মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কাজী আরেফ আহমেদ
কাজী আরেফ আহমেদ (১৯৪২-১৯৯৯) মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু থেকেই যেসব ছাত্রনেতা স্বাধীনতার লক্ষ্যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম, ৬৬-র ৬-দফা আন্দোলনকালে ঢাকা মহানগর -ছাত্রলীগ-এর সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধকালে বিএলএফ-এর গোয়েন্দা শাখার প্রধান, স্বাধীনতোত্তর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল – জাসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের গণআদালতে বিচারের অন্যতম উদ্যোক্তা। তিনি ১৯৪২ সালের ৮ই এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলার খয়েরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী আবদুল কুদ্দুস, মাতার নাম খোদেজা খাতুন। ৫ ভাই ও ৫ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৪র্থ।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পিতার সঙ্গে কাজী আরেফ আহমেদ ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৬০ সালে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। পরে জগন্নাথ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৬৬ সালে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হন। পাকিস্তান সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণে তিনি কালো তালিকাভুক্ত হন। ফলে তাঁর পক্ষে স্নাতকোত্তর চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
জগন্নাথ কলেজে ভর্তির পর কাজী আরেফ আহমেদ ছাত্র- রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হন। ১৯৬২ সালে শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্টবিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এ বছরই তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তখন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে কে এম ওবায়দুর রহমান ও সিরাজুল আলম খান। ১৯৬৩ সালে কাজী আরেফ আহমেদ ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের একটি অংশ ১৯৬২ সাল থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে কাজ করতে থাকে। কাজী আরেফ আহমেদ ছিলেন এ ধারার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। এ ধারাভুক্ত অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, শেখ শহীদুল আলম, খালেদ মোহাম্মদ আলী, এম এ মান্নান, চিত্তরঞ্জন গুহ প্রমুখ।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- বাঙালির মুক্তি সনদ ‘ছয় দফা’ ঘোষণা করলে ছাত্রলীগ মহানগর কমিটির সভাপতি কাজী আরেফ আহমেদ বিবৃতি দিয়ে ছয় দফার প্রতি সকলকে সমর্থন প্রদানের আহ্বান জানান। তিনি ছয় দফার সমর্থনে ঢাকার রাজপথে মিছিল বের করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে কাজী আরেফ আহমেদ মুজিব বাহিনী-র অন্যতম সংগঠক ছিলেন। ভারতের কালসিতে তিনি নেতৃত্ব পর্যায়ের ট্রেনিং গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে পশ্চিমাঞ্চলীয় সেক্টরে মুজিব বাহিনীর সহ-প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পাল করেন। এছাড়াও তিনি মুজিব বাহিনীর গোয়েন্দা শাখার প্রধান ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি আওয়ামী লীগ/ছাত্রলীগ থেকে বের হয়ে এসে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল – জাসদ (৩১শে অক্টোবর ১৯৭২) প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন।
জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে কাজী আরেফ আহমেদ ১৯৮৭ সালের জুন মাসে কারাবরণ করেন এবং ১৯৮৮ সালের ২৯শে মার্চ মুক্তি পান। ১৯৯১ সালের ২৯শে ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামীর আমির ঘোষণার পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকলের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এ-সময় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’। এ কমিটি গঠনে কাজী আরেফ আহমেদ গুরুত্বপূর্ণ ভমিকা পালন করেন। ১৯৯২ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের গণ আদালতে বিচারের তিনি ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা।
১৯৯৯ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার কালিদাসপুর স্কুল মাঠে সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় বক্তব্যরত অবস্থায় সন্ত্রাসীদের অতর্কিত আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হয়ে কাজী আরেফ আহমেদ মৃত্যুবরণ করেন। সেদিন কুষ্টিয়া জেলা জাসদ সভাপতি লোকমান হোসেন, সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট ইয়াকুব আলী, স্থানীয় জাসদ নেতা ইসরাইল হোসেন এবং শমসের মণ্ডলসহ ৫ জন নিহত হন। কাজী আরেফ আহমেদের স্ত্রীর নাম রওশন জাহান সাথী। তিনি বর্তমানে আওয়ামী মহিলা শ্রমিক লীগের সভানেত্রী। এ দম্পতির ১ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তান রয়েছে। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড