কামান্না ট্র্যাজেডি (শৈলকুপা, ঝিনাইদহ)
কামান্না ট্র্যাজেডি (শৈলকুপা, ঝিনাইদহ) সংঘটিত হয় ২৬শে নভেম্বর ভোররাতে। ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার একটি ছোট গ্রাম কামান্না। উপজেলা সদর থেকে এর দূরত্ব মাত্র ১৪ কিমি। কুমার নদের পাড়ে অবস্থিত এ গ্রামটি মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল মুক্ত এলাকা। ২৫শে নভেম্বর শৈলকুপা থানাকে হানাদারমুক্ত করার উদ্দেশ্যে মাগুরা জেলার হাজিপুর ও আশপাশের গ্রামের মুজিব বাহিনীর ৪২ জন মুক্তিযোদ্ধা মো. নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে রওনা হন। পথিমধ্যে সন্ধ্যা নেমে এলে নিরাপদ এলাকা ভেবে কামান্না গ্রামের মাধব বাবুর বাড়িতে তাঁরা আশ্রয় নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের এ বাহিনীর মূল কমান্ডার ছিলেন শ্রীপুর উপজেলার বাড়েলা গ্রামের আব্দুল হাই। তিনি কামান্না গ্রামে বিয়ে করেন। আত্মীয়তার সূত্রে নিরাপদ ভেবে তিনি মাধব বাবুর বাড়িতে ঐ গ্রুপকে রেখে শ্বশুর বাড়িতে অবস্থান করেন। রাতে এ গ্রামেরই এক দালাল শৈলকুপায় অবস্থিত রাজাকার, আলবদর- ও -আলশামস বাহিনীকে খবর দেয়। খবর পেয়ে শৈলকুপার চতুড়ার রাজাকার কমান্ডার নওশের আলী ঝিনাইদহ এবং মাগুরায় অবস্থিত পাকবাহিনীকে খবর দেয়। এ খবর পেয়ে ঝিনাইদহ ও মাগুরা ক্যাম্প থেকে একদল পাকসেনা এসে মাধব বাবুর বাড়ি ঘিরে ফেলে। এ-সময় মাধব বাবুর বাড়ি থেকে ৩০০ গজ উত্তরে বাড়ির প্রবেশপথে একজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা পাহারায় ছিলেন। পাকবাহিনী প্রথমে তাকে হত্যা করে। এরপর ফজরের আজানের সময় হানাদারদের রাইফেল ও স্টেনগান গর্জে ওঠে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অপ্রত্যাশিত এ আক্রমণে ঘুম থেকে জেগে ওঠা মুক্তিযোদ্ধারা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। ন্যূনতম প্রস্তুতি নেয়ার সময়ও তাঁরা পাননি। তাই হঠাৎ আক্রমণে কেউ ঘরের মধ্যে, কেউ বা বাইরের উঠানে পাখির মতো গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়েন। এরূপ নির্মমভাবে শহীদ হন ২৭ জন মুজিবসেনা।
পাকবাহিনী ফেরার পথে নদীতে চাল ধৌত অবস্থায় রঙ্গবিবি নামক একজন মহিলাকে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া অদূরে ঝোপঝাড়ের মধ্যে প্রাতঃকৃত্যরত অবস্থায় ফণীভূষণ নামে একজন গ্রামবাসীকে তারা গুলি করে হত্যা করে। অতঃপর নদী পাড় হয়ে তারা ঝিনাইদহে চলে যায়।
কামান্না ট্র্যাজেডির শিকার ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধা হলেন: মো. আলমগীর হোসেন (পিতা মতিয়ার রহমান, হাজিপুর), অধীর শিকদার (পিতা দয়াল শিকদার, হাজিপুর), গৌড় চন্দ্র রায় (পিতা পুলিন চন্দ্র রায়, হাজিপুর), মো. শহিদুল ইসলাম (পিতা নুরুল কাদের, হাজিপুর), মো. মমিন উদ্দিন (পিতা সুলতান শেখ, ফুলবাড়ী), মো. ওয়াহেদ বিশ্বাস (পিতা আব্দুল জলিল বিশ্বাস, ফুলবাড়ী), মুন্সী আলিমুজ্জামান (পিতা মুন্সী আব্দুর রাকিব, বিষ্ণুপুর), হোসেন আলি বিশ্বাস (পিতা আব্দুল বারিক বিশ্বাস, শ্রীমন্তপুর), মো. শরিফুল ইসলাম (পিতা তোরাব আলি, শ্রীমন্তপুর), মো. আনিসুর রহমান (পিতা মৌ. আব্দুর রাজ্জাক, শ্রীমন্তপুর), মো. নাসিম মিয়া (পিতা খেলাফত হোসেন, শ্রীমন্তপুর), মো. মনিরুজামান ওরফে মনি খাঁ (পিতা সুরুজ মিয়া, শ্রীমন্তপুর), মো. আলী হোসেন (পিতা আব্দুল হামিদ, আড়ালিয়া), মো. কাওছার শেখ (পিতা বাহাদুর শেখ, মির্জাপুর), মুন্সী আব্দুল মতলেব (পিতা মুন্সী এলেম আলী, ইছাখাদা), মো. সলেমান শিকদার (পিতা আকরাম শিকদার, নরসিংহহাটি), মো. রিয়াদ আলী মণ্ডল (পিতা উজির আলী মণ্ডল, আলীধানী), খন্দকার রাশেদ আলী (পিতা খন্দকার আব্দুল মাজেদ, শিবরামপুর), সেলিম বিশ্বাস (পিতা আব্দুল মজিদ, শিবরামপুর), নির্মল কুমার বিশ্বাস (পিতা নরহরি বিশ্বাস, বাগডাঙ্গা), মো. তাজুল ইসলাম (পিতা শরাফত আলী, পারনান্দুয়াল), মো. গুলজার খাঁ (পিতা দয়াল খাঁ, মালিগ্রাম), মো. আব্দুল আজিজ (পিতা শমসের আলি, নিশ্চিন্তপুর), মো. আব্দুর রাজ্জাক (পিতা আনছার আলি, বারইপাড়া), মো. মালেক হোসেন (পিতা ইয়াছিন আলী, দাড়িয়াপুর), মো. আব্দুল কাদের (পিতা মদন বিশ্বাস, কাজলী) এবং মো. গোলাম আকবর (পিতা মসলেম আলী, কেয়াগ্রাম, পাংশা)। শেষের জন বাদে বাকি সবাই মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার অধিবাসী। পরদিন সকালে হাজার- হাজার শোকার্ত মানুষ চোখের জলের মধ্য দিয়ে ঘটনাস্থলের কাছেই কুমার নদের পাড়ে কামান্না হাইস্কুলের খেলার মাঠের উত্তর পাশে এঁদের কবর দেয়। ছয়জন করে দুটি কবরে ১২ জন এবং ৫ জন করে ৩টি কবরে ১৫ জনকে কবর দেয়া করা হয়। এদের স্মরণে শৈলকুপায় নামসহ একটি স্মৃতিফলক রয়েছে। [মো. আব্দুল ওহাব]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড