বীর উত্তম কাজী নূর-উজ্জামান
কাজী নূর-উজ্জামান, বীর উত্তম (১৯২৫-২০১১) ৭নং সেক্টর কমান্ডার। ১৯২৫ সালের ২৪শে মার্চ ভারতের নদীয়া জেলার চাকদাহে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম খান সাহেব কাজী সদরুলওলা এবং মাতা রতুবুন্নেসা। ৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তাঁর পরিবার ঢাকায় চলে আসে। কাজী নূর-উজ্জামান কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অনার্সের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৪৬ সালে তিনি নৌবাহিনী থেকে কাজী নূর-উজ্জামান সেনাবাহিনীতে স্থানান্তরিত হন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে আর্টিলারি কোরে কমিশন প্রাপ্ত হন। ১৯৪৯ সালে ইংল্যান্ডের রয়েল আর্টিলারি স্কুল থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালে ক্যাডেট ট্রেনিং স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৬ সালে তিনি মেজর র্যাঙ্কে উন্নীত হন। ১৯৬১ সালে তিনি স্বেচ্ছায় সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং একই বছর ইপিআইডিসি-তে যোগ দেন। ১৯৭০ সালে তিনি সেখান থেকে ইস্তফা দিয়ে ব্যক্তিগত ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন।
কাজী নূর-উজ্জামান ছিলেন স্পষ্টবাদী ও রাজনীতি সচেতন। অবসর গ্রহণের পর কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হলেও বামপন্থী রাজনীতির প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল। তাঁর চাকরি জীবনে তিনি দেখেছেন কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসাররা বাঙালিদের ঘৃণার চোখে দেখত। তাদের এ আচরণ তাঁকে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে তাঁর স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণের এটিই ছিল প্রধান কারণ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থন ছিল। ৭১-এর ২৫শে মার্চ রাতে পাকহানাদার বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে নির্বিচারে বাঙালিদের হত্যা তাঁকে দারুণভাবে ব্যথিত করে। তখন তিনি পিলখানার ইপিআর (বর্তমান বিজিবি) হেডকোয়ার্টার্স থেকে সামান্য দূরে ধানমন্ডিতে পরিবার- পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন। সেখান থেকে তিনি ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সে হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ অনুমান করতে পারেন। কানে ভেসে আসছিল নারী, শিশু ও জওয়ানদের কান্না ও করুণ আর্তনাদ। সে-সময় তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর। ঐ অবস্থায় তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান নেন। তিনি ময়মনসিংহে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে অবস্থানরত বিদ্রোহী মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাঁর বাহিনীতে যোগ দেন। তিনি কিছুদিন মেজর সফিউল্লাহর বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি কোম্পানির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর কলকাতায় জেনারেল ওসমানী তাঁকে ওয়ারফোর্স রিক্রুটমেন্টের কাজে নিয়োজিত করেন। সেপ্টেম্বর মাসে মেজর নাজমুল হক জিপ দুর্ঘটনায় নিহত হলে কাজী নূর-উজ্জামানকে রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া ও দিনাজপুরের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ৭নং সেক্টরের কমান্ডার-এর দায়িত্ব দেয়া হয়। এ সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্স ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তরঙ্গপুরে। ৭নং সেক্টরকে ৮টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়, যথা— মালান, তপন, মেহেদীপুর, হামজাপুর, আঙ্গিনাবাদ, শেখপাড়া, থোকরাবাড়ি ও লালগোলা। ২ হাজার নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ও ১০ হাজার গেরিলা নিয়ে এ সেক্টরের মুক্তিবাহিনী গঠিত ছিল। যুদ্ধকালে কাজী নূর-উজ্জামানকে লে. কর্নেল র্যাঙ্কে পদোন্নতি দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য কাজী নূর-উজ্জামানকে ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র : কর্নেল (অব.) কাজী নূর-উজ্জামান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ : একজন সেক্টর কমান্ডারের স্মৃতিকথা, ঢাকা, অবসর প্রকাশনা ২০০৯; Lt. Gen. Mir Shawkat Ali, BU, The Evidence, vol. one, Dhaka, Somoy Prakashan 2008.
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড