You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর প্রতীক কাজী সাজ্জাদ আলী জহির - সংগ্রামের নোটবুক

বীর প্রতীক কাজী সাজ্জাদ আলী জহির

কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৫১) বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত। তিনি ১৯৫১ সালের ১১ই এপ্রিল কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার ইলিয়টগঞ্জের চৌসই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী আবদুল মুত্তালিব, মাতার নাম কাজী নুরুন নাহার বেগম।
ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করার পর ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। কাকুল সামরিক একাডেমিতে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে তিনি আর্টিলারি কোরে কমিশন লাভ করেন। এ-সময় তাঁকে শিয়ালকোটে ১৪নং প্যারা ব্রিগেডের ৭৮ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টে পদায়ন করা হয়। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। শিয়ালকোটে যোগদানের কয়েকদিন পর তিনি জম্মু-কাশ্মীর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং ৪নং সেক্টরে অন্তর্ভুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। এ-সময় ভারত সরকার বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য কয়েকটি ১০৫ এমএম কামান প্রদান করে। সেগুলো দিয়ে মুক্তিবাহিনীর জন্য একটি ২ ফিল্ড আর্টিলারি ব্যাটারি গঠন করা হয়। এর নাম দেয়া হয় দ্বিতীয় ফিল্ড ব্যাটারি। সাজ্জাদ আলী জহির এ ব্যাটারিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে উপ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। অক্টোবর মাস থেকে এ ব্যাটারি জেড ফোর্সের হয়ে সিলেটে পাহাড়ের বিভিন্ন যুদ্ধে আর্টিলারি ফায়ার সাপোর্ট দিয়ে সহায়তা করে। সেগুলোর মধ্যে দুরবিন টিলার যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
মৌভীবাজার জেলার বড়লেখায় দুরবিন টিলা অবস্থিত। এখানে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। ২০শে নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের এ গোলন্দাজ দলটি পরিকল্পনা অনুয়ায়ী ভারত সীমান্ত থেকে হানাদারদের এ ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। যুদ্ধে হানাদারদের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদেরও ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ৮ জনে নেমে আসে। অপরদিকে হানাদার বাহিনীর সংখ্যা ছিল দেড় শতাধিক। পাকিস্তানি বাহিনী তাঁদের পেছনে চলে আসায় সাজ্জাদ আলী জহিরকে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। হানাদাররা পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা করলে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু হয়। সাজ্জাদ আলী জহির হানাদারদের ওপর মেশিনগানের গোলা ছুড়তে থাকেন। এ আক্রমণে বড় ধরনের ক্ষতি মেনে নিয়ে হানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। কৌশলগত কারণে এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের জয় হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চাকরিতে বহাল হন এবং পর্যায়ক্রমে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৮২ সালে তাঁকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়। চাকরিকালে তিনি সেনাসদর, আর্টিলারি রেজিমেন্ট এবং আর্টিলারি প্রশিক্ষণ স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া এ-সময় তিনি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণে সাফল্যের জন্য দুবার সেনা প্রধানের প্রশংসাপত্র লাভ করেন।
সাজ্জাদ আলী জহির মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে একজন অতিপরিচিত ও পরিশ্রমী লেখক-গবেষক হিসেবে বহুল প্রশংসিত। এ-যাবৎ তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৪৯টি। তাঁর লেখা গ্রন্থগুলোর মধ্যে বীরশ্রেষ্ঠদের জীবনী, রংপুর সেনানিবাসে দুঃসাহসিক আক্রমণ, রংপুরের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলার কিশোর মুক্তিযোদ্ধা, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুরের দেশে ফেরা, The Return of a Hero, Return of the Falcon, ইউ কে চিং বীর বিক্রম আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা উল্লেখযোগ্য। বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ ভারত থেকে বাংলাদেশে আনার জন্য গঠিত কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ভারতের শহীদ সৈনিকদের সম্মাননা প্রদান কার্যক্রমে নিয়োজিত ছিলেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৩ সালে কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তাঁর স্ত্রীর নাম খালেদা মরিয়ম সাজ্জাদ। এ দম্পতি ১ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তানের জনক-জননী। [মনিরুজ্জামান শাহীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড