You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে কাজিপুর উপজেলা (সিরাজগঞ্জ)

কাজিপুর উপজেলা (সিরাজগঞ্জ) ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর ৮ই মার্চ সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১১ সদস্যবিশিষ্ট এ পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন মোতাহার হোসেন তালুকদার এমএনএ (আওয়ামী লীগ) এবং সদস্য সচিব আনোয়ার হোসেন রতু (আওয়ামী লীগ)। পরিষদের অন্য সদস্যরা ছিলেন আওয়ামী লীগের সিরাজগঞ্জ মহকুমা শাখার নেতৃবৃন্দ, যথা— দবির উদ্দিন আহমদ, সৈয়দ হায়দার আলী, আব্দুল মোমেন তালুকদার, শহিদুল ইসলাম তালুকদার, রওশন-উল হক, ডা. আবু হেনা, গোলাম হাসনায়েন, আমির হোসেন ভুলু এবং আমিনুল ইসলাম চৌধুরী। একই দিন সিরাজগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগ-এর নেতৃত্বে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এ পরিষদের সভাপতি ছিলেন মহিউদ্দিন আলমগীর ও সদস্য সচিব আজিজুল হক বকুল। কাজিপুর থানা সদরেও শাহজাহান খানের নেতৃত্বে একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। উল্লেখ্য যে, মুজিবনগর সরকার-এর অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন <এম মনসুর আলী- কাজিপুরের সন্তান হওয়ায় এ থানায় ছিল তাঁর ব্যাপক প্রভাব। তাঁর আহ্বানে শ্রেণি-বৈষম্য ভুলে সকলে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
সিরাজগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) এ কে শামসুদ্দিন আহম্মদ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার জন্য বিভিন্ন থানায় বার্তা প্রেরণ করেন। সে অনুযায়ী বিভিন্ন থানায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হতে থাকে। তাঁর প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় কাজিপুরের জন্য দুটি গরুর গাড়িতে করে বেশকিছু রাইফেল ও ডামি রাইফেল প্রেরণ করা হয়। এগুলো প্রথমে সংগ্রাম পরিষদের সদস্য আমির হোসেন ভুলু (রেহাইবেতগাড়ী) তাঁর নিজ বাড়িতে রাখেন, পরে নিরাপত্তার জন্য সেগুলো চিলগাছার আফজাল তালুকদারের বাড়িতে রাখা হয় এবং আরো পরে বাগবাটীর জমিদার বাড়ির পরিত্যক্ত ভবন কাজিপুরের লক্ষ্মীপুরে জি আই খানের বাড়িতে রাখা হয়। আব্দুল লতিফ মির্জা, মোজাফফর হোসেন মোজাম, আজিজ মির্জা, আব্দুর রউফ পাতা, বিমল ও সরিষাবাড়ী কুমার দাস, জহুরুল ইসলাম মিন্টু, লুৎফর রহমান অরুণ, কে এম হোসেন আলী হাসান, আমিনুল ইসলাম চৌধুরীসহ ৩০-৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার সংগৃহীত অস্ত্রও কাজিপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া হয়।
লক্ষ্মীপুর গ্রামের জি আই খানের বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রানজিট ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সংগ্রাম
পরিষদের তত্ত্বাবধানে এবং লুৎফর রহমান দুদুর নেতৃত্বে শুভগাছা ইউনিয়নের পাকহাটে (পরবর্তীতে নামকরণ করা হয় বাংলাবাজার হাট) ১২ই এপ্রিল প্রায় ৪০০ যুবককে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় ৩০৩ রাইফেল, ডামি রাইফেল ও বাঁশের লাঠি। প্রশিক্ষক ছিলেন সেনাসদস্য আব্দুর রশীদ, সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কোরের সদস্য আব্দুস সাত্তার চাকলাদার ও ওসমান গণি। কিছুদিন পরে প্রশিক্ষণের সুবিধা ও নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প আজিতপুর চরের কাশবনে স্থানান্তর করা হয়। প্রশিক্ষণকালীন ব্যয় নির্বাহের প্রধান উৎস ছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আর্থিক সহযোগিতা ও হাটে-বাজারে অর্থ সংগ্রহ। এছাড়া সর্বস্তরের জনগণ প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য খাদ্য সরবরাহ করত।
কাজিপুর উপজেলায় পাকসেনাদের প্রতিরোধ করার জন্য মোজাফফর হোসেন মোজাম গ্রুপ, লুৎফর রহমান দুদু গ্রুপ এবং আঞ্চলিক সংগ্রাম পরিষদের স্থানীয় যুবকদের নিয়ে একটি প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় আব্দুল লতিফ মির্জার পরিচালনায় পলাশডাঙ্গা যুব শিবির।
এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে পাকসেনারা কাজিপুর থানায় প্রবেশ করে এবং কাজিপুর থানা ও থানার পশ্চিম পাশে ডাকবাংলোতে (সিও অফিস) ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীকালে দুটি স্থানই যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে যায়।
পাকসেনারা কাজিপুর থানা ক্যাম্পে অবস্থানের পর মুসলিম লীগ এর প্রভাবশালী নেতাদের নিয়ে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিল- আবুল হোসেন মুন্সী, দলিল বক্স চেয়ারম্যান, আব্দুল গণি মিয়া, পোকা সরকার, আব্দুল খালেক সরকার, ময়েজ উদ্দিন, মতিয়ার রহমান, ইমান আলী চেয়ারম্যান, মুঞ্জিল, ভেটু, আফজাল হোসেন প্রমুখ। এদের সহায়তায় রাজাকার বাহিনীও গঠিত হয়। রাজাকার কমান্ডার ছিল মনসের ডাকাত, রহিম উদ্দিন, আব্দুস ছাত্তার প্রমুখ। এরা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্বন্ধে পাকহানাদারদের বিভিন্ন তথ্য প্রদান করত এবং বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাত। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা কাজিপুরের বিভিন্ন স্থানে হত্যা, গণহত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটায়। পাকসেনারা কাজিপুর থানায় প্রবেশের সময় তরফদার বাড়ি এবং কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এরপর তারা সাউট টালার জ্যোতিন্দ্রনাথ সরকার, বানিন্দ্রনাথ তরফদার, প্রিয়নাথ তরফদার, জিতেন্দ্রনাথ তরফদার, তারা ডাক্তার এবং ময়েজউদ্দিন আকন্দের বাড়িসহ হিন্দুপাড়ায় আগুন দেয়। ফেরার পথে সিরাজগঞ্জ সংগ্রাম পরিষদের সদস্য আমির হোসেন ভুলুর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
৫ই মে অস্ত্র উদ্ধারের উদ্দেশ্যে এবং ময়েজউদ্দিন রাজাকারের প্ররোচনায় পাকবাহিনী ভোররাতে গান্ধাইল গ্রামে প্রবেশ করে। কিন্তু কোনো অস্ত্র না পেয়ে ৯ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। এ ঘটনা —গান্ধাইল গণহত্যা নামে পরিচিত। ১৭ই নভেম্বর বরইতলা গ্রামে দেড় শতাধিক নিরীহ মানুষকে হত্যা করে, যা বরইতলা গণহত্যা- নামে পরিচিত। তারা গান্ধাইল, বীর সিংড়াবাড়ি, বরইতলা ও খামারপাড়ায় তিনশতাধিক ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং লুণ্ঠন চালায়। বরইতলায় রাবেয়া খাতুন ও জেলতন নেছা নামে দুজন নারী পাকবাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা ভাটপিয়ারী রাজাকার ক্যাম্পে বিভিন্ন এলাকা থেকে যুবকদের ধরে এনে নির্যাতন করত এবং কাউকে-কাউকে হত্যা করে যমুনা নদীতে ফেলে দিত। এছাড়া পাকসেনারা কাজিপুর থানা ক্যাম্প ও ডাকবাংলোকে নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করত। এখানে মুক্তিযোদ্ধা, যুবক ও নারীদের ধরে এনে অমানবিক নির্যাতন করত। তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে কাউকে ছেড়ে দিত, আবার কাউকে গুলি করে নদীতে ফেলে দিত।
কাজিপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হয় বরইতলার যুদ্ধ ও কাজিপুর থানা আক্রমণ । বরইতলার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৪ই নভেম্বর মোজাফফর হোসেন মোজামের নেতৃত্বে। কয়েক ঘণ্টাব্যাপী এ-যুদ্ধে ৪৯ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। কাজিপুর থানা আক্রমণ পরিচালিত হয় তিনবার ১০ই সেপ্টেম্বর, ২রা ডিসেম্বর ও ৩রা ডিসেম্বর। এতে বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৩রা ডিসেম্বর পাকসেনারা কাজিপুর ছেড়ে সিরাজগঞ্জ শহরে চলে যায়। ফলে এদিনই কাজিপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয় এবং লুৎফর রহমান দুদু কাজিপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
কাজিপুর থানায় বিভিন্ন যুদ্ধে ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন- রবিলাল দাস (পিতা বিষ্ণু রবিদাস, তারাকান্দি), সুজাবত আলী (পিতা দেলবার মণ্ডল, মাথাইল চাপড়), সোহরাব হোসেন (পিতা এলাহী বক্স, মিরারপাড়া), আব্দুস সামাদ (পিতা অসীম উদ্দিন, কাচিহারা), সোহরাব হোসেন (পিতা মমতাজ উদ্দিন, দোয়েল), আব্দুর রাজ্জাক (পিতা হাবিবুর রহমান, চর আদিত্যপুর), চাঁন মিয়া (পিতা আফাজ উদ্দিন, চর কাজিপুর), আব্দুল মজিদ সরকার (পিতা আব্দুস সোবাহান, চর তেকানি), শাহ জামাল (পিতা ইসমাইল প্রামাণিক, পশ্চিম খুকশিয়া), জমসের আলী (পিতা নাসির উদ্দিন, চরছিন্না), সোলায়মান হোসেন (পিতা ছাবেদ আলী, কাচিহারা), দেলশাদ (পিতা ছন্দের মন্ডল, চরগিরিশ), ইজ্জত আলী (পিতা ইঞ্জিল মণ্ডল, সিংড়াবাড়ি) এবং আব্দুল আজিজ (পিতা ছিলিম খাঁ, পূর্ব খুকশিয়া)।
কাজিপুর থানায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে তিনটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। সেগুলো হলো- বরইতলা যুদ্ধের স্মরণে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, আলমপুর চৌরাস্তায় নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ এবং পিপুলবাড়িয়ায় নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রবিলাল দাসের স্মরণে একটি মঠ নির্মিত হয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে সেটি বিলুপ্ত। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা কারিগরি স্কুল এন্ড কলেজ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ও মুক্তিযোদ্ধা ভবন- এর নির্মাণকাজ চলছে। [মো. রেজাউল করিম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!