কাঞ্চনা গণহত্যা (সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম)
কাঞ্চনা গণহত্যা (সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম) সংঘটিত হয় ২৪শে এপ্রিল। এতে ৩০ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে সাতকানিয়া উপজেলায় কামিনী কুমার ঘোষ প্রতিষ্ঠিত আমিলাইষ-কাঞ্চনা বঙ্গচন্দ্ৰ ঘোষ ইনস্টিটিউটে পড়াশুনা করত চন্দনাইশ উপজেলার বৈলতলি ইউনিয়নের আজিজুর রহমানের পুত্র আহমদ সৈয়দ। একই স্কুলে তখন শিক্ষকতা করতেন চট্টগ্রাম শহরের জানে আলম দোভাষের জামাতা। এই শিক্ষকের দু-পুত্রও ইনস্টিটিউটে পড়ালেখা করত। একদিন কোনো এক কারণে এদের সঙ্গে আহমদ সৈয়দের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কামিনী কুমার ঘোষ তাতে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হন। আহমদ সৈয়দ দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তিনি পিতা- পুত্রের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে সমস্যার সমাধান করেন। কিন্তু মুচলেকা নেয়ার কারণে কামিনী কুমার ঘোষের প্রতি আহমদ সৈয়দ ও তার পুত্র আজিজুর রহমান ক্ষুব্ধ হয়। তারা কামিনী কুমার ঘোষের ওপর চরম প্রতিশোধ গ্রহণের উপায় খুঁজতে থাকে। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালানোর পর দোহাজারী সিএন্ডবি অফিস পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্যাম্পে পরিণত হলে তারা কামিনী কুমার ঘোষকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২৪শে এপ্রিল এই ক্যাম্প থেকে সৈন্য ডেকে নিয়ে গিয়ে কাঞ্চনায় গণহত্যা ঘটায়। সেদিন দুপুরে ক্যাম্প থেকে ৪-৫টি গাড়িতে করে ফুলতলা- খোদার হাট সড়ক ধরে অনেক সৈন্য দক্ষিণ কাঞ্চনা, উত্তর কাঞ্চনা ও মধ্যম কাঞ্চনায় আসে। তারা এলাকাসমূহের সকল হিন্দুবাড়িসহ সাতকানিয়া-চন্দনাইশের এমপিএ ডা. বি এম ফয়েজুর রহমানের বাড়িও জ্বালিয়ে দেয় এবং কামিনী কুমার ঘোষসহ ৩০ জন হিন্দুকে হত্যা করে। তারা মুসলমানদের বাড়িঘর না জ্বালালেও নির্বিচারে হিন্দু-মুসলমান নারীদের ধর্ষণ করে। এ-ক্ষেত্রে উত্তর কাঞ্চনা নিবাসী এক সেনাসদস্যের স্ত্রীর কথা উল্লেখযোগ্য। তিনি সেদিন পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হন। ঐ সেনাসদস্য ছিল পাকিস্তানপন্থী এবং সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-কে ভীষণ অপছন্দ করত। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা তার স্ত্রী গণধর্ষণের শিকার হলে সে অতিশয় দুঃখে উন্মাদপ্রায় হয়ে এক পর্যায়ে বুঝতে পারে যে, তার পাকিস্তানপন্থী হওয়া ছিল ভয়ানক ভুল। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অনুরক্ত হয়ে সে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। সে অনেক অপারেশন ও সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ শেষে নভেম্বর মাসে হাবিলদার আবু মো. ইসলাম কোম্পানির যোদ্ধা হিসেবে দেমাগ্রিতে যাওয়ার সময় বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার নোয়াপতং ইউনিয়নের ক্যানাইজু পাড়া এলাকায় ১৬ই নভেম্বর ভোর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ও মিজোদের ভয়াবহ আক্রমণে শহীদ হয়।
দক্ষিণ কাঞ্চনা, উত্তর কাঞ্চনা ও মধ্যম কাঞ্চনায় শহীদ হওয়া ৩০ জন শহীদের মধ্যে ৯ জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন— কামিনী কুমার ঘোষ (পিতা চৈতন্যচরণ ঘোষ, মধ্যম কাঞ্চনা ঘোষবাড়ি, সাতকানিয়া), রমণী ঘোষ (পিতা চন্দ্রকুমার ঘোষ, মধ্যম কাঞ্চনা), অম্বিকা চরণ ঘোষ (পিতা কৈলাস চন্দ্র ঘোষ, মধ্যম কাঞ্চনা), অমলেন্দু চক্রবর্তী (পিতা সুরেন্দ্র চক্রবর্তী), দেবেন্দ্র লাল শর্মা (হরিনারায়ণ মাস্টার বাড়ি, মধ্যম কাঞ্চনা), মহেন্দ্র লাল দাশ (পিতা সাঁচিরাম দাশ), জীবনকৃষ্ণ দত্ত (পিতা শরৎচন্দ্র দত্ত), কৃষ্টচরণ বিশ্বাস (পিতা নকুল চন্দ্র বিশ্বাস) ও যতীন্দ্র লাল বিশ্বাস (কৃষ্টচরণ বিশ্বাসের দত্তক পুত্র)। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের গুলিতে কাঞ্চনা ইউনিয়নের আরো ৪ জন শহীদ হন। তারা হলেন- রবীন্দ্রলাল চক্রবর্তী, পরিতোষ ঘোষ (পিতা ধীরেন্দ্র লাল ঘোষ, মধ্যম কাঞ্চনা ঘোষবাড়ি), মৃণাল কান্তি দাশ (পিতা জ্যোতির্ময় দাশ) এবং স্বপন ঘোষ। [শামসুল আরেফীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড