল আলম লাল মিয়া প্রমুখ। বিএলএফ বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন ডা. সিরাজুল ইসলাম। তাঁর সহযোগী ছিলেন শামসুউদ্দিন খান, মো. ওবায়দুল্লা এবং কামাল উদ্দিন নান্নু। নিয়মিত বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে সুবেদার নাসির উদ্দিন ও আব্দুস সাহিদ দায়িত্ব পালন করেন।
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই কাপাসিয়ায় পাকসোনারা যাতে আসতে না পারে সেজন্য ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করে মাহমুদুল আলম খাঁন বেনু মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কাপাসিয়া-রাজেন্দ্রপুর সড়কে রাজাবাড়ি ব্রিজের পূর্ব পাশে পরিখা খনন করেন। স্থানীয় জনসাধারণ বন্দুক ও লাঠিসোঁটা নিয়ে ব্রিজের আশেপাশে পাহাড়ারত ছিল। ফলে রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাস থেকে কাপাসিয়ায় আসতে পাকসেনারা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দিগধা মাদ্রাসার নিকটে মাহমুদুল আলম খান বেনুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাকসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেন।
প্রথমে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি এবং পরবর্তীতে ১লা মে পাকসেনারা কাপাসিয়ায় অনুপ্রবেশ করে। তখন তারা কাপাসিয়া বাজারের কিছু অংশ এবং স্থানীয় জনসাধারণের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে রাজন্দ্রেপুর সেনানিবাসে ফিরে যায়। এরপর তারা মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থায়ীভাবে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং ২৩শে নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে।
কাপাসিয়ায় পাকবাহিনীর সহযোগিতায় শান্তি কমিটি রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। মুসলিম লীগ নেতা এ কে শফিউদ্দিন আহমদ (চেয়ারম্যান, তরগাঁও), আরিফ দর্জি (পাবুর, চেয়ারম্যান কাপাসিয়া) ও আমীর আলী মাস্টার (খোদাদিয়া, সভাপতি, প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি) এবং ন্যাপ নেতা মনির মাস্টার (সহকারী প্রধান শিক্ষক, কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়)এর নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। জুন-জুলাই মাসে শান্তি কমিটির সহায়তায় বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে তরুণদের ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। মাওলানা জালাল উদ্দিন আকবরী (চিনাডুলি, তরগাঁও), জাহাঙ্গীর (কাপাসিয়া) ও রিয়াজ উদ্দিন (কাপাসিয়া) ছিল রাজাকার কমান্ডার। এছাড়া নাছির উদ্দিন (রিয়াজ উদ্দিনের ভাই), ইমান আলী মুন্সী, বানারহাওলার হাকিম উদ্দিন খান, ইসলাম উদ্দিন খান, লিয়াকত খান, সুরুজ আলী খান ও রিয়াজ উদ্দিন, রাউৎকোনা গ্রামের সোলায়মান শেখ, সালাম শেখ ও কমর উদ্দিন শেখ, মাওলানা আ. আওয়াল (বাড়ৈগাঁও, দুর্গাপুর), রাওনাট (দুর্গাপুর) গ্রামের মাওলানা আ. বারেক, মমতাজ উদ্দিন পলান, নিজাম উদ্দিন পলান, মেজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া, আলী নেওয়াজ মোল্লা, শাহনেওয়াজ মোল্লা, আবুল কালাম মোল্লা, মো. নজরুল ইসলাম মোল্লা, মো. মোতালেব পলান, আলাউদ্দিন (রুবারটেক, দুর্গাপুর), সাইফুল্লা (কামড়া, দুর্গাপুর), গিয়াস উদ্দিন (বাড়ৈগাঁও, দুর্গাপুর) প্রমুখ রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিল। শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে নিরাপত্তামূলক টহল, পাহাড়া, পথপ্রদর্শন, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও লুণ্ঠনে সহায়তা করেছে।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে তরগাঁও এবং কাপাসিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দারা। রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী তরগাঁও গ্রামের মোহাম্মদ আলী মীর, রমিজ উদ্দিন বেপারী, রস্তুম আলী ও আফাজকে গুলি করে হত্যা করে। দরিমেরুন গ্রামের হাফিজ উদ্দিনকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে এবং মহেন্দ্র বর্ধনের স্ত্রী প্রিয়বালা বর্ধনকে ধর্ষণের পর গুলি করে হত্যা করে। তারা টোক ইউনিয়ন থেকে আইয়ুব আলী ও ঘোষেরকান্দি গ্রাম থেকে ছফুর কেরানীকে ধরে নিয়ে কাওরাইদের গয়েশপুর ক্যাম্পে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
কাপাসিয়ায় পাকবাহিনীর সহযোগিতায় শান্তি কমিটি রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। মুসলিম লীগ নেতা এ কে শফিউদ্দিন আহমদ (চেয়ারম্যান, তরগাঁও), আরিফ দর্জি (পাবুর, চেয়ারম্যান কাপাসিয়া) ও আমীর আলী মাস্টার (খোদাদিয়া, সভাপতি, প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি) এবং ন্যাপ নেতা মনির মাস্টার (সহকারী প্রধান শিক্ষক, কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়)-এর নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। জুন-জুলাই মাসে শান্তি কমিটির সহায়তায় বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে তরুণদের ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। মাওলানা জালাল উদ্দিন আকবরী (চিনাডুলি, তরগাঁও), জাহাঙ্গীর (কাপাসিয়া) ও রিয়াজ উদ্দিন (কাপাসিয়া) ছিল রাজাকার কমান্ডার। এছাড়া নাছির উদ্দিন (রিয়াজ উদ্দিনের ভাই), ইমান আলী মুন্সী, বানারহাওলার হাকিম উদ্দিন খান, ইসলাম উদ্দিন খান, লিয়াকত খান, সুরুজ আলী খান ও রিয়াজ উদ্দিন, রাউৎকোনা গ্রামের সোলায়মান শেখ, সালাম শেখ ও কমর উদ্দিন শেখ, মাওলানা আ. আওয়াল (বাড়ৈগাঁও, দুর্গাপুর), রাওনাট (দুর্গাপুর) গ্রামের মাওলানা আ. বারেক, মমতাজ উদ্দিন পলান, নিজাম উদ্দিন পলান, মেজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া, আলী নেওয়াজ মোল্লা, শাহনেওয়াজ মোল্লা, আবুল কালাম মোল্লা, মো. নজরুল ইসলাম মোল্লা, মো. মোতালেব পলান, আলাউদ্দিন (রুবারটেক, দুর্গাপুর), সাইফুল্লা (কামড়া, দুর্গাপুর), গিয়াস উদ্দিন (বাড়ৈগাঁও, দুর্গাপুর) প্রমুখ রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিল। শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে নিরাপত্তামূলক টহল, পাহাড়া, পথপ্রদর্শন, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও লুণ্ঠনে সহায়তা করেছে।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে তরগাঁও এবং কাপাসিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দারা। রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী তরগাঁও গ্রামের মোহাম্মদ আলী মীর, রমিজ উদ্দিন বেপারী, রস্তুম আলী ও আফাজকে গুলি করে হত্যা করে। দরিমেরুন গ্রামের হাফিজ উদ্দিনকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে এবং মহেন্দ্র বর্ধনের স্ত্রী প্রিয়বালা বর্ধনকে ধর্ষণের পর গুলি করে হত্যা করে। তারা টোক ইউনিয়ন থেকে আইয়ুব আলী ও ঘোষেরকান্দি গ্রাম থেকে ছফুর কেরানীকে ধরে নিয়ে কাওরাইদের গয়েশপুর ক্যাম্পে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
খোদাদিয়া গ্রামের হরিমঞ্জুরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন বাড়ি থেকে রমেশ চন্দ্র ঘোষকে ধরে নিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর পারে বলদাঘাটে গুলি করে হত্যা করে।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা বিভিন্ন হাট-বাজার ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। অক্টোবর মাসে শ্রীপুর ক্যাম্প থেকে গোসিংগা খেয়াঘাট পাড় হয়ে পাকবাহিনী বালাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের গ্রামের বাড়ি, দরদরিয়া গ্রামের মজিদ ওয়ারেজ আলীর বাড়ি, সাহাবউদ্দিন ও সিরাজ মাস্টারের বাড়ি এবং দেওনা গ্রামের চেরাগ আলী মোড়লের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তারা ঘাগটিয়া ইউনিয়নের চরখিরাটি গ্রামের বোমারাড়ীর মো. সিরাজ উদ্দিন, হাবিজ উদ্দিন, মমতাজ উদ্দিন, কফিল উদ্দিন ও হযরত আলীর বাড়িতে পার্শ্ববর্তী মনোহরদী উপজেলা থেকে এসে অগ্নিসংযোগ করে। দরিমেরুন গ্রামের হরকুমার দাস, দীপক শীল, তারিণী শীল ও কালিদাস শীলের বাড়ি এবং পানবারইদ গ্রামের যোগেশ শিকদারের বাড়িতে পাকসেনারা অগ্নিসংযোগ করে। চাঁদপুর ইউনিয়নের চাঁদপুর বাজার, চাঁদপুর গ্রামের গুরুচরণ ঘোষ, রজনী ঘোষ, বিনোদ চক্রবর্তী ও হিরেন্দ্র কুমার চক্রবর্তীসহ অধিকাংশ হিন্দুদের বাড়িতে এবং আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুবুল আলম মাস্টার ও মিজানুর রহমান মাস্টারের বাড়িতে তারা অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট করে। পাকসেনারা পার্শ্ববর্তী শ্রীপুর এবং গফরগাঁও থেকে নদীপথে এসে সীমান্তবর্তী সিংহশ্রী ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশীদ চেয়ারম্যান, সিরাজ উদ্দিন মোড়ল, নুরুল ইসলাম, আজিম ফকির, কফিল উদ্দিন, খলিল এবং নামিলা গ্রামের আলম, ফজলু মাস্টার ও পুলিশ সদস্য ইব্রাহিমের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং নির্যাতন চালায়। তারা টোক ইউনিয়নের টোকবাজার, টোকনয়ন বাজার, ঘোষেরকান্দি ও আড়ালিয়া গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে। কাপাসিয়া সদর ইউনিয়নে হিন্দুদের বাড়িঘরেও পাকসোনরা অগ্নিসংযোগ করে এবং কয়েজনকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। তরগাঁও ইউনিয়নের তরগাঁও গ্রামে পাকবাহিনী ভুলক্রমে একটি হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে। এতে ৪৩ জন নিহত হয়, যাদের অধিকাংশই ছিল রাজাকার। তারা চাঁদপুর ইউনিয়নের গফুর পণ্ডিত ও আব্দুস শাহীদ শিকদার এবং বড়জোনা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আ. মান্নানকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্মমভাবে অত্যাচার করে। শান্তি কমিটির সদস্য এবং রাজাকাররা বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানসহ নানারকম খবর সংগ্রহ এবং গরু-ছাগল লুট করে তা পাকসেনাদের ক্যাম্পে সরবরাহ করত। কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ভবন এবং কাপাসিয়া থানা ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। কাপাসিয়া ইউনিয়নের বরুন গ্রামে মহেশ দাসের বাড়িতে একটি গণকবর রয়েছে। এখানে কুঞ্জমোহন দাস, নিত্য নন্দন দাস, অনিল চন্দ্র দাস ও সদানন্দন দাসকে কবর দেয়া হয়।
কাপাসিয়া উপজেলায় পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশকিছু যুদ্ধ ও অপারেশনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে গিলাপুরা টেকের যুদ্ধ, জামিরারচর ব্রীজ অপারেশন, তরগাঁও লঞ্চঘাটের যুদ্ধ, তরগাঁও তফিজ মোক্তার বাড়ির যুদ্ধ , এবং তরগাঁও খেয়াঘাটের যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। ৪ঠা সেপ্টেম্বর গিলাপুরা টেকের যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন বিএলএফ বাহিনীর ডা. সিরাজ, শামসুউদ্দিন খান, মো. জয়নাল আবেদীন, উবায়দুল্লাহ্, মাজহারুল হক মিন্টু, ভিএফ কমান্ডার আনোয়ার হোসেন, কামাল উদ্দিন নান্নু, আব্দুস সামাদ প্রমুখ। এ-যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ আহত হন।
২৫শে সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য কাপাসিয়া-রাজেন্দ্রপুর সড়কে জামিরারচর গ্রামে খালের ওপরের ব্রিজটি ধ্বংস করার উদ্যোগ নেন। এ উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধারা যখন ব্রিজের বিভিন্ন স্থানে এক্সপ্লোসিভ লাগানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন কাপাসিয়া থেকে পাকসেনারা গুলি ছুড়তে-ছুড়তে ব্রিজের দিকে অগ্রসর হয়। পাকসেনাদের অতর্কিত আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে নিরাপদ আশ্রয় নেয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সাজ্জাদ আহত হন (পরবর্তীতে অন্য একটি যুদ্ধে শহীদ)।
অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে তরগাঁও লঞ্চঘাটের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা কাপাসিয়া থেকে নদীপথে রানীগঞ্জের দিকে অগ্রসরমান পাকসেনাদের লঞ্চ আক্রমণ করেন। যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং সামনে অগ্রসর না হয়ে কাপাসিয়া ক্যাম্পে ফিরে যায়। এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন এফএফ বাহিনীর কমান্ডার মাহমুদুল আলম খাঁন বেনু। ১১ই অক্টোবর তরগাঁও তফিজ মোক্তারের বাড়িতে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সাজ্জাদ ও গিয়াস ঘটনাস্থলে শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধা আউয়ালকে পাকসেনারা জীবিত ধরে নিয়ে যায় এবং তাদের অমানুষিক নির্যাতনে আউয়াল শহীদ হন। ২০শে নভেম্বর তরগাঁও খেয়াঘাটে উভয়পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধা নরেন ও সাহাব উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। ২৪শে নভেম্বর কাপাসিয়া উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। এ উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. দৌলত হোসেন মোল্লা, বীর বিক্রম ও ফারুক লস্কর, বীর প্রতীক।
কাপাসিয়া উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- সাজ্জাদ হোসেন (পিতা আফছার উদ্দিন আহমেদ, চিনাডুলি, পাকবাঘিয়া), আবুল হোসেন (পিতা আজিম উদ্দিন, তরগাঁও), গিয়াস উদ্দিন (পিতা আতব খান, গিয়াসপুর, বারিষাব), আ. খালেক (পিতা আজিম উদ্দিন, বাঘিয়া, তরগাঁও), ফারুক লস্কর, বীর প্রতীক (পিতা নুরুউদ্দিন লস্কর, আড়াল, সনমানিয়া), আ. হাই (পিতা আ. রহমান, সালদৈ ঘাগটিয়া), শিব্রত রায় (পিতা সুরুজ রায়, বর্জনা), মোহাম্মদ আলী (পিতা আ. গফুর, বেলাশী, রায়েদ), জসিম উদ্দিন (পিতা আ. গফুর, দেইলগাঁও), নুরুল ইসলাম খন্দকার (পিতা আ. হক, বেগুনহাটি, রানীগঞ্জ), রিয়াজ উদ্দিন (পিতা আ. ওহাব, দক্ষিণগাঁও, সনমানিয়া), আলিম উদ্দিন (পিতা আ. বারেক, দক্ষিণগাঁও, সনমানিয়া), বশির উদ্দিন (পিতা মহর আলী, আড়াল, সনমানিয়া), ইব্রাহীম (পিতা ইয়াছিন, চামুরখী), রেহান উদ্দিন (পিতা আছমত মৃধা, রায়েদ), মো. দৌলত হোসেন মোল্লা, বীর বিক্রম (পিতা আয়েত আলী, চরখামের, কড়িহাতা), মো. ফজলুল হক (বাগেরহাট, রায়েদ; সেনাবাহিনীর সদস্য), ফজলুল হক (উজলী, টোক; সেনাবাহিনীর সদস্য), মো. চাঁন মিয়া (কপালেশ্বর, সিংহশ্রী; সেনাবাহিনীর সদস্য) এবং আ. গফুর (চিনাডুলি, বাঘিয়া, তরগাঁও; সেনাবাহিনীর সদস্য)।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের স্মরণে কাপাসিয়া ব্রিজসংলগ্ন বাস টার্মিনালের উত্তর পাশে কাপাসিয়া-ঢাকা এবং ঢাকা-কিশোরগঞ্জ সড়কের মধ্যবর্তী স্থানে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি স্মৃতি ভাস্কর্য স্থাপনের কাজ চলছে। শহীদ গিয়াস উদ্দীনের স্মরণে বারিষাব ইউনিয়নের জয়রামপুর গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে ‘গিয়াসপুর’। এখানে গিয়াসপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও গিয়াসপুর বাজার অবস্থিত। তরগাঁও গ্রামের তফিজ উদ্দিন মোক্তারের বাড়িতে শহীদ সাজ্জাদ, গিয়াস ও আ. আউয়াল স্মরণে তাঁদের নামসম্বলিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। চিনাডুলিতে শহীদ ইমতিয়াজ উদ্দিন সাজ্জাদ, ইকুরিয়া বাজারে শহীদ জসিম উদ্দিন এবং বেগুনহাটি গ্রামে শহীদ নুরুল ইসলামের কবর পাকা করা হয়েছে। কাপাসিয়া বাজার থেকে কলেজ রোড পর্যন্ত রাস্তা শহীদ শিব্রত রায়ের নামে, চেরাগালী মার্কেট থেকে কালীগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তা শহীদ ইব্রাহিমের নামে, রানীগঞ্জ থেকে গাজীপুর-তারাগঞ্জ রাস্তা শহীদ নুরুল ইসলামের নামে, কাপাসিয়া-রানীগঞ্জ রাস্তা থেকে দেইলগাঁও পাকা রোড শহীদ জসিম উদ্দিনের নামে, তরগাঁও সাবেক চেয়ারম্যান অফিস থেকে বাঘিয়া পর্যন্ত রাস্তা শহীদ ইমতিয়াজ উদ্দিন আহম্মদ সাজ্জাদের নামে, নবীপুর ব্রিজ থেকে মাঝিপাড়া পর্যন্ত রাস্তা শহীদ আবুল হোসেনের নামে, দিগধা আড়াল মিয়া বাড়ির ব্রিজ থেকে খালের ঘাট পর্যন্ত রাস্তা শহীদ খালেকের নামে, চরখামের জেলে পাড়া থেকে ইকুরিয়া পর্যন্ত রাস্তা শহীদ দৌলত হোসেন মোল্লার নামে, কাপাসিয়া-মনোহরদী রাস্তা থেকে বাওরাইদ পর্যন্ত রাস্তা শহীদ আ. হাইর নামে, গিয়াসপুর মোড় থেকে আমরাইদ পর্যন্ত রাস্তা শহীদ গিয়াস উদ্দিনের নামে, রায়েদ থেকে বাগেরহাট পর্যন্ত রাস্তা শহীদ ফজলুল হকের নামে, আমরাইদ থেকে কোঠামনি বাজার পর্যন্ত রাস্তা শহীদ মোহাম্মদ আলীর নামে, কোঠামনি থেকে দরগার বাজার পর্যন্ত রাস্তা শহীদ রেহান উদ্দিনের নামে, আড়াল বাজার থেকে কড়িহাতা পর্যন্ত রাস্তা শহীদ ফারুক লস্করের নামে, আড়াল গ্রামীণ ব্যাংক থেকে দিঘুলী বাজার পর্যন্ত রাস্তা শহীদ আলিম উদ্দিনের নামে, আড়াল হানিফের দোকান থেকে। হাতিরদিয়া বাজার পর্যন্ত রাস্তা শহীদ রিয়াজ উদ্দিনের নামে, আড়াল স্কুল থেকে সালদৈ পর্যন্ত রাস্তা শহীদ বাসির উদ্দিনের নামে, কপালেশ্বর থেকে কোঠামনি বাজার পর্যন্ত রাস্তা শহীদ ফজলুল হকের নামে, বীর উজলী থেকে ডুমদিয়া পর্যন্ত রাস্তা শহীদ মো. চাঁন মিয়ার নামে এবং বাঘিয়া চিনাডুলি মোড় থেকে খালের ঘাট পর্যন্ত রাস্তা শহীদ গফুর মিয়ার নামে নামকরণ করা হয়েছে। [মুহম্মদ শহীদুল্লাহ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড