You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে কানাইঘাট উপজেলা (সিলেট)

কানাইঘাট উপজেলা (সিলেট) জেলা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এ উপজেলার এক পাশে ভারতীয় সীমান্ত, অন্যান্য পাশে সিলেটের জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কানাইঘাট উপজেলার জনগণ আওয়ামী লীগ-এর প্রার্থীকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে। এ নির্বাচনের পথ ধরেই দেশের অন্যান্য জায়গার মতো কানাইঘাটেও মুক্তিযুদ্ধের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী – এবং মুসলিম লীগ-এর নেতারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রচারণায় সোচ্চার ছিল। সিলেট জেলা জামায়াতের নেতা মাওলানা আবু সায়িদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতার অংশ হিসেবে কানাইঘাটের মনসুরিয়া মাদ্রাসায় এক সমাবেশে ফতোয়া দেয়, ‘যারা পাকিস্তান ভাঙতে চায় কিংবা যারা স্বাধীনতার পক্ষের লোক, তারা কাফের’। এই ফতোয়া জারির পর থেকে উপজেলায় দালালদের সংখ্যা বেড়ে যায়। তবে স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে কানাইঘাট উপজেলার মানুষজন ছিল সক্রিয়। এমনি অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগ থেকেই যুদ্ধের এক ধরনের প্রস্তুতি নিতে থাকে এ উপজেলার স্বাধীনতাকামী মানুষ।
কানাইঘাট আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ডা. ফয়জুল হক ও সাধারণ সম্পাদক মশাহিদ উদ্দিনসহ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনগণের কাছে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রিম বার্তা পৌঁছে দিতে থাকেন এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য এলাকার ছাত্র-যুবকদের প্রস্তুত করে তোলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে তারা বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই উপজেলার বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সীমান্তবর্তী আসামের কাছাড় জেলার লোহারপুল এলাকার একটি পাহাড়ে কানাইঘাটের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
কানাইঘাট আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ডা. ফয়জুল হক, সাধারণ সম্পাদক মশাহিদ উদ্দিন, লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়নের কান্দলা গ্রামের কন্টু মিয়া এবং মুলাগুল গ্রামের মনোহর মিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে ও প্রশিক্ষণ প্রদানে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠাতেও তাঁরা ভূমিকা রাখেন।
পাকবাহিনীর আগমনের খবরে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা উপজেলার বড়চতুল, মালিগ্রাম, সড়কের বাজার প্রভৃতি এলাকায় তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এর অংশ হিসেবে কোথাও-কোথাও তাঁরা ব্রিজ ধ্বংস করার চেষ্টা করেন।
এপ্রিল মাসের প্রথমদিকে পাকবাহিনী তাদের দোসর মুসলিম লীগ নেতা আব্দুস সালাম (সালাম মিয়া মিনিস্টার) এবং ইফজালুর রহমানের সহায়তায় কানাইঘাট উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে এবং সদর ডাকবাংলোতে ক্যাম্প স্থাপন করে।
মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা এ উপজেলার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী ছিল। তাদের নেতৃত্বে বিভিন্ন বাহিনী গড়ে ওঠে। পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশের পর জেলা জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষনেতা মাওলানা লুতফুর রহমান (বানীগ্রাম), তার ভাই মৌলভী আলতাফুর রহমান, জামায়াত নেতা মাওলানা আবু সায়িদ চৌধুরী (সড়কের বাজার, বর্তমানে লন্ডনে অবস্থানরত), শামসুল হক মিয়া (ঝিংগাবাড়ী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান), হাফেজ মনজুর আহমদ (ছত্রপুর) প্রমুখের নেতৃত্বে রাজাকার- বাহিনী গঠিত হয়।
মুসলিম লীগ নেতা ইফজালুর রহমান (চরিপাড়া, পরবর্তীকালে কানাইঘাট উপজেলা বিএনপির সভাপতি এবং স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান), আব্দুস সালাম (সাবেক মন্ত্রী, সোনাপুর), মোহাম্মদ আলী মেম্বর (বড়দেশ, বর্তমানে বিএনপি নেতা এবং স্থানীয়ভাবে আড়া মোহাম্মদ হিসেবে পরিচিত), আলাই মেম্বার (দলইমাটি), বতাই মোল্লা (ধনপুর), মুবেশ্বর আলী মেম্বার (সুরইঘাট নয়াগ্রাম), আলমগীর (ডালাইরচর), আব্দুল মালিক (দুর্লভপুর), আলাউদ্দিন (চরিপাড়া), জমসেদ মিয়া (দুর্লভপুর), মনুফর পঞ্চায়েত (কুওরগড়ি), খারই মিয়া (মহেষপুর), মৌলভী আলতাফুর রহমান (বাণীগ্রাম), কনুমান হাজী (বড়দেশ) প্রমুখ শান্তি কমিটি – আলবদর – ও – আলশামস- বাহিনীর সক্রিয় নেতা ছিল।
শান্তি কমিটির নেতা ইফজালুর রহমান এবং আলাই মেম্বরের বাড়ি উপজেলা সদরের পাশে হওয়ায় বিভিন্ন সময় পাকবাহিনীকে উপজেলায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তারা প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে। অনুপ্রবেশের পর পাকবাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় ফয়জুল হক (মহেষপুর) এবং আব্দুর রহীম (নন্দিরাই)-কে হত্যা করে। রাজাকার নেতা আতাউর রহমান আতাই, আমজাদ আলী, বশির আহমদ প্রমুখের সহায়তায় পাকবাহিনী গৌরীপুর গ্রামে সাদাত হোসেনের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে তুলে নিতে চাইলে বাধা দেয়ায় সাদাত হোসেনকে হত্যা করে। ২৮শে আগস্ট মালিগ্রামে দুজন রাজাকার নিহত হলে ৩০শে আগস্ট পাকবাহিনী মালিগ্রামের খলিলুর রহমান, চান্দ আলী ও বতু মিয়াকে হত্যা করে। মৌলভী আলতাফুর রহমান এবং হাফেজ মনজুর আহমদ চারখাইয়ের বিভিন্ন হিন্দু বাড়ির মালামাল লুটপাট এবং লোকজনদের নির্যাতন করে। জামায়াত নেতা লুতফুর রহমান, আবু সায়িদ চৌধুরী ও শামসুল হক মিয়া জেলা পর্যায়ের নেতা হওয়ার কারণে শুধু কানাইঘাট উপজেলা নয়, সিলেট জেলা সদর এবং অন্যান্য উপজেলায়ও পাকবাহিনীকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে। পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের অত্যাচার-নির্যাতনে অনেক জায়গায় হিন্দুধর্মের অনুসারীরা নিজদের রক্ষার জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা কানাইঘাটে ১০৫টি অগ্নিসংযোগ এবং ১০০টি লুটপাটের ঘটনা ঘটায়। এছাড়া তারা ২২৫ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে।
১৯শে আগস্ট পাকবাহিনীর দোসর মোহাম্মদ আলী মেম্বর এবং খারই মিয়ার সহযোগিতায় উপজেলা সদর সংলগ্ন বিষ্ণপুর গ্রামে মালিগ্রাম গণহত্যা সংঘটিত হয়। এ গণহত্যায় ১৯ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। পাকবাহিনী তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করে বিষ্ণপুর খালের পাড়ে গণকবর দেয়। উপজেলা সদরে পাকবাহিনীর ডাকবাংলো ক্যাম্প ছিল নির্যাতনকেন্দ্র। থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মশাহিদ উদ্দিনকেও এ ক্যাম্পে এনে নির্যাতন করা হয়। হানাদার বাহিনীর এসব কাজে সহযোগিতা করত রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর লোকজন।
উপজেলা সদরের বিষ্ণুপুরের খালটি কানাইঘাটের বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। এ খালের পাড় গণকবর হিসেবে চিহ্নিত। এ স্থানটি ডাকবাংলো তথা হানাদার বাহিনীর নির্যাতন ক্যাম্পের পাশাপাশি ছিল বলে একে গণহত্যার জন্য বেছে নেয়া হয়। তাছাড়া এ গণহত্যার প্রধান দোসরদের বাড়ি ছিল এ স্থানের আশেপাশে।
২৮শে আগস্ট মালিগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাজাকারদের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে দুজন রাজাকার মারা যায়। নভেম্বরের শেষদিকে উপজেলার ভাড়ারীমাটি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। যুদ্ধে পাকবাহিনী পিছু হটে এবং দুজন রাজাকার নিহত হয়।
কানাইঘাট থানা হানাদারমুক্ত করার জন্য ২৬শে নভেম্বর জেড ফোর্সের ক্যাপ্টেন রব কানাইঘাট দরবস্ত সড়কের লোভাছড়া চা বাগানে অবস্থান নেন। এতে পাকসেনাদের গতিবিধি সীমিত হয়ে পড়ে। একই সময় ৪ নং সেক্টরের লেফটেন্যান্ট গিয়াসের নেতৃত্বে একটি কোম্পানি কানাইঘাট দরবস্ত সড়কে এবং লেফটেন্যান্ট জহিরের নেতৃত্বে একটি কোম্পানি কানাইঘাট চুরখাই সড়কে ডিফেন্স নেয়। ২রা ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন রব দুটি কোম্পানি নিয়ে কানাইঘাট থানা আক্রমণ করলে তুমুল লড়াই শুরু হয়। ৩রা ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা তিনদিক থেকে পাকবাহিনীকে ঘিরে ফেলে সর্বাত্মক আক্রমণ করেন। এ আক্রমণে অধিকাংশ পাকসেনা নিহত হয় এবং ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর সরোয়ারসহ ২৫ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে। এ-যুদ্ধে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ২০ জন আহত হন। এছাড়া কানাইঘাটের মুক্তিযোদ্ধারা ৪ নং সেক্টরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে কুলাউড়া, শমসের নগর ও ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত যুদ্ধে অংশ নেন। ৬ই ডিসেম্বর কানাইঘাট উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
কানাইঘাট উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নূর উদ্দিন (পিতা হাজী আহমদ আলী, কুলরমাটি), তয়মুস আলী (পিতা গোলাম আকবর, নক্তিপাড়া), আ. লতিফ (পিতা গোলাম হায়দার, নক্তিপাড়া), শাহাদাত আলী (পিতা আরজদ আলী, ভাগারীমাটি), আহসান আলী (বাকালছড়া কলনী), শহিদুল হোসেন (আ. হক চৌধুরী, ছোটদেশ; জালালপুর সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), রফই (পিতা রোসন আলী, দুর্গাপুর), রফিকুল হক (পিতা ফয়াজ আলী, পূর্ব দর্পনগর) এবং সিপাহি মাহমুদ আলী (পিতা আসফর আলী, কায়স্তগ্রাম)। এ উপজেলায় ১৩ জন তালিকাভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন।
মালিগ্রাম গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে বিষ্ণুপুরের গণকবরটিকে দেয়াল দিয়ে বেষ্টন করে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। [এহসানুল হক জসীম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!