You dont have javascript enabled! Please enable it! কাঁকড়া রেলসেতু বধ্যভূমি (চিরিরবন্দর, দিনাজপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

কাঁকড়া রেলসেতু বধ্যভূমি (চিরিরবন্দর, দিনাজপুর)

কাঁকড়া রেলসেতু বধ্যভূমি (চিরিরবন্দর, দিনাজপুর) দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলায় অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে অসংখ্য লোককে হত্যা করা হয়। দিনাজপুরের আত্রাই নদীর একটি শাখা নদীর নাম কাঁকড়া। চিরিরবন্দর রেলস্টেশন থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে কাঁকড়া নদীর ওপর কাঁকড়া রেলসেতুর অবস্থান। রেলপথে দিনাজপুর থেকে পার্বতীপুর হয়ে ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা ও লামনিরহাটে যেতে হলে কিংবা ঐসব এলাকা থেকে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও বিরলে যেতে হলে এ সেতু অতিক্রম করতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ অঞ্চলে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল রেলপথ। তাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গুরুত্বপুর্ণ এই রেলসেতু রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিল। যুদ্ধের বিভিন্ন সময়ে ছোট-ছোট অনেক সেতু মুক্তিবাহিনী ধ্বংস করতে পারলেও এ সেতুর ক্ষতিসাধন করতে পারেনি।
মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে সেতুর নিরাপত্তা রক্ষায় একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছিল হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী। সেতুর দুই মাথায় তাদের ক্যাম্প ছিল। সেতুর পশ্চিম মাথার দুপাশে মাটির তলদেশে ছিল আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাম্প। সেতুর পূর্বে ছিল রাজাকার-দের ক্যাম্প। রাতদিন সেতুতে পাহাড়ার ব্যবস্থা ছিল। সেতুর অর্ধ কিলোমিটার জুড়ে মাটিতে মাইন পুঁতে রাখা হয়েছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে যুবকদের ধরে এনে বিপুল সংখ্যক বাংকার খোঁড়া হয়েছিল। বাংকার খোড়ার পর যুবকদের কাঁকড়া সেতুর তলদেশে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেতুর কাছাকাছি যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে অনেকে মাইন বিস্ফোরণে মারা গেছে। আবার অনেককে দূর থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে রাজাকার বাহিনীর যোগাযোগ হতো বিশেষ সংকেতের মাধ্যমে। রাজাকাররা গোপন খবর এনে হানাদারদের দিত। তারা নারীদের ধরে এনে হানাদারদের হাতে তুলে দিত। কাঁকড়া রেলসেতুসহ চিরিরবন্দর- দিনাজপুর রেলপথের দুপাশের বিভিন্ন গ্রামের লোকজনকে ধরে এনে এই ব্রিজের কাছে ট্রেন থামিয়ে তুলে দেয়া হতো! কখনো ব্রিজের দক্ষিণ প্রান্তে এক সঙ্গে অনেককে হত্যা করা হতো। আবার দূরের অনেক লোককে এই সেতুর কাছে নিয়ে এসে হত্যা করা হতো।
সেতুর আন্ডারগ্রাউন্ড বাংকার থেকে চিরিরবন্দর থানা ক্যাম্পে যাবার জন্য রেল লাইনের দক্ষিণ পাশ দিয়ে ট্রেঞ্চ খনন করা হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনারা ট্রেঞ্চের ভেতর দিয়ে সেতু ক্যাম্প থেকে থানা ক্যাম্পে যাতয়াত করত। ফলে দিনের বেলায়ও তাদের অবস্থান বোঝা যেত না।
কাঁকড়া নদীর রেলসেতুর দক্ষিণ পাশ ছিল একটি বড় বধ্যভূমি। এখানে বহু মানুষকে ধরে এনে দিনের পর দিন হত্যা করা হয়েছে। যাদের হত্যা করা হতো তাদের দ্বারাই হত্যার পূর্বে কবর খোঁড়ানো হতো। মেয়েদের হত্যার আগে ধর্ষণ করা হতো। এ বধ্যভূমিতে রাতের আঁধারে বিভিন্ন স্থান থেকে ট্রেনে করে লাশ এনে মাটিচাপা দেয়া হতো।
কাঁকড়া নদীকে বধ্যভূমি হিসেবে এবং কাঁকড়া রেলসেতুর উভয় দিকের ক্যাম্পকে বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহার করা হতো। সেতুর পূর্বদিকে রিভার ভিউ মিল নামে একটি রাইস মিলকেও পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা ও নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত। এখানে অনেককেই হত্যা করে লাশ কাঁকড়া সেতুর দক্ষিণ প্রান্তে বালুচাপা দেয়া হয়।
কাঁকড়া রেলসেতুতে গণহত্যা শুরু হয়েছিল এপ্রিল মাসে। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে একদিন দুপুর ১২টার দিকে পাকিস্তানি সেনা ও বিহারি ভর্তি একটি ট্রেন পার্বতীপুর থেকে মন্মথপুর ও চিরিরবন্দর হয়ে কাঁকড়া ব্রিজের পূর্ব প্রান্তে এসে দাঁড়ায়। তারপর গাড়ি থেকে নেমেই তারা এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। রিভার ভিউ মিলে চাল নিতে আসা বহু লোক পাকিস্তানি সেনাদের আগমনের ব্যাপারটি বুঝতে পারেনি। ঐ মিলে তখন অমরপুর, বাসুদেবপুর, লক্ষ্মীপুর, রঘুনাথপুর, সুখদেবপুর, আন্ধারমুহা, জগন্নাথপুর, নান্দেরাই, রাজাপুর, মহাদানী, ছোট বাউল, বড় বাউল, শ্যামনগররসহ আরো অনেক গ্রামের লোক চাল নিতে এসেছিল। কিন্তু তাদের অনেকেই আর বাড়ি ফিরতে পারেনি। তারা গণহত্যার শিকার হয়। ঐদিন প্রায় ৪ শত লোকের প্রাণহানি ঘটে। রিভারভিউ মিল পরিণত হয় বধ্যভূমিতে।
কাঁকড়া রেলসেতুর আড়াই-তিন কিলোমিটারের মধ্যে যত বাড়িঘর ছিল, তা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। আশপাশের অনেককে ধরে এনে হত্যা করা হয়। সেতুর আশপাশে নিহতদের কয়েকজন হলেন- ছিটমহাদানীর আফতাবউদ্দিন সরকারের পুত্র আব্দুর রজ্জাক সরকার (৪০), জাফর আলীর পুত্র সেকেন্দার আলী (২৬), হাজী খতিবউদ্দিনের পুত্র আব্দুল মজিদ শাহ, ভুষাপাড়ার আলিমউদ্দিনের পুত্র আজিমউদ্দিন (২৫), বাসুদেবপুরের সপিরউদ্দিন শাহ ও নসিরন খাতুনের ছেলে মো. নাসিরউদ্দিন (৪০), থানাপাড়ার নমিরউদ্দিন সরকারের পুত্র আইয়ুব আলী সরকার (৭৫), চিরিরবন্দর হাসপাতাল এলাকার খাজুমদ্দিন মণ্ডলের পুত্র মফিজউদ্দিন মণ্ডল কাচুয়া, দক্ষিণ সুখদেবপুরের বেশারউদ্দিন সরকারের পুত্র আব্দুল মালেক সরকার, মো. ছাবের আলী, চিরিরবন্দরের মো. মজুমদার প্রমুখ। [আজহারুল আজাদ জুয়েল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড