কিংবদন্তী বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী
কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম (জন্ম ১৯৪৭) কিংবদন্তী বীর মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবীর বা বাঘা সিদ্দিকী হিসেবে খ্যাত, অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী, বিরল সামরিক প্রতিভা ও সমর কৌশলী, দেশের অভ্যন্তরে বিশাল এক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সংগঠক, কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান, ঢাকার অদূরে টাঙ্গাইলে এক বৃহৎ মুক্ত অঞ্চলের প্রতিষ্ঠাতা, পাকহানাদার বাহিনীর ত্রাস, হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য সফল যুদ্ধের পরিচালক, স্বাধীনতোত্তর বঙ্গবন্ধু সরকারের জেলা গভর্নর এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। কাদের সিদ্দিকীর পুরো নাম আব্দুল কাদের সিদ্দিকী। তিনি ১৯৪৭ সালের ১৪ই জুন টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী উপজেলার ছাতিহাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুহম্মদ আব্দুল আলী সিদ্দিকী এবং মাতার নাম লতিফা খাতুন। কাদের সিদ্দিকীরা ছিলেন ৯ ভাই ও ৬ বোন। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী তাঁর অগ্রজ। ১৯৬৫ সালে স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় কাদের সিদ্দিকী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। ১৯৬৭ সালে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে পুনরায় পড়াশুনায় ফিরে আসেন। তিনি করটিয়া সা’দত কলেজের ছাত্র ছিলেন।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে – অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে টাঙ্গাইলে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কাদের সিদ্দিকী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের সর্বপ্রকার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। একজন সাবেক সৈনিক ও দেশপ্রেমিক সন্তান হিসেবে কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ – ‘… ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা-কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-এর মধ্যে ঐ মুহূর্তে করণীয় সম্বন্ধে সুষ্পষ্ট দিকনির্দেশনা পান। ২৫শে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়লে কালবিলম্ব না করে কাদের সিদ্দিকী টাঙ্গাইলে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁদের ঐ প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। ফলে তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত এলাকা সখিপুরে অবস্থান নেন। সেখানে শুরু হয় তাঁর বাহিনীর পুনর্গঠন। তিনি এভাবে ১৭ হাজার সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ও ৭২ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের সমন্বয়ে এক বিশাল স্থানীয় মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলেন, যা চতুর্দিকে কাদেরিয়া বাহিনী নামে পরিচিতি লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে তাঁর বাহিনী পাকিস্তানি শত্রুদের বিরুদ্ধে তিন শতাধিক যুদ্ধ ও এম্বুশ পরিচালনা করে। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের অনেকগুলো সেতু ধ্বংস, বিভিন্ন থানা দখল এবং শত্রুসেনাদের একের পর এক সম্মুখ যুদ্ধে হত্যা বা বিতাড়িত করে টাঙ্গাইল জেলার এক বিস্তীর্ণ এলাকায় মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২২শে মে কালিহাতীর চারান নামক স্থানে, যা চারানের যুদ্ধ নামে পরিচিত। তিনি সরাসরি যে সব যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন, সে সবের মধ্যে বল্লার যুদ্ধ (১২ই জুন), বাসাইল থানা অভিযান (১৪ই জুন), কামুটিয়ার যুদ্ধ (১৭ই জুন), পাথরঘাটার যুদ্ধ (২৫শে জুলাই), গর্জনার যুদ্ধ (১৪ই আগস্ট), মাকড়াইয়ের যুদ্ধ (১৬ই আগস্ট), বাথুলির যুদ্ধ (২১শে নভেম্বর), নাগরপুরের যুদ্ধ (৩০শে নভেম্বর), এলাসিন ঘাটের যুদ্ধ (১লা ডিসেম্বর) ও ঘাটাইল থানা অপারেশন (১০ই ডিসেম্বর) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তাঁর বাহিনীর সঙ্গে পাকহানাদারদের আরো যেসব যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তার মধ্যে সিরাজকান্দির জাহাজমারা যুদ্ধ (১১ই আগস্ট), গানজানা খেয়াঘাটের যুদ্ধ (১৭ই আগস্ট), তামাই-পশ্চিমপাড়ার যুদ্ধ (২১শে আগস্ট), কয়েরা চরপাড়ার যুদ্ধ (২২শে সেপ্টেম্বর), ফুলদহেরপাড়ার যুদ্ধ (২৫শে সেপ্টেম্বর), পানকাতার যুদ্ধ (২৫শে সেপ্টেম্বর), ভেঙ্গুলার যুদ্ধ (২৬শে সেপ্টেম্বর), ভুঞাপুরের যুদ্ধ (৮ই অক্টোবর), সিংগুরিয়ার যুদ্ধ (৮ই অক্টোবর), করটিয়ার যুদ্ধ, মমিনপুরের যুদ্ধ (২৪শে অক্টোবর), ধলাপাড়ার যুদ্ধ (২৮শে অক্টোবর) ও দেওপাড়ার যুদ্ধ (১০ই ডিসেম্বর) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে ১৬ই আগস্ট ঘাটাইলের মাকড়াই সম্মুখ যুদ্ধে শত্রুর গোলার আঘাতে কাদের সিদ্দিকী আহত হন। ১১ই ডিসেম্বর তাঁর বাহিনী টাঙ্গাইল শহর দখল করে। এরপর তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকেন। ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণকালে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে কাদের সিদ্দিকী ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধকালে কাদের সিদ্দিকী স্বউদ্যোগে স্থানীয়ভাবে একটি বিশাল বাহিনী গড়ে তুলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অসীম সাহসিকতা প্রদর্শন, শত্রুকে পরাস্ত করে বিরাট এক মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, তার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে স্বাধীনতোত্তর বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭২ সালের ২৪শে জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে তাঁর নেতৃত্বে ১ লক্ষ ৪ হাজার অস্ত্র জমা দেয়া হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক ব্রিটিশ- পাকিস্তানি ঔপনিবেশক আমলের আমলা নির্ভর প্রশাসন ব্যবস্থার স্থলে গণতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার অংশ হিসেবে জেলা গভর্নর ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তমকে টাঙ্গাইল জেলার গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত দেশী-বিদেশী চক্রের ষড়যন্ত্রে ঘাতক-খুনিদের হাতে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্য অত্যন্ত নির্মম- নিষ্ঠুরভাবে নিহত হলে তিনি কিছুসংখ্যক অনুসারী নিয়ে ভারতে গমন করেন এবং সেখান থেকে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। এভাবে দীর্ঘ ১৬ বছর ভারতের মাটিতে অবস্থান করার পর ১৯৯০ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৯ সালে তিনি জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করে নতুন রাজনৈতিক দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ গঠন করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি তাঁর এ নতুন দল থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি তাঁর দলের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত আছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী একাধিক পুস্তক রচনা করেছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্বাধীনতা ৭১ (অনন্যা, ঢাকা ১৯৯৭)। স্ত্রী নাসরিন সিদ্দিকী, ছেলে দীপ সিদ্দিকী ও মেয়ে কুঁড়ি সিদ্দিকীকে নিয়ে তাঁর সংসার। তিনি অধিকাংশ সময় ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের নিজ বসবাস করেন। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম, স্বাধীনতা ‘৭১, ঢাকা, অনন্যা ১৯৯৭
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড