কাতিয়ানাংলা গণহত্যা (বটিয়াঘাটা, খুলনা)
কাতিয়ানাংলা গণহত্যা (বটিয়াঘাটা, খুলনা) সংঘটিত হয় ২৮শে মে। এতে বহু সংখ্যক সাধারণ মানুষ শহীদ হন। বটিয়াঘাটা উপজেলার ৩নং গঙ্গারামপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম কাতিয়ানাংলা। কাজীবাছা নদীর তীরে অবস্থিত এ গ্রামটি হিন্দু অধ্যুষিত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে মাস দেড়েকের মতো এ এলাকার মানুষ নিজেদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। অন্যান্য ইউনিয়নের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং মুসলিম লীগ-এর লোকজন কয়েকবার এ এলাকায় আক্রমণ ও লুটপাটের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে ১৭ই মে তারা পরিকল্পিতভাবে কাজীবাছা নদীর পূর্বপাড়ের বালিয়াডাঙ্গা, ভাণ্ডারকোট ও আমীরপুর গ্রাম থেকে এসে আন্ধারিয়া গ্রামে হামলা করে। গ্রামে নিরাপত্তা পাহারা থাকার কারণে দ্রুত গ্রামবাসীর কাছে এ খবর পৌঁছে যায়। অধিকাংশ গ্রামবাসী যে যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। সেদিন মুসলিম লীগের লোকজন অনেক বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনার পর এ এলাকার মানুষ ভীষণ নিরাপত্তাহীনতা বোধ করে। এলাকাবাসী সিদ্ধান্ত নেয় যে, ১৯শে মে তারা ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। অন্যান্য গ্রামের মতো কাতিয়ানাংলা গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়। পথিমধ্যে বটিয়াঘাটার বাদামতলা বাজার, চুকনগর ও ঝাউডাঙায় অনেক মানুষ গণহত্যার শিকার হয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পর থেকে খুলনা জেলার আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ বটিয়াঘাটার বিভিন্ন গ্রামে তাদের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তাছাড়া ঐসব এলাকা থেকে নৌপথে বটিয়াঘাটার ওপর দিয়ে ভারতে যাওয়া অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ছিল। তাই ভিটেমাটি ত্যাগ করা ভয়ার্ত মানুষ এই নৌপথ ব্যবহার করত। প্রায় প্রতিদিন এ পথ দিয়ে প্রচুর মানুষ যাতায়াত করত। ২৮শে মে বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার ঘাটতলা ও বেতাগা গ্রামের শতশত নারী-পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ রাজাকার- ও পাকসেনাদের ভয়ে ভিটেমাটি ত্যাগ করে ভারতের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাচ্ছিল। পথিমধ্যে কাজীবাছা নদীর তীরে কাাতিয়ানাংলা বাজারের কাছে যাত্রাবিরতি করে তারা সকালের খাওয়া-দাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঠিক সেই সময় খুলনা থেকে মোংলাগামী পাকসেনাদের গানবোট যাচ্ছিল। পাকসেনারা গানবোট থেকে নিরস্ত্র এসব মানুষের ওপর অবিরাম গুলিবর্ষণ শুরু করে। তখন প্রাণ বাঁচানোর জন্য যে যার মতো গ্রামের ভেতরে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে, কেউ-কেউ নদীতে ঝাঁপ দেয়। পাকবাহিনীর গানবোট চলে যাওয়ার পর নদীর তীরে বেড়িবাঁধের ওপর ৯টি মৃতদেহ পাওয়া যায় এবং অনেক মৃতদেহ নদীতে ভাসতে দেখা যায়। এছাড়া পানিতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মরক্ষা করতে গিয়ে অনেকে পানিতে ডুবে মারা যায়। যারা এ গণহত্যায় শহীদ হন তারা কেউ কাতিয়ানাংলা বা তার আশপাশের গ্রামের অধিবাসী নন। তারা ছিলেন বটিয়াঘাটা এলাকার বাইরের বাগেরহাটসহ অন্যান্য এলাকার মানুষ। [শংকর কুমার মল্লিক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড