মুক্তিযুদ্ধে কাঁঠালিয়া উপজেলা (ঝালকাঠি)
কাঁঠালিয়া উপজেলা (ঝালকাঠি) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণ থেকে এদেশের সচেতন জনগোষ্ঠী বুঝতে পারে যে, মুক্তিযুদ্ধ অত্যাসন্ন। কাঁঠালিয়ার জনগণও সে লক্ষ্যে অগ্রসর হতে থাকে। তারা বঙ্গবন্ধু আহূত অসহযোগ আন্দোলন- এ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন আওয়ামী লীগ-এর নেতৃবৃন্দ। তবে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র দল হলেও ন্যাপ- ও কমিউনিস্ট পার্টি-র নেতৃবৃন্দও এতে যোগ দেন। আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনার জন্য একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এর সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে মো. রসুল সিকদার (থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি) এবং মো. তোফাজ্জেল হোসেন রাজা মিয়া (থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক)। কমিটির সদস্য ছিলেন— ফকর উদ্দিন মোল্লা, আব্দুল জব্বার হাজী, চাঁন মিয়া মোল্লা, মোশারফ হোসেন গোলদার, নিজাম উদ্দিন হাওলাদার, মজিবর রহমান বাহাদুর, আজাহার আলী খান, মো. ইসহাক হাওলাদার এবং মো. মহসীন নকীব ২৫শে মার্চ পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট-এর পর ২৬শে মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কাঁঠালিয়ার জনগণও এতে অংশগ্রহণ করে।
প্রশিক্ষিত পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হলে তার জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। তাই ভান্ডারিয়া-কাউখালী- কাঁঠালিয়া আসন (বাকেরগঞ্জ-৯) থেকে নির্বাচিত এমএনএ মো. এনায়েত হোসেন খান, আওয়ামী লীগ নেতা মো. রছুল সিকদার ও মো. তোফাজ্জেল হোসেন রাজা মিয়া (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ)-র নেতৃত্বে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা গৌরীপুর নিবাসী মেজর তাজুল ইসলাম ও আলমগীর কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ছোট-ছোট দল গঠন করে যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যুদ্ধের শেষদিকে ভান্ডারিয়া থানার যুদ্ধকালীন কমান্ডার সুবেদার মো. আব্দুল জলিল আকনকে কাঁঠালিয়া থানার অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হলে তাঁর নেতৃত্বেও মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠানো হয়। এসব প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। কাঁঠালিয়া উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন- মো. এনায়েত হোসেন খান এমএনএ, মো. নূরুল ইসলাম ভান্ডারী এমপিএ (বাকেরগঞ্জ-১৭), মো. রছুল সিকদার, মো. তোফাজ্জেল হোসেন রাজা মিয়া, মো. ফারুক সিকদার (যুদ্ধকালীন কমান্ডার), মো. আব্দুল জলিল আকন (যুদ্ধকালীন কমান্ডার), নূরুল হক জমাদ্দার ওরফে চাঁন মিয়া (যুদ্ধকালীন থানা কমান্ডার), সামছুল হক মৃধা (যুদ্ধকালীন থানা কমান্ডার), ফকর উদ্দিন মোল্লা, আব্দুল জব্বার হাজী, চাঁন মিয়া মোল্লা, মোশারফ হোসেন গোলদার, নিজাম উদ্দিন হাওলাদার, মজিবর রহমান বাহাদুর, আজাহার আলী খান, মো. ইসহাক হাওলাদার, মো. মহসীন নকীব প্রমুখ।
প্রথমদিকে থানা প্রশাসন মুক্তিযুদ্ধের তেমন বিরোধিতা করেনি। কিন্তু পরবর্তীতে তারা এর চরম বিরোধিতা শুরু করে। থানার পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা স্বাধীনতাকামী মানুষদের ওপর অত্যাচার শুরু করে। পাকবাহিনী বরিশাল থেকে গানবোটে এসে অভিযান চালায়। ২৫শে মে তারা আমুয়া বন্দর ও বাঁশবুনিয়া এলাকায় ব্যাপক গণহত্যা চালায়। ১৪ই আগস্ট নলছিটি থানার মো. সেকান্দার হাওলাদারের নেতৃত্বে ১২-১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারের ছদ্মবেশে এসে কাঁঠালিয়া থানা আক্রমণ করে থানার সকল
অস্ত্র হস্তগত করেন। এ ঘটনার পর ২২শে সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী কাঁঠালিয়ায় স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। মুক্তিযোদ্ধারা বাধ্য হয়ে থানা সদর বা তার কাছাকাছি এলাকা ছেড়ে কৈখালী, বানাই ও সাতানিতে ক্যাম্প স্থাপন করে যুদ্ধ চালাতে থাকেন।
কাঁঠালিয়া উপজেলায় মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামী খুবই শক্তিশালী ছিল। এসব দলের উদ্যোগে শান্তি কমিটি , আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল কাঁঠালিয়া সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ মল্লিক। এছাড়া উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ছিল মো. নূরুল ইসলাম সিকদার (সাবেক এমএলএ), মো. ছত্তার সিকদার, মো. তৈয়বুর রহমান আকন প্রমুখ।
আব্দুল আজিজ মল্লিকের নেতৃত্বে কাঁঠালিয়ার বিভিন্ন ইউনিয়নেও শান্তি কমিটি গঠিত হয়। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা এসব কমিটির সভাপতি হয়। আলবদর বাহিনী গঠিত হয় মো. শাহজাহান রাজ্জাকের নেতৃত্বে। তারই নেতৃত্বে বিভিন্ন ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে আলবদর বাহিনীর স্থানীয় কমিটি গঠন করা হয়। এ বাহিনীর সদস্যরা এলাকার হিন্দু ও আওয়ামী লীগ নে তা – ক মী দের পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিত। আলশামস বাহিনী গঠিত হলেও এ বাহিনীর তেমন তৎপরতা ছিল না। রাজাকার বাহিনীর প্রধান ছিল মো. আবু পঞ্চায়েত। তার নেতৃত্বে কাঁঠালিয়ার সকল ইউনিয়নে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। ইউনিয়নওয়ারি শীর্ষ রাজাকাররা হলো- ১নং চেঁচরী রামপুর ইউনিয়ন: আ. রহিম হাওলাদার (উত্তর চেঁচরী), আ. সত্তার তালুকদার (বানাই), মো. সুলতান খান (মহিষকান্দি); ২নং পাটিখালঘাটা ইউনিয়ন: আ. রশিদ মুন্সি (নেয়ামতপুরা), মতি মিয়া জমাদ্দার (পাটিখালঘাটা), আ. রাজ্জাক মাস্টার (মরিচবুনিয়া); ৩নং আমুয়া ইউনিয়ন: মো. নূরুল ইসলাম সিকদার (আমুয়া), আলী হোসেন ডাক্তার (আমুয়া), মো. মতি হুজুর (আমুয়া), তোতা মীরবহর (বাঁশবুনিয়া), আ. রশিদ হাওলাদার (ছোনাউটা); ৪নং কাঁঠালিয়া ইউনিয়ন: আব্দুল আজিজ মল্লিক (দক্ষিণ আউরা), আ. ছত্তার সিকদার (কাঁঠালিয়া), আলতাফ হোসেন মানিক মিয়া (দক্ষিণ আউরা), হযরত আলী জমাদ্দার (দক্ষিণ আউরা), মো. তৈয়বুর রহমান আকন (উত্তর আউরা); ৫নং শৌলজালিয়া ইউনিয়ন: আ. রশিদ হাওলাদার ওরফে মাস্টার (কচুয়া), মোকতার আলী হাওলাদার (উত্তর তালগাছিয়া), পেয়ার হালদার (শৌলজালিয়া); ৬নং আওরাবুনিয়া ইউনিয়ন: আ. মজিদ হাওলাদার (আওরাবুনিয়া), নূরুল হক তালুকদার (উত্তর চড়াইল) এবং মো. ইসমাইল কাজী (ছিটকী)।
পাকবাহিনীর সহযোগিতায় তাদের স্থানীয় দোসররা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নারীনির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চলায়। বিশেষ করে, তারা হিন্দুদের বাড়ি, দোকানপাট ও বাজার এবং আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর লুট করে। পাকবাহিনী একাধিকবার বরিশাল থেকে গানবোটে এসে হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতন চালায়। তারা এ উপজেলায় দুটি গণহত্যা চালায় -আমুয়া-বাঁশবুনিয়া গণহত্যা – ও আওরাবুনিয়া গণহত্যা। ২৫শে মে হিন্দু অধ্যুষিত আমুয়া-বাঁশবুনিয়ায় ৪২ জনকে হত্যা করে এবং বহু ঘরবাড়িতে আগুন দেয়। আওরাবুনিয়া কাঁঠালিয়ার সবচেয়ে বড় হিন্দুপ্রধান এলাকা। ২৯শে জুন পাকবাহিনী এখানে ব্যাপক হত্যা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালায়। এতে তিনশতাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হানাদাররা এখানে ২৯ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে।
তৎকালীন সিও অফিসের অডিটোরিয়ামের দোতলার একটি কক্ষ পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখানে হিন্দু, মুক্তিযোদ্ধা এবং আওয়ামী লীগের নেতা- কর্মীসহ স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। এ ব্যাপারে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা পাকসেনাদের সহযোগিতা করত। কাঁঠালিয়া টি টি ডি সি হলের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় নির্যাতিতদের কান্না ও আর্তনাদ শোনা যেত। এখান থেকে অনেককে মহকুমা সদর পিরোজপুরে পাঠিয়ে দেয়া হতো।
কাঁঠালিয়া উপজেলায় দুটি বধ্যভূমি আছে – বাঁশবুনিয়া দাসের বাড়ি ব্রিজ বধ্যভূমি ও আওরাবুনিয়া মডেল হাইস্কুল বধ্যভূমি। বাঁশবুনিয়া বধ্যভূমির আশপাশে তিনটি গণকবর ছিল, কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে সেগুলো এলাকার মানুষের দখলে চলে গেছে। আওরাবুনিয়া গণকবরের আশপাশেও তিনটি গণকবর ছিল, যা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। একটি এখনো টিকে আছে, সংরক্ষণ না করলে সেটিও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার অশঙ্কা রয়েছে।
কাঁঠালিয়া উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি যুদ্ধ হয় – কৈখালীর যুদ্ধ ও দক্ষিণ চেঁচরীঘাট কুড়ার মোড় যুদ্ধ। কৈখালীর যুদ্ধ সংঘটিত হয় অক্টোবর মাসে কমান্ডার আব্দুল জলিল আকনের নেতৃত্বে। এ-যুদ্ধে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং একজন পাকসেনা আহত হয়। ক্ষিপ্ত পাকসেনারা পরের দিন চাঁদেরহাট বাজারে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে বাজারের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দক্ষিণ চেঁচরীঘাট কুড়ার মোড় যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১২ই নভেম্বর। এর নেতৃত্বেও ছিলেন আব্দুল জলিল আকন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় কমান্ডার আব্দুর রহমান লস্কর। এটি ছিল একটি গেরিলা যুদ্ধ। ঘটনাস্থল থেকে ৬ কিমি দূরে পাকবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা দুপুর ২টা-৩টার দিকে তিনদিক থেকে অতর্কিতে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করেন। এতে ভীত-সন্ত্রস্ত পাকবাহিনী গুলি করতে-করতে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। তাদের গুলিতে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে তিনজন হলেন – আনোয়ার হোসেন, কেশব চন্দ্র বল এবং উপেন্দ্র নাথ হাওলাদার। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল ১৫-২০ জন এবং পাকসেনাদের সংখ্যা ছিল ২০-২৫ জন। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ছিল এসএলআর, গ্রেনেড, রাইফেল ও বন্দুক। আর পাকবাহিনীর অস্ত্র ছিল এলএমজি, এসএলআর, গ্রেনেড ও রাইফেল। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুল করিম মাস্টার, আব্দুল মান্নান মিয়া, মো. হামিদুল হক খান, সরদার রুহুল আমীন, নূরুল ইসলাম, মো. মোশারেফ হোসেন, আব্দুল করিম হাওলাদার, মান্নান হাওলাদার, মান্নান লস্কর, আনোয়ার হোসেন, কেশব চন্দ্র বল, উপেন্দ্র নাথ হাওলাদার প্রমুখ। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে না পেরে অবশেষে পাকবাহিনী ৬ই ডিসেম্বর ভোররাতে গানবোটে করে পালিয়ে যায়। ফলে এদিনই উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
কাঁঠালিয়া উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. তোফাজ্জেল হোসেন রাজা মিয়া (পিতা হৈজন মীরবহর, আমুয়া), মো. আলাউদ্দিন (পিতা মো. হেমায়েত উদ্দিন, লেবুবুনিয়া), কেশব চন্দ্র বল (পিতা মধুসূধন বল, আওরাবুনিয়া), উপেন্দ্র নাথ হাওলাদার (পিতা জগবন্ধু হাওলাদার, উত্তর আউরা) এবং আব্দুল হাকিম (পিতা মো. হোসেন আলী, আওরাবুনিয়া)। এছাড়া ১২ই নভেম্বর দক্ষিণ চেঁচরীঘাট কুড়ারমোড় যুদ্ধে ভান্ডারিয়া উপজেলার আনোয়ার হোসেন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে আমুয়া ইউনিয়নের বাঁশবুনিয়া গ্রামের দাসের বাড়ি ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় ঝালকাঠি জেলা পরিষদের অর্থায়নে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া আমুয়া ইউনিয়নে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. তোফাজ্জেল হোসেন রাজা মিয়ার নামে ১৯৮০ সালে শহীদ রাজা ডিগ্রী কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। [এম এম তারিকুজ্জামান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড