মুক্তিযুদ্ধে কাপ্তাই উপজেলা (রাঙ্গামাটি)
কাপ্তাই উপজেলা (রাঙ্গামাটি) পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাচীন থানাগুলোর একটি। ১৯৫৮-৬২ সময়ে এখানে বাঁধ নির্মাণ করে তৈরি করা হয় এশিয়াখ্যাত বিশাল কাপ্তাই হ্রদ। ৭২৫ বর্গকিলোমিটার দীর্ঘ এ হ্রদের তীর ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে কাপ্তাই শহর। দেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এটি এখানে রয়েছে চন্দ্রঘোনা পেপার মিলস। শতশত কর্মকর্তা ও কর্মচারীর কারণে কাপ্তাই সব সময় সরগরম থাকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি একদিকে কর্ণফুলী নদী, অপর দিকে কাপ্তাই হ্রদের জলরাশি এর সৌন্দর্যকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। ২৭৩.২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে এ উপজেলার সীমানা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পাশাপাশি। আমেরিকা, পাকিস্তান ও ভারতের বেশকিছু লোকের অবস্থান ছিল এখানে। তখন প্রায় বিশ হাজার লোকের বসবাস ছিল এ উপজেলায়। কাপ্তাই উপজেলার পূর্বে বিলাইছড়ি, পশ্চিমে রাঙ্গুনিয়া, উত্তরে কাউখালী ও রাঙ্গামাটি সদর এবং দক্ষিণে রাজস্থলী উপজেলা। ১৯৭০ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি আন্দোলন-সংগ্রামে এখানকার লোকজনের ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। নির্বাচনের পর যখন পাকিস্তানের সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ষড়যন্ত্র করছিল, তখন সারাদেশের মতো কাপ্তাই উপজেলার লোকজনও আন্দোলন- সংগ্রামে লিপ্ত হয়।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১লা মার্চ স্থগিত করলে শহরজুড়ে মিছিল-মিটিং চলতে থাকে। লাল ও সবুজ রঙের বাংলাদেশের পতাকা সরকারি-বেসরকারি ভবনগুলোতে উড়তে দেখা যায়। এদিকে পাকিস্তান থেকে জাহাজে করে সেনা, গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র আনার পর এটা সবার কাছে নিশ্চিত হয়ে যায় যে, পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠেছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহেই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ম্যানেজার শামসুদ্দিন ও বাংলাদেশ- সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট (স্থানীয়ভাবে সুইডিশ নামে পরিচিত)-এর প্রিন্সিপাল ফারুক আজিজ খানসহ কয়েকজন চিটাগাং রাইফেল ক্লাবে রাইফেল ও বন্দুকের গোলাগুলি কিনতে যান। তাঁরা ক্লাবে পৌঁছে দেখেন ক্লাবের সমস্ত গোলাবারুদ জব্দ করা হয়েছে। শহরের আন্দরকিল্লায় অল্প কয়েকটি বন্দুকের দোকান খোলা ছিল। সেখান থেকেও সেনাবাহিনী সব গোলাবারুদ নিয়ে দোকানগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। এর উদ্দেশ্য সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। কাপ্তাই ফিরে ঐদিন সন্ধ্যায় তাঁরা টেলিফোনে অন্যান্য কর্মকর্তা ও বন্ধু-বান্ধবদের খবরটি জানিয়ে দেন।
যুদ্ধ শুরুর পূর্বে দফায় দফায় মিছিল হতো। সুইডিশ থেকে বিশাল মিছিল আসত বাজারের দিকে। সেখান থেকে যেত পিডিবি এলাকায়। মিছিল শেষে বিশাল সমাবেশে বক্তব্য রাখতেন শামসুদ্দিন, পিডিবি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবদুর রশিদ, শ্রমিক নেতা রশিদ আহমদ চৌধুরী, প্রকৌশলী আবদুর রহমান, সুইডিশের অধ্যক্ষ ফারুক আজিজ খান প্রমুখ।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রলীগ নেতা শাহ আলম, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে কেপিএম স্কুলের ছাত্র শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী, রমজান আলী, আবুল কাশেম মল্লিক, রুহুল আমিন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শহীদসহ ১৭-১৮ জন যুবক ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের সভায় যোগ দেন। স্থানীয় ছাত্র- যুবকদের ঢাকা যাওয়ার জন্য কাপ্তাই এলাকার ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীরা অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেন।
চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দ মানচিত্রখচিত বাংলাদেশের পতাকা এবং নিউজ প্রিন্টে জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ ছাপানো লিফলেট সরবরাহ করতেন এবং স্থানীয় ছাত্ররা এসব বিতরণ করতেন। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-যুবকরা কাপ্তাই উপজেলার সকল অফিসের পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান।
ছাত্রলীগ নেতারা কাপ্তাই ও চন্দ্রঘোনার বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগান লেখেন এবং লোকজনদের স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেন। ২৫শে মার্চের আগে চন্দ্রঘোনায় এক সমাবেশ চলাকালে ছাত্ররা কেপিএম এবং আশপাশের সমস্ত অফিসের পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে সমাবেশ স্থলে পুড়িয়ে ফেলেন। এর পরের দিন প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের পতাকা টাঙিয়ে দেন।
কাপ্তাইয়ে ম্যানেজার শামসুদ্দিন, প্রকৌশলী শেখ রহমান, আবু সালেহসহ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঙালি কর্মচারীরা মিছিল- মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করতেন এবং মিছিলের আয়োজকদের সহযোগিতা করতেন। ম্যানেজার শামসুদ্দিনের নির্দেশে আবু সালেহ প্রায় পাঁচ শতাধিক লাঠি বানিয়ে স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের দেন। সাতই মার্চের পর থেকে সারাদেশ যখন উত্তাল হয়ে ওঠে, তখন কাপ্তাইয়ের লোকজনও আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে নেমে আসে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ আন্দোলনের ডাক দেন। কাপ্তাই বাংলাদেশ-সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্ররা মিছিল নিয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের দিকে যেতেন। সুইডিশের প্রিন্সিপাল ফারুক আজিজ খানসহ শিক্ষক-শিক্ষার্থী আর সাধারণ লোকজনও মিছিলে যোগ দিত। মিছিল জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ঢুকলে ম্যানেজার শামসুদ্দিনের নেতৃত্বে প্রকৌশলীরা, পিডিবি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রশিদসহ এর ছাত্র-শিক্ষকরা এবং প্রজেক্টের বাঙালি কর্মচারীরা তাতে যোগ দিতেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ম্যানেজার শামসুদ্দিন, এর প্রকৌশলী সালেহ, শ্রমিক নেতা রশিদ আহমদ চৌধুরী এবং পিডিবি স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রশিদ বসে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। সংগ্রাম কমিটির প্রধান করা হয় শ্রমিক নেতা রশিদ আহমদ চৌধুরীকে। এর সদস্য হিসেবে ছিলেন- রেফাত উল্লাহ, আবদুর রশিদ, আবদুল হামিদ, আলিউজ্জামান মজুমদার, আবুল কালাম, জয়নাল, রুহুল আমিন, কাদের, আলতাফ, সিরাজুল ইসলাম, রফিক, কাজী নুরুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম, মুজিবুর রহমান, শফিউল্লাহ, শফিক প্রমুখ ৩০-৪০ জন। সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। পিডিবি স্কুল মাঠে এদের প্রশিক্ষণ দিতেন বাঙালি ইপিআর জওয়ানরা। ২৬শে মার্চের পর ইপিআর জওয়ানরা রাঙ্গামাটি থেকে আসতে শুরু করলে তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া তাঁদের সঙ্গে আনা অস্ত্র পারাপার এবং তাঁদের চট্টগ্রামে যেতে সহযোগিতা করা হয়।
চট্টগ্রাম থেকে ডা. মাহফুজ রহমান, ইন্দু নন্দন দত্ত, এস এম ইউসুফ, সাবের আহমেদ আসগরি প্রমুখ নেতা কাপ্তাই ও চন্দ্রঘোনা স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন এবং মাঝে-মাঝে এখানে এসে মিছিলে নেতৃত্ব দিতেন। তাঁরা সমাবেশে বক্তব্য রেখে লোকজনদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যোগাতেন। কেপিএম স্কুলের ছাত্র শাহাদাৎ হোসেন, রমজান আলী, আবুল কাশেম মল্লিক, রুহুল আমিন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শহীদসহ ৩০-৪০ জন ছাত্র-যুবক সক্রিয়ভাবে আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। এ-সময় তাঁরা প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন। সাতই মার্চের পর থেকে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। কেপিএম স্কুল মাঠে ছাত্র- যুবকদের সঙ্গে কেপিএম-এর কিছু কর্মচারীকেও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কেপিএম-এর সিকিউরিটি গার্ড জাকির হোসেন জমাদার ও হানিফ জমাদার (ইপিআর-এর অবসরপ্রাপ্ত দুই সদস্য) প্রশিক্ষণ দিতেন। প্রশিক্ষণ নেয়া ছাত্র-যুবক, কেপিএম কর্মচারী ও সাধারণ লোকজনের মধ্যে ছিলেন- আবদুল হামিদ, হাফিজ উল্লাহ, দুলা মিয়া, নুরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর আলম, আবুল কালাম, জাহাঙ্গীর, আবদুর রব, জাফর আহমদ, সিদ্দিক আহমদ, নুরুল আলম, মোহাম্মদ ইলিয়াস, নুরুল আজিম, শাহজাহান, মোশারফ হোসেন, মনছুর আমিন, বাদশা মিয়া, আবদুল আলী, শাহাদাত হোসেন, হারিছ, ফয়েজ আহমদ, শহীদুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম বাঙালি, আনিছুর রহমান, রমজান আলী, নুরুচ্ছফা, নওয়াব আলী সরকার, শহীদুল আলম, নুরুল আলম খোকা, রুবেল আমিন, আবদুল্লাহ হেলালী, আবুল বশর, সাদেক, বিমল, আবদুস শুক্কুর, আবদুল খালেক, আবুল কাসেম মল্লিক, শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী, শেখ মুজিব, নুরুল হোসেন মিয়া, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শহীদ প্রমুখ। স্কুল মাঠ ও মেডিনিটি সেন্টার মাঠে কাঠ ও বাঁশের বন্দুক দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। কেপিএম-এর ক্যামিস্ট মোশাররফ স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের এসিড দিয়ে বোমা বানানো শেখাতেন। একদিন বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে তিনি শাহাদাৎ বরণ করেন।
চন্দ্রঘোনার ১৪নং বাংলোতে বিশাল এক ওয়ারলেস টাওয়ার ছিল। ঐ টাওয়ার থেকে ওয়ারলেসে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেত। সাতই মার্চের পর চট্টগ্রাম মেডিকেলেজের ছাত্র শাহ আলম, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে আবুল বশর, বাদশা, রমজান আলীসহ একদল ছাত্র সেখানে যান। টাওয়ারের সিকিউরিটি গার্ড ছিল দুজন পাকিস্তানি। একজনের কাছে বন্দুক, আরেকজনের কাছে রাইফেল ছিল। ছাত্ররা গিয়ে সিকিউরিটি দুজনের কাঁধে লাঠি দিয়ে আঘাত করে তাদের অস্ত্র কেড়ে নেন। আঘাতে দুজনই পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। এরপর তাঁরা ট্রান্সমিটার খুলে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে শাহ আলম চৌধুরী এটি ভারতে নিয়ে যান।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সমন্বয়ে ২০-২১ জনের একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। কমিটির সভাপতি করা হয় স্থানীয় কেপিএম-এর জুনিয়র অফিসার আলী আহমদ চৌধুরীকে এবং সাধারণ সম্পাদক করা হয় কেপিএম-এর স্টোর কিপার নুরুন্নবীকে। এ-সময় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন বাদশা ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন রমজান আলী। চন্দ্রঘোনায় ডা. শাহ আলম, বীর উত্তম ‘সবুজ সংঘ’ নামে একটি সামাজিক ও ক্রীড়া সংগঠন গঠন করেছিলেন। ঐ ক্লাবের সদস্য ছিল ৪০-৫০ জনের মতো। ক্লাবের সব সদস্যই প্রশিক্ষণ ও আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
এদিকে পাকসেনাদের সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকানো ও তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মচারী ও সুইডিশের ছাত্রদের নিয়ে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়, যা পূর্বে উল্লিখিত। কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রশিদ আহমদ চৌধুরীকে প্রধান করে গঠিত এ কমিটিতে কাপ্তাই ভিত্তিক অন্যান্য সংগঠনের প্রতিনিধিদের সদস্য হিসেবে রাখা হয়। কমিটির কাজ ছিল সেনা আক্রমণের মুখে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায়, সে ব্যাপারে পরিকল্পনা তৈরি করা; একই সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ অনুসারে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা। সাধারণত চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের কার্যালয় থেকে টেলিফোনে বিভিন্ন নির্দেশনা আসত। আবদুল হান্নান তখন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। চট্টগ্রামের বিভিন্ন বিষয়ে তিনি নির্দেশনা দিতেন।
২৫শে মার্চ রাতেই চট্টগ্রাম থেকে ইপিআর এডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের পক্ষ থেকে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবহিনীর অপারেশন সার্চলাইট নামে মানুষের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ ও গণহত্যার খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী কাপ্তাই ইপিআর শিবিরে ছুটে যান। তিনি তখন সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। পাকিস্তানি মেজর পীর মোহাম্মদ কোনো কিছু আঁচ করতে পারার আগেই ক্যাপ্টেন হারুন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। এনসিওদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে পিছমোড়া করে হাত বেঁধে একটি বিশাল কক্ষে তাদের আটকে রাখা হয়। এভাবে শুরুতেই ক্যাপ্টেন হারুন বিদ্রোহ করেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই মেজর পীর মোহাম্মদের বাড়িটি ইপিআর জওয়ানরা ঘিরে ফেলেন এবং তাকে গৃহবন্দি করা হয়। এরপর ক্যাপ্টেন হারুন ট্রুপস নিয়ে রাতেই চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে মুভ করেন।
মেজর পীর মোহাম্মদ গোপনে পূর্বে কয়েকজন অবাঙালিকে কিছু অস্ত্র সরবরাহ করে বলেছিল, নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তারা যেন বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু ২৫শে মার্চ রাতে ক্যাপ্টেন হারুন খবর পাওয়া মাত্র ইপিআর জওয়ানদের নির্দেশ দিয়ে এদের নিরস্ত্র করেন। ফলে বড় ধরনের বিপদ থেকে বেঁচে যায় নিরস্ত্র বাঙালিরা।
কয়েকদিন পর রাঙ্গামাটির মহকুমা প্রশাসক এম আব্দুল আলী কাপ্তাইয়ে আসেন। কাপ্তাইয়ে যাতে শত্রুবাহিনী প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য তিনি সব ধরনের চেষ্টা করেন। তাঁর সহকর্মী ও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট রহমতুল্লাহ তাঁকে রাঙ্গামাটি ফিরে যেতে নিষেধ করলেও তিনি তা না শুনে সেখানে ফিরে আসেন। এর কয়েকদিনের মধ্যেই অস্ত্রসহ পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েন। তাঁকে ১২ দিন নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যা করা হয় (দ্রষ্টব্য এম আব্দুল আলী)।
১৪ই এপ্রিল পাকসেনারা কাপ্তাই দখলে নিয়ে বেশ কয়েকজনকে হত্যা করে। তারা কাপ্তাই ও চন্দ্রঘোনার বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্পগুলো হলো- ডিসিএন বাংলো, এ ব্লকের তিনতলা বিল্ডিং (কলাবাগান), কাপ্তাই হাইস্কুল, সুইডেন ইনস্টিটিউট এবং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এসব ক্যাম্পে দু-তিনশ পাকসেনা ছিল।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কাপ্তাই ও চন্দ্রঘোনা দখলে নেয়ার পর লোকজন জীবনের ভয়ে দিগবিদিক ছুটতে থাকে। নৌপথ কিংবা সড়ক পথে পালানোর সুযোগ ছিল না, কারণ পাকবাহিনী সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। এর মধ্যেও অনেকে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ায়।
কর্নফুলী নদীর অপর পাড়ে চিরম। সেখানে জঙ্গলের মধ্যে আত্মগোপন করার জন্য কিছু লোক ছুটে যায়। চিরম বাজার জামে মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ও ইমাম ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ সিরাজুল হক। তিনি মসজিদের ইমাম হওয়ার সুবাধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে মসজিদে অমুসলিমদের আশ্রয় দেন। তিনি তিনটি হিন্দু পরিবারকে নিজের ঘরে আশ্রয় দিয়ে তাদের রক্ষা করেন। এছাড়া হানাদার বাহিনীর ভয়ে গোপন জায়গায় আশ্রয় নেয়া বাঙালিদের খাবার সরবরাহ করতেন। এ কাজে তাঁর ছেলে ও এলাকার যুবকরা সক্রিয় ভূমিকা রাখে। মুহাম্মদ সৈয়দ, আবদুল হালিম, এলাহী বক্স, অংথুই মারমা, টি এস তালুকদার, সাধন চক্রবর্তী প্রমুখ ইমামের বাসা থেকে রান্না করা খাবার জঙ্গলে আশ্রয় নেয়া লোকদের সরবরাহ করতেন।
পাকিস্তানী বাহিনী কাপ্তাই দখলে নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত অবাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ব্যবসায়ীরা অনেকটা নীরব ছিল। কিন্তু কাপ্তাই দখল হয়ে যাবার পর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের অবাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হিংস্র হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- জাইদি ফারুকী (পিডিবি কর্মকর্তা), ফারুকী (পিডিবি কর্মকর্তা), আবদুল্লাহ (পিডিবি কর্মকর্তা), হানিফ (পিডিবি কর্মকর্তা), জিয়ার খান (ইউপি চেয়ারম্যান), আরজি খান (ব্যবসায়ী), নজরুল খান (ব্যবসায়ী), মিত্র আর জি খান (ব্যবসায়ী), উজির গুল খান (ব্যবসায়ী), রহিম গুল খান (ব্যবসায়ী), কমর গুল খান (ব্যবসায়ী), গুলতুদ্দিন খান (ব্যবসায়ী), কামাল উদ্দিন খান (ব্যবসায়ী), আলম উদ্দিন খান (ব্যবসায়ী), লাল বাদশাহ (ব্যবসায়ী), রেজাউল (মৎস্য অফিসার), নেওয়ার খান (নিরাপত্তা রক্ষী), মুসা খান (দারোয়ান) ও সুবহান (নিরাপত্তা রক্ষী)। এদের সঙ্গে যোগ দেয় স্থানীয় পাহাড়িরা। তারা চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের নির্দেশে পাকিস্তানি বাহিনীকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করে। পাকসেনারা কাপ্তাই দখলে নেয়ার পর সর্বত্র ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। যাকে যেখানে পেয়েছে গুলি করে হত্যা করেছে। চন্দ্রঘোনার কলাবাগানের একটি ক্লাব ঘরে ৫-৬ জন লোক খেলছিল। এ খবর রাজাকার-দের মাধ্যমে পাকসেনারা জানতে পেরে সেখানে গিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে তাদের হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি পাকিস্তানি বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় কয়েকশত ঘরবাড়ি লুটপাট করে পুড়িয়ে দেয়।
পাকসেনারা কাপ্তাই দখলে নেয়ার পর বিহারিরা অত্যাচার- নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চালায় এবং তাদের সহযোগিতা করে। তাদের এসব দুষ্কর্মে স্থানীয় পাহাড়িরা যোগ দেয়। পার্শ্ববর্তী রাঙ্গুনিয়া উপজেলা থেকে রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত কাপ্তাই আসা-যাওয়া করত। তারা লোকজনের ঘরবাড়ি লুট করত।
চন্দ্রঘোনায় প্রবেশ করে পাকসেনারা হত্যালীলায় মেতে ওঠে। তারা যাকে যেখানে পেয়েছে হত্যা করেছে। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়েক লাইনে ঘর ছিল। পাকসেনারা কাপ্তাই দখলে নেয়ার পর রাজাকারদের সহযোগিতায় একশর মতো ঘর পুড়িয়ে দেয়। রাজাকাররা বাড়িঘরের মালামাল লুট করে নেয়। পাকসেনারা চন্দ্রঘোনার কেপিএম ও কলাবাগানসহ বিভিন্ন স্থানেও ব্যাপক অগ্নিসংযোগ করে।
পাকসেনারা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ঢুকে ঘর থেকে ম্যানেজার শামসুদ্দিন ও প্রকৌশলী সালেহকে ধরে এনে বাঁধের অদূরে নিয়ে গুলি করে। প্রথমে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শামসুদ্দিন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ দৃশ্য দেখে প্রকৌশলী সালেহ অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তবে ঘটনাক্রমে তিনি বেঁচে যান। এছাড়া আরো যাদের হত্যা করা হয়, তারা হলেন- আবদুল বারী খান, হাজী ছমির আহমদ, মকবুল আহমদ, মো. ইউসুফ, মো. ছদর আলী মোল্লা, মো. শামছুল হক সরকার, মো. হাফিজ উল্লাহ, মো. গোলাম রহমান, মো. ফজলুল হক, মো. মহসীন, মো. মনজুর আলম, মো. আবদুল করিম, মো. আবদুল আজিজ, মো. দেয়াজ উদ্দিন চৌধুরী, মো. শফি, মো. সুরজাত আলী, আহমদ হোসেন, আবুল বশর, মো. হামিদুল হক, মো. আমিন উল্লাহ ফকির, মো. আবদুল জব্বার, মো. আবদুর রশিদ, মো. সাহাব মিয়া, মো. নজির আহমদ, মৌলবি মো. সাইফুল্লাহ, মস্তান আলী, বাগ্মীশ্বর বড়ুয়া, চিছা মেঘ, অমল আচার্য, মোছাম্মৎ শামছুন নাহার বেগম, মোছাম্মৎ আম্বিয়া খাতুন প্রমুখ। চন্দ্রঘোনায় কোব্বাদ কন্ট্রাক্টর, সিলেটি আলিম, আয়াত উল্লাহ, নুরুল আমিন ড্রাইভার, ইকবাল (পান্না ড্রাইভারের ছেলে)-সহ ১৫- ১৬ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
পাকসেনাদের ডিসিএন বাংলো, এ ব্লকের তিনতলা বিল্ডিং (কলাবাগান), কাপ্তাই হাইস্কুল, সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ক্যাম্প ছিল নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এসব ক্যাম্পে রাজাকারদের সহায়তায় লোকজনদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো।
কাপ্তাই উপজেলায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়নি। তবে এ উপজেলার অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। কাপ্তাইয়ের অনেক ছাত্র-যুবক, কেপিএম ও পিডিবি-র অনেক শ্রমিক-কর্মচারী মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। কাপ্তাই, সুইডিশ ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে রশিদ আহমদ চৌধুরী, রেফাত উল্লাহ, আবদুর রশিদ, আবদুল হামিদ, আলিউজ্জামান মজুমদার, আবুল কালাম, জয়নাল, রুহুল আমিন, কাদের, আলতাফ, সিরাজুল ইসলাম, রফিক, নুরুল ইসলাম, মুজিবুর রহমান শফিউল্লাহ, শফিক, নুরুল ইসলাম সহ ৩০-৪০ জন ছাত্র-যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। এছাড়া চন্দ্রঘোনা রেয়ন ও পেপার মিলস থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাঁরা হলেন- আবদুল হামিদ, হাফিজ উল্লাহ, দুলা মিয়া, নুরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর আলম, আবুল কালাম, জাহাঙ্গীর, আবদুর রব, জাফর আহমদ, সিদ্দিক আহমদ, নুরুল আলম, মোহাম্মদ ইলিয়াস, নুরুল আজিম, শাহজাহান, মোশারফ হোসেন, মনছুর আমিন, বাদশা মিয়া, আবদুল আলী, শাহাদাত হোসেন, হারিছ, ফয়েজ আহমদ, শহীদুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম বাঙালি, আনিছুর রহমান, রমজান আলী, নুরুচ্ছফা, নওয়াব আলী সরকার, শহীদুল আলম, নুরুল আলম খোকা, রুবেল আমিন, আবদুল্লা হেলালী, আবুল বশর, আবদুল খালেক, কাসেম মলিল্লক, শেখ মুজিব, নুরুল হোসেন মিয়া প্রমুখ। এঁদের মধ্যে আবুল কালাম যুদ্ধকালীন সময়েই সিপাহি থেকে ল্যান্স নায়েক পদে উন্নীত হন। নুরুল আলম এফএফ সদস্য হিসেবে নোয়াখালীতে যুদ্ধে অংশ নেন। অন্যরা ‘জেড’ ফোর্সের সদস্য হিসেবে ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেটের সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রায় ২০০ মুক্তিযোদ্ধাসহ মেজর টি এম আলী ও পরে সুবেদার আবু বকর সিদ্দিকী আরো ২০০ মুক্তিযোদ্ধাসহ কাপ্তাই আসেন এবং রাঙ্গুনিয়ায় বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেন। ১৬ই ডিসেম্বর কাপ্তাই উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
কাপ্তাই উপজেলার দুজন মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হন। তাঁরা হলেন— ডা. শাহ আলম, বীর উত্তম- ও ক্যাপ্টেন ইঞ্জিনিয়ার ইসহাক, বীর প্রতীক- (কেপিএম-এর ক্যামিকাল ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে খুলনায় বসবাসরত)।
কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকায় শহীদ শামসুদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও শহীদ এ কে এম শামসুদ্দিন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া নৌবাহিনীর সদস্য শহীদ মোয়াজ্জেমের নামে নৌবাহিনীর উদ্যোগে শহীদ মোয়াজ্জেম সড়ক ও শহীদ মোয়াজ্জেম নৌঘাঁটির নামকরণ করা হয়। [ইয়াছিন রানা সোহেল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড