মুক্তিযুদ্ধে কাউনিয়া উপজেলা (রংপুর)
কাউনিয়া উপজেলা (রংপুর) ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটে, তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ৬ দফা প্রণয়ন করেন। এর ফলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ভীত- সন্ত্রস্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে <আগরতলা মামলা দায়ের করে এবং বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে প্রেরণ করে। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন, যা পরবর্তীতে আরো তীব্র হয়ে গণআন্দোলনে রূপ নেয়। ৬৯-এর গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনে – আওয়ামী লীগ- নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় সংসদ অধিবেশন বন্ধ ঘোষণা করে। ফলে আবারো আন্দোলন নতুন মাত্রায় রূপ নেয় এবং প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে কাউনিয়ার সর্বস্তরের জনতা মুক্তিযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়। ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে অসহযোগ আন্দোলন-এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১০ই মার্চ রংপুর জেলাধীন কাউনিয়া, পীরগাছা ও গঙ্গাচড়া নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত আব্দুল আউয়াল এমএনএ-কে সভাপতি এবং আজিজার রহমান চৌধুরীকে সদস্য-সচিব করে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিলেন- আব্দুর রহমান (চেয়ারম্যান, টেপামধুপুর), মৌলভী সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ (বালাপাড়া আওয়ামী লীগের সভাপতি), ডা. ইসমাইল হোসেন, কেতাব আলী প্রধান, এলাহী বক্স মণ্ডল, ভূষণ চন্দ্র বর্মণ, ডা. রহিমুদ্দিন বসুনিয়া, ওমর আলী (চেয়ারম্যান), মহির উদ্দিন বসুনিয়া, মোখলেছার রহমান বসুনিয়া, হাকিবুর রহমান মাস্টার, ইদ্রিস আলী মাস্টার, মোমতাজুর রহমান, এমদাদুর রহমান, ইয়াকুব আলী, কফিল উদ্দিন সরকার, আছিম উদ্দিন সুটকু, নেছাব উদ্দিন, নূরুল ইসলাম (টুল্লা), বন্দে আলী প্রামাণিক, শাহজাহান মাস্টার, আনছার আলী (ঘাটিয়াল), বুলু মাস্টার, তমেজ উদ্দিন মাস্টার, শহিদুর রহমান, বেদারুল আলম হীরু, রাশেদুল ইসলাম বাচ্চু, বখতে জামান মাস্টার, মজিবুর রহমান (প্রেসিডেন্ট, হারাগাছ বিড়ি শ্রমিক ইউনিয়ন), আজিজ মাস্টার, রমেশ চন্দ্র বর্মণ মাস্টার প্রমুখ। একই সঙ্গে ছাত্রনেতা এম এ কুদ্দুসের নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন রবিউল হাসান বাবলু, সদস্য- সচিব নাদিরুজ্জামন নাদির, অর্থ-সম্পাদক তৈয়বুর রহমান এবং সদস্য ফজলুল হক, আব্দুর রশিদ, আজিজুল হক, আরজউল্লাহ, বিল্লাল হোসেন, লুৎফর রহমান, হযরত আলী মিয়া, আব্দুল মজিদ, আব্দুস সালাম, মোফাজ্জল হোসেন, পেশকার আলী, হযরত আলী প্রমুখ।
৪ঠা এপ্রিল তিস্তা ব্রিজের যুদ্ধের পর সামরিক বাহিনীর এএমসি কোরের বাঙালি সদস্য জয়নাল আবেদীনের নিকট ৩টি থ্রি-নট থ্রি-রাইফেল ও এক বাক্স গুলি ছিল। সেগুলো দিয়েই ২০শে এপ্রিল চরঢুষমারায় সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণ দেন সুরুজ্জামান। হারাগাছ দরদী উচ্চ বিদ্যালয়ের ল্যাবরটরিতে বিজ্ঞান শিক্ষক হাকিবুর রহমান, আবুল কাশেম, এবাদুর রহমান প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ এসিড ও পেট্রোল দিয়ে বোমা তৈরির ব্যবস্থা করেন। হারাগাছ গ্রামের আব্দুল হক দিনাজপুর থেকে সাঁওতালদের নিকট থেকে বিষমাখানো তীর-ধনুক ক্রয় করে এনে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। এদিকে মুস্তাফিজুর রহমান মুকুলের নেতৃত্বে নাজিরদহ চরে মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি প্রাথমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হয়। কাউনিয়া উপজেলায় যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন তিনজন। তাঁরা হলেন মো. তাজির উদ্দিন (পিতা কেফায়েত উল্লাহ প্রামাণিক, সাবদী), আজাহারুল ইসলাম (পিতা আজিজার রহমান আকন্দ, সদরাতালুক) ও সরদার আব্দুল হাকিম (পিতা আম্বার উদ্দিন, সদরাতালুক)
সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ ২৮শে মার্চ কাউনিয়া থানা থেকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ২৯শে মার্চ তিস্তা থেকে আসা একটি ঝটিকা মিছিলের সঙ্গে সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ একত্রিত হয়ে থানা ঘেরাও করেন। বিক্ষুব্ধ জনতা রংপুর থেকে কাউনিয়ার দিকের কাঁচা রাস্তাটি খনন করে কাউনিয়ায় পাকিস্তানি সৈন্যদের আগমনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তিস্তা ব্রিজের মাঝখানে রেলের একটি মালবাহী বগি রেখে ব্রিজের দুপাশের রেললাইন উপড়ে ফেলে পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রবেশের পথ বন্ধ করে দেয়। ৩১শে মার্চ রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ও ইপিআর ক্যাম্প থেকে অস্ত্রসহ পালিয়ে আসা বাঙালি সেনা ও ইপিআর সদস্য এবং ছুটিতে আসা সেনাসদস্যরা মিলে তিস্তা ব্রিজের উত্তর পাশে ক্যাম্প স্থাপন করে পাকিস্তানি সেনাদের প্রবেশের পথে সতর্ক অবস্থান নেন। ৩০শে জুন জয়েন উদ্দিনের নেতৃত্বে এলাকাবাসী তকিপল বাজারের নিকট রেললাইন তুলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
১লা এপ্রিল কাউনিয়া উপজেলায় পাকিস্তানি বাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটে। তিস্তা ব্রিজে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে এক প্লাটুন সৈন্যসহ পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন এজাজ কাউনিয়া থানায় আসে এবং ওসি আব্দুস সাত্তার (সাত্তার ঠাকুর)-কে সঙ্গে নিয়ে তিস্তা ব্রিজে আক্রমণ চালায়। ব্রিজের উত্তর পাশে ওঁৎ পেতে থাকা বাঙালি সেনারা গুলি চালালে ওসি সাত্তার ঠাকুর নিহত হয়। ঐ যুদ্ধে পাকবাহিনী পরাজিত হয়ে কাউনিয়া থানায় প্রত্যাবর্তন করে। পরের দিন আবারো পাকবাহিনী ব্রিজ আক্রমণ করে। সেই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন এজাজসহ ১৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। এটি তিস্তা ব্রিজ যুদ্ধ নামে পরিচিত। ৪ঠা এপ্রিল পাকবাহিনী কাউনিয়া থানা এবং তিস্তা ব্রিজের দুপাশে ক্যাম্প স্থাপন করে। তারা ১২ই এপ্রিল হারাগাছ ‘ডাক্তার বিড়ি’র মালিক নওসের মহাজনের বাড়িতে এবং অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে টেপামধুপুর শঠিবাড়ীতে ক্যাম্প স্থাপন করে।
কাউনিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এর সদস্যদের মধ্যে রইচ উদ্দিন আহম্মেদ (পিপিপি-র আহ্বায়ক, সাবেক এমএলএ), ডা. আব্দুস সামাদ (নাজিরদহ), আব্দুল হামিদ (খোপাতী), আব্দুল কদ্দুস সরকার (খোপাতী), আব্দুল কদ্দুস মণ্ডল (হরিচরণ নস্কর), আলতাব হোসেন তালুকদার (খোদ বালাপাড়া), আহাম্মদ হোসেন তালুকদার ওরফে ফুনু (খোদ বালাপাড়া), আব্দুল জলিল সরকার (সাবেক চেয়ারম্যান, শহীদবাগ), কালু মুন্সি আবু (রাজাকার কমান্ডার, মীরবাগ), রহিম উদ্দিন ভরসা (সারাই), মোবারক চৌধুরী (সারাই), ইসাহাক আলী প্রেসিডেন্ট (সারাই), আব্দুল মান্নান ওরফে হাড়ি মান্নান (সারাই), মনছুর আলী চেয়ারম্যান (সারাই), নাদের হোসেন বকরী (হারাগাছ), আব্দুস সামাদ (হারাগাছ), আসান আলী মেম্বার (হারাগাছ), তোফেল (হারাগাছ), এন্তাজ উদ্দিন (হারাগাছ), আজিজার রহমান লম্বু (হারাগাছ), ইস্রা মফিজ (হারাগাছ), আজিজার মোছারু (হারাগাছ), মকদুম মিয়া (সাবেক এমএলএ, হারাগাছ), মোটা তোফেল (হারাগাছ), পাঠান নূর হাবীব খান (হারাগাছ), নূর গুল খান (হারাগাছ), আব্দুল মান্নান সেক্রেটারি (সারাই ইউনিয়ন পরিষদ), ডা. আজিজুল হক চেয়ারম্যান (বালাপাড়া), মোসলেম উদ্দিন (চরঢুষমারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, ‘দালাল মাস্টার’ হিসেবে পরিচিত), আলিমুদ্দিন বাউদিয়া (টেপামধুপুর), আলেফ উদ্দিন ক্যাশিয়ার (টেপামধুপুর), আজগর আলী (টেপামধুপুর), আব্দুর রশিদ ওরফে টেডি রশিদ (সদরাতালুক), হজরত আলী (রাজাকার কমান্ডার, হায়বৎ খাঁ), আব্দুর রহমান (কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার, হরিশ্বর), ইউসুফ আলী (পোস্ট মাস্টার, বাজে মসকুর), আবুল সওদাগর (রাজিব), মৌলভী এ বি এম আব্দুল করিম (রাজিব), বাঘা আজিজ (রাজিব), আলহাজ্ব ইসমাইল হোসেন ওরফে গেনু হাজী (রাজিব), ঠ্যাংকাটা জব্বার (রাজিব), পেশকার আলী মুন্সী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ৪ঠা এপ্রিল পাকবাহিনী তিস্তা ব্রিজে মহেন্দ্রনগর ও কাউনিয়া থানা থেকে দ্বিমুখী আক্রমণ চালায়। এ-যুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য আফজাল হোসেন শহীদ হন। পাকবাহিনী তিস্তা ব্রিজ দখল করে নেয়। ১লা জুন তিস্তা ব্রিজ সংলগ্ন পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প থেকে তাদের তিনজন সদস্য নিজপাড়া গ্রামের একজন মহিলাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। ফলে বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী আব্দুর রহমান (কমান্ডার) ও ছফর মুহুরীর নেতৃত্বে ঐ তিন পাকসেনাকে ধরে দা-কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে টুকরা-টুকরা করে ধম্মু নারায়ণের পরিত্যক্ত বাড়ির ইঁদারায় ফেলে মাটিচাপা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে পাকবাহিনী আব্দুর রহমান (কমান্ডার) ও তাঁর ছেলে আব্দুল আউয়াল এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি মৌলভী সুলতান উদ্দিন আহম্মেদকে গ্রেপ্তার করে অমানবিক নির্যাতনের পর জেল হাজতে পাঠায়। কিছুদিন পর মৌলভী সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ ও আব্দুল আউয়াল মুক্তি পেলেও কমান্ডার আব্দুর রহমান যুদ্ধকালীন সময় পর্যন্ত জেল হাজতেই আটক ছিলেন।
৯ই জুন তিস্তা ব্রিজের পশ্চিম পার্শ্বে গদাই (মালগুদাম) নামক স্থানে দুজন হানাদার বাহিনীর সদস্য এক মহিলাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। তখন গ্রামের অন্যান্য মহিলারা ইজ্জত বাঁচাতে গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত তিস্তার নদীর একটি চ্যানেল সাঁতরিয়ে একটি চরে আশ্রয় নেয়। অতঃপর ঐ দুই পাকসেনা তাদের পিছু নিয়ে নৌকায় নদী পার হয়ে চরের ভেতর প্রবেশ করে। সেখানে আনসার আলী ও মহর আলী শেখের নেতৃত্বে চরের সাধারণ জনতা দুই সেনাসদস্যকে ধরে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে টুকরা-টুকরা করে তিস্তা নদীতে ফেলে দেয়। ১০ই জুন পাকবাহিনী তিস্তা ব্রিজসংলগ্ন ক্যাম্প থেকে শুরু করে হারাগাছ এবং তৎসংলগ্ন কুর্শা ইউনিয়ন পর্যন্ত ১০-১২টি গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় এবং এলোপাথারি গুলি করে অনেক মানুষকে হত্যা করে। বালাপাড়া ইউনিয়নের ভূতছড়া মৌজায় জোড়াবান্দা বিলের নিকট একসঙ্গে ১৫০ জন লোককে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে, যা জোড়াবান্দা গণহত্যা নামে পরিচিত। শহীদদের যেখানে গণকবর দেয়া হয়, সে স্থানটি জোড়াবান্দা গণকবর হিসেবে পরিচিত।
পাকবাহিনী হরিশ্বর গ্রামের জামাত উল্লাহ শেখ ও ছামসুল মিস্ত্রীকে ধরে নিয়ে অমানবিক অত্যাচার করে ছেড়ে দেয়। অক্টোবর মাস পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতা আবদার রহমানের বাড়ি থেকে ভায়ার হাট জমিদার বাড়ি পর্যন্ত ৩৫০টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধা সরদার আব্দুল হাকিমের পিতা আম্বার উদ্দিন, ইউসুফ আলীর পিতা মনছের আলী, সোলেমান মিয়ার পিতা তছির উদ্দিন, ইলিয়াস উদ্দিনের পিতা জাহের উদ্দিন, আওয়ামী লীগ নেতা আবদার রহমান এবং তালেব কাজীকে পাকবাহিনী গ্রেফতার করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালায়। পরে তাদের মুক্তি দেয়। এছাড়াও রাধানাথ বর্মণ, হরেন্দ্র চন্দ্র শীল ও নগেন্দ্র মহন্তকে ধরে নিয়ে নির্মম অত্যাচার শেষে গুলি করে হত্যা করে। পরবর্তীতে আবারো আওয়ামী লীগ নেতা আবদার রহমানকে গ্রেফতার করে অমানবিক নির্যাতন শেষে জেল হাজতে পাঠায়।
তিস্তা ব্রিজের দক্ষিণ পার্শ্বের পাকসেনাদের বাঙ্কার, টেপামধুপুর শঠিবাড়ী ক্যাম্পের বাঙ্কার এবং কাউনিয়া থানা পাকহানাদারদের নির্যাতনকেন্দ্র ছিল। এ উপজেলায় একটি গণকবর রয়েছে – জোড়াবান্দা গণকবর।
৩রা ডিসেম্বর থেকে ৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী-র তুমুল যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে পাকসেনারা টিকতে না পেরে ৮ই ডিসেম্বর তিস্তা ব্রিজের দক্ষিণ পাশের শেষ গার্ডারটি বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়ে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর প্রবেশপথে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করে। ঐদিনই পাকবাহিনী তিস্তা ব্রিজ ও কাউনিয়া থানা থেকে চলে যায়। অনুরূপভাবে টেপামধুপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে কোম্পানি কমান্ডার আজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। ঐ যুদ্ধে পাকবাহিনী টিকে থাকতে না পেরে পালিয়ে যায় এবং আজহার কোম্পানি টেপামধুপুর হয়ে ৯ ডিসেম্বর কাউনিয়া থানায় প্রবেশ করে। এদিনই কাউনিয়া উপজেলা হানাদার মুক্ত হয়।
কাউনিয়া থানায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা একজন বলে জানা যায়। তিনি হলেন জাফর আলী (পিতা দফের উদ্দিন, হরিচরণ)। ১০ই জুন ভূতছড়া মৌজার জোড়াবান্দা বিলের পাশে গণহত্যায় শহীদ ১৫০ জনের স্মরণে বালাপাড়া ইউনিয়নের এক অংশ কেটে শহীদবাগ ইউনিয়ন নামকরণ করা হয়েছে। কাউনিয়া দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে লালমনিরহাটে গণহত্যায় শহীদ নিজপাড়া গ্রামের মোফাজ্জল হোসেনের নামে নামকরণ করা হয়েছে। কাউনিয়া রেলস্টেশন ওভার ব্রিজটিও শহীদ মোফাজ্জাল হোসেন ব্রিজ নামে নামকরণ করা হয়। কাউনিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে (বালিকা বিদ্যালয় মোড়) স্টেশন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা এম এ কদ্দুসের নামে রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে। শহীদবাগ ইউনিয়নের মহাসড়কের পাশে খোদ ভূতছড়ায় শহীদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। জোড়াবান্দা গণহত্যায় শহীদদের গণকবরস্থলে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। বালিকা বিদ্যালয়ের মোড় থেকে টেপামধুপুর পর্যন্ত রাস্তাটি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জাফর আলীর নামে নামকরণ করা হয়েছে। [মো. সুরুজ্জামান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড