২১ জানুয়ারি, ২০১৩; সােমবার সকাল ১০টা ৪৪ মিনিট। দুই পক্ষের আইনজীবী, বিশিষ্টজন ও গণমাধ্যমের কর্মীতে ঠাসা আদালতকক্ষ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আসন নেন বিচারপতি মাে. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারক মাে. শাহিনুর ইসলাম । আসামি আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার পলাতক। তার অনুপস্থিতিতে ১০টা ৪৭ মিনিটে রায় ঘােষণা শুরু হয়। ১১টা ৫০ মিনেটে শেষ হয় রায় পড়া। রায়ে আবুল কালাম আযাদকে একই সঙ্গে মানবতাবিরােধী অপরাধ ও গণহত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ফাসিতে ঝুলিয়ে এই দণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এটিই দেশে মানবতাবিরােধী অপরাধের মামলায় প্রথম রায়। একই সঙ্গে বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে এই প্রথম কাউকে একাত্তরের গণহত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের ফসল এই বাংলাদেশ। ওই নয় মাসে এ দেশে ভয়াবহ ও লােমহর্ষক অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন, প্রায় চার লাখ নারী ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং এক কোটিরও বেশি মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এই অপরাধ সংঘটনকারীদের বিচার হয়নি, যা এই জাতি ও এ দেশের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বে এক গভীর ক্ষত রেখে গেছে।
রায়ের পর্যবেক্ষণ
আযাদের বিরুদ্ধে গঠিত আটটি অভিযােগের মধ্যে সপ্তমটি ছিল গণহত্যার । এ অভিযােগ সম্পর্কে প্রথমে ও বিস্তৃতভাবে রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। একাত্তরের ১৭ মে রাজাকার বাহিনীর সদস্য ও স্থানীয় আল-বদর বাহিনীর নেতা আযাদ ৩০-৩৫ জন সশস্ত্র রাজাকারকে সঙ্গে নিয়ে ফরিদপুরের বােয়ালমারী উপজেলার হাসামদিয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় হামলা চালায়। হিন্দু জনগােষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিক ধ্বংসের উদ্দেশ্যে তারা বাড়িঘর লুট ও অগ্নিসংযােগ করে, নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শরৎচন্দ্র পােদ্দার, সুরেশ পােদ্দার, শ্যামাপদ পােদ্দার, যতীন্দ্র মােহন সাহা, নীল রতন সমাদ্দার, সুবল কয়াল ও মল্লিক চক্রবর্তীকে হত্যা করে। হরিপদ সাহা ও প্রবীর কুমার সাহা ওরফে পুইটাকে হত্যা করা হয় ময়েনদিয়া বাজারের নদীর ঘাটে নিয়ে। রায়ে বলা হয়, প্রাপ্ত সাক্ষ্যে হিন্দু জনবসতি লক্ষ্য করে চালানাে ওই লােমহর্ষক ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা প্রমাণিত হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের ১৯তম সাক্ষী (সত্য রঞ্জন সাহা) ওই ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী। তাঁর বাবা ওই ঘটনায় নিহত হন। সাক্ষ্যে উঠে এসেছে, কীভাবে আসামি তার সহযােগীদের নিয়ে সরাসরি ধ্বংসাত্মক অপরাধে অংশ নিয়েছিলাে। ১৬তম (আবদুল মান্নান), ১৭তম (সুশীল কুমার) ও ২০তম সাক্ষীর (অসিত বরণ সাহা) সাক্ষ্যের মধ্য দিয়েও রাষ্ট্রপক্ষ এই অভিযােগে আসামির শাস্তি পাওয়ার যথার্থতা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। রায়ে আরও বলা হয়, বৃহৎ পরিসরে ওই হত্যাকাণ্ড ও বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ হিন্দু জনবসতিকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করে। হত্যা, ধ্বংস, লুণ্ঠণ, মানসিক আঘাতসব ধরনের অপরাধ মিলিয়ে একটি অভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়, হামলাকারীরা ‘হিন্দু জনগােষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে আংশিকভাবে ধ্বংসের জন্য ওই হামলা চালায়। গণহত্যার উদ্দেশ্যে ওই হত্যাযজ্ঞ চালানাে হয়, যা গণহত্যার সমান অপরাধ।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ৩(২)(সি) ধারায় গণহত্যা বা জেনােসাইডের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, একটি নির্দিষ্ট গােষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা, শারীরিক বা মানসিকভাবে আঘাত দেওয়া, জীবনযাপন পদ্ধতি বিনষ্ট করে তাদের আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসের চেষ্টা, বংশবিস্তার রােধ করে গােষ্ঠীকে ধ্বংস করার চেষ্টা এবং এক গােষ্ঠীর শিশুদের আরেক গােষ্ঠীতে রূপান্তরের চেষ্টা গণহত্যা বা জেনােসাইড হিসেবে গণ্য হবে। আযাদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযােগ মুক্তিযুদ্ধকালে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আযাদ ও তার সহযােগীরা ফরিদপুর শহরের খাবাসপুরে হবি মাতব্বরের দোকানের কাছ থেকে রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে ধরে নির্যাতন করে ফরিদপুর সার্কিট হাউসে নিয়ে যায়। সেখানে পাকিস্তানি মেজর আকরাম কোরাইশি ও আলী আহসান মােহাম্মাদ মুজাহিদের সঙ্গে আলােচনার পর রণজিৎকে অন্য একটি বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন করে আযাদ। পরে রণজিৎ সেখান থেকে পালিয়ে রক্ষা পান। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলে, পাকিস্তানি সেনাদের ঘনিষ্ঠ সহযােগী আযাদ শুধু রাষ্ট্রপক্ষের পঞ্চম সাক্ষীকে (রণজিৎ নাথ) আটকে রেখে নির্যাতন ও অমানবিক যন্ত্রণাদানে উৎসাহিতই করেনি, বরং নিজেও নির্যাতন করেছে। কেন রণজিৎ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলেন?
এর জবাব মেলে সাক্ষীর বর্ণনায় ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হলে রণজিৎকে দেখে মুজাহিদ (আলী আহসান মােহাম্মদ মুজাহিদ, জামায়াতের বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল ও তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি) বলে, “সে একজন মুক্তিযােদ্ধা ও হিন্দু।’ এরপর রণজিৎকে আযাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ জন্য রণজিৎকে অপহরণ, আটক রাখা ও নির্যাতনের মতাে মানবতাবিরােধী অপরাধের সঙ্গে সরাসরি অংশগ্রহণের দায় আযাদের ওপর পড়ে। তৃতীয় অভিযােগ একাত্তরের ১৪ মে আযাদ ১০-১২ জন সশস্ত্র রাজাকারসহ বােয়ালমারী থানার কলারন গ্রামের সুধাংশু মােহন রায়কে গুলি করে হত্যা করে। ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী (নেপাল চন্দ্র পাঠক) ও তৃতীয় সাক্ষীর (মােজাহের সিকদার) সাক্ষ্য পরস্পরকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। এতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়, অপরাধ সংঘটনের সময় আযাদ ১০-১২ জন। সঙ্গীসহ সশস্ত্র অবস্থায় ছিলে । আযাদ পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযােগী রাজনৈতিক দলের (জামায়াত) কাছ থেকে রাইফেল চালনার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাে। এই দুই সাক্ষীই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। চতুর্থ অভিযােগ একাত্তরের ১৬ মে বেলা তিনটার দিকে আযাদ ১০-১২ জন রাজাকার নিয়ে সালথা থানার (সাবেক নগরকান্দা) পুরুরা নমপাড়া গ্রামের মাধব চন্দ্র বিশ্বাসকে গুলি করে হত্যা করে।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের ষষ্ঠ সাক্ষী (ভক্ত রঞ্জন বিশ্বাস), অষ্টম সাক্ষী (প্রফুল্ল কুমার মণ্ডল) ও দশম সাক্ষী (তুষ্ট কুমার মণ্ডল) ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। মাধবকে হত্যা করা হয় দশম সাক্ষীর বাড়ির পুকুরপাড়ে । এই অভিযােগও প্রমাণিত হওয়ায় আযাদকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। পঞ্চম অভিযােগ একাত্তরের ৮ জুন দুপুর ১২টার দিকে আযাদ চার-পাঁচজন সশস্ত্র রাজাকারকে সঙ্গে নিয়ে বােয়ালমারী থানার নতিবদিয়া গ্রামের এক হিন্দু বাড়িতে হামলা চালিয়ে দুই হিন্দু নারীকে গণধর্ষণ করে। ট্রাইব্যুনাল বলেন, ওই ঘটনার শিকার বেসামরিক ব্যক্তিদের পক্ষে আজাদের। নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র হামলাকারীদের প্রতিরােধ করা সম্ভব ছিল না। কারণ ওই সশস্ত্র ব্যক্তিরা পাকিস্তানি সেনা ও পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায়। ঘটনার ধরন ও বিবরণ থেকে জানা যায়, ওই হামলার লক্ষ্য ছিল হিন্দু জনগােষ্ঠী। ওই ঘটনায় আযাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরােধী অপরাধ হিসেবে ধর্ষণের অভিযােগ প্রমাণিত হয়েছে। ষষ্ঠ অভিযােগ একাত্তরের ৩ জুন আযাদ ও ১০-১২ জন সশস্ত্র রাজাকার সালথা। থানার ফুলবাড়িয়া গ্রামে লুটপাটের পর চিত্তরঞ্জন দাসকে বাড়ি থেকে বের করে গুলি করে হত্যা করে। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় (জ্যোৎস্না রানী দাস), চতুর্থ (ধলা। মাতব্বর) ও নবম (নগেন চন্দ্র মণ্ডল) সাক্ষীর সাক্ষ্যে এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে ওই নির্দিষ্ট দিনে আযাদের নেতৃত্বে রাজাকাররা ফুলবাড়িয়া গ্রামে।
হামলা চালায়। ওই হামলার কারণে সাক্ষী জ্যোৎস্নাসহ লুণ্ঠন ও অপরাধের শিকার। অনেকে গ্রাম ছেড়ে ভারতে চলে যান। রাজাকার বাহিনীর নেতা হিসেবে আযাদ। সরাসরি এই অপরাধ করেছে। অষ্টম অভিযােগ একাত্তরের ১৮ মে সকাল ১০টার দিকে আযাদ সাত-আটজন সশস্ত্র রাজাকারকে সঙ্গে নিয়ে সালথা থানার উজিরপুর বাজারপাড়া গ্রামের গুরুদাসের ১৮ বছর বয়সী মেয়েকে অপহরণ করে খাড়দিয়া গ্রামের চান কাজীর বাড়িতে (আযাদের শ্বশুর) আটকে রেখে নির্যাতন করে। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের একাদশ সাক্ষী (দেব কুমার দাস) ও দ্বাদশ সাক্ষীর (রওশন আলী বিশ্বাস) সাক্ষ্য থেকে এটা প্রমাণিত হয়, আযাদ তার। সহযােগীদের নিয়ে নির্যাতিতার বাড়িতে হামলা চালিয়ে জোর করে তুলে নিয়ে যায় । এই অপহরণে আযাদ সরাসরি অংশ নিয়েছিলাে। সাত-আট দিন ধরে ওই নারীর ওপর যৌন নির্যাতন চালানাের বিষয়টি দ্বাদশ সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে (এক নারী) স্পষ্ট হয়েছে। তাই অপহরণ ও নির্যাতনের মতাে মানবতাবিরােধী অপরাধ সংঘটনে আযাদকে দোষী সাব্যস্ত করা হলাে। ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, একাধিক সাক্ষ্য থেকে এটা প্রমাণিত, আযাদ সশস্ত্র অবস্থায় অপরাধ করেছে। তাকে নিছক অনুপস্থিত অভিযুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। সে একজন পলাতক আসামি। বিচারের মুখােমুখি না হওয়া তার শাস্তি পাওয়ার যুক্তিকে সুদৃঢ় করে। সে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ। নেয়নি। এতে বােঝা যায় যে সে শাস্তি পাওয়ারই যােগ্য। শাস্তির বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, গণহত্যা ও হত্যার মতাে মানবতাবিরােধী অপরাধ মানবতাবােধের জন্য এক প্রচণ্ড আঘাত। অপরাধের গভীরতা বিবেচনা করে। ট্রাইব্যুনাল একমত যে, একমাত্র মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে এই গর্হিত অপরাধের ন্যায়বিচার হবে। চূড়ান্ত আদেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ২০(২) ধারা অনুসারে, আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু গণহত্যা (অভিযােগ-৭) ও মানবতাবিরােধী অপরাধের অভিযােগে (অভিযােগ-৩, ৪, ৫) দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেওয়া হলাে।
প্রতিক্রিয়া
রায়ের পর সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। বলেন, ‘এ রায় সারা দেশের মানুষের প্রাণের রায় । কোটি কোটি মানুষের প্রাণের দাবি আজ বাস্তবায়িত হয়েছে। এ রায় আমাদের সার্বভৌমত্বের রায়। এ রায় মানবতাবিরােধী অপরাধের বিরুদ্ধে রায়। রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি গােলাম আরিফ টিপু বলেন, “এই রায় মানবতাবিরােধী অপরাধের বিচারে কেবল রাষ্ট্রপক্ষের একার সফলতা নয়, এই সফলতা সারা দেশের মানুষের। তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান বলেন, ‘শুরুতে এই বিচারের তদন্ত ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। শেষ পর্যন্ত অনেক বাধা অতিক্রম করে একটি রায়ের মাধ্যমে তদন্ত সফল হয়েছে।’ তদন্ত কর্মকর্তা নূর হােসেন বলেন, ‘আমি আযাদের বিরুদ্ধে তদন্তে যেসব। অভিযােগ পেয়েছি, তা এই রায়ের মাধ্যমে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। একজন তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে আমার কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছি, এতেই। আনন্দ।’ রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সাহিদুর রহমান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও প্রমাণাদির মাধ্যমে আযাদের বিরুদ্ধে অভিযােগ প্রমাণ করতে পেরেছে। তার প্রতিফলনই রায়ে প্রতিফলিত হয়েছে। এই রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
মামলা ও বিচার কার্যক্রম
আযাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরােধী অপরাধের অভিযােগের তদন্ত শুরু হয় ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল। ২০১২ সালের ২৫ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষ তদন্তের বিষয়টি ট্রাইব্যুনাল২-এ আনে এবং সুষ্ঠ তদন্তের স্বার্থে আযাদকে গ্রেপ্তারের আবেদন করে। ৩ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল আযাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরােয়ানা জারি করেন। কিন্তু সেদিন রাজধানীর উত্তরখানে আযাদের বাসভবন ‘আযাদ ভিলায় গিয়ে পুলিশ তাকে পায়নি। সে এর আগেই পালিয়ে যায়। ২৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তাকে সাত দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে বলা হয়। সে হাজির হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাকে পলাতক ঘােষণা করে তার অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ শুরু করেন। ট্রাইব্যুনাল ৭ অক্টোবর তার পক্ষে আইনজীবী হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাে. আবদুস শুকুর খানকে নিয়ােগ দেন। ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর আযাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা ও মানবতাবিরােধী অপরাধের আটটি অভিযােগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। ২৬ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়, চলে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তদন্ত কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপক্ষের ২২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়। তবে আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী কোনাে সাক্ষী হাজির করতে পারেননি। ২৩ ডিসেম্বর দুই পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়। ২৬ ডিসেম্বর যুক্তি উপস্থাপন শেষে ট্রাইব্যুনাল মামলার রায় অপেক্ষমাণ রাখেন। ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি ঘােষিত হয় এ মামলার রায়।
ট্রাইব্যুনাল আযাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ৩(২) ধারায় আট ধরনের অভিযােগ গঠন করেন। প্রথম অভিযােগ অনুসারে, একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আযাদ ও তার সহযােগীরা ফরিদপুর শহরের খাবাশপুর থেকে রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে ধরে নির্যাতন করে। তবে রাত দুইটা-আড়াইটার দিকে তিনি পালাতে সক্ষম হন।
দ্বিতীয় অভিযােগ, ২৬ জুলাই আলফাডাঙ্গা থেকে আবু ইউসুফ পাখিকে ধরে এনে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আটক রাখা হয় । আযাদ পাকিস্তানি মেজর আকরামের সঙ্গে আলােচনা করে পাখিকে আটক রাখে এবং অমানবিক নির্যাতন করে। তৃতীয় অভিযােগ অনুসারে, ১৪ মে আযাদ ফরিদপুরের বােয়ালমারী থানার কলারন গ্রামের জমিদার সুধাংশু মােহন রায় ও তার বড় ছেলে মণিময় রায়কে বাড়ির পাশের রাস্তায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাড়ি ফিরতে বলে। তারা বাড়ির দিকে রওনা হলে আযাদ পেছন থেকে রাইফেল দিয়ে গুলি করে। এতে সুধাংশু নিহত ও মণিময়। গুরুতর আহত হন। চতুর্থ অভিযােগ, ১৬ মে আযাদ রাজাকারদের নিয়ে সালথা থানার (সাবেক নগরকান্দা) পুরুরা নমপাড়া গ্রামে মাধবচন্দ্র বিশ্বাসের বাড়িতে লুটপাট করে। মাধবকে বাড়ি থেকে টেনেহিচড়ে নিয়ে আযাদ গুলি করে হত্যা করে। পঞ্চম অভিযােগ অনুসারে, ৮ জুন আযাদ ও তার চার-পাঁচজন সহযােগী বােয়ালমারীর নতিবদিয়া গ্রামের এক হিন্দু বাড়িতে দুই নারীকে গণধর্ষণ করে। ষষ্ঠ অভিযােগে বলা হয়, ৩ জুন আযাদ ও তার সহযােগীরা সালথা থানার ফুলবাড়িয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় লুটপাট শেষে চিত্তরঞ্জন দাসকে গুলি করে হত্যা করে। সপ্তম অভিযােগ অনুসারে, ১৭ মে আযাদ ৩০-৩৫ জন রাজাকারকে নিয়ে। বােয়ালমারীর হাসামদিয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শরৎচন্দ্র পােদ্দার, সুরেশ পােদ্দার, শ্যামাপদ পােদ্দার, জতীন্দ্র মােহন সাহা, নীল রতন সমাদ্দার, সুবল কয়াল এবং মল্লিক চক্রবর্তীকে হত্যা করে। সেখান থেকে হরিপদ সাহা ও প্রবীর কুমার সাহা ওরফে পুইটাকে অপহরণ করে ময়েনদিয়া বাজারের নদীর ঘাটে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। অষ্টম অভিযােগ অনুসারে, ১৮ মে আযাদ সাত-আটজন রাজাকারকে নিয়ে সালথা থানার উজিরপুর বাজারপাড়া গ্রামের এক তরুণীকে অপহরণ করে খাড়দিয়া গ্রামের চান কাজীর বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন করে। সাত-আট দিন পর ওই তরুণী মুক্তি পান।