You dont have javascript enabled! Please enable it!

কাজিরচর-রামপুর যুদ্ধ (কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ)

কাজিরচর-রামপুর যুদ্ধ (কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ) সংঘটিত হয় ১৬ই জুলাই কটিয়াদী উপজেলার কাজিরচর ও পার্শ্ববর্তী মনোহরদী উপজেলার রামপুর এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদে। পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সংঘটিত এ-যুদ্ধ ছিল এক মরণপণ যুদ্ধ। ব্রহ্মপুত্র নদের দক্ষিণ পাড়ে নরসিংদী জেলার প্রান্তদেশ রামপুর ও উত্তর পাড়ে কিশোরগঞ্জ জেলার সর্বশেষ সীমা কাজিরচর। রামপুর বাজার সংলগ্ন পশ্চিম পাশে জেলেপাড়ার গুদারাঘাট। এখানে ঘন ঝোঁপঝাড়, লতাগুল্মাদি, নানাবিধ বনজ বৃক্ষাদি আর পানের বরজের ছড়াছড়ি। বিপরীত দিকস্থ উত্তর পাড়ে কাজিরচরের কোণ ও পার্শ্ববর্তী দিগাম্বরদী (সুতালরী) গ্রামের সিকি কিলোমিটার দক্ষিণে বিরাট আকারের চরাঞ্চল। এখানে ব্রহ্মপুত্র নদ এক সুবিশাল বাঁক নিয়েছে। কৌশলগত কারণে ত্রিভুজাকৃতির এই চড় ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১৪ই জুলাই বেলাবতে কয়েকটি লঞ্চভর্তি পাকসেনারা স্বাধীনতাবিরোধী স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় সেখানে এম্বুশরত মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। বেলাবর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুবেদার আবুল বাশারসহ ৮জন মুক্তিযোদ্ধা তখন শহীদ হন। এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে কটিয়াদী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা সংকল্পপবদ্ধ হন। গোপনসূত্রে তাঁরা খবর পান যে, বেলাব থেকে পাকসেনারা লঞ্চযোগে কটিয়াদী হয়ে মঠখলার দিকে যাবে। রামপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান ক্যাম্প ছিল নূরু মেম্বারের বাড়িতে। সেখানকার সাহসী কমান্ডার ছিলেন শেখ হারুন। রামপুর, খিদিরপুর ও সাগরদী এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা একসঙ্গে পাকবাহিনীর ওপর হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সে অনুযায়ী তাঁরা যথাসময়ে নদীর উভয় পাড়ে এম্বুশ করেন। ঝোঁপঝাড়ের কারণে আড়াল নেয়ার সুবিধা বেশি থাকায় রামপুর অংশে অধিক সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেন। কাজিরচর অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল ছিল। ১৪ই জুলাই পাকিস্তানি সেনাদের ৫টি গানবোট বেলাব থেকে কটিয়াদীতে এসে অবস্থান নেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের দলনেতা শেখ হারুন খবর পান যে, পরদিন ১৫ই জুলাই গানবোটগুলো যুদ্ধ-সরঞ্জাম ও খাদ্যসামগ্রী নিয়ে মঠখলা হয়ে ময়মনসিংহ অথবা ঢাকার দিকে যাবে। তিনি তখন মনোহরদীর সাগরদীতে অবস্থান করছিলেন। স্থানীয় আরেকজন গ্রুপ কমান্ডার ইপিআর ইঞ্জিনিয়ার কোরের সিপাহি মোশাররফ হোসেন কিরণের নেতৃত্বে ২০জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল শেখ হারুনের দলের সঙ্গে যোগ দেয়। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, রামপুর বাজারের পশ্চিম পাশে গানবোটগুলোকে আক্রমণ করবেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা যথাস্থানে এম্বুশ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানি বাহিনী ঐদিন কটিয়াদী থেকে যাত্রা করেনি। মুক্তিযোদ্ধারা বেশ খানিকটা রাত পর্যন্ত এম্বুশ স্থলে অবস্থান করে স্থানীয় একটি বাড়িতে বাকি রাত কাটান। পরদিন ১৬ই জুলাই সকাল আটটার দিকে পাকিস্তানি নিশান উড়িয়ে পরপর কয়েকটি গানবোট পশ্চিমদিকে আসতে থাকে। গানবোটগুলো দুটি করে জোড় বেঁধে আসছিল। তা দেখে পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি দলে বিভক্ত করা হয়। তিনটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ হারুন, কিরণ এবং সানোয়ার। সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন শেখ হারুন। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা পজিশন নেন। কথা ছিল, গানবোটগুলো ১নং ও ২নং দল পার হয়ে ৩নং দলের ফায়ারিং রেঞ্জের মধ্যে এলেই আক্রমণ শুরু হবে। প্রথমে শেখ হারুন ফায়ার ওপেন করে সংকেত দিলে সকল মুক্তিযোদ্ধা একযোগে গুলি ছুড়বেন। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর প্রথম জোড়া লঞ্চ দেখামাত্র অতি উত্তেজনাবশত ২নং দলের মুক্তিযোদ্ধা আফতাব উদ্দিন হঠাৎ গুলি চালানো শুরু করেন। এতে পূর্বপরিকল্পনার ব্যত্যয় ঘটে।
তখন বাধ্য হয়ে অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও একযোগে গুলি চালাতে আরম্ভ করেন। জবাবে পাকহানাদাররাও ভারী মর্টারশেল ও মেশিনগানের গোলাবর্ষণ শুরু করে। পাকবাহিনীর বেপরোয়া গোলাবর্ষণে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা এম্বুশ ছেড়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। অগ্রগামী দুই জোড়া গানবোট আক্রান্ত হয়েছে দেখতে পেয়ে কিছুটা দূরে পেছনে কাভার দেয়া অন্য গানবোটগুলো গতি কমিয়ে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে। পরে কিছুটা এগিয়ে এসে রামপুর বাজার থেকে সামান্য দূরে নদীতীরে গানবোট ভেড়ায়।
পাকিস্তানি হানাদাররা তীরে উঠে গান পাউডার দিয়ে রমেশ দাসের বাড়িতে আগুন দিয়ে সব জ্বালিয়ে দেয়। শশী বর্মণ ও নিশি বর্মণের বাড়িও আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করে। রামপুর বাজার সংলগ্ন পশ্চিম পাড়ার শশীমোহন দাস নামে সত্তরোর্ধ এক নিরীহ গ্রামবাসী জীবন রক্ষার্থে ঝোঁপের আড়ালে আত্মগোপন করতে গেলে পাকিস্তানি হানাদাররা তাকে গুলি করে হত্যা করে। তারা রামপুর বাজারে ঢুকে আব্দুস সাত্তারের দোকান ভাঙচুর করে। এরপর তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দুজন সহযোগীকে ধরে ফেলে। দুজনের একজন মানিক মাঝি কৌশলে হাতের বাঁধন খুলে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মরক্ষা করেন।
এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা সম্পূর্ণ বিজয়ী হতে না পারলেও শত্রুপক্ষের ব্যাপক ক্ষতি হয়। শত্রুসেনাদের কেউ-কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে অথবা আতঙ্কে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে হতাহত হয়। পাকসেনারা নিহত ও আহতদের মঠখলা সেনাক্যাম্পে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় প্রেরণ করে। কাজিরচর-রামপুরের এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্য মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আবদুর রশিদ, আতাউর রহমান, মোশাররফ হোসেন, হায়দার আলী নান্নু, আবদুল আউয়াল, কাজী মোস্তফা, কাজী সাইদুর রহমান, আব্দুল কুদ্দুস, জয়নাল আবেদীন, আমিনুল ইসলাম, মজিবুর রহমান, মতিউর রহমান, মোস্তফা, মো. শামসুদ্দিন, তমিজ উদ্দিন, আবু তাহের, আতাউর রহমান, আব্দুল জব্বার, রফিকুল ইসলাম, আহম্মদ হোসেন খান, আব্দুল হাকিম, আব্দুল মালেক প্রমুখ। [মো. রফিকুল হক আখন্দ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!