You dont have javascript enabled! Please enable it! বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড আলবদর নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান - সংগ্রামের নোটবুক

 

একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের আগমুহূর্তে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অন্যতম দুই হােতা আল-বদর নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরােধী অপরাধের মামলায় দুজনকেই ফাসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তাদের বিরুদ্ধে আনা ১১টি অভিযােগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল এ রায় প্রদান করেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণ
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি মাে. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মাে. শাহিনুর ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে রায় ঘােষণা করেন। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, জামায়াতে ইসলামীর মস্তিষ্কপ্রসূত ঘাতক বাহিনী আল-বদর একাত্তরে বুদ্ধিজীবী নিধনের যে নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছে, তা গােটা জাতির বুকে ক্ষত হয়ে আজও রক্ত ঝরাচ্ছে। আমরা আরও বিশ্বাস করি, গত চার দশকে মাটির শ্রেষ্ঠ।

কামারুজ্জামান জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের ময়মনসিংহ জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি হিসাবে ২২ শে এপ্রিল ১৯৭১ জামালপুর মহকুমায় আশেক মাহমুদ কলেজে ইসলামী ছাত্র সংঘের বাছাই করা একান্ত অনুগত নেতা-কর্মীদের নিয়ে প্রথম আল-বদর বাহিনী গড়ে তােলার পেছনে প্রধান সংগঠকের ভূমিকা পালন করে। কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে মাসখানেকের মধ্যে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার সমস্ত ছাত্রসংঘ কর্মীকে আল-বদর বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মামলার কার্যক্রম ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযােগে করা মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ২ অক্টোবর তাকে মানবতাবিরােধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানাে হয়। ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১-এ তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোেগ দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল মামলাটি ট্রাইবুনাল-২-এ স্থানান্তর করা

ট্রাইব্যুনাল-২ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ৪ জুন মানবতাবিরােধী অপরাধের সাতটি অভিযােগ গঠন করেন। ২ জুলাই এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। তদন্ত কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপক্ষের ১৮ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন এবং আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন পাঁচজন। উভয় পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে চলতি বছরের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয় এবং শেষ হয় ৩১ মার্চ। আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন ২ এপ্রিল শুরু হয়ে ১৫ এপ্রিল শেষ হয়। যুক্তি উপস্থাপন শেষে ১৬ এপ্রিল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষাধীন রাখেন ট্রাইব্যুনাল।
অভিযােগ ও রায়ের পর্যবেক্ষণ
একাত্তরের ২৯ জুন তার নেতৃত্বে আল-বদররা শেরপুরের ঝিনাইগাতি থানার রামনগর গ্রামের বদিউজ্জামানকে অপহরণ ও নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করে। প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল বলেন, কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদরের দলটি কূটকৌশলে বদিউজ্জামানকে অপহরণ করে এবং আহম্মেদনগর ক্যাম্পে সেনাদের কাছে হস্তান্তর করে, যার পরিণতি ভালাে করেই জানতাে। জেনেশুনে এ কাজ করার মাধ্যমে সে হত্যার মতাে মানবতাবিরােধী অপরাধে উৎসাহ জুগিয়েছে, উসকানি দিয়েছে ও সহায়তা করেছে।
কামরুজ্জামান ও তার সহযােগীরা শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় নগ্ন করে শহরের রাস্তায় হাঁটাতে হটাতে চাবুকপেটা করে। রায়ে বলা হয়, হান্নানের প্রতি অমানবিক আচরণের ঘটনাটি রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং ওই ঘটনা কামারুজ্জামানের পূর্ণ সহযােগিতায় ও জ্ঞাতসারে হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের ১১, ১২ ও ১৩ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্য অনুসারে একাত্তরের ২৫ জুলাই। আল-বদর ও রাজাকার বাহিনীর সদস্য এবং পাকিস্তানি সেনারা সম্মিলিতভাবে | সােহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড ও নারী ধর্ষণ করে। রায়ে বলা হয়, যৌন নির্যাতনের শিকার তিন নারীর সাক্ষ্যে ওই অপরাধের ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে। কামারুজ্জামানের কর্মকাণ্ড, আচরণ ও প্রভাবের মাত্রা সবকিছু মিলিয়ে এ ঘটনায় তার অংশগ্রহণকেই প্রতিষ্ঠা করে। আল-বদর নেতা কামারুজ্জামান এখানে উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করে এবং সে পুরাে ঘটনা জানতাে। সােহাগপুরে দলগতভাবে শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যা ও নির্বিচার যৌন হামলার দায় নেতৃত্বস্থানীয় কামারুজ্জামানের ওপর পড়ে। রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় ও পঞ্চম সাক্ষীর সাক্ষ্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে, মুক্তিযুদ্ধকালে আল-বদর সদস্যরা গােলাম মােস্তফাকে অপহরণ করে সুরেন সাহার বাড়িতে স্থাপিত আল-বদর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী মােহন মুন্সির ‘স্যারের হাত এখন সই হইছে, এখন সাহস হইছে, বন্দুক চালাইতে পারে। এ বক্তব্য গােলাম মােস্তফা হত্যায় কামারুজ্জামানের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। রাষ্ট্রপক্ষের নবম সাক্ষীর সাক্ষ্য অনুসারে, দারা ও তার বাবা টেপা মিয়াকে অপহরণ। করে আল-বদর সদস্যরা জিলা পরিষদ ডাকবাংলাের আল-বদর ক্যাম্পে নিয়ে যায়।
প্রথম সাক্ষী বলেছেন, ওই ক্যাম্পে ২০-৩০; কখনাে ৪০ জন আল-বদর সদস্য অবস্থান করতে । নবম সাক্ষী বলেছেন, কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদররা প্রায়ই ওই ক্যাম্পসংলগ্ন নদীর ঘাটে নিয়ে গুলি করে লােকজনকে হত্যা করতাে। রাষ্ট্রপক্ষের ১৫তম সাক্ষী বলেছেন, কামারুজ্জামানকে প্রায়ই আগ্নেয়াস্ত্রসহ তার ক্যাম্প কার্যালয়ে দেখা যেত। এসব সাক্ষ্যের বিশ্লেষণ করে রায়ে বলা হয়, ওই ক্যাম্পে সংঘটিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পদ্ধতি কামারুজ্জামান পরিচালনা করতাে। ওই পদ্ধতির মধ্যেই দারা ও টেপা মিয়াকে অপহরণ এবং পরে দারাকে হত্যা করা হয় । রায়ে বলা হয়, উর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় বেসামরিক নেতাদের ওপর বর্তায়। কারণ, অধস্তন বা প্রকৃত অপরাধীদের ওপর তাদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ থাকে। এটা প্রমাণিত যে, অপরাধগুলাে সংঘটিত হয়েছে দুটি আল-বদর ক্যাম্পে বা আল-বদর সদস্যদের মাধ্যমে অথবা আহম্মেদনগর সেনাক্যাম্প থেকে। আল-বদর ক্যাম্পগুলােতে বা আল-বদর সদস্যদের ওপর কামারুজ্জামানের দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ছিল।
আল-বদরকে মনে করা হতাে পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দল জামায়াতের ‘অ্যাকশন সেকশন’। কামারুজ্জামান অপরাধ করতে আল-বদর বাহিনীর সদস্যদের পরিচালনা করেছে, পরিকল্পনা করেছে, পরামর্শ, উসকানি ও নৈতিক সমর্থন দিয়েছে। সাক্ষ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, উল্লিখিত মানবতাবিরােধী অপরাধের ঘটনাগুলাে ঘটে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বেসামরিক নিরস্ত্র মানুষকে লক্ষ্য করে । ১, ২, ৩, ৫ ও ৬ নম্বর অভিযােগে উল্লিখিত ঘটনা ঘটে একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে ২৪ এপ্রিলের মধ্যে, ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ শুরু হওয়ার এক মাসের মধ্যে। শুধু চতুর্থ অভিযােগের ঘটনাকাল ২৫ নভেম্বর। কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে সাতটি অভিযােগের মধ্যে পাঁচটি অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। প্রথম, তৃতীয়, চতুর্থ ও সপ্তম এই চারটি অভিযােগে মানবতাবিরােধী অপরাধ হিসেবে হত্যায় সংশ্লিষ্টতা বা সহযােগিতার জন্য এবং দ্বিতীয় অভিযােগে মানবতাবিরােধী অপরাধ হিসেবে অমানবিক আচরণের দায়ে কামারুজ্জামানকে। দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
শাস্তি শাস্তির বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, সােহাগপুর গ্রামে নির্বিচার হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনাটি চরম হিংস্র প্রকৃতির ছিল। কামারুজ্জামান তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে তার অংশগ্রহণ প্রমাণ করেছে। হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি নির্বিচার যৌন নিপীড়ন মানবিকতাবােধকে উৎখাত ও ধ্বংস করেছে, যার দায় কামারুজ্জামানের উপর বর্তায়। চূড়ান্ত আদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ২০(২) ধারা অনুসারে তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযােগে কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। প্রথম ও সপ্তম অভিযােগে অপরাধের গভীরতা ও আনুপাতিকভাবে অপরাধীর সংশ্লিষ্টতা বিবেচনা করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং দ্বিতীয় অভিযােগে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

সূত্র : ফিরে-দেখা-৭১-যুদ্ধাপরাধীদের-বিচার-সুজন-হালদার