কানখাইয়া খাল যুদ্ধ (ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম)
কানখাইয়া খাল যুদ্ধ (ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম) সংঘটিত হয় ১১ ও ১২ই ডিসেম্বর। এতে ৩ জন পাকসেনা, ৫০-৬০ জন -মিলিশিয়া, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস নিহত এবং অসংখ্য আহত হয়।
ফটিকছড়ি থানার ধর্মপুর গ্রামের সর্বদক্ষিণে রাউজান থানার সীমান্তে কানখাইয়া খাল অবস্থিত। খালটি বছরে প্রায় ৯ মাস শুকনো থাকে। এই খালকে কেন্দ্র করেই সংঘটিত হয় চট্টগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধ।
১৯৭১ সালের ১০ই ডিসেম্বর। ফটিকছড়ি তখন প্রায় হানাদারমুক্ত অঞ্চল। মুক্তিযোদ্ধারা কচুপাড়া ক্যাম্পে নিজ-নিজ আশ্রয়স্থলে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হঠাৎ রাতের নীরবতাকে ছিন্ন করে মুক্তিযোদ্ধাদের কানে আসে গোলাগুলির শব্দ। শব্দের উৎস খুব কাছে বলেই তাঁদের ধারণা হয়। গ্রুপ কমান্ডার শেখ আবু আহমদ তাঁর নিকটস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে গোলাগুলির শব্দের উৎস লক্ষ করে এগুতে থাকেন। তাঁরা কিছুদূর এগুতেই আবু বকর গ্রুপ, ভারত বড়ুয়া গ্রুপ ও সোলায়মান গ্রুপের যোদ্ধাদের দেখতে পান। তাঁরাও গোলাগুলির শব্দ শুনে দ্রুত সংগঠিত হয়ে ক্যাম্প থেকে বের হয়ে আসেন। সবাই মিলে কানখাইয়া খালের দিকে এগুতে থাকেন। খাল তখন শুকনো। আর শুকনো খাল মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেঞ্চের কাজ করবে। মুক্তিযোদ্ধারা খাল পর্যন্ত পৌঁছে রাতে সেখানে অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা অপেক্ষা করতে থাকেন সঠিক সংবাদ ও ভোরের আলোর জন্য, যাতে কোনো শত্রুর ফাঁদে না পড়েন। মুক্তিযোদ্ধারা সারারাত খালে অপেক্ষা করেন। পরদিন ১১ই ডিসেম্বর সকালে তারা জানতে পারেন পার্শ্ববর্তী রাউজান থানার মুক্তিযোদ্ধারা হলদিয়া গ্রামের আমিরহাটস্থ রাজাকার- মিলিশিয়া ক্যাম্প আক্রমণ করেছেন। উভয় পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান শহীদ হয়েছেন এবং মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেছেন। এমতাবস্থায় কানখাইয়া খালে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা আশঙ্কা করছিলেন হানাদার বাহিনী তাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে পারে। তাই মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা এখানে থেকেই হানাদারদের প্রতিরোধ করবেন। বিনা প্রতিরোধে তাদের বাড়িঘরে লুটপাট, গ্রাম ধ্বংস ও হত্যাকাণ্ড চালাতে দেবেন না। ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিও বৃদ্ধি পেয়েছে। শতশত জনতা তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। হানাদারদের গতিবিধির সংবাদ নিয়ে, খাদ্য-পানীয় সরবরাহ করে, দেশীয় অস্ত্র, মরিচের গুঁড়া ইত্যাদি নিয়ে সাধারণ জনতা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের আশঙ্কা অচিরেই সত্যে পরিণত হয়। দেখা যায়, হানাদাররা ধানক্ষেতের আল ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তা দেখে গ্রুপ কমান্ডাররা হানাদারদের রেঞ্জের মধ্যে পেয়েই নিজ-নিজ অস্ত্র থেকে গুলি করার নির্দেশ দেন। হানাদাররাও পাল্টা গুলি ছুড়তে শুরু করে। ঘণ্টাখানেক গুলি বিনিময়ের পর হানাদাররা পিছু হটে। মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ তাদের পিছু ধাওয়া করে। অর্ধ মাইল দূরে সর্তাখাল। খালপাড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের আড়ালে থেকে শত্রুপক্ষ পাল্টা আঘাত করে। কিন্তু তারা সামনে এগুচ্ছে না দেখে মুক্তিযোদ্ধারা মনে করেন, হানাদারদের আর আসার সম্ভাবনা নেই। তাঁরা অবস্থান ত্যাগ করে ক্যাম্পে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু স্থানীয় জনগণের দাবির মুখে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অবস্থান বহাল রাখেন। তাদের আশঙ্কা ছিল, হানাদাররা হামলা করবেই। জনতা স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ খেতে বসে। কেউ-কেউ গল্পে মত্ত ৷ ঠিক এমন সময় হানাদাররা নতুন শক্তি নিয়ে অতর্কিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও দ্রুত সংগঠিত হয়ে পাল্টা আঘাত হানেন। এবারও হানাদাররা পিছু হটে। তারা অবস্থান ত্যাগ করার পর মুক্তিযোদ্ধারা নিজ-নিজ অবস্থানে চলে যান।
পরদিন ১২ই ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা খবর পান যে, হানাদারদের এক বিরাট বহর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসছে। ইতোমধ্যে এ খবর সব মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের কাছে পৌঁছে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা আবারো কানখাইয়া খালের দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু অর্ধ মাইল এগিয়ে তাঁরা থেমে যান। গ্রুপ কমান্ডার শেখ আবু আহমদ কানখাইয়া খালের অদূরে রমজুমুন্সির হাটের পূর্বপাশে অবস্থিত কলকিত্যা পুকুরে এম্বুশ বসানোর সিদ্ধান্ত নেন। কারণ শত্রুপক্ষ কাছাকাছি চলে এসেছে। বকর গ্রুপও ৫-৬ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কিছু দূরে ধোপা পুকুরে এম্বুশ বসান। অল্প সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা কিছু হালকা অস্ত্র নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকেন। কিছুক্ষণের মধ্যে শত্রুবাহিনীর বিরাট বহর মুক্তিযোদ্ধাদের খুব কাছাকাছি চলে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনা, মিলিশিয়া, রাজাকার আলবদরদের বিরাট বাহিনী দেখে কিছুটা ভরকে যান। পিছু হটারও সুযোগ নেই। তাই তাঁরা শত্রু হননে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। হানাদাররা খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। কমান্ডার শেখ আবু আহমদ মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশ দেন এলোপাতাড়ি গুলি না করে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী সকলকে একযোগে ফায়ার করতে, যাতে শত্রুরা মনে করে মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় অনেক। কমান্ডারের এ কৌশলে কাজ হয়। ৫-৬টি অবস্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা একসঙ্গে ফায়ার করতে শুরু করেন। ফলে শত্রুবাহিনী পিছু হটতে শুরু করে। একই সঙ্গে বকর গুপের মুক্তিযোদ্ধারা অন্য প্রান্ত থেকে আক্রমণ করেন। শত্রুদের পিছু হটতে দেখে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ধাওয়া করে অর্ধ মাইল দূরে কানখাইয়া খাল পর্যন্ত নিয়ে যান। সেখান থেকে হানাদাররা চলে যায় সর্তাখালের পাড়ে। মুক্তিযোদ্ধারাও কানখাইয়া খালে অবস্থান দৃঢ় করেন। ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি আরো বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক মুক্তিযোদ্ধা এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। এখান থেকে একদল মুক্তিযোদ্ধা। কানখাইয়া খালের উৎপত্তিস্থলের দিকে চলে যান। তাঁরা 5 বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাশে অবস্থান নিয়ে হলদিয়া গ্রাম হয়ে রাউজান সদর থেকে আসা শত্রুদের প্রতিরোধ করবেন।। কিন্তু ভারত বড়ুয়া গ্রুপের যোদ্ধারা অতি উৎসাহ ও 5 অভিজ্ঞার অভাবে সর্তাখাল পার হয়ে হলদিয়ায় ঢুকে শত্রুদের আক্রমণ করে বসে। ফলে সহযোদ্ধা শফিউল আলম ও জহুরুল আলম গুলিবিদ্ধ হন। মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত পিছু হটে অবস্থান নেয়ার ফাঁকে হানাদাররা হলদিয়া ও ধর্মপুরের পূর্বাংশে ঢুকে ১৫ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। এ-সময় ভারত বড়ুয়া গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চিমে ছিলোনিয়া খালে অবস্থান নেন। শম্ভু বড়ুয়ার গ্রুপ ও কমান্ডার আমিনুল হকের গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেন মোহাম্মদ তকির হাটের পাশে, যাতে গহিরা-অদুদিয়া সড়ক হয়ে শত্রুবাহিনী ঢুকতে না পারে। নুরুল গনির গ্রুপ (ছোট) ও মীর আহমদ গ্রুপ নাজিরহাট-নানুপুর সড়কে অবস্থান নেয়। এভাবে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের অবস্থান সংহত করেন। কানখাইয়া খালের মূল অবস্থানে থাকে কমান্ডার শেখ আবু আহমদ গ্রুপ, কমান্ডার সোলাইমান, কমান্ডার বকর গ্রুপ ও নুরুল গনি গ্রুপ। ইতোমধ্যে হানাদার বাহিনীর জন্য সেনানিবাস থেকে আরো অস্ত্রশস্ত্র ও সেনাসদস্য আসে। কিন্তু কোনো দিক থেকে সুবিধা করতে না পেরে তারা মোহাম্মদ আমির হাট হয়ে কানখাইয়া খালে অবস্থারত। মুক্তিযোদ্ধাদের মূল অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা নানুপুরে অবস্থারনরত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সংবাদ পাঠান। সেখানে অবস্থান করছিলেন মীর্জা আবু 1. মনসুর এমপিএ ও লে. শওকতের নেতৃত্বে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একদল দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের কাছে ছিল – ভারী অস্ত্রশস্ত্র। মীর্জা মনসুর ও লে. শওকতের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের এক বিরাট বাহিনী কানখাইয়া খালের দিকে অগ্রসর হয়। মুক্তিযোদ্ধারা কানখাইয়া খালে মিলিত হয়ে নতুনভাবে আক্রমণ রচনা করেন। ইতোমধ্যে নিজস্ব গোয়েন্দাদের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শক্তি সম্পর্কে অবগত হন। এক পর্যায়ে উভয়পক্ষে যুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর অবস্থান লক্ষ করে মর্টার ও মেশিনগান দিয়ে অনেকটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে সমর্থ হন। মুক্তিযোদ্ধাদের ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের আঘাতে হানাদার বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যায়। এদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসে। ফলে পাকসেনারা ভয়ে পিছু হটে। এ-যুদ্ধে ৩ জন পাকসেনা, ৫০-৬০ জন মিলিশিয়া, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস নিহত এবং অসংখ্য আহত হয়। পাকসনারা গাড়ি বোঝাই করে নিহত-আহতদের নিয়ে সেনানিবাসে পালিয়ে যায়। [জামাল উদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড