You dont have javascript enabled! Please enable it! যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-রাজাকার আব্দুল আলীম - সংগ্রামের নোটবুক

বিচারিক প্রক্রিয়া

উত্তরের জনপদ জয়পুরহাটে ৭১’র পুরাে নয় মাস এক জীবন্ত আতংকের নাম ছিল আব্দুল আলীম। বাঙালির মুক্তির আকাক্ষার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে যে মেতে উঠেছিলাে ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বরতায়। মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরােধী অপরাধের দায়ে ট্রাইব্যুনাল তাকে আমৃত্যু কারাভােগের আদেশ প্রদান করেন। পরিচিতি ৭১’র এই চিহ্নিত ঘাতকের জন্ম ১৯৩০ সালের ১ নভেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি থানার পাদুয়া গ্রামে। ১৯৫০-৫১ সালে তার পরিবার তকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের জয়পুরহাটে এসে বসবাস শুরু করে। ১৯৫৮ সালে সে মুসলিম লীগে যােগ দেয় এবং ১৯৬২ সালে সে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হয়। একাত্তরে সে কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ছিলাে। মুক্তিযুদ্ধকালে সে জয়পুরহাটের বিশিষ্ট পাট ব্যবসায়ী শাওনলাল বাজলার গদিঘর দখল করে সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প, শান্তি কমিটির কার্যালয়, রাজাকারদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর আফজালের জন্য থাকার ব্যবস্থা করে। আলীম ১৯৭৯ সালে বিএনপিতে যােগ দেয় এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকারের মন্ত্রী ছিলাে আলীম।

আলীমকে ২০১১ সালের ২৭ মার্চ মানবতাবিরােধী অপরাধের মামলায় জয়পুরহাট শহরের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ৩১ মার্চ শারীরিক অবস্থার কারণে তাকে জামিন দেন ট্রাইব্যুনাল-১। ২০১২ সালের ২৭ মার্চ তার বিরুদ্ধে মামলাটি ট্রাইবুনাল-১ আমলে নেন। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২এ স্থানান্তর করা হয়। ওই বছরের ১১ জুন ট্রাইব্যুনাল-২ আলীমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরােধী অপরাধের ১৭টি অভিযােগ গঠন করেন। এর মধ্যে গণহত্যার অভিযােগ তিনটি। এগুলাে হলাে জয়পুরহাটের। কড়ই কাদিপুর গ্রামে ৩৭০ জন হিন্দুকে হত্যা, উত্তর হাটশহরে নয়জনকে এবং জয়পুরহাট চিনিকলে বিচার বসিয়ে ২৫ জনকে হত্যা। আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে এই মামলায় ২০১২ সালের ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষের ৩৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় ২২ আগস্ট, ২০১৩। আসামিপক্ষের তিন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয় ২৭ আগস্ট এবং শেষ হয় ৩ সেপ্টেম্বর। রাষ্ট্রপক্ষ ৪ সেপ্টেম্বর থেকে চার কার্যদিবস এবং আসামিপক্ষ ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে পাঁচ কার্যদিবস যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করে। যুক্তিতে রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে আবদুল আলীম ছিলাে জয়পুরহাটে অপরাধের কম্পাস। তার নির্দেশে ও পরামর্শে সেখানে বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরােধী অপরাধ সংঘটিত হয়।
ট্রাইব্যুনালের রায়
২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর মানবতাবিরােধী অপরাধের দায়ে ট্রাইব্যুনাল আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ প্রদান করেন। ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে, আবদুল আলীম জয়পুরহাটের একজন অভিজাত ও উচ্চশিক্ষিত মানুষ। স্বাভাবিকভাবে মানবসভ্যতা ও মানবমর্যাদা সম্পর্কে সে ওয়াকিবহাল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালে স্থানীয়ভাবে সে অপরাধের দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছে। শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীকে সর্বোচ্চ সহযােগিতা করেছে। রক্ষা পায়নি মানসিক রােগী, ৯০ বছরের বৃদ্ধও।’ তবে ৮৩ বছর বয়সী আলীমের জন্য অনুকম্পা নিয়ে এসেছে অসুস্থতা ও বার্ধক্য। ট্রাইব্যুনাল বলেন, অপরাধীর সাজা এমন হওয়া উচিত, যাতে অপরাধের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ শিকার ব্যক্তিরা ন্যায়বিচার পান। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত নৃশংস অপরাধ ও ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্নের বিচারহীনতা থেকে জাতি মুক্তি পায় । অপরাধের গুরুত্ব, অংশগ্রহণের ধরন এবং মাত্রা এ তিন বিবেচনায় আলীমের প্রাপ্য সাজা মৃত্যুদণ্ড। আলীমের মতাে উচ্চপদস্থ ও শিক্ষিত অপরাধীকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া উচিত। রাষ্ট্রপক্ষের এ বক্তব্যের সঙ্গে আমরা দ্বিমত করি না।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘কোন অপরাধে কী সাজা দিতে হবে আইন বা বিধির কোথাও তা সুনির্দিষ্ট বলা নেই। ৮৩ বছর বয়সী আলীম শারীরিকভাবে দুর্বল। সে অন্যের সাহায্য ছাড়া। চলাফেরা করতে পারেন না এবং বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছে। মানসিক বা শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিকে ফাসিতে ঝােলানাে হয় না। আলীম হিসাব কষে শত শত মানুষকে মৃত্যুর মুখে দাঁড় করিয়েছেন, বর্বরতম পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলে।
কিন্তু আইনের অক্ষর তার বর্তমান শারীরিক অবস্থা উপেক্ষা করে নির্দয় হতে পারে । এ জন্য মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যােগ্য অপরাধ করার পরও তার সাজা লাঘব করা হলাে।’ তবে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘আলীমকে দেওয়া লাঘবকৃত সাজা কোনােভাবেই তার কৃত অপরাধের গুরুত্বকে কমিয়ে দেবে না। সাজা লাঘব করা হয়েছে, অপরাধ নয়।’ চূড়ান্ত আদেশে ট্রাইব্যুনাল, প্রথম অভিযােগে দেশান্তরে বাধ্য করার দায়ে আবদুল আলীমকে ১০ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ প্রদান করেন। ৬, ৭, ৯ ও ১২ নম্বর অভিযােগে হত্যার উদ্যোগ ও সহযােগিতার দায়ে তাকে ২০ বছরের কারাদণ্ড এবং ২, ৮, ১০ ও ১৪ নম্বর অভিযােগে গণহত্যা ও মানবতাবিরােধী অপরাধ হিসেবে। হত্যার দায়ে জীবনের বাকি সময় তাকে কারাদণ্ডের আদেশ প্রদান করেন। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত আলীমকে কারাগারে থাকতে হবে । আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজা দেওয়ায় এর সঙ্গে ২০ বছর ও ১০ বছর কারাদণ্ডের সাজা একীভূত হয়ে যাবে।
অভিযােগ ও রায়ের পর্যবেক্ষণ
১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা জয়পুরহাট সদর থানার কড়াই। কাদিপুর, চকপাড়া, সােনারপাড়া, পালপাড়া, মুন্সিপাড়া গ্রামে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লােকজনের বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযােগ করে। পরে। পাকিস্তানি সেনারা হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩৭০ জন নিরস্ত্র ব্যক্তিকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে, যার সঙ্গে আলীম সংশ্লিষ্ট ছিলাে। 
এ অভিযােগের পক্ষে আনা রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করে ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, আলীম ও শান্তিকমিটির অন্য সদস্যরা ওই গণহত্যায় পাকিস্তানি সেনাদের সহযােগিতা করেছিলাে। একাত্তরের মে মাসের শেষ দিকে ক্ষেতলাল উপজেলার হিন্দুপল্লি, উত্তরহাট শহর, হারুনজাহাট ও তৎসংলগ্ন এলাকায় লুটপাট ও অগ্নিসংযােগের পর হিন্দু। সম্প্রদায়ের ১০ ব্যক্তিকে আলীমের নির্দেশে হত্যা করা হয়। এ অভিযােগটিও সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে রাষ্ট্রপক্ষ। ১৯৭১ সালের জুনের শেষ দিকে ২৬ জন নিরস্ত্র মুক্তিযােদ্ধা জয়পুরহাটে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার শিকার হন, যার সঙ্গে আলীম সংশ্লিষ্ট ছিলাে। রায়ে বলা হয়, ওই গণহত্যায় আলীম পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে থেকে শুধু কার্যকরভাবে অংশগ্রহণই করেনি, গণহত্যায় পরামর্শ ও মানসিক সমর্থন দিয়েছে। একাত্তরের অক্টোবরে আলীমের নির্দেশে আহত মুক্তিযােদ্ধা ফজলুল করিমসহ তিনজন নিরস্ত্র মানুষকে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা হত্যা করে। রায়ে বলা হয়, আলীমের উসকানিমূলক বক্তব্যের জের ধরে ওই তিনজন হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। একাত্তরের মে মাসের প্রথম দিকে ক্ষেতলাল উপজেলার কোকতারা গ্রামের নয়জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যায় শান্তিকমিটির সদস্য ও রাজাকারদের নির্দেশ দেয় আবদুল আলীম। একাত্তরের ২৬ মে আলীম পাঁচবিবি উপজেলার নওদা গ্রামের চারজন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার জন্য পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও স্থানীয় শান্তিকমিটির সদস্যদের উসকানি দেয়। একাত্তরের ১৪ জুন ১৫ নিরস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাকে হত্যা ও ২৬ জুলাই জয়পুরহাটের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আবুল কাসেমকে হত্যায় আলীম জড়িত ছিলাে।

সূত্র : ফিরে-দেখা-৭১-যুদ্ধাপরাধীদের-বিচার-সুজন-হালদার