মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনী (টাঙ্গাইল)
কাদেরিয়া বাহিনী (টাঙ্গাইল) বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত টাঙ্গাইলের স্থানীয় মুক্তিবাহিনী। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারের অধীনে নিয়মিত ও অনিয়মিত মুক্তিবাহিনী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয়ভাবে বেশ কয়েকটি বাহিনী গড়ে উঠেছিল। সে-সবের মধ্যে কাদেরিয়া বাহিনী ছিল সর্ববৃহৎ, সবচেয়ে দুর্ধর্ষ এবং সর্বাধিক কৃতিত্বের অধিকারী। পাকবাহিনীর কাছে এ বাহিনী ছিল মহাআতঙ্কস্বরূপ। এ বাহিনী শত্রুসেনাদের একের পর এক সম্মুখ যুদ্ধে হত্যা বা বিতাড়িত করে টাঙ্গাইল জেলাসহ বিস্তীর্ণ একালায় মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
১৯৭১ সালের ১০ই জুন – আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম- সখিপুরের বহেড়াতৈল-এ ৪০০ জন ছাত্র-যুবককে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রিক্রুট করে প্রথম তাঁর বাহিনীর আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ বাক্য পাঠ করান। ক্রমাগত তাঁর বাহিনীর যোদ্ধাসংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৫ই অক্টোবর পর্যন্ত এ বাহিনীর যোদ্ধাসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার। ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজারে উন্নীত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে বহেড়াতৈলেই তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীতে সখিপুরের মহানন্দপুরে এ বাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সদর দপ্তর ছিল ভূঞাপুরে। বহেড়াতৈল, মহানন্দপুর এবং ভূঞাপুর ছাড়াও ভারতের মেঘালয় প্রদেশের তুরার হিরো ক্যাম্প থেকে এ বাহিনীর অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। টাঙ্গাইল জেলার সবকয়টি থানা, ময়মনসিংহের পাঁচটি থানা, ঢাকার চারটি থানা ও পাবনার তিনটি থানাসহ বিশাল এলাকা কাদেরিয়া বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। এ বাহিনীর দখলে থাকা বাংলাদেশের বৃহত্তম মুক্তাঞ্চল টাঙ্গাইলে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ছত্রীসেনা (প্যারাস্যুট বাহিনী) অবতরণ করার সুযোগ পায়।
কাদেরিয়া বাহিনীর নিজস্ব প্রশাসন ব্যবস্থা ৮টি বিভাগে বিন্যস্ত ছিল। সেগুলো হলো- সামরিক বিভাগ, বেসামরিক বিভাগ, বেতার টেলিফোন ও যোগাযোগ বিভাগ, জনসংযোগ বিভাগ, খাদ্য বিভাগ, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিভাগ, সদর দপ্তর নিরাপত্তা বিভাগ ও প্রচার বিভাগ। প্রচার বিভাগ থেকে সাইক্লোস্টাইল করে কাদেরিয়া বাহিনীর মুখপত্র রণাঙ্গন- নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করা হতো। এটি সম্পাদনা করতেন ‘রণদূত’ ছদ্মনামে কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক প্রধান আনোয়ার উল আলম শহীদ (স্বাধীনতা পরবর্তীকালে রক্ষীবাহিনীর উপ-প্রধান ছিলেন)। সহ-সম্পাদক ছিলেন ফারুক আহমেদ (যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, দীর্ঘকাল টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগ-এর দপ্তর সম্পাদক ছিলেন)। পত্রিকাটির মূল্য ছিল ৫০ পয়সা। প্রতিটি বিভাগেই কাদের সিদ্দিকী প্রয়োজনীয় সংখ্যক সুদক্ষ কর্মকর্তা নিযুক্ত করেন। এ বাহিনীতে কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবক ছিল।
কাদেরিয়া বাহিনী ৫টি সেক্টরে বিভক্ত ছিল:
১ নম্বর সেক্টর : টাঙ্গাইল-মধুপুর সড়কের পশ্চিম থেকে যমুনা নদী পর্যন্ত এলাকা। গোপালপুর, জগন্নাথগঞ্জ ঘাট ও ধনবাড়ী শত্রুঘাঁটিতে আক্রমণ এবং মধুপুর-ধনবাড়ী সড়ক সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত রাখা এ সেক্টরের দায়িত্ব ছিল। এর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন ১০ জন কোম্পানি কমান্ডার। সেক্টরের সার্বিক সমন্বয়কারীর দায়িত্বে ছিলেন সরিষাবাড়ীর মেদুরের কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল হাকিম। এ সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্স স্থাপিত হয় গোপালপুর থানাধীন নলিন বাজারে।
২ নম্বর সেক্টর: ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের পশ্চিমে মির্জাপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জের ধামরাই, ঘিওর ও সাটুরিয়া, পাবনার চৌহালি ও বেলকুচি থানা পর্যন্ত এলাকা। এ সেক্টরের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন ৯ জন কোম্পানি কমান্ডার। সার্বিক সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন জাহাজমারা হাবিব নামে পরিচিত ঘাটাইলের সাধুরগলগণ্ডা গ্রামের কোম্পানি কমান্ডার হাবিবুর রহমান, বীর বিক্রম। এর হেডকোয়ার্টার্স স্থাপিত হয় নাগরপুরের সলিমাবাদে।
৩ নম্বর সেক্টর: ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের পূর্ব পাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এবং টাঙ্গাইল জেলা শহর। এর দায়িত্বে ছিলেন ১৪ জন কোম্পানি কমান্ডার। সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন কোম্পানি কমান্ডার ফজলুর রহমান। এর হেডকোয়ার্টার্স স্থাপিত হয় সখিপুরের বহেড়াতৈলে।
৪ নম্বর সেক্টর: টাঙ্গাইল-মধুপুর সড়কের পূর্বাঞ্চল এ সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। আক্রমণের লক্ষ্যস্থল ছিল কালিহাতী ও ঘাটাইল থানা এবং টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের শত্রুর কনভয়। এর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন ৪ জন কোম্পানি কমান্ডার। সমন্বয়কারী কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন নবী নেওয়াজ খান। এ সেক্টরের সদর দপ্তর স্থাপিত হয় মরিচাতে।
৫ নম্বর সেক্টর: মধুপুর, মুক্তাগাছা ও ভালুকার সমগ্র অঞ্চল। এ সেক্টরটিকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এর দায়িত্বে ছিলেন ৬ জন কোম্পানি কমান্ডার। সমন্বয়কারী ছিলেন পূর্বাঞ্চলে আফসার উদ্দিন এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কমান্ডার আলী হোসেন লাল্টু।
এছাড়া আরো ১৪টি কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ভ্রাম্যমাণ কোম্পানি হিসেবে রাখা হয়।
কাদেরিয়া বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডাররা হলেন মনিরুল ইসলাম মনির (কস্তুরিপাড়া, কালিহাতী), ফজলুর রহমান (টাঙ্গাইল), নবী নেওয়াজ খান (চারান, কালিহাতী), হাবিবুর রহমান (জাহাজমারা হাবিব নামে পরিচিত; সাধুরগলগণ্ডা, ঘাটাইল), লোকমান হোসেন (বেতুয়া, সখিপুর), লাবিবুর রহমান (কালিয়াকৈর, গাজীপুর; পরে শহীদ), সৈয়দ গোলাম মোস্তাফা (গোলাড়া, কালিহাতী), শওকত মোমেন শাহজাহান (গড়গোবিন্দপুর, সখিপুর), রবিউল আলম গেরিলা (আকুরটাকুরপাড়া, টাঙ্গাইল), জয়নাল আবেদীন (সুঠাইন, নাগরপুর), কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙ্গাল (বেতডোবা, কালিহাতী), সাইদুর রহমান (কামার্তী, কালিহাতী), খোরশেদ আলম তালুকদার (বীরঘাটাইল, ঘাটাইল), হাবিবুর রহমান (সিংগুলী, কালিহাতী; পরে শহীদ), জহুরুল হক চান মিয়া (ব্রাহ্মণশাসন, ঘাটাইল), হাবিবুল হক খান বেনু (গৌরাঙ্গী, ঘাটাইল), আব্দুস সবুর খান (কালিবাড়ী, টাঙ্গাইল), আব্দুল গফুর মিয়া (কাউলজানি, বাসাইল), ইদ্রিস আলী (বড়চওনা, সখিপুর), আব্দুল হাকিম (মেদুর, সরিষাবাড়ী), আলী হোসেন খান লাল্টু (ঝনঝনিয়া, বাসাইল), খন্দকার হাবিবুর রহমান (বামনহাটা, ভূঞাপুর), আসাদুজ্জামান আরজু (বলরামপুর, ভূঞাপুর), রিয়াজ উদ্দিন তালুকদার (দেওপাড়া, ঘাটাইল), আজাদ কামাল (বাইমহাটী, মির্জাপুর), নূর হোসেন আঙ্গুর তালুকদার (নলিন, গোপালপুর), মতিয়ার রহমান মতি (বাসাইল), দেলবর হোসেন আনসারী (চৌবাড়িয়া, টাঙ্গাইল), আব্দুল হাকিম তালুকদার (ভাবলা, কালিহাতী), আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী (সিরাজগঞ্জ), ফজলুল হক (উপলদিয়া, ঘাটাইল), এন এ খান আজাদ (টাঙ্গাইল), আব্দুর রাজ্জাক ভোলা (মুসুদ্দি, ধনবাড়ী), আমান উল্লাহ (হাকিমপুর, কালিহাতী), মকবুল হোসেন খোকা (সানবান্দা, সখিপুর), জহুরুল হক খান ডিপটি (ভেঙ্গুলা, গোপালপুর), রেজাউল করিম (সারিয়াকান্দি, বগুড়া), এ কে এম বায়েজীদ আলম (করটিয়া, টাঙ্গাইল), হাবিবুর রহমান তালুকদার খোকা (বাসাইল), আনিসুর রহমান (সরিষাবাড়ী), ইউনুস আলী তালুকদার (বীরঘাটাইল), কলিবুর রহমান (কাউলজানি, বাসাইল), আব্দুস সাত্তার খান আলমগীর (নাগরপুর), নূরুল ইসলাম (কোনাবাড়ী, গোপালপুর), ফেরদৌস আলম রঞ্জু (পাইকরা, কালিহাতী), মোকাদ্দেস আলী (আইসরা, কালিহাতী), খসরু মিয়া (রতনপুর, ঘাটাইল), লুৎফর রহমান (সরিষাবাড়ী), হুরমুজ আলী (ফুলবাড়িয়া, ময়মনসিংহ), খলিলুর রহমান (সাড়াসিয়া, সখিপুর), তারা মিয়া (কোনাবাড়ী, গোপালপুর), তমসের আলী (বাসাইল), সুলতান উদ্দিন (ধামরাই), সোলেমান প্রমুখ।
কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা হলেন আনোয়ার উল আলম শহীদ (কালিহাতী), হামিদুল হক (সখিপুর), নূরুন্নবী (গোপালপুর), আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম (টাঙ্গাইল), আবদুল আলীম তালুকদার (ভূঞাপুর), আবদুল বাসেত সিদ্দিকী (সরাবাড়ী, ঘাটাইল), মোয়াজ্জেম হোসেন খান (ঘাটাইল), নূরুল ইসলাম (টাঙ্গাইল), সৈয়দ নূরুল ইসলাম (কালিহাতী), বুলবুল খান মাহবুব (ঘাটাইল), রফিক আজাদ (ঘাটাইল), মাহবুব সাদিক (বাসাইল), মামুনুর রশিদ (ঘাটাইল), ডা. শাহজাহান চৌধুরী (বাসাইল), আলী আসগর খান দাউদ (টাঙ্গাইল), আতোয়ার আলী (টাঙ্গাইল), সোহরাব আলী খান আরজু (কালিহাতী), আবদুল আউয়াল সিদ্দিকী (কালিহাতী), মোহাম্মদ আলী হোসেন (টাঙ্গাইল), মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দী (টাঙ্গাইল), আমজাদ হোসেন মাস্টার (বাসাইল) প্রমুখ।
কাদেরিয়া বাহিনীর প্রতিরোধ কৌশল টাঙ্গাইলে কাদেরিয়া বাহিনীর আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পাকবাহিনী টাঙ্গাইল শহর ও এর আশপাশে হত্যা ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাই তাদেরকে প্রতিহত করার কৌশল হিসেবে মুক্তিযোদ্ধারা গ্রেনেড হামলা ও সেতু ধ্বংসের পরিকল্পনা করেন। এ উদ্দেশ্যে মুক্তিবাহিনীর সদস্য বাকু, কালাম, সালাউদ্দিন, নীলু, মিনু, আনিস, বাদল প্রমুখের সমন্বয়ে গঠিত একটি গ্রেনেড স্কোয়াড টাঙ্গাইলে যায় এবং ১৭ই জুলাই তাঁরা টাঙ্গাইল শহরে এ্যাকশন শুরু করেন। প্রথমেই কালাম ও নীলু ওয়াপদা রেস্টহাউস, পাওয়ার হাউস এবং টাঙ্গাইল শান্তি কমিটির সেক্রেটারি অধ্যাপক খালেকের বাড়িতে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের আতঙ্কিত করে তোলেন। এরপর শহরের রূপবানী সিনেমা হলে রাজাকারদের ওপর গ্রেনেড হামলা করেন।
পাকবাহিনী তাদের সহায়তার জন্য কালিহাতীতে একটি -রাজাকার- ক্যাম্প স্থাপন করেছিল এ ক্যাম্পের রাজাকারদের কাজ ছিল পাকবাহিনীর চলাচল নির্বিঘ্ন করার জন্য সড়কের সেতুগুলো পাহারা দেয়া। তাদের এ কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্য ৩০শে জুলাই ভোরে দুজন মুক্তিযোদ্ধা গ্রেনেড নিয়ে কালিহাতী বাজারের উত্তর পাশের রাস্তায় নির্দিষ্ট দূরত্বে দুটি বড় গাছে উঠে লুকিয়ে থাকেন। যথাসময়ে রাজাকার বোঝাই একটি ট্রাক প্রথম গাছটির কাছে আসতেই ট্রাকটির ওপর প্রচণ্ড শব্দে একটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। সঙ্গে-সঙ্গে অপর গাছটি থেকে নিক্ষিপ্ত হয় আরেকটি গ্রেনেড। এতে ঘটনাস্থলে ৪ জন রাজাকার নিহত এবং ২১ জন আহত হয়। মুক্তিসেনা দুজন ততক্ষণে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে সক্ষম হন। এ ঘটনার পর পাকসেনারা ঐ এলাকার অনেক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে।
পাক হানাদারদের ঘায়েল করার আরেকটি কৌশল ছিল সেতু ধ্বংস করা। ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়ক দিয়ে পাকবাহিনী টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও জামালপুরে খাদ্য ও গোলাবারুদ সরবরাহ করত। তাই কাদেরিয়া বাহিনীর এক নম্বর কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা ৫ই জুলাই বিস্ফোরক দিয়ে প্রথমে কালিয়াকৈরের উত্তরে ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের সূত্রাপুর সেতুটি ধ্বংস করে দেন। এভাবে কাদেরিয়া বাহিনী যুদ্ধকালীন নয় মাসে দেড় শতাধিক সেতু ধ্বংস করে। সে-সব সেতুর মধ্যে মহিষাবাথান, গজারিয়া, সূত্রাপুর, কোদালিয়া, দেওহাটা, কুর্নি, মির্জাপুর, সুভল্যা, পাকুল্লা, জার্মুকি, বাঐখোলা, মটরা, করটিয়া, ভাতকুড়া প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সেতু ধ্বংসের ফলে একদিকে যেমন পাকবাহিনীর যাতায়াত বাধাগ্রস্ত হয়, অন্যদিকে তেমনি মুক্তিবাহিনীর জয়ের পথ সুগম হয়। কাদেরিয়া বাহিনীর উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ কাদেরিয়া বাহিনী ২৫৩টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বলে জানা যায়। বাহিনীর অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকী নিজে ৪০টিরও অধিক যুদ্ধে সরাসরি নেতৃত্ব দেন। এ বাহিনীর উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলো হলো- চারানের যুদ্ধ (২২শে মে), বাসাইল থানা অভিযান (১৪ই জুন), কামুটিয়ার যুদ্ধ (১৭ই জুন), ঘাটাইল থানা অভিযান (১৮ই জুন), বল্লার যুদ্ধ (১২ই জুন ও ১৬ই জুলাই), দেওপাড়ার যুদ্ধ (১৩ই নভেম্বর ও ১০ই ডিসেম্বর), কালিদাসপাড়া সেতু যুদ্ধ (২৭শে জুলাই), নবগ্রামের যুদ্ধ (৪ঠা আগস্ট), সিরাজকান্দির জাহাজমারা যুদ্ধ (১১ই আগস্ট), গর্জনার যুদ্ধ (১৪ই আগস্ট), মাকড়াইয়ের যুদ্ধ (১৬ই আগস্ট), গানজানা খেয়াঘাটের যুদ্ধ (১৭শে আগস্ট), তামাই পশ্চিমপাড়ার যুদ্ধ (২১শে আগস্ট), কয়েরা চরপাড়ার যুদ্ধ (২২শে সেপ্টেম্বর), পানকাতার যুদ্ধ (২৫শে সেপ্টেম্বর), বারইপটল-ফুলদহেরপাড়ার যুদ্ধ (২৫শে সেপ্টেম্বর), ভেঙ্গুলার যুদ্ধ (২৬শে সেপ্টেম্বর), ঘোনাবাড়ীর যুদ্ধ (৬ই অক্টোবর), জামতৈলের যুদ্ধ (৮ই অক্টোবর), ভূঞাপুরের যুদ্ধ (৮ই অক্টোবর), সিংগুরিয়ার যুদ্ধ (৮ই অক্টোবর), মমিনপুরের যুদ্ধ (২৪শে আগস্ট), বনগ্রামের যুদ্ধ (২৫শে অক্টোবর), নয়াপাড়ার যুদ্ধ (৩০শে অক্টোবর), পাথরঘাটার যুদ্ধ (২৫শে জুলাই), পোড়াবাড়ীর যুদ্ধ (৫ই নভেম্বর), ধলাপাড়ার যুদ্ধ (২৮শে অক্টোবর), মুক্তাগাছার বটতলার যুদ্ধ (১১ই নভেম্বর), ছাব্বিশার যুদ্ধ (১৭ই নভেম্বর), মির্জাপুরের যুদ্ধ (১৮ই নভেম্বর ও ১২ই ডিসেম্বর), করটিয়ার যুদ্ধ (ডিসেম্বরের প্রথম), বাথুলির যুদ্ধ (২১শে নভেম্বর), নাগরপুরের যুদ্ধ (৩০শে নভেম্বর), কেদারপুরের যুদ্ধ (৩০শে নভেম্বর), এলাসিন ঘাটের যুদ্ধ (১২ই অক্টোবর ও ১লা ডিসেম্বর), শমেসপুরের যুদ্ধ (৬ই ডিসেম্বর), ব্রাহ্মণশাসনের যুদ্ধ (১০ই ডিসেম্বর), গুণগ্রামের যুদ্ধ (১০ই ডিসেম্বর), বাঘুটিয়ার যুদ্ধ (১০ই ডিসেম্বর), ঘাটাইল থানা অপারেশন (১০ই ডিসেম্বর), দেওপাড়ার যুদ্ধ(১০ই ডিসেম্বর), টাঙ্গাইল ডিস্ট্রিক্ট গেটের যুদ্ধ (১০ই ডিসেম্বর), গোপালপুরের যুদ্ধ (৮ই অক্টোবর ও ১১ই ডিসেম্বর) ইত্যাদি। এসব যুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে ৩ হাজারেরও অধিক পাকসেনা নিহত হয় এবং ১৩ হাজারের মতো পাকসেনা ও রাজাকার বন্দি হয়। অপরপক্ষে পাকবাহিনীর গুলিতে কাদেরিয়া বাহিনীর দুশর অধিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
কাদেরিয়া বাহিনীর খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম (কালিহাতী, টাঙ্গাইল; অধিনায়ক, ছাতিহাটি), আবদুস সবুর খান, বীর বিক্রম (পূর্ব আদালতপাড়া, টাঙ্গাইল; কোম্পানি কমান্ডার), আবুল কালাম আজাদ, বীর বিক্রম (পারদিঘুলিয়া, টাঙ্গাইল; কোম্পানি কমান্ডার), হাবিবুর রহমান, বীর বিক্রম (জাহাজমারা হাবিব নামে পরিচিত; সাধুরগলগণ্ডা, ঘাটাইল), হাবিবুর রহমান তালুকদার, বীর প্রতীক (বাসাইল, টাঙ্গাইল; কোম্পানি কমান্ডার, তেঙ্গুনিয়া), খোরশেদ আলম তালুকদার, বীর প্রতীক (ঘাটাইল, টাঙ্গাইল; কোম্পানি কমান্ডার), ফজলুল হক, বীর প্রতীক (ঘাটাইল, টাঙ্গাইল; কোম্পানি কমান্ডার, উপলদিয়া), আব্দুল গফুর মিয়া, বীর প্রতীক (বাসাইল, টাঙ্গাইল; কোম্পানি কমান্ডার, কাউলজানি), মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, বীর প্রতীক (ভালুকা, ময়মনসিংহ; কোম্পানি কমান্ডার), আবদুল হাকিম, বীর প্রতীক (সরিষাবাড়ী, জামালপুর; কোম্পানি কমান্ডার, মেদুর), সৈয়দ গোলাম মোস্তফা, বীর প্রতীক (কালিহাতী, টাঙ্গাইল; কোম্পানি কমান্ডার, গোলড়া), আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী, বীর প্রতীক (দিয়ারী, সিরাজগঞ্জ; কোম্পানি কমান্ডার), সাইদুর রহমান, বীর প্রতীক (কালিহাতী, টাঙ্গাইল; কোম্পানি কমান্ডার, কামার্তী), হামিদুল হক, বীর প্রতীক (সখিপুর, টাঙ্গাইল; কোম্পানি কমান্ডার, কচুয়া), ফয়েজুর রহমান, বীর প্রতীক (দিঘুলিয়া, টাঙ্গাইল; কোম্পানি কমান্ডার), মোহাম্মদ খসরু মিয়া, বীর প্রতীক (ঘাটাইল, টাঙ্গাইল; কোম্পানি কমান্ডার, রতনপুর), আনিসুর রহমান, বীর প্রতীক (সরিষাবাড়ী, জামালপুর; (কোম্পানি কমান্ডার) এবং শহীদুল ইসলাম লালু, বীর প্রতীক (গোপালপুর পৌরসভা, টাঙ্গাইল; কিশোর যোদ্ধা)। মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর অসামান্য অবদান সর্বজন স্বীকৃত। ১১ই ডিসেম্বর এ বাহিনী টাঙ্গাইল শহর দখল করে।
১৬ই ডিসেম্বর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে এ বাহিনীর দশ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ক্লে এবং সানত সিং-এর সঙ্গে সাভার-মিরপুর হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেন। অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকী রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৭২ সালের ২৪শে জানুয়ারি কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নিকট টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী হাইস্কুল মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সমর্পণ করেন। [শফিউদ্দিন তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড