You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর প্রতীক কাজী জয়নাল আবেদীন

কাজী জয়নাল আবেদীন, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪৮) বিমান বাহিনীর সৈনিক হয়েও স্থল যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৮ সালের ২রা জানুয়ারি নোয়াখালী জেলার সেনবাগে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো. হারিস মিয়া এবং মাতার নাম আছিয়া খাতুন। কাজী জয়নাল আবেদীন ১৯৬৪ সালে ফেনী হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬৬ সালে করাচি ইসলামিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি, একই কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে বিএ এবং করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেন।
কাজী জয়নাল আবেদীনের কর্মজীবনের শুরু পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে চাকরির মধ্য দিয়ে। এসএসসি পাসের পর পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে তিনি বিমান বাহিনীতে যোগ দেন৷
১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি বিমান বাহিনীর করাচিস্থ ড্রিগরোজ বেইজে কর্মরত ছিলেন। আগরতলা মামলার আসামি সার্জেন্ট মফিজুল্লাহ, সার্জেন্ট শামসুল হক ও মফিজুল বারি করাচির এ ড্রিগরোজ বেইজ থেকে গ্রেফতার হন। তাঁদের সঙ্গে কাজী জয়নাল আবেদীনের ঘনিষ্ঠতা ছিল। ৭০-এর নির্বাচনের পূর্বে তিনি ছুটিতে দেশে আসেন এবং ছুটি শেষে করাচিতে গিয়ে কর্মে যোগ দেন। ৭১-এর ৭ই মার্চ তিনি আবার ছুটি নিয়ে দেশে আসেন। ২৫শে মার্চ ফেনীর ট্রাঙ্ক রোডে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তাঁর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা খাজা আহমেদ এমএনএ-র নির্দেশে কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামগামী পাকবাহিনীর কনভয়ের বিরুদ্ধে তাঁরা এ স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু পাকবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে তাঁদের এ প্রতিরোধ ভেঙ্গে যায়। এরপর স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি এলাকার ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। মে মাসের প্রথমদিকে তিনি সেনবাগ ও কুমিল্লার গুণবতী সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান। সেখানে গিয়ে চোত্তাখোলা ক্যাম্পে যোগ দেন। এখান থেকে আগরতলা হয়ে আসামের গোয়ালাপাড়া জেলার তেলঢালায় মেজর জিয়ার নেতৃত্বাধীন ব্রিগেডের প্রশাসনিক কাজে যোগ দেন। কিন্তু প্রশাসনিক কাজের চেয়ে তিনি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। পরে তিনি মেজর তাহেরের নেতৃত্বে পরিচালিত ১১ নম্বর সেক্টরে যোগ দিয়ে ধানুয়া-কামালপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্যাম্প। ক্যাম্পের একদিকে বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কামালপুর ঘাঁটি। অন্যদিকে ভারতের সীমান্তের মধ্যে ছিল ১১ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্স। ধানুয়া-কামালপুর ক্যাম্পের কারণে পাকসেনারা ১১ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে হামলা করতে পারত না। মিত্রবাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অপারেশন পরিচালনা করলে এ ক্যাম্প থেকে সহায়তা দেয়া হতো। এ ক্যাম্পের কমান্ডার হিসেবে কাজী জয়নাল আবেদীন পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধ ও এম্বুশে অংশ নেন। ৩১শে আগস্ট এ ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। প্রায়ই পাকসেনারা এ ক্যাম্পে আক্রমণ করত। কাজী জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে সেসব আক্রমণ প্রতিহত করা হতো। ক্যাম্পের আশেপাশে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি বাংকার ছিল। কাজী জয়নাল আবেদীন সেসব বাংকারের মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশনা, সহায়তা ও নেতৃত্ব দিতেন। ১৪ই নভেম্বর কামালপুর যুদ্ধে মেজর তাহের যখন গুরুতর আহত, তখন তিনি তাঁর কাছেই ছিলেন। ৪ঠা ডিসেম্বর একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে পাকবাহিনীর ১৬৭ জন সৈন্য আত্মসমর্পণ করলে পাকবাহিনীর কামালপুর ঘাঁটির পতন ঘটে। কাজী জয়নাল আবেদীন এক কোম্পানি ফোর্স নিয়ে কামালপুর থেকে বাহাদুরঘাট-দেওয়ানগঞ্জ হয়ে জামালপুর আসেন। পরে ১৩-১৪ই ডিসেম্বর তাঁরা ময়মনসিংহে ১১ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্স স্থাপন করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কাজী জয়নুল আবেদীনকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে তিনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট ক্যাডারে যোগ দেন। ১৯৮৩ সালে পুলিশ সার্ভিসে যোগদান করে ২০০১ সালে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পূর্বে তিনি ডিআইজি পদে উন্নীত হন। তিনি ২ পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম মালেকা পারভীন। [জালাল আহমেদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!