বাংলার বাণী
২৮শে আগস্ট, মঙ্গলবার, ১৯৭৩, ১১ই ভাদ্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
আফ্রিকা আর রোডেশিয়ার মানুষের পাশে আমরাও
জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইম নিউইয়র্ক থেকে বিশ্ব সংস্থার কার্যাবলীর বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন সম্প্রতি। রিপোর্টের প্রারম্ভেই বলা হয়েছে—ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ আজো তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছে। অধিকার-বঞ্চিত মানুষ মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্যে বছরের পর বছর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু স্বৈরাচারী শাসক শ্রেণী তাদের সেই মৌলিক অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। মুক্তিকামী মানুষের উপর ঔপনিবেশিক শাসন বহাল থাকার দরুণ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উত্তেজনাও বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এ প্রসঙ্গে মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইম দক্ষিণ আফ্রিকার কথা উল্লেখ করে বলেন—দক্ষিণ আফ্রিকায় আজো বর্ণবৈষম্য, বর্ণবিভেদ ও ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম রয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনের দরুণ সেখানে যা চলছে তা যদি অব্যাহতভাবে চলতে থাকে তাহলে তা আফ্রিকার বাইরেও প্রভাব বিস্তার করবে। মহাসচিব দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, মুক্তিকামী মানুষের জন্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও স্বস্তি পরিষদের প্রস্তাবাবলী ঐ সকল ঔপনিবেশিক শাসক শ্রেণীর জন্যেই বাস্তবায়িত হয়নি। এবং বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিক শাসনের জন্যে উদ্ভূত উত্তেজনার জন্যে ঐ সকল দেশের শাসক শ্রেণীই মূলতঃ দায়ী। ডঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইম আরো উল্লেখ করেন, রোডেশিয়ার অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের স্বস্তি পরিষদের যে নির্দেশ ছিল তা বাস্তবায়নেও অনেক দেশ সাড়া দিচ্ছে না।
বস্তুতঃপক্ষে জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইম যে বার্ষিক কার্যবিবরণী প্রকাশ করেছেন তা বর্তমান বিশ্বের শান্তি ও মানবতার স্বপক্ষে একটি উপযোগী বিশ্লেষণাত্মক ব্যাপার। বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষ আজ মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। দুনিয়ার সকল গণতান্ত্রিক শান্তিকামী মানুষ আজ বিশ্বভ্রাত্ব ও শান্তির জন্যে সংগ্রামমুখর। ঠিক এমনি একটি বিশ্বভ্রাতৃত্ব গঠনের আন্দোলনের সময় যারা এখনও ঔপনিবেশিক শাসনের দ্বারা কোন জাতির মুক্তিকে ঠেকিয়ে রেখে শোষণ করছে তারা আর যাই হোক মানবতার শত্রু। মানবতার জয়গানে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ যখন সোচ্চার ঠিক সেই মুহূর্তে রোডেশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক শাসন ও বর্ণবৈষম্যের ঘৃণ্য হাতিয়ার ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরা ইতিপূর্বে বহুবার ঘোষণা করেছি—বিশ্বের সকল মুক্তি সংগ্রামরত মানুষের পাশে রয়েছি। সাংবিধানিকভাবে আমরা গণতন্ত্র ও মানবতার স্বপক্ষে। সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে আমরা মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিতে বিশ্বাসী। বিশ্বের যে সকল জাতি তাদের স্বশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি, যারা আজো মুক্তিকামনায় সংগ্রাম করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে, যারা আজো ধলো-কালোর বিভেদে শোষিত হচ্ছে, যারা জীবনের মূল্য দিয়ে স্বাধীনতার রক্ত-সূর্যকে ছিনিয়ে নিয়ে আসতে বদ্ধপরিকর আমরা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাদের স্বপক্ষে।
তাই আমরা ঔপনিবেশিক শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে বিশ্বেরে শান্তিকামী মানুষের আন্দোলন জোরদার করার আহ্বান জানাই। বিশ্বে যতদিন শোষকের শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকবে ততদিন শান্তিকামী মানুষ তাদের আন্দোলন অব্যাহত গতিতে চালিয়ে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। বাংলাদেশ সে আন্দোলনে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জোগাবে।
হায়রে দুর্ভাগা দেশ!
দেহের রক্ত ঢেলে, জীবনকে বাজী রেখে যাঁরা শোষণ-বঞ্চনার অন্ধকার থেকে স্বাধীনতার রক্ত সূর্যকে ছিনিয়ে এনে পরিয়েছেন দেশ মাতার ললাটে, সেই সব নিবেদিত প্রাণ আহত ও পঙ্গু চিকিৎসাধীন মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা আবার আক্রান্ত হয়েছেন। কিছুদিন আগে তাঁরা বহিরাগতদের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন শেরে বাংলা নগরস্থ শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে, এবার হলেন মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতালে।
গত শনিবার মধ্যরাতের ঘটনা পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সেদিন রাতে টেলিভিশনে প্রদর্শিত ভারতীয় চলচ্চিত্র দেখাকে কেন্দ্র করে রাত সাড়ে ন’টার দিকে চিকিৎসাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে হাসপাতালের ডাক্তার ও মেডিকেল কলেজের কিছু সংখ্যক ছাত্রদের মধ্যে বচসা থেকে হাতাহাতি শুরু হয়। তারপর ঘটনাটির পরিসমাপ্তি তখন সাময়িকভাবে ঘটলেও রাত সাড়ে বারোটার দিকে লোহার রড, লাঠি, ছুরি এমনকি পিস্তলধারী প্রায় একশত ব্যক্তির সুপরিকল্পিত আক্রমণের শিকার হন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সমস্ত মুক্তিযোদ্ধারা। এর ফলে অন্যূন ৮০ জন আহত, ৫ জন নিখোঁজ হন এবং তাঁদের কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সহ টাকাপয়সা, সার্টিফিকেট ইত্যাদি অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছিনতাই হয়ে যায়। এই পৈশাচিক ও নৃশংস আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা অসহায়ের মতো মার খেয়েছেন, কেউ তাদের সাহায্য করেনি এবং রোববার পর্যন্ত কেউ তাদের দেখতে পর্যন্ত আসেননি। আক্রমণকারীরা প্রতিটি কক্ষে প্রবেশ করে ব্যাপকভাবে মারপিট করে—ফলে হাসপাতালের কাচের জানালা ও অন্যান্য আসবাবপত্রের ক্ষতি সাধিত হয়। হাসপাতালের দারোয়ান, ওয়ার্ডবয়রাও এই আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্যে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকজন ডাক্তার ও মেডিকেলের কিছু সংখ্যক ছাত্র ও হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দায়ী করেছেন এবং অপরপক্ষে তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দোষী বলে উল্লেখ করেছেন।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এই ঘটনার যে মর্মান্তিক ও নৃশংসতার ছবি পাওয়া যায় তাতে গোটা জাতির লজ্জায় মাথা হেট হয়ে আসে না কি? যে অমিততেজ সৈনিকেরা জীবনের বিনিময়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের জন্যে নিঃস্বার্থ ত্যাগ করলেন, পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিলেন হাসি মুখে, যাঁরা ভালো হওয়ার জন্যে দিনের পর দিন হাসপাতালের শয্যায় দিন গুণছেন, যাঁরা জাতির গর্ব তারাই কি না বার বার পৈশাচিকভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন এদেশেরই মানুষের কাছে! হায়রে দুর্ভাগা দেশ!
জানিনা অত্যন্ত দুঃখ ও কলঙ্কময় এই ঘটনার জন্যে সরকার কি করছেন। কিন্তু আমাদের সুদৃঢ় বক্তব্য, ঘটনাটির নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া দরকার এবং দোষী ব্যক্তির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে সংঘটিত অনুরূপ ঘটনার প্রেক্ষিতে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধারা প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখু মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাত করে তাঁদের দুর্ভাগ্যের কথা ব্যক্ত করলে তিনি তাঁদের কল্যাণের সর্বপ্রকার ব্যবস্থার আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমরা আশা করি, সরকার সে বিষয়ে অমনোযোগী হবেন না বরং ভবিষ্যতে যাতে এমনিতর লজ্জাকর ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে বিষয়ে এবং দেশ মায়ের স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই বীর সোনার সন্তানদের যথার্থ মর্যাদা প্রদানে কার্যকর ব্যবস্থা করতে কুণ্ঠিত হবেন না। হলে তা জাতির ললাটে কুঠারাঘাতই করা হবে, আত্মঘাতী প্রবঞ্চনাই হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক