শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত কাজী আজিজুল ইসলাম
কাজী আজিজুল ইসলাম (১৯৩০-১৯৭১) শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত। তিনি ১৯৩০ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থান ভারতের জলপাইগুড়িতে। পিতা সেখানে চাকরি করতেন। তাঁদের আদি নিবাস কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার চিওরা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম কাজী আমিনুল ইসলাম, মাতা আছিয়া বেগম।
জলপাইগুড়িতে প্রথমিক শিক্ষা শেষ করে কাজী আজিজুল ইসলাম কৃতিত্বের জলপাইগুড়ি হাইস্কুল থেকে
মেট্রিকুলেশন এবং জলপাইগুড়ি কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাস করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি হিসাববিজ্ঞানে সম্মান এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষা শেষে তিনি ভাষা-আন্দোলন-এ যোগ দেন। এ কারণে তিনি কয়েকটি ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হন। ভাষা-আন্দোলনের কর্মসূচি পালনে তিনি নিজের অর্থ ব্যয় করেন। ১৯৫৫ সালের ২রা আগস্ট তিনি সাব-ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক-১ শাখায় সেকশন অফিসার হিসেবে যোগ দেন। আগরতলা মামলা – চলাকালীন সময়ে তিনি ঐ শাখা থেকে মামলা সংক্রান্ত গোপন নথিপত্র অভিযুক্তদের প্রতিনিধির নিকট গোপনে সরবরাহ করতেন। ১৯৭০ সালের ৬ই মে তিনি এডিসি জেনারেল হিসেবে বরিশালে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বহু মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এ সময় তিনি ভোলায় বন্যাপীড়িত মানুষের মাঝে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্বে তিনি বরিশাল জেলার আওয়ামী লীগ-এর এমএনএ, এমপিএ এবং নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তোলেন। ২৬শে মার্চ সকাল ১১টায় বরিশাল সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ‘স্বাধীন বাংলা সরকারের দক্ষিণাঞ্চলীয় সচিবালয়’ প্রতিষ্ঠার পর ২৭শে মার্চ সেখানে উপস্থিত হয়ে সচিবালয়ের অধীনে দায়িত্ব পালনে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ২৮শে মার্চ সেখানে তিনি নিজ উইলি জিপ গাড়িটি সচিবালয়ের ব্যবহারের জন্য প্রদান করেন। এরপর তিনি একটি হামবার্ক সাইকেলে চড়ে কালেক্টরেট ভবনে চলে যান। মৃত্যু পর্যন্ত এই সাইকেলেই তিনি চলাফেরা করতেন।
স্বাধীন বাংলা দক্ষিণ অঞ্চলীয় সচিবালয়ের সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী কাজী আজিজুল ইসলাম ৩রা এপ্রিল থেকে বরিশাল ত্রিশ গোডাউনের খাদ্য সামগ্রী ডিলারদের মাধ্যমে গ্রাম অঞ্চলে তা সরিয়ে নেয়ার কাজের সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৮ই এপ্রিল পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর যুদ্ধ বিমান বরিশাল শহরের ওপর বোমাবর্ষণ করে বহু লোককে হতাহত করে। হামলার পর সচিবালয়ের পক্ষ থেকে মাইকযোগে নগরবাসীকে শহর ছেড়ে গ্রামে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার জন্য বলা হয়। এ ঘোষণার পর কাজী আজিজুল ইসলাম তাঁর স্ত্রী ও পুত্র-কন্যাদের নিয়ে বরিশাল শহরের পশ্চিমে মনসুর মীরার
কড়াপুরে বাড়িতে আশ্রয় নেন। এ সময় ভোলায় সেকেন্ড অফিসারের বদলিজনিত কারণে রিলিফ কাজে অচল অবস্থার সৃষ্টি হলে স্বাধীন বাংলা দক্ষিণ অঞ্চলীয় সচিবালয়ের পক্ষ থেকে কাজী আজিজুল ইসলামকে ভোলায় পাঠানো হয়। ২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী বরিশাল শহর দখল করলে মুক্তিযোদ্ধারা শহর ছেড়ে গ্রামে অবস্থান নেন। এ-সময় একদল দুর্বৃত্ত ভোলা ট্রেজারিতে রক্ষিত টাকা লুট করতে গেলে কাজী আজিজুল ইসলাম পুলিশের সহযোগিতায় তা প্রতিহত করেন।
৫ই মে কাজী আজিজুল ইসলাম স্ত্রী ও সন্তানদের খোঁজ নিতে গোপনে লঞ্চযোগে বরিশালে এলে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়েন। হানাদাররা তাঁকে ওয়াপদা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন ইয়াহিয়ার নির্দেশে ঐদিন সন্ধ্যার পর ত্রিশ গোডাউনের পূর্বদিকের রাস্তার পাশে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরেরদিন ত্রিশ গোডাউনের জনৈক খাদ্য কর্মকর্তা রাস্তার পাশে কাজী আজিজুল ইসলামের গুলিবিদ্ধ লাশটি দেখতে পান। ঐ খাদ্য কর্মকর্তা দিনশেষে রাতের অন্ধকারে গোডাউনের কুলিদের সহযোগিতায় রাস্তার পাশে গর্ত করে তাঁর লাশ মাটিচাপা দেন।
বরিশাল শহর হানাদারমুক্ত হলে ডিসেম্বরের শেষদিকে কাজী আজিজুল ইসলামের স্ত্রী মিসেস আয়েশা ইসলাম পুত্র কাজী আতিকুল ইসলামকে নিয়ে বরিশালে আসেন এবং ত্রিশ গোডাউন এলাকায় স্বামীর কবরের সন্ধান করতে থাকেন। ঐ খাদ্য কর্মকর্তা রাস্তার পাশের মাটিচাপা দেয়া স্থানটি তাঁকে দেখান। নিশ্চিত হওয়ার জন্য কবরের মাটি খোঁড়া হয়। মাটির নিচে পাওয়া মাথার খুলির সঙ্গে চোয়ালের বাঁধানো দাতটি দেখে তিনি নিশ্চিত হন যে, এটিই তাঁর স্বামী শহীদ কাজী আজিজুল ইসলামের কঙ্কাল। ত্রিশ গোডাউনের এ খাদ্য কর্মকর্তার সহযোগিতায় কবরটি কোনোরকমে বাঁধাই করে চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ১লা মার্চ শহীদ কাজী আজিজুল ইসলামের বিষয়ে একটি বিশেষ গেজেট প্রকাশ করে (মিনিস্ট্রি অব কেবিনেট এফেয়ার্স No. EDI-53/72-576-29th February 1972)। পরবর্তীতে শহীদ কাজী আজিজুল ইসলামের কবর বাঁধাই করে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ, তাঁর প্রতিকৃতির ম্যুরাল এবং নামফলক স্থাপন করা হয়। শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে ত্রিশ গোডাউন হয়ে নদীর পাড় পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ কাজী আজিজুল ইসলাম সড়ক’। বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালে শহীদ কাজী আজিজুল ইসলামকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড